বেমানান,অন্তিম পর্ব
পর্ব – ১২ তুই আজ আমায় ফের সামলে নিস…
শনিবার দুপুর একটা কুড়ি!
ঈশানি দাঁড়িয়ে রয়েছে শেষ দশ মিনিট থেকে বাইপাস ধাবার বাইরে…..
গত চারদিনে কমপক্ষে কুড়ি বার চেক করেছে ঈশানি স্নিগ্ধর নম্বরটা আনব্লক আছে কিনা! তবুও একটাও ফোন আসেনি স্নিগ্ধর! একবার স্নিগ্ধ কে ফোন করবে? না না! তার চেয়ে ভালো Dr ব্যানার্জি কেই একবার ফোন করে বলা যাক যে ঈশানি পৌঁছে গিয়েছে……
ঈশানি ডায়াল নম্বরের লিস্ট থেকে ডায়াল করে ফেলে Dr ব্যানার্জি কে…..
“হ্যালো ম্যাডাম! আমি বাইপাস ধাবার বাইরে…”
“ওঃ! তুই পৌঁছে গিয়েছিস, স্নিগ্ধও তো অনেকক্ষণ বেরিয়েছে…….তোকে ফোন করেনি……”
“না….”
“দাঁড়া দেখছি…এই ছেলেটা…..কে নিয়ে আর পারিনা…..”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঈশানির ফোনটা বেজে উঠলো, এবারে আর Dr ব্যানার্জির ফোন না, স্নিগ্ধর ফোন…..প্রায় চার মাস পর স্নিগ্ধর নামটা ঈশানি দেখলো ফোনের স্ক্রিনে….
ফোনটা রিসিভ করে খুব ভয় ভয় গলায় বললো
“হ্যালো…”
“ভেতরে ওয়েট করছি, গেট থেকে ঢুকে ডান দিকে, প্রথম রো, পাঁচ নম্বর টেবিলে….”
ঈশানি ফোনটা কেটে দেয়, তারপর বেশ তাড়াতাড়ি করে গেট খুলে ঢুকতেই দেখে স্নিগ্ধ কে!
এবারে হাঁটার গতি কমিয়ে আসতে আসতে স্নিগ্ধর মুখোমুখি গিয়ে বসে……
স্নিগ্ধর পরণে, ডেনিম জিন্স, একটা সাদা শার্ট , ট্রিমড দাড়ি, ঠিক যেমনটা ঈশানি দেখেছিলো হাওড়া তে প্রথম দিন…..
ঈশানি কিছু বলেনা, মাথা নীচু করে বসে থাকে স্নিগ্ধর সামনে…..
“ঈশানি! আমারও একটা ফোন আছে, তাতে একটা সিমও আছে, এবং সেই সিমটা কাজও করে….”
ঈশানি কিছু বুঝতে পারেনা….হাঁ করে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধর দিকে, তারপর বলে
“মানে?”
“মানে সব কিছুতে মা কে ফোন করার খুব দরকার আছে কি! কারা দেখা করতে এসেছে …….আমি আর তুই……
তুই কার অপেক্ষা করছিলিস?
আমার!
তাহলে তোর কাকে ফোন করা উচিত ছিল?”
“আমি আসলে ভয় পেয়েছিলাম তোমাকে ফোন করতে….”
“কেন? বদমেজাজি ছেলে আমি? শর্ট টেম্পার্ড?”
“না….” খুব নীচু গলায় বলে ঈশানি…..
“তাহলে?”
“আমি ভুল করেছি স্নিগ্ধ স্যার…তাই….”
“ফর গড সেক…….প্লিজ আর স্যার বলিসনা…..প্লিজ! এতো বড় একটা মিসআন্ডারস্টান্ডিং তৈরী হয়েছে জাস্ট বিকজ অফ ইওর স্যার ডাক…….সো! প্লিজ! কল মি স্নিগ্ধ!”
ঈশানি কিছু বলেনা….আবার চেয়ে থাকে স্নিগ্ধর দিকে….স্নিগ্ধ একটু উঠে, পকেট থেকে ফোনটা বের করে হোয়াটস্যাপে কাউকে একটা মিস কল করে…..মিনিট দুয়েকের মধ্যেই স্নিগ্ধর ফোনটা আবার বেজে ওঠে…….
“হমম হ্যালো …..এইতো সামনে…..হমম ……না রে বাবা আমি কিছু বলিনি তুই যা বলার বল…..হমম দিচ্ছি….ধর…..”
স্নিগ্ধ ফোনটা ঈশানি কে ধরতে ইশারা করে….
“কি হলো! কথা বল….”
ঈশানি বুঝতে পারেনা ফোনের ওপারের মানুষটা কে, তবুও স্নিগ্ধর কোথায় ফোনটা কানে লাগিয়ে নেয়……
“হ্যালো…..”
“হ্যালো ঈশানি…..আমি স্নিগ্ধর দিদিভাই বলছি…..সেদিন কার ঘটনার জন্যে আমি সত্যি দুঃখিত গো……”
“কোন ঘটনা?”
“টুসির বিয়ের দিন দুপুরে যখন তুমি ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলে আমি লাইনটা কেটে দি……আসলে সেদিন এমনি কল সেন্টার থেকে এতবার ফোন আসছিলো….তার ওপর তুমি বলছিলে স্নিগ্ধ স্যার…লোন…তোমার নামটাও আমি শুনতে পাইনি জানো……স্নিগ্ধ আবার চট করে কারুর মুখের ওপর না বলে লাইন কাটতে পারেনা! তাই জন্যে আমি বলেছিলাম স্নিগ্ধ এই ধরণের ফোন এন্টারটেন করে…….
একবার যদি সেদিন ঈশানি নামটা শুনতে পেতাম……দেখো যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে…..বুঝে হোক….না বুঝে হোক…আমি একটা ভুল করে ফেলেছি……তুমি আমায় ক্ষমা..”
“না! দিদিভাই! প্লিজ তুমি এভাবে বলোনা….আমি সেই ঘটনার জন্যে কিচ্ছু মনে করিনি….”
“সে! তুমি কিচ্ছু মনে করো না করো, আমি ভাবলাম তোমাকে আজই এই কথাটা জানিয়ে দি, আমাদের মধ্যে একটা নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে চলেছে ঈশানি, সেই সম্পর্কটা শুরু হওয়ার আগেই তোমার মনে আমার জন্যে একটা খারাপ লাগা তৈরী হোক সেটা আমি চাইনা….একদম!”
ঈশানির সব হিসেব গুলো গুলিয়ে যায়……
কোন সম্পর্কের কথা বলছিলো স্নিগ্ধর দিদিভাই? বিয়ে……
“হ্যালো ঈশানি…”
“হ্যাঁ দিদিভাই…..এসব ছাড়ো তুমি…আমি কিচ্ছুটি মনে করেনি…….তোমরা সবাই ভালো?”
“হমম আমরা সব্বাই খুব ভালো এখানে…..আচ্ছা তোমরা এবার নিজেদের মধ্যে কথা বলো কেমন……আর প্লিজ বিয়ের আগেই এই স্নিগ্ধ স্যার বলার অভ্যেস টা ত্যাগ করো….চলো আমি রাখি…..ভালো থেকো!”
“হ্যাঁ দিদিভাই….তুমিও ভালো থেকো!”
ফোনটা রেখে ঈশানি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধর দিকে…….এবার তো স্পষ্ট শুনলো ঈশানি দিদিভাই বিয়ের কথাটা বললো…..
“কি ? কি ভাবছিস? ”
“না! কিছু না!”
এতক্ষণে ওয়েটার এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে…..
ওয়েটার কে দেখেই স্নিগ্ধ মেনুকার্ড টা ঘুরিয়ে দিলো ঈশানির দিকে…..
“বল! কি খাবি…..?”
“কে আমি?”
“হ্যাঁ…মানে আমিও খাবো…..”
“আমি বলবো আমরা কি খাবো? তুমি বলোনা….”
“ওহ্হো! ঈশানি……আচ্ছা দাদা দুটো চিকেন…”
“না ! চিকেন না…..আজ শনিবার তো!”
স্নিগ্ধ একটা অদ্ভুত মুখ করে তাকায় ঈশানির দিকে…..তারপর মেনু থেকে বেছে বেছে ভেজ খাবারের নাম গুলো পড়তে থাকে এক এক করে,, দশমিনিট পর কোনোরকমে ডিশ ডিসাইড করে দুটো একই খাবার অর্ডার করে দুজনের জন্যে…..
“এখনো প্রতি শনিবার নিরামিষ খাস?”
“হমম…..”
“হয়ে গেলো আমার! আজ শনিবার, কাল অষ্টমী, পরশু মা শীতলা…..এখন সারাজীবন বসে বসে ঘাস পাতা খাও…..” ফিসফিস করে বললো স্নিগ্ধ……
“হ্যাঁ! কিছু বললে…..?”
“না….কিছুনা…বললাম ভেজ খেতে আমার খুব ভালো লাগে…..”
স্নিগ্ধর বলার ধরণটা দেখে ঈশানির ঠোঁঠে হাসির রেখা ফুটে উঠলো…..
“একদম হাসবি না তুই! একদম না!
আমাকে কত কষ্ট দিয়েছিস জানিস?….সেগুলো না শুনে একদম হাসবিনা…..!”
স্নিগ্ধর কথাটা শেষ হতেনা হতেই ঈশানির মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো নিমেষে……
“কি হলো? মাথা নীচু করে বসে গেলি যে!”
“না মানে …..ভুল হয়েছে আমার….সরি….”
“শুনতে পেলাম না কি?”
“সরি…..”
“এখনও শুনতে পেলাম না! কি?”
ঈশানি এবারে বেশ জোর গলায় বললো
“সরি…..”
ঈশানি আর কিছু বললোনা, মাথা নীচু করে বসে রইলো আবার….
স্নিগ্ধ খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ঈশানির দিকে….
তারপর বললো –
“বিশ্বাস কর, ঈশানি! এতো অপমান করলি তারপরও আমি তোকে কিচ্ছু বলিনি…..তাই বলে সোজা ট্রান্সফার Apply করে দিবি?
এন্ড কি বলেছিলিস…..মুক্তি চাই….তাহলে এলি কেন আজকে? মা বলেছে বলে…..? নাকি তুই দয়া দেখিয়ে দেখা করতে এসেছিস…… ঈশানি মাথা নীচু করে প্লিজ বসে না থেকে..”
“কোনোটাই নয় ! ”
“তাহলে এলি কেন?”
“কারণ, কাকিমা এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে, তাই আমি ভাবলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস….”
“ওওওঃ! আচ্ছা আচ্ছা……মা কে দেখে তোর মনে হলো সিরিয়াস ,,,আমাকে দেখে কি মনে হতো? মনে হতো আমি সিরিয়াস নই? তাইতো?”
“নাঃ সেরকম কিছু নয়!”
“তাহলে কিরকম?”
“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“কি জিজ্ঞেস করতে চাস? সেদিন রাতে কি হয়েছিল?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো স্নিগ্ধ!
“না না!”
“তবে?”
“দিদিভাই বললো বিয়ের ব্যাপারটা….মানে বললো আমাদের বিয়ের আগে তোমাকে স্নিগ্ধ স্যার বলার অভ্যেস টা চেঞ্জ করতে…..”
“হমম……তো? তাতে কি হলো? স্যার বলে ডাকতে চাস সারাজীবন?”
“না না……সেটা নয়, আমি বলছিলাম বিয়ের কথা বললো, তুমি বিয়ে করতে চাও আমাকে বা, পারবে বিয়ে করতে?” কথাটা বলতে বলতে ঈশানির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো….
স্নিগ্ধ এবারে খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলো ঈশানি কে –
“হ্যাঁ বিয়ে করতে চাই, সারাটা জীবন তোর সাথে থাকতে চাই, কেন তুই চাস না? ……. ঈশানি …..কি হলো….কাঁদছিস কেন …..? আমার দিকে দেখ…….ওই ঈশানি…..”
ঈশানি কোনোরকমে চোখ ও মুখটা রুমালে মুছে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো –
“থাকতে চাই…..আমিও….সারাজীবন…তোমার ….সাথে!”
স্নিগ্ধর ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো…….জলের গ্লাসটা ঈশানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো – “জল খা একটু…….
গুড গার্ল…..এখন ঠিক আছিস?”
ঈশানি আবার প্রশ্ন করলো খুব আসতে আসতে –
“ভালোবাসো আমাকে?”
স্নিগ্ধ চোখে চোখ রাখলো ঈশানির দিকে! তারপর ভীষণ একটা ছোট্ট উত্তর দিলো
“হমম….”
“বলোনি তো আগে?”
“তুইও তো বলিসনি, বলেছিস বুঝি?”
“আমি ভাবতাম ব্যাপারটা ওয়ান সাইডেড, শুধু আমার দিক থেকে……”
বলেই ঈশানি মাথাটা আবার নীচু করে নেয়, কান দুটো লাল হয়ে আসে ঈশানির……
স্নিগ্ধ একটু চুপ করে বসে থাকে ঈশানির মুখের দিকে চেয়ে, তারপর বলে –
“তোর এই ধারণাটা হলো কি ভাবে? ওয়ান সাইডেড? সারাটা দিন, প্রায় একটা বছর রোজ সকাল বিকেল তোর সাথে সময় কাটিয়েছি, কখনো হাঁটতে গিয়ে, কখনো ব্যাংকে, কখনো তোর সাথে বাজার করতে গিয়ে, প্রতি সপ্তাহে কলকাতা আসা বন্ধ করে দিলাম…কেন বল?
কারণ তোকে ছাড়া ভালো লাগতোনা এখানে, একবার নয়, হাজার বার তোকে ফোন করতাম কারণে, অকারণে, কতবার তোকে বিকেলে ফোন করে বলেছি তোকে মিস করছি…..ওই আমার দিকে দেখ, মিস করছি মানে কি রে? আর তারপর চম্পার জন্মদিনের দিন, একটা আধখাপছা টেক্সট করেছিলাম তো! দেখিস নি ওটা? কি রে বল ওটা দেখিস নি?”
ঈশানি খুব মৃদু গলায় জবাব দিলো –
“ওটা তো সঙ্গে সঙ্গেই ডিলিট করে দিলে ….”
“হ্যাঁ কারণ, ওরকম আধখাপছা মেসেজ করে প্রপোস করতে চাইনি, সেদিন রাতে ঘুম আসছিলোনা, তোর কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো, তাই আবেগে প্রথমে পাঠিয়ে ফেলেছিলাম, পরে ভাবলাম বস! জীবনে প্রথম করা প্রপোস এরকম মেসেজে! তাও আবার আধখাপছা মেসেজ! তাই ডিলিট করে দি…… তবে তুই যে একটু হলেও পড়েছিলিস এটা আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর! ”
“কি ভাবে?”
“কারণ তার পরের দিন তোর হাবভাব পাল্টে গেলো, টিপিক্যাল মেয়েদের মতন সেজেগুজে আসতে শুরু করলি, আমার জন্যে কন্সার্ন টা বেড়ে গেলো, হঠাৎ পায়েশ বানিয়ে চম্পার মায়ের হাত দিয়ে পাঠালি….সেগুলো তো এমনি এমনি না!”
“না পায়েসটা আমি এমনিই….”
“ছেড়ে দে ঈশানি…..আমাকে বোঝাস না! …..তোকে বললাম যে একবার হাসবি না!”
“হাসছি না! তারপর বলো……”
“কি বলবো….আমি? তুই বলবি……
হঠাৎ তোর কি হলো? কেন ফোন, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ সব কিছু বন্ধ করে দিলি? ব্যাস দুদিন ফোন পেলিনা আর দিদিভাই কি বললো …..তাতেই তোর মনে হলো সব শেষ? আমাদের সম্পর্কের ভীত এতটা নড়বড়ে ছিল ঈশানি? এতটা যে দুদিন ফোন এলোনা আর তোর মনে হলো আমি তোকে ভুলে গেলাম! কি ভাবে মনে হলো এটা তোর?”
“আমি বুঝতে পারিনি স্নিগ্ধ!”
“আরে একটা ছেলে একটা মেয়ে কে দশ ফুট দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেও মেয়েটা বুঝতে পারে, আর আমি রোজ তোকে দেখেছি তোর পাশে বসে, রোজ তোকে দেখেছি কখনো লুকিয়ে, কখনো সামনা সামনি, কখনো কাকভোরে, কখনো পড়ন্ত বিকেলের আলোয়, আবার কখনো রাতের চাঁদের আলোয়, আর তুই বলছিস বুঝতে পারিসনি……কি বুঝতে পারিসনি?
(দাদা! আপনি সব খাবার গুলো এখানেই রাখুন! আমরা সব নিজেরা গুছিয়ে নেবো আর কিছু লাগলে আপনাকে জানাচ্ছি…… )
…..সব সময় ক্লাইম্যাক্সের সময় কেউনা কেউ ঠিক চলে আসবে……. হ্যাঁ তো কোথায় ছিলাম আমি!”
“আমি কেন বুঝতে পারিনি সেখানে ছিলে…..”
“রাইট……হমম…..তো এতো কিছুর পরও তুই বুঝতে পারিসনি……তারপর বাড়ির বিয়ে ফেলে, মিদনাপুরের ঘরের চাবি কলকাতায় ফেলে শুধু তুই ফোন তুলছিলিসনা বলে, বিয়েবাড়ির ড্রেসেই আমি রওনা হলাম মিদনাপুর….গিয়ে দেখছি গেট খোলা….বাহ্! সুন্দর! ওই তুই কোয়াটারের গেট খুলেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লি….হমম….
আমার জায়গাতে সেদিন যদি অন্য কোনো বাজে ছেলে ঢুকতো ঘরে? সে কিন্তু রাত তিনটে অবধি মাথায় জল পট্টি করে দিতোনা…..!”
“রাত ……..তিনটে?”
“আজ্ঞে ম্যাডাম! কোয়াটারে যখন আমি ঢুকি তখন সাড়ে দশটা……..রাত সাড়ে দশটা……তুই বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে…..গায়ে হাত দিতে বুঝলাম জ্বর….কোনো মতে থার্মোমিটার খুঁজে বের করে দেখলাম 101 জ্বর………তার মধ্যে, আমার বাড়ি থেকে অনর্গল ফোন চলেই আসছে…..ফোনটা সুইচ অফ করে প্রথমে ফোনটা তোর ড্রয়ারে রাখলাম……তারপর ঘরময় খুঁজেও তোর ঘরে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নেই! কি আশ্চর্য……থার্মোমিটার আছে কিন্তু প্যারাসিটামল নেই! আমার ঘরের চাবি আনিনি……অগত্যা মুসল ধারে বৃষ্টির মধ্যে ওষুধ কিনতে বেরোলাম…..একটা দোকানও খোলা নেই, আশেপাশের চত্বরে……স্টেশন পেরিয়ে যখন ওষুধ নিয়ে ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা…..হেঁটে হেঁটে গিয়েছি স্টেশনে…..ফেরার সময় যদিও একটা টুকটুক ম্যানেজ করে কিছু এক্সট্রা দিয়ে ফিরলাম!
ফিরে এসে, বিস্কিট জলে ডুবিয়ে খাওয়ালাম তোকে, তারপর জলে গুলে ওষুধ! তখন যা জ্বর তোর, যদি ওষুধ টা আটকে যেত গলায়! ওষুধ দেওয়ার পর মাথায় জলপট্টি করি তিনটে অবধি ভেজা জামাকাপড়ে……
তারপর এতো ক্লান্ত লাগছিলো, কুর্তা টাও পুরো ভিজে, তারপর শীতকাল! গায়েই পায়জামাটা শুকিয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে……
কুর্তাটা ভেজা বলে খুলে, একটু খাটে হ্যালান দিয়ে বসলাম পা ছড়িয়ে, তারপর চোখ দুটো বুজে এলো, ঘুমের ঘরেই হয়তো তারপর কম্বলটা একটু টেনে ঢাকা দিয়েছিলাম নিজেকে! তারপর সকাল হতেই তোর শকিং রিঅ্যাকশন……
যেন আমি কি ভুল করে ফেলেছি……অপমান করে তাড়িয়ে দিলি, ওয়ালেট, ফোন সব তোর ড্রয়ারেই পরে রইলো….
এতো বাজে ভাবে অপমান করলি আমার আর ওগুলো নিতে আসতেও ইচ্ছে করলোনা……ওয়ালেট ছাড়া…..টাকা ছাড়া……ফোন ছাড়া……পারতিস মিদনাপুর থেকে গড়িয়া আসতে…..আমি এসেছি সেদিন!”
ঈশানি অবাক হয়ে শুনতে থাকে স্নিগ্ধর কথা…..
“কি ভাবে এতটা রাস্তা টাকা ছাড়া…..”
“বাস কন্ডাক্টার হেল্প করে, পরের দিন সকালে ওদের বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে সব ক্লিয়ার করি, বাকিটা পথ হেঁটে গিয়েছিলাম…….
আমি সেদিন ভালো বয়ফ্রেন্ড হতে গিয়ে আমার বাড়ির লোককে খুব কষ্ট দিয়েছিলাম ঈশানি……স্পেশালি মাকে খুব হার্ট করেছিলাম………খুব বকা দিয়েছিলো আমাকে …..তাও বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে! ছোট থেকে বোধহয় অতটা বকা কোনোদিন খায়নি আমি……”
“কাকিমা জানতো?”
“হ্যাঁ, মা জানতো আমি তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছি……তবে ফোনটা বন্ধ করেছিলাম বলে রেগে ছিল!”
“তারপর?”
“খাবার সব ঠান্ডা হয়ে গেলো….খেতে খেতে শোন!
…..তো মা জানতো অনেকদিন, ওই অষ্টমীর দিন তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম…..সেদিনই সবটা বলেছিলাম……
কিন্তু সেদিন আমি সিরিয়াসলি ঠিক করিনি ফোনটা বন্ধ করে……
মা বকা দিয়ে আবার রাতে যখন মানাতে এসেছিলো তখন বারবার জিজ্ঞেস করছিলো কি হয়েছে….আমি ওপর ওপর বলেছিলাম…….
যাক ছাড়! যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে…..পুরোনো জিনিস ঘেঁটে কি লাভ! এখন তুই বল থাকতে চাস তো সারাজীবন আমার সঙ্গে?”
বলেই স্নিগ্ধ নিজের ডান হাত দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে ঈশানির বাঁ হাতটা……
ঈশানির চোখ দিয়ে আবার দুফোটা জল গড়িয়ে পরে…..
“হয়েছে তো! অনেক হয়েছে বাবু! আর কান্নাকাটি নয়, যেটা বলার সেটা বল……”
“এরপরেও বলতে হবে? আমি কখনো ভাবিনি তুমি বিয়ে নিয়ে ভাববে? আমি যে বড্ডো বেমানান স্নিগ্ধ!”
“আর একবার যদি শুনি আমি এই কথাটা তোর মুখে…….আমি সত্যি চলে যাবো….আর কোনোদিনও ফিরবোনা…..
ঈশানি শোন আমার কথাটা……
তোর
প্রব্লেমটা কি জানিস….তোর মনের মধ্যে বেমানান শব্দটা গেঁথে আছে, আর সেটা কিছুতেই আমি তোর মাথা থেকে বের করতে পারছিনা……
কেন বুঝতে পারছিসনা তুই?
দুটো মানুষ যখন দুজন কে ভালোবাসে তখন কিচ্ছু ম্যাটার করেনা ঈশানি…..শুধু ম্যাটার করে দুজনে দুজনের পাশে থাকাটা…..ম্যাটার করে বিশ্বাসটা…..ভরসা টা……এই ভরসা যে আমার ভালোবাসার মানুষটা সব সামলে নেবে……যাই পরিস্থিতি আসুক সে সব সামলে নেবে……এই কনফিডেন্সটা কই….তোর মধ্যে…..হমমম……”
“সরি!….”
“ইটস ওকে! এখন খাবার গুলো খাও….ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”
“হমম….!! ”
কথোপকথন ও খাওয়া দাওয়ার শেষে যখন ওরা রেস্তোরাঁ থেকে বেরোলো মধ্যগগন থেকে সূর্য তখন আসতে আসতে পারি দিচ্ছে পশ্চিম আকাশের দিকে…..
ঝলমলে রোদ্দুর এসে পড়লো ওদের চোখে, ঠোঁটে গালে!
“ঈশানি! শোন না! একটা আবদার করবো রাখবি?”
“কি আবদার!”
“আমার সাথে আমাদের বাড়ি যাবি? প্লিজ আজকে না বলিসনা…..দেখ মা অনেকবার বলছিলো ফাঁকা হাতে প্রপোস না করতে, আমিও একটা জিনিস দেখাতাম তোকে কিন্তু সেটা বাড়িতে……. আজকে প্লিজ না বলিসনা ঈশানি….”
“কিন্তু স্নিগ্ধ! বাড়িতে….আমি…..মানে আমার বাড়িতে বলেছি তাড়াতাড়ি ফিরবো…..”
“বাড়িতে একটু ফোন করে বলনা, একটু দেরি হবে! বেশিক্ষণ তোকে থাকতে বলছিনা, এক দু ঘন্টা…..মা ও আজকে বাড়িতে আছে জানিস! চল না ঈশানি….এখন থেকে কুড়ি মিনিট লাগবে..ম্যাক্সিমাম! প্লিজ!”
“ওকে!”
ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসলো ওরা…..
লুকিং গ্লাসের আয়না দিয়ে স্নিগ্ধ চেয়ে রইলো ঈশানির সরল চোখ দুটোর দিকে……..
“স্নিগ্ধ! আমি না কিচ্ছু গিফট নিতে পারবোনা আজকে! বাড়িতে….ওরম লুকিয়ে….”
“রিলাক্স! আমি বলেছি তোর শাশুড়িমা বলেছিলো গিফটের কথা, কিন্তু আমি আনি নি তো! আমি একটা অন্য জিনিস দেখাবো তোকে! ইন ফ্যাক্ট দুটো জিনিস দেখাবো তোকে….”
ঈশানির ঠোঁটে আবার হাসির রেখা ফুটে উঠলো….
ঈশানি খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের নীল আকাশের দিকে, সারিসারি গাছপালা, উঁচু উঁচু বিল্ডিং পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চললো স্নিগ্ধর বাড়ির পথে…..
পড়ন্ত রোদের বেলায় গাড়ি দাঁড়ালো একটা তিনতলা লাল বাড়ির সামনে, বিশাল এক লাল বাড়ি, প্রতি -তলায় একটা ঝুলবারান্দা……..
দ্বিতীয় ফ্লোরে একটা বেতের দোলনা ঝুলছিলো এক কোণে……
আর একটি কোণে, বেতের টেবিল ও বেতের মোড়া সাজানো!
“ঈশানি! বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? চল ভেতরে চল…..”
“হমম…স্নিগ্ধ আমার একটু টেনশন হচ্ছে!”
“কিসের টেনশন?”
“সবাই কি ভাববে!”
“উউফ! ঈশানি মা নিজেই আমাকে বলেছে তোকে রাজি করিয়ে বাড়ি নিয়ে আসতে…চল চল …..ভেতরে চল…..খুব রোদ লাগছে তোর! আবার ঘাম বসে জ্বর চলে আসবে…..
কি হলো হাসছিস কেন?……..
চল!”
ঈশানি বাড়িতে ঢুকতেই বুঝতে পারে, ছোট থেকে বড়ো, বাড়িতে উপস্থিত সবাই চেনে ঈশানি কে! এমন কি বাড়ির পরিচারিকাও ঈশানির সাথে কথা বললো বেশ কিছুক্ষণ, ঈশানির নিজেকে এতটা বিশেষ কোনোদিনও মনে হয়নি বা কেউ মনে করাইনি কোনোদিনও!
বাড়ির সবাই ঠিক স্নিগ্ধর মতন, এমন ভাবে জিজ্ঞেস করছে – “কিরে! কি খবর! কেমন আছিস!” যেন কত বছর থেকে চেনে ঈশানি কে…….
এরই মধ্যে স্নিগ্ধর খুড়তোতো ও সবচেয়ে ছোট বোন ঝিলমিল বলেই চলেছে স্নিগ্ধর জন্যে
মেয়ে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা……….
চলছিল ওদের হাসি, ঠাট্টা, আড্ডা……..
তখন ঝিলমিল ও স্নিগ্ধ খুনসুটি করেই চলেছে নিজেদের মধ্যে…..স্নিগ্ধর মুখে সেই ছেলে মানুষির হাসি……যেমনটা ঈশানি দেখেছিলো ফাস্ট লোকালে প্রথমদিন স্টোন, পেপার, সিসার খেলার সময়!
হঠাৎই Dr শর্মিলা ব্যানার্জি এসে স্নিগ্ধকে বললেন –
“স্নিগ্ধ …..
বিকেল গড়িয়ে এলো যে ….যা তোর ছাদের ঘরটা একবার দেখিয়ে নিয়ে আয় ঈশানিকে…..আর ঝিলমিল…এদিকে আয়তো….”
“না মাম্মাম আমি ছোড়দা দেড় সাথে ওপরে যাবো…..চলো ঈশানি দি ছোড়দার ইকোফ্রেন্ডলি রুমে নিয়ে যাই তোমাকে…..”
“ঝিলমিল! Assignment টা নিয়ে বসবি বললি যে! ……”
Dr শর্মিলা ব্যানার্জি কিছু একটা ইশারা করলো ঝিলমিল কে, তারপর ঝিলমিল বললো –
“ওঃ! হ্যাঁ তাইতো আমার তো Assignment টা নিয়ে বসতে হতো তোমার সাথে……চলো চলো….
ঈশানি দি…..তুমি ছোড়দার সাথে যাও…..
আমি আসছি…..কিছুক্ষণের মধ্যেই….ওকে! টাটা”
বলে মুচকি হেসে ঝিলমিল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো…..
“কি হলো স্নিগ্ধ! দাঁড়িয়ে রইলি কেন! যা ওকে একটু ঘুরিয়ে আন…..
ঈশানি এই বাড়িতে কারুর ঘর টা দেখ বা না দেখ, কিন্তু স্নিগ্ধর ঘরটা অবশ্যই ঘুরে আয় ……বিশেষ করে এই সময়টা…..সন্ধ্যে নামলেই…. আবার মশা…..”
স্নিদ্ধ ঈশানিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো ছাদের দরজার বাইরে,
ছাদের দরজাটা খুলতেই, একরাশ ঠান্ডা হাওয়া স্নিগ্ধকে স্পর্শ করে ঈশানির গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো…..ঈশানির এলোমেলো চুল অজান্তেই
স্নিগ্ধকে স্পর্শ করে ফেললো…..
ছাদে পা ফেলতেই ঈশানি দেখলো দীর্ঘ নীল আকাশ! পশ্চিম আকাশের সূর্য তখন সিঁদুরে রাঙা! ছাদের পাশেই একটা বড়ো আম গাছ…..
গাছে ছোট্ট ছোট্ট আমের মুকুল!
ছাদ জুড়ে বিভিন্ন রঙের ফুলের গাছ লিলি, জিনিয়া, জবা, গোলাপ, সব ফুলের নাম তো ঈশানি জানেওনা!
ছাদের ঠিক মাঝামাঝি জায়গাতে ফার্মহাউস স্টাইলে বানানো একটা ছোট্টো ঘর! ঠিক যেমন ঈশানি দেখেছিলো রূপকথার বইয়ের কোনো এক পাতায়! ঢালু লাল সিলিং! লাল কালো মেঝে……
ঘরটার বাইরে – উঠোনের মতন একহাত জায়গা ছাড়া, উঠোনের খানিকটা অংশ ঢাকা, লাল সিলিংএ, আবার খানিকটা অংশ খোলা!
উঠোন ভর্তি নাম না জানা বিভিন্ন আকারের পাতার গাছ টবে সাজানো! কোথাও আবার ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের শিশি ব্যবহার হয়েছে টব হিসেবে!
কোথাও বা ঝুলছে টব – সবুজ কচি পাতা নিয়ে সাদা দড়িতে!
“ঈশানি! ঘরে চল! ভেতরে একটা ছোট্ট aquarium ও আছে! বাইরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি!”
ঘরে ঢুকতেই ঈশানি দেখলো ঘরের এক কোণে একটা ছোট্ট বিছানা, বিছানার বাঁ পাশে একটা বড়ো ল্যাম্প! ল্যাম্পের বাঁ পাশে একটা বিশাল জানালা! জানালায় ঝুলছে নানান রঙের উইন্ডবেল! দক্ষিণের হাওয়ায় বারবার উইন্ডবেল গুলো নিজেদের মতন গেয়ে চলেছিল ফিরে পাওয়া ভালোবাসার গানের সুর!
বিছানার ডান দিকে বেডসাইড টেবিলের ওপর একটা গোল বয়ামে রাখা aquarium! ছোট্ট দুটো লাল মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক!
“ঈশানি! কেমন লাগলো? সবটা কিন্তু আমার গোছানো! দেওয়ালের পেন্টিংস গুলো সব আমার আঁকা কিন্তু!”
ঈশানি বিস্মিত চোখে দেখতে থাকলো স্নিগ্ধর আঁকা বিভিন্ন ছবি! অসাধারণ সব স্কেচ দেওয়াল জুড়ে বাঁধানো! পেন্সিল স্কেচ, জল রং, আবার কোনটা অয়েল পেন্টিং!
“ঈশানি! কিরে….. কিছু…… বলছিস না যে! কেমন লাগলো আজকের দিনটা!”
“স্নিগ্ধ! সবটা সত্যি কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! ঠিক যেন একটা রূপকথার গল্প! ঠিক যেমন ছোটতে বইয়ের পাতাতে দেখেছিলাম! সেইরকম! সবমিলিয়ে এটা যেন এক স্বপ্নের ঘর!”
“বুঝ্লাম! শোন না! এবারে একটা বোকা বোকা কথা বলবো তোকে?”
“কি কথা?”
“তুই বলছিলিস না তখন……মানে কমপ্লেন করছিলিস সোজাসোজি কখনো কিছু বলিনি কেন?”
“ধুর! ….সে তো এমনি…..”
“কি এমনি! না মানে আমি একটা স্পিচ রেডি করেছি তো! সেটা শুনতেই হবে তোকে! অনেক কষ্টে দশ লাইন রেডি করেছি…..”
“কিসের স্পিচ?” মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে ঈশানি!
“একদম নেকামি করবিনা! তুই জানিস কিসের স্পিচ!”
মুখ টিপে হাসতে হাসতে ঈশানি বলে –
“বেশ বলো….”
“ওকে!……..বলছি……ওকে……..
ঈশানি আমি……তুই হাসাটা বন্ধ করবি? আর অন্য দিকে দেখ…..এভাবে আমার দিকে… ”
“এটা স্পিচ? এটা তোমার স্পিচ? সিরিয়াসলি মিস্টার ব্যানার্জি…..”
বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করে ঈশানি…..
“………..আমি জানিনা কবে থেকে আর কি ভাবে আমার সাদাকালো জীবনটায় এক নিমেষে রঙ ঢেলে দিলি তুই?
আমি জানিনা কোন রাতে প্রথম স্বপ্ন এসেছিলিস তুই?
আমি জানিনা কবে থেকে আমার ভালোলাগাটা তোর ভালো থাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেলো,
আমি জানিনা ভালোবাসা শব্দ টা কবে থেকে তোর আর আমার হয়ে গেলো!
! জানিস তোকে হাসতে দেখে মাঝরাতে কতদিন বেখেয়ালে গান গেয়েছি আমি! আবার তোর কষ্ট দেখে কতরাত তারা গুনেছি আমি!
ঈশানি আমি তোর সাথে সারাটাজীবন থাকতে চাই! সবরকম পরিস্থিতিতে শুধু তোকে পাশে পেতে চাই! ……
…………,….আমি কথা দিলাম আজ তোকে…. জীবনের সব ওঠানামা তে আমি থাকবো তোর সাথে!…..”
ঈশানি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে ,,, স্নিগ্ধ একটু থেমে খুব নীচু গলায় ফিসফিস করে বললো –
“তুই দেখিস সবটা সামলে নেবো আমি, শুধু কথা দে আর এরকম বোকাবোকা কারণে, আমাকে ছেড়ে যাবিনা! বোকাবোকা কারণ কি, কোনো কারণেই আমাকে ছেড়ে যাবিনা!
যত পোয়েটিক কথা বলতে পারতাম সব বলে ফেলেছি, এবারে দুটো কাজের কথা বলি কেমন? তোকে বলেছিলামনা, তোকে দুটো জিনিস দেখানোর আছে……দাঁড়া এক মিনিট”
….বলেই স্নিগ্ধ একটা কাগজের টুকরো তুলে দিলো ঈশানির হাতে…….তারপর বললো
“এর মধ্যে ইভনিং ক্লাসেস, ডিসট্যান্স লার্নিং এর কিছু কলেজ শর্টলিস্ট করা আছে, যারা মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোভাইড করে, পড়তে চেয়েছিলিস না তুই!
এবারে আবার নতুন করে সবটা শুরু কর!
এবারে কেউ তোকে বলবেনা চার-মাসে চাকরি না পেলে বিয়ে দিয়ে দেব……..
……. কেউ আর তোকে খোঁচা দিয়ে কথা বলবেনা, কেউ আর তোকে বেমানান বলবেনা! শুধু কনফিডেন্স রাখতে হবে, মনে আছে তো! হমম? ”
“হমম মনে আছে! আমি সত্যি আবার পড়াশোনা শুরু করবো স্নিগ্ধ? আমি পারবো তো!”
ঈশানির চোখদুটো কেমন জ্বলজ্বল করে উঠলো স্নিগ্ধর দেওয়া কাগজটা পেয়ে….
“কেন পারবিনা? আমি আছি তো! পাগল মেয়ে একটা!……আর একটা জিনিস দেখানোর ছিল কিন্তু! ”
“কি?”
“তুই বলেছিলিস মনে আছে সাকসেস শব্দটা সবার কাছে আলাদা!”
“হমম মনে আছে তো!”
“হমম বলেছিলিস সাকসেস মানে যদি শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনের হতো , তাহলে এই দেশে আর কেউ ফসল ফলাতো না! কোনো বাঁশিওয়ালা বাঁশিও বাজাতো না! কোনো লিওনার্দো মোনালিসা আঁকতো না! কোনো উদাস বাউল গান শোনাতে আসতো না! ……..হমম তো!
মোনালিসা তো নয় কিন্তু আজ স্নিগ্ধ ব্যানার্জি প্রথম পোট্রেট এঁকে সাকসেস খুঁজে পেলো ……কার পোট্রেট বল?”
“কার?” বিস্মিত দৃষ্টিতে ঈশানি চেয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে!
স্নিগ্ধ কোনো উত্তর দিলোনা শুধু ঘরের এক কোণ থেকে একটা ক্যানভাসে আঁকা ছবি এনে রাখলো খাটের ওপর!
ঈশানি আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা! হাতদুটো দিয়ে মুখটা ঢেকে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো!
“ঈশানি কি হলো? ওইইই ঈশানি! আচ্ছা হলোতো! ওইইই…..কি রে হাতটা সরা মুখ থেকে……এতো বাজে হয়েছে নাকি ……ঈশানি….. ঐই….
আচ্ছা হলোতো! কিরে! …………………..
কি হলো বললিনা তো কেমন হয়েছে, তুই জানিস চম্পার বাড়িতে যখন গান গাইছিলিস তখন লুকিয়ে ছবিটা ফোনে তুলেছিলাম! ভাগ্গ্যিশ ফোনটা হারিয়ে যাওয়ার আগে এটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো….
ঈশানি অনেক হয়েছে ….এবারে চুপ কর ! তুই কিন্তু এবারে আমাকে কাঁদাচ্ছিস ঈশানি……….”
“মিস্টার ব্যানার্জি! সবটা কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার!
আমি একবার জড়িয়ে ধরতে পারি….
আপনাকে……?”
পশ্চিমে আকাশের সূর্যের আলো তখনও মিলিয়ে যাইনি পুরোপুরি আকাশ থেকে, আলো আঁধারের এই মিলনমেলায় স্নিগ্ধ জড়িয়ে ধরে ঈশানি কে! খানিকক্ষণ জড়িয়ে ধরার পর ফিসফিস করে স্নিগ্ধ বলে –
“আমি তো শুধু এইটুকুই চেয়েছিলাম ঈশানি, কেউ আমাকে ভালোবাসুক! শুধু আমাকে! আমার ভালোটাকে, আমার খারাপটাকে!
আমার ব্যাকগ্রউন্ডটা কে নয়! তাইতো লুকিয়ে ছিলাম এই ফ্যামিলির ব্যাপারটা! আমি চেয়েছিলাম কেউ আমার আমি টা কে নিজের করে ভালোবাসুক! তাইতো আমি ছিলাম তোর অন্তহীন অপেক্ষায়…………….
…………………………………..
তুই কিন্তু এখনো বললিনা কেমন হয়েছে পোট্রেট টা”
“খুউউউউব ভালো হয়েছে! ইন ফ্যাক্ট আঁকা ছবিটা আমার থেকেও বেশি সুন্দর হয়েছে!”
“হতেই হবে! তোর অংশুমানের মতন মাকাল ফল নই রে…….”
“ধ্যাৎ! খুউব বাজে হচ্ছে কিন্তু স্নিগ্ধ ……”
“তবে তোর চেয়ে সুন্দর হয়নি……
কারণ তোর চেয়ে বেশি সুন্দর কিছু হতেই পারেনা!”
এভাবেই শুরু হলো ওদের গল্প! এক রূপকথার গল্প! যে গল্পের রাজা নেই, রানী নেই, আছে শুধু দুটো সাধারণ মানুষ আর তাদের শর্তহীন সীমাহীন, অন্তহীন ভালোবাসা!
ওরা জানলোনা ঈশানির ডাইরির দুটো পাতা খুব সাবধানে ছিঁড়ে কৌশানি নিয়ে গিয়েছিলো Dr শর্মিলা ব্যানার্জির চেম্বারে! আর দশটা মানুষের মতন appointment নিয়ে!
খুব সহজ সরল গলায় কৌশানি বলেছিলো
“ম্যাডাম! আপনি আমায় চিনবেন না! আমি কৌশানি দত্ত…..ঈশানি দত্তর বোন!”
যদিও কৌশানি কোনোদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি শুধু ঈশানির নামটা শুনেই Dr ব্যানার্জি এতো কিছু করে ফেলবেন দিন কুড়ির মধ্যে……
সমাপ্ত!