বেমানান,পর্ব – ১ দিভাই কি হয়েছে?
মৌপর্ণা
সকাল থেকে সানাই, উলুধ্বনি, বিয়েবাড়ির শোরগোল ও বাজনার আওয়াজে মাথাটা বেশ ধরে গিয়েছে ঈশানির, অথচ দুটো মিনিট বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই আজকে! মা একা হাতে আর কতোদিক সামলাবে?
বেলা প্রায় দেড়টা! এদিকে ফটোগ্রাফার এর ফটো সেশন শেষ হওয়ার নাম গন্ধ নেই এখনো!
এদিকে বেলা পোহালেই, লগ্ন!
“অরিন্দম……. আর কতক্ষণ? এবার কৌশিকী কে ছাড়ো, মেকআপ আর্টিস্ট কে আড়াইটে তে আসতে বলা হয়েছে, তার আগে কৌশিকী কে স্নান টা…….”
“অরিন্দম দা! আমার না মনে হচ্ছে, দিভাই সত্যি ঠিক বলছে…..”
“আচ্ছা আচ্ছা বেশ! তবে তোমার মেকআপ করার সময় কিন্তু আমার দু-তিনটে শট লাগবে…..একবার আমাকে ফোন করে দিওনা…
ঈশানি দি…তুমি একটু কল করে দিও প্লিজ ”
ঈশানি দত্ত – দত্ত বাড়ির বড়ো মেয়ে – সিঙ্গেল…
বয়েস: ২৫ প্লাস….
উচ্চতা: ৫’৪” …….
ছিপছিপে চেহারা, লম্বা মুখের গঠন, টিকালো নাক, ভাষা দুটো চোখ, মাথা ভর্তি চুল (তবু সে লোকের নজরে বড্ডো বেমানান, রং টা বেশ চাপা কিনা!)
ঈশানি পেশায় ব্যাংকার – তাও নেই নেই করে বছর চারেক হলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে গত আড়াই বছর থেকে নামকরা সেন্ট্রালাইজড ব্যাংকের ক্লার্ক ……শেষ আড়াই বছর থেকেই মিদনাপুরের একটা ছোট্ট গ্রামে পোস্টেড্…এখন দিন দশেকের ছুটি তে কৌশানির বিয়ে উপলক্ষে….
ইন্টেলিজেন্ট, রেস্পন্সিবল….ভারী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে ঈশানি….
স্বভাব চরিত্রের দিক থেকেও নিখাদ ও বৃহৎ মনের মানুষ!
কৌশানি দত্ত – দত্ত বাড়ির ছোট মেয়ে…
বয়েস: ২৪ প্লাস…কলকাতার বেশ নামি দামি হোটেলের রিসেপশনিস্ট…..বেশ স্টাইলিশ এলিগেন্ট লুক! ফর্সা – সুন্দরী……অন্তত বাঙালির ডেফিনেশন তো তাই বোঝাই তাইনা? তাইতো বাংলা ম্যাট্রিমোনিয়াল এ সবসময় দেখতে পাবেন “ফর্সা, সুন্দরী” কখনো দেখেছেন – “কালো সুন্দরী মেয়ে!”
তো এই ফর্সা সুন্দরী মেয়ের জন্যে সম্বন্ধ আসতো নিত্য নতুন দিন! সুন্দরী মেয়ে, আর কতদিনই বা – আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু বলে দেরি করতেন দত্ত কর্তা ও গিন্নি!
যদিও দত্ত কর্তা ও গিন্নির কারোরই ইচ্ছে ছিলোনা ঈশানির আগে কৌশানির বিয়ে দেওয়ার…..কিন্তু পাড়া পড়শী, আত্মীয় স্বজনের কথা টাও তো ফেলে দেবার মতন নয়….সুপাত্র……আগে কৌশানির ই বিয়ে টা হোকনা! এমনিও জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে….তিন বিধাতা নিয়ে!
আর তারপর ঈশানি ও বেশ জোর করলো কৌশানি বিয়েটা দিয়ে দেওয়ার জন্যে! তো
বেশ কিছুদিন পাত্র বাছা-বাছি, একটু ঘোড়া ফেরার পর কৌশানি ও রাজের আজ বিয়ে!
*************************************************
বাসর ঘর টা সাজিয়ে গুছিয়ে ঈশানি যখন কৌশানির ঘরে ঢুকলো, তখন প্রায় আড়াইটে, কৌশানি স্নান সেরে চুল খুলে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরের দিকে চেয়ে…..এক মনে কি যেন ভাবছে সে!
“কি রে পাগলী! ওহহও চুল দিয়ে জল পড়ছে যে!”
বলেই আলনা থেকে তোয়ালে টা বের করে কৌশানির ভিজে চুল মুছিয়ে দিতে শুরু করলো ঈশানি……
“দিভাই…তুই আপসেট?”
জানালার বাইরে দিকে চেয়েই প্রশ্ন করলো কৌশানি….
“আপসেট কেন হতে যাবো রে পাগলী? আমার ছোট্ট বোনটার বিয়ে বলে কথা…..”
“তবে তোর হাসিটা আজ মিথ্যে কেন দিভাই?”
ঈশানির চোখ দুটো জলে ভরে এলো! ভাঙা ভাঙা গলায় বললো তাহলে তোরও মনে হয় -“আমি তোর সাথে হিংসে করি?”
“না দিভাই না! প্লিজ দিভাই এটা বলিসনা…..এসব বলে আমায় প্লিজ কাঁদাসনা….
আমি জানি তুই আমার জন্যে খুব খুশি……
ছোট থেকে নিজের জন্যে কোনোদিনও কিছু চেয়েছিস বাবার কাছে?
শুধু তো আমার জন্যে বায়না করেছিস তুই! আর তুই কিনা আমার সাথে হিংসা করবি! এটা রিমি মাসী কেন ভগবান এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবোনা রে ……..
কিছুতেই না…..” বলেই কৌশানি জড়িয়ে ধরলো তার দিভাই কে!
“অনেক হলো ছাড় এবারে! পার্লার থেকে এখনো এলোনা যে….দাঁড়া একটা ফোন করি! ২:৩৫ ….হয়ে গেলো….খেয়াল আছে তোর?”
“তুই আছিস তো, খেয়াল রাখার জন্যে! তোর কি হয়েছে দিভাই…..বলনা দিভাই…….
এবার ছুটিতে আসার পর থেকেই কেমন একটা মনমরা হয়ে বসে আছিস….সব সময় কাজের অজুহাত দেখিয়ে আমার থেকে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছিস! সেদিন স্নিগ্ধ দার কথা বলতেই রেগে গেলি? কি হয়েছে দিভাই? আমায় বলবিনা?”
“বলবো! পরে বলবো সব! তোর বিয়েটা মিটে যাক….পরে সব বলবো তোকে ….! আমিও আর সবটা চেপে রাখতে পারছিনা রে! কৌশানি….তোর বিশ্বাস হয়….আমি কোনো ভুল করতে পারি….মানে…..ভুল …..অন্যায়….বা ধর…..এমন কোনো কাজ যেটা সমাজের চোখে নোংরা….”
ঈশানির কথাটা শেষ হতেনা হতেই ঘরে ঢুকে এলো রিমি মাসি…..
ঈশানীও মুহূর্তের মধ্যে আলমারি দুটো পাল্লা খুলে দুচোখ চটপট আড়াল করে নিলো রিমি মাসির থেকে….
“কিরে? ঈশানি….তুই আবার কাঁদছিস? আমি কিন্তু দেখতে পেয়েছি……তোকে বললামনা শুভ দিনে এরকম যখন তখন চোখের জল ফেলবিনা…..”
ঈশানি কোনোরকমে চোখের জল মুছে উত্তর দেওয়ার আগেই কৌশানি বললো –
“দিভাই এর …কান্না…হাসি ….বকা …আদর …এই সবগুলোই চিরকাল আমার জন্যে আশীর্বাদ …আর রিমি মাসি…দিভাই গয়নাগাটি গুলো বের করছে….এক্ষুণি আবার পার্লারের মেয়েটা আসবে কিনা! তুমি ওপরে যাওনা…..মা কত করবে বলো একা হাতে!
*************************************************
বেশ কিছুক্ষণ হলো বিয়ে শুরু হয়েছে কৌশানির…..
ঘড়িতে ঠিক আটটা….চারিদিক আলো তে ঝলমল করছে অনুষ্ঠান বাড়ি…..
সানাইয়ের সুর বেজে চলেছে ক্যাসেটে……..
কফি, পকোড়ার একটা মেশানো গন্ধ আসছে ফুড স্টল থেকে! সেই গন্ধতেই শরীরটা যেন আরো খারাপ লাগছিলো ঈশানির! মাথার শিরাটাও দপদপ করছে দুপুর থেকে…..
শেষ চারটে রাত ঠিক মতন ঘুম হয়নি ঈশানির ……তত্ত্ব সাজানো……বিয়ের জিনিস জোগাড় করা……বিয়ের শেষ মিনিট প্রস্তুতি সবই তো ঈশানি এসেই শেষ করেছে….
সবাই কি সুন্দর করে সেজেছে আজ! কাকিমনি, মাসি….রোশনি…তিতলি…সবাই কে কি সুন্দর মানিয়েছে সাজ পোশাকে…..
অথচ ঈশানি কোনোরকমে একটা সিল্ক শাড়ি জড়িয়ে, বসে বিয়ের মণ্ডপের এক কোণায়…..ক্লান্ত বিধস্ত দুচোখের তলায় কালী…..একটা লাল লিপিস্টিক লাগিয়েও সে মুছে ফেলেছে আজ ……
কে যেন বললো….”বাবা…..ওই রঙে আবার ফেটফেটে লাল লিপস্টিক…”
…..কি অদ্ভুত না! যে জিনিস টা, ঈশানির হাতেই নেই, সেই জিনিসটা নিয়ে আজীবন বলে গেল ওরা…..
কালো….ফর্সা ….লম্বা…বেঁটে….এগুলো সবটাই তো বিধাতার গড়া…..তবুও কেন যে ওরা বারবার……
“ঈশানি দি …… ঐ ঈশানি দি …..” তিতলির ডাকে মগ্নতা ভাঙলো ঈশানির…….
“কি হলো বল? বাবা ডাকছে নাকি?”
“না না পিসেমশাই না….একজন ডাকছে তোকে….স্নিগ্ধজিৎ নাম বললো….ওই যে ব্ল্যাক শার্ট……..বললো তোর অফিস কলিগ …..”
হাত দেখিয়ে ইশারা করলো তিতলি……
*************************************************
“আর কি চায় আপনার মিস্টার ব্যানার্জি?”
“ঈশানি পুরো ব্যাপারটা তে ওভাররিয়াক্ট করছিস তুই! দেখ তুই এতো অপমান করার পরেও আজ আমি এখানে এসেছি….আমাকে জাস্ট দুটো মিনিট দে সবটা এক্সপ্লেইন….”
ফিসফিস করে কথা গুলো বললো স্নিগ্ধ……
“কিচ্ছু বাকি নেই মিস্টার ব্যানার্জি…..
এক্সপ্লেইন করার মতন কিচ্ছু বাকি নেই!….আজ এই বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান চলছে….প্লিজ এখানে নতুন করে ….”
“বললাম তো তোকে জাস্ট দুটো মিনিট! তুই একটু ফাঁকাতে চল…এভাবে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এতো লোকের ভিড়ে আমি কি ভাবে…!”
“পুপু….অভি……একটু ভেতরে যা তো তোরা…….একটু বাদে আবার আসিস…..”
ঈশানির কথা মতো ওরা ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে যেতেই, ঈশানি এক ঝটকায় ব্যালকনির দরজাটা আছাড় মেরে ছিটকিনি মেরে দিলো বাইরে থেকে…..
তারপর স্নিগ্ধর চোখে চোখে বললো –
“শুরু করুন!”
“কিছু খেয়েছিস সকাল থেকে? চোখের তলাটা তে কালী পরে রয়েছে……কেমন শুকনো লাগছে তোকে তুই জানিস…..সবাই আজ কত সুন্দর করে সেজেগুজে …”
“আপনি নিশ্চই এইটা বলতে চাননা মিস্টার ব্যানার্জি….আর দেড় মিনিট সময় আছে আপনার কাছে! যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন…….ওদিকে অনেক কাজ পরে আছে….”
“ভালো লাগছে না জানিস ……মানে তোকে ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না……..আমি জানিনা তোকে কি ভাবে বোঝাবো?”
একটু থেমে স্নিগ্ধ আবার বলতে শুরু করলো – “তুই বিশ্বাস কর সেইদিন রাতে আমি এমন কিচ্ছু….”
“স্নিগ্ধ প্লিজ! প্লিজ এক কথা আমার আর ভালো লাগছেনা…..প্লিজ……! ব্যাস তোমার হয়ে গিয়েছে সব কথা…. আমি চলি….”
“না ….” বলেই স্নিগ্ধ ঈশানি কে আটকানোর প্রচেষ্টায় ঈশানির ডান হাতটা বেশ জাপটে ধরলো…..
গলাটা বেশ চড়িয়ে ঈশানি বললো
“ছাড়ো আমাকে! স্নিগ্ধ প্লিজ…..এখানে নতুন করে সিন ক্রিয়েট করোনা!”
স্নিগ্ধ, ঈশানির হাতটা ছেড়ে দিয়ে এক দৃষ্টি তে চেয়ে রইলো ঈশানির দিকে…..আর তারপর ঈশানির পাশ কাটিয়ে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে গেলো ব্যালকনি থেকে…..
ঈশানি দাঁড়িয়ে রইলো একা….
ঝাপসা চোখের সামনে লাল, সবুজ টুনি বাল্ব গুলো নিজের ছন্দ মতন জ্বলে চলেছে……
ব্যান্ড পার্টি, সানাই আর লোকজনের শোরগোল মিলেমিশে মাথা ধরাটা আরো বাড়িয়ে দিলো ঈশানির……
খুব ইচ্ছে করছিলো ওপরের ঘরে আলো, আওয়াজ, রোশনাই সব বন্ধ করে চুপচাপ চোখ দুটো বুজে একটু শুয়ে থাকতে …..ইচ্ছে করছিলো কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে একটু হালকা গান শুনতে শুনতে…. ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্নিগ্ধর সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলোর কথা ভাবতে……কাল্পনিক স্বপ্ন যদি একটু মন হালকা করতে পারে, তবে ক্ষতি কি?
খুব ইচ্ছে করছিলো গান গুলো আজ আবার নিজের মতন আওড়ে যাক ওদের না বলা কথা গুলো…….হ্যাঁ স্নিগ্ধই তো বলেছিলো ঈশানি কে – মিউসিক একটা থেরাপি……কারণ একটা গান কিরকম অনায়েসে সংযোগ স্থাপন করে নিজের জীবনের ঘটনার সাথে গানের কথা গুলো…..স্নিগ্ধ বলেছিলো গানের বিটস গুলো কত নিরস লোক কে নাচতে শিখিয়ে দিলো…..কত মন খারাপের রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিলো….কত প্রেমিক কে প্রপোজ করতে শিখিয়ে দিলো….কত একলা মানুষের সঙ্গী হয়ে গেলো…….
(চলবে) …….