বেমানান,পর্ব ৯ এ তুমি কেমন তুমি!

0
1015

বেমানান,পর্ব ৯ এ তুমি কেমন তুমি!

সকালে যখন ঈশানির ঘুমটা ভাঙলো, পূর্ব আকাশের সূর্য তখনও সোনালী হয়ে রয়েছে, এক ফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে ঈশানির বিছানায়!

বেশ গরম লাগছিলো ঈশানির, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিলো কপালের ভাঁজে, একটু দুর্বল লাগছিলো ঠিকিই, তবে কাল রাতের চেয়ে অনেকটা ভালো,, ঈশানি অনুভব করলো কম্বলে ঢাকা তার সমস্ত শরীরটা, আবার পরণে সোয়েটার! তাইতো বুঝি এতো গরম লাগছে!

মনে মনেই ভাবলো সেই কাল সন্ধ্যে বেলায় বিছানায় এসে বসেছিল সে,,,,,
তারপর থেকেই কি ঘুমোচ্ছে সে?
একবার মনে হলো এটা পরের দিনেরই সকাল তো? নাকী বিকেল?
না সকালই হবে নিশ্চই, তাই হবে নিশ্চই, কারণ কাল যখন সে বিছানায় এসে বসেছিল, তখন ঘরটা ছিল পুরো অন্ধকার……
কম্বলের মধ্যেই আলতো করে ডান পাশ থেকে চিৎ হতেই আঁতকে উঠলো সে! এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো সে!

স্নিগ্ধ এখানে কি করে?

স্নিগ্ধ তখনও ঘুমোচ্ছে দেওয়াল ও খাটের ছোট্টো ফাঁকের মাঝে রাখা একটা কোলবালিশে হেলান দিয়ে, পা দুটো ছড়ানো খাটের ওপর,,,
স্নিগ্ধর পরণে সাদা সিল্কের ধুতি কাটিং প্যান্ট ও গোল গলার একটা কালো গেঞ্জি, গলায় একটা রুপালি চেনে রুদ্রাক্ষর একটা লকেট,
হাঁটুর নীচের দিকটা এখনো কম্বলে মোড়া! খাটের পাশেই রাখা একটা চেয়ারের ওপর স্নিগ্ধর টিল ব্লু কালারের সিল্কের কুর্তা, কুর্তার ওপরে কালো সুতোর কাজ, এই কুর্তাটা ঈশানি দেখেছিলো ছবিতে!
ঈশানির গা হাত পা অবশ হতে থাকে, খাটের ওপর বসে থরথর করে কাঁপতে থাকে ঈশানি!
সে ঠিক দেখছে তো?

স্নিগ্ধ সারারাত তার সাথে ছিল, তাও এই গ্রামের স্টাফ কোয়াটারে! একই কম্বলে!!
এমনই তো ওরা নানান কথা বলে ওদের দুজনকে নিয়ে, তারপর স্নিগ্ধর রাত ভর এখানে থাকাটা যদি জানতে পারে ওরা?

ভাবতে ভাবতে জোরে জোরে হাঁপাতে শুরু করে ঈশানি! একটা চাপা কান্নার ও ভয়ের আওয়াজ বেরিয়ে আসে ঈশানির শুকনো গলা থেকে!
গলার নালীটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে আবার!

স্নিগ্ধর ঘুমটা ভাঙতেই দেখে ঈশানি থরথর করে বসে কাঁপছে খাটের অন্য কোণায়!

“ঈশানি কি হয়েছে? এরকম করছিস কেন? ঈশানি! ঈশানি!
কি হয়েছে? হ্যাঁ? আমাকে বল! এখনও শরীরটা খারাপ লাগছে? জ্বর আছে নাকি এখনো? হমম ? এই ঈশানি কিছু বল এরকম থরথর করে কাপঁছিশ কেন! স্বাশ কষ্ট হচ্ছে নাকি?”

ঈশানি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধর কালো গেঞ্জির দিকে! স্নিগ্ধ বোধহয় আন্দাজ করতে পারে এবারে কিছু!
তাড়াতাড়ি করে এক ঝটকায় কম্বল থেকে বেরিয়ে গলা দিয়ে গলিয়ে নেয় চেয়ারে রাখা কুর্তা! তারপর আবার বলতে শুরু করে –

“কিরে? তুই আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিস কেন? হমমম! তুই যেরকম ভাবছিস সেরকম কিছু নয় ……..
ঈশানি! ঈশানি রিলাক্স! ওকে? কাল খুব জ্বর ছিল তোর! ঘরের দরজা খোলাই ছিল!
সদর দরজা হাট করে ঘরের খাটে কুঁকড়ে শুয়ে ছিল তুই! থরথর করে কাঁপছিলিস ওকে? ঈশানি! ঈশানি! তুই কাঁদছিস কেন? শোন না, তুই প্লিজ একটু শোন!”

“বেরিয়ে যাও! এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যায়! এক্ষুণিই! কার অনুমতি নিয়ে এই ঘরে কাল সারারাত থেকে গেলে তুমি?”
বিভিৎস কুৎচিত একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে ঈশানির গলা থেকে!

স্নিগ্ধ বলে চলে – “ঈশানি তুই ভুল বুঝছিস! আমাকে! আমি…..আমি……!”

এবারে ঈশানি খাট থেকে উঠে, নিজের শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় স্নিগ্ধকে শোয়ার ঘর থেকে, আবারো সেই ঘেন্না মাখা গলায় চিৎকার করে বলতে থাকে –
“বেরিয়ে যাআআওওওও! মুক্তি দাআআওওওওও! আমাকে এবারে! প্লিইইইজজ স্নিগ্ধ মুক্তি দাআআওওওও ! ”

“ঈশানি তুই শুনছিসনা, আমি কি বলছি! তুই একটু আমার কথাটা শোন!”

“একদম এগোবেনা…..একদম না! আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করবো!”

“ঈশানি!” স্নিগ্ধর চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে আসে!

“এই মুহূর্তে যদি বেরিয়ে না যাও, বা যদি আর কোনোদিনও আমার কোয়াটারের দিকে চোখ তুলেও তাকাও, আমি কিন্তু ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেব!”

স্নিগ্ধর নিস্বাশ কেমন যেন আটকে আসে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে! কিছু বলেনা, বলতে পারেনা, তারপর গেট খুলে হনহন করে বেরিয়ে যায় ঈশানির ঘর থেকে!

স্নিগ্ধ বেরিয়ে যেতেই ঈশানি দরজা খুলে আশপাশ টা ভালো করে দেখতে থাকে! কেউ নেই কোত্থাও! শুধু কয়েকটা কাক বসে ব্যালকনি থেকে নিজেদের মধ্যে ডাকাডাকি করতে থাকে! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সাড়ে ৬ টা……
মাধবী দি ছাড়া এতো ভোরে কেউ ওঠেনা এই কোয়াটারে! মাধবী দি মনে হয়না উঠেছে এখনো! উঠলে নিশ্চই ওদের গলা পেয়ে বাইরে আসতো………

ঈশানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে একটু! ঘরে গিয়ে আবার বসে পরে খাটে………..
মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো যন্ত্রনায়!
আবারো খাটের ওপর শুয়ে পরে চিৎ হয়ে, খুব ক্লান্ত লাগছিলো ঈশানির, ক্লান্তি তে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো খানিকক্ষণ,, আবার চোখ দুটো বুজে এলো ঘুমে কিছুক্ষণের মধ্যেই!

বেলা প্রায় ৯…….
আবারো হুড়মুড় করে উঠে বসলো ঈশানি!
চুপচাপ বসে রইলো খাটের ওপর খানিকক্ষণ, তারপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই, এক লাফে বিছানা ছেড়ে ঢুকে পড়লো স্নান ঘরে!

স্নান সারতে সারতে বারবার সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিলো ঈশানির! বারবার মনে হচ্ছিলো স্নিগ্ধ সত্যি এসেছিলো কাল রাতে!
কাল সারারাত ঈশানির সাথে একই বিছানায় শুয়ে ছিল? নাকি ভোরের ঘটনা গুলো শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন!
সবটাই ঈশানির কল্পনা!

স্নিগ্ধ পারলো কি ভাবে এটা করতে? কেন ঈশানির অনুমতি ছাড়া থেকে গেলো সারাটা রাত ঈশানির ঘরে! কারণটা যাই হোকনা কেন,, তাই বলে একটা আইবুড়ো মেয়ের ঘরে সারাটা রাত থেকে যাবে, তাও আবার সেটা গ্রাম গঞ্জের স্টাফ কোয়াটারে!
এটা হয়তো স্নিগ্ধদের দক্ষিণ কলকাতার পাড়ায় খুব সাধারণ ব্যাপার, বা হয়তো স্নিগ্ধদের মতন পরিবারে এটা হামেশাই ঘটে থাকে! বড়োলোকের বড় বড় ব্যাপার! ফাইভ স্টারে নাকি ওয়েডিং! আইটিসি তে! সত্যি এটা ভাবার মতন দুঃসাহস
আছে সাধারণ মানুষের!
ভাবতে ভাবতে ঈশানি নিজেকেই দোষ দিতে থাকে, ঠিকই তো বলেছে মাধবী দি, ঈশানির এতদিনে এটা তো অবশ্যই জানা উচিত ছিল যে স্নিগ্ধ কোনো সাধারণ পরিবারের ছেলে নয়, কলকাতার সব চেয়ে বড় কার্ডিওলজিস্ট মিস্টার শুভঙ্কর ব্যানার্জির ছেলে, এমন কি মা ও বেশ নামি কার্ডিওলজিস্ট, প্রথম দশ জনের মধ্যে একজন তো বটেই!

এতবড়ো কথাটা লুকিয়ে গেলো দিব্বি!

ঈশানির মাথায় আবারো ঘুরপাক খেতে থাকে একি প্রশ্ন! কেউ দেখেনি তো?
কেউ দেখলে ওরা কি ভাববে! যদি মাধবী দি দেখে ফেলতো, বুকের ভেতর টা আবার ছ্যাৎ করে উঠলো ঈশানির!
সত্যি তো কেউ বিশ্বাস করতো ওদের মধ্যে কিচ্ছু হয়নি কাল রাতে……
ভাবতে ভাবতেই ঈশানির হাত পা টা আবার অসার মনে হলো,,
একটা ঠান্ডা শ্রোত বয়ে গেলো ঘাড় থেকে পিঠের শিরদাঁড়া বয়ে, নিজের মনের অজান্তেই আওড়ে নিলো কথাটা – “না! না! সেটা কি ভাবে সম্ভব?”

মাথা বড়ো অদ্ভুত জিনিস,, কারণে অকারণে তর্ক করতেই হবে তাকে মনের বিরুদ্ধে!
মাথাটা অনর্গল বলে চললো হতেই পারে কিছু ঘটেছে, স্নিগ্ধর ঘরে ঢোকা টের পাওয়া গেলোনা, পাশে বসা টের পাওয়া গেলোনা, কে জানে আর কি কি টের পাওয়া যায়নি………………

“উউউউউউফফফফ! কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন! ….কেন কাল রাতের কথা কিচ্ছু মনে পড়ছেনা” ভাবতে ভাবতেই ঈশানি স্নান সেরে রওনা হলো অফিস পথে…..

খালি পেটেই আজ শুরু করতে হবে কাজ!

ব্যাংকে আসতে আজ এমনিই ভীষণ দেরি হয়ে গিয়েছিলো!
তাই আজ উপবাসেই থাকতে হলো ঈশানি কে দুপুর দেড়টা অব্দি!
লাঞ্চ টাইমে ওরা আবার স্নিগ্ধর বাড়ির নেমন্তন্ন নিয়ে কথাবার্তা শুরু করতেই ঈশানির কেমন যেন মনে হলো স্নিগ্ধ কি ভাবে আসতে পারে কাল ঈশানির ঘরে, কাল তো ওর বোনের বিয়ে ছিল! তবে?
আর যদি স্নিগ্ধ এসেও থাকে তবে ব্যাংকে আসেনি কেন? এতক্ষণে নিশ্চই কোনো না কোনো কাজে নীচে সে একবার এসে ঘুরে যেত!

তবে? পুরো নিজের চোখে দেখা ব্যাপারটা কল্পনা! মনগড়া!
ঈশানি শুনেছিলো এরকম মানসিক রোগের কথা, রোগের নামটা যদিও মনে পড়লোনা ঈশানির যেখানে মানুষ কিছু আদখাপছা ঘটনা কল্পনা করে নিজের মনেই!

“ঈশানি!” মাধবী দেবীর ডাকে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো ঈশানি…..

“হ্যাঁ মাধবী দি কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ! আজ জানিস একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো!”

“কি মাধবী দি?”

“অবিকল স্নিগ্ধর মতন একটা ছেলেকে দেখলাম কোয়াটার থেকে বেরোতে, তাও ধর সকাল ছটা, সাড়ে ছটা……..”

ঈশানি কিছু বললোনা,, আবার সেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মাধবী দেবীর দিকে!
মনে মনেই বুঝলো তারমানে স্নিগ্ধ সত্যি এসেছিলো সকালে!

মাধবী দি বলে চলে – “তো! জানিস আমি ফণীবাবু কে জিজ্ঞেস করি,, স্নিগ্ধ সকালে এসেছিলো কিনা? উনি তো আবার কখনো সখনো ভোরে বেড়োন…..”

ঈশানি নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলো – “তো ফণীবাবু কি বললেন তোমায়?”

“কি আবার! আরে কাল তো সবাই ওরা অনেক রাতে ফিরেছে, তাও ধর দেড়টা! তাই ওতো সকালে আজ আর কেউ ওঠেনি…..”

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঈশানি! তবু মনে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো ঈশানির রাতে স্নিগ্ধ কখন এসেছিলো? ওরা কেউ দেখেনি তো!
তারপর নিজের মন কেই শান্তনা দিলো ঈশানি – কেউ দেখলে এতক্ষণে হুলুশ থুলুশ পরে যেত! ওরা কি ঈশানি কে এতো সহজে ছেরে দিতো?

তখন বিকেল তিনটে!

হঠাৎই ঈশানির মনে হলো ফোনটা তো এখনো বন্ধ কাল সন্ধ্যে থেকে! ইশশ! এতক্ষণে কত চিন্তাই না করেছে ওরা ওদিকে…..

তড়িঘড়ি করে ফোনটা সুইচ অন করেই বাড়িতে ফোন করে একটা……

“হ্যালো মা! সরি মা! তুমি আমায় অনেক বার ফোন করেছিলে না…আসলে কাল ………? ”

“ওমা! সরি কিসের? নাহ রে তোকে আর আমি কই ফোন করলাম? জানিস ক্যাটেরার এখন বলছে তোপসের ফ্রাই টা দিতে পারবেনা, এই নিয়ে সকাল……….”

ঈশানি আর কিছু শুনলনা,, শুধুই মায়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে চললো!

ফোনটা রাখতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন শুন্য মনে হলো! কে জানে কেন? বোধহয় ভেবেছিলো বাড়ির কেউ খুব চিন্তা করছে তাকে নিয়ে!
ভেবেছিলো স্নিগ্ধ নেই তো কি হয়েছে!

না না মা, বাবা ছিল, আছে ও থাকবে, এখন তো একটু ব্যস্ত হবেই! বাড়ির প্রথম বিয়ে বলে কথা!

রাতে যখন ঘরে ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যে ছটা, সদর দরজা লক করে, মুখ হাত ধুয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে আবার গিয়ে বসে পড়লো খাটে, আজ চম্পার মাকে নিজেই ফোন করে ডেকেছে ঈশানি!

আজ সকাল থেকে যেটা ঘটে চলেছে সেটা বিশ্বাস ও হচ্ছেনা আবার কখনো সত্যি মনে হচ্ছে!
মাথা আর কাজ করছিলোনা ঈশানির! মনে হচ্ছিলো সত্যি সত্যি এবারে পাগল হয়ে যাবে ঈশানি, মাথাটা আবার বেশ ধরে গিয়েছিলো!

বেলটা বেজে উঠলো ঈশানির ঘরে, ওই বুঝি চম্পার মা এলো, খাট থেকে নামতে গিয়েই ঈশানির পায়ের ধাক্কায় উল্টে গেলো ছোট বাটিতে রাখা জলটা!
বাটির মধ্যে জেন্টস সাদা একটা ভেজা রুমাল!
স্নিগ্ধর রুমাল বোধহয়!

ঈশানি তাড়াতাড়ি রুমালটা কোনো রকমে একটু চিপে, লুকিয়ে রেখে দিলো নিজের হাতব্যাগে, তারপর সদর দরজা খুলে দিলো….

চম্পার মা ঘরে ঢুকতেই প্রথম প্রশ্ন – “কি হয়েছে গো দিদি তোমার? জ্বর এসেছিলো নাকি?”

“তুই কি করে জানলি?”

“এই যে টেবিলের ওপর জ্বরের ওষুধ…”

ঈশানির চোখ পড়লো ডাইনিং টেবিলের দিকে! ঠিকতো প্যারাসিটামলের দুটো পাতা, একটা পাতায় একটা ওষুধ কম!
কে এনেছিল এগুলো – “স্নিগ্ধ?”

ব্যাপারটা আসতে আসতে পরিষ্কার হচ্ছিলো ঈশানির কাছে,,,,,,
সকালে রান্নাঘরের বেসিনে পরে থাকা ভেজা বিস্কিটের খানিকটা অংশ, টেবিলে প্যারাসিটামল ও খাটের তলায় জলপট্টির বাটি, সকালে স্নিগ্ধর বারবার জ্বরের কথা বলা – তাহলে সব সত্যি!

অথচ ছেলেটা কে কি অনায়েসে তাড়িয়ে দিলো ঈশানি……
ভাবতে ভাবতে ঈশানির চোখ দুটো ভোরে এলো জলে……

আরও দিন চারেক পরের কথা……
স্নিগ্ধ আজ ব্যাংকে এলেও কথা হলোনা ঈশানির সাথে একটাও……

আজ ঈশানির মনে হলো তাহলে সেদিনের ভোরের ঘটনাটা সত্যি ছিল, মনে মনেই নিজের মনকে সান্তনা দিলো ঈশানি –
“যাক! ভালোই হয়েছে! এমনিও অসমান বন্ধুক্ত, সম্পর্ক কদিনিই বা ঠিকতো…….
তবে সেদিনের রাতে এক্সাক্টলি ঠিক হয়েছিল জানার জন্যে মনটা ছটপট করতে থাকলো ঈশানির…….”

সন্ধ্যে তখন সাতটা, ব্যাংক মোটামোটি ফাঁকা বললেই চলে, ঈশানি কোনোরকমে অনেকখানি সাহস করে সিঁড়ি বেয়ে স্নিগ্ধর ঘরের বাইরে দরজায় টোকা দিলো

“আসবো? একটু দরকার ছিল …..”

স্নিগ্ধ ফাইলের পাতা থেকে চোখ না সরিয়ে ঈশানি কে ভেতরে আসতে বললো….

ঈশানি চেয়েও কিছুতেই জিজ্ঞেস করে উঠতে পারলোনা সেদিন রাতের কথাটা, কোনোমতে গলাটা পরিষ্কার করে বললো –
“কাল থেকে টানা পাঁচ দিন ছুটি আছে আমার! তাই …”

“তো! আমি কি করবো? হমম! কাউন্টারে বসে তোর জায়গাতে টাকা গুনবো..?”
কথাটা বলতে বলতে একটা উপেক্ষার হাসি হাসলো স্নিগ্ধ, আবার মাথা নীচু করে ফাইলের পাতায় চোখ বোলাতে লাগলো, মাঝে মাঝে কিছু একটা টাইপ করে চললো কম্পিউটারে,
তারপর ঈশানির দিকে চেয়ে বললো –

“যেটা জিজ্ঞেস করতে এসেছিস, সেটা জিজ্ঞেস কর বসে না থেকে!”

ঈশানি এবারে মাথা তুলে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো
“কেন তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে সারারাত থাকলে?” কথাটা বলতে বলতে ঈশানির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো!

“সেটার কৈফিয়ত আমি দিতে পারবোনা, শুধু এইটুকু বলতে পারি, তুই যেরকম সিন্ ক্রিয়েট করলি আগেরদিন, সেরম সিন্ ক্রিয়েট করার মতন কোনো ঘটনা ঘটেনি সেদিন, তোর জ্বর ছিল, তাই আমি ছিলাম, ব্যাস এই টুকুই!”

“তোমাদের মতন বড়লোকদের কাছে এটা নাই ম্যাটার করতে পারে, তবে আমাদের মতন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে চরিত্রের অনেকটা দাম আছে……”

“ঈশানি – এনাফ ইস এনাফ! ইউ আর জাস্ট গোয়িং টু ফার!… ওকে? চরিত্র নিয়ে কথা বলার মতন কিছু হয়নি আর এই কথাটা আমি তোকে আজ শেষবারের মতন বললাম!”

“বেশ, চাইনা কোন এক্সপ্লানেশন! তাহলে তুমি রাহুলের জায়গাতে আমার নামটা রেকমেন্ড করো ফর মিউচুয়াল ট্রান্সফার,,, ব্যাস তাহলেই আমি খুশি!”

“মানে?”

“মানেটা খুব পরিষ্কার! তুমি বুঝতে পারছোনা! মিউচুয়াল ট্রান্সফার apply
করার উইন্ডো খুলেছে তো পোর্টালে, আমি Apply
করেছি, তুমি ওদের বলো যে আমার দু বছর হয়ে গিয়েছে, আমি যেতে চাই…….”

“পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? একটা এতটুকু কারণের জন্যে তুই সোজা ট্রান্সফার Apply করে দিলি?” বিস্মিত দৃষ্টিতে স্নিগ্ধ চেয়ে রইলো ঈশানির দিকে!

ঈশানি বলে চললো –
“তোমাকে আমি আগেও বলছি, এখনো বলছি, এটা আমার কাছে ছোট কারণ নয়! ওকে?
আর তাছাড়া আমি এখানে থাকতে চাইনা
এটা ফাইনাল…..
সেটা যে কারণেই হোকনা কেন!
আর এখানে থাকতে না চাওয়া টা আমার ডিসিশন, তুমি বলার কে?” বেশ চিৎকার করেই কথাটা বললো ঈশানি…..

ঈশানি গলাটা নামিয়ে, চোখদুটো মুছে নিলো হাতের রুমালটা দিয়ে –
“প্লিজ স্যার! প্লিজ! আমি দুহাত জোর করে বলছি, আমার নামটা রেকমেন্ড করুন, আমাকে এই জায়গাটা থেকে ও আপনার জীবন থেকে মুক্তি দিন! প্লিজ! অ…আমি মুক্তি চাই…..

রাহুল তো ছেলে, আরও এক – দুবছর ও নিশ্চই ম্যানেজ করে নেবে, আমি সত্যি আর পারবোনা এখানে থাকতে, এখানে আর একদম ভালো লাগছেনা আমার, রুবির কাছের ব্রাঞ্চ টাতে হয়ে গেলে, আমিও শান্তি পাবো আর …..”

“…..ঠিক বলেছিস! তুইও শান্তি পাবি,,,,,, আর আমিও ,,,,
একটা বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক ভীষণ নড়বড়ে হয় ঈশানি, জোর করে,,,,,,,
ধরে বেঁধে.,,,,,,,, সেটাকে টেকানো যায়না! ………
আর কিছু বলার না থাকলে তাহলে এখন আয়…..অনেক কাজ পরে আসলে……”
খুব আসতে আসতে ও থেমে থেমে কথাটা শেষ করে স্নিগ্ধ, আর তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে মুখ ফিরিয়ে ফাইল পত্র খুঁজতে থাকে কাপবোর্ড থেকে!
“কিছু না বলার থাকলে এখন আয় ঈশানি!”
ভাঙা ভাঙা গলায় এভাবেই স্নিগ্ধ শেষ করে ওদের কথপোকথন……

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here