বেমানান!
পর্ব – ১০ আজও আছে গোপন, ফেরারি মন!
(বর্তমান দিন)
বেশ খানিকক্ষণ আগেই কৌশানির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছে!
লাল টকটকে সিঁদুরে রাঙানো কৌশানির সিঁথি, নববধূ রূপে কৌশানি কে ভারী মানিয়েছে……
এখন সবাই ফটো তুলতে ব্যস্ত নবদম্পতি কে ঘিরে!
সবার মুখে এক কথা, পুরো মা লক্ষীর মতন লাগছে কৌশানিকে…..
ধপধপে গায়ের রঙ, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, হাতে গাছকৌটো!
ঈশানি এখনো বসে মণ্ডপের পাশে একটা সোফায়!
একটু গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে বাকিদের থেকে, তিলতিল করে স্নিগ্ধ যে আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে ভালোবাসার ব্যাপারটা গড়ে তুলেছিল ঈশানির মনে শেষ এক বছরে, সেটা গতসপ্তাহে মানুষটার সাথে বিদায় নিয়েছে ঈশানির জীবন থেকে!
আজ আবার ঈশানি সেই পুরোনো ঈশানি, যে নিজেকে ভালোবাসেনা, যে নিজেকে বিশ্বাস করেনা…..
“ঈশানি, এই ঈশানি…….”
“হ্যাঁ মা বলো….”
“বলছি স্নিগ্ধ বলে তোর যে অফিস কলিগ এসেছিলোনা, সে আমার হাতে একটা এনভেলপ দিয়ে বললো তোকে দিয়ে দিতে, আমি জিজ্ঞেস করলাম তোর সাথে দেখা হয়েছিল কিনা! বললো হ্যাঁ কিন্তু তোকে দিতে ভুলে গিয়েছে! আর কি জানি বুঝলাম না জানিস, আটটা পনেরো নাগাদ বেরিয়ে গেলো, আবার আমাকে বললো খেয়েছে, কি জানি কি করে, প্রথম ব্যাচ বসতেই তো প্রায় আটটা হয়ে গিয়েছিলো…….
কখন খেলো কে জানে…..!”
একটু থেমে মিসেস দত্ত গলাটা বেশ নীচু করে বললেন –
আবার কৌশানির জন্যে একটা বেশ দামি ঘড়ি এনেছিল জানিস, আমি ওই বাড়ি গিয়েছিলাম, ওই এনভেলপটা আর ঘড়িটা দুটোই আলমারিতে রেখে এসেছি…..”
ঈশানি যখন অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে নিজের ঘরে ফিরলো তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, তবুও ঘর ভর্তি লোক ঈশানি ও কৌশানির বিছানায় বসে আড্ডা মারছে…
ঈশানি হনহন করে ঘরে ঢুকে আলমারিটা চাবি দিয়ে খুলেই এনভেলপটা বের করতেই রিমি মাসি বলে উঠলো – “ওকি রে, কৌশানির বিয়েতে পাওয়া টাকা পয়সা ওর সামনে খুলিস! এ ভাবে ওকে না জানিয়ে….”
রিমি মাসির কথাটা শেষ হতে না হতেই ঈশানি বেশ মেজাজে বলে উঠলো –
“প্রথমত এটা আমার অফিসিয়াল কাগজ, দু নম্বর এটা আমার আর কৌশানির ব্যাপার, আনন্দ করছো করোনা, সব ব্যাপারে কথা বলতেই হবেনা তোমাকে মাসি…..”
ঈশানির কথাটা শেষ হতেনা হতেই, ঘরে থাকা বড়োরা ঈশানি কেই দোষারোপ করতে থাকে অনর্গল – “ঈশানি, রিমি কিন্তু তোর মায়ের পরের জন, আর এমন কি বলেছে, ঠিকই তো বলেছে, কৌশানির জিনিসে বরাবর তোর নজর……”
“আমার নজর!”
“হ্যাঁ! আর না তো কি!”
ঈশানি কোনো উত্তর দেয়না, কারুর দিকে তাকায়না, চুপচাপ এনভেলপ টা বের করে আলমারিতে আবার চাবি ঘোরাতে শুরু করে, খুব ইচ্ছে করছিলো স্নিগ্ধর দেওয়া ঘড়িটা একবার দেখতে, তবে এমনিই এতো কথা, তারপর ঘড়ি খুললে তো আর রক্ষা নেই!
ঈশানি যখন ঘর থেকে বেরোলো ফিসফিস করে কেউ যেন বললো –
“কিসের যে এতো অহংকার কে জানে, ওই তো ক্লার্কের চাকরি, আর ওই তো ছিরির দেখতে……”
কথাটা শুনেও ঈশানি দাঁড়ালোনা, বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো চাপা যন্ত্রনায়!
“ক্লার্কের চাকরি পেতেই কত ছেলেমেয়েরা পিএইচডি করে ফর্মের লাইনে দাঁড়িয়ে …..” স্নিগ্ধর বলা কথাটা মনে পড়লেও আজ আর সেই কথাটা আত্মবিশ্বাস বাড়ালোনা ঈশানির!
স্নিগ্ধ এনভেলাপে কি দিয়েছে চিঠি?
বাথরুমের ভেতরে গিয়ে এনভেলপের বাইরেটা ছিঁড়ে ফেলে ঈশানি, কাগজটা বের করে দেখে মিউচুয়াল ট্রান্সফার approval এর একটা মেলের প্রিন্টেড কপি!
কাগজটা দেখে ঈশানির চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো!
আজ কেন আবার মন ভাঙার জল এলো চোখে কে জানে! ঈশানি তো এটাই চেয়েছিলো! মুক্তি!
কখনো কখনো মনে হয় মন বোধহয় নিজেই জানেনা সে কি চায়, বা কিছু কল্পনা করতে ভয় পায়! না পাওয়ার মেনে নেওয়াটা যে অনেকটা ভালো সুখের স্বপ্নের অনিশ্চয়তার থেকে!
সেদিন রাতে মুখ হাত ধুয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করে ঈশানি বসার ঘরের সোফায় একটা সিঙ্গেল লেপ ও বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো লেপে পুরো শরীর ও মুখটা ঢেকে, কানে হেডফোন গুঁজে বেশ জোরেই চালিয়ে দিলো গান……
না আজ আর ঘুম পড়ানোর গান নয়, আজ লড়াইটা ছিল ওদের ঈশানি কে বলা নানান আঘাত করা কথাগুলো কে এড়িয়ে যাওয়ার করার গান!
চোখ দুটো বুজে গান শুনতে শুনতে বারবার স্নিগ্ধর মুখটা ভেসে উঠছিলো বন্ধ চোখের পাতার সামনে!
এতো কিছুর পরও তাহলে আজ স্নিগ্ধ সত্যি এলো!
“কিছু খেয়েছিস সকাল থেকে, মুখটা কেমন যেন শুকনো লাগছে তোর” স্নিগ্ধর বলা কথা গুলো কানে বাজতে থাকে ঈশানির!
সত্যি তো সবাই দিব্বি এতো কথা আলোচনা করছে কেউ কি একবারও খোঁজ রেখেছে যে শুধু কৌশানি নয়, কৌশানির সাথে ঈশানীও আজ উপোষ সকাল থেকে!
ক্লান্ত চোখে তখন হালকা একটা ঘুম লেগে এসেছিলো ঈশানির দু চোখে, হেডফোনে তখনও বেজে চলেছে নব্বই এর ভালোবাসার গান! হঠাৎই ঈশানি বুঝলো কেউ যেন বেশ জোরে তাকে ধাক্কা দিচ্ছে! কান থেকে হেডফোন টা সরিয়ে দেখলো মিসেস দত্ত দাঁড়িয়ে!
“কিরে! কাউকে কিছুনা বলে, এখানে এসে ঘুমিয়ে পড়লি যে! ওদিকে এতো গিফট, এতো লোকজন কে সামলাবে হ্যাঁ! বিয়ের সব জিনিস, কৌশানির সব জিনিসপত্র সবতো ছড়িয়ে পরে, কোনো দায়িত্ববোধ নেই তোর, হমমম! আর রিমি মাসিকে কি বলেছিস? এই শিক্ষা! ছি! মুখের ভাষা টাও দিনদিন কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে ………”
ঈশানি কিছু বলেনা…..সোফাতে উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মিসেস দত্তর দিকে!
“কি হলো ও ভাবে তাকানোর কি হলো! এবারে উঠুন আর কৌশানি কে একটু সাহায্য করে আমাকে ধন্য করুন……”
ঈশানি উঠতেই যাবে সোফা থেকে ঈশানি দেখলো কৌশানি এসে দাঁড়ালো মিসেস দত্তর পাশে! এবার বুঝি ওঔ কিছু বলবে!
ঈশানি কথা না বাড়িয়ে সোফা থেকে উঠে কৌশানির দিকে ইশারা করে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো – “চল বুনু…..”
“না! দিভাই……তুই চুপটি করে ওখানেই বোস…..আমি পারবো রে একা একা…..আর মা দিভাই সেই সকাল থেকে কাজ করেই যাচ্ছে, কিচ্ছু খায়নি ও……. তুমি সে খবর রাখো!
ও রিমি মাসি কে কি বলেছে তাই তুমি কন্সার্ন….অথচ না খেয়ে সোফায় একা একা কেন শুয়ে, ওর শরীরটা ঠিক আছে কিনা, সে খবর তুমি রাখো মা! আমি চলে গেলে ওকে তুমি একটুখানি ভালোবেসো মা, ও খুউব একা যে!”
কথাটা শেষ করতে ঈশানি দেখে কৌশানির দুটো চোখের কোল বেয়ে জল নেমে এসেছে গালে!
মিসেস দত্ত অবাক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ঈশানি ও কৌশানি কে! তারপর কান্না ভেজা একটা গলায় বলে – “যাই! ওখান থেকে কিছু খাবার….”
“থাক মা! আজ আমি নিয়ে এসেছি খাবার! আমি চলে গেলে না হয় তুমি ওকে খায়িয়ে দিও! আয় দিভাই হাতটা ধুয়ে টেবিলে এসে বোস দেখি! কে জানে এরকম সুযোগ আমি আবার কবে পাবো, তোকে আদর করে নিজে হাতে খাওয়ানোর!”
ঈশানি আর কিছু বলতে পারেনা, কথাগুলো কেমন যেন জড়িয়ে আসে, সোফা থেকে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কৌশানিকে জাপ্টে, তারপর ফেটে পরে কান্নায়! ওরা দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে!
“কিরে! আজ যেতেই হবে? কালই তো কৌশানির বৌভাত সেরে এতো রাতে ফিরলি! আজ তো শনিবার হাফ! আজ না হয় থেকে গিয়ে সোমবার ফিরতিস….! এখনো রাগ করে আছিস না আমার ওপর! তুই মা হলে বুঝতিস বড়ো মেয়েকে ঘরে রেখে ছোটোকে বিয়ে দিলে ……..আমি তো মা! ওদের সাথে কি দরকার ছিল খারাপ ব্যবহার করার, দুদিনের জন্যে….”
“মা! আমি রেগে নেই!
তোমায় বলা হয়নি সেদিন তুমি যে এনভেলপের কথা বলেছিলে, যেটা স্নিগ্ধ স্যার তোমার হাতে দিয়ে গিয়েছে ওটা তে ট্রান্সফার অর্ডার এর একটা সফ্ট কপির প্রিন্ট ভার্শন ছিল! ওরা দিন পনেরোর মধ্যেই আমাকে রুবির ব্রাঞ্চে জয়েন করতে বলেছে!”
“কি বলছিস ঈশানি! সত্যি! আর তুই এটা আমাকে এতদিনে বলছিস! ভালোই হয়েছে তুই এখানে এলে এবার আবার তোর জন্যে ছেলে দেখা শুরু করবো!”
“মা প্লিজ! কিছুদিন আমাকে একটু শান্তি তে থাকতে দাও…..আমার এমন কিছু বয়েস হয়নি!”
“ব্যাপারটা বয়েসের নয় ঈশানি, চার বছর হয়ে গেলো তোর তোর চাকরি করা…..”
“চার নয় আড়াই বছর!”
“সে তো সরকারি এই ব্যাংকের চাকরিটা! তার আগেও তো তুই প্রাইভেট ব্যাংক টাতে ছিলিস এক বছর মতন! তখন সোনারপুরের ছেলেটা রাজিও ছিল, শুধু ওরা চাকরিটা ছাড়তে বলেছিলো!”
“শুধু! মা, ছোটথেকে এই পড়াশোনা, চাকরি, টিউশন পড়ানো ছাড়া আমার জীবনে আছে টা
কি? আর তুমি বলছো শুধু চাকরি! এই চাকরিটাই আমার কাছে আমার পরিচয়, ইডেন্টিটি ! আর কতদিন পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটবে মা! আমি কি খুব অসুবিধে …..”
“তুই মা হলে তবে বুঝতিস, পিঠোপিঠি দুই বোন, ছোটজনের বিয়ে…..”
“মা! প্লিজ এটা নিয়ে আমরা অনেকবার কথা বলে ফেলেছি! প্লিজ এই ভোর সাড়ে-চারটের সময় কান্নাকাটি করোনা!
বেশ ঠিক আছে, আমাকে নতুন ব্রাঞ্চে একটু গুছিয়ে নিতে দাও! তারপর না হয়…..”
“কতদিন?”
“আমি জানিনা মা!”
“শোন না ঈশানি, এবার দেখিস তোর জন্যে এমন ছেলে দেখবো যে তোকে পুরো স্বাধীনতা দেবে!”
“স্বাধীনতা দেবে মানেটা কি মা? আমার জীবনে আমাকে স্বাধীনতা দেবে! সে কে আমাকে স্বাধীনতা দেওয়ার!”
অজান্তেই স্নিগ্ধর ঈশানি কে বলা স্বাধীনতা নিয়ে কথাটা বেরিয়ে এলো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে!
শেষ এক বছরের সব কথা তাহলে ভুলে যায়নি ঈশানি!
তেরো দিন কেটে গিয়েছে হুড়হুড় করে এর মধ্যে!
কাল রোববার!
আর পরশু সোমবার – ঈশানির মিদনাপুর ব্রাঞ্চের লাস্ট ওয়ার্কিং ডে!
শেষদিনে টুকটাক বিকেলের জলখাবারের আবদার ধরেছে অফিসের লোকজন, ওরা যেরকমই হোকনা কেন প্রায় আড়াই বছর কাটিয়েছে ঈশানি ওদের সাথে, তাই একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেলো ঈশানি……
আজ চম্পার মা এলে পুরো মাসের মাস মাইনে টাই দিয়ে দেবে ঈশানি, গরিব মানুষ, কত কষ্ট করে রোজগার করে, দিন দশেক মাসে বাকি থাকলেও আর হিসেব নিকেশ করে কি লাভ!
ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা, আজকে ব্যাংক হাফ ছিল, কাজেই ঈশানি অনেকটাই তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়েছে ঘরে, গোছগাছ অনেকটাই সেরে ফেলেছে শেষ দু তিন দিনে!
স্নিগ্ধ রোজ এসেছে ব্যাংকে এর মধ্যে, তবে কথা হয়নি দুজনের একবারও! চোখে – চোখ পড়লেও স্নিগ্ধ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে বারবার, বা না দেখার ভান করে এগিয়ে গিয়েছে ঈশানি কে পাশ কাটিয়ে!
কলিং বেলের আওয়াজে মগ্নতা কাটলো ঈশানির!
চম্পার মা নতুন শুরু করেছে, ছটার আগেই কাজে চলে আসা……..
মনে মনে ভীষণ রাগ হলো ঈশানির! আবার এসে কানের কাছে বকবক বকবক শুরু করবে এক্ষুণি……
কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু অন্য রকম ঘটলো, চম্পার মা নিজের মনেই বেঁচে থাকা সবজি নিয়ে কাটাকুটি শুরু করলো…..
ঈশানি আর কিছু বললোনা….
চুপচাপ ঘরে ঢুকে গিয়ে আবার বিছানাতে এলিয়ে দিলো পুরো শরীরটা!
ঘন্টা খানেক পরে চম্পার মা হাতে চা নিয়ে ঢুকলো ঈশানির ঘরে…
“দিদি তোমার লাল চা এনেছি…এখানে রাখবো?”
শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলো ঈশানি কে…..
“হমম রাখো, রূপসা দি(চম্পার মায়ের ভালো নাম) আবার চম্পার বাবা তোমায় মেরেছে নাকি?”
“না! দিদি, উনি কিচ্ছুটি করেন নি”
“তাহলে এতো মনমরা হয়ে আছে কেন!”
চম্পার মা এতক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছিল! শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছতে মুছতে বললো
“তুমি সত্যি চলে যাবে দিদি! আমার সব বাড়ির কাজ ছেড়ে গেলো জানো, কি ভাবে চলবে কে জানে! চম্পার এই মাসের ইস্কুল পত্তরের খরচা তো সব স্নিগ্ধ দাদাবাবু দিলো, কিন্তু এই ভাবে….”
“দাঁড়া! স্নিগ্ধ স্যারের বাড়িতে তুই এখন আর কাজ করিসনা……”
“না গো দিদি! সেই কবে ছেড়ে দিয়েছি!”
“কেন?”
“কেন কিগো দিদি! স্নিগ্ধ দাদাবাবু তো বাজার করে না বহুদিন ধরে, সেই যে দাদাবাবু বোনের বিয়ে থেকে ফিরলো তখন থেকে, শুধু ভাত রান্না করার জন্যে আমার টাকা নিতে ভালো লাগতোনা গো! তবে জানো আমি মানা করা সত্ত্বেও আমাকে অনেকগুলো টাকা জোর করে দিলো!”
চম্পার মা বেরিয়ে যাওয়ার সময় অনেক কান্নাকাটি করছিলো, পুরো মাসের মাসমাইনে টাও কিছুতেই নিতে চাইছিলনা!
ঈশানির বারবার বলা সত্ত্বেও বলে গেলো কাল বিকেলে আবার আসবে……
ঈশানির যদিও একটা বিকেল একাই ম্যানেজ করে নিতো, ঘরে বিশেষ সবজিও নেই, বাসন পত্র যা নেওয়ার সব গুছিয়ে নিতে হবে কাল রাতের মধ্যেই!
সোমবার সকালে বাইরের হোটেলেই কোনোরকমে এডজাস্ট করে নেবে ঈশানি…..
রোববারের সকাল থেকে বিকেল সারাদিন সব গোছগাছ করতে করতেই কেটে গেলো ঈশানির,
চম্পার মা এসে ভাতে ভাত করে দিয়েছিলো, সঙ্গে একটা ডিম্ সেদ্ধ……
রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করে যখন ঈশানি শোয়ার ঘরে এসে খাটে বসলো তখন সবে নটা…….আজ কৌশানি কেও ফোন করা যাবেনা,,, ওরা হানিমুনে থাইল্যান্ড গিয়েছে বেরোতে……
ঘরের সব ড্রয়ার, আলমারি গুলো একবার দেখে নিলে ভালো হতো……
এটা ভেবেই আলমারির সব ড্রয়ার গুলো চেক করে ঈশানি বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার টা খোলার চেষ্টা করতে থাকলো,,ড্রয়ারটা বেশ শক্ত বরাবরই…..তবুও একবার চেক করে নিলে ক্ষতি কি?
এমনি কাল মুভার্স এন্ড প্যাকার্স থেকে লোক এসে সকালেই সব আসবাবপত্র পৌঁছে দেবে ঈশানির উত্তর কলকাতার এপার্টমেন্টে …….
কাল কোনোরকমে মাটিতে বিছানা করেই রাতটা ম্যানেজ করতে হবে!
শীতকালের এই এক ঝামেলা, লেপ কম্বল সেগুলো হাতে হাতেই বইতে হবে পরের দিন ট্রেনে!
দুচারটে কিল মেরে অবশেষে ড্রয়ারটা খুলতেই ঈশানির হৃদস্পন্দন টা দুগুণ হয়ে গেলো, ঈশানি দেখলো ড্রয়ারে পরে একটা ব্র্যান্ড নিউ এন্ড্রয়েড ফোন এবং একটা জেন্টস ওয়ালেট! ফোনটার স্ক্রিন গার্ডের ওপর লাগানো প্লাস্টিকটাও সরানো হয়নি এখনো!
ওয়ালেট টা চেনা ঈশানির, ওয়ালেট টা স্নিগ্ধর! কিন্তু ফোনটা কার?
ফোনটা বন্ধ দেখে, বাইরের ঘর থেকে দৌড়ে গিয়ে ঈশানি নিয়ে এলো নিজের চার্জারটা……তারপর চার্জে বসাতেই সবুজ লাইট জ্বলে উঠলো ফোনে, ব্যাটারি ২৫%! আশ্চর্য তারমানে ফোনটা সুইচ অফ করেই রাখা হয়েছিল ড্রয়ারে……
ফোনের পাশের ডান দিকের সুইচ টা জোরে টিপতেই ফোনটা সুইচ অন হয়ে গেলো!
ফোনটা তে কোনো লক ছিলোনা! কন্টাক্টসে অদ্ভুত ভাবে তিনটে নম্বর সেভ করা! বাড়ি, দিদিভাই ও ঈশানি!
ঈশানি নম্বরটা এই নতুন ফোনে কি ভাবে?
কল রেকর্ডসে গিয়ে ঈশানির বুকের ভেতরটা কেমন খাঁখাঁ করে উঠলো!
অনর্গল ও অসংখ্যা বার ডায়াল করা হয়েছিল ঈশানির নম্বর ওই ফোন থেকে…….
তারিখ – ২৮ নভেম্বর! ওই দিনই তো স্নিগ্ধের খুড়তোতো বোনের বিয়ে ছিল!
সেইদিনই সকালে অসংখ আননোন নম্বর ডায়াল করা হয়েছে ফোন থেকে, খুব অদ্ভুত ভাবে সবকটি নম্বর একই ধরণের, সবকটি নম্বরের শুরুর পাঁচটি সংখ্যা এক, আবার শেষের তিনটে সংখ্যাও হুবহুব এক! শুধু আলাদা মাঝের দুটি নম্বর!
নম্বর গুলোকে দু চারবার খুঁটিয়ে দেখতেই ঈশানি বুঝলো সারাদিন ধরে ফোনের মালিকটি চেষ্টা করেছে ঈশানির সাথে যোগাযোগ করার! কারণ যে আটটা সংখ্যা (সামনের দিকের পাঁচটা এবং শেষের দিকের তিনটে) বারবার রিপিট করা হয়েছে আননোন লিস্টে সেই আটটা সংখ্যা ঈশানির নম্বর এর মধ্যেও একই ভাবে অবস্থিত!
বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো ঈশানির!
ফোনের টেক্সট মেসেজে যেতেই ঈশানির কাছে সব জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেলো!
একের পর এক মেসেজ সেন্ড করা হয়েছিল ফোনটি থেকে ঈশানি কে!
তাও নেই নেই করে তিরিশ চল্লিশটা মেসেজ তো হবেই, প্রতিটা মেসেজে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জিনিস লেখা –
“কি রে ফোনটা বন্ধ বলছে কেন? আর আমাকে ব্লক করেছিস কেন? ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, সবেতে ব্লক করে দিয়েছিস বোধহয়!
ঈশানি আমার কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে! ঈশানি আমি কিন্তু সত্যি বাড়ির বিয়ে ছেড়ে চলে আসবো গাড়ি নিয়ে তোর কাছে! ঈশানি প্লিজ ফোনটা ধর! আমি জানি গত দুদিনে কথা হয়নি একবারও, কিন্তু কি করতাম বল, হাওড়া থেকে ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো! তারপর থানায় রিপোর্ট করাতে গিয়ে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেলো!
কাল সারাদিন ভোডাফোন অফিসে বসে থেকে একই নম্বরের সিম জোগাড় যদিওবা করলাম, ফোনটা কেনা হয়ে উঠলোনা আর সেদিন রাতে!
তারপরের দিন ফোন কিনেও তোর নম্বরটা মনে পড়লোনা পুরোপুরি! আমি যে কেন তোর নম্বরটা ড্রাইভে বা সিমে সেভ করিনি! তারপর ইন্টারনেট টাও কাজ করছেনা এখানে! তারপর বাড়িতে বিয়ে!
আজকে ব্যাংকের সবাই আসার পর তোর নম্বরটা পেয়েই অনেক বার ট্রাই করছি যোগাযোগ করার, কিন্তু বারবার সুইচ অফ বলছে!
মেসেজ টা পরে প্লিজ রেস্পন্ড করিস! আমি খুউউব টেনশনে আছি রে!”
কয়েকটা মেসেজ আবার একটু অন্যরকম
“শরীর ঠিক আছে তোর?”
“আমার এক বন্ধুর নম্বর থেকে ফেসবুকে মেসেজ করলাম, রিপ্লাই করলিনা কেন? রেগে আছিস?”
ঈশানি মেসেজটা পড়তেই নিজের ফোনের messanger টা খুলে দিলো! ঠিকতো শঙ্খ রাই এর প্রোফাইল থেকে একটা মেসেজ!
মেসেজে ইংরেজিতে লেখা
“Hey! This is sankha, snigdha’s friend, can you please share your contact, snigdha lost his phone and so asked me to text you!”
ঈশানির পাথর হয়ে বসে রইলো খাটের ওপর বেশ কিছুক্ষণ, না মেলা হিসেব গুলো আসতে আসতে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো ঈশানির কাছে!
ফোনে স্নিগ্ধকে ব্লক করা, ফোনটা সুইচ অফ করে রাখা, স্নিগ্ধর বন্ধু শঙ্খর মেসেজ টা না পড়া! সব দোষতো ঈশানির একার এখানে! স্নিগ্ধর দোষটা কি ছিল এখানে!
ভাবতে ভাবতে বালিশ আঁকড়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে ঈশানি! সেই রাতে আর ঘুম আসেনা আর!
স্নিগ্ধর কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তা সে নিজেই বন্ধ করেছে দুহাতে!
সারাটা রাত নিজের মন কে বুঝিয়ে চলে ঈশানি, স্নিগ্ধর মনে যাই থাকনা কেন এই সম্পর্কের এমনিও কোনো পরিণতি নেই! তাই যা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে! সারাটা রাত ডাইরি লিখতে থাকে ঈশানি মন ভাঙার গান শুনতে শুনতে!
সকালে মুভার্স প্যাকার্স থেকে লোক এসে আসতে আসতে পুরো কোয়াটার খালি করে দেয় ঈশানির!
ঈশানি শুন্য মনে দেখতে থাকে খালি ফাঁকা ঘর গুলোকে, বাথরুমের আয়না টাকে যেই আয়নাতে নিজেকে বারবার দেখেছিলো ঈশানি, তারপর নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করছিলো একদিন!
বিকেলে জল খাবারের সময় সবাই উপস্থিত হলেও স্নিগ্ধ আজ নীচে আসেনি একবারও! আজ ঈশানি লাঞ্চেও যেতে দেখেনি স্নিগ্ধ কে!
কিন্তু একবার তো আজ দেখা করতেই হবে স্নিগ্ধর সাথে! স্নিগ্ধর সিম লাগানো ফোন, ওয়ালেট সব তো রয়ে গিয়েছে এখনো ঈশানির কাছে!
সন্ধ্যেয় আসতে – আসতে সবাই বেরিয়ে গেলে ঈশানি আবারো একবার দাঁড়ালো স্নিগ্ধর ঘরের বাইরের দরজায়, নক করার আগেই স্নিগ্ধ বললো
“ভেতরে আয়…..”
ঈশানি চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লো স্নিগ্ধর উল্টোদিকে মুখ করে!
তারপর আসতে আসতে ব্যাগ থেকে একে একে বের করলো ওয়ালেট ও ফোন, রেখে দিলো টেবিলের ওপর!
স্নিগ্ধর মুখে একটা ফেকাসে হাসি দেখলো ঈশানি, ঠান্ডা গলায় স্নিগ্ধ বললো
“এগুলো এতদিনে খুঁজে পেলি নাকি?”
“হ্যাঁ! কাল আসলে সব ড্রয়ার গুলো খুঁজতে গিয়ে
….আমি তো ওই ড্রয়ারে কিছু রাখিনা! ”
“আচ্ছা! বুঝলাম! তারপর কবে থেকে জয়েনিং, কাল না পরশু?”
“কালকেই….যদি সব ঠিকঠাক থাকে!”
“হমম……ঠিক আছে চল ভালো থাকিস!” বলেই স্নিগ্ধ ফাইল পত্র ঘাঁটতে শুরু করলো আবার!”
ঈশানি কাঁপা কাঁপা ও নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলো –
“আজ কিছু খেয়েছো?”
“হ্যাঁ! খেয়েছি….” স্নিগ্ধ একটা ছোট্ট উত্তর দিয়ে আবার চোখ রাখলো কম্পিউটারে……
“ওহ! না দেখলামনা বাইরে যেতে, তাই…..”
“বাড়ি থেকে রুটি আলুভাজা এনেছিলাম……!”
“নিজে বানাও, মানে চম্পার মা বলছিলো…..”
“হমমম! নিজেই, আর এখন তো আর তুই নেই যে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াবি! তাই নিজেই! সময় কাটেনা আজকাল, ঘরে ফিরে রান্না বান্না করলে ইদানিং সময় টা কাটছে ভালো! তাই আর কি!”
“পারছো করতে ? আগেতো পারতে না!”
“আগে তো তোর সাথে কথা না হলেও থাকতে পারতাম না! সারাজীবন ব্যাপার গুলো আগের মতন থাকেনা রে পাগলী!”
ঈশানি দেখলো স্নিগ্ধর চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠলো! ঈশানি চেয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে!
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, গলাটা একটু পরিষ্কার করে স্নিগ্ধ বললো –
“তাহলে চল! ভালো থাকিস!”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো, তারপর উল্টোদিকের আলমারিতে থেকে একের পর এক ফাইল বের করে চললো!
ঈশানি আসতে আসতে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই, স্নিগ্ধ ঘুরে দাঁড়ালো ঈশানির দিকে চেয়ে, এবারে ঈশানি দেখলো স্নিগ্ধর ভিজে দুটো চোখ!
স্নিগ্ধ আর চোখের জল লুকোলো না আলমারির দরজার পেছনে! গলাটাও পরিষ্কার করলো না, কান্না মাখা ভাঙা ভাঙা গলায় বললো –
“ওহ্হো! ভুলে গিয়েছিলাম দেখ! অগ্রিম জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা! খুব খুব ভালো থাকিস! তোর জীবনের আগামী দিন খুব ভালো কাটুক! তোর জন্যে ……” আর কিছু বলেনা স্নিগ্ধ শুধু একটা ক্যাডবেরি রেখে দেয় টেবিলের ওপর আর তারপর ঘুরে আবার আলমারিতে বাইরে বের করা ফাইল গুলো একে একে ঢোকাতে থাকে!
তারপর হঠাৎ বেশ চিৎকার করেই বলে –
“ঈশানি! কিছুনা বলার থাকলে প্লিজ চলে যা! আর ফিরে আসিসনা কখনো!”
রাত বারোটায় ফোন আসে কৌশানির –
“হ্যালো দিভাই! হ্যাপ্পি বার্থডে!”
“থ্যাংক ইউ……”
“কিরে আমিই প্রথম উইশ করলাম তো?”
ঈশানি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে ফোনটা ধরে!
“কি রে দিভাই…..আমিই প্রথম তো?”
“হ্যাঁ রে পাগলী! তুইই প্রথম!”
“দিভাই আগামী রবিবার আসছি আমি! জমিয়ে আড্ডা দেব! ততদিন প্লিজ ভালো থাকিস! কেমন?”
(চলবে……)