বেমানান!
পর্ব – ৮ কথা ছিল সাথে তোর, বলা হলো শেষ না!
আরও মাস দুয়েক পরের কথা, ডিসেম্বরের শুরুর দিক!
ব্যাংক থেকে ফিরে কোনোরকমে জুতোটা বাইরে ছেড়ে, হাত পা না ধুয়েই ঈশানি ঘরের খাটে গিয়ে বসে পড়লো……
ডাইনিং এর একটা টিমটিমে আলো ছাড়া পুরো কোয়াটারের আর কোনো ঘরে আলো জ্বালালো না ঈশানি, ক্লান্ত বিদ্ধস্ত চোখে মুখে,, বাইরের জামা কাপড়েই বসে রইলো খাটে……
তারপর আসতে আসতে গা টা এলিয়ে দিলো খাটের ওপর! অনুভব করলো বুকটা যেন কেমন একটা চাপ ধরে আছে!
চাপা কান্নায় মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোলোনা ঈশানির, তবু চোখ বেয়ে জল নেমে এলো অঝোরে!
অথচ দুদিন আগেও সবটা ঠিক ছিল ওদের মধ্যে!
গত পরশু রাতেও ঘন্টা খানেক কথা হয়েছিল দুজনের,,,
ঈশানির কেমন যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, স্নিগ্ধ মুখে সোজাসোজি কিছুনা বললেও ভালোবাসে ঈশানি কে! সবকথা গুলো হয়তো স্নিগ্ধ গুছিয়ে বলতে পারেনি কখনো!
আবার কখনো কখনো মনে হয়েছিল কোথায় কিছু বলেনি? মাঝে মাঝেই তো বলে মিস করছিলাম তোকে! মিস করছিলাম মানে কি? সব ভালোবাসার প্রপোজ তো সমান হয়না! আবার মাস দুয়েক আগের সেই মেসেজ টা – “ঈশানি….তোকে কিছু বলতে চাই , আর পারছিনা….” যেটা নিমেষেই ডিলিট করে দিয়েছিলো, সেগুলো কি ভালোবাসার অভিপ্রকাশ ছিলোনা?
গত পরশু দিন রাতের ট্রেন ছিল স্নিগ্ধর, কলকাতায় যাওয়ার, স্নিগ্ধর কাকুর মেয়ের বিয়ে, স্নিগ্ধ দেড় জয়েন্ট ফ্যামিলি, কাজেই পুরোটাই ছিল স্নিগ্ধদের বাড়ির অনুষ্ঠান! ঈশানি তো বটেই, ব্যাংকের সব স্টাফ দেড় নিমন্ত্রণ ছিল স্নিগ্ধদের অনুষ্ঠানে!
গত পরশু রাত অব্দিও ঈশানি বুঝতে পারছিলোনা স্নিগ্ধদের বাড়ির অনুষ্ঠানে ঈশানির যাওয়া টা ঠিক হবে কিনা? কারণ অফিসের এক মাত্র মহিলা কর্মী মাধবী দেবী যাচ্ছিলেন না সেই অনুষ্ঠানে, এদিকে দিন দশেক পর আবার ঈশানির বোন কৌশানির বিয়ে,,,, তখন আবার ছুটি লাগবে দিন সাতেকের,,,,
কাজেই স্নিগ্ধর বাড়ির অনুষ্ঠানের শেষে যে, দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে সরাসরি নিজের বাড়ি গিয়ে দু-চার দিন ছুটি কাটাবে তারও উপায় ছিলোনা ঈশানির!
স্নিগ্ধ গত পরশু দিন বলেছিলো – “দেখ কি করবি, বুধবার রাতে এলে এখান থেকে সোজা বাড়ি চলে যাস,, মানে ওদের সাথে অত রাতে ট্রেনে আর মিদনাপুর ফিরতে হবেনা! ইন ফ্যাক্ট আমি ঠিক শান্তি পাবনা! শুনছিস রে?”
গত পরশু রাতের এই কথাটাই ওদের বলা শেষ কথা ছিল! তারপর থেকেই স্নিগ্ধর একটা ফোন ও আসেনি এখনো পর্যন্ত!
******************************************************
গতকাল ব্যাংকে গিয়ে ঈশানি দেখলো বাকিরা মত্ত স্নিগ্ধর বাড়ির অনুষ্ঠানে যাবে বলে, সুদীপ্ত বাবু পান চিবোতে চিবোতে ঈশানি কে জিজ্ঞেস করলো – ” কি রে শুনলাম তুই যাচ্ছিস না কাল, কি ব্যাপার? তুই না গেলে স্নিগ্ধর কত মন খারাপ হবে বলতো!” বলেই ওরা হো-হো হাসতে শুরু করলো!
প্রতিবারের মতন চুপচাপ বসে রইলো ঈশানি!
ইদানিং ওদের টন্ট টা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো ঈশানির, আজ কথাটা শুনে সেরম খারাপ লাগলোনা তাই আর,,,,
তবে একটু মনটা খারাপ ছিল এমনিই, যদিও কারণ টা ছিল অন্য!
ঈশানির গল্পের ম্যাজিকম্যান যে ছুটিতে ছিল বেশ কিছুদিন ,,,,,সকালের মর্নিং ওয়াক টাও তাই সারতে হয়েছিল একাই ,,,,,
ম্যাজিকম্যান মানুষ টা সত্যি নিমেষে ম্যাজিক করে মুছে ফেলে ঈশানির সব কষ্ট, দুঃখ! আর সেই মানুষটার সাথে একটাবারও কথা হয়নি সকাল থেকে ,,,,এতক্ষণে তো নিশ্চই পৌঁছে গিয়েছে ঘরে! তবে পৌঁছে ফোন করলোনা যে এবার!
“তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ঈশানি? কিছু মনে করবিনা তো!” মাধবী দেবীর ডাকে ঈশানি বেরিয়ে এলো চিন্তার জগৎ টা থেকে,,,,,মৃদু হেসে বললো –
“বলোনা কি বলবে? ”
স্নিগ্ধর পর মাধবী দেবীই তো ছিল এই ব্যাংকে যে ঈশানির একটু হলেও খেয়াল রাখতো! যদিও স্নিগ্ধর বারণের জন্যেই আর সেরকম ব্যক্তিগত কথা ইদানিং ঈশানি বলতো না মাধবী দেবীকে …
মাধবী দেবী গলাটা বেশ নীচু করে প্রশ্ন করে ঈশানি কে – “বাড়ি থেকে আর ছেলে দেখছেনা তোর?”
ঈশানি একটু …..না…. মানে….. কিন্তুর… পর বলে – “আপাতত নয়, কিন্তু এই বছরের শেষে……”
“এই বছরের শেষে কি! বিয়ে? পাত্র কই?”
ঈশানি কিছু উত্তর দেয়না, চুপচাপ ফাইল, খাতা পত্র গুলো বের করে আসতে আসতে গোছাতে থাকে টেবিলের ওপর…..
মাধবী দেবী গলাটা পরিষ্কার করে আবার বলা শুরু করে – “এই মেয়ে,,,, আমি তোর মায়ের মতন, তাই তোর ভালোর জন্যেই বলছি স্নিগ্ধ কে নিয়ে স্বপ্ন দেখিসনা!”
ঈশানির বুকের ভেতর টা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো! হাত-পা গুলো নিমেষেই যেন মনে হলো কেমন অসার হয়ে এলো!
ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মাধবী দেবীর দিকে কিছুক্ষণ …..
খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো স্বপ্ন দেখবনা কেন?
তারপর নিজেকে একটু সামলে, একটা মিথ্যে হাসি দিয়ে নিমেষেই বললো –
“নাহ! মাধবী দি সেরম কিছু নয়!”
ঈশানি নিজেও বুঝলোনা কেন এরমটা মুখ দিয়ে বেরোলো ঈশানির……
“না হলেই ভালো! নয়তো কোথায় ডাক্তার শুভঙ্কর ব্যানার্জির পরিবার আর কোথায় আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার! ….
ওদের স্ট্যাটাসের সাথে কি আর আমাদের মেলে?”
ঈশানি হতবম্ব দৃষ্টি তে মাধবী দেবীর দিকে চেয়ে বললো –
“শুভঙ্কর ব্যানার্জি মানে? কার্ডিও শুভঙ্কর ব্যানার্জি, মিসেস শর্মিলা ব্যানার্জি? সেই শুভঙ্কর ব্যানার্জির কথা বলছো কি তুমি?”
“হ্যাঁ! কার্ডিও শুভঙ্কর ব্যানার্জি ও শর্মিলা ব্যানার্জি – ফেমাস কার্ডিওলজিস্ট! ওদেরই তো একমাত্র ছেলে স্নিগ্ধ ব্যানার্জি!
কেন তুই জানতিস না, স্নিগ্ধর সাথে তোর এতো কথা হয় তুই এটা জানতিস না?
স্নিগ্ধও তো মেডিক্যাল কলেজে এক বছর পড়েছিল, তারপর বোধহয় কিছু একটা শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর পড়তে পারেনি, তারপর তো বোধহয় ফিজিক্সে মাস্টার্স করে এই চাকরিতে…..
তুই জানতিস না এটা?”
এক অদ্ভুত ঝড় বয়ে যায়,,,, ঈশানির মন জুড়ে! কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারেনা! স্নিগ্ধ শুভঙ্কর ব্যানার্জির ছেলে! কই বলেনি তো কখনো!!
ঈশানি কিছু উত্তর দেয়না! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাধবী দির দিকে ,,, মাধবী দি বলে চলে –
বড় বড় লোকের বড়ো বড়ো ব্যাপার! আইটিসি রয়েল বেঙ্গল না কি বেশ নাম বললো! কার্ডের ওপর লেখা ছিল, ঠিক মনে পড়ছেনা! ওখানেই তো ওর খুড়তোতো বোনের বিয়ে,,,,ফ্যামিলি তে সবাই ডাক্তার! দিদি জামাইবাবু তো লন্ডনে থাকে!
ওরাও দুজনেই শুনেছি ডাক্তার! তারপর আবার ব্রাহ্মণ! আমাদের সাথে কি আর মিল খায়? তাও যদি তুই খুব সুন্দরী হতিস তাও না হয় ……!” কথাটা শেষ না করেই হঠাৎ থেমে যায় মাধবী দেবী…..
ঈশানির বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কোল বেয়ে!
কোনোরকমে চোখের জলটা মুছে ফেলে, কম্পিউটারে একটু আগে ওপেন করা এক্সেল ফাইলটা খুলে এক মনে চেয়ে রইলো ঈশানি…. মাউসটা নিয়ে এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করতে থাকলো কোনো কারণ ছাড়াই!
চোখের সামনেটা আবার ঝাপসা হয়ে এলো!
************************************************
মিনিট দশেকের মধ্যেই শুরু হলো ব্যাংকিং আওয়ার্স…..
হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ঈশানির মনটা পরে রইলো ফোনের দিকে!
প্রাণটা কেমন যেন ছটফট করছিলো স্নিগ্ধর সাথে একটাবার কথা বলার জন্যে!
বেলা তখন তিনটে, তখনও অবধি স্নিগ্ধর ফোন এলোনা!
কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো ঈশানির! মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো অনেক কিছু!
মাধবী দি হঠাৎ আজই কেন এতো গুলো কথা বললো ঈশানি কে!
আবার আজকেই স্নিগ্ধ ফোন করলোনা একটাও! হিসেব মতন তো ভোর বেলায় ফোন করার কথা ছিল! সবটাই প্ল্যান? কি প্ল্যান?
নিজের মনটা কে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে অনেক শান্ত করার চেষ্টা করলো ঈশানি –
“বাড়িতে বিয়ে, হয়তো লোকজন আছে অনেক, তাই একটু দেরি হতেই পারে!”
তবু মাথা তর্ক করে চললো মনের সাথে –
“……তাই বলে বেলা তিনটের পরও ও ব্যস্ত! এতো কিসের ব্যস্ততা! নাকি আমি মানুষটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নই…..”
মনটা ভীষণ ছটফট করছিলো ঈশানির! মাধবী দেবীর চোখ এড়িয়ে কোনো রকমে ফোনটা ঈশানি নিয়ে এলো ওয়াশরুমে,,
সত্যি তো ঈশানীরও তো বন্ধুক্তের কিছু কর্তব্য আছে! মনে মনেই ভাবলো শেষ বার ঈশানি জন্মদিনে ফোন করেনি বলেই স্নিগ্ধর রাগ হয়েছিল! অন্য কিছুনা হোক, শুধু বন্ধু হিসেবে একটা ফোন করা যেতেই পারে! তারপর টেনশনও হচ্ছে ভীষণ! ছেলেটা ঠিকঠাক পৌঁছলো কিনা?
বুকের ভেতর টা কেমন ঢিপঢিপ করছিলো ঈশানির, তবুও স্নিগ্ধর নম্বরটা ডায়াল করলো ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে!
অটোমেটেড ভয়েস বারেবারে বলে গেলো এক কথা – “যে নম্বরটি তে আপনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন, সেটি এখন বন্ধ আছে, দয়া করে কিছু সময় বাদে আবার চেষ্টা করুন!”
Switched Off! পৌঁছে একটা ফোন করার প্রয়োজন বোধ করলোনা স্নিগ্ধ?
একবার, দুবার, আটবার, দশবার করতে করতে রাত দশটার ভেতরে নেই নেই করে উনচল্লিশ বার ডায়াল করে ফেললো স্নিগ্ধর নম্বরটা!
বারবার ওই একই অটোমেটেড ভয়েস সেই একেই কথা শুনিয়ে গেলো ঈশানি কে!
রাতভর জেগে রইলো ঈশানি! ফোন এলোনা, ফোন লাগলোনা,,, ভেতরে ভেতরে ভীষণ টেনশন হচ্ছিলো ঈশানির! স্নিগ্ধ ঠিক আছে তো?
মনের ভেতর আজে বাজে চিন্তা আসছিলো ঘুরে ফিরে! সারারাত ফোনেই নিউস চেক করতে থাকলো ঈশানির! সেরকম বাজে খবর তো কিছুনেই! কিন্তু স্নিগ্ধর কিছু হলোনা তো!
********************************************************
ভোর সাড়ে চারটে……
হোয়াটস্যাপে এখনো স্নিগ্ধর লাস্ট সীন দেখাচ্ছিলো দুদিন আগেকার তারিখ!
মনে মনেই ভগবানের কাছে কাতর প্রার্থনা করতে থাকে ঈশানি! মনে মনে বলে চলে – “ভগবান কিচ্ছু চায়না,, ওকে ভালোবাসতে হবেনা আমাকে,,, শুধু একটা খোঁজ দাও! শুধু যেনতেন প্রকারে একবার একটা খোঁজ দাও যে ও ভালো আছে! ব্যাস!”
এসব ভাবতে ভাবতেই অবচেতন মনেই ঈশানির আঙ্গুলটা পরে যাই ফেসবুক আইকনে…
,,, আর ফেসবুক খুলতেই একটা বড়ো গ্রূপের সাথে স্নিগ্ধর একটা হাসি মুখের ছবি!
“যাক! বাবা,,, এই তো ও ঠিক আছে! ও….ভালো আছে!”
মনটা এক মিনিটের জন্যে শান্ত হলেও পরক্ষণেই ঈশানির মাথাতে নাড়া দেয় প্রশ্ন – “সব ঠিক আছে তো স্নিগ্ধ ফোন করলোনা কেন এখনো! মাধবী দেবীই বা কালই এই সব কথা কেন বললো? স্নিগ্ধ বলেছে কিছু? কি বলেছে? আর স্নিগ্ধর ফোনটাই বা বন্ধ কেন?
ঈশানি আবার হাতে ফোনটা নিয়ে আরও একবার ডায়াল করলো স্নিগ্ধর নম্বর……সেই একই কথা বলে যাচ্ছিলো অটোমেটেড ভয়েস!
এখনো অফ? কিন্তু কেন?
******************************************************
আজ সকালে একটু আগেই পৌঁছলো ঈশানি ব্যাংকে!
অনেক ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বের করলো স্নিগ্ধর বাড়ির ল্যান্ড লাইন নম্বরটা! শুধু একটা বার স্নিগ্ধর সাথে কথা হলেই মনটা অনেকটা শান্ত হয়ে যেত ঈশানির…..
মনের ভেতরের ছটফটানি টা বেড়েই চলেছিল প্রতি ঘন্টার সাথে,,,,
কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলো স্নিগ্ধর ল্যান্ডলাইন নম্বর……
রিং বেজে গেলো,,, কেউ ধরলোনা ফোনটা……!!
********************************************************
ঘড়িতে ঠিক ৫:০০….
মনটা কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলোনা ঈশানি!
বিকেলে আজ বাকিরা একটু আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধর বাড়ির অনুষ্ঠানে যাবে বলে! ঈশানির একবার মনে মনে ইচ্ছে হলে ওদের সাথে যেতে,,, কিন্তু কোনো রকমে নিজের মন কে বুঝিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সিটেই………
আজ মাধবী দেবীও ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছে অফিস থেকে!
তাই স্নিগ্ধ কে বারেবারে ফোন করতে কোনো বাঁধা রইলো না ঈশানির!
কাল সকাল থেকে আজ সন্ধ্যের মধ্যে মোটমাট প্রায় নব্বই বার ফোন করেও যোগাযোগ করতে পারলোনা ঈশানি!
এমনকি ল্যান্ডলাইনে নেই নেই করে পাঁচ বার ফোন করে ফেলেছিলো আজ সকাল থেকে….একটা শেষ চেষ্টা করবে?
একটা শেষ চেষ্টা করবে বলে ঈশানি আবারো ডায়াল করলো স্নিগ্ধর বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা,,,, দু চারটে রিং হতে না হতেই ঈশানি ওপাশ থেকে একটি মেয়ের গলা পেলো –
“হ্যালো…..”
এক মিনিটের জন্যে ঈশানি কিছুতেই বুঝতে পারলোনা কি বলবে এবার!
ফোনটা কেটে দিলো সাথে সাথে!
মিনিট দুয়েক পর মনে মনে একটা হিসেবে কোষে আবার ডায়াল করলো ল্যান্ডলাইন নম্বর টা, এবারে একটা রিঙের পরেই ঈশানি শুনলো একই ভদ্রমহিলার গলা –
“হ্যালো কে বলছেন?”
“স্নিগ্ধ স্যার কে একটু দেওয়া যাবে? আমি ঈশানি….”
“হ্যালো একটু জোরে বলুন,,,,,কাকে চায়?”
“স্নিগ্ধ স্যার আছে? ”
“কি দরকার স্নিগ্ধর সাথে?” বেশ কাটকাট গলায় প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা?
“ওই কিছু লোনের ব্যাপারে……”
“না! না! লোন লাগবে না এখন! আপনি রাখুন…”
“হ্যালো ম্যাডাম!……”
আর কোনো উত্তর এলোনা ফোনের ওপাশ থেকে,,,,শুধু ঈশানি শুনলো ভদ্রমহিলা খুব সম্ভবত তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে বললো –
“যত সব ফালতু ফোন! স্নিগ্ধ যে কেন এতো এন্টারটেইন করে এই ধরণের মেয়ে গুলোকে আমিতো বুঝিনা!…….”
“এই ধরণের মেয়ে” ও “মেয়ে গুলো” এই দুটো কথা শোনার পর ঈশানি আর বসে থাকতে পারলোনা নিজের সিটে,,,,ব্যাগ নিয়ে সোজা হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে!
সারাটা পথে একিই কথা ভেবে গেলো ঈশানি,, এই ধরণের মেয়ে মানে ঠিক কোন ধরণের মেয়ে!
নীচু স্টেটাস! আর ভদ্রমহিলা ওভাবে কেন কথা বললেন?
আর মেয়ে গুলোকে এন্টারটেইন করে মানে কি? কটা মেয়েকে এন্টারটেইন করেছে স্নিগ্ধ!
কোয়াটারে ঢোকার আগেই চম্পার মা কে ফোন করে বললো সেই রাতে না আসতে, বাড়িতে কোনো রকমে একটা ফোন করে কোয়াটারের ঘরের বাইরে জুতো খুলেই বসলো গিয়ে অন্ধকার ঘরের খাটে…..
আসতে আসতে শরীরটা খাটে এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকলো শেষ দুদিনের কথা!
আর তারপর ফোনটা অফ করে চুপচাপ শুয়ে রইলো বিছানার ওপর চিৎ হয়ে! আজ জামা কাপড় ছাড়ার বা মুখ হাত ধোয়ার মতন ও শক্তি ছিলোনা ঈশানির!
নিজেকে দোষ দিতে থাকলো ঈশানি মনে মনেই!কি ভাবে আর কবে থেকে এই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো সে! স্নিগ্ধ তো বরাবরই একটা চাওয়া পাওয়ার হিসেব ছাড়া মনের এক কোণায় লুকিয়ে রাখা একটা ভালোলাগা মাত্র! তাহলে? অনাহূতের মতন কাল রাত থেকে কেন ডায়াল করে চলেছে স্নিগ্ধর নম্বর! ছি! একশো বার ডায়াল করেছে কাল থেকে আজ অবধি সেই নম্বর!
কত স্বপ্নই না দেখেছিলো ঈশানি শেষ কয়েক মাসে, এই বুঝি আজই স্নিগ্ধ বলবে সব মনের কথা!
অথচ সে – কি স্বার্থপর! এক নিমেষেই কেমন পর করে দিলো ঈশানিকে!
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আর স্নিগ্ধর সাথে এক মুহূর্ত নয়,,,,,,, শুয়ে শুয়েই ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে ব্লক করে দিলো স্নিগ্ধর হোয়াটস্যাপ, মোবাইল সব নম্বর! আর তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে শুয়ে রইলো বিছানায়….
সত্যি তো স্নিগ্ধ আর ঈশানি সব দিক থেকেই বড্ডো বেমানান! স্টেটাস, লুক্স, কাস্ট,,,,,,,, কোনো দিক থেকেই ঈশানির সামর্থ ছিলোনা স্নিগ্ধর পাশে দাঁড়ানোর! আর স্নিগ্ধ বোধহয় এবার সবটা বুঝেই ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে!
বা – ওখানে হয়তো অন্য কোনো গার্ল ফ্রেন্ড আছে, হয়তো মাধবী দি সেটা জানে! তাইতো বললো কাল ও কথা!
হ্যাঁ না জানার কিছুই নেই! স্নিগ্ধর বাবা যে শুভঙ্কর ব্যানার্জী সে খবরও তো জানা ছিলোনা
ঈশানির, অথচ বাকিরা তো দিব্বি জানে সব, হয়তো একিই ভাবে স্নিগ্ধর গার্ল ফ্রেন্ডের কথাও জানে ওরা!
স্নিগ্ধ কে না বলা কথাগুলো মনে মনেই কবর দিয়ে ফেললো ঈশানি!
স্নিগ্ধ কেন, আর কেউ জানবেনা কখনো – যে ঈশানি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো স্নিগ্ধ কে – এতটা যতটা হয়তো আজ অবধি কেউ কাউকে বাসেনি!
আজ অংশুমানের কথাও একবার মনে পড়লো ঈশানির!
অংশুমানের সময় সবাই বলেছিলো ঈশানিকে যে অংশু ভালোবাসেনা তাকে !
শুধুই জড়িয়ে ছিল কিছু স্বার্থ! ঠিক যেমনটা সবাই বলেছিলো ঠিক তেমনটাই হয়েছিল কিছুদিন বাদে!
ছোটবেলার একটা লাইন মনে পরে গেলো ঈশানির – “History repeats itself!”
ভাবতে ভাবতে ঈশানির কখন যে চোখ দুটো বুঝে এলো সে নিজেও জানলোনা!
মাঝ রাতে ঘুমটা যখন একটু আলগা হয়ে এলো মাথাটা ভীষণ ভারী লাগছিলো ঈশানির যেন মাথায় একটা বড়ো বাটখারা বাঁধা! ভীষণ শীত শীত করছিলো ঈশানির, শরীরে জোর নেই যে কম্বলটা টেনে গায়ে বিছিয়ে নেবে নিজের, ভীষণ দুর্বল শরীরে সিঁটিয়ে পরে থাকলো কুঁকড়ে খাটের উপর! গলাটা শুকিয়ে এলো, তবু আসে পাশে জলের বোতল দেখতে পেলোনা ঈশানি আধ- খোলা চোখে অন্ধকার ঘরে!….
হঠাৎ খানিক বাদে ঘুমের ঘোরে মনে হলো যেন ঈশানির ম্যাজিকম্যান ঈশানির পাশেই বসে!
ঈশানির মনে হলো যেন কেউ খুব আলতো স্পর্শে আসতে আসতে গলায় জড়ানো ওড়নাটা খুলে ফেললো, আর তারপর কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলো ঈশানির কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটা কে, মনে হলো যেন জলের সাথে মিশিয়ে কিছু একটা খাবার নামলো খাদ্য নালী বয়ে, তারপর আরও একটু জল! তেতো জল!
মনে হলো খুব যত্নে কেউ খুব একটা ঠান্ডা স্পর্শ করছিলো ঈশানির কপালে বারবার, মনে হচ্ছিলো যেন এক কুচি বরফ পড়লো ঈশানির চোখের পাতায়! ভীষণ ভারী লাগছিলো চোখের পাতাটা! ঈশানি তাকাতে পারলোনা চোখ খুলে!
ঘুমের ঘরেই ঈশানির মুখ থেকে বেরিয়ে এলো – “স্নো কুইন!”
তুষার রানী বা স্নো কুইন – রূপকথার এমন এক চরিত্র যে আঘাত করতো সহজ সরল মানুষদের বরফের কুচি দিয়ে, সেই বরফের কুচি চোখ দিয়ে প্রবেশ করে পৌঁছতো হৃদয়ে আর তারপর সেই বরফের কুচি সেই মানুষটির হৃদয় থেকে মুছে ফেলে দিতো সব ভালোলাগা, সব ভালোবাসা, শুধু রেখে যেত ঘৃণা ও বিকৃত চিন্তা ভাবনা!
(চলবে …..)