বেলাশেষে,পর্ব ২ অন্তিম

0
1512

#বেলাশেষে,পর্ব ২ অন্তিম
#ছোটগল্প

কলেজের গেটের বাইরে ছুটির পর পা রাখতেই মনটা ছটফট করছিল কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার আশায় । সারাদিন অপেক্ষায় থেকে এখন শেষ পর্যন্ত দেখা পেয়েও গেলো … ওই তো সাগ্নিক , বাইক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে __ অবাক চোখে দেখলো সৌমি , চিরটাকাল সবরকমের নেশা থেকে দূরে থাকা ছেলেটার ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট ।

এমনি কোনো এক ফাল্গুনের তপ্ত দুপুরে সৌমির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়েই সাগ্নিক বলেছিল ,
” এর কাছে সব নেশা ফেল ”,
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো , সময় সবকিছু কতটা বদলে দেয় ।

সৌমিকে সামনে দেখে চট করে সিগারেটটা ফেলে একটু অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো সাগ্নিক , হাত দুটো পিছনে নিয়ে অসামঞ্জস্য ভাবে সিগারেটটা পা দিয়ে তড়িঘড়ি নেভাতে একপ্রস্ত যুদ্ধই করলো বটে , সৌমিলি সেদিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়লো ,
” ও এসে গেছিস ! কখন এলি ? ”
সৌমি কিছুটা রাগ নিয়েই বললো , ” যখন সিগারেট টানতে ব্যস্ত ছিলি ”
এই জিনিসটা বরাবরই অপছন্দের সৌমির , সাগ্নিক সেটা জানে __ কিন্তু আর কথা বাড়ালো না , হাত দুটো পিছনে রেখেই মৃদু হাসলো শুধু ।

বিচ্ছেদের তিনবছর পরও প্রাক্তনের পছন্দ অপছন্দের এতটা খেয়াল রাখা যায় !
” প্রাক্তন ” , হ্যাঁ প্রাক্তনই তো বটে __ কেঁপে উঠলো সৌমীর মনটা , ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা , যে একদিন সম্পূর্ণ রূপে তার ছিল , আজ সে প্রাক্তন । সারাদিন এই প্রাক্তন এর অপেক্ষাতেই তো ছিল সৌমিলি ।
কিন্তু মন কি মানে ? বিচ্ছেদের তিনবছর পরও দুজনের দুজনের প্রতি সেই একি রকম অধিকারবোধ , একে অপরের পছন্দ অপছন্দ সবটুকু জানা __ সত্যি কি ” প্রাক্তন ” শব্দটার সাথে এগুলো যায় ?
কে জানে হয়তো যায়, বা হয়তো যায়না । কেউ কেউ বেলাশেষে একিভাবে মনের কুঠুরিতে স্থান দিয়ে যায় তার তথাকথিত প্রাক্তনকে ।

গড়ের মাঠে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকক্ষণ নীরবতার পর সাগ্নিক শেষ অবধি জিজ্ঞেস করেই বসলো ,
” সবটা কি আমাকে একবার বলে যেত না সৌমি ? শুধু শুধু ওই নাটকগুলোর কোনো প্রয়োজন কি সত্যিই ছিল ? কি লাভ হলো বলতো , না পারলাম আমি ভালো থাকতে আর না ভালো থাকলি তুই ! ”
সাগ্নিক এর কথাগুলো অভিযোগ নাকি অন্যকিছু , ঠিক ধরতে পারলো না সৌমি , তবে কথাগুলো কর্নকূহর বরাবর প্রবেশ করে অডিটরি নার্ভ কর্তৃক মস্তিষ্কে আঘাত করতেই চমকে উঠলো সৌমিলি , ” না … নাটক !! মানে কি বলতে চাইছিস তুই ? ”

সাগ্নিক হাসলো , একেই বোধহয় বলে তাচ্ছিল্যের হাসি … ” আচ্ছা সৌমি , তোর সেই যার সাথে বিয়েটা ঠিক হয়েছিল … হলো না শেষ পর্যন্ত ? তোর রোজগেরে হাসব্যান্ড ! শেষ অবধি …

দাঁতে দাঁত চাপলো সৌমিলি , তিনবছর আগের কথাগুলো এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে সে যথেষ্ট অপ্রস্তুতও বটে ।সৌমির জানা মতে ওদেরই কোনো এক বন্ধুর কাছেই সবটা শুনেছে সাগ্নিক , অতএব মিথ্যেটা যে এখানে আর খাটবে না ।
সকাল থেকে ওর প্রত্যাশায় এতটাই মশগুল ছিল যে একবারও তো তখন ভেবে দেখেনি, সাগ্নিক এর মুখোমুখি হলে তিনবছর আগে ফেলে আসা এই সত্যের সামনেও যে দাঁড়াতে হবে ! কি উত্তর দেবে তখন ?

কিই বা বলার আছে , বলবে যে আমার মৃতপ্রায় বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে জলাঞ্জলি দিয়েছি নিজের স্বপ্ন , নিজের ভালোবাসা ! কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে কথাটা ? আদৌ কি মেনে নেবে সাগ্নিক ? সেদিন যে বিষাক্ত কাঁটায় জর্জরিত করে ফিরিয়ে দিয়েছিল সাগ্নিককে …তখন তো একবারও খোঁজ নিতে পারেনি রক্তাক্ত মনটার । তবে আজ কিসের অধিকারে কোন মুখেই বা চোখ রাখবে সাগ্নিকের চোখে ?

নিজেকে করা নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যখন ব্যস্ত সৌমিলি , সাগ্নিক আবার বলে উঠলো , ” বললি না তো বিয়েটা হলো না কেনো ? ” ,
বড্ড নির্লিপ্ত শোনালো স্বরটা , কিন্তু যেনো মনে হলো তাচ্ছিল্য করে গেলো একইসাথে !

সৌমি ঠিক ভেবে পেলো না , কি উত্তর দেবে … আমতা আমতা করে বললো , ” না.. মানে ______

” উত্তর নেই তো কাছে সৌমি , তুইও জানিস ! কেনো সেদিন এতবড়ো সিদ্ধান্তটা নিলি সৌমি ?প্রেমিক হিসেবে না হয় আর তোর যোগ্য ছিলাম না __ কিন্তু বন্ধু হিসেবেও কি এতটাই অযোগ্য ছিলাম যে একটাবার সত্যিটা বলে উঠতে পারলি না ? বিশ্বাস কর সৌমি , সেদিন সত্যিটা বললেও বন্ধুত্বের হাতটা কোনোদিনও ছেড়ে দিতাম না । আমাদের অত বছরের বন্ধুত্বটা এতটা দুর্বল প্রমাণ করে , সেটার অপমান না করলেই পারতিস রে ” …. , বেশ খানিকটা চড়লো সাগ্নিকের কঠিন গলার স্বর ,,
তবে কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেই আজ সৌমির মুখোমুখি হতে চেয়েছিল সে ।

বুকের ক্ষতগুলো নোনা জলের সাথে মিশে গাল বেয়ে চিবুকে এসে নামছে ক্রমাগত , ভাঙ্গা গলায় আপ্রাণ চেষ্টায় কান্নাটা আটকে বললো সৌমি ,
” আমাকে ক্ষমা করে দিস পারলে , আমি আমাদের বন্ধুত্বের অপমান করতে চাইনি __ আর না চেয়েছি তোকে অসম্মান করতে । আসলে পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে ______

” চাইলে সেটাও আমাকে বলতে পারতিস , কিন্তু বললি না … উল্টে কতগুলো মিথ্যে সাজিয়ে এনে দাঁড়ালি আমার সামনে ___ কেনো সৌমি ? একবারও কি মনে হলো না , যে তোকে এতগুলো বছর ধরে চেনে তোর এই অভিনয় তাকে ঠিক কতটা ভেঙে দিতে পারে ? তুই খুব ভালো করে জানতিস সৌমি , ঠিক কতটা ছিলি তুই আমার কাছে , তারপরও একবারও মনে হলো যে তোকে নিয়েই বেচেঁ থাকে সে __

ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেলে মৃদু , শরীর জুড়ানো হালকা হিমেল হাওয়ায় বিস্তৃত মাঠ এর একটা কোনে কোনো এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরতা এক রমণী , আর তার অত্যন্ত কাছে একটি যুবক । দৃশ্যটি নিশ্চিন্তভাবে চোখ জুড়ানো বটে , বিশেষ করে আনমনা লেখকের জন্য তো অবশ্যই ।
যুবকটির মুখে মেশানো অভিমান , তার শক্ত হাতে বাঁধা পরে অপরাধবোধে জীর্ণ , ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় কাতর তরুণীটি ।

কিন্তু এতকিছুর পরও সৌমির চোখের জল সহ্য হলো না সাগ্নিক এর , অবচেতনে হোক বা অজান্তে হোক .. যেভাবেই হোক অভ্যেসবশত হাতের আঙ্গুলগুলো মুছে দিলো চোখের জলটা__
বোধহয় বেলাশেষে কোনো এক নতুন বসন্ত সূচনায় অপেক্ষায় , উদ্বোধনে ডেকে উঠলো একঝাঁক নাম না জানা পাখি ।

” আ … আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না সাগ্নিক ; একদিকে বাবা .. অন্যদিকে তুই ! জীবনের সবথেকে দুটো প্রিয় মানুষের মধ্যে যদি কাউকে বেছে নিতে হয় __ কিভাবে সম্ভব সেটা ? ভেবেছিলাম তোকে দূরে সরিয়ে দিলে , আমাকে ঘৃনা করলে হয়তো নতুন করে আবার শুরু করার চেষ্টা করবি ! আমি চাইনি তোকে ভালোবাসায় আটকে রাখতে ____ আমাকে ঘৃনা করলে হয়তো একটা সময় ঠিক ভুলে যাবি সেটা ভেবেই ___

” কেনো এতো বোকা তুই সৌমি , কেনো ? কি করে ভাবতে পারলি তোকে ঘৃনা করা আমার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব ? ___ এতকিছু করে কি লাভ হলো বলতে পারিস ? না পারলি নিজে ভালো থাকতে আর না____ কথাটা শেষ হলো না , হয়তো শেষ করার ক্ষমতায় কুলালো না , তার আগেই সামনের তরুণীটি আবদ্ধ হলো তার তথাকথিত প্রাক্তনের বাহুডোরে ।

দুজনেরই চোখে জল .. স্থান কাল পাত্র সবকিছুর হিসেবের উর্ধ্বে গিয়ে দুটো অশান্ত , অতৃপ্ত মন একে অপরের স্পর্শে শীতল হতে ব্যস্ত ।

” ভালোবাসি সাগ্নিক ! খুব ভালোবাসি ___ ক্ষমা করে দিবি রে আমায় প্লিজ ___ বিশ্বাস কর আমি অমন কাজ করতে চাইনি , যতবার ভেবেছি তোর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো ততবার অপরাধবোধ আটকে দিয়েছে আমায় , পারিনি তোর চোখে চোখ রাখতে … কিন্তু সেদিনের একটা কথাও আমার মনের কথা ছিল না সাগ্নিক ” , সৌমীর চোখের জল আজ বাঁধ ভেঙেছে,

” আর কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে খুন করে ফেলবো তোকে , তারপর নিজে মরবো ”

কান্নাভেজা দুটো স্বরের স্নিগ্ধ , স্বচ্ছন্দ স্বীকারোক্তি … সূর্যটা আসতে আসতে পারি দিচ্ছে পশ্চিম দিগন্তের সীমারেখায় । বেলাশেষে যখন যে যার আপন নিরে ফেরার প্রস্তুতিতে , তখন একে অপরের বাহুডোরে দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যাস্ত সৌমি আর সাগ্নিক । দীর্ঘদিনের কাজের পর , বছরের শেষে যখন প্রবাসী ঘরে ফেরে , সেই শান্তি সেই স্বস্তিটুকু নিংড়ে নিতে মত্ত ওরা দুজন ।
কোনো এক বসন্তের বেলাশেষে এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য এভাবেই প্রমাণ করে দিয়ে যাবে , দূরত্ব কখনো ভালোবাসা কমাতে পারেনা ! প্রাক্তন হলেই মনের টান সবসময় কেটে যায়না … ঠিক এভাবেই হয়তো আরো সাগ্নিক – সৌমিলিরা প্রমাণ করে যাবে,আজও পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে … আজও মানুষ ভালোবাসায় বাঁচে । আজও বসন্ত বেলাশেষে ভালোবাসা নিয়ে আসে ।

সমাপ্ত

কেমন লাগলো ” বেলাশেষে ” ? জানিয়ে যেতে ভুলো না যেনো ❤️ #happyreading

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here