#বেলা_শেষে
#অন্তিম_পর্ব
জামান সাহেবের কথায় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহুল। সে ভেবেছিলো জামান সাহেব হয়তো তাকে কড়া কথা বলবেন, কিন্তু মেহুলকে সম্পূর্ণ অবাক করে তিনি বললেন,
— “তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আমি কখনোই আশা করি নি। আমি তো তোমাকে কখনোই রিমি কিংবা রাজীব থেকে আলাদা ভাবি নি। কিন্তু আমার মনে হয় না তুমি আমাকে নিজের বাবার মতো ভাবো।”
— “কেনো বাবা! আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
— “ভুল নয় অন্যায় করেছো। অন্য কারোর সাথে নয়, নিজের সাথে। তুমি অন্যায়টা নিজের সাথে করেছো, এবং এখনো করে যাচ্ছো। যে চলে গেছে তাকে ফেরানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় কিন্তু আগামী ভবিষ্যতকে আপন করার সুযোগ তো আছে আমাদের। জীবন কিন্তু খুব স্বার্থপর, সে সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। তোমায় হাসিমুখে সেই সুযোগ আলিঙ্গন করতে চাচ্ছে। তুমি তাকে ফিরিয়ে দিও না মেহুল৷”
— “কিন্তু বাবা…”
— “একটা কথা কি জানো তো, কোনো মানুষ একাকীত্বকে বরণ করতে পারে না। তোমার সম্পূর্ণ জীবনটাই পড়ে আছে মেহুল। আমি বলছি না একজন নারোর জীবন কাটাতে পুরুষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, আমি শুধু বলছি একজন মানুষের একজন নিবিড় বন্ধুর প্রয়োজন হয়। আর সেই বন্ধুটি তুমি ফারাবীর মাঝে ঠিক খুজে পাবে। ছেলেটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে, সম্মান করে। কোনো বদ গুন নেই তার, যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং সৎ ছেলে সে। তার চিন্তাধারাগুলো বেশ পরিণত। তোমার যেকোনো মতামতকে সে সম্মান করে। এমন মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের হবে না হয়তো। তাই আরেকটাবার ভেবে দেখো। শুনেছি ছেলেটা নাকি এই সপ্তাহের শেষে ঢাকা চলে যাবে। ওর চাকরি হয়েছে ঢাকায়।”
জামান সাহেবের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো মেহুল, ফারাবীর ঢাকায় চলে যাওয়া শুনে তার মনের আকাশে কালো মেঘের সঞ্চারণ হয়। বুকের ভেতরটা শূন্যতায় ছেয়ে গেলো। চোখটা জ্বালা করছে, এই বুঝি আকাশপাতাল ভেঙ্গে বর্ষণ নামবে আঁখিজোড়ায়৷ মেহুল নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে, যেনো তার চোখের লবণাক্ত ধারা জামান সাহেবের চোখে না পড়ে। জামান সাহেব মেহুলের মাথায় মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিলেন। পরম মমতাভরা কন্ঠে বললো,
— “তুমি যদি রাজী থাকো তবে আমাকে জানিও”
— “বাবা, ওবাড়ির কেউ আমাদের এই সম্পর্কটাকে মেনে নিবেন না।”
জড়ানো কন্ঠে ধীর স্বরে মেহুল বললো। জামান সাহেব স্মিত হাসি হাসলেন। তারপর বললেন,
— “বিয়ে দু পরিবারের হলেও সংসারটি কিন্তু দুটো মানুষের হয়। তারা সুখী হলে আশেপাশের মানুষগুলো এমনিতেই সুখী থাকে। পারিপার্শ্বিক বাঁধা তো থাকে, অগ্নির ভেতর দিয়ে যায় বলেই সোনার রঙ চকচক করে। আর একটা কথা, যখন সব রঙ হারিয়ে যায়, তখন ক্লান্ত পৃথিবী কালো রঙ বরণ করে নেয়; এই আশায় যখন নতুন সূর্য উঠবে তখন হাজারো রঙ্গের মেলায় নিজেকে বিলীন করবে সে। তাই এতো ভেবো না। শান্ত চিত্তে ভাবো, তুমি কি চাও!”
কথাটা বলেই জামান সাহেব প্রস্থান করলেন। মেহুল ছাদের কর্ণিশেই দাঁড়িয়ে রইলো। শীতল বাতাস বইছে। উড়ছে তার কালো ঢেউ খেলানো চুলগুলো। চোখ তার বিষাদসিন্ধুর বাঁধ ভাঙলো। চোখ বুঝে আকাশ পানে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রাত নিঃস্তব্দ, হাওয়া কথা বলছে তার কানে কানে;
“আর কত! আর কত অন্যের জন্য বাঁচবে। নিজের জন্য ও বাঁচো”
★
ফারাবী তার ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত। শেফালী বেগম তার দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলের রাগ সম্পর্কে তার বেশ ভালো করেই ধারণা আছে। চরম শান্ত ছেলেটি যদি একবার রেগে যায় তবে তার রাগ দমানো বহু কষ্টের হয়। আর সেই রাগের ফলাফল আজ ছেলের ঢাকায় একেবারের জন্য প্রস্থান। আজ মূলত মায়ের উপর রাগ করেই ঘর ছাড়ছে ফারাবী। নিজের ছেলের চোখেই আজ নিচু মনের মানুষের খেতাব পেয়েছেন শেফালী বেগম।
মেহুলের সাথে সেদিন শেষ বারের মতো কথা বলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাসায় ফিরলে ঘরের ছোট কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। ফারাবীর রুমটি শেফালী বেগমের রুম পেরিয়েই যেতে হয়। ফারাবী যখন নিজের রুমের দিকে এলোমেলো পায়ে যাচ্ছিলো তখন কানে আসে,
“তুমি চিন্তা করো না, মেহুলের ভুত তোমার ছেলের মাথায় বেশিদিন টিকবে না, আমি তো মেহুলকে চিনি মেয়েটার আত্মসম্মানের বেশ বড়াই। তাই এসব নিয়ে চিন্তা করো না”
মেহুলের হৃদয়বিদারক কথাগুলো তখনো ফারাবীর মস্তিষ্কে ঘুরছিলো। সেই সময়ে মায়ের এমন ধারা কথা শুনে বেশ অবাক হয় ফারাবী। অনুমতি বিহীন তার ঘরে প্রবেশ করে, প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মায়ের দিকে,
— “আত্মসম্মানের এমন কি ঘটেছে যে মেহুল তা রক্ষার্থে আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে?”
ছেলের প্রশ্নে হতচকিত হন শেফালী বেগম। করিম সাহেব ছেলের উপর বেশ চটে উঠেন,
— “একটা বাহিরের মেয়ের জন্য তুমি তোমার মাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারো না ফারাবী”
— “আমি তো প্রশ্নবিদ্ধ করছি না, কৌতুহল জাহির করছি। তবে সত্যি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়! আমার খুশির মর্ম কি আদৌ আছে? মা তুমি চিন্তা করো না, মেহুল আমাকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে আফসোস মেহুলের ভুত নামবে না। কারণ ভুতটা আমি মাথায় উঠিয়েছি। মেয়েটির তো দোষ নেই। লজ্জা করছে, আমার জন্য না জানি তাকে কি কি শুনতে হয়েছে!”
সেদিনের পর থেকে ফারাবী সিদ্ধান্ত নেয় এই বাড়িতে থাকবে না। এই শহরের প্রতি বড্ড অনীহা জন্মেছে তার। জোর পূর্বক ভালো থাকার অভিনয়টা সে যে করতে পারে না। ব্যাগটা গুছিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে শেফালী বেগম অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাবী তার কাছে যায়। মলিন হাসি একে বলে,
— “ভেতরে আসছো না যে?”
— “কেনো চলে যাচ্ছিস?”
— “ভালো লাগে না এখানে থাকতে, দিনে না হলেও সপ্তাহে তার দেখা মিলে যে, তখন অসহায় কাগে নিজেকে”
— “আমি তোর বাবাকে বলেছি, জামান ভাই এর সাথে কথা বলার কথা”
— “লাগবে না মা, তুমি যে বলেছিলে মেয়েটির আত্মসম্মানের বড্ড বড়াই”
ছেলের করুন অসহায় মুখখানা শেফালী বেগমের সহ্য হচ্ছে না। উচু, লম্বা ছেলেটিকে বড্ড রোগা লাগছে তার। না ঘুমের কোনো ঠিক আছে না খাওয়ার ঠিকানা। নিজের ব্যাস্ত রাখতে ব্যাস্ত সে। অহেতুক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। যেনো মেহুলের নিবিড় চিন্তাগুলো মনকে দূর্বল না করে। মেহুলের জন্য নিজের মায়ের সাথে সে খারাপ আচারণ করে নি। তবে তার উচ্ছ্বাসিত ছেলেটি যেনো কোথাও হারিয়ে গেছে। যা শেফালী বেগমকে ভেতর থেকে চুরমার করে দিচ্ছে। ফারাবী মায়ের মুখখানা আলতো করে ধরে বলে,
— “তুমি মন খারাপ করো না মা, আমি ঠিক হয়ে যাবো। আমার ভাগ্যেই মেহুল নেই, তোমার এতে কোনো দোষ নেই”
ফারাবীর মলিন হাসিটা শেফালী বেগমকে আরোও অপরাধবোধে কুড়ে কুড়ে খায়। নিজের স্বার্থপরতা আজ ছেলেটাকে বিষাক্ত যন্ত্রণা দিচ্ছে। ফারাবী সব কিছু গুছিয়ে নেয়। তার ট্রেন নয়টায়। এখন না বের হলে ট্রেন মিস হবে। ফারাবী নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিলো। শীতের সকালে ইজি বাইক পাওয়াটা বড্ড দুষ্কর। ফারাবী মাকে জড়িয়ে ধরে বেড়িয়ে পড়ে। আগামী পরশু তার এপোয়েনমেন্টের কাজ করতে হবে। সামনের সপ্তাহ থেকে জয়েনিং। তাই আজ ই রওনা দিচ্ছে ফারাবী। ঢাকায় থাকার ব্যাবস্থাটাও পাকাপাকি করতে হবে তাকে। সবার সাথে বিদায় নিয়ে ইজিবাইকে উঠে ফারাবী। গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। ইজিবাইক যখন মেহুলের বাড়ির সামনে থেকে যায় তখন দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ফারাবী। হয়তো আর দেখা হবে না তাদের_____
ফারাবী ট্রেন স্টেশনে পৌছায় নয়টা বাজার পনেরো মিনিট পূর্বে। স্টেশনের ভেতরে পৌছাতেই পা জোড়া আটকে যায় তার। নীল শাড়িতে এক রমনী দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের সামনে। যেনো রমনীটি তার অপেক্ষাতেই ছিলো। ফারাবী অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। রমনী এগিয়ে আছে তার দিকে। মুচকি হেসে বলে,
— “পালাচ্ছেন বুঝি?”
রমনী আর কেউ নয় বরং মেহুল। মেহুলের শান্ত মিহি কন্ঠের কথা শুনে কাঁধের ব্যাগটি পড়ে যায় ফারাবী। অবাক কন্ঠে বলে,
— “আপনি এখানে?”
— “পারলাম না নিজেকে আটকে রাখতে! বহুবার জিজ্ঞেস করলাম নিজেকে কি চাই আমার? উত্তরটা একটাই একজন নিবিড় বন্ধু। যার সাথে নীল-লাল সংসারটা ভালোই জমবে। আমাকে নিবেন আপনার সাথে?”
মেহুলের প্রশ্নে ফারাবীর চোখজোড়া চকচক করে উঠে। পারিপার্শ্বিক পরোয়া না করেই জড়িয়ে ধরে মেহুলকে। মেহুলকে জামান সাহেব ই নিয়ে এসেছে ট্রেন স্টেশন অবধি। কারণ মেহুল তাকে বেশ সাহস নিয়ে মনের কথাগুলো বলেছিলো। আজ সে শ্বশুর নয় একজন পিতা রুপে তার কন্যাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠেছে। ফারাবী এবং মেহুলের সেদিকে হুশ নেই। তারা নিজেদের মাঝেই আবদ্ধ করেছে নিজেদের। হঠাৎ মেহুল প্রশ্ন করলো,
— “ট্রেন চলে যাচ্ছে, ঢাকায় যাবেন না?”
ফারাবী মেহুলের হাতটা নিজের মুঠোয় নিলো। স্মিত হেসে বললো,
— “যাহা চাই তাহা কি পাই? বেলা শেষে জীবনের হিসেবে কিছু খোয়াবোই; এটাই জীবনের নিতান্ত সত্যতা।”
বলেই হাটতে লাগলো ট্রেনের বিপরীতে। মেহুল ও স্মিত হেসে হাটতে লাগলো তার সাথে সাথে। বেলা শেষে সত্যি কিছু বা কিছু খোয়ানো যায় ই, আবার জীবনের হিসেবে জমা হয় না পাওয়া অনেক কিছু________
||সমাপ্ত||
মুশফিকা রহমান মৈথি