#বেলা_শেষে
#২য়_পর্ব
করিম সাহেবের মুখশ্রী লজ্জা এবং অপমানে লাল হয়ে গিয়েছে নিজের ছেলের কথাটা শুনে। ফারাবী কাউকে পরোয়া না করেই সবার সামনে বলে উঠলো,
— “আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। বিয়েটা যখন আমাকেই করতে হবে তাহলে নিশ্চয়ই আমার মতামতের একটা গুরুত্ব থাকা উচিত, তাই নয় কি? আর এই বিয়েতে আমার কোনো মত নেই। এই বিয়ে হলে না আমি সুখী হবো না রিমি। আমাকে ক্ষমা করবেন আংকেল, ছোট বেলা থেকে আপনাদের সামনেই বড় হয়েছি। আপনাদের অপমান করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু রিমিকে আমি বিয়ে করতে পারবো না”
ফারাবীর শান্ত কন্ঠের কথাটা উপস্থিত সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। জামান সাহেব বিমূঢ় দৃষ্টিতে করিম সাহেবের মুখপানে তাকিয়ে রইলেন। মুনমুন বেগম ফারাবীর এমন আচারণে বেশ অবাক হলেন। মেহুলের কৌতুহল দৃষ্টিতে ফারাবীর মুখপানে তাকিয়ে রইলো। করিম সাহেব তীব্র স্বরে বললেন,
— “কি ফাজলামি হচ্ছে ফারাবী?”
— “ফাজলামি করতে যাবো কেনো বাবা? আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে এতোটা গম্ভীর সময়ে আমি ফাজলামি করবো?”
— “তোমার যদি এতোই আপত্তি তবে প্রথমেই বলতে পারতে?”
— “মাকে বলেছি, কিন্তু মা আমলে নেয় নি। আর পরে ভাবলাম এক ঢিলে দু পাখি মারা হবে। তাই এখানে আসা”
— “খোলশা করে বলবে কি?”
ফারাবী ফোশ করে নিঃশ্বাস ফেললো, তারপর আড়চোখে মেহুলের পানে চাইলো। মেহুল ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। মেহুলের মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপটা ঠিক আন্দাজ করে নিলো ফারাবী। ফারাবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বললো,
— “আমি মেহুলকে ভালোবাসি, মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসি। আমি তাকে ব্যাতীত কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। তোমরা যদি বিশ্ব সুন্দরীও আমার সম্মুখে এনে দাও তাকে আমার ভালো লাগবে। কিন্তু সমস্যা হলো মেহুল আমার প্রেম নিবেদনকে নাখোচ করে দিয়েছে। এখন আপনারাই বলেন, আমি যদি রিমিকে বিয়ে করি সে বা আমি কি সুখী হবো? কখনোই না। আমি রিমিকে মন থেকেই মেনে নিতে অক্ষম, তাহলে এই বিয়েটা তো মূল্যহীন। তাই এই বিয়েটা আমি করবো না।“
রিমি আড় চোখে মেহুলের দিকে চাইলো। মেহুল নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় মুখখানা লাল হয়ে গিয়েছে তার। মাটির ভেতরে ঢুকে গেলে হয়তো মুক্তি পেতো এই লজ্জার থেকে। জামান সাহেব বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুনমুন বেগম চোখ মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন,
— “তোমার মাথা ঠিক আছে তো ফারাবী? কোথায় কি কথা বলা উচিত তার বোধজ্ঞান কি হারালে নাকি?”
— “আমি অনুচিত কোনো কথা বলি নি আন্টি, আমি শুধু সত্যিটা বললাম। আমি মেহুলকে ভালোবাসি। তার অতীত যেমন হোক না কেনো আমার আপত্তি নেই। সবার জীবনে এগিয়ে যাবার অধিকার রয়েছে, সবার ভালোবাসা পাবার অধিকার আছে। তদ্রুপ মেহুলের ও অধিকার রয়েছে এই বেরঙ জীবনের ইতি টেনে নতুন করে সব শুরু করা। আমি তো অযৌক্তিক কোনো কিছু বলি নি। যদি মেহুল রাজী থাকে আমি মেহুলকে এক কাপড়ে বিয়ে করতে রাজী”
করিম সাহেব নিজের ছেলের কন্ঠের দৃঢ়তা দেখে অবাক হলেন। তার শরীর রাগে কাঁপছে, ছেলের স্পর্ধা দিনদিন আকাশ ছুয়ে যাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না তারা। শেষমেশ কি না একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করবে তার ছেলে। মেয়ের কি অভাব? এই মেয়েই কেনো? এর মাঝেই মুনমুন বেগম বলে উঠলেন,
— “করিম ভাই, ছেলেকে দিয়ে এভাবে অপমানিত না করালে তো পারতেন? এতো বছরের সম্পর্ক এক দিনেই শেষ করে দিলো আপনার ছেলে। আমাদের বাড়ির বউকে এভাবে লাঞ্চিত করার কি মানে?”
মুনমুন বেগমের কথায় ফারাবী অবাক কন্ঠে বললো,
— “লাঞ্চিত? আমি লাঞ্চিত করেছি মেহুলকে? আমি হতবাক আন্টি। ভালোবাসা কি লাঞ্চিত করা?”
— “করছো না? নয়তো কেনো আমাদের বউ এর নামে বাজে কথা বলছো? সবাই তো ওকেই দোষ দিবে”
— “আমি তো স্পষ্ট করেই বললাম, আমি ওকে বিয়ে করতে রাজী”
মেহুল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ছুটে অন্দরে চলে গেলো সে। ফারাবী মেহুলের যাবার পানে চেয়ে রইলো, আটকাতে চেয়েও পারলো না। সেই অধিকার যে তার নেই। মেহুল ঘরের দরজা দিলো। মাটিতে নতজানু বসে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কি দরকার ছিলো ফারাবীর এমনটা করার! ভালোই তো ছিলো সে, বেরঙ জীবনটাকে তো বরণ ই করে নিয়েছে। তবে কেনো ফারাবী সব এলোমেলো করতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। সে চায় না নতুন করে কিছু। করিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। নিজের স্ত্রীকে কড়া স্বরে বললেন,
— “শেফালী চলো, এখানে বসে অপমানিত হবার ইচ্ছে নেই আমার।“
ফারাবী আর বসে রইলো না, তীব্র যন্ত্রনায় বুক জ্বালা করছে তার। কেনো যেনো নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। সে কি সত্যি মরীচিকার পেছনে ছুটছে!
বাসায় প্রবেশ করতেই হুংকার ছাড়লেন করিম সাহেব,
— “তোমার কি আক্কেল জ্ঞান নেই ফারাবী? এতো মেয়ে থাকতে শেষ পর্যন্ত একটা বিধবা মেয়েকে তোমার মনে ধরলো? একবার চিন্তা করে দেখেছো আমার মান সম্মানের কথাটা? জামান ভাইয়ের সামনে আমার মুখ দেখানোর উপায় রাখো নি তুমি”
— “আমার সাথে বিয়ে করে যদি রিমি সুখী না হতো, তখন মুখ দেখাতে পারতে তো?
ফারাবীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না করিম সাহেব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। করিম সাহেবের ক্ষুদ্ধ নজর ফারাবীকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগলেন। ফারাবী সেই নজরকে উপেক্ষা করে বললো,
— “একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই বাবা, বিয়ে করলে মেহুলকেই করবো। এ ব্যতীত আমি কোনো মেয়েকে নিজের দুনিয়াতে প্রবেশ করাবো না”
কথাটা বলেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলো ফারাবী। করিম সাহেব শেফালী বেগমকে বললেন,
— “দেখলে ছেলের স্পর্ধা?”
— “ও কিন্তু ভুল কিছু বলে নি”
নিজ স্ত্রীর নির্লিপ্ত কথায় আরোও চটে গেলেন করিম সাহেব। হিনহিনে স্বরে বললেন,
— “তুমি ওর এমন কাজে সায় দিচ্ছো?”
— “অন্যায় তো করে নি সে, আর মেহুল মেয়েটিকে আমার মন্দ লাগে না। রাজীব মারা যাবার মর থেকে মেয়েটা এক হাতে সংসারটাকে চালাচ্ছে, এমন মেয়ে আমার বাড়ি বউ হয়ে এলে মন্দ হবে বলে মনে হচ্ছে না”
করিম সাহেবের রাগ আসমান ছুলো, নিচুস্বরে “যতসব” বলেই উনি নিজ রুমে চলে গেলেন। শেফালী বেগমের মুখে স্মিত হাসি। হাসির কারণটা সে ব্যাতীত কেউ ই জানে না।
****
অফিস থেকে বের হলো ফারাবী। নীল আকাশে কালো মেঘেরা দল বেধে জড় হয়েছে। যেনো শীতের আগমন তাদের পছন্দ হয় নি। তারা হরতাল করবে তাই, সেই হরতালে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে অজস্র বারিধারা। ফারাবী সকালের ফকফকা আকশ দেখে ছাতাটা আনে নি। আর ডিসেম্বরের মাঝপ সপ্তাহে প্রকৃতির এমন মুখ গোমড়া ভাবটা আঁচ করে নি সে। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো বাসস্ট্যান্ড এর কাছে। ভিজে গেলেই ঠান্ডা লাগবে। তখন অবস্থা ব্যাপক খারাপ হবে। হঠাৎ গতি মন্থর হয়ে গেলো তার। সামনে থাকা নারীটিকে দেখে বিস্ময়ে আত্নহারা হলো ফারাবী। মেহুল নিজে এসেছে তার সাথে দেখা করতে?………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি