#বেলা_শেষে
#৩য়_পর্ব
মেহুলের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে ফারাবী। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। বুকের এক কোনায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। মেহুল তার সাথে দেখা করতে এসেছে, ব্যাপারখানা প্রথমে তাকে আনন্দ দিলেও সেই আনন্দ মূহুর্তেই মিয়ে গেছে যখন জানতে পারে মেহুলের আসার উদ্দেশ্য। মেহুল ফারাবীর জন্যই অপেক্ষা রত ছিলো। ফারবী মেহুলকে দেখতে পেয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো তার কাছে। আকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি এখানে? কাজ ছিলো বুঝি?”
মেহুল শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
— “আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি”
মেহুলের উত্তরটা তপ্ত খরার একপশলা বৃষ্টির ন্যায় ফারাবীর হৃদয়ের আঙ্গিনায় শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। উচ্ছ্বাসিত চিত্তে সে বললো,
— “আপনি সত্যি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? আপনার ধারণা নেই আমার কতটা আনন্দ হচ্ছে! চলুন, আমরা কোথাও যেয়ে বসে কথা বলি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো দেখাচ্ছে না।”
— “আমি কোথাও যাবো না। অহেতুক ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। কথাগুলো শান্ত মস্তিষ্কে শুনুন”
ফারাবী এবার কিছুটা দমলো। সকল উৎসাহ মূহুর্তেই যেনো বাস্পায়িত হয়ে গেলো। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে গেলো। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
— “বলুন”
মেহুল ভনীতা বিহীন নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
— “আমার পক্ষে আপনাকে ভালোবাসা সম্ভব নয় ফারাবী। ভালোবাসাটা জোর করে হয় না। আমি আপনার ভালোবাসাটাকে অপমান করছি না। তবে আপনার ভালোবাসাটা এক পাক্ষিক। এই এক পাক্ষিক ভালোবাসার ভার আমার পক্ষে মেনে দেওয়াটা সম্ভব নয়। আমি রাজীবের স্থানে আপনাকে বসাতে পারবো না। তাই পাগলামীটা এবার ছেড়ে দিন। আপনি বলে ছিলেন, আমি যদি চাই তবে আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজী। কিন্তু আমি চাই না। নিশ্চয়ই এই ভালোবাসার জোরাজোরিতে আমার মতের একটা দাম আছে? তাই নয় কি!”
— “তবে কি আপনি চান আমি রিমিকে বিয়ে করি?”
— “সেটা আপনার ব্যাপার। আমি তাতে কিছুই বলবো না, আমার বলা না বলাতে কিছুই যায় আসে না। তবে আমাকে আপনি ভুলে যান। একটা কথা জানেন তো, জীবন সবকিছু একমুঠোতে দেয় না। কিছু মূহুর্ত, কিছু সুখ মুঠো ছাড়া হবে, হতেই হবে। যাহা চাই তাহা সর্বদা কি পাই! বেলা শেষে জীবনের হিসেবে কিছু খোয়াবোই; এটাই জীবনের নিতান্ত সত্যতা। অতি তিক্ত কিন্তু বাস্তবতা”
মেহুল থামলো। অজানা অনুভূতিগুলো গলায় এসে জমেছে। বিদ্রোহ করছে, কথাগুলো আটকে যাচ্ছে। স্বর কাঁপছে, তার কি তবে কষ্ট হচ্ছে? কেনো হচ্ছে? সে তো ফারাবীকে ভালোবাসে না! তবে কেনো তার এতোটা কষ্ট হচ্ছে! মেহুলের জানতে ইচ্ছে করছে না! শুধু এটুকু জানে সে, এই ভালোবাসাকে সে গ্রহন করতে পারবে না। এটাই চিরন্তন সত্যি। মেহুল ফারাবীর অগোচরে নিজেকে সামলে নিলো। শক্ত গলায় বললো,
— “আশাকরি, আপনি বুঝেছেন। এর পর থেকে আমাকে বিরক্ত করবেন না। অন্যথা আমার রুদ্র রুপ দেখতে বাধ্য হবেন”
মেহুলের কথাগুলো ফারাবীর কর্ণকুহরে ঝংকার তুলছে। বুকের অতলের জল সমুদ্রে এক বিস্তার ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিবৃত্ত চিত্ত এক মূহুর্তেই প্রচন্ড আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। এই রক্ত কেউ দেখতে পারে না। কিন্তু এই রক্তক্ষরণে তীব্র যন্ত্রণা রয়েছে যা ফারাবীর শীতল আঁখিজোড়াকে ঝাপসা করে তুললো। আবেগ কন্ঠকে ভারী করে তুললো। সে নতমস্তকেই দাঁড়িয়ে রইলো, নিজের স্বচ্ছ জল গুলো ফেললো অতি সংগোপনে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কে বলেছে! যতসব পচা মস্তিষ্কের জং ধরা চিন্তাধারা। আরে! তারা কি আইরন ম্যান নাকি! তাদের হৃদয়টাও তো রক্ত মাংসের। সেটায় ও কষ্ট অনুভূত হয়। ফারাবী রুদ্ধশ্বাস ফেলে ভারী কম্পিত স্বরে বললো,
— “চিন্তা করবেন না, আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো না। তবে একটা কথা দিতে পারছি না, সেটা হলো আপনাকে ভুলে যাওয়া। আমি কখনোই আপনাকে ভুলতে পারবো না। আসলে কি বলুন তো! আমরা কেউ পারফেক্ট নই, জীবনে কেউ পার্ফেক্ট হয় না। এটা একটা মিথ। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি, কারণ আপনার সামনে আমার কখনো পার্ফেক্ট হবার মেকি অভিনয় টা করতে হয় নি। আপনার সামনে আমি পুরোদস্তুর “আমি” হয়ে থাকতে পেরেছি। পাড়ার দোকানের সামনে থেকে যখন আপনি আমার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দেখেও না দেখার ভান করতেন এবং পড়ে এক সময় দেখা হলে স্মিত হেসে বলতেন “সিগারেটটা না খেলেও তো পারেন ফারাবী ভাই, লাঙ্গস তো যাবে” কথাটা স্বল্প কিন্তু ভালো লাগতো। আমাদের মূহুর্তগুলো ক্ষুদ্র, কিন্তু মনের দেয়ালে সোনালী ফ্রেমে বাঁধা। আপনার জন্য সব ভুলে নিজেকে উজার করে দিতেও হয়তো আমি দুবার ভাববো না। রাতের আধারে যখন আপনি ছাদের কর্ণিশে দাঁড়িয়ে তারা গুনে, আমি চাঁদ ছেড়ে আপনাকে দেখি। খানিকটা আফসোস ও হয় আমি যদি ওই আকাশটা হতে পারতাম, হয়তো আপনি আমাকে দেখতেন। অদূর ভবিষ্যতে আপনার সাথে নীল-লাল সংসার গড়ার এক মরীচিকা স্বপ্ন দেখেছিলাম শুধু মাত্র কয়েক মূহুর্তের মোহ এর জন্য নয়। তাই আপনাকে ভালোবাসাটা ছাড়তে পারছি না। পারবো না। ক্ষমা করবেন, আপনাকে ভুলতে পারবো না। হয়তো সময়ের স্রোতে, মনকে ভালো লাগা টাইপ বিশেষণ দিয়ে বুঝিয়ে দেবো। কিন্তু মনের কোনে আপনি চিরকাল থাকবেন। আপনি এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যেতে পারেন”
ফারাবী দাঁড়িয়ে রইলো না। একটা রিক্সা ডেকে মেহুলকে উঠতে বললো। তারপর এলোমেলো পায়ে হাটতে লাগলো ব্যস্ত খুলনার ফুটপাতে। আজ যেনো আকাশ টাও তার সাথে মন খারাপের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নীল আকাশের কোনায় সূর্যের রক্তিম বর্ণ জড় হতে লাগলো। ব্যস্ত শহরের দিবসটি আজ অন্ত গেলো।
মেহুল যন্ত্রচালিত রোবটের ন্যায় সেই রিক্সায় উঠে যায়। তার হৃদয়টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার জানা নেই জিনিসটা কি। বাসায় পৌছালে শাশুড়ী মা প্রশ্ন ছুড়েন,
— “আজ এতোটা দেরি হলো যে? কোথাও গিয়েছিলে?”
মেহুল উত্তর দেয় না। শুধু নতমস্তকে নিজ ঘরে চলে যায়। জামান সাহেব মেহুলের শুকনো মুখটা বেশ ভালো করেই অবলোকন করলেন। মেয়েটির গাল ভেজা সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। মেহুল, নিজের ঘরে চলে গেলো। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। ফারাবীর মুখখানা চোখের সামনে ভাসছে তার। মেহুল এতোটা কঠিন না হলেও হয়তো পারতো। কিন্তু সমাজের একদল গোষ্ঠী তার চরিত্রে আঙুল তুলতে সর্বদা যে প্রস্তুত। তার সেদিনের কথাটি আজ ও বেশ স্পষ্ট মনে আছে। যেদিন ফারাবীর মা শেফালী বেগম তাকে বলেছিলেন,
— “আজকালকের মেয়েরা কত চালু হয় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তুমি, পুরুষদের কিভাবে বশে আনতে হয় তুমি ভালোই জানো।”
সেদিন লজ্জা এবং অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো মেহুলের। ফারাবীর সাথে তার বন্ধুসুলভ মেলামেশাকে নোংরাভাবে সম্বোধন করেছিলেন শেফালী বেগম। সেদিন থেকেই মেহুল ফারাবীকে এড়িয়ে চলছিলো। তার সপ্তাহ দুয়েকের মাঝেই ফারাবী তাকে প্রমে নিবেদন করে বসে। ফলে সেদিনের অপমানের বিভৎস্তা স্মৃতিকে বিষাক্ত করে তুলে। ফলে ফারাবীকে চপেটাঘাত করতেও দুবার ভাবে না মেহুল। আজ পুনরায় সেই স্মৃতিগুলো ক্যামেরায় সেলুলয়েডের রিলের মতো একের পর এক চোখের সামনে ভাসছিলো। ভাগ্যের এমন অবাক পরীক্ষায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছে মেহুল! আজ সত্যি নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে, কে বলেছে প্রেম মানে সুখ, প্রেম মানে সুখ নয় বরং বিষাদ, বিষাক্ত নীল বিষাদ।
মেহুলের দিনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই কাটতে লাগলো। অফিস, বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির মানুষদের নিয়েই তার দিনগুলো নিজস্ব বৈচিত্রেই ব্যাতীত হয়। মাঝে মাঝে মুনমুন বেগম এবং রিমি তার উপর নিজেদের বিরক্ত জাহির করে। মেহুল উত্তর বিহীন তার মতো করে নিজেকে গুছাতে লাগলো। কিন্তু মনে লুকায়িত প্রকোষ্ঠে কেনো যেনো এক আগুন্তক বারেবারে কড়া নাড়ছিলো। কর্ণকুহরে ফিসফিস করে বলছিলো,
“তুমি হীনা আমি, এবং আমিহীন তুমি বড্ড অসহায়”
এক নিবিড় রাত,
মেহুল ছাদের কর্ণিশে উদাস নয়নে তারা গুনছিলো। রাতে তারা গুনতে ভালো লাগে তার। নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে তারার আড়ালে খুজতে ভালো লাগে তার। যেমন নিজের বাবা, রাজীব। রাজীবের সাথে তার সম্পর্কটা খুব নিবিড় ছিলো। কোনো মনোমালিন্য ছিলো না সম্পর্কে। হয়তো নির্মম ভাগ্যের তার ঝুলিতে এই স্বল্প সুখটাই লেখা ছিলো। তাই বিয়ের দু বছরের মাঝেই এই অঘটন টা ঘটে। তাই এখন সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় করে। এই বুঝি ভাগ্য আবার পরিহাস করতে ব্যাস্ত। এর মাঝেই জামান সাহেব উপস্থিত হয় সেখানে। গম্ভীর স্বরে বলে,
— “মেহুল, তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে।”
মেহুল পিছনে ফিরে বিনয়ী স্বরে বলে,
— “বলুন বাবা”
— “তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আমি কখনোই আশা করি নি……
চলবে…..
মুশফিকা রহমান মৈথি