#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_১
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
তিনদিন আগে ঠিক হওয়া বিয়েটা আজ ভেঙে গেল। পাত্রীর নাম সূচনা৷ বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ, সূচনার মা তার বড়ো চাচার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে আজ থেকে বিশ বছর আগে স্বামী, সন্তান এবং সংসার ত্যাগ করেছেন। ভেঙেছেন দু’টো স্বপ্নের সংসার। বাবা, মা হারা করেছেন চারটে শিশুকে। বড়ো চাচার বড়ো ছেলের বয়স তখন সাত, ছোটো ছেলের বয়স চার। আর সূচনার বয়স ছিল দুই, বড়ো ভাইয়ের বয়স পাঁচ বছর। এই চারটে শিশুর শৈশব’কে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল দু’জন বিকৃত রুচির মানব,মানবী। কে জানতো আজ এত বছর পরও সেই ঘন অন্ধকার দূর হবে না। অন্ধকার রুমে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে সূচনা। তার কর্ণে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাত্রের মা’য়ের বলা শেষ কথাগুলো,
-” দেখো মা লিমনের সঙ্গে তোমার চার বছরের সম্পর্ক আছে বলে চোখ বন্ধ করে তোমাকে পুত্রবধূ করে নেওয়ার মতো মানুষ আমি না। তোমার পারিবারিক বিষয়ে লিমন আমাকে কিচ্ছু জানায়নি। গতকাল পর্যন্তও আমি অন্ধকারে ছিলাম। বিয়ের মতো একটা বিষয়ে কোন কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না। এক্ষেত্রে তোমরা ভারী অন্যায় করেছ। জীবিত মানুষ’কে মৃত বানিয়েছ। কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। আমাদের কানে ঠিক এসেছে তোমার মা দিব্যি বেঁচে আছেন। তোমার চাচার সঙ্গে দিব্যি সুখে সংসার করছেন। এমন বেহায়াপনা যে নারী করতে পারে সেই নারীর গর্ভজাত সন্তান আমার বাড়ির বউ হবে! এটা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না৷”
-” আমিতো কোন দোষ করিনি আন্টি। তাহলে আমি কেন শাস্তি পাবো? ”
-” সার যত ভালোই হোক চাল কুমড়ার বীজে মিষ্টি কুমড়া ধরবে না মা। ”
দু’হাতে কর্ণদ্বয় চেপে ধরলো সূচনা। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে তার। দু-চোখ বেয়ে নোনাপানির স্রোত নামছে। চারদিক থেকে যেনো বিরতিহীন ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
-” সার যত ভালোই হোক চাল কুমড়ার বীজে মিষ্টি কুমড়া ধরবে না মা। ”
আকস্মিক চিৎকার করে ওঠল সূচনা,
-” আমি ঘেন্না করি, ঘেন্না করি ঐ মহিলা’কে। ভাইয়া, ভাইয়া তুমি কোথায়? ঐ মহিলার জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল ভাইয়া। তুমি কেন আমাকে সেই দু’বছরে গলা টিপে মেরে ফেললে না। আমি সহ্য করতে পারছি না, এই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছি না। ”
দরজায় কট করে শব্দ হলো। রুমে প্রবেশ করল, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একজন পুরুষ। এলোমেলো পায়ে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সুইচ টিপ দিলো। ঝকঝকে আলো ফিরে এলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটায়। বড়ো ভাই রুদ্র’কে দেখে সূচনা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। অসহায় চোখে ক্ষণকাল ভাইকে দেখে হঠাৎ ডুকরে ওঠল। দু’হাতে মুখ চেপে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল পূর্বের ন্যায়। কালো রঙের কাবলিতে আচ্ছাদিত দেহখানা ধপাৎ করে মেঝেতে বসে পড়ল। বোনের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। ফলশ্রুতিতে তার এলোমেলো উষ্কখুষ্ক ঘাড় ছোঁয়া সব গুলো চুল সামনের দিকে নেমে দাঁড়ি, গোঁফ ভর্তি গুরুগম্ভীর মুখটা ঢেকে দিলো। বারকয়েক তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। সূচনার কান্না তখনো থামেনি। কোন প্রকার স্বান্তনার বাণী শোনালো না রুদ্র। আদুরে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনেও নিলো না বোনকে। মাথায় হাত রেখে ভরসাও দিলো না। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে শুধু একটি প্রশ্ন করল,
-” লিমনের মতামত কী? ”
সঙ্গে সঙ্গে ক্রন্দনরত কণ্ঠে জবাব দিলো,
-” ওর পরিবারে ওর মা’য়ের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। লিমনের হাত, পা বাঁধা। ”
রক্তিম চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” ঐ বাঁধন ছাড়িয়ে চামড়া তুলে মরিচ দিয়ে তোর সামনে আনব। এবার বল এরপর আর কাঁদবি? ”
কেঁপে ওঠল সূচনা। আতঙ্কিত হয়ে কান্না থেমে গেল তার। উষ্কখুষ্ক চুলের ফাঁকে ভাইয়ের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিজোড়া দেখে অন্তরাত্মা পুনরায় কেঁপে ওঠল। সে খুব ভালো করেই জানে তার ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। ভীষণ রগচটা, ভয়ানক জেদি, তীব্র খ্যাপাটে! এখন যদি সম্মত হয় তাহলে লিমন’কে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সে চায় না লিমন’কে। যে পরিবার তার করুণ সত্যিটা জেনে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই পরিবারে কোনমতেই সে যেতে চায় না। সবচেয়ে বড়ো কথা যাকে ভালোবেসে ঐ পরিবারে যেতে চেয়েছিল, সেই লিমনই এখন অন্য সুরে কথা বলছে। যে সুরে আর যাই থাকুক ভালোবাসা নেই। ভালোবেসে ভালোবাসাহীন সম্পর্কে জড়ানোর মতো ব্যর্থতা এ পৃথিবীর বুকে আর একটিও নেই। সারাজীবন সঙ্গীহীন কাটাবে, দরকার নেই তার ঘরবাঁধার। যে মেয়ের জন্মদাত্রী দুটো ঘর ভেঙেছে সেই মেয়ের সত্যি ঘরবাঁধার অধিকার নেই। সমাজের লোকেরা তো আঙুল দিয়ে তাই দেখিয়ে দিলো।
-” না ভাইয়া। যে ছেলে চার বছরের সম্পর্ক’কে গুরুত্ব না দিয়ে পরিবারের পরামর্শ’কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সে ছেলেকে জীবনসঙ্গী করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”
রুদ্রর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠল। ঐ চোখের ভাষা পড়ে ফেলল সূচনা। মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” আমি তোমার বোন। আমার ভালোবাসা ঠুনকো বলে আমার আত্মসম্মান ঠুনকো নয়। ”
স্বস্তির শ্বাস ফেলে রুদ্র বলল,
-” কান্না থামবে কীভাবে? ”
-” আজ কাঁদতে দাও না ভাইয়া? যে মহিলা আমাদের বাবার ঘর ভেঙেছে, সে মহিলার জন্য আমার কোনদিন ঘর, সংসার হবে না। এতদিন লোকমুখে শুনেছি। আজ সচক্ষে দেখলাম, দু’কানে স্পষ্ট শুনলাম। কাঁদতে না পারলে মরে যাব কাঁদতে দাও। ”
-” বাবা ঠিক বলেন মানুষ মরার চেয়েও স্বপ্ন মরার কান্না বেশি ভয়ংকর। ”
নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলে ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র। দু-হাতে সম্মুখে আসা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দু’ঠোঁট ফাঁক করে বড়ো বড়ো শ্বাস ছাড়ল। কিছু সময় রুম জুড়ে পায়চারি করে হঠাৎ জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা সূচনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বলল,
-” তোর ঘর হবে, তোর বর হবে, তোর একটা ভরা সংসার হবে। ঐ মহিলার জন্য তোর জীবন আমি নষ্ট হতে দেবো না। ”
দু-চোখ বন্ধ করে সূচনা বলল,
-” আমার এসব কিচ্ছু চাই না। স্বাদ মিটে গেছে। ”
-” আমি লিমনের কাছে যাচ্ছি। ”
রুদ্র পেছন ঘুরে পা বাড়াতেই তড়াক করে তার পা আঁকড়ে ধরল সূচনা। মিনতির সুরে বলল,
-” তুমি যাবে না। আমি ওকে চাই না বিশ্বাস করো। ”
-” তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে তোর উপযুক্ত পাত্র নিয়ে আসছি। উপযুক্ত ঘর, উপযুক্ত বর দু’টোই এনে দেবো। ”
উন্মাদের মতো ‘না না’ করে ওঠল সূচনা। খ্যাপা রুদ্রও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো,
-” হয় তুই উপযুক্ত পাত্রকে গ্রহণ করবি। নয়তো আমার বোনকে প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে হাড়গোড় ভাঙা লিমনকে দু-চোখ ভরে দেখে বুকের জ্বালা মেটাব আমি।”
ভয়ে শিউরে ওঠল সূচনা। ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
-” না না। ”
জেদি কণ্ঠে রুদ্র পুনরায় বলল,
-” আমার বোনের এক ফোঁটা অশ্রুর মূল্য ঐ লিমন’কে দিতে হবে। আর যদি তুই সেটা না চাস তাহলে তোর সুখের জন্য যা কিছু করব সব মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। ”
কয়েক পল পিনপতন নীরবতা চলার পর রুদ্র বলল,
-” বল কাকে চাই লিমন নাকি আমার বাছাই করা উপযুক্ত পাত্র? ”
ফুঁপিয়ে ওঠে সূচনা বলল,
-” তুমি যা বলবে সব মেনে নেবো। শুধু যার থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছি তার সঙ্গে যেনো আমার এ’জীবনে আর দেখা না হয়। আর হ্যাঁ তুমি ওর কিছু করবে না, কিছু না। ”
-” পা ছাড় দাদিন’কে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছি খেয়ে নিস। আমি যেন এর মাঝে আর কোন কথা না শুনি।”
পা ছেড়ে দিলো সূচনা৷ রুদ্র দরজা অবধি যেতেই হঠাৎ বলে ওঠল,
-” বাবাকে জানিয়েছ? ”
-” জানিয়ে দেবো। ”
___
বেলা বারোটায় রুদ্রর ফোনে কল এলো। বিছানা জুড়ে শরীর ছেড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিল সে। হঠাৎ ফোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার চ্যালা ঝিনুক নামের ছেলেটা বলল,
-” বস দাদিন যে ছেলের খোঁজ নিতে বলেছিল নিয়েছি। সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু এখন তার বাইকে একটা মেয়ে’কে দেখতে পাচ্ছি। ”
-” পিছু নিয়ে দেখ কাহিনী কোন পর্যন্ত গড়ায়। ”
ঝিনুক’কে আর কিছু বলতে না দিয়ে শোয়া অবস্থায়ই পাশ থেকে সাদা রঙের কাবলিটা তুলে গায়ে জড়াতে জড়াতেই ওঠে বসল৷ দু’চোখ ডলে চট করে বিছানা ছেড়ে ওয়ালেট, মোবাইল, গাড়ির চাবি, আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ত্বরিতগতিতে বেরিয়ে পড়ল। পনেরো মিনিটের মাথায় পরিচিত শহরের একটি ন্যাশনাল ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো। তার গাড়ি দেখেই ঝিনুক রাস্তার ওপাশ থেকে ডাক দিলো,
-” বস। ”
ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রুদ্র বেরিয়ে এলো। ঝিনুক সহ আরো চার, পাঁচ’টা ছেলে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরলো তাকে। বলিষ্ঠ বুক, পেশিবহুল হাত টান টান করে দাঁড়িয়ে ঝিনুকের দিকে সরু চোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে গড়গড় করে ঝিনুক বলতে লাগল,
-” মেয়েটার সাথে সেই যে ঢুকছে আর বের হয়নাই।”
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল রুদ্রর। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে ঘনঘন টান দিয়ে বলল,
-” কোথায় ঢুকেছে? ”
-” কলেজের ভিতরে। ”
পাশ থেকে অল্পস্বল্প হাসির শব্দ ভেসে এলো। রুদ্র দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-” শালা কথার ধরন তো অন্য কিছু বোঝালো!’
ঝিনুক মাথা চুলকালো। তৎক্ষনাৎ পাশ থেকে আবির নামে রুদ্রর বন্ধু বলে ওঠল,
-” এই রুদ্র ঐ তো ঐ মেয়ে ঐ মেয়েই ছিল। ”
আবিরের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতেই চট করে বা দিকে ঘার বাঁকালো রুদ্র। দেখতো পেলো, ছোটোখাটো দু’টো মেয়ে এগিয়ে আসছে। গেট পেরিয়ে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাঁটা ধরল মেয়ে দু’টো। এদের মধ্যে একজন ননস্টপ কথা বলছে। কথাগুলো শুনতে না পেলেও মুখের ভঙ্গি আর হাত দু’টোর নাচানাচি দেখে বুঝলো ভয়াবহ রকমের ইন্টারেস্টিং কোন টপিক নিয়ে বর্ণনা চলছে। এতটাই ইন্টারেস্টিং যে পাশের জন’কে একটি কথা বলার সুযোগ দিতেও সে রাজি নয়। ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল রুদ্রর। বিরক্তিতে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
-” দু’টোর মধ্যে কোনটা ছিল সেটা বল নাকি দু’টোই ছিল!”
ঝিনুক জিব কেটে বলল,
-” ঐ যে জিন্স প্যান্ট, গোলাপি জামা পরা মেয়েটা।”
আবির বলল,
-” যেটা বকবক করছে থামছেই না ঐটা। ”
সিগারেটে শেষ দু’টো টান দিয়ে সন্তর্পণে শেষ অংশটুকু ফেলে দিলো রুদ্র। তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝবরাবর কয়েকপল চুলকে গম্ভীর স্বরে আদেশ করল,
-” ঝিনুক তুই যা। সরাসরি প্রশ্ন কর মাহেরের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক। রিলেশন থাকলে সেটা কত দিনের? জেনে আয় কুইক। ”
বেশ ভাবসাব নিয়ে চেহেরায় পাক্কা ভিলেনের ছাপ ফুটিয়ে মেয়ে দু’টোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ঝিনুক। সরাসরি প্রশ্ন করল,
-” এই যে বকবকানি মাহের ভাইয়ের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? কতদিন চলছে এই সম্পর্ক? ”
কথার মাঝে বাঁধা পেয়ে গোলাপি গাউন পরা মেয়েটি পিটপিট করে তাকিয়ে রইল ঝিনুকের দিকে। পাশের মেয়েটিকে অর্থাৎ বান্ধুবীকে বলল,
-” নয়ন পাঁচ সেকেণ্ড ওয়েট কর। ”
নয়ন ভ্রু কুঁচকে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এই হৈমী এই ছাগলটা আবার কে? ”
নিমিষেই ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো নয়নের দিকে। হৈমী ওসবে ধ্যান না দিয়ে ঝিনুক’কে উদ্দেশ্য করে চটপটে গলায় বলল,
-” আপনি একটু দাঁড়ান। আমি নয়ন’কে গতকালকের ঘটনাটা বলে শেষ করি। তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলছি। ”
ঝিনুকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরু হয়ে হৈমীর মুখের দিকে পড়ল। হৈমী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটি হাসি উপহার দিয়ে নয়নের দিকে ফিরে আবার কথা বলতে শুরু করল। দু’মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর ওপাশ থেকে রুদ্র চোখ রাঙালো ঝিনুক’কে, আবির গালাগাল শুরু করল। ঝিনুক পুনরায় হৈমীকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হলে হৈমী ঝিনুক, নয়ন দু’জনকেই গল্প শোনাতে লাগলো। গল্পের শেষ প্রান্তে যেতেই হাওয়াই মিঠাইওয়ালাকে দেখতে পেলো সে। তৎক্ষনাৎ চিল্লিয়ে ওঠে ঝিনুক’কে বলল,
-” এ ভাই আপনি একটু দাঁড়ান আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবো৷ এখন দিতে গেলে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা চলে যাবে। ”
বলতে বলতেই রাস্তার ওপাশে চলে গেল। তার পেছন পেছন নয়নও গেল। ঝিনুক এক ঢোক গিলে হা করে রুদ্রর দিকে তাকাল। আবির বলল,
-” এই শালা আহাম্মকের মতো হা করে মেয়েটাকে দেখেই গেলি। কিছু শুনছোস? আয় এদিক আয়।”
এপাশে এসে ঝিনুক বলল,
-” ভাই আমারে তো সুযোগই দিলো না। কি সব যে বলল কিছু বুঝলামও না। কানের ভেতর গড়গড় শব্দ শুনলাম। আমার মাথা কিলবিল করতেছে। ”
বিরক্তিসূচক শব্দ করে রুদ্র বলল,
-” প্রশ্ন করার পর কী বলল? ”
হৈমীর বলা কথাটা বলতেই রুদ্র গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওদিকে হৈমী হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আবির বলল,
-” দোস্ত এদিকে আসতাছে।”
সকলেই রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে রইল। রুদ্রও তীক্ষ্ণ চোখে একবার দেখল, মেয়েটা তাদের দিকে আগাচ্ছে। তাই দৃষ্টি সরিয়ে ঝিনুক’কে ইশারা করল কথা বলতে। হৈমী যখন তাদের থেকে এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়ালো ঝিনুক বলল,
-” আপা উত্তর’টা? ”
আবারও দাঁত ক্যালিয়ে হেসে দিলো হৈমী। বড়ো বড়ো চোখজোড়া কতক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
-” উত্তর দিতেই আসছি ভাই। প্রশ্ন যেন কী ছিল? আপনার মাহের ভাই আর আমার সম্পর্ক কী? কতদিন চলছে এই সম্পর্ক এটাই তো? ”
কিঞ্চিৎ মাথা হেলিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে রইল হৈমী। ঝিনুক সহ আবিরও হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠল। রুদ্র কানখাড়া করে একটি সিগারেট ধরালো। এমন সময় হঠাৎ হৈমী হাতে থাকা আধখাওয়া হাওয়াই মিঠাই নয়নের হাতে ধরিয়ে তর্জনীতে বুড়ো আঙুলের মাথা ঠেকিয়ে ঝিনুক’কে বলল,
-” এক মিনিট দাঁড়ান আমি এই যাব আর এই আসব। আপনার উত্তর দেবো দাঁড়াবেন কিন্তু… ”
হৈমী ছ’জন ছেলেকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
নয়ন ঠোঁট টিপে হেসে তাকে অনুসরণ করল। ঝিনুক আশ্চর্য হয়ে রুদ্রর দিকে তাকালো। রুদ্র বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। কতক্ষণ পর ফোঁস করে ওঠে জ্বালিয়ে পুড়য়ে ছারখার করে দেবে আন্দাজ করা গেল না। আবির অধৈর্য্য হয়ে বলল,
-” এইটা কোন প্রজাতিরে ভাই! মানে হয় কোন? ”
রুদ্রর আশপাশে থাকা প্রত্যেকেই হৈমীর কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করতে লাগল। রুদ্র একের পর এক সিগারেট শেষ করতে ব্যস্ত। মেয়ে মানুষদের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। শুধু প্রশ্নের উত্তর চাই। কিন্তু তার চারপাশে ঘিরে থাকা ছেলেরা দেখতে পেলো। হৈমী নামক মেয়েটা গেটের পাশে একটা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বাটে হ্যাংলা, পাতলা ছেলেটা মিটিমিটি হাসছে। ঝিনুক বলল,
-” লুইচ্চার মতো হাসতাছে না পোলাডা?”
আবির বলল,
-” হ কাহিনী কী দেখি আগে। ”
হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা প্যান্টের পকেট থেকে একটি লাল গোলাপ বের করল। হৈমী চটপটে গলায় বলল,
-” তাড়াতাড়ি প্রপোজ করো আমার বেশি সময় নেই। ঐ যে দেখো চার, পাঁচ, ছয়টা ছেলে ওদের মধ্যে ঐ খাটো ছেলেটার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ”
ছেলেটার নাম পালন। আজ সে এসেছে হৈমীকে প্রপোজ করতে। গতকাল ম্যাসেন্জারে নক দিয়ে এ ব্যাপারে জানিয়েছিল। প্রেম করবে না হৈমী কারণ হ্যাংলা পাতলা ছেলে তার পছন্দ নয়৷ তবে তার দয়ার শরীর। সেধে এসে প্রপোজ করলে কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। ফুল টুল বা গিফ্ট টিফ্ট আনলে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। পরবর্তীতে যদি প্রেম, ভালোবাসার জন্য ফোর্স করে সোজা ব্লক। সামনে এলে দু’চারটা চর,থাপ্পড় ব্যাস কাহিনী খতম! পালন চারপাশে লাজুক চোখে তাকিয়ে গোলাপ দিয়ে ” আই লাভ ইউ ” বলে প্রপোজ করল হৈমীকে। হৈমী ঝটপট গোলাপটা নিয়ে বলল,
-” আমাকে ভালোবেসে ফুল দেওয়ার জন্য থ্যাংকিউ। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রেমটেমও চলবে না আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”
চলবে..ইনশাআল্লাহ