বেসামাল_প্রেম,পর্ব_২১ (বর্ধিত অংশ) ,২২

0
2241

#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_২১ (বর্ধিত অংশ) ,২২
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১ (বর্ধিত অংশ)

খোলা আকাশের নিচে উষ্ণ দেহটাকে আগলে বসে রুদ্র। ছোট্ট, নরম দেহটি অবিরত কাঁপছে। দু’জনের ক্রমাগত শ্বাস-প্রশ্বাসে পরিবেশটা থমথমে।পরিবেশের এই গুমোট ভাব পরিবর্তন করে সহসা হৈমীর মাথায় হাত রাখল রুদ্র বলল,
-” ঠিক আছো? ”

নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই বিব্রত হলো। অনুভব করল এ মুহূর্তে তার গম্ভীর স্বরটায় একটু নম্রভাব আনা প্রয়োজন। মেয়েটা এমনিতেই ভয় পেয়েছে এমন পরিস্থিতিতে এমন শাসালো স্বর শুনলে আরো বেশি ভয় পাবে। তাই পুনরায় কণ্ঠে স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করে বলল,
-” ঠিক আছো? ”

উহুম হলো না বোধহয়। তার স্বাভাবিক কণ্ঠ মানেই তো রাশভারি, ভীষণ গম্ভীর। তার গলা দিয়ে নরম বুলি বের হওয়া কখনোই সম্ভব হয় না। তাই অমন রাশভারি কণ্ঠে আর কিছু বলার ইচ্ছেও করল না। হৈমীকে কৌশলে আগলে ধরে মাথা ঝুঁকাল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হৈমীর করুণ মুখশ্রীতে। সহসা চমকে ওঠল হৈমী। সংবিৎশক্তি ফিরে পেল সে। নিজেকে রুদ্রর পক্ষপটে লেপ্টে থাকতে দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” আমি ঠিক আছি, ছাড়ুন। ”

রুদ্র তাকে ছড়তে উদ্যত হলেও কী মনে করে যেন ছাড়ল না৷ বরং পূর্বের তুলনায় একটু বেশি গভীরভাবে জড়িয়ে নিল। হতভম্ব হৈমী দুর্বল শরীরে নড়েচড়ে ওঠল। রুদ্র তার দুহাত মুড়িয়ে এমনভাবে জড়িয়ে নিল যে আর অল্প নড়চড়ও করতে পারল না। বেশ আয়েশ করে চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল সে। হৈমী কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” ছাড়বেন না? ”

স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলো। তুমি এখানে কীভাবে আটকা পড়লে? যতক্ষণ সবটা জানতে না পারছি ততক্ষণ ছাড়ব না। ”

লজ্জায় বিব্রত হলো হৈমী। রুদ্র তার দিকে কতটা খেয়াল করেছে সে জানেনা। কিন্তু সে সম্পূর্ণ হুঁশে আছে। তার গায়ে ওড়না নেই, চাদর নেই। একে-তো রুদ্রর শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে, তারওপর গায়ে নেই ওড়না। মাথা ভনভন করতে শুরু করল তার। লজ্জায় আড়ষ্ট চোখে একবার রুদ্রর দৃষ্টি বরাবর তাকিয়ে আর একবার নিজের দিকে তাকাল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। রুদ্রর দৃষ্টি তার মুখশ্রীতেই স্থির। হৈমীর মন কথন সে টের পায়নি। তাই সহজ গলায় পুনরায় বলল,
-” তুমি এখানে কেন? ”

ঢোক গিলল হৈমী। চাপা স্বরে বলল,
-” ছাড়ুন তারপর বলছি। ”

রুদ্র ছাড়ল না তার দু’হাতের বন্ধন আরো গাঢ় হলো। ফলশ্রুতিতে হৈমীর শরীর আরো বেশি গভীর হলো তার সঙ্গে। সহসা শিউরে ওঠল সে। অথচ রুদ্রর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার মতোই উত্তর জানতে মগ্ন। লজ্জায়, জড়তায় থমথমে হয়ে গেল হৈমী। জড়োসড়ো হয়ে শরীর বাঁকিয়ে পড়ে রইল রুদ্রর বাহুডোরে। কিয়ৎকাল পর বুঝতে পারল উত্তর না দিলে ছাড়াছাড়ি নেই। উত্তর দিলেই মুক্তি মিলবে তার রুদ্র দ্যা ডন বেয়াইয়ের থেকে। তাই সমস্ত কথা খুলে বলল। সব কথা শুনে আচমকা হৈমীকে ছেড়ে দিল সে। টাল সামলাতে না পেরে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল হৈমী। ভয় ভয় চোখে বড়ো বড়ো করে তাকাল। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তোমায় বলেছিলাম ওদের সঙ্গে এত মাখামাখি না করতে! ”

ক্রোধে গর্জন ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াল। অমনি তড়াক করে হৈমী তার এক পা আঁকড়ে ধরল। মিনমিনে স্বরে বলল,
-” প্লিজ আমাকে একা রেখে যাবেন না। প্লিজ। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। পিছু ঘুরে হৈমীকে হাত টেনে দাঁড় করাল। হৈমী আশপাশে তাকিয়ে ওড়না আর চাদর তুলে নিয়ে রুদ্রর এক বাহু জাবটে ধরল। ভয়কাতুরে গলায় বলল,
-” আমি এভাবেই যাব একদম নিচে গিয়ে ছাড়ব। ”

কিছু বলল না রুদ্র। শুধু ভ্রুজোড়া কুঁচকে একবার তাকাল হৈমীর দিকে। সত্যি সত্যি হৈমী ওভাবেই
সিঁড়ি দিয়ে নামল। শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই মুখোমুখি হলো সোহান, রোশানের। ওদের দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না রুদ্র। হৈমীকে ছাড়িয়ে ওরা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই তৎক্ষনাৎ সোহানের গালে ঠাশ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ভয়ে রোশান পিছিয়ে গেল কয়েক পা৷ সোহানের ডান হাত আপনাআপনিই থাপ্পড় খাওয়া গালটায় চেপে ধরল। রুদ্র বীভৎস এক ধমক দিয়ে বলল,
-” হাতে পায়ে বড়ো হয়েছিস, বুদ্ধি খোলেনি। এসব কী ধরনের মজা তোদের? রোশান না হয় ছোটো তুই কীভাবে এসবে সমর্থন করলি! ”

সোহান থমকানো স্বরে বলল,
-” সরি ভাইয়া আর হবে না। ”

রুদ্র মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। সোহান রোশান দু’জন হৈমীকেও সরি বলল। এরপর রুদ্রর কঠিন চোখের সামনে থেকে পালিয়ে গেল দু’ভাই। হৈমী হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল। অমনি আমতাআমতা করে সে বলল,
-” আআমি দাদিনের কাছে যাব। কুসুম আপুকে বলব পোড়া লোহা পানিতে ভিজিয়ে সে পানি দিতে। আমি খাব, ভয় পেলে এমন করে পানি খেতে হয়, এতে ভয় কেটে যায়। দাদিনকে বলব যেন দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে দেয় আমি খাব৷ আআমি নিচে যাব, মানে নিচে যাই? ”

রুদ্র চোখ কটমট করে তাকাল। হৈমী জোরপূর্বক হেসে আমতা আমতা করেই বলল,
-” আচ্ছা ঠিক আছে যাই আমি হ্যাঁ? যাই, গেলাম ”
______
সকাল ৭ঃ ৪৫ মিনিটে শেখ বাড়িতে হামিদার আগমন ঘটল৷ কাউকে কিছু না জানিয়ে সকাল সকাল মায়ের আগমনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল মাহের। সে চিন্তাটুকুকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলেন হামিদা নিজেই।

শাশুড়ির এভাবে আসাতে প্রথমে অবাক হলেও পরবর্তীতে ভীষণ খুশি হয় সূচনা৷ গল্পস্বল্প করে সকালের খাবার আয়োজন করে। খেতে বসার পরই সকলের অগোচরে মাহেরকে হামিদা বলেন,
-” বউমাকে নিয়ে আজই বাড়িতে ফিরতে হবে। জরুরি কাজ আছে, বাড়ি গিয়ে সব বলব। ”

ব্যস এইটুকুতেই মাহের বুঝে নিয়েছে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। নয়তো টিশার প্রেগ্ন্যাসির শেষ সপ্তাহে টিশাকে ফেলে এভাবে তার মা ছুটে আসত না। সূচনা আরো কয়েকটা দিন থাকতে চেয়েছিল। শাশুড়ির তাড়ায় থাকা হলো না। স্বামী, ননদ, শাশুড়ির সঙ্গে দুপুরের আগেই শশুর বাড়ি চলে যেতে হলো। বাড়িতে যাওয়ার পর মাহেরকে পোশাক পরিবর্তনের জন্যও সময় দিল না হামিদা৷ ছেলেকে আলাদা করে ডেকে জানাল, দু’দিনের ভিতরে হৈমীর বিয়ে দেবে সে। ছেলে তার পরিচিতই টিশার ছোটো কাকার বড়ো ছেলে আমান। মাহের যতদূর জানে মাত্র একটি এমপিওভূক্ত কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে আমান। বিবিএসের জন্যও প্রিপারেশন নিচ্ছে। তার সমবয়সী ছেলেটা৷ সে যাইহোক হঠাৎ মায়ের এ সিদ্ধান্ত কেন? মনের প্রশ্ন মুখে আনার পূর্বেই হামিদা ভীতু কণ্ঠে বলল,
-” তুই না করিস না, আমি যা বলছি হৈমীর ভালোর জন্যই বলছি। ”

-” তুমি শান্ত হও মা। আমার দিকে তাকাও। কী হয়েছে?”

দু’হাতে মায়ের চোয়াল চেপে ধরল মাহের। ভরসার সাথে তাকিয়ে বলল কথাটা। হামিদা বিচলিত হয়ে বলল,
-” যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হৈমীর বিয়ে দে মাহের। আমার কথাটা শোন নয়তো সামনে গুরুতর বিপদ ঘটবে। ”

-” সবটা খুলে বলো মা তুমি কোন বিপদের কথা বলছ পরিষ্কার বুঝতে পারছি না। ”

-” সূচনার ভাই!”

-” রুদ্র আগের মতো নেই মা। ও নিজেকে শোধরানো চেষ্টা করছে। তাছাড়া তুমি নিজেই বলেছিলে ও যদি নিজেকে শোধরায় আর হৈমীর প্রতি ওর মনোভাবটি সত্যি হয় তাহলে তুমি আপত্তি করবে না। তোমার কথা শুনেই আমি রুদ্রকে বুঝিয়েছিলাম। ”

হামিদা উত্তেজিত স্বরে বলল,
-” হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম সময় নিয়ে রুদ্রকে নিয়ে ভাবতে কিন্তু… ”

-” কিন্তু কী মা? ”

-” জেনেশুনে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ আমি নষ্ট করতে পারি না। গতকাল আমি যা শুনেছি এরপর রুদ্রর হাতে আমার মেয়েকে তুলে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ”

-” কী শুনেছ! ”

-” রুদ্র হৈমীকে পছন্দ করে এটা সত্যি, বিয়ে করতে চায় সেটাও সত্যি। কিন্তু ও কখনো হৈমীকে মা হতে দেবে না। ”

-” এসব কী বলছ! ”

-” হ্যাঁ আমি টিশাকে হৈমীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। আড়াল থেকে সমস্তটাই শুনেছি। তুই তো জানিস টিশা আস্তে কথা বলতে পারে না৷ ওপাশে হৈমী কী বলেছে না শুনলেও টিশার মুখে সবটাই শুনেছি। রুদ্র হৈমীকে শর্ত দিয়েছে বিয়ের পর কখনো বাচ্চা নেবে না। মাহের, হৈমী অবুঝ ওর বয়স কম আবেগের বশে ও ভুল সিদ্ধান্ত নেবে। জল বেশিদূর আগানোর আগেই আমাদের ওকে সঠিক রাস্তা দেখাতে হবে। ”

থমকানো স্বরে মাহের বলল,
-” কী করতে চাইছ? ”

-” আমি সব কথা সেরে এসেছি। তুই সম্মত হলেই একদিন পর বিয়েটা দিয়ে দিব। এখন ওঠিয়ে দিব না শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখি। তেমন কাউকে জানাবোও না। শুধু আমানের বাবা, মা ভাই, আর আমরা। টিশাও জানে না কিছু শুধু ওর জামাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলেছিও এসব যেন টিশাকে না জানায়। মুখ পাতলা তো হৈমীকে জানিয়ে সমস্যা বাঁধাবে। ”

-” হৈমীকে না জানিয়ে কীভাবে বিয়ে হবে? ”

-” ওকে জানাবো আজ। আমি চাইনি ও বাড়ি থাকাকালীন সব জানুক। তুই কী বলিস? ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাহের৷ থমথমে স্বরে বলল,
-” রুদ্র যা বলেছে এরপর তোমার কথার বিরোধিতা করার সাহস আমার নেই৷ আমি আমার বোনের এতবড়ো সর্বনাশ করতে চাই না। ”

-” তাহলে জানিয়ে দিই তোর মত আছে? ”

-” দাও। ”

চলবে..

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২২
রুদ্রর বন্ধু আবিরের বিয়ে আজ। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই রুদ্রকে জানানো হয়েছে। ব্যস্ততায় সে গুরুত্ব দেয়নি। আজ সকাল সকাল সব বন্ধুরা তার বাড়ি হাজির। তাদের প্ল্যান বরযাত্রীতে বর ব্যাতীত সকল পুরুষই এক রঙের একই পোশাক পরবে। এ পরিকল্পনা থেকে বৃদ্ধরা মাফ পেতে পারে। কিন্তু যুবকদের একজনও পাবে না৷ সে রুদ্র যতই রসকষহীন কাঠখোট্টা মানুষ হোক না কেন। বন্ধুরা কেউ ছাড় দেবে না তাকে। বাধ্য হয়ে তাই কিছু কেনাকাটা করতে বের হলো রুদ্র। সঙ্গে থাকল ঝিনুক, পনির।

গতকাল হৈমীর বিয়ের কথা সূচনা শুনেছিল। মাহেরের আদেশ অনুযায়ী এ ব্যাপারে তেমন ভাবেওনি। সকাল সকাল এবার শাশুড়ি মায়ের আদেশ, ননদকে নিয়ে একটু কেনাকাটা করতে হবে। যে যা হুকুম করছে সূচনা বাধ্য মেয়ের মতো তাই পালন করছে। হৈমীকে সকালবেলাই জানানো হলো আগামীকাল তার বিয়ে! আকস্মাৎ এমন কথা শুনে শ্বাসরোধ হয়ে এলো তার। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” ও আম্মু আমার বিয়ে? আমিত জানি না। পাত্র কে? ”

হামিদা সহজ গলায়ই উত্তর দিল,
-” তোর চেনাই টিশার চাচাত ভাই আমান। ”

বিস্মিত গলায় হৈমী বলল,
-” আমান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে! আমিত অনেক ছোটো আম্মু। বিয়েটা এক বছর পর দাও প্লিজ, এখন দিলে বাল্যবিবাহ হয়ে যাবে। ”

হৈমীর কথা শুনে সূচনা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। এই মেয়ে কি বিয়েটা মজা হিসেবে নিচ্ছে? ওর লাইফে কি সিরিয়াস বলতে কিছুই নেই? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। হামিদা চোখ গরম করে বিয়ের ব্যাপারটি কতটা সিরিয়াস বোঝালেন মেয়েকে। সব বুঝে হৈমী শুধু চুপ মেরে গেল। সূচনা যখন রেডি হয়ে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বের হতে চাইল, ঠিক তখনি তার টনক নড়ল। ঢোক গিলে দুরুদুরু বুকে প্রশ্ন করল,
-” ও ভাবি সত্যি আমার বিয়ে কিন্তু কেন? ”

সূচনা অধরকোণে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
-” সত্যি তোমার বিয়ে হৈমী। কেন এই উত্তর আমিও জানি না। শুধু জানি এই বিয়েটা হলে তুমি ভালো থাকবে। ”

-” আমিত আমান ভাইকে পছন্দ করি না ভাবি… ”

বাকিটুকু বলতে পারল না হৈমী। তার মা এসে তাড়া দিল রেডি হতে। বাকি কথাটুকু ঢোক চিপে গিলে ফেলল সে, বিরস মুখে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে ঢুকে গেল বাথরুমে। হামিদা যদি আর কয়েক সেকেণ্ড পর আসতো তাহলেই সূচনা শুনতে পেত হৈমীর গিলে ফেলা বাকি বাক্যটুকু,
-” আমিত তোমার ভাইকে পছন্দ করি! ”

প্রচণ্ড সিরিয়াস সময়টায় হৃদয়ে দোলা দেয়া কঠিন সত্যটুকু হৈমীর বলা হলো না, শোনা হলো না সূচনার। মনের অতি গোপনে যেই সত্যিটুকু যত্ন করে রেখেছে হৈমী সে সত্যটুকু শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বার বার স্মরণ করল। সেদিন রুদ্রকে প্রথমবার দেখা, চিঠি দিয়ে প্রপোজ করা সবটাই কি মজা ছিল? ওসব মজা হলেও এরপরের ঘটনাগুলো? রুদ্রকে দেখার জন্য মন আনচান করা, তার চোখের নাগালে থাকতে চাওয়া, তাকে নিয়ে শতশত কল্পনা, জল্পনা, অসংখ্য কৌতূহল, অন্য নারীর আশপাশে দেখলে গা জ্বালা অনুভূতি, এসব তো মিথ্যে নয়। আর এই যে হঠাৎ বিয়ে! বিয়ে তো কষ্টদায়ক কোনো ঘটনা নয়। তবুও তার কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? সে তো কারো কাছে কমিটেড নয়। কারো সাথে তার প্রেমঘটিত বিষয়াদিও নেই৷ তাহলে এ ব্যথার মানে কী? তার কি রুদ্রর সঙ্গে অদৃশ্য কোনো বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে?

আপনমনে প্রশ্ন উঠতেই চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিল হৈমী। স্মরণ করল রুদ্রর রাশভারি মুখটাকে। ঐ দৃঢ় দৃষ্টিজোড়াকে। শরীর, মন আহত হওয়া সেই স্পর্শগুলোকে! মুহুর্তেই হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠল, চোখ দু’টো হলো ঝাপসা। বুক ভারীও হলো। বিরবির করে বলল,
-” সবার পছন্দ যে ভালো হয় তার তো মানে নেই। সবারই যে ভালো জীবনসঙ্গী পেতে হবে এমন কোনো নিয়মও নেই। রুদ্র বেয়াই না হয় গুন্ডা টাইপ, কর্কশ মানুষ তাই বলে সে কি পুরুষ মানুষ না? তারও অধিকার আছে আমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার। ”

কিছুক্ষণ চুপ করে আবারো নিজেই নিজেকে বোঝাতে লাগল। যেন তার ভিতরের সত্তা তাকে বোঝাচ্ছে।

-” আমি যদি একটু বেশি দয়ালু হয়ে উনাকে ভালোবাসি ক্ষতি কী হবে শুনি? তবুও তো মানুষকে দেখাতে পারব আমার জামাই দ্যা গ্রেট ডন রুদ্র। সবচেয়ে বড়ো কথা আনকমন একটা জামাই হবে। দেখতেও মন্দ না ইয়া লম্বা, ফর্সা বোধহয় আমার চেয়ে কমই হবে। এটা সমস্যা না ছেলেরা একটু কম ফর্সাই ভালো লাগে। তবে হেব্বি স্মার্ট উনি, ইউনিক হেয়ার স্টাইল, দাঁড়ি স্টাইল, এক পলক তাকালেই তো চোখ ঝলসে যায়। কত পুরুষ দেখি বুকের পাটা নাই, এর দিকে তাকালেই তো ব্ল্যাক বোর্ডের মতো মসৃণ, সমান বুকের পাটা দেখতে পাই। দেখেই বোঝা যায় কী শক্ত, মজবুত। অমন তরতাজা যুবক চোখ লাগিয়ে দেওয়া সুন্দর পুরুষটা না হয় একটু গুন্ডামিই করে। করুক না, পৃথিবীতে একটা দু’টো গুন্ডাকে আমার মতো সুন্দরীরা ভালোবাসতেই পারে। এতবড়ো পৃথিবীতে গিজগিজে মানুষের ভীড়ে একটা দু’টো আনকমন কাপল থাকতেই পারে৷ এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া শুনেছি বউ পেলে অনেক জামাই ভালো হয়ে যায়। ”

কত কথা সহজ ভাবে আপন মনে বিরবিরিয়ে যাচ্ছে হৈমী। অথচ মেয়েটা জানেই না সামনে তার ঠিক কতটা কঠিন সময় আসবে। রুদ্রর প্রতি তার আবেগটা সত্যি। আজ হয়তো তার হৃদয় কিশোরী বয়সের আবেগে জর্জরিত। কিন্তু এই আবেগ কতটা অনেস্ট তা পৃথিবীর কেউ বুঝবে না কেউ না। কেবল যারা এই আবেগে জর্জরীভূত তারাই টের পাবে।

অদৃশ্য ঘোর থেকে সহসা আঁতকে ওঠল হৈমী ভাবল,
-” আমার যে আমান ভাইয়ের সাথে বিয়ে। এই ভাবনা গুলো আগে কেন এলো না? আরেহ আগে আসবে কী করে আগে তো আমার বিয়ে ঠিক হয়নি। কিন্তু এবার কী হবে? আমার তো বিয়ে! রুদ্র বেয়াইকে কি জামাই হিসেবে পাবো না? আমার তো উনাকেই ভালো লাগে একটু ভয় পাই তবুও তো উনাকেই পছন্দ হয়। ”

হৈমীর বের হতে দেরি হচ্ছিল তাই সূচনা বাথরুমের দরজায় টোকা দিল। বলল,
-” হৈমী তাড়াতাড়ি বের হও। এত দেরি হচ্ছে কেন? মা কিন্তু বকছে। ”
________________
কেনাকাটা করে গাড়িতে বসে ঝিনুক পনিরের অপেক্ষা করছিল রুদ্র। এই দু’জন গেছে সিগারেট আর পান কিনতে। পনির সিগারেট তেমন খায়না। সে খুব পানভক্ত। পান খেয়ে দাঁত, ঠোঁট লাল করে চেহেরায় আলাদা মাধুর্য আনে সে। আর ঝিনুক রুদ্রর মতোই দুঃসহ সিগারেটখোর। ওদের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকেই চোখ দু’টো আশপাশে ঘোরাচ্ছিল রুদ্র। এমন সময় সহসা চোখজোড়া স্থির হয় ডান পাশের রিকশাতে। যে রিকশায় বসে আছে দুটো পরিচিত মুখ। আর এই দু’টো পরিচিত মুখই রুদ্রর অতি প্রিয়। হ্যাঁ সূচনার মতোই হৈমীও তার অতি প্রিয়। কারো প্রিয়জন হয়ে ওঠতে খুব বেশি সময় যেমন লাগে না তেমনি খুব বেশি কারণও লাগে না। হৈমীর ক্ষেত্রে রুদ্রর এই অনুভূতিটা তেমনি হয়ে গেছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হৈমীকে নিয়ে সূচনা শপিংমলে ঢুকে পড়ল। রুদ্র এ দৃশ্য দেখতে দেখতেই পকেট থেকে সেলফোন বের করে কল করল সূচনাকে। কল রিসিভ হতেই প্রশ্ন করল,
-” তোকে শপিংমলে দেখলাম, কিছু কিনবি? ”

থতমত খেয়ে ঢোক গিলে সূচনা বলল,
-” হ্যাঁ ওই তো হৈমীর কিছু কেনাকাটা আছে। মা বলল ওর সঙ্গে আসতে…”

রাশভারি স্বরে রুদ্র বলল,
-” আমাকে ফোন করতি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। এভাবে একা দু’জন মেয়ে আসা ঠিক হয়নি। মাহের ব্যস্ত থাকলে আমায় ফোন করা উচিৎ তোর। ”

-” আসলে ভাইয়া.. হৈমীর জন্য। ”

-” কার জন্য এসেছিস সেটা ফ্যাক্ট না। তুই আরেকজনের দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়েছিস সেটাই ফ্যাক্ট। আমি মনে করি দায়িত্ব নেয়ার বয়সটা তোর এখনো হয়নি। মাহেরের উচিৎ ছিল তোদের সঙ্গে আসা। হোয়াটএভার, যেখানে আছিস দাঁড়া আমি আসছি। ”

রুদ্র তাদের কাছে আসবে শুনেই সূচনার বুক ধড়ফড় শুরু হলো। কেমন ভয় ভয় করছে। যেন বিপদের গন্ধ চারপাশে ছেয়ে গেছে। বারকয়েক ঢোক গিলে হৈমীর হাত শক্ত করে ধরল সে। চাপা স্বরে সতর্ক করল,
-” হৈমী কাল তোমার বিয়ে এটা যেন ভুলেও ভাইয়ার সামনে উচ্চারণ করো না। বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত সবার কাছেই গোপন থাকবে। ”

হৈমীর হৃদয়টা ঠুস করে ভেঙে গেল। হায় হায় করে আর্তনাদ ওঠল সেখানে। শেষ পর্যন্ত চুরি করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে। ইস কী বিচ্ছিরি বিয়ে! এক মিনিটও অতিবাহিত হলো না। রুদ্র এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। হৈমীকে দেখেও না দেখার ভাণ করে বলল,
-” দেড় ঘন্টার মধ্যে কেনাকাটা শেষ কর। আমি তোদের পৌঁছে দিয়ে আসব। ”

রুদ্রকে দেখে হৈমীর মনটা একটু বেশিই বিষাদীয় ঠেকল। আজ যদি তার সঙ্গে রুদ্রর ভালো সম্পর্ক থাকত, প্রেমঘটিত ব্যাপার থাকত হঠাৎ করে এই বিয়ে ঠিক নিয়ে দুজন দুজনের গলা জড়াজড়ি করে একটু শোক পালন করা যেত। ইস, কেন যে অমন টাইপ সম্পর্ক হলো না ধূরর!

শাশুড়ি বলে দিয়েছেন লাল রঙের বেনারসি কিনতে। হৈমী কিনবে সাদা রঙের আঁচল টা অবশ্য লাল। রুদ্র ওদের থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। শাড়ি তাও আবার বেনারসি দেখেই এগিয়ে এলো। কেনাকাটা হৈমীর জন্য শুনল অথচ কিনতে দেখছে শাড়ি! এসব শাড়ি তো বিয়েতেই পরে মেয়েরা। এই মেয়ে এসব শাড়ি চুজ করছে কেন? ভ্রু কুঁচকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল রুদ্র। কিন্তু কিছুই বলল না। সূচনা ভয় ভয় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে হৈমীকে বলল,
-” তুমি কিন্তু বলবে না তোমার বিয়ে। ”

হৈমী মাথা নাড়াল। এমন সময় কল এলো মাহেরের। সূচনা রিসিভ করে হৈমীর পাশ থেকে সরে গেল। কারণ মাহের কোনো প্রশ্ন করলে রুদ্রর সামনে উত্তর দিতে গিয়ে সমস্যা হবে। যদি বুঝে যায় আগামীকাল হৈমীর বিয়ে? বুঝতে পেরে যদি কোন পাগলামি করে? যদিও রুদ্রর অনুভূতি সম্পর্কে তেমন জানেনা সূচনা। যা জেনেছিল সব অতীত। তবুও সতর্ক থাকতেই হবে। হৈমী মাথা নিচু করে শাড়িটা দেখছিল এমন সময় শাড়ি বিক্রেতা একটি দোপাট্টা এগিয়ে বলল,
-” আপু দোপাট্টা নেবেন না? এই শাড়ির সঙ্গে কিন্তু এটা বেশ মানায় দেখুন। ”

এহেন কথা শুনে ধীরপায়ে রুদ্র এসে বসল হৈমীর পাশে। কপাল কুঁচকে রাশভারি আওয়াজে বলল,
-” ইডিয়টের মতো এগুলো কিনছ কেন? মাথায় কি বউ সাজার ভুত চাপল ? ”

আকস্মিক তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল হৈমী। হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে বলল,
-” ইডিয়ট কে ইডিয়ট আমি? হ্যাঁ আমিত ইডিয়টই এজন্যই তো কাল বিয়ে আর জানতে পারলাম আজ। ইডিয়ট বলেই তো আমার সঙ্গে এসব হচ্ছে। আমার মা আমার ভাই শেষ পর্যন্ত বালিকা হৈমীকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছে!”

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। চোখ কটমট করে তাকিয়ে রইল রুদ্রর হতভম্ব মুখশ্রীতে। কয়েক পল চলল পিনপতন নীরবতা। রুদ্র স্থির বসে স্থির চোখে তাকিয়ে ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” কার বিয়ে? ”

চমকে ওঠল হৈমী। মুহুর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার। আমতাআমতা করে পূর্বের স্থানে বসল। মুখটা কাচুমাচু করে রুদ্রর দিকে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” ভাবিকে প্লিজ বলবেন না। ”

-” কী বলব না? ”

-” কাল আমার বিয়ে এই কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। আগামীকাল গোপনে বিয়ে দেওয়া হবে আমাকে। আমান ভাইয়ের সঙ্গে, টিশাকে তো চেনেন ওর চাচাত ভাই। আমান ভাই দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু আমার জানি কেন পছন্দ হয় না। মানে জামাই হিসেবে আর কী…. ”

কথার ছলে রুদ্রর চোখের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠল হৈমী৷ সরে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে বলল,
-” ওমা ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনি কি রেগে যাচ্ছেন? রাগ করছেন কেন? গোপনে আমার বিয়ে তাই? রাগ করবেন না থাক, আপনাদের পরে জানানো হবে, দাওয়াতও দেবে। ”

কাঁচের দেয়ালের ওপাশে সূচনাকে আসতে দেখে হৈমী নিচু কণ্ঠে চটপটে বলল,
-” ভাবি আসছে আপনি কিন্তু কিছু না জানার ভাণ করে থাকবেন। ”

সূচনা আসার পরও রুদ্র একই ভাবে একই চোখে হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার নিশ্বাস চলছে কিনা এটুকুও বোঝা যাচ্ছে না। হৈমী শাড়ি আর দোপাট্টা দেখায় মন দিল। সূচনা এসে রুদ্রর পাশে বসল। শাড়ির দামদর ঠিক করার প্রস্তুতি নিল। হৈমী শাড়ি দেখার ফাঁকে রুদ্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার শাড়ির দিকে তাকাল। বিরবির করে বলল,
-” ইস যদি আমার বয়ফ্রেন্ড হতেন নিশ্চয়ই আমার হাতদুটো ধরে বলতেন, হৈমী এই বিয়ে তুমি করো না। অন্যের বাসরে তুমি যেও না। আমি কিন্তু বাঁচব না। ধূর ছাই ফাটা বাঁশের কপাল আমার! ”

শাড়ি, দোপাট্টা কেনা শেষে সূচনা হৈমী ওঠল। রুদ্র একই ভাবে বসে। সূচনা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে রুদ্রকে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে রোবটের ন্যায় ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। সূচনার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভরাট সুরে বলল,
-” সময় দিলি না আমাকে? আমিও তোদের সময় দেব না। আমি আবারো বুঝে গেলাম এই সমাজ, সংসার অনেস্ট এন্ড উইকদের জন্য নয়। ”

কথাগুলো বলে আচমকাই বাঁকা হাসল রুদ্র। পাশফিরে তাকাল হৈমীর দিকে। ছোট্ট গোলগাল মুখটায় প্রগাঢ় দৃষ্টি ছুঁড়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
-” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা মিস. হৈমন্তিকা। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here