#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৪৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
দুদিন পর৷ রুদ্রকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। দুই পরিবারের মধ্যে কথা হয়েছিল হৈমীর পরীক্ষার পর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শেখ বাড়িতে আনা হবে হৈমীকে। আকস্মাৎ রুদ্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ হলো। রুদ্রর বাবা জানালেন তার ফিরতে তিনমাস লাগবে। এসে ছেলে, ছেলে বউয়ের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। এ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রুদ্রর সুস্থতা। পারিবারিক চিন্তা, বিজনেস সবকিছু থেকে দীর্ঘসময় ছুটি দেয়া হলো রুদ্রকে। বিজনেসের পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়ল বড়ো চাচার ছেলে রাদিফ, আর ছোটো চাচা রিজওয়ান শেখের ওপর৷ রুদ্র মানতে চাইল না। দাদিন বকাঝকা করল। ফাঁকা বাড়িটা হুট করেই মানুষে ভরে ওঠল। বড়ো চাচি, ছোটো চাচা, চাচি, চাচাত ভাইরা উপস্থিত হলো বাড়িতে।
সন্ধার পর মুহুর্ত। বেডরুমে আধশোয়া হয়ে বসে রুদ্র। চোখ দু’টো স্থির সামনের দেয়ালে। ক্লথ ব্যাগ থেকে নিজের কাপড় বের করে, সেগুলো গুছিয়ে কাভার্ডে রাখছে হৈমী। রুদ্রর গায়ে শুধু টি-শার্ট, ট্রাউজার। স্মরণ হতেই একটি হুডি সোয়েটার বের করল হৈমী। রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল,
-” এটা পরে নিন। ”
গম্ভীর মুখটা হৈমীর দিকে ফেরাল রুদ্র। কিয়ৎক্ষণ চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। হৈমী আহত মনে তার পাশে এসে বসল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেই সোয়েটারটা পরিয়ে দিতে উদ্যত হলো। সহসা রুদ্র চমকে ওঠে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। হৈমীকে সোয়েটার পরিয়ে দিতে সাহায্য করল সে। যেন একটু স্বস্তি পেল হৈমী। নিঃস্বাস ফেলল স্বস্তি সহকারে। দরজার বাইরে থেকে হামিদা ডাকল হৈমীকে,
-” হৈমী আছিস? ”
রুদ্রর মাথায় হুডি তুলে দিয়ে সরে এলে হৈমী। বলল,
-” আছি আম্মু ভেতরে এসো তুমি। ”
হামিদা ভেতরে এলেন। নড়েচড়ে পূর্ণ গম্ভীরতা বজায় রেখে ঠাঁই বসে রইল রুদ্র। মা’কে হৈমী একটি চেয়ার টেনে দিল। চেয়ারে বসে রুদ্রর দিকে স্নেহময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন হামিদা। বললেন,
-” বাবা তোমার বয়স অল্প। এই বয়সে আমোদে মেতে থাকবা। তা না করে এত কি চিন্তা করো? সব দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলো। নেশাপানি আগে খেয়েছ এখন ওসব ছেড়ে দাও৷ দেখলে তো কী বিপদ ঘটল?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। না ফিরে তাকাল আর না কোনো জাবাব দিল। হামিদা হৈমীর ফ্যাকাশে মুখটার দিকে এক পলক তাকাল৷ এরপর রুদ্রর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-” আমার মেয়েটার চেহেরার কী হাল হয়েছে দেখেছ? কত বয়স ওর? এই বয়সটা কি স্বামী নিয়ে চিন্তা করার বয়স তুমি বলো? মুখটা একদম রক্তশূন্য হয়ে গেছে৷ ”
চকিতে হৈমীর দিকে দৃষ্টি তুলল রুদ্র। বুকের ভিতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আটকাল হৈমীর। মাথা নিচু করে ফেলল সে। হামিদা বললেন,
-” বাবা, আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিয়েছ তুমি। তোমার নিজের জীবনই যদি ঠিক না থাকে ওর জীবন ঠিক থাকবে? এতদিন তুমি একা ছিলে। যেভাবে খুশি বেঁচেছ এখন তো একা নেই। তোমার সঙ্গে হৈমীও জড়িত এখন। তোমার ভালো, মন্দ যা কিছু ঘটুক সবটার প্রভাব ওর ওপর পড়বে। ”
রুদ্র ঘনঘন চোখের পলক ফেলে হৈমীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। হামিদা বলতেই থাকলেন,
– ” দু’দিন ধরে মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে মা হয়ে আমিত টের পাচ্ছি। ও খুব বোকাসোকা বাবা৷ কিন্তু ওর মনে মানুষের জন্য অগাধ মায়া ভালোবাসা। যাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তাদের কষ্টেও কতটা কষ্ট পায় আমি জানি৷ তুমি তো ওর স্বামী ওর চোখ দু’টোই বলে দেয় ও তোমাকে কতটা ভালোবাসে। আমার হৈমী ভালো নেই বাবা। তোমার জীবনে কী হয়েছে না হয়েছে ওসব আমি বুঝতে চাই না৷ তুমিও সেসব কামড়ে বেঁচে থেকো না৷ আমি তোমার কাছে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন ভিক্ষা চাই আমার মেয়ের জন্য৷ ”
সহসা রুদ্রর একটি হাত চেপে ধরলেন হামিদা। ডুকরে ওঠলেন মুহুর্তেই। হৈমীর চোখ দিয়ে টপটপিয়ে জল গড়াল। নাক টানার শব্দ পেল রুদ্র। ক্রন্দনরত কণ্ঠে হামিদা বললেন,
-” বাপ মরা মেয়ে আমার। তুমিই এখন শেষ ভরসা। আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের সুষ্ঠু জীবন ভিক্ষা চাই। আমার মেয়েটা খুব ভালো বাবা। আমার বিশ্বাস ও তোমাকে সুখী করতে পারবে৷ তুমি শুধু স্বাভাবিক জীবনে ফেরো। আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করা মেয়েটার এমন নিভে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারি না বাবা। ”
রুদ্রর নিঃশ্বাসের গতি বাড়ল৷ আচমকা হৈমী তার মা’কে সামলালো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলল,
-” আম্মু চুপ করো। ডাক্তার উনাকে উত্তেজিত করতে নিষেধ করেছে। আর কিছু বলো না প্লিজ। ”
নিজেকে সামলাতে না পেরে ওঠে গেলেন হামিদা। চোখ বুঝে ঘনঘন শ্বাস নিল রুদ্র। মায়ের দিকে আর খেয়াল দিল না হৈমী। রুদ্রর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল। বলল,
-” আপনার কি খারাপ লাগছে? আমি ভাবি কে ডাকব? পানি খাবেন? ”
শেষ বাক্যে মাথা নাড়ল রুদ্র। অর্থাৎ সে পানি খাবে। এক মুহুর্ত দেরি না করে পানি আনল হৈমী৷ নিজহাতে রুদ্রকে পানি খাওয়াল সে। নিজের ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে দিতে নিলে রুদ্র কিঞ্চিৎ চমকাল। তার মনে হলে মাত্র দু’দিনে মেয়েটা অনেক বেশি বড়ো হয়ে গেছে। অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছে।
রাত বাড়তে লাগল। হামিদা, মাহের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সূচনা কিছুদিন বাবা বাড়িতে, ভাইয়ের কাছে থাকবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপত্তি করেনি মাহের। বরং সে যতদিন থাকবে মাহেরও মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে বলে স্বান্তনা দিয়েছে। রাত নটার দিকে ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে রুমে এলো সূচনা৷ হৈমীকে বলল,
-” ভাইয়াকে আজ আমি খাওয়িয়ে দেই৷ এরপর আমরা দু’জন মিলে খেয়ে নিব। ”
মাথা কাত করে সম্মতি দিল হৈমী। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়৷ সূচনার দিকে তাকিয়ে রুদ্রর দম বন্ধ হয়ে এলো। তার ভেতরে জমানো কথা গুলো গুমোট ধরল। দু’দিন আগে তার সঙ্গে কাদের দেখা হয়েছিল কেউ জানে না। জানলে সবার প্রতিক্রিয়া কী হবে সে জানে না। কিন্তু সূচনার প্রতিক্রিয়া ঠিক আঁচ করতে পারে৷ গোপনে গোপনে একাধারে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করল সে। ভাইকে খাওয়িয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়িয়ে, ভালোমন্দ কথাবার্তা বলে চলে গেল সূচনা। হৈমীকে বলে গেল নিচে যেতে দু’জনে একসঙ্গে খাবে। রুদ্রর সব ওষুধ খাওয়ালেও ঘুমের ওষুধটা খাওয়া হয়নি। সূচনা দিতে নিলে রুদ্র বলেছে আরেকটু পর খাবে। হৈমী নিচে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল,
-” পানি রেখে যাব? নাকি আমি এলে ঘুমের ওষুধ খাবেন। ”
থম মেরে হৈমীর শান্ত দু’টো চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্র। ফ্যাকাশে মুখটায় প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল,
-” তুমি এসো তারপর খাব।”
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর হৈমীর সঙ্গে প্রথম এই কথাটা বলল রুদ্র। হৈমীর অশান্ত হৃদয়টা এটুকুতেই শান্ত হলো। ফ্যাকাশে মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হলো হৈমীর। ধিকিধিকি বুকটা নিয়ে সন্তর্পণে চলে গেল নিচে। নিচে যেতেই দেখা হলো বড়ো চাচি জেরিন, ছোটো চাচি রিনার সঙ্গে। সাদমান, সোহান, রোশান টিভি দেখছে। হৈমী তাদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” ওরা খেয়েছে? ”
বড়ো চাচি বললেন,
-” সবাই খেয়েছে তুমি আর সূচনাই বাদ আছ। চটজলদি খেয়ে নাও। এখানে বেশ শীত। ”
ছোটো চাচি সহসা হৈমীকে বললেন,
-” তুমি ঘরের কাজ পারো না? ”
হৈমী খেতে বসতে বসতে মাথা নাড়াল,
-” খুব একটা না। ”
ছোটো চাচি বললেন,
-” এসেছ থেকে ঘরেই বসে আছ। কাজ না জানলেও শশুর বাড়িতে এসে ঘরে বসে থাকা ঠিক না। আমার এত বছর হলো বিয়ের। কতদিন পর পর এখানে আসি। তবুও তো ঘরে বসে থাকি না। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই সব হয়তো বোঝো না। আমি হলাম চাচি শাশুড়ি। আমার কথা শুনতে খারাপ লাগতে পারে৷ কিন্তু আমি যা বলব মুখের ওপরই বলব। কাল থেকে আমাদের হাতে হাতে কাজ করবে বুঝেছ। ”
হৈমীর মুখটা চুপসে গেল। সে মাথা কাত করে খেতে মনোযোগ দিল। সূচনা চাচিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” ছোটো কাকি, শাশুড়ি হলেই কি এভাবে কথা শোনাতে হবে? কই আমার শাশুড়ি তো এভাবে কথা শোনায় না। আমাদের হৈমী তো ছোটো আস্তেধীরে সব শিখে নেবে। ভাইয়া অসুস্থ সবে আসল বাড়িতে৷ এখনি কী কাজ করবে ও? ”
-” যে করার শুরু থেকেই করে গো। আর তোমার শাশুড়ি কথা শোনাবে কীভাবে তুমি তো সব পারো। এ বাড়িতে থাকাকালীনই নিজের সব কাজ নিজে করেছ। দাদিন, ভাইয়ের খেয়াল রেখেছ। ও বাড়িতেও নিশ্চয়ই সব কাজে তুমি এক্টিভ। ”
মৃদু হাসল সূচনা বলল,
-” না গো কাকি। আমি সব পারি না। আমারো ভুল হয় মা সবকিছু শিখিয়ে পরিয়প নিচ্ছে। তোমরাও হৈমীকে সব শিখিয়ে পরিয়ে নিও। ”
টুকটাক কথা চলতে থাকল৷ হৈমী চুপচাপ খাচ্ছিল। ছোটো চাচি খোঁচা দিয়ে হঠাৎ বলল,
-” আমার বিয়ের সময় তো আমি কত আতঙ্কে ছিলাম। বাবা মা বিয়ে দিচ্ছে তবুও কত ভয়, কত লজ্জা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো একা একাই বিয়ে করে সংসার শুরু করে। তবে যাই বলো সূচনা, হৈমীর সাহস আছে বলতে হবে। একা বিয়ে আবার ঢাকা গিয়ে কতদিন থেকে এলো। মনে বোধহয় মায়া, ভালোবাসা কম। নয়তো এভাবে নিজের পরিবার ছেড়ে কেউ থাকতে পারে? ”
রিনার অতিরিক্ত কথা কেউই পছন্দ করল না। বড়ো চাচি বিরক্ত হয়ে চলে গেল৷ সূচনা রিনাকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। হৈমীর চোখ দু’টো টলমল করছে। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে চোখ গলে যেন অশ্রু না বের হয়। এরই মধ্যে রিনা আচমকা সূচনাকে বলল,
-” একটা জিনিস খেয়াল করেছ সূচনা। রুদ্র এর আগে কখনো এতটা অসুস্থ হয়নি। বিয়ের কদিন যেতে না যেতেই কী ভয়াবহ অসুস্থ হলো বলো? আচ্ছা হৈমী তুমি কি ওর সঙ্গে ঝগরা করেছিলে? ”
আঁতকে ওঠল হৈমী। গলায় খাবার আঁটকে গেল তার। ত্বরিত পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। থমথমে গলায় বলল,
-” সেরকম কিছু হয়নি। ”
রিনা বলল,
-” কী জানি বাবা। ছেলেটা কোন চাপে এই বয়সে স্ট্রোক করে বসল। বিয়ে করল বউ নিয়ে খুশি হওয়ার বদলে এই অবস্থা কেন হলো বুঝলাম না। ”
ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল সূচনার। কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে বলল,
-” আপনি একটু চুপ করবেন কাকি। ওকে এসব শোনাচ্ছেন কেন? প্লিজ অযথা কথা বাড়াবেন না। ভাইয়া ওকে নিয়ে অবশ্যই হ্যাপি। তাছাড়া ভাইয়ার দুঃশ্চিন্তা কী নিয়ে হতে পারে আমার থেকে ভালো কেউ জানে না৷ তাই এ ব্যাপারে হৈমীকে দোষারোপ করবেন না। ”
অসন্তুষ্ট হলো রিনা। গজগজ করতে করতে চলে গেল সে। সূচনা হৈমীকে বলল,
-” কিছু মনে করো না হৈমী৷ ছোটো কাকি একটু বেশি কথা বলে। মুখে কোনো লাগাম নেই। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগরা করার স্বভাব উনার। এখানে এসে দু’দিনও টিকতে পারে না। দাদিনের সাথে খুব লেগে যায়। তুমি মন খারাপ করো না। সব জায়গায়তেই ভালো মন্দ মিশিয়ে মানুষ আছে। এগুলো ব্যাপার না। ”
হৈমী জোরপূর্বক হাসল। বলল,
-” কিছু মনে করিনি। ”
-” তুমি খুব টেনশন করছ তাই না? কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছ। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখো। তুমি শুধু ভাইয়ার সঙ্গে সময় কাটাও। ওকে টেনশন করার সুযোগ দিও না। ডাক্তার কী বলেছে মনে আছে তো? এ মুহুর্তে ভাইয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। মনে রেখ একজন স্ত্রীই তার স্বামীকে মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিকে শান্তি দিতে পারে। ”
হৈমী মন দিয়ে সূচনার কথা শুনছিল৷ সূচনা আকস্মাৎ প্রশ্ন করল,
-” তোমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে তো? ”
মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোঝাল হৈমী। সূচনা প্রচণ্ড খুশি হয়ে বলল,
-” এখন তো পরীক্ষা শেষ। আপাতত পড়ার ঝামেলা নেই। এবার দু’জন দু’জনকে পূর্ণ সময় দাও। আর হ্যাঁ স্বামীর মনের সব কথা, সব ব্যথা শুষে নেয়ার চেষ্টা করো। এতে ভাইয়ার মন থেকে চাপ কমবে তুমিও জানতে পারবে কী নিয়ে এত টেনশন করছে ওর জীবনে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। হলে সেই সমস্যা টা কী? আমার চাপা স্বভাবের ভাইটার ভিতরের কথা শুষে নিতে পারলে তুমি সার্থক হৈমী। ”
নির্নিমেষে সূচনার দিকে তাকিয়ে ছিল হৈমী। পূর্ণ মন দিয়ে শুনছিল প্রতিটি কথা। এক পর্যায়ে তীব্র জেদ তৈরি হলো মনে৷ রুদ্রর মনে ঠিক কী চলছে? কী নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে হঠাৎ এতবড়ো অঘটন ঘটাল? প্রত্যেকটা কথা তাকে জানতে হবে জানতেই হবে। রুদ্র যদি তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে থাকে অবশ্যই তার সঙ্গে সবটা শেয়ার করবে।
____________________
ছোটো চাচির বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমে এলো হৈমী৷ এসে দেখল রুদ্র সিগারেট খাচ্ছে। অমনি তার বুকটা কেঁপে ওঠল। একছুটে এসে রুদ্রর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল। মেঝেতে। হাতে ছ্যাঁকাও খেল একটু। রুদ্র হতভম্ব হয়ে চাপা আর্তনাদে বলল,
-” এটা কী হলো! ”
আচমকা কেঁদে ওঠল হৈমী৷ বলল,
-” ডাক্তার এসব নিষেধ করেছে আপনাকে। আপনি তবুও এটা খাচ্ছেন। কী চাচ্ছেন আপনি বলবেন? মরে যেতে চাচ্ছেন? আমাকে একা করে দিতে চাচ্ছেন? ”
বিছানায় ধপ করে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল হৈমী। রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল৷ চোখের পলক ফেলল ঘনঘন। কয়েক পল পর বলল,
-” ওকে ওকে কাঁদতে হবে না। আর খাব না রিলাক্স।”
আচমকা হাত বাড়িয়ে দিল হৈমী। গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়াল। ভাঙা আওয়াজে বলল,
-” আমাকে ছুঁয়ে কথা দিন আর কখনো সিগারেট বা অন্য কোনো নেশা জাতীয় কিছু খাবেন না। ”
মৃদু ধমকে রুদ্র বলল,
-” পাগলামি করছ হৈমী। বললাম তো খাব না। ছুঁয়ে কথা দিতে পারব না। ”
-” ছুঁয়ে কথা দিন নয়তো ঠিক আপনি এসব খাবেন। ”
রুদ্র ছুঁয়ে কথা দিতে রাজি হলো না। হৈমী হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। রুদ্রকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়ল সে। ওষুধ খেয়ে কম্বলের নিচে চলে এলো রুদ্রও। সন্তর্পণে পাশফিরে শোয়া হৈমীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মুখ গুঁজে দিল কানের নিচে ঘাড়ে। সহসা কেঁপে ওঠল হৈমী। চোখ বেয়ে পড়ল নোনাপানির ধারা। অভিমানী কণ্ঠে সে আবারো বলল,
-” কথা দিন আর কখনো ওসব খাবেন না। ”
আলগোছে হৈমীর কামিজ ফালি ওঠিয়ে উষ্ণ নরম পেটে হাত রাখল রুদ্র। জিজ্ঞেস করল,
-” পেট ভরে খেয়েছ? ”
উত্তর দিল না হৈমী। রুদ্র বুঝল কথা না দেয়া অবধি উত্তর পাবে না সে। এত্তো রাগ? এত্ত জেদ? ভেবেই স্কন্ধে আলতো কামড় বসালো। গা শিউরে ওঠল হৈমীর। এক হাতে গায়ে জড়ানো কম্বলটা খামচে ধরল সে। রুদ্র ধীরেধীরে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। ঘুম জড়ানো চোখ দু’টো হৈমীর মুখে স্থির করে সে বলল,
-” এত তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে গেল! ”
-” ঘুমিয়ে পড়ুন। ডাক্তার বলেছে রাত না জাগতে। ”
-” কেন ওরা কি বউ পাশে রেখে সব সময় ঘুমায়? ”
-” ওরা সুস্থ আপনি অসুস্থ। ”
-” আমি একদম সুস্থ। তার প্রুফ নিশ্চয়ই সেদিন পেয়েছ? ”
ভ্রু কুঁচকে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল হৈমী। বলল,
-” কী নির্লজ্জ আমি ওসব নিয়ে বলেছি নাকি? ”
আলতো হেসে ঠোঁট এগিয়ে হৈমীর ঠোঁটে চুমু খেল রুদ্র। হৈমী চোখ বুজল আচমকা। রুদ্র আলগোছে তার উষ্ণ বুকে মাথা রেখে বলল,
-” কথা দিলাম তোমার অনুমতি না নিয়ে আর ওসব খাব না। ”
বিস্মিত হয়ে চোখ খুলল হৈমী। বলল,
-” এর মানে? ”
-” যখনি খাব তোমার অনুমতি নিয়ে খাব। ”
-” আমি কক্ষনো অনুমতি দিব না। ”
-” সেটা পরে দেখা যাবে। ”
বলতে বলতেই হৈমীর বক্ষ বিভাজনে নাক ঘষতে শুরু করল সে। সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল হৈমীর। ছটফটিয়ে ওঠল সে। শ্বাসরোধ করে বলল,
-” আপনার ঘুম প্রয়োজন। ”
-” উহুম তোমাকে প্রয়োজন। ”
স্বামী – স্ত্রী যখন একে অপরকে খুশি রাখার চেষ্টা করে পৃথিবীর সব সুখ যেন সেই দম্পতির মধ্যেই নিহিত থাকে। হৈমী জানে রুদ্রর তাকে প্রয়োজন। রুদ্র জানে চঞ্চলা হৈমীর হঠাৎ নিশ্চুপতা ভাঙতে একমাত্র সেই পারে। তার ভালোবাসা দিয়ে। জীবনে কিছু ঝড় আসে। যে ঝড় সবটা লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। আমরা মানুষরা কি টের পাই এই ঝড় না এলে নতুন করে শুরুর কথা ভাবা হতো না?
চলবে..