#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৪৭
#জান্নাতুল_নাঈমা
আচ্ছন্ন মনে রুমে বসে হৈমী। দু-চোখ জুড়ে ভাসছে রুদ্রর মুখাবয়ব। একটা মানুষের কত রূপ হয়? মস্তিষ্ক জুড়ে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এই নিয়ে রুদ্রর ক’টা রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটল তার? হিসেব কষতে ইচ্ছে করল না। শুধু হৃদয় জুড়ে দুলুনি অনুভব করল। এ মুহুর্তে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী স্ত্রী। শশুর বাড়ির ঝুটঝামেলা সম্পর্কে আগে শুনেছে। চোখের সামনে এ প্রথম দেখল। পাশাপাশি নিজের স্বামী নামক মানুষটার আরো একটি রূপের পরিচয়ও পেল। রুদ্র তার সঙ্গে যাই করুক না কেন। সেসব তার হৃদয়ে কতটুকু নেড়েছে জানে না। তবে আজকের ঘটনাটি তার সমস্ত হৃদয় নাড়িয়ে এক রুদ্রর বশীভূত হয়ে গেল। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মেয়েই বোধহয় চায়, তার জীবনসঙ্গী এভাবেই পাশে থাকুক। পারিবারিক যাবতীয় সমস্যায় পাশে থেকে এভাবেই মোকাবিলা করুক। শশুর বাড়িতে একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে বড়ো সাপোর্ট আর কিছুই হতে পারে না। হৈমীকে আচ্ছন্ন রূপে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল রুদ্র। মৃদু কেশে এগিয়ে এসে বলল,
-” কী ব্যাপার কোথায় ভাসছ? এই নাও এখান থেকে একটা খেয়ে নাও দ্রুত। ”
চমকে ওঠল হৈমী। পিটপিট করে তাকাল রুদ্রর গম্ভীর মুখটায়। রুদ্র ইশারায় তার হাতের দিকে তাকাতে বলল। সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল হৈমী। বিতৃষ্ণা জাগল খুব। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। রুদ্র নিঃশব্দে তার পাশে বসল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” শরীরটা ভালো লাগছে না। এটা খেয়ে এসে আমার পাশে কিছুক্ষণ বসো। ”
নড়েচড়ে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। রুদ্রর শরীর খারাপ লাগছে? আর কিছু ভাবতে পারল না। বিচলিত ভঙ্গিতে একটি কন্ট্রাসেপটিভ পিল নিয়ে ছুটে গেল নিচে। রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল হৈমী ফিরে আসার।
চঞ্চলিত পায়ে, প্রায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ডাইনিং রুমে যাচ্ছিল হৈমী। আচমকা ছোটো কাকির কাঁধের সঙ্গে ধাক্কা খেলে ছোট্ট দেহটা টনটন করে ওঠল। দু-চোখ উপচে বেরিয়ে এলো নোনাপানির ধারা। ছোটো চাচিও আচমকা ধাক্কা খাওয়াতে কাঁধে বেশ ব্যথা পেল। চ্যাঁচিয়ে ওঠল হিংস্র ভাবে। বলল,
-” এই মেয়ে এই চোখের মাথা খেয়েছ নাকি। ও মা গো আমার কাঁধটা বুঝি আর নেই। সর্বনাশা মেয়ে আমার কী সর্বনাশটাই করল। ”
বুকের বা পাশে হাত রেখে কাঁপতে লাগল হৈমী। কী ভয়াবহ আঘাত পেয়েছে শুধু মাত্র সেই জানে। উচ্চ শব্দে না কেঁদে শুধু ফুঁপাতে লাগল। ছোটো কাকি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে কিছুক্ষণ বকাবকি করে চলে গেল। হৈমীর মাথাটা ভনভন করছে। হঠাৎ খেয়াল করল তার হাতে থাকা ট্যাবলেটটা নেই! কোথায় পড়ল? আশপাশে উদ্ভ্রান্তের মতো খোঁজাখুঁজি করল কিছুক্ষণ। পেল না! বাম পাশের কাঁধ থেকে বুক পর্যন্ত ব্যথায় অসহ্য হয়ে ফিরে গেল রুমে। রুদ্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই হৈমী তার পাশে গিয়ে বসল। ডুকরে ওঠল আচমকা। রুদ্র হতভম্ব হয়ে পলক ফেলল। কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” কী হয়েছে? কাঁদছ কেন, কী হলো? ”
ঠোঁট উল্টে হৈমী ঘটনাটা বলল। রুদ্র সহসা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তোমাকে কতবার বলেছি ধীরেসুস্থে হাঁটবে। ধীরেসুস্থে কথা বলবে। ”
রুদ্রর এমন কথায় হৈমীর কান্নার বেগ বাড়ল। রুদ্র খেয়াল করল হৈমীর শরীর মৃদু কাঁপছে। একটি হাত বুকের বা পাশে নরম স্থান চেপে ধরেছে। শ্বাস রোধ হয়ে এলো রুদ্রর। ঢোক গিলে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” বেশি ব্যথা পেয়েছ? ”
হৈমী ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
-” মনে হচ্ছে লোহার সাথে বাড়ি খেয়েছি। হাতটাও নাড়াতে পারছি না। ”
ধীরেধীরে এগিয়ে এলো রুদ্র। থমথমে মুখে হাত বাড়িয়ে হৈমীর বা হাতটা ধরল। উপর নিচ হাতটা ওঠানামা করতে নিলে মৃদু আর্তনাদ করল হৈমী। রুদ্র সেসবে পাত্তা না দিয়ে বেশ কয়েকবার জোর পূর্ব হাতটা নাড়াচাড়া করল। বলল,
-” ঠিক আছে সেরে যাবে। এরপর যেন এত ছটফট ছটফট না করো। ধীরেসুস্থে হাঁটবে, ধীরেসুস্থে কথা বলবে। দেখবে অঘটন ঘটবে না। ”
হৈমী ক্ষেপে গিয়ে বলল,
-” আমি ঠিক ভাবেই গিয়েছিলাম। ”
-” ওকে ওকে কুল। ”
স্যারেন্ডারের ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হৈমীর দুগালের নোনাপানি মুছে দিল রুদ্র। হৈমী কিঞ্চিৎ শান্ত হলো। থমথমে সুরে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার কেমন লাগছে? ”
ভ্রু কুঁচকাল রুদ্র। বারকয়েক চোখের পলক ফেলে আচমকা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে মুখে ডান হাতটা হালকা চেপে ধরে বলল,
-” কেমন আর লাগবে দমফাটা হাসি আঁটকে ছিলাম। ছোটো কাকি আর তুমি মিলে যে কাণ্ডটা ঘটিয়েছ এরপর আমার আর কেমন লাগবে। ”
রুদ্রর আচমকা হাসি দেখে হৈমীর ব্যথাহত মনে আরো দ্বিগুণ ব্যথা লাগল। চোখ কটমট করে, রাগে ফুঁসতে লাগল সে। রুদ্র হাসি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে বলল,
– ” আমার বউয়ের যেমন শুঁকনো পথে আছাড় খাওয়ার অভ্যেস। ছোটো কাকার বউয়ের তেমন সোজা পথে হাঁটতে গেলে ঝগরা করার অভ্যেস। দু’জন ভিন্ন প্রজাতির পাগল একসাথে হলে এমন ঘটনা তো ঘটবেই! ”
চোখ বড়ো বড়ো করে মুখ হা করে ফেলল হৈমী। তার রক্ত লাল মুখটা যেন কাঁপছে। তিরতিরিয়ে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়ায় নজর পড়তেই রুদ্র কেশে ওঠল। আলগোছে বিছানা থেকে ওঠে গিয়ে দরজা আঁটকে দিল সে। নিঃশব্দে পুনরায় বিছানায় এসে হৈমীকে কাছে টেনে নিল। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” রাগছ বেশ ঠোঁট কাঁপাচ্ছ কেন ? ”
হৈমী নড়েচড়ে সরে যেতে চাইল। কিন্তু রুদ্রর বাঁধন থেকে সরে যাওয়া কি এতই সহজ? একদমই নয়। বেচারি সরতে পারল না বরং জব্দ হলো বলিষ্ঠ দেহের নিবিড় আলিঙ্গনে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়া সিক্ত হলো স্থূল ঠোঁটের উত্তাপে। দীর্ঘসময় নরম ঠোঁটে প্রণয় বর্ষণে ভিজল রুদ্র। বক্ষতলে ছটফটানো দেহের ভাঁজে শরীর ছেড়ে শান্তির শ্বাস নিল সে। ধীরেধীরে দু’হাতে আগলে ধরল হৈমী। টের পেয়ে তৃপ্তি ভরে হাসল রুদ্র। মাথা তুলে লাজুক মুখটা দেখে হাত বাড়িয়ে আদর করল। কপোল ছুঁয়ে উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল,
-” ভাগ্যিস তুমি ছিলে। ”
কাঁপা কাঁপা স্বরে হৈমী বলল,
-” ভাগ্যিস কেন? ”
নিজের বাঁধন থেকে হৈমীকে মুক্ত করে পাশের বালিশে মাথা রাখল রুদ্র। চোখ বুঁজে নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
-” ঐ দিনের পর একমাত্র তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি নিজেকে কিছু করিনি। এতকাল সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচেছি। সব সময় মনে হয়েছে আমার কিছু হলে ওর কী হবে? ওকে কে আগলে রাখবে। আজ ওকে আগলানোর জন্য আমি ছাড়াও সঠিক মানুষ রয়েছে। কিন্তু আমি নির্ভার হতে পারিনি। এই পৃথিবীটা খুবই নিষ্ঠুর। তার নিষ্ঠুরতা সহ্য আমাকে করতেই হবে। শুধু আফসোস রয়ে গেল কিছু মানুষকে শিক্ষা দিতে পারলাম না বলে। ”
অবাক চোখে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” কাকে শিক্ষা দিতে পারলেন না? ”
-” যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছে।
আঁতকে ওঠল হৈমী। ঢোক গিলে বলল,
-” কীভাবে? ”
-” নিজেকে শেষ করে। ”
আতঙ্কিত হয়ে হাত বাড়িয়ে রুদ্রর ঠোঁট চেপে ধরল হৈমী। রুদ্র সে হাতের তলায় সন্তর্পণে চুমু খেল। চোখ বুজে। কয়েক পল পর মুখ সরিয়ে বলল,
-” পারব না তো। এতদিন পারিনি বোনের জন্য। এখন পারব না বউয়ের জন্য। ”
হৈমীর চোখ দু’টো টলমল করছিল। সেই টলমল চোখে নির্নিমেষে তাকিয়ে রুদ্র বলল,
-” সেদিন রাতে হসপিটালে ঐ মহিলার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। বহু বছর পর! ”
ত্বরিত বেগে ওঠে বসল হৈমী। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বিচলিত মুখে তাকাল রুদ্রর দিকে। যেন আরো কিছু শুনতে চায়। আরো অনেক কিছু জানতে আগ্রহী সে। তার আগ্রহ বুঝল রুদ্র। টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজল নিবিড়ভাবে। হৈমী ঘনঘন চোখের পলক ফেলল। রুদ্র অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে নিজের সঙ্গিনীকে বলতে লাগল তার জীবনে সুপ্ত থাকা পীড়াদায়ক কথাগুলো,
– ” এই পৃথিবীতে আমরা সবাই কিছু না কিছু অবলম্বন করে বাঁচি। যার জীবনে অবলম্বন করার মতো কিছু না থাকে সেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়!”
হৈমীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রুদ্র সহসা শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়াল। দৃঢ় ভাবে পা ফেলে এগিয়ে গেল বুকশেলফের সামনে। অগণিত বইয়ের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট একটি বই বের করল সে। সেই বইয়ের ভাঁজে থাকা বহু পুরোনো দিনের একটি ছবি বের করল। থম মেরে দৃষ্টিপাত করল ছবিতে জ্বলজ্বল করা চারটে মুখকে। এরপর সন্তর্পণে বইটা রেখে হৈমীর পাশে এসে বসল। দু’হাতে ছবিটা ধরে পলকহীন তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল,
– ” জানো হৈমী, মানুষের জীবনে কিছু অতীত অভিশাপ হয়। ”
ভরাট কন্ঠস্বরের রুদ্রর সঙ্গে পরিচিত হলেও কাঁপা কণ্ঠের রুদ্রর সঙ্গে পরিচিত ছিল না হৈমী। ফলে রুদ্রর কম্পিত কণ্ঠে বুক কেঁপে ওঠল তার। ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল সে। রুদ্রর দৃষ্টি হাতে থাকা ফ্যামিলি ফটোতে স্থির। শ্বাসরোধ করা কণ্ঠে সে পুনরায় বলল,
-” আমরা কতটা সুখী ছিলাম এই ছবিটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ”
রুদ্রর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার ছবিটার দিকে তাকাল হৈমী। রুদ্রর বাবার সামনে চার, পাঁচ বছর বয়সি একটি ছেলে দাঁড়ানো। তার পাশে দাঁড়ানো হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত সুন্দরী এক নারী। সেই নারীটির কোলে ধবধবে ফর্সা, গুলুমুলু একটি বাচ্চা। পরনে হালকা গোলাপি রঙের ফ্রক। বোঝার বাকি নেই এরা কারা। হৈমীর এত ভাল লাগল যে খপ করে রুদ্রর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। এরপর চোখ ভরে দেখতে লাগল রুদ্রকে। অনেকটা সময় পর চারজনকেই মুগ্ধ চোখে পলকহীন দেখতেই থাকল। তার সে চাহনি দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল রুদ্র বলল,
-” এই সুখী পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেছে হৈমী। ধ্বংস করা হয়েছে শুধু এই পরিবারটাকে নয় আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎকেও। আমার জীবনের জঘন্য অতীত এই মহিলা, আমার জন্মদাত্রী। আর এই অতীতটাই আমার জন্য অভিশাপ। দিনশেষে এই অতীত স্মৃতি আমাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়। আমি সহ্য করতে পারি না, আমার ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে যায়। ”
ছলছল চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্রর করুণ মুখ তার বুকে আঘাত হানল। রুদ্র অসহনীয় স্বরে বলতে লাগল,
-” আমাদের পরিবারে সবকিছুই পরিপূর্ণ ছিল। কোনো কিছুর কমতি ছিল না। কিন্তু এত সুখ বাবার সহ্য হলো না। সে বরাবরই বিজনেস পাগল ছিল। হঠাৎ করেই একদিন আমরা জানতে পারি বিদেশের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাবা। এবার দেশে নয় বিদেশেও বিজনেস করবে তিনি। বাংলাদেশে বড়ো কাকা, ছোটো কাকা সামলাবে। আর সে বিদেশের এক নামকরা কোম্পানিতে যোগ দেবেন। ধীরেধীরে সেখানে স্থায়ী হওয়ারও চেষ্টা করবেন৷ আরো কত কী প্ল্যান। তখন আমি খুব ছোটো৷ শুধু মনে আছে এটা নিয়ে বাবার সঙ্গে এই মহিলার ঝগরা হয়েছিল। বাবা বিদেশে যাক সে চায়নি। কয়েক মাস পর একপ্রকার জোর করেই আমাদের রেখে বাবা চলে গেল। আর এই মহিলা রাগ করে আমাকে আর বোনকে নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। বাবার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধও করে দিল। একমাস পর বড়ো কাকা গেলেন আমাদের আনতে। আমার নানার জোরাজোরিতে উনি এলেন এ বাড়িতে। এরপর সময়গুলো কীভাবে গেছে আমার ঠিকঠাক মনে নেই৷ কিন্তু সাদমান যখন বড়ো কাকির গর্ভে এলো শেষ চারমাস বড়ো কাকি বাবার বাড়ি ছিল। সেই সময়গুলোর অনেক কিছুই মনে আছে, আজো মনে পড়ে। কখনো সকালে ঘুম ভাঙলে, কখনো মাঝরাত্রে। ”
এ পর্যন্ত বলে চোখ খিঁচিয়ে ফেলল রুদ্র। আচমকা তার একটি বাহু চেপে ধরল হৈমী। সেখানে মাথা ঠেকিয়ে বা’হাতে ছবিটা ধরে ঘনঘন শ্বাস ফেলল সে। বলল,
-” পুরোটা শেষ করুন প্লিজ। আমি জানতে চাই। আম্মু বলেছে মনের ভেতর খুব কষ্টের কিছু জমানো থাকলে সেগুলো যদি বিশ্বস্ত কাউকে শেয়ার করেন মন হালকা হয়। বুকের ওপর একশ মন বোঝা থাকলেও তার ওজন জিরো জিরো হয়ে যায়। ”
ঘনঘন শ্বাস ফেলল রুদ্রও। দু-হাত শক্ত মুঠোবন্দি করে চোখ বুজল। মনে পড়ে গেল সেইসব ঘৃণ্যতম দৃশ্য। হৈমী তার স্ত্রী। সেইসব দৃশ্য এতবছর কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনি। সেই ঘটনাগুলো কাউকে জানাতে পারেনি। বুকের ভিতর তীব্র ক্রোধ জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে। যা কোনোদিন ভাঙা সম্ভব না। ঘৃণার মাত্রা এতটাই বেশি যে ঐ দুজন মানুষের মৃত দেহ দেখতেও গা গুলিয়ে ওঠবে তার। যতটা ঘৃণা করলে জন্মদাত্রীর মুখে থুথু দেয়া যায় ঠিক ততোটাই ঘৃণা করে রুদ্র। সেই ঘৃণা থেকেই নিজের সঙ্গিনীকে বলল, তার জন্মদাত্রী আর বড়ো চাচার পরোকিয়ার গল্প। আশ্চর্য হলেও সত্যি ঐ ছোট্ট বয়সে রুদ্র ঠিক কী কী ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঐ দুজন মানুষ পরিবারের সকলের মুখে চুনকালি মেখে, চারটে সন্তানকে মা, বাবা ছাড়া করেছে। এসব ভাবতেই তীব্র ঘৃণা, ক্রোধে চোখ উপচে পানি বেরিয়ে এলো হৈমীর। রুদ্র, সূচনা, রাদিফ, সাদমান সবার জন্যই বুকটা হুহু করল তার। তার মনের অবস্থা টের পেয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিল রুদ্র। রুদ্রর বুকে মুখ গুঁজে সহসা ডুকরে ওঠল হৈমী। অজান্তে রুদ্রর চোখ বেয়েও দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। থমথমে কণ্ঠে সে বলল,
-” বাবা টাকার পেছনে দৌড়াল, আর উনি দৌড়ালেন যৌবনের উন্মেষ পেতে। এই দু’টোই কি মানবজীবনে সব? তাই যদি হয়ে মানুষ কেন বংশবৃদ্ধি করে? কী দরকার ছিল উনাদের আমাকে আর সূচনাকে পৃথিবীতে আনার? বাবার ওপর অভিমান কাজ করলেও কখনো ঘৃণা কাজ করে না। কারণ বাবা পাপ করেনি। আর উনি পাপ করেছে মস্তবড়ো পাপ। যার ক্ষমা ইহকাল, পরোকাল কোনো কালেই নেই। ”
ক্ষণকাল থেমে আবারো বলল,
-” ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে নিজেকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন৷ বাবার ভালোবাসা আমি বুঝতে পারি না। সে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি রাখেনি৷ কিন্তু ভালোবাসায় বিরাট ত্রুটি রেখেছে। যিনি জন্ম দিলেন তিনি তো ছুঁড়েই ফেললেন। দাদিন ভালোবাসে আমায় কিন্তু সেই ভালোবাসা আমার পর্যাপ্ত লাগে না। কারণ তিমি আজো আমার, আমাদের চেয়ে বড়ো কাকাকে বেশি ভালোবাসেন। দাদিন বেস্ট মা হৈমী। ছেলে এতবড়ো অপরাধ করার পরও সুযোগ পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলের খোঁজ নেন। ”
বিস্ময়ে শরীর শিউরে ওঠল হৈমী। রুদ্র বাহু আরো শক্ত করে চেপে ধরল। রুদ্র বাঁকা হেসে বলল,
-” এই বাড়ির কানায় কানায় কী ঘটে সব আমি জানি হৈমী। এ বাড়ির মানুষ গুলোর মন বইয়ের পাতার মতোন পড়তে পারি। একটা সময় আমি সবার কাছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না। সূচনাকে আগলে মানুষ করতে যেয়ে নিজেকে আগলানোর মানুষ খুঁজতাম। বড্ড দিশাহীন লাগত তখন। সপ্তাহে একবার বাবা ফোন করে খোঁজ নিতেন৷ দাদিন তিনবেলা খেয়েছি কিনা, ঠিক সময় স্কুলে গিয়েছি কিনা খোঁজ নিতেন। সূচনাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে গিয়ে আমাকে পিঠে রাখতেন। আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে, বাচ্চামো ভাবনা জাগতো একটা মানুষের দুটো বুক কেন থাকে না? দাদিনের দু’টো বুক থাকলে সূচনার মতোন আমিও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতাম। ”
থরথর করে কাঁপতে লাগল হৈমী। বুক ফেটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইল তার। অসহনীয় হয়ে হাঁটু ভর করে রুদ্রর গাল দু’টো কাঁপা হাতে স্পর্শ করল৷ এরপর চট করে রুদ্রর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। হতভম্ব হয়ে গেল রুদ্র। দু’হাতে হৈমীর পিঠ জড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” অ্যাঁই মেয়ে , এভাবে কাঁদছ কেন। চুপ চুপ। আরে বাবা আমি সূচনার জন্য এটুকু সেক্রিফাইস করেছি৷ ও তো খুব ছোটো ছিল এইটুকুন দুধের শিশু। ”
হৈমীর কান্না থামার নাম নেই। রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ছোট্ট শরীরটা গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল,
-” আমার কষ্টে যার চোখে এত পানি ঝড়ে সে নিশ্চয়ই নিঃস্বার্থ ভাবে আমায় ভালোবাসে? ”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে হৈমী বলল,
-” আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, এরচেয়েও বেশি ভালোবাসবো। খুব আগলে রাখব আপনাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিব না কখনোই না। ”
-” আমি এটাই চাই হৈমী। তুমি আমাকে ভালোবাসো। এতটা ভালোবাসো যে আমি সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে এক তোমাতে বিভোর থাকি। তুমি শুধুমাত্র আমাকেই ভালোবাসো, শুধুমাত্র আমার জন্য বাঁচো। আমার আর তোমার মাঝখানে একটি পিঁপড়াকেও সহ্য করতে পারব না হৈমী। তুমি আমার শেষ অবলম্বন, তুমি পারবেনা আমাকে তোমার শেষ এবং একমাত্র অবলম্বন করে বাঁচতে? ”
উন্মাদের মতো মাথা নাড়াল হৈমী। বলল,
-” পারব, আমাকে পারতেই হবে। ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হৈমীর বুকে চুমু খেল রুদ্র। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। দিনশেষে তুমি আমার হাসির কারণ। আমি তোমাকে ঠিক কতটা… ”
সহসা থেমে গেল রুদ্র। হৈমী চমকে তার মুখের দিকে তাকাল। আকুতি করে বলল,
-” বলুন। ”
চোখের ভাসাতে পুরোটা বোঝালেও মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না রুদ্র হৈমীকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। বরং জগতের সকল গম্ভীরতা মুখে টেনে ভরাট স্বরে বলল,
-” এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনো। পিপাসা লেগেছে।
”
চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে রুদ্রর বুকের বা’পাশে হাত রাখল হৈমী। বলল,
-” বলুন না কতটা ভালোবাসেন আমায়? ”
হৈমীর হাতের ওপর সন্তর্পণে হাত চেপে রাখল রুদ্র। কিঞ্চিৎ মাথা নুইয়ে বলল,
-” বলতে পারি না, বোঝাতে পারি। ”
-” আমি তো বুঝি না বলে বোঝান। ”
-” ভালোবাসা বলার জিনিস নয় মিসেস। ”
-” আমি অনুভবও করি না । ”
বাঁকা হাসলো রুদ্র। বলল,
-” বোঝো কি বোঝো না তা তো সময়ই বলে দেয়।”
-” তবুও বলবেন না? ”
কপট রাগ দেখাল হৈমী। রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দুম করে শুয়ে পড়ল। আদেশ বাক্যে বলল,
-” আর কোনো কথা নয়। যা বলেছি চুপচাপ তাই করো। যাও। ”
__________________________________
চলবে।