বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৫২

0
820

#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৫২
#জান্নাতুল_নাঈমা

-” তোর প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি সূচনা। কিন্তু উত্তরটা তোকে আমি দিব না। কাউকেই দিব না। কারণ এতে আমি অপরাধী হয়ে যাব। ভয়ংকর অপরাধী। তুই নিশ্চয়ই জানিস, অপরাধীদের সঙ্গে কেউ সংসার করতে চায় না। অপরাধীদের কেউ ভালোবাসে না। ”

কথাগুলো সহজভাবে বলল ঠিক। কিন্তু এর তাৎপর্য বুকের ভিতর বিষাক্ত অনুভূতির জন্ম দিল। কারণ, সে কোনোদিন তার ভুল স্বীকার করতে পারবে না। যদি স্বীকার করে হৈমীর চোখে মস্ত বড়ো অপরাধী হয়ে যাবে। কিন্তু স্বীকার না করেও যে অপরাধী হয়ে গেছে এই বোধ তার মাঝে জাগ্রত হলো না। অপরাধী স্বীকার করুক বা না করুক সে সব সময় অপরাধী হয়েই থাকে। রুদ্র থমথমে মুখে ওঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যাবার প্রস্তুতি নিল। প্রস্তুতি অনুযায়ী প্রস্থান করতে সক্ষম হলো না। অদৃশ্য এক মায়ার জালে আঁটকে পড়ল আচমকা। মনের ঘরে প্রশ্ন জমল, আর পাঁচটা দম্পতির মতো তারা কি পারে না সুখী হতে? আর পাঁচটা দম্পতির মধ্যে নতুন প্রাণের আগমনী বার্তা এলে তাদের মতো কি জটিলতা তৈরি হয়? হয় না তো! নিষ্ঠুর বাস্তবতায় তার শৈশব চাপা পড়েছে বলে এর অংশীদার তার সন্তান কেন হবে? হৈমীরই বা দোষটা কোথায়? ভালোবাসা কি কখনো অপরাধ হয়? মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। ভয়ংকর ভাবে ভালোবেসে। তার মতো করে সে কি ভালোবেসেছে বা বাসতে পারবে? রুদ্রর বেসামাল হৃদয়ে তিক্ত হয়ে দানা বাঁধল করুণ এক সত্যি। আত্মোপলব্ধি হলো। সে স্বার্থপর! ভীষণ রকমের স্বার্থপর একটা মানুষ সে। সময়ের বিবর্তনে, পরিস্থিতির ভারে এতটা স্বার্থপর কীভাবে হয়ে গেল! আপন মনেই বড়ো বিস্ময় জেগে ওঠল। দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা হলো সহসা। অজান্তেই আবারো বসে পড়ল হৈমীর পাশে। ভারি নিঃশ্বাস ফেলল ক্রমশ। বলিষ্ঠ ডান হাতটা ধীরেধীরে এগিয়ে নিল। হৈমীর উদর স্পর্শ করল সন্তর্পণে। চোখ বুঁজে, শ্বাস রোধ করে অনুভব করার চেষ্টা করল আরেক অপরাধীকে। হ্যাঁ অপরাধী! যে পৃথিবীতে না এসেই বাবা, মা’য়ের মধ্যে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছে। শিশুসুলভ ভাবনায় বুঁদ হতেই
দু’চোখের কার্ণিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়াল। ঠোঁট কামড়ে হাসল কিঞ্চিৎ। কয়েক পল হাত বুলাল উষ্ণ উদরে। চুমু খেতে মুখও এগুলো। নড়াচড়া করে ওঠল হৈমী। রুদ্র চট করে কামিজের ফালি ওঠাল। ভেজা ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেল তলপেটে। আচমকা চোখ খুলল হৈমী। রুদ্র আর এক মুহুর্ত ব্যয় না করে ঝটপট রুম ত্যাগ করল। তড়াক করে ওঠে বসল হৈমী। খোলা পেটে হাত রেখে পলক ফেলল ঘনঘন। নিশ্বাস ফেলল দ্রুত। পাশে তাকিয়ে ঘুমন্ত সূচনাকে দেখে নিল জহুরি চোখে। আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে পুনরায় কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ পিটপিট করে মেকি হাসল চোখ বুজে। বিরবির করে বলল,

-” আপনি চলেন ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। বেয়াই মশায়, আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন ঘুমন্ত হৈমী এতটা নিশ্চুপ থাকে না। ভাগ্যিস গভীর ঘুমাইনি। তাই তো আপনি রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথে আপনার পারফিউমের ঘ্রাণে বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠেছে! গোপনে এসে এতগুলো আদর দিয়ে গেলেন? কী ধরনের মানুষ আপনি? ভালোবাসা প্রকাশের সৎ সাহসটা নেই। অথচ ক্ষোভ প্রকাশের পূর্ণ সাহস রয়েছে। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র দুঃশ্চিন্তা সে করছে না। দুঃশ্চিন্তা কেবল রুদ্রর মন নিয়ে, রাগ নিয়ে, বেসামাল চিন্তা, চেতনা নিয়ে। আর এসব কারণেই কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে সহায়তা করেছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড, খালাত বোন টিশা। এবার দেখার অপেক্ষা সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক। দিন গোণা শুরু। কাঙ্ক্ষিত সময়টা আসতে অনেকগুলো মাস অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে। বাচ্চাটাকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনতে হবে। সবশেষে শান্তি এটাই বাচ্চাটার কিছু হয়নি। সে তো রুদ্রর ভয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস রুদ্র ঠিক সময় উপস্থিত হয়েছিল। নয়তো কতবড়ো সর্বনাশ ঘটে যেত। এরজন্য অবশ্য রুদ্রর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর পরের ঘটনা গুলো শুধুই দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাস গুলোর শেষ পরিণতি কী হবে। সে জানে না। সে শুধু জানে ভালোবেসে মাথা নত করে আর থাকবে না। রুদ্র যখন মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছে তাকে ডিভোর্স দেবে। তখন এর মূল্য রুদ্রকে চুকাতেই হবে। যেই রুদ্র সেদিন তাকে বলেছিল, শুধু তাকে ভালোবাসতে, তাদের মধ্যে তৃতীয় কাউকে না আনতে। শুধু তার জন্য বাঁচতে। সেই রুদ্রই তৃতীয় কারো জন্যই তাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছে। তার কাছে ঐ এক মুহুর্তে বউয়ের চেয়ে বাচ্চা বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুদ্রকে জানাশোনার পর তার একটা উপলব্ধি হয়েছে,
মানুষের অপর নাম গিরগিটি। এরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনের রঙ বদলায়। রুদ্র তার চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়েছে। যার দাম তাকে দিতেই হবে। দিনশেষে একবার না হয় হৈমীও রঙ বদলাবে। স্বার্থপর হবে। সহ্য করতে পারবে তো রুদ্র?
______________________
সকালবেলা ঘুম ভাঙল মায়ের ফোনে। মেয়ের খবর নিয়ে হামিদা তার আফসোস শুরু করলেন,

-” আল্লাহর কাছে চাইলাম ছেলের ঘর আলো করে ছোট্ট প্রাণ আসুক। কিন্তু পেলাম মেয়ের বেলায়। ”

হৈমী হাই তুলতে তুলতে বলল,

-” ছেলের ঘরেও আসবেনি আম্মু চিন্তা করো না। ”

হামিদা উদাস গলায় বলল,

-” বিয়ের পর থেকেই তো বলতেছি বউকে। এখনো সুখবর পেলাম না৷ আল্লাহ জানে সমস্যা আছে কিনা। আমার তো সন্দেহ হয় ওরা আদেও ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা! ”

-” উফফ আম্মু অযথা চিন্তা করছ তুমি। সেরকম কিছুই না। ”

-” থাক বাদ দে ওসব। রুদ্রর কথা বল। সব ঠিকঠাক আছে তো? শোন হৈমী, এরপর যদি আর একবার তোর গায়ে ও হাত তোলে আমি কিন্তু বধু নির্যাতনের কেস দিয়ে দিব ওর নামে! ”

খিলখিল করে হেসে ওঠল হৈমী। বলল,

-” তুমি চিন্তা করো না তো আম্মু। কিছুই হবে না। দোয়া করো সময় দ্রুত চলে যাক। আর আমিও ফিরে আসি। ”

আঁতকে ওঠল হামিদা। বলল,

-” ফিরে আসি মানে? কবে, কখন। ”

চুপসে গেল হৈমী। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” বাচ্চাকে তার বাবার কাছে দিয়ে তবেই ফিরব। ”

চমকাল হামিদা। গা শিউরে ওঠল নিমিষেই। কী ভয়ানক কথা! শঙ্কিত গলায় বলল,

-” বাচ্চা কে দিয়ে আসি মানে। এটা কি দোকানে কেনা জিনিসপত্র নাকি! কষ্ট করবি তুই, তুই হলি মা। মায়ের অধিকার সবচেয়ে বেশি। কোন দুঃখে তুই ওকে দিয়ে আসবি? আসলে এখনি আয় তোর ভাই এখনো বেঁচে আছে। আমি বেঁচে আছি। কোনো সমস্যা হবে না। ”

-” কোন দুঃখে দিয়ে আসব সেটা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমি এসব কথা কারো সাথে শেয়ার করবে না। শুধু জানবে আমি যা করব ভেবেচিন্তেই করব। ”

-” তুই আর কী সর্বনাশ করবি নিজের? আর কী সর্বনাশ হওয়ার বাকি আছে বল আমাকে! ”

-” ধরে নাও শেষ একটা সর্বনাশই করব। ”

-” এক থাপ্পড় খাবি। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার মতো বয়স এখনো তোর হয়নি। এজন্যই একের পর এক ভুল করছিস। সর্বনাশ বয়ে আনছিস! ”

-” সিদ্ধান্ত নিতে বয়স লাগে না আম্মু। বাস্তবতাই শিখিয়ে দেয় কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রাখছি আমি। এ ব্যাপারে প্লিজ তুমি কাউকে কিছু বলবে না। ”

হামিদাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না সে। চট করে ফোন কেটে দিল। উত্তেজিত হয়ে পড়ল হৈমী। মাহের কে ডেকে সমস্ত কথাই বলল। দেরি না করে মাহের কল করল হৈমীকে। মায়ের ওপর বিরক্ত হলো হৈমী। মাহেরকে বুঝিয়ে বলল,

-” চিন্তা করো না ভাইয়া। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলব। ”

মাহের বিচলিত ভঙ্গিতে বলল,

-” নিজের জীবনের আর কোনো সিদ্ধান্ত একা নিয়ো না হৈমী। তুমি এখনো ছোটো। অন্তত আমার ওপর বিশ্বাস করে সবটা জানিয়ো। আর হ্যাঁ যে কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষনাৎ আমাকে জানাবে। ”

ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ফোন কেটে দিল হৈমী। কিছুক্ষণ পর সূচনা রুমে এলো। মিষ্টি এক হাসি উপহার দিয়ে বলল,

-” ফ্রেশ হয়েছ? নাস্তা রেডি। ”

হৈমী দু’দিকে মাথা নাড়াল। সূচনা এসে রুম ঝাড় দিল। এরপর বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে হৈমী ডাকল,

-” ভাবি এদিকে আসো কথা আছে। ”

সূচনা কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো। ফিরে এসে বসল হৈমীর পাশে। হৈমী কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়াই বলল,

-” সবার আগে আমি তোমার ননদ। এরপরের সম্পর্ক গুলো আপাতত ভুলে যাও। ”

সহসা হৈমীর মুখে এমন কথা শুনে ভড়কে গেল সূচনা। হৈমী পুনরায় বলল,

-” ননদের শশুর বাড়িতে এতদিন এসে থাকাটা লোকে ভালো চোখে দেখে না। এবার তুমি বলবে এটা তোমার বাপের বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি। এখানে এসে মাসের পর মাস থাকতেই পারো৷ তাহলে আমিও বাঘিনী ননদ হয়ে বলব, এটা যদি করো আমার ভাইয়ের জন্য দ্বিতীয় বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে! ”

সূচনার বুকটা ধক করে ওঠল। চোখের পলক পড়ল ঘনঘন। বিস্ময়ে মুখ হা! মনে হচ্ছে আঠারো বছর বয়সী হৈমী নয় তার সম্মুখে চল্লিশের ঊর্ধ্বে এক হৈমী বসে আছে। বেশ বিচক্ষণ নারী। ভারি বুদ্ধি সম্পন্ন। রায় বাঘিনী ননদিনী যাকে বলে। ঢোক গিলল সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

-” আমি শুধু ভাইয়ার কথায় এখানে নেই। মাহেরও আমাকে তোমার দেখাশোনার জন্য এখানে থাকতে বলেছে। ”

চটে গেল হৈমী। বলল,

-” কেন? আমি কি পঙ্গু হয়ে গেছি। যে আমার দেখভাল করার জন্য আলাদা লোক লাগবে। তাছাড়া আমি যার বউ, যার বাচ্চা আমার পেটে সেই আমার দেখাশোনা করুক। সে কি অযোগ্য, সে কি অকর্মা, নাকি সে প্রতিবন্ধী! যে তার বউকে দেখাশোনার জন্য আরেজনের বউকে ধার করতে হবে! ”

বাক্য গুলো প্রায় চিৎকার করে উচ্চারণ করল সে। দূর থেকে মনে হলো বেশ ঝগড়া লেগেছে। তাই ছুটে এলো রুদ্র। পাশের ঘরের সাদমানেরও ঘুম ছুটে গেছে। খালি গায়ে চোখ কচলাতে কচলাতে সেও বেরিয়ে এলো। নিচ থেকে রুদ্র আর সাদমান কে দেখে রিনাও উপরে চলে এলো।

সূচনা হৈমীকে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ করল। শুনল না হৈমী। চিৎকার করে বলল,

-” আমার ভাই কি বউকে বাপের বাড়ি রাখার জন্য বিয়ে করেছে? এ বাড়ির মেয়ে যদি শশুর বাড়িতে নিজ কর্তব্য পালন না করে বাপের বাড়ি এসে থাকতে পারে আমি কেন পারব না? আজই বাপের বাড়ি চলে যাব আমি। ”

শক্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়ল রুদ্র। সাদমানের ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেল। রিনার মুখ হা হয়ে গেল হৈমীর মুখে এ ধরনের কথা শুনে। এসব বলার মেয়ে তো সে না। ভুতে টুতে ধরল নাকি! সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে বিশেষ করে রুদ্রর উপস্থিতি স্বচক্ষে দেখে হৈমীর গলার জোর বাড়ল। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,

-” আমি এ ঘরে কেন? কেন আমি এই ঘরে থাকছি। আমার কি এই ঘরে থাকার কথা? যে আমাকে বিয়ে করে এই বাড়িতে এনেছে তার ঘরে কি বন্যা হয়েছে? নাকি তার ছোঁয়াচে রোগ আছে কোনটা? ”

রুদ্রর কঠিন ভাবমূর্তি দেখে সরে গেল সাদমান। সূচনাকে তাকে মানাতে বলল,

-” আচ্ছা আচ্ছা এত রাগ করো না। বাবা আসুক এরপর মাহের এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তুমি প্লিজ শান্ত হও। ”

পিটপিট করে তাকিয়ে রইল হৈমী। ঠোঁট টিপে হাসল আড়ালে। বলল,

-” হ্যাঁ তাড়াতাড়ি চলে যাবে। আমার আম্মু চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে ছেলে ঘরের নাতি-নাতনির মুখ দেখার। মন দিয়ে সংসার করবে আর আল্লাহর কাছে আম্মুর জন্য নাতি, নাতনি চাইবে। অন্যের বউকে নিয়ে এত ভাবার দরকার নেই। যার বউ সে যদি দেখে রাখতে না পারে না পারুক। এর দায় অন্যরা কেন নেবে। নিজে সুখী থাকবে না বলে অন্যদের সুখ কেন কেড়ে নেবে? বউকে ভালোবাসার যোগ্যতা তার নেই বলে অন্যের যোগ্যতাকে খাটাতে দেবে না কেন? আমার ভাই তো কারো মতো কাপুরষ না। যে বউকে চোরের মতো ভালোবাসবে। ”

এক নাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে ওঠল হৈমী। পানি পিপাসা লেগে গেল তার। সূচনা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাই হঠাৎ হৈমীর অদ্ভুত আচরণের কারণ টের পেয়ে গেল। তাই রাগ করল না একটুও। বরং স্বস্তিই পেল। মাহেরকে ছেড়ে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আর বেচারা মাহের একদিকে বোন অন্যদিকে বউ। দুই মেরুর টানে চুপসে রয়েছে। সবদিক বিবেচনা করেই হৈমী সকাল সকাল হট্টগোল বাজিয়েছে। যা সবার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে। কিন্তু তার এই হট্টগোলের মাঝে চরম অপমানিত হয়েছে রুদ্র। যার পরিপ্রেক্ষিতে না পারল কিছু বলতে আর না পারল সহ্য করতে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু স্মরণ করে গেল। তার বউ তাকে, কাপুরুষ বলেছে। অযোগ্য , অকর্মণ্য। আর যেন কী? মনে করতে পারল না। গম্ভীর মুখটা আরো বেশি গম্ভীর করে বসে রইল নিজ রুমে। সিদ্ধান্ত নিল সূচনাকে বলবে,

-” হৈমী যেন রাতে তার ঘরে গিয়ে ঘুমায়। ”
_______________________
প্রাকৃতিক নিয়মে দিন পেরিয়ে রাত এলো। হৈমী চুল আঁচড়াচ্ছিল। সূচনা রুমে এসে বলল,

-” হৈমী ভাইয়া ও ঘরে যেতে বলেছে। তোমায়। একটুও খারাপ আচরণ করবে না। কথা দিয়েছে। ”

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল হৈমী। অবিশ্বাস্য সুরে বলল,

-” কথা দিয়েছে? ”

-” না মানে আমি বললাম তুমি ওর সঙ্গে খারাপ বিহেভ করবে না তো? ভাইয়া না করল। খারাপ বিহেভ করবে না৷ একটা ধমকও দেবে না। সরাসরি কথা দেয়নি। তবে মুখে বলেছে। ”

-” কিন্তু আমি যাব না৷ তুমি গিয়ে বলো হৈমীর বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও করছে না ও ঘরে যেতে। একটুও শখ জাগছে না

-” তাহলে সকালবেলা চ্যাঁচামেচি করলে কেন? ”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভারিক্কি স্বরে প্রশ্নটি ছুঁড়ল রুদ্র। চমকে ওঠল সূচনা৷ চমকাল হৈমী নিজেও। বেশ ভাব নিয়ে মুখ ফিরিয়ে চুল বাঁধল। রুদ্র শান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালো,

-” রুমে এসো। ”

চেতে ওঠল হৈমী। বলল,

-” আমি যাব না। কী করবেন? মেরেধরে নিয়ে যাবেন? ”

রুদ্র সহসা কয়েক পা এগুলো। সূচনার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” চোখ বন্ধ কর। ”

আচমকা চোখ বন্ধ করে নিল সূচনা। ঢোক গিলল হৈমী। রুদ্র গম্ভীর মুখে শীতল কণ্ঠে বলল,

-” মেরে নয় ধরে নিয়ে যাব। ”

কথাটা বলতে বলতেই সহসা হৈমীকে পাঁজা কোল করে নিল। চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল হৈমী। বুকের ভিতর চিনচিন অনুভূতি হলো সেই রাতের কথা ভেবে। রাগে, দুঃখে চোখ গলে পানি বেরিয়ে এলো। গম্ভীর মুখো রুদ্র হৈমীর ছোট্ট দেহখানি আগলে ধরে সন্তর্পণে বেরিয়ে গেল। নিজ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হৈমীকে শুইয়ে দিল বিছানায়। এরপর ঝটপট লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালালো। নিজেও এসে হৈমীর পাশে শুয়ে পড়ল।একহাত দূরত্বে শুয়ে দু’জন। থেকে থেকে হৈমীর ফোপাঁনোর শব্দ ভেসে আসছে। আর রুদ্রর বুক চিরে বেরুচ্ছে এক একটা দীর্ঘ শ্বাস। মন বলছে মেয়েটাকে বুকের ভিতর শক্ত করে জরিয়ে নিতে। কিন্তু নিজের ভিতর চলা অদ্ভুত অপরাধবোধে হাতটা এগুচ্ছে না। এরপর কেটে গেল ঘন্টার পর ঘন্টা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো হৈমী। সেই সুযোগে রুদ্র কাছে টেনে নিল ওকে। প্রশস্ত বুকটায় হৈমীকে জড়িয়ে শান্তি মিলল। এক মুহুর্ত অনুভব করল, সে ভীতু ভীষণ রকম ভীতু। সে হেরে গেছে। এই মানুষটার কাছে করুণভাবে হেরেছে সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here