বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৫৩

5
1403

#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৫৩
#জান্নাতুল_নাঈমা

সন্ধ্যার আগ মুহুর্ত। শশুর বাড়ি এসে পৌঁছাল সূচনা৷ বউকে বাড়ির ভেতরে রেখে বাইক নিয়ে বাজারে গেল মাহের। হামিদা কিঞ্চিৎ রাগ দেখাল সূচনার সঙ্গে। বলল,

-” বেলা থাকতে আসতে পারো না? কতদিন বলেছি সন্ধ্যা মাথায় আসবে না। ”

সূচনা আমতা আমতা করে বলল,

-” আসলে মা, বাবা আমাদের সঙ্গে বেরোলো। তাই দেরি হয়ে গেছে দুঃখীত। ”

নরম স্বরের দুঃখ প্রকাশে গলে গেল হামিদা। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

-” বেয়াই তো এলো না! ”

ত্বরিত স্বরে সূচনা বলল,

-” আসবে আসবে। আসলে বাবা আজ জরুরি কাজে ঢাকায় গেল। কয়েকদিন ওখানে থেকে তারপর আপনার সঙ্গে দেখা করে যাবে। ”

-” বেশ যাও হাত, মুখ ধুয়ে আসো। সেমাই রেঁধেছি। ”

মৃদু হেসে মাথা কাত করল সূচনা। ধীরপায়ে চলে গেল নিজের ঘরে। স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে৷ অনুভব করল বড্ড শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আপন নীড়ে ফিরেছে। কী আশ্চর্য! এ বাড়ি, এ ঘর এতটা আপন, এতটা শান্তির কবে থেকে হয়ে গেল? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল এ বাড়ির ছেলের মনের সঙ্গে মনের মিলন ঘটেছে যখন তখন এ ঘর, সংসার আপন মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না৷ পাশের মানুষটা যদি স্বস্তির হয় তাহলে যে কোনো ঘরেই শান্তি মেলে। তৃপ্তি ভরে হাসল সূচনা৷ ফেলল নিঃশ্বাস। হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে চলে গেল শাশুড়ির কাছে। সে তাকে পিরিচে সেমাই বেড়ে দিল। সূচনা বাচ্চাদের মতো করে শাশুড়ির বানানো সেমাই খেল। তার খাওয়া দেখে মৃদু হাসল হামিদা৷ বলল,

-” ফ্রিজে আরো আছে। পরে আবার খেয়ো। এখন খেয়ো না। তাহলে ভাত খেতে পারবে না। ”

সূচনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। জিজ্ঞেস করল,

-” রাতে কী রান্না হবে মা? ভাত বসিয়েছেন? ”

কী রান্না হবে বলে দিল হামিদা। ভাত বসানো হয়নি। তাই সূচনা গিয়ে ভাত বসিয়ে দিল। এরই মধ্যে মাহের কাঁচা সবজি নিয়ে এলো। মায়ের কাছে আবদার করল পাঁচ মেশালি সবজি রেঁধে দিতে। স্বামীর আবদার কান খাড়া করে শুনে নিয়ে সে হামিদাকে বলল,

-” আমি করব আপনি আরাম করুন। ”

হামিদা বলল,

-” সবজি গুলো কেটে দিই? ”

বাঁধা দিয়ে সূচনা বলল,

-” আমি করে নিব। আপনি বরং ওর সঙ্গে বসে গল্প করুন। ”

এতদিন পর শশুর বাড়ি এসে শাশুড়িকে দিয়ে কাজ করাতে মন সায় দিল না। স্বামী, শাশুড়িকে যত্ন নিয়ে রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে মনটা পিপাসিত হয়ে ওঠল সূচনার। হামিদা যেন স্বস্তিই পেল। বয়স বেড়েছে তো। আর কতই করবে একা হাতে? বসার ঘরে বসে টিভি অন করল সে। পোশাক পাল্টে মাহের এলো। মায়ের পাশে বসে রান্নাঘরের দিকে উশখুশ করল। এতদিন পর বউ বাড়ি ফিরেছে। কাছে পাবার তৃষ্ণা বেড়েছে চারগুণ। মায়ের পাশে বসলেও মন পড়ে রইল রান্না ঘরে। সূচনা সবজি কাটছিল। পানি খাবার ছুতায় এলো মাহের। নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-” আমি কি হেল্প করব? ”

চমকে তাকাল সূচনা। আলতো হেসে বলল,

-” কী বলছ! তুমি কেন রান্নায় হেল্প করবে? হেল্প নেয়ার হলে মায়ের থেকেই নিতাম। ”

বাক্য শেষে কাজে মন দিল সে। মাহের মুখ ছোটো করে তাকিয়ে রইল। সে সাহায্য করতে চেয়েছিল কারণ এতে কাজগুলো দ্রুত সরবে৷ একা হাতে বেশ সময় লাগবে। আর যত সময় লাগবে তত তাকে কাছে পাওয়ার প্রহর গুনতে হবে। রান্নার পুরো সময় অন্তত মাহের দশবার এলো গেল। শুরুতে টের পায়নি সূচনা। যখন টের পেল তখন ক্রমশ তার গাল গুলো লাল হতে শুরু করল। শেষে চোখ রাঙাল। বসার ঘরে হামিদা রয়েছে। তার সামনে এতবার আসা যাওয়া করছে। মাহেরের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? লজ্জা, শরমকে কি ভুলে খেয়ে নিল আশ্চর্য! রান্না শেষ করে হাত ধুচ্ছিল সূচনা৷ সেই সময় এগারো বারের মতো আগমন ঘটন মাহেরের। হাত ধোঁয়া শেষে তোয়ালেতে হাত মুছে দৃঢ় চোখে তাকাল সূচনা। বলল,

-” কী হচ্ছে এটা। মা কী ভাবছে বলো তো? তুমি তো লজ্জা পাচ্ছ না, আমি লজ্জায় কীভাবে এখন বেরোব সেই চিন্তা করছি। ছিঃ ছিঃ। নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়ে গেছে! ”

বসার ঘরের দিকে উঁকি দিল মাহের। মা টিভি দেখায় মগ্ন৷ ঘাড় ফিরিয়ে এক কদম এগোলো লজ্জাবতীর সামনে। সহসা কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনল লজ্জার লতিকাকে। লজ্জা, ভয়ে শিউরে ওঠল সূচনা। মাহেরের বুকে ধাক্কা দিয়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠল,

-” হায়রে এসব কী হচ্ছে! মা এসে যাবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে। লজ্জায় মরে যাব আমি। ”

শেষ বাক্যটায় মাহের আহত সূচক শব্দ করল। তর্জনী বাড়িয়ে চেপে ধরল গোলাপি রাঙা নরম ঠোঁটজোড়া। বলল,

-” চুপপ। মা আসবে না। আর না তুমি লজ্জায় মরবে। আর শোনো, সত্যি আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ ক’টা দিন উন্মাদের মতোই ছটফট করেছি। এবার আমার খারাপ হয়ে যাওয়া মাথাটা ঠিক করো। সব ছটফটানি কমিয়ে দাও। বুকের ভিতর বেসামাল প্রেমের উন্মাদনা চলছে। যতক্ষণ না একান্তে পাচ্ছি ততক্ষণ এই উন্মাদনা কমবে না। ”

ঠোঁট কেঁপে ওঠল সূচনার৷ গলা শুঁকিয়ে চৌচির। মসৃণ কোমরে উষ্ণ হাতের চাপ পড়লে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়াল সে। মৃদু হেসে বেসামাল নিঃশ্বাস গুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল মাহের৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” জলদি খাবার বাড়ো। খাবারের পাট জলদি চুকিয়ে ঘরে যাও। নয়তো এই বেসামাল হৃদয় ভয়াবহ বিদ্রোহ করে বসবে! ”

ঢোক গিলল সূচনা৷ নিঃশ্বাস গুলো অস্থিরতায় রূপ নিল নিমিষে। একটু দূরে যাওয়াতে যদি এমন ভয়ংকর প্রেমিকের দেখা মেলে। বেসামাল প্রেমের স্পর্শ পায়। তাহলে মাঝেসাঝে একটু বেশি দূরে গিয়ে জ্বালাতন করাই যায়। বিনিময়ে না হয় চারগুণ জ্বলবে সে৷ এক নিগূঢ় পবিত্র প্রেম আগুনে জ্বলতে কার না ভালো লাগে?
_______________________
হৈমীর গর্ভাবস্থার তিনমাস চলছে। শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। রুদ্রর বাবা হৈমীকে খুবই স্নেহ করেন। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে বেশ গল্প করে দু’জন মিলে। গতকাল গল্পের ফাঁকেই হৈমীর চোখ, মুখে অস্বাভাবিকতা টের পেয়েছিল। সকাল হতেই রুদ্রকে বলে পাঠিয়েছিল ডক্টরের কাছে। হৈমীর বর্তমান ওজন আটচল্লিশ কেজি। তিনমাসে দু কেজি ওজন বেড়েছে। পেটও ফুলেছে। ঠিক যেন পাঁচ মাসের গর্ভবতী! এতে তেমন কোনো সন্দেহ ডক্টর করেনি৷ তবুও নিশ্চিন্ত থাকার জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলল। কিন্তু হৈমীর মা, রুদ্রর দাদিন এতে মত দিলেন না। তারা পাঁচ মাসের আগে আলট্রাসনোগ্রাম করতে দেবে না। রুদ্র বরাবরের ত্যাড়া স্বভাবের। তবুও এক্ষেত্রে কেন জানি ভয় পেল! এত ভয় কেন করছে জানা নেই। শুধু জানে শাশুড়ি আর দাদিনকেই ভরসা করা যায়। প্রথম মা হচ্ছে হৈমী। এতদিন সেরকম ভাবে অনুভূতি জাগেনি। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায়, শারীরিক পরিবর্তনে ধীরেধীরে মাতৃত্ব জাগ্রত হচ্ছে। আজকাল ঘুমের ঘোরের সে বেশ সচেতন থাকে। আগের মতো ছটফট, হাত, পা ছোড়াছুড়ি করে না। সর্বক্ষণ মন, মস্তিষ্ক জুড়ে থাকে তার মাঝে কেউ আছে। তার একটু অসাবধানতা কারো ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই নিয়ে তার ভয়ের শেষ নেই। তার সে ভয়টাই চোখে পড়েছে রুদ্রর। হৈমী যেমন প্রথম মা হচ্ছে, সেও প্রথম বাবা হচ্ছে। তাদের জীবনে প্রতিদিন যা কিছু ঘটছে সবই দুজনের কাছে নতুন। তারা দু’জন যেন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু। যে যেভাবে পা ফেলতে বলবে তারা যেন ঠিক সেভাবেই পা ফেলবে।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর বমি হলো হৈমীর। বাথরুমে ঢুকে বমি করছিল সে। শব্দ শুনে দৌড়ে এলো রুদ্র। কাঁধ চেপে ধরল আচমকা। রাশভারি, ভরাট চোয়ালের মানুষটার মুখ ছোটো হয়ে গেল। দু-চোখে নেমে আসল রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা। বমি করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল হৈমী। চোখে মুখে পানি দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল রুদ্রর বুকে। আতঙ্কিত রুদ্র মিইয়ে গেল। পাঁজা কোল করে হৈমীকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। টেনশনে হাঁটু কাঁপছে তার। চোখ বুঁজে শুয়ে থাকা হৈমীর শরীরটাও কাঁপছে। কী করবে রুদ্র? কিছু বুঝতে না পেরে কল করল বড়ো কাকির নাম্বারে। জেরিন রুদ্রর ফোন পেয়ে অবাক হলো। মাত্রই রুদ্র, হৈমী হাসপাতাল থেকে ফিরে ঘরে গেল৷ বাড়িতে থেকেই ফোন! বিচলিত ভঙ্গিতে উপরে ছুটল সে। পেছন পেছন দাদিনও ওঠে এলো। দরজায় টোকা দিতেই রুদ্র দরজা খুলে দিল। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে তার। দুঃশ্চিন্তায় চোখ দু’টো লাল টকটক করছে। দাদিন উত্তেজিত হয়ে বলল,

-” কী হইছে কী হইছে? ”

জেরিন কোনো প্রশ্ন না করে হৈমীর কাছে ছুটে এলো। রুদ্র থমথমে কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

-” ওর বমি হচ্ছে। বমির সঙ্গে রক্তও এসেছে অল্প। ”

রুদ্রর বিধ্বস্ত মুখ, ভাঙা স্বরে শিউরে ওঠল দাদিন। জেরিন অবাক হলে রুদ্রর অবস্থা দেখে। হৈমীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” আরে চিন্তার কিছু না। বমি করতে করতে গলা ফেটে হয়তো একটু রক্ত এসেছে। এমন হয়। রাদিফ পেটে থাকার সময় আমারো এমন হয়েছিল। ”

জেরিনের দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকাল রুদ্র। তার ভিতরে কী চলছে কেবল সেই জানে। অনুভূতিটা ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। ভয় হচ্ছে তার খুব ভয় হচ্ছে। কেন হচ্ছে! হৈমীকে ভালো ডক্টর দেখাতে হবে৷ শিঘ্রই ভালো ডক্টর দেখাতে হবে। ভাবতে ভাবতেই সে সেলফোন বের করল। কল করল বান্ধবী সুবর্ণাকে। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হলো সুবর্ণা তার ভয়টাকে পাত্তাই দিল না৷ তার মতে গর্ভাবস্থায় এসব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। রাগ করে ফোন কেটে দিল সে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে হৈমীর অবস্থার উন্নতি ঘটল। আচমকা চোখ খুলে সে জেরিন কাকিকে বলল,

-” খুব খিদে পেয়েছে। আমি ভাত খাব। ”

জেরিন ত্বরিত চলে গেল খাবার আনতে। দাদিন চিরুনি নিয়ে হৈমীর পাশে বসল। চুল আঁচড়ে বলল,

-” তেল দিয়ে দেই। এমন সময় মাথা শুষ্ক রাখতে হয় না। ”

হৈমী বলল,

-” না না তেল দিয়ে থাকতে পারি না আমি। ”

রুদ্র পাঁচ মিনিটে গোসল শেষ করে বের হলো। ডিভানে বসল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। জেরিন খাবার এনে বিছানার সাইট টেবিলে রাখল। দাদিন হৈমীর চুল আঁচড়ে বেঁধে দিল৷ রুদ্রকে বলল,

-” ও খেতে থাকুক তুই চল খেয়ে নিবি। যাও বউ মা ওর জন্য খাবার বাড়ো। ”

জেরিন, দাদিন দু’জনই চলে গেল। হৈমী রুদ্রর দিকে কিয়ৎকাল চেয়ে থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,

-” এত চিন্তা দেখাতে হবে না৷ খেয়ে নিন গিয়ে। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। ওঠে এসে হৈমীর পাশে বসে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” আসলে তোমার কেমন লাগে হৈমী?”

-” আপনাকে? সত্যি বলতে এখন একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু ভালোবাসি। ”

সোজাসাপ্টা কথাটা বলেই খেতে মন দিল সে। রুদ্র আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,

-” আমি বলছি তোমার শরীর কেমন লাগে? কেমন ফিল করো তুমি? ”

-” ওহ। ”

ক্ষীণ স্বরে বলল হৈমী। আড়ালে জিভ কামড়াল। পানি খেয়ে শুঁকনো গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

-” শরীরে শুধু অস্বস্তি লাগে। আর বমি পায়। ”

রুদ্র চিন্তান্বিত মুখে কয়েক পল তাকিয়ে রইল।হৈমী বলল,

-” যান খেয়ে নিন গিয়ে। ”

মুখ ফিরিয়ে নিল রুদ্র। বলল,

-” তুমি খেয়ে নাও। ”

-” আপনি খাবেন না? ”

-” জানি না। ”

মুখ ভেঙচিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিল হৈমী৷ অর্ধেক খাবার শেষ করে আর খেতে পারল না। কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। যতই রুদ্র শান্ত থাকুক যতই তার মুখ ঝামটা সহ্য করুক। খাবারের বেলায় ছাড় দেবে না। তাই বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল,

-” আমি খাইয়ে দিই আপনাকে? ”

ভারি অবাক হলো রুদ্র। হৈমী তাকে খাইয়ে দেবে? সেই যে সল অসুস্থ হবার পর মাঝেমধ্যে যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিত অমন? বুকের ভিতরটায় যেন ভালো লাগার স্পর্শ পেল। থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইল পলকহীন। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বুঝে খুশি মনে খাইয়ে দিল হৈমী। সুযোগে একটু ভালোবাসা লুফে নিল রুদ্র। টের পেল হৈমী৷ মনে মনে রহস্যময় হাসল খুব। খাওয়া শেষ করে নিজের শরীরের অবস্থা জানিয়ে ম্যাসেজ করল টিশাকে। সে তাকে বেশকিছু বিষয় সাজেশন দিল। সাহসও দিল খুব। এরপর ম্যাসেজে জিজ্ঞেস করল,

-” হে রে তোর জামাই এর কী খবর? ভাবসাব কেমন? ”

হৈমী রিপলাই করল,

-” ভাবসাব তো বদলেছে। জানিস প্রতিদিন রাতে এক হাত দূরত্ব রেখে ঘুমাই। সকালে দেখি আমি তার বুকে! এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে ঘুমের ঘোরে আমিই যাই নাকি সেই আদর করে বুকে নেয় বুঝতে পারছি না। ”

টিশা সঙ্গে সঙ্গে রিপলাই দিল,

-” যদি তুই যেতি সে তো সরে যেতে পারত৷ যায়নি তো এর মানে সেই কাছে টেনেছে। বাব্বাহ তোর জামাই তো পাক্কা সেয়ান! ”

হৈমী হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

-” জানিস হাসপাতাল থেকে এসে একবারো বাইরে যায়নি। ডিভানে বসে আছে। থেকে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। আমার যে কী হাসি পাচ্ছে। ”

-” তোর কথা শুনে তো আমারই পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। এই শোন রাতে কি শুধু ঘুমাসই রুদ্র ভাই আদর টাদর করতে চায় না? ”

-” মাঝেমধ্যে করতে আসে আমি সরিয়ে দিই। ”

-” বাব্বাহ মানে? এতদিনে একবারো ধরা দিসনি? ”

-” আরে বইন মেনে যায় কিন্তু… ”

-” কী? ”

-” তাও দু’দিন হয়ে গেছে। ”

-” জানি তো অমন হয়েই যায়। শোন মাঝেসাঝে একটু আধটু ধরা দিবি৷ পুরুষ মানুষ বুঝিসই তো? আর শোন আবার যেন গলে গিয়ে নিজের পরিকল্পনা থেকে সরে যাস না৷ মনে রাখবি পুরুষ মানুষকে জব্দ করা অতো সহজ না। রুদ্র ভাই যতই ভালো মানুষি দেখাক পুরোপুরি গলবি না। আগে একটা ধাক্কা দিবি তারপর টেনে তুলবি বুঝছিস। যাই আমার বাবুটা কান্না করছে। পরে নক দিব আবার। ”

-” আচ্ছা টাটা। ”
________________________
রাত তখন একটা বেজে ঊনপঞ্চাশ। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল হৈমীর। তলপেটে মিঠে মিঠে ব্যথা অনুভূতি হলো। এক সময় এই ব্যথা বাড়লে শরীরে ঘাম ছেড়ে দিল তার। ছটফট করতে করতে রুদ্রর বুকে হাত লেগে গেল। সহসা ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল রুদ্র। হৈমীর দিকে বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,

-” কী হয়েছে, কী হয়েছে? ”

হৈমী হাসফাস করতে করতে বলল,

-” একটু ফ্যানটা জুড়ে দিন। আমার অস্থির লাগছে। ”

ত্বরিত ফ্যানের সুইচ টিপল রুদ্র। এরপর কাছে এসে ওর কপাল, গলায় হাত দিয়ে ঘাম মুছল। হৈমী অসহায় চোখে তাকিয়ে। ভাবছে, এ মুহুর্তে এ বাড়িতে রুদ্রর চেয়ে আপন কেউ তার নেই। এরপর আচমকা ভাবল, শুধুই কি এ বাড়িতে? এ পৃথিবীতে নয় বুঝি? এই যে চোখজোড়ায় এত দুঃশ্চিন্তা! এগুলো তো তার জন্যই। পরমুহূর্তে মনে হলো, তার জন্য নাকি তার গর্ভের বাচ্চাটার জন্য। চোখ উপচে পানি বেরিয়ে এলো হৈমীর। রুদ্র সহসা হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করল। বিচলিত কণ্ঠে বলল,

-” বেশি খারাপ লাগছে? আমি কি ডক্টরকে ফোন করব? ”

হৈমী নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল। রুদ্র বিচলিত হয়ে পাশে শুয়ে কাছে টেনে নিল ওকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” কী অসুবিধা লাগছে হৈমী? বলো আমায়। ”

-” কার জন্য এত চিন্তা আমার জন্য নাকি ওর? ”

মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল রুদ্র। শ্বাসরুদ্ধ করে জবাব দিল,

-” আমার বউয়ের জন্য। ”

কেঁপে ওঠল হৈমী। এক নিমিষেই সমস্ত খারাপ লাগা যেন উধাও হয়ে গেল। পেটের ভিতর খিদে ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠল৷ কয়েক পল পর ওঠে বসে রুদ্রর দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। রুদ্রও তার গভীর দৃষ্টি জোড়া স্থির রাখল। হৈমী মুখ বাঁকাল। হকচকিয়ে পলক ফেলল রুদ্র। স্মরণ হলো কিশোর বয়সে, ক্লাস টাইমে পাশের সিটে থাকা এক কিশোরীর মুখ। প্রথম ক্লাসে, প্রথম চাহনিতে মেয়েটা ঠিক এভাবেই তাকে মুখ বাঁকিয়ে ছিল। এ মুহুর্তে হৈমীকে তার সম বয়সী ক্লাসমেট মনে হলো। গোপনে হাসল কিঞ্চিৎ। হৈমী উদাসি রুদ্রর বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-” আমার খুব খিদে পেয়েছে। যা খাই সব বমি হয়ে চলে যায়, আবার খিদে পায়। ”

হুঁশ ফিরল রুদ্রর। বলল,

-” খিদে পেয়েছে খাবে। এত ভাবার কী আছে। আমি যাচ্ছি কী খাবে বলো? ”

-” কী আছে? ”

-” কী খাবে বলো। ”

-” বার্গার খাব। ”

-” আচ্ছা আমি গরম করে আনছি। ”

চোখ পিটপিট করে হৈমী বলল,

-” আপনি গরম করবেন! ”

-” কেন আমি কি পঙ্গু গরম করতে পারব না ? ”

আচমকা শব্দ করে হেসে ফেলল হৈমী। হাসি পেল রুদ্ররও কিন্তু সে হাসিটা চেপে নিয়ে বেরিয়ে গেল। হৈমী নিজের কথা ফেরত পেয়ে হাসিমুখেই ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল নিচে। সে যাওয়া তে রুদ্র একটু অখুশি হলো। বলল,

-” মাতব্বরি না করলেও চলত। আমি রুমেই নিয়ে যেতাম। ”

চেয়ার টেনে বসে হৈমী বলল,

-” যতটুকু করেছেন এতেই ধন্য। ”

বার্গার গরম করে হৈমীকে দিয়ে জুস আনতে গেল রুদ্র। নিয়ে এসে বলল,

-” এটা রুমে গিয়ে খাবে৷ সে পর্যন্ত ঠান্ডা কমুক। ডিরেক্ট ঠান্ডা খাবে না। ডক্টর নিষেধ করেছে। ”

মাথা দুলাল হৈমী৷ রুদ্র তাকে বসিয়ে ডাইনিং থেকে বের হলো। আসার সময় মোবাইল ড্রয়িংরুমের সোফায় রেখেছে। সেটাই আনতে গেল৷ ঠিক সেই মুহুর্তেই দাদিনের রুম থেকে কান্নার শব্দ পেল। স্পষ্ট বুঝতে পারল দাদিন কাঁদছে। সন্দিহান হয়ে এগিয়ে গেল সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকতে উদ্যত হয়েছে তখনি কানে ভেসে এলো,

-” আমি তো মা দিলু। মায়ের কাছে তো সব সন্তানই সমান বল। আমারো তো মন চায় তিন ছেলেকে একসঙ্গে সুখী দেখি। তিন ছেলে চোখের সামনে থাকুক, মা মা ডাকুক। ”

ওপাশের কথা শুনল না রুদ্র। দাদিন আবার বলল,

-” আমি তোকে কালই টাকা পাঠাব। বাড়িতে কবে আনতে পারব জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব বাপ। তুই চিন্তা করিস না। ছেলেটারে দেখে রাখিস। ”

শরীরটা নড়ে ওঠল রুদ্রর। রাগে, দুঃখে সরে যেতে উদ্যত হতেই হৈমীর মুখোমুখি হলো। হৈমী কিছু বলতে ঠোঁট নাড়াতেই সে তার ঠোঁট চেপে ধরল৷ এরপর হাত টেনে চলে গেল উপরে নিজেদের ঘরে। ঘরে গিয়ে মুখ খুলল হৈমী। বলল,

-” দাদিন দিলওয়ার চাচার সাথে যোগাযোগ রেখেছে! ”

রুদ্র সহসা চোখ বুজে ফেলল। সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না। একদিন না একদিন বেরিয়ে আসেই। দাদিন তার চোখে ধরা পরেছে অনেক আগেই আর হৈমীরও চোখেও ধরা পড়ে গেল। নিজের ক্রোধ টুকু নিয়ন্ত্রণে এনে রুদ্র বলল,

-” এ কথা কাউকে বলবে না মনে থাকবে? ”

মাথা নাড়িয়ে হৈমী বলল,

-” থাকবে। ”

মলিন হাসল রুদ্র। দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল। ঘাড় খিঁচছে তার। হৈমী বুঝল অনেক কিছুই। তাই নিঃশব্দে এসে পাশে বসল। রুদ্র তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করল,

-” যদি কোনোদিন এ বাড়ির সঙ্গে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করে দেই তুমি পাশে থাকবে তো? ”

বিস্মিত চোখে তাকাল হৈমী। বুকের ভিতর ধক করে ওঠল তার। ঢোক গিলল সময় নিয়ে। কী বলবে সে? কী বলা উচিৎ তার? সেসব চিন্তায় না গিয়ে শুধু মাথা নাড়াল। রুদ্র আর একটি শব্দ ব্যয়ও করল না। ইশারায় তাকে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ল। বাকি রাতটা কাটিয়ে দিল নিদ্রাহীন। মনে মনে শুধু ভাবল, দাদিনকে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। জানি, সে একজন আমি না!

চলবে…

5 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here