বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৮

0
2133

#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৮
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা

রেডি হতে হতে আধঘন্টা লেগে গেল হৈমীর। আজ সে সাজের বেলায় বেশ কৃপণতা করল। তার এরূপ আচরণ দেখে মা হামিদা নিজেই বিস্মিত হয়ে বললেন,
-” কীরে তোর হলো কী? মুখটা এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? ”

থতমত খেয়ে গেল হৈমী। সূচনা বলল,
-” তুমি তো সাজতে ভীষণ ভালোবাসো হৈমী তাহলে আজ কেন এমন করছো! সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে তোমার? ”

বারকয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল হৈমী৷ এতক্ষণ সাজের বেলায় কৃপণতা করলেও মা, ভাবির কথা শুনে ঠোঁটজোড়াতে গাঢ় করে লিপস্টিক লাগালো৷ এরপর তাদের সামনে এসে চোখ পিটপিট করে ব্যস্ত গলায় বলল,
-” এই তো সেজেছি আম্মু, ভাবি কেমন লাগছে আমায়? আচ্ছা আম্মু তুমি এমন কেন বলো তো, বেশি সাজগোজ করায় কম তো বকাঝকা করো না। বেশি কথা বললেও শাসন করে করে আমার ছোট্ট হৃদয়খানা অতিষ্ঠ করে ফেলো৷ আর আজ যখন কথা বলছি না, সাজছি না এতেও সন্দেহ করছো, চোখ পাকাচ্ছ। আমি যাব কোথায় বলো তো? ”

সূচনা তার কাঁধ চেপে ধরে বলল,
-” আমাদের বাড়ি যাবে চলো। ”

চমকে ওঠল হৈমী৷ নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বেড়ে গেল তার। হামিদা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
-” তুই যেমন তেমনি থাক মা, শুধু ও বাড়ি গিয়ে বুঝেশুনে কথা বলিস। ”

সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নব দম্পতি পা রাখল শেখ বাড়িতে। কিছু নিয়ম রীতি পালন করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করানো হলো তাদের। ভাই, ভাবির সঙ্গে শেখ বাড়ির ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই সোফার মাঝবরাবর পরিচিত দুর্ধর্ষ বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটিকে দেখে আত্মা শুকিয়ে গেল হৈমীর। ঘনঘন ঢোক গিলতে শুরু করল সে। যতটা সম্ভব ভাইয়ের গা ঘেঁষে থাকলে লাগলো।

পায়ের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করেই বসে আছে রুদ্র। তার পাশে গিয়েই বসল মাহের। টুকটাক কথা বলল সে রুদ্রর সঙ্গে। হৈমী তখন ড্রয়িংরুমের এক পাশে দাঁড়ানো। সূচনা রান্নাঘরে গিয়ে দাদিন আর চাচীদের সঙ্গে কথা বলছে৷ সোহান, রোশান হৈমীকে ইশারা করছে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য। সে প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর এলো সাদমান। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বলল,
-” আরেহ হৈমী যে, তোমাদের ওখানে যাওয়ার পর তো তোমার দেখাই মিলল না। ডেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কোথায় পালিয়েছিলে হুম? আজ রাতে কিন্তু আর পালানোর সুযোগ নেই। ”

রোশান চিল্লিয়ে ওঠল বলল,
-” ব্রো আজ কিন্তু আমরা সবাই মিলে লুডু খেলব। ”

সোহান শার্টের কলার উঁচিয়ে বলল,
-” কী আর খেলবি, হেরে যাওয়ার ভয়ে আগেই বেয়ানের গলা শুকিয়ে কাঠ! ”

তীব্র অপমান বোধ করল হৈমী। আঙুল উঠিয়ে বলল,
-” এই হৈমীকে লুডু খেলায় হারানো এত সোজা নয়। ”

বোনের কথা শুনে আলতো হেসে রুদ্রর সঙ্গে কথায় মনোযোগ দিলো মাহের। আকস্মাৎ সব ভয়, জড়তা ত্যাগ করে নিজের স্বভাবে চলে গেল হৈমী৷ ছোটোখাটো ঝগরা লেগে গেল সবার সঙ্গে। মাহেরের জরুরি কল আসায় সে রুদ্রর পাশ থেকে ওঠে বাইরে চলে গেল। তর্কবিতর্কে মশগুল হৈমী টেরই পেলো না রুদ্রর কঠোর দৃষ্টিজোড়া তার পানেই স্থির। যখন টের পেলো চুপসে গেল। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঘনঘন ঢোক গিলে আড়চোখে রুদ্রকে দেখতে দেখতে আমতা আমতা করে উত্তর দিলো সকলকে। এমন সময় রুদ্রর দাদিন কাজের মেয়েকে দিয়ে হালকা নাস্তা পাঠালো সকলের জন্য। সোহান, রোশান, সাদমান তিন ভাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল খাবারের দিকে৷ সূচনা পোশাক পরিবর্তন করার জন্য উপরে চলে গেল। হৈমী তার পেছন পেছন যেতে পা বাড়াতেই তাকে উদ্দেশ্য করে দাদিন বলল,
-” ও মেয়ে তুমি অমন চুপচাপ ক্যান গো? এমনিতে তো মুখে খই ফুটে। নাকি আত্মীয়তা করানোর জন্য ওটা নাটক ছিল! ”

চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল হৈমী। আড়চোখে রুদ্রর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সাহেব বেশ আয়েশ করে বসে ঠোঁটে তর্জনী ছুঁইয়ে বদমায়েশি হাসি হাসছে। নিমিষেই চিৎকার করে মাথায় বেঁধে রাখা ঝাঁকড়া চুলগুলো খামচে ধরতে ইচ্ছে করল হৈমীর। মনের বিশাল কষ্টটুকু চেপে রেখে জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” কইই আসলে শরীরটা ভালো নেই দাদি। ”

দাদিন সন্তুষ্ট হলো না। মুখে তীব্র অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে বলল,
-” থাক আর জোর করে হাসতে হবে না৷ নাস্তা করো।”

ঠোঁট উলটে হৈমী ডাকল,
-” ও দাদিন। ”

দাদিন চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল। হৈমীর কথায় ফিরে তাকাতেই হৈমী তড়াক করে তার সামনে এসে টোপ করে গালে চুমু খেলো। বলল,
-” রাগ করো না দাদিন প্লিজ। আসলে কী হয়েছে বলো তো আমার আশপাশে একটা লম্বা, মোটাসোটা , বড়ো বড়ো হাত, বড়ো বড়ো চোখ, বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা মৌমাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। তুমিই বলো মৌমাছি আশপাশে থাকলে কি আমরা স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারি? তারওপর যদি একবার সে মৌমাছির কামড়ায়… ”

ঠাশ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেতেই চমকে ওঠল সকলে। সবচেয়ে বেশি চমকাল হৈমী। যার ফলে ভয়ে সিঁটিয়ে দাদিনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। টি টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসটা কীভাবে পড়ল বুঝতে পারলো না কেউ। কিন্তু ওখানে রুদ্র বসা ছিল সে এখন নেই দাদিন বিচলিত হয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখতে পেল রুদ্র সিঁড়ি ডেঙিয়ে উপরে যাচ্ছে। বাকি তিন নাতির ঠোঁট অল্প ফাঁক, চোখ রুদ্রর যাওয়ার পানে স্থির।

ডিনার করার সময় সকলে একসাথে হওয়ার পর হঠাৎ দাদিন হৈমীকে জিজ্ঞেস করল,
-” তা হৈমী তুমি যেন কিসের মৌমাছির কথা বলছিলে? বড়ো বড়ো দাঁত, হাত কিসব যেন? ”

মাহের চিন্তিত হয়ে বোনের দিকে তাকাল। রুদ্রর ছোটো তিন ভাই হো হো করে হাসতে লাগল। মৌমাছির বড়ো বড়ো হাত, দাঁত! হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিল কাঁপিয়ে ফেলল ওরা৷ হৈমী কাচুমাচু হয়ে সম্মুখে গম্ভীর হয়ে বসে খাবার খাওয়া রুদ্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিলো। দাদিন আবারও হৈমীকে প্রশ্ন করল। সূচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” আহ দাদিন হৈমী মজা করেছে তোমার সঙ্গে। ”

সকলের খাওয়া শেষ শুধু হৈমীরই বাকি৷ দাদিন বলল,
-” এত সময় নিয়ে খাওয়া ঠিক না। তোমার মনে হয় খাওয়াতে মনোযোগ নাই। খাওয়ার সময় অমন উদাস ভাব ভালো লক্ষণ না বুঝছো? ”

এমন সময় হঠাৎ রুদ্র এসে চেয়ার টেনে বসল। দাদিন বলল,
-” কিছু বলবি? ”

রুদ্র উত্তর করল না। নিজের মতো গম্ভীর হয়ে কয়েক পল বসে থেকে হাত বাড়িয়ে জগ থেকে আস্তে আস্তে গ্লাসে পানি ভরলো। ভাবটা এমন যে সে পানি পান করতেই এসেছে। অথচ হৈমী বুঝল তার উদ্দেশ্য অন্যকিছু। হলোও তাই গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে সে হৈমীকে উদ্দেশ্য করে দাদিনকে বলল,
-” দাদিন সুরামাস চলছে, এ মাসে বড়ো বড়ো হাত, বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা মৌমাছিরা সুরাপানের জন্য ভোঁ ভোঁ করে। উপরওয়ালার দান করা মধুচক্র শুধু অমন মৌমাছির জন্যই বরাদ্দ। ”

দুর্বোধ্য কথাগুলো শেষ করে ঢকঢক করে পানি পান করল রুদ্র। অধরে তির্যক হাসি ফুটিয়ে তুলে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পল তাকিয়ে রইল হৈমীর দিকে। ঐ দৃষ্টির গভীরতা একদম বুকে গিয়ে লাগলো হৈমীর। অদ্ভুত এক যন্ত্রণাময় অনুভূতি হলো তার। থতমত খেয়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র নিজেও। রাশভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
-” সো হটেস্ট হানিকাম্ভ! ”

ধীরপায়ে চলে গেল রুদ্র। হৈমী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের ভিতর ধকধকে অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাদিন ডাকল,
-” ও মেয়ে খাওয়া শেষ করো। ”

হৈমী আনমনেই বলে ওঠল,
-” সুরামাস মানে কী দাদিন? ”

-” চৈত্রমাস। ”

-” কিন্তু এখন তো শ্রাবণ মাস চলছে। ”

ঠোঁট টিপে হেসে দাদিন বলল,
-” এ চৈত্রমাস সে চৈত্রমাস নারে। এ চৈত্রমাস মানে মধুমাস। যেমন তোর ভাই আর ভাবির মধুমাস চলছে!”

শেষ পর্যন্ত হৈমী যখন রুদ্রর বলা সুরামাসের অর্থ বুঝলো গাল দু’টো লাল হয়ে কানদুটো গরম হয়ে ওঠল তার। বিরবির করে আওড়ালো,
-” পুরাই নষ্ট মাইন্ডেড লোক! আল্লাহ কী বাঁশটাই খেলাম। এই বাঁশ কবে দূর হবে, কবে কবে উফফ। ”

লুডুখেলার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সূচনার ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল বলে সে রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। মাহের, হৈমী, সাদমান, আর সোহান একদান খেলল। এরপর মাহের ওঠে গেল। শুরু হলো সাদমান, হৈমী, সোহান আর রোশানের খেলা। মাহের সূচনার রুমে গিয়ে দেখলো সূচনা শুয়ে আছে। চোখদুটো বন্ধ। কেন জানি মনে হলো সে ঘুমায়নি। তাই বলল,
-” মাথা ব্যথা কমেছে? ”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল সূচনা। জিজ্ঞেস করল,
-” কে জিতল? ”

-” হৈমী। আমার প্রশ্নের উত্তর টা? ”

-” মেডিসিন নিয়েছি কমে যাবে। ”

মাহের কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। সূচনা তার দিকে তাকিয়ে। তার চাহনি দেখে সে বলল,
-” কিছু বলতে চান? ”

সূচনা ওঠে বসলো। গলায় ওড়নাটা আরো শক্ত মতোন জড়িয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে প্রশ্ন করল,
-” আমার প্রতি আপনার কোনো ক্ষোভ রয়েছে? ”

আশ্চর্য হয়ে মাহের বলল,
-” ক্ষোভ তাও আপনার ওপর? ইম্পসিবল এমন মিষ্টি একটা মেয়ে, বন্ধু, বউয়ের ওপর ক্ষোভ রাখা ইম্পসিবল। ”

মাহেরের মুখপানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সূচনা৷ আনমনেই ভাবলো,
-” আমি কি সত্যি আপনার মতো মানুষকে ডিজার্ভ করি? আপনি যে অনন্য আর আমি অতি নগণ্য। ”

মুখে বলল,
-” আমি আপনাকে বঞ্চিত করছি এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই? ”

ভ্রু বাঁকিয়ে মাহের প্রশ্ন করল,
-” ক্লিয়ার করে বলুন। ”

-” আসলে দাদিন আমার আর আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় সত্যি বলে দিয়েছি। বিয়ের পর এসব নিয়ে দাদিরা কথা তুলেই। দাদিনকে আমি মিথ্যা বলতে পারি না৷ তাই সত্যিই বলেছি। সব শুনে সে ভীষণ বকেছে আমায়। বলেছে আমি পাপ করছি। ”

ভীষণ রকম সিরিয়াস মুখো ভঙ্গি নিয়ে সূচনার সামনে বসলো মাহের। বলল,
-” তাই বুঝি? তো কী কী বলেছেন দাদিন? ”

-” বাসর রাতে স্বামীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে পাপ হয়। ”

-” উহুম শুধু বাসর রাতে নয় বিয়ের পর থেকে প্রতিটা রাতেই। ”

মুখ ছোটো করে তাকিয়ে রইল সূচনা। ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে বিছানা থেকে নামতে নামতে মাহের বলল,
-” ম্যাডামের মাথা ব্যথার কারণ তাহলে এটা? ”

ধীরগতিতে সূচনাও নেমে দাঁড়ালো। ট্রাউজারের পকেটে দু-হাত গুঁজে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে এক পা দু পা করে হাঁটতে লাগল মাহের। ঠোঁটে তার জগতের হাসি লেপটে আছে। হাঁটতে হাঁটতে বেলকনিতে চলে গেল সে। ইশারায় সূচনাকেও যেতে বলল। বড়োসড়ো বেলকনিতে বিভিন্ন রঙবেরঙের ফুলগাছ দেখতে পেলো মাহের। বলল,
-” ফুল ভালোবাসেন? ”

সূচনা মাথা নাড়ালো। সে মুচকি হেসে বলল,
-” ফুল ভালোবাসা মেয়েদের মন ফুলের মতোই সুন্দর হয়। এমন একটা ফুলকে দুঃখ দেয়ার দুঃসাহস কোন পাষাণের হলো কে জানে? ”

-” যাকে জন্মদাত্রী দুঃখ দিতে পারে তাকে পুরো দুনিয়ার মানুষ দুঃখ দেয়াও অস্বাভাবিক কিছু না। ”

কিঞ্চিৎ দমে গেল মাহের। বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” পাশে এসে দাঁড়ান । ”

সূচনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পাশ থেকে মাহেরের শেভ করা চোয়ালে দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি চাইলে আপনার অধিকারটুকুর ব্যবহার করতে পারেন। ”

স্পষ্টবক্তায় মাহের,
-” আমি বাজার থেকে কোনো পণ্য কিনে আনিনি যে ব্যবহার করব। আর আপনি আমার পরিহিত টিশার্টও নন। ”

সূচনা মাথা নত করে ফেলল। কয়েক পল সময় নিয়ে মাহের বলল,
-” যখন কোনো পুরুষ পারস্পরিক মিলনের উদ্দেশ্যল তার স্ত্রীকে তার শয্যায় ডাকে, এরপর স্ত্রী যদি স্বামীর আহ্বানে সাড়া না দেয়, আর স্বামী যদি তার এ আচরণে কষ্ট পেয়ে তার প্রতি নারাজ অবস্থায় রাত অতিবাহিত করে, এমতাবস্থায় জান্নাতের বাসিন্দারা তাকে সকাল হওয়া পর্যন্ত লানত দিতে থাকে। (বুখারি) আমি আপনাকে শয্যায় ডাকিনি আই মিন আপনার সঙ্গে ইন্টিমেট হতে চাইনি। সো পাপ, পূণ্যের কথা এখানে আসা বেমানান। ”

সূচনার হৃৎস্পন্দন চঞ্চল হয়ে ওঠল। চোখের পলক ঘনঘন ফেলতে শুরু করল সে৷ মাহের ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। শীতল কণ্ঠে বলল,
-” আমি ভেতরে বাইরে এক মানুষ সূচনা। একজন পুরুষ তার দৈহিক তাড়নার জন্য ভেতরে যদি একটা নারী শরীরকে চায়। আর তার পাশে তার জন্য আপনার মতো একজন বৈধ নারী থাকে তাহলে কিন্তু সে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। ইভেন আমি নিজেও চুপচাপ থাকতে পারতাম না৷ যদি আপনাকে চাইতাম৷ ”

অকপটে প্রশ্ন সূচনার,
-” তারমানে আপনি আমাকে চাইছেন না? ”

-” চাইছি তবে সেটা দৈহিক প্রয়োজন মেটাতে নয়। আপনি এতটা ইমম্যাচিওর নন, একজন পুরুষের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা অবশ্যই আপনার আছে। বিয়ের পর নারী, পুরুষকে শুধু শারীরিক সম্পর্ক করেই কেন স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের সূচনা করতে হবে? চেনা নেই, জানা নেই টুকটাক পরিচয়ে নরনারীর এই রূপ সম্পর্ক অন্তত আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। সম্পর্কের শুরুতে আমি আপনার কাছে বন্ধুত্ব চেয়েছি। হয়তো দুপক্ষের সম্মতিতে, মানসিকভাবে একটি সুন্দর অনুভূতি নিয়ে একদিন আমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে ওঠব। ঐ অনুভূতি যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমার তরফ থেকে কোনো অভিযোগ নেই। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ক্লিয়ারলি? ”

অদৃশ্য মোহে পড়ে মাথা নাড়ালো সূচনা। মৃদু হেসে মাহের বলল,
-” আপনি প্লিজ ভুল বুঝে টেনশন করবেন না। আর হ্যাঁ আপনি যেভাবে সেটিসফাইড থাকবেন আমাকে বলবেন। যদি আপনার মনে হয় আমাদের মাঝে গভীরতা আসা উচিৎ দ্বিধাহীন বলবেন। না বললেও আমি বুঝবো, আপনার চোখের ভাষা কেন জানি বুঝতে সক্ষম হই। ”

লজ্জায় আরক্ত হয়ে বেলকনি থেকে চলে গেল সূচনা। বলে গেল,
-” আপাতত আমি বন্ধু হিসেবেই সেটিসফাইড। ”

মাহের তার পিছন পিছন রুমে গিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে বলল,
-” এই দাদিন আমাদের প্রাইভেসি ভেঙে দিলো। শুনুন, ঘরের কথা পরকে বলবেন না। ”

-” দাদিন তো পর নয়। ”

অধর কামড়ে সূচনার দিকে তাকাল মাহের। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” স্বামী স্ত্রী মধ্যে সে পরই। আমাদের মধ্যে আজ বন্ধুত্ব আছে কাল সে সম্পর্কে প্রণয় আসবে পরশু পরিণয় এসব দাদিনকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে তারা নিজেরাই টের পাবে আমার প্রণয়, পরিণয় সব কমপ্লিট। ”

-” কীভাবে? ”

বিছানায় আলগোছে শরীর ছেড়ে দিলো মাহের৷ দু-হাত মাথার নিচে রেখে সন্তর্পণে চোখ বুঝে বলল,
-” যখন আমাদের বাচ্চারা কান্না করে সবার ঘুমে ডিস্টার্ব করবে তখনি সবাই টের পাবে। এই আমি চোখ বুজেছি আপনি যত লজ্জা পাওয়ার পেয়ে নিন। দেখব না। লজ্জা পাওয়া শেষ হলে গুড গার্ল হয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়ুন। ”

সূচনা হেসে ফেলল। তার মনে হলো ইতিহাসে তারাই প্রথম বন্ধু। যারা কিনা জেনে বসে আছে একদিন তাদের প্রণয় হবে, পরিণয় হবে আবার বাচ্চাও হবে। ইস কী ভয়ানক সুন্দর ব্যাপারটা!
___
দাদিনের সঙ্গে হৈমীর ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। লুডু খেলা শেষ করে হৈমী দাদিনের রুমে যাচ্ছিল। এমন সময় তার ফোনে ম্যাসেজ এলো,
-” অনেক লুডু খেলা হয়েছে ডার্লিং, এবার ছাদে এসো তোমার লম্বা, মোটাসোটা মৌমাছি অপেক্ষায় আছে। ”

ম্যাসজটি দেখামাত্রই আতংকিত হয়ে দাদিনের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো হৈমী৷ দাদিন গভীর ঘুমে তলিয়ে। সে বারকয়েক ঢোক গিয়ে কাঁপা হাতে রিপলাই করল,
-” দাদিনের সামনে কীভাবে যাব। ”

-” পা’য়ে হেঁটে আসবে। ”

-” উনি কী ভাববেন? ”

-” জাস্ট টু মিনিটস এর মধ্যে না এলে নিচে গিয়ে কোলে উঠিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে নিয়ে আসব।”

ম্যাসেজটি দেখে হাত থেকে টুশ করে মোবাইলটা পড়ে গেল৷ তরতর করে ঘামতে লাগলো সে। বুকের ভিতর হৃৎস্পন্দনের বাতিটা যেন ঠুশ করে নিভে গেল। শ্বাসরোধ করেই পা চালালো ছাদের দিকে। পুরো বাড়িতে ঝকঝকে আলো থাকায় মোবাইল ছাড়া যেতে তার একটুও অসুবিধা হলো না। ছাদের দরজা অবধি যেতেই বা দিকের দোলনায় বসে দোলখাওয়া রুদ্র বলল,
-” আ’ম হেয়ার ডার্লিং। ”

কেঁপে ওঠল সে। বাদিক ফিরে ঢোক গিলল ঘনঘন। রুদ্র তর্জনী উঁচিয়ে কাছে যেতে ইশারা করল। হৈমী অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। ফলে মৃদু ধমকে ওঠল সে। ধমক খেয়ে হকচকিয়ে একটু একটু করে এগুতে শুরু করল হৈমী। গলায় ঝুলানো ওড়নাটা দিয়ে বার বার শরীর ঢাকতে লাগলো। একবার একপাশ টানে আবার আরেকপাশ টানে। রুদ্রর তুখোড় দৃষ্টিজোড়া তাকে আপাদমস্তক এমনভাবে দেখছে যে মন চাইছে পুরো শরীরে কম্বল মুড়িয়ে রাখতে। যেন একটু ফাঁকও না থাকে আর ঐ বদ নজরটাও তার ওপর না পড়ে৷

হৈমী যখন রুদ্রর একেবারে কাছাকাছি চলে এলো, রুদ্র হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের ওপর ফেলল তাকে। কিঞ্চিৎ ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করল মেয়েটা। রুদ্র তাকে দু’হাতে আবদ্ধ করে নিতেই বলল,
-” উহ ছাড়ুন একদম ঠিক হচ্ছে না, আহ। ”

রুদ্র বাঁকা হেসে ছেড়ে দিলো। হৈমী উলটে পড়ল ছাদের মেঝেতে। দু-হাত মেঝেতে ভর করে মাথা উঁচু করে ভয়ার্ত চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” উহহ। ”

উচ্চরবে কতক্ষণ হেসে নিয়ে রুদ্র বলল,
-” এই অশ্লীল শব্দগুলো করে কী মিন করতে চাইছো ডার্লিং? ”

রেগেমেগে আগুন হয়ে ওঠে দাঁড়ালো হৈমী। আকস্মিক রুদ্রর গলা চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,
-” আপনি একটা অশ্লীল, অসভ্য বর্বর মানুষ একটা। আপনার সাহস কী করে হয় আমার সঙ্গে এই অসভ্যতা করার? আর ঐ ভিডিয়ো কেন করেছেন আপনি এসব কেন? ”

-” চুমু দাও।”

অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সর্বোচ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করার মাঝে এমন একটি কথা বলায় ভড়কে গেল হৈমী। গলায় চেপে রাখা হাতটি আরেকটু শক্ত করে বলল,
-” খু’ন করে দেবো একদম। ”

-” আর আমি চুমু দেবো। ”

ঘাড় বাঁকিয়ে হৈমীর ঠোঁটে আলতো করে চুমু দিলো রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে গেল হৈমী। ঠোঁটে হাত ঘষতে ঘষতে থুথু ফেলল,
-” ইয়াক থু। ”

চট করে ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র। এক এক করে পা ফেলে হৈমীর দিকে এগিয়ে বলল,
-” আমি বলেছিলাম সাদমানের থেকে দূরে থাকতে রাইট? থাকোনি! এতবড়ো ভুলের শাস্তি না দিয়ে চুমু চেয়েছি খুশি হওয়ার কথা রাইট? তা না করে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছো ডেম ইট! ”

বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে হৈমীর একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরল। উচ্চতায় হৈমী তার গলা সমান তাই তার দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে গিয়ে বলল,
-” চুমু দাও যেমনটা দাদিনকে দিয়েছো তখন। ”

দাদিনকে চুমু দিয়েছে বলে এখন তাকেও চুমু দিতে হবে। সে আর দাদিন কি এক হলো? তাছাড়া দাদিনকে সে গালে চুমু খেয়েছে এই অসভ্য লোকটা ঠোঁট আগাচ্ছে কেন? অস্থির হয়ে সহসা কেঁদে ফেলল হৈমী। বলল,
-” আপনি খুব খারাপ। আমি ভাইয়াকে সবটা বলে দিব। আপনি যতই ভয়ানক হোন না কেন আমার ভাইয়া আপনাকে ভয় পায় না। ”

-” এই মেয়ে চুমু দাও! ”

হৈমীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধমক দিলো রুদ্র। কাঁপতে কাঁপতে মুখ বাড়ালো হৈমী। রুদ্র ঠোঁটজোড়া এগিয়ে দিতেই হৈমী চট করে তার গালে সজোরে একটা কামড় বসালো। এমনভাবে দাঁত বসালো যে দাঁড়িভরা গাল বেয়েও বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে এলো। রুদ্র চোখ মুখ কুঁচকে মুখ দিয়ে ‘আহ’ শব্দ বের করল, তার হাত আলগা হয়ে এলে হৈমী ছুটে পালালো ছাদ থেকে। ছুটে চলে যাওয়ার সময় অবশ্য কয়েকটা কথা বলে গেল,
-” কীরে লু’চ্চা এখন তুই অশ্লীল শব্দ করিস ক্যান? হৈমীর চুমু খাবি তাইনা ? হৈমীর? খেলি তো কামড়, দেখ কেমন লাগে! শালা বদমায়েশ! ইতর লোক! ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here