বেসামাল_প্রেম,০৬,০৭

0
2149

#বেসামাল_প্রেম,০৬,০৭
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬
এনগেজমেন্টের সাতদিন পর বিয়ের আয়োজন করা হলো। শেখ বাড়িতে বহু বছর পর আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সকলের উপস্থিতিতে চমকপ্রদ এক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুরো বংশের একমাত্র মেয়ে সূচনা৷ ভীষণ আদরের। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে একমাসের জন্য দেশে এসেছেন রিদওয়ান শেখ। চাচাত ভাই রাদিফের পরিবার, ছোটো চাচা রিজওয়ানের পরিবার সকলেই উপস্থিত এই বিয়েতে। বিয়েটা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হলো। বিদায়ের পূর্বে নব দম্পতি’কে মেয়ের বাড়ির সকল আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে।

এই ফাঁকে বান্ধবীদের নিয়ে বেয়াইদের সঙ্গে ছাদে গেল হৈমী। সকলে মিলে বেশকিছু ফটোশুট করল। সময়টা সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। ভাই-ভাবি’কে রেখে ছাদে আসতে ইচ্ছে করছিল না হৈমীর৷ আসতে বাধ্য হলো রুদ্রর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া দেখে। এই দৃষ্টিজোড়া আজ নতুন নয় পুরোনো। ঠিক যেদিন থেকে হৈমী তাকে ইগনোর করছে সেদিন থেকেই রুদ্রর এমন দৃষ্টির শিকার হচ্ছে। প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে আড়ালে গিয়ে খুশিতে নাচানাচি করেছে। মুখ সে বন্ধ রাখতে পারেনি। কথা না বলে টিকতে পারেনি এক মিনিটও। তবে সে কথাগুলো বলেছে সাদমানের সঙ্গে, সোহান, রোশানের সঙ্গে। তিন কাজিনের সঙ্গে হৈমীর গদগদ ভাবটা যেন সহ্য হচ্ছিল না রুদ্রর। গা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। টের পেয়ে ওদের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়ে দিয়েছে হৈমী। ভাইয়ের উপদেশে সত্যি সত্যি সেদিনের পর থেকে রুদ্রর সঙ্গে কথাত দূরে থাক স্বেচ্ছায় সামনেও যায়নি। আশপাশে থাকলেও এড়িয়ে গেছে। কখনো সামনে পড়লে তাকে দেখিয়ে অন্যদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

রাদিফের ছোটো ভাই সাদমান, রিজওয়ানের দুই ছেলে সোহান এবং রোশানের সঙ্গে হৈমীর পরিচয় হয়েছে এনগেজমেন্টের দিনই। সাদমান সিনিয়র হলেও সোহান, রোশান হৈমীর জুনিয়র। এই জুনিয়র দুই বেয়াইয়ের সঙ্গে হৈমীর মাখামাখি বাড়াবাড়ি রকমের। সোহান পড়ে ক্লাস নাইনে, রোশান সিক্সে। এদের একজন’কে সোবেয়াই আরেকজন’কে রোবেয়াই সম্বোধন করে হৈমী। হৈমীর অহেতুক বকবক এরা দারুণ আগ্রহী হয়ে শোনে। যা দেখে এদের প্রতি হৈমীর টান একটু বেশিই। সাদমানের সঙ্গেও কম জমে ওঠেনি। ফটোশুটের মাঝে হঠাৎ সাদমানের ফোনে রুদ্রর কল এলো। সাদমান কথা শেষ করে রোশান’কে নিচে পাঠিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর রোশান জুস খেতে খেতে ছাদে এলো। মাগরিবের আজান দিচ্ছে বলে হৈমী সকলকে বলল,
-” গাইস এবার আমাদের নিচে যেতে হবে। আর বেয়াইরা বাকি আড্ডা আমাদের বাসায় হবে। রাতে দারুণ কিছু অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। ”

হৈমীর কথা শেষ হতেই প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে রোশান বলল,
-” বেয়ান আপু বেয়ান আপু, নিচে যাওয়ার আগে আমি সবাই’কে ডান্স করে দেখাতে চাই। ”

হৈমীর বান্ধবী নয়ন হো হো করে হেসে ওঠল। বলল,
– “তাই নাকি? তো দেখান আপনার ডান্স বাচ্চা বেয়াই। ”

সকলে হৈ হৈ করে ওঠল৷ রোশানও হেলিয়ে দুলিয়ে ডান্স করতে শুরু করল। হৈমী ভিডিও করার জন্য উদ্যত হতেই হঠাৎ রোশান তার সামনে এসে কোমর দোলাতে লাগল। হাসতে হাসতে একেক জনের পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। সকলের হাসির তালে রোশান লাফাতে শুরু করল। লাফাতে লাফাতে হাতে থাকা গ্লাসের সম্পূর্ণ জুস ঢেলে দিলো হৈমীর গায়ের ওপর। ফলশ্রুতিতে তার সাদা রঙের লেহেঙ্গা’টা ভিজে বিশ্রী দেখাল। আঁতকে ওঠে চিল্লিয়ে ওঠল হৈমী। আঁতকে ওঠল রোশান নিজেও। নাচ থামিয়ে মুখে হাত দিয়ে বলল,
-” ইস ড্রেস নষ্ট করে দিলাম তো! ”

নাক ফুলিয়ে রোশানের কান মলে দিলো হৈমী। গটগটিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে করে করেছ তুমি। আমি সব বুঝতে পেরেছি। এসব কে শিখিয়েছে তোমায়? ঐ গুন্ডাটা নিশ্চয়ই? ”

সাদমান হাসতে হাসতে বলল,
– “যত দোষ এখন আমার ভাইয়ের। সে এসবের আগেও নেই পরেও নেই তবুও তাকে টানছো কেন হু? কাহিনি কী? ”

সোহান বলল,
– “রোশান ইচ্ছে করে করলেও মন্দ করেনি। বেয়ানের সঙ্গে একটুআধটু হয়েই থাকে। ”

বেয়াইদের কথা শুনে হৈমী সহ হৈমীর বান্ধবী’রা মিলে ঝগরা বাঁধিয়ে দিলো। নিচে যাওয়ার আগে নয়ন সাদমান’কে শাসিয়ে গেল,
– “এর প্রতিশোধ আমরা নিয়েই ছাড়ব হুহ। ”

নিচে যাওয়ার পর হৈমীর অবস্থা দেখে সাদমানের মা জেরিন তাকে সূচনার রুমে গিয়ে পোশাক পাল্টে নিতে বলল। নাক ফুলিয়ে হৈমী বলল,
– “আমিত আর কোনো ড্রোস আনিনি চাচি।”

– “সূচনার কাভার্ড থেকে একটা শাড়ি পড়ে নাও। ”

– “আমি শাড়ি পরতে পারি না৷ ”

– “আহারে মন খারাপ করছো কেন? তুমি যাও আমি কাউকে পাঠাচ্ছি। কাউকে না পেলে আমিই যাব। ”

হৈমী যখন সূচনার রুমে গেল। আড়াল থেকে রুদ্র বেরিয়ে এলো। রোশান তাকে চোখ টিপ দিতেই রুদ্র বাঁকা হেসে পা বাড়ালো সূচনার রুমের দিকে।

হৈমীর বান্ধবীদের অনেকেই বিয়ে বাড়ি থেকেই নিজেদের বাড়ি চলে গেল৷ থেকে গেল নয়নের সঙ্গে গুটিকয়েক বান্ধবী। জেরিন সূচনার এক বান্ধবী’কে বলল সূচনার ননদ’কে শাড়ি পরিয়ে দিতে। সে সূচনার রুমেই আছে। সূচনার বান্ধবী কথামতো সূচনার রুমের সামনে পর্যন্ত যেতেই হঠাৎ রুদ্র তার সামনে দাঁড়াল। হকচকিয়ে গিয়ে ঢোক গিলল সে। রুদ্র বাঁকা হেসে বলল,
– “মিম, তোমার নাম তাই না? ”

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মিম বলল,
– “জি ভাইয়া। ”

– “গুড, এখানে ঠিক এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে। যতক্ষণ না আমি বের হবো ঠিক ততক্ষণ কেমন? ”

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে মিমের৷ দম আটকে সে মাথা নাড়ালে রুদ্র বলল,
– “কেউ এলে বলবে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। ”

ভেতরে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো রুদ্র। ভয়ে থরথর করে হাত, পা কাঁপতে শুরু করল মিমের। তার মনে কী চলছে বোঝা গেল না৷ শুধু মনের আতঙ্কিত ভাব চোখমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠল। বিরবির করে বলল,
– নারী বিদ্বেষী রুদ্র ভাই আমার সঙ্গে কথা বলল! হায় আল্লাহ রুদ্র ভাই আমার সঙ্গে কথা বলেছে!

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মেদহীন পেটটা পিটপিট করে দেখছে হৈমী। মেরুন রঙের ব্লাউজ, পেটিকোট পরার ফলে তার শুভ্র দেহখানির উজ্জ্বলতা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। নিজেকে আপাদমস্তক কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ভাবল, বিছানায় রাখা শাড়ির ভাঁজ’টা খোলা যাক। সে পর্যন্ত কেউ নিশ্চয়ই আসবে। ভেবে নিয়ে যখন বিছানার দিকে ঝুঁকল তখন সুইচ টেপার শব্দ শুনল সঙ্গে সঙ্গে পুরো রুম অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল! সে ভয় পেয়ে চিৎকার দিলো,
– “কে কে? ”

মুহুর্তেই বলিষ্ঠ একটি হাত তার মুখ চেপে ধরল। আতঙ্কিত হয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করল হৈমী। মুখে চেপে রাখা হাতটি অল্প আলগা হতেই সজোরে কামড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা মুখ থেকে সরে গেল। রাশভারী এক কণ্ঠস্বর শুনতেই সর্বাঙ্গে শিউরে ওঠল হৈমীর।
– “মিস. হৈমী আপনার গুন্ডা ক্রাশ গুন্ডামি করতে হাজির। ”

এটুকু বলেই পেছন থেকে একহাত দিয়ে পুনরায় শক্ত হাতে হৈমীর মুখ চেপে ধরল। আরেকহাতে হৈমীর পেট পেঁচিয়ে ধরে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে হৈমীর কোমল স্কন্ধে কামড় বসালো। শরীর শিউরে ওঠে হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মুখ দিয়ে বের হলো অস্পষ্ট আওয়াজ। সে আওয়াজ শুনে রুদ্র মুখ তুলে ওর কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
– “এভাবে কামড়াতে হয়। যা হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে। ”

থরথর করে কাঁপতে থাকা হৈমীকে নিজের দিকে ঘোরালো। রুদ্রর একঝাঁক উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল হৈমীর মুখশ্রীতে। চোখজোড়া শক্ত করে বুজে প্রাণপনে ছোটার চেষ্টা করল হৈমী৷ কিন্তু পারলো না। রুদ্র তাকে শূন্যে তুলে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে সুইচ অন করল। চোখ খুলে ভয়ার্ত চোখে রুদ্রর দুর্বোধ্য চেহারাটা দেখে নিলো হৈমী। বাঁকা হেসে হৈমীর ঠোঁটজোড়া থেকে হাত সরালো রুদ্র। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করল হৈমী। রুদ্রর মাথায় বুকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি দিতে লাগল। রুদ্র মাথা নিচু করে একহাতে কৌশলে মোবাইল ফোন বের করে ক্যামেরায় গিয়ে ভিডিও অন করে ফোনটা এমন জায়গায় রাখল যেখান থেকে তাদের স্পষ্ট দেখা যাবে। চোখ বন্ধ করে চিৎকার চেঁচামেচি, হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে ভয়ানক এই কাণ্ডটা দেখতেই পেলো না হৈমী। হঠাৎ করেই তাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলা হলো। লজ্জায় ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও চিৎকার থামালো না। রুদ্র চোখ রাঙিয়ে তার দিকে এগুতে এগুতে বলল,
– ” স্বেচ্ছায় আমার ভিতর উদ্দাম সৃষ্টি করে আমাকেই ইগনোর? ”

বলতে বলতেই হৈমীর খুব কাছে চলে গেল সে। হৈমী পিছিয়ে যেতে উদ্যত হতেই ওর পিঠ আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে আনল। চিৎকার, চেচামেচি থামাতে আচমকাই ওর ঠোঁটজোড়া নিজ ঠোঁট দ্বারা আবদ্ধ করে নিলো। দু’চোখে অশ্রু ছেড়ে হৈমী যখন নড়চড় থামিয়ে দিলো তখন রুদ্র নিজেও থেমে গেল। ইতিমধ্যেই ঠিক কোন মাত্রায় অসংলগ্নতা করেছে সে হারে হারে টেরও পেলো। তবুও বিন্দু আফসোস রাখল না মনে। নিশ্চল হৈমী’কে বুকের মধ্যেখানে অতি সন্তর্পণে চেপে নিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল,
– ” হয় মরেছো নয় মেরেছো এবার শুধু ভুগবে। ”

আকস্মাৎ রুদ্রর গলা টিপে ধরল হৈমী। ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বলল,
– ” এটা কী করলেন আপনি! আপনাকে আমি পুলিশে দেবো আপনি খুব জঘন্য একটা মানুষ। ”

চোয়াল শক্ত করে হৈমীর দু-হাত চেপে ধরল রুদ্র। মস্তিষ্ক বলল, আরো কিছু হওয়া উচিৎ নয়তো প্ল্যান সাকসেসফুল হবে না! মস্তিষ্কে কথাগুলো চলতেই ঝড়ের গতিতে হৈমীকে বিছানায় ফেলে নিজের অর্ধেক শরীরটা ওর ওপর ছেড়ে দিলো। দানবের মতো শরীরটা নিজের ক্ষুদ্র শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই দম বন্ধ হয়ে এলো। চোখ বড়ো বড়ো করে কেঁদে ওঠল হৈমী৷ বলল,
-” ওমাগো! মরে গেলাম। ”

রুদ্র বাঁকা হাসলো। হৈমীর ছটফটে হাতদুটো নিজের শক্তহাত দ্বারা বেঁধে নিয়ে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কোমল গ্রীবাদেশে ঠোঁটের বিচরণ চালালো। পরাস্ত হৈমী ছটফট করতে করতে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। কী হচ্ছে এসব তার সাথে কে বাঁচাবে তাকে? বার বার আল্লাহ’কে স্বরণ করতে লাগল। মনে পড়ল সমাজে ধর্ষিত হওয়া নারীদের শেষ পরিণতি। তার জন্যও কি এমন কিছু অপেক্ষা করছে!

দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই রুদ্র থেমে গেল। দরজার বাইরে থেকে নয়ন বলল,
-” হৈমী মিম আপু তোকে শাড়ি পরাবে বলে দাঁড়িয়ে আছে৷ তুই দরজা খুলছিস না কেন?

হৈমী লাফ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে যেই চিৎকার দেবে অমনি রুদ্র তার মুখ চেপে ধরল। শাসিয়ে বলল,
– ” শব্দ করবে না একদম চুপ। ”

ডুকরে ওঠল হৈমী। রুদ্র দৃঢ় চোখে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” আজকের পর সাদমানের সঙ্গে কথা বলবে না। সোহান, রোশানের সঙ্গেও কম কথা বলবে। ভেবো না এখান থেকে মুক্তি পেলেই তুমি মুক্ত। আমি বড্ড অসংযত, বড্ড বেশি বেসামাল আমি। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য তোমার নেই। কারোরি নেই। মরেছো নিজের দোষে মাথায় রেখো। ”

রুদ্র ওঠে দাঁড়াল। হৈমীর জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ৷ তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে, শরীর কাঁপছে মৃদু মৃদু৷ বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিলো রুদ্র। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে মোবাইল নিয়ে এতক্ষণের হওয়া ভিডিওটা সেভ করল। এরপর আবার চলে এলো হৈমীর কাছে। তার পাশে বসে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। রাশভারী স্বরে বলল,
-” আমি মানুষ’টা ভীষণ ঔদ্ধত্য। কিন্তু কিছু করার নেই। আমাকে উপেক্ষা করা একদম উচিৎ হয়নি৷ এরচেয়েও বেশি উচিৎ হয়নি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওদের সঙ্গে মেলামেশা। এসব আমি একদম পছন্দ করি না। আর হ্যাঁ এরপর যত মেলামেশা আমার সঙ্গে করবে। একমাস সময় দিলাম নিজেকে প্রস্তুত রেখো। ”

অন্তর্মুখী চরিত্রের রুদ্র নিজের অনুভূতিগুলোকে বুঝতে না পেরে উল্টাপাল্টা আচরণ দেখিয়ে হৈমীর মনে তাকে নিয়ে খুবই বীভৎস এক ধারণার জন্ম দিলো। অবুঝ হৈমী অন্তর্মুখী রুদ্রর মন’কে বুঝতে পারলো না৷ বোঝার কথাও নয়। যেখানে একরোখা, জেদি, তেজি রুদ্র নিজেই নিজের অনুভূতি বুঝতে না পেরে এক নারীর প্রতি জন্মানো প্রথম এবং গভীর অনুভূতির অসৎ আচরণ করল সেখানে অন্য একটি মানুষ হৈমী কি করে বুঝবে?

চলবে..

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৭
সূচনা মাহেরের বাসরঘর বান্ধবীদের সহায়তায় নিজহাতে সাজিয়েছে হৈমী। কথা ছিল বরকে বাসরঘরে ঢুকতে হলে আগে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে৷ প্রস্তুত ছিল মাহের৷ প্রস্তুত ছিল সকলেই। কিন্তু হৈমী বাসরঘরের ধারেকাছেও এলো না। নয়নকে দিয়ে খবর পাঠাল তার শরীর ভালো নেই, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা তাই স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সবাই নতুন বউ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে হৈমীর কাছে কেউ যাওয়ার সুযোগ পেল না৷

নতুন পরিবেশে এসে সূচনার খুবই হাঁসফাঁস লাগছিল। সারাদিনের ধকল শেষে তাকে মাহেরের ঘরে দেয়া হলো। গোলাপ এবং বেলি ফুলের কড়া ঘ্রাণে মাথা ধরে গেল কেমন। বুকের ভিতর অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করল। অচেনা বাড়ি, অচেনা ঘরের এই চমকপ্রদ আয়োজনটি নিয়েই একদিন সে স্বপ্ন দেখেছিল। একটি মিষ্টি স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর তিতকুটে অনুভূতির স্পর্শ এমন ধারালো হতে পারে জানা ছিল না তার। ধীরপায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সূচনা। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আকস্মাৎ দু-হাতে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল৷ রুমে ঢুকতেই এই দৃশ্যের মুখোমুখি হলো মাহের৷ ক্ষণকাল থমকে দাঁড়িয়ে রইল সে। এরপর মৃদু কেশে নিজের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল। ধাতস্থ হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সূচনা। কাঁপা হাতে হাতের চুড়ি, কানের দুল খুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখল। মাহের আগেই বরের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে টিশার্টের সঙ্গে ট্রাউজার পরেছে। আয়নাতে এক নজর দেখে নিল সূচনা। বুকচিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কাভার্ডের পাল্লা খুলে লাল এবং বাসন্তী রঙের মিশ্রণে একটি শাড়ি বের করল মাহের। সাধারণত বাঙালিরা গায়ে হলুদে যে শাড়িগুলো পরে ঠিক সে ধরনের শাড়ি। শাড়িটি নিয়ে সূচনার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। সূচনা তখন গলায় পরিহিত সীতাহার খুলার চেষ্টা করছে। মাহের সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার চেষ্টাটুকু দেখল। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের শাড়িটি সূচনার সামনে ধরে বলল,
– ” ম্যাডাম এটা ধরুন আমি হেল্প করছি৷ ”

সূচনা বা’দিকে কিঞ্চিৎ সরে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
-” আমি পারব, আমি পারব। ”

মাহের শাড়ি ধরতে ইশারা করল। বলল,
-” আমার কাজিন বড়ো আপু এটা পরতে বলেছে। আপত্তি না থাকলে এটা পরবেন। ”

চট করে শাড়িটা নিয়ে সূচনা বলল,
-” আচ্ছা পরব৷ ”

মৃদু হেসে মাহের বলল,
-” এবার ঘুরে দাঁড়ান আমি হেল্প করছি। ”

-” না না লাগবে না। ”

অদ্ভুত করে হাসল মাহের। মাথা চুলকে বলল,
– ” অকে তাহলে নিজে আরেকটু ট্রাই করুন। ”

গা থেকে সকল জুয়েলারি, শাড়ির পিন খুলতে খুলতে রাত দু’টো বাজিয়ে ফেলল সূচনা। এরপর শাড়ি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে বের হলো। মাহের মোবাইল ঘাটাঘাটি করছিল সূচনা বের হতেই মুচকি হেসে বলল,
-” হলো? ”

কিছুটা লজ্জা পেল সূচনা। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বোকার মতো প্রশ্ন করল,
-” আপনি এখনো জেগে আছেন? ”

-” আমার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষাতে ছিলেন বুঝি? আপনি তো বেশ চালাক। কিন্তু আমি তো আজ ঘুমাব না। ”

চমকে তাকাল সূচনা। মাহের স্বাভবসুলভ মুচকি হেসে বলল,
-” ভয় নেই অনুমতি ব্যাতীত আপনাকে স্পর্শও করব না। ”

সূচনা মাথা নিচু করে ফেলল। অদ্ভুত ভাবেই নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগল তার৷ মাহের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পকেট থেকে একটি হলুদ গোলাপ বের করে বিছানায় রাখল। বলল,
-” এটা আপনার জন্য। ”

হাত বাড়াল সূচনা বলল,
-” হাতে দিতে মানা করিনি তো! ”

-” অনুমতিও দেননি। ”

-” আচ্ছা দিলাম। ”

মাহের ফুলটা সূচনার হাতে দিয়ে বলল,
-” স্বামী হিসেবে নয় বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন। ”

মাথা নিচু করে সূচনা বলল,
-” করলাম। ”

-” পাশে বসতে আপত্তি আছে? ”

না সূচকে দ্রুত মাথা নাড়াল সূচনা। মাহের শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” তাহলে দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। ”

বাধ্য মেয়ের মতো মাহেরের পাশে বসল সে। মাহের তার দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করল,
-” আজ আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। শুনেছি এই রাতে প্রতিটি স্বামীই তার বউকে কিছু চাইতে বলে। আর বউ যা চায় স্বামী তাকে তাই দেয়৷ আমি আপনার স্বামী, আমারো জিজ্ঞেস করা উচিৎ আপনার কী চাই? ”

-” আপনার ইচ্ছে না হলে জিজ্ঞেস করবেন না। ”

-” ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে, তবে শুধু আজকের জন্য নয় সারাজীবনের জন্য। ”

থমথমে কণ্ঠে সূচনা বলল,
-” কীহ। ”

-” এমন একটি জিনিস চান যা সারাজীবন দিতে পারব আপনাকে। ”

মাহেরের থেকে সারাজীবনের জন্য চাওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পেল না সূচনা। অথচ কত কিছু চাইতে পারতো। প্রতিটি মেয়েই হয়তো এ সময় স্বামীর থেকে ভালোবাসা চেয়ে নিত। কিন্তু সূচনার যে ভালোবাসার প্রতি তিক্ততা রয়েছে। একজনকে ভালোবেসে প্রতারণার স্বীকার হয়ে আরেকজনের কাছে ভালোবাসা চাওয়া ভীষণ কঠিন, যন্ত্রণাদায়ক।

মাহের বলল,
-” লম্বা লিস্ট হচ্ছে নাকি? ”

-” তেমন কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। ”

-” ভাবুন ভাবুন, সময় গেলে কিন্তু সাধন হবে না। ”

দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর মাহেরের দিকে তাকাল সে। মাহের তার দিকেই উৎসুক নয়নে তাকিয়ে। চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে সূচনা বলল,
-” আপনার থেকে একটু ভরসা, একটু বিশ্বাস আর বন্ধুত্ব এর বেশি চাওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”

মাহেরের মৃদু হাসিটা বিস্তৃত হলো। সূচনা বলল,
-” আপনার কিছু চাওয়ার আছে? ”

-” আপনি বোকা তাই সব একটু একটু চেয়েছেন। আমি ভাই অত বোকা নই আমার সব বেশি বেশি চাই। আর শেষ চাওয়াটা হচ্ছে এই বিছানার অর্ধেক ভাগ। দেখতেই পাচ্ছেন রুমে ডিভান নেই, মেঝেতেও শুতে পারি না। ”

মুখ ফিরিয়ে হাসি আঁটকে সূচনা জবাব দিল,
-” ভাগ দেওয়া হলো। ”

বাসর রাতটি আর সবার মতো করে কাটল না সূচনার৷ তবুও যেন স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। পাশাপাশি শুয়ে সারারাত গল্প করল দু’জন। একে অপরের বিষয়ে জানতে পারল অনেক কিছুই। এর মধ্যে সূচনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করল একটি বিষয়। তা হলো দীর্ঘসময় দুজন পাশাপাশি থাকার পরও ভুলক্রমেও মাহের স্পর্শ করেনি তাকে। মাঝে একহাত দূরত্ব অটুট রেখে কী সাবলীল ভঙ্গিমাতে শুয়ে ছিল মাহের। কী দারুণ এটিটিউড!

ফজরের আজান দেয়ার পর দু’জন একসঙ্গে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে মাহের সূচনাকে বলল,
-” বন্ধু হিসেবে একটি হেল্প চাই। ”

-” কী হেল্প? ”

-” আপনি শাড়িটা চেঞ্জ করুন। যেটা পরেছেন এটা বালতিতে ভিজিয়ে রেখে দিন৷ ”

সূচনা লজ্জিত হলো ভীষণ। মাহের কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল,
-” কাজিন ভাই, বোন, ভাবিরা প্রচণ্ড দুষ্ট। এসব নিয়ে তাদের কৌতুহলের শেষ নেই। আর মুরুব্বিদেরও। দেখা যাবে সকাল হলে এটা নিয়ে ছোটোরা ট্রল করবে, বড়োরা শালিশ বসাবে। আমি চাচ্ছি না এ বিষয়টা নিয়ে কথা হোক। তাছাড়া মা এমনিতেই টেনশনে আছে। সে ধারণা করবে আমি অতীত আঁকড়ে ধরে আপনার প্রতি অবহেলা করেছি। ”
___
বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ হলো। জ্বর, ঠান্ডার অজুহাত দিয়ে হৈমী কারো সামনেই এলো না। মাহের ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল। হঠাৎ করে কী হলো মেয়েটার? মেয়ের বাড়ির লোকজন বর বউকে ফিরাই নিয়ে যাবে। কত কী প্ল্যান ছিল হৈমীর। অথচ গত রাত থেকে সব কিছুতে অনুপস্থিত সে। সূচনা বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে হৈমীর সঙ্গে দেখা করতে এলো, সঙ্গে মাহের। হৈমী কাঁথা গা’য়ে দিয়ে শুয়ে ছিল। ওদের দেখেও ওঠল না। মাহের গা’য়ে হাত দিয়ে দেখল তেমন জ্বর নেই। সূচনা হৈমীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” তোমাকে ছাড়া কিন্তু যাব না আমি। ”

মাহের অনেক বোঝাল সন্দেহ করে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করল৷ উত্তর দিল না হৈমী৷ তার এক কথা সে যাবে না৷ হৈমীর এইরূপ আচরণ চাপা রইল না। একে একে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। সূচনাও জেদ করে বসে রইল হৈমী না গেলে সে বাবার বাড়ি যাবে না। হৈমীর মা হামিদা এসে মেয়েকে বকাঝকা করলেন। তবুও কাজ হলো না। মাহের মাকে শান্ত করে হৈমীর রুম থেকে বের করে নিয়ে গেল। সূচনাকে ইশারা করে গেল আরেকটু বোঝাতে সে আসছে। সূচনার কাজিন সোহান, রোশান যখন শুনল হৈমী তাদের বাড়ি যাবে না বলে সূচনাও যাবে না জেদ ধরেছে। তখন এই খবর বিদ্যুৎ গতিতে রুদ্রর কানে পৌঁছে দিল। ঠিক তার দশমিনিট পরই হৈমীর ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,
-” মিস. বকবকানি হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে আমার এবং আপনার দারুণ হটেড ভিডিওটি একবার দেখে আসুন। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ”

সূচনা মুখভার করে বসে ছিল। হৈমী হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠে বসল। সূচনা চমকে গিয়ে বড়ো বড়ো করে তাকাল হৈমীর দিকে। হৈমী ভয়ার্ত চোখ করে কাঁপা হাতে ফোনের সাউন্ড অফ করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। অচেনা নাম্বার থেকে পাঠানো ভিডিওটা দেখে যেন তার পা’য়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। মাথায় ভেঙে পড়ল আস্ত আকাশ! বারকয়েক ঢোক গিলে কাঁপা হাতে ম্যাসেজ করল,
-” এসব কী! ”

সঙ্গে সঙ্গে রিপলাই এলো,
-” সময় মাত্র পনেরো মিনিট। এর মধ্যে তৈরি হবে এবং ভদ্র মেয়ের মতো সূচনার সঙ্গে আমার বাড়িতে আসবে। কথা অনুযায়ী কাজ না হলে এক ঘন্টার মধ্যে আমার বাড়িটা তোমার জন্য পার্মানেন্ট হয়ে যাবে। অকে ডার্লিং, আ’ম অয়েটেং! ”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here