বেসামাল_প্রেম,২০,২১

0
2566

#বেসামাল_প্রেম,২০,২১
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২০
স্তম্ভিত রুদ্রের দু-হাত আচম্বিত নম্রতায় পরিণত হলো। হৈমীর দৃষ্টি ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। কয়েক পল অতিবাহিত হওয়ার পর হৈমীর কাঁধজোড়া পুরোপুরি আলগা করে দিল রুদ্র। একই সঙ্গে বিস্ময়, অবিশ্বাস্য চাহনি তার। এমন একটি উত্তরের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। হৈমীর এই শীতল ক্রোধ হজম করতে ভীষণ বেগ পেতে হলো৷ থমথমে স্বরে কেবল উচ্চারণ করল,
-” বেরিয়ে যাও। ”

তার বলতে দেরি কিন্তু হৈমীর বেরিয়ে যেতে দেরি হলো না৷ এ ঘটনা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে পড়ার মতোন ঘটনা। তাই অসহনীয় হয়ে দু-হাত শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন ক্ষণে ক্ষণে তার বক্ষ তীরে আছড়ে পড়তে লাগল।
_____
সন্ধ্যার পর মাহেরের অনুরোধে জর্জেটের মধ্যে একটি হলুদ শাড়ি পরল সূচনা। বাসন্তী হলুদ শাড়ি। সূচনাকে বেশ মানিয়েছে। সেই যে বিয়ের ক’দিন শাড়ি পরেছিল এরপর আর পরা হয়নি। শাড়িতে সূচনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল মাহেরের। পাশাপাশি বউ নিয়ে রাতের শহর ঘুরারও ইচ্ছে হচ্ছিল। সারপ্রাইজের কথাটাও সে ভুলেনি। কিন্তু সময়, সুযোগই পাচ্ছিল না। তাই প্ল্যান করল কোথাও একটা ঘুরে আসা যাক। সূচনারও মন ভালো হবে, তারও একান্তে পাওয়া হবে মানুষটাকে। কাঙ্ক্ষিত উপহারটুকুও দেওয়া হবে। বাইকের চাবি হাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মাহের৷ সূচনার সাজ কমপ্লিট হতেই বের হবে সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সূচনা। সাজ সম্পন্ন হলেও লজ্জায় আয়নার সামনে থেকে সরতে পারছে না। কারণ সরলেই মাহেরের মুখোমুখি হতে হবে। পেতে হবে বুক কাঁপা, ঠোঁট কাঁপা, দু গাল রঙিন হয়ে ওঠা লজ্জাদের। সময় অপচয় করতে চুলের আগায় চিরুনি বুলাতে শুরু করল৷ মাহের মৃদু কেশে বলল,
-” সব ঠিক আছে তো, আরো সাজবেন? ”

মুহুর্তেই বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠল তার। ইস কী লজ্জা, কী লজ্জা! আরো কেন সাজবে? সব তো ঠিকই আছে। মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা করল সে। নরম সুরে বলল,
-” আপনি এগোন আমি আসছি। ”

শাড়ি পরে বাইকে বসতে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হলো। মাহের বুঝতে পেরে বলল,
-” আঁচল কোলে তুলুন। একহাত কাঁধে রাখুন। ”

ধীরেসুস্থে তাই করল সূচনা। মাহেরও বাইক স্টার্ট দিল। ধীরেসুস্থে চলতে শুরু করল শহরের পরিচিত রাস্তায় । এরপর চলে গেল লেকের পাড়ে। সেখানে মাহেরের গুটিকয়েক বন্ধু, বান্ধবী ছিল। সূচনার সঙ্গে আগেই পরিচিত থাকার দরুন কুশল বিনিময় করল তারা। লেকের একপাশে সারি সারি কফিশপ। রাতের পরিবেশটাকে রঙবেরঙের আলোকচ্ছটা মুখরিত করে রেখেছে। ভালোই লাগছিল সূচনার৷ চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করছিল সে। এমন সময় সকলের মাঝেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল মাহের। হাতে হাত আলতো ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-” হাত ধরুন। ”

সকলের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল সে। বিব্রত চোখে তাকাল মাহেরের পানে। মাহের পুনরায় শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” হাত ধরুন একটা জায়গায় যাব আমরা। ভয় পেতে পারেন, হাত ধরলে সাহস পাবেন। ”

সিরিয়াস হয়ে মাহেরের শক্তপোক্ত হাতটা আলতো করে স্পর্শ করল সে। অধর কামড়ে হাসল মাহের। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আমুদে সুরে বলল,
-” বউ আমার ব্যাপক লজ্জাবতী! ”

বাক্যটির ইতি টেনেই সূচনার নরম হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে শক্ত করে ধরল সে। সূচনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটানে সকল আলোকচ্ছটা এবং বন্ধুদের মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল দু’জনায়। তলিয়ে গেল নিবিড় অন্ধকারে। মাহেরের সঙ্গে কয়েক পা মিলিয়ে হাঁটার পর ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” এত অন্ধকার কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”

-” ভয় পাচ্ছেন? ”

একটু বেশি কাছাকাছি হয়ে সূচনা বলল,
-” ফোন বের করুন, ফ্লাশ অন করুন। ”

মৃদু হেসে সূচনার কাঁধ জড়িয়ে ধরল মাহের। ঘন অন্ধকারে আচমকাই এমন উষ্ণ আলিঙ্গন পেয়ে বুক ধড়ফড় করে ওঠল। কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি। ”

একহাতে সূচনাকে জড়িয়ে অপর হাতে পকেট থেকে ফোন বের করল মাহের। ফ্লাশ অন করে নিজের দিকে ধরেই বলল,
-” এই তো আমিই ভয় কীসের? ”

-” আমরা কথায় যাচ্ছি? ”

-” কোথায় না এখানেই বসব। ”

ফোনের আলোটুকু সম্মুখে ধরতেই সূচনা দেখল কয়েক টুকরো কাঠ জড়ো করে রাখা হয়েছে। মাহের তার কাঁধ ছেড়ে হাত ধরে বসতে ইশারা করল। বসার পর কাঠগুলোতে আগুন ধরাল সে।

পৌষের প্রথম সপ্তাহ চলছে। আহামরি শীত পড়েনি তাই অবাক হলো সূচনা। আমতা আমতা করে বলল,
-” এসব কী চলুন ওদিকে যাই। ”

আড়চোখে তাকিয়ে ঘাসের ওপর লাইটার রাখল মাহের। সূচনা খেয়াল করল চারপাশে বেশ ঘন গাছ। ছোট্ট খাটো জঙ্গল বলা চলে। সে জঙ্গলের ভীতর ফাঁকা অংশের ঘাসের ওপর বসে আছে তারা। আশ্চর্য হয়ে মাহেরের পানে তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল,
-” এখানে আমি কখনো আসিনি। ”

-” আমিও। এটা কফিশপের পিছনের অংশ। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। দিনের বেলায় অনেক ছোটো-ছোটো ছেলেরা এখানে এসে সিগারেট খায়। কেউ কেউ নেশাও করে। ”

মন খারাপ হলো সূচনার। বলল,
-” তাহলে আমরা এখানে কেন? ”

-” নেশা করব তাই। ”

-” ছিঃ আপনি এসব কী বলছেন? ”

-” সত্যি বলছি তার আগে সারপ্রাইজটা দিই? ”

বিস্মিত হলো সূচনা। এমন জায়গায় তাকে সারপ্রাইজ দিতে এনেছে মাহের? কী এমন সারপ্রাইজ যা এখানে দিতে হবে? চিন্তায় মগ্ন সে হঠাৎ চমকে ওঠল পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর পেয়ে। ভীতিগ্রস্ত হয়ে সামনে তাকাল সে। হ্যাঁ লিমন তার প্রাক্তন। আঁতকে ওঠে পাশে তাকাল। মাহের তার দিকেই তাকিয়ে। সূচনা ঢোক গিলল কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের! ”

মাহের তার দিকে চেপে বসল। একহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। মৃদু স্বরে বলল,
-” পুরো ভিডিয়োটা দেখুন সূচনা। ”

সূচনার শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। মাহের ফোনের স্ক্রিনে ভিডিয়ো প্লে করে তার সামনে ধরে আছে। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, র”ক্তা”ক্ত অবস্থায় বসে আছে লিমন। তার সামনে চার-পাঁচ জন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবাই এক ডাকে প্রশ্ন করছে লিমনকে,
-” বল তোর সঙ্গে মাহেরের বউয়ের ঠিক কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমরাও শুনি? ”

উত্তরে আহত সুরে লিমন বলল,
-” আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যা বলেছি সব রাগের বশে। সব মিথ্যা সব মিথ্যা। সূচনা পবিত্র আমি ওকে কোনোদিন সেভাবে স্পর্শই করিনি। হাত ধরা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক হয়নি। ও খুব ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে। শুধুমাত্র ওর সংসারে আগুন ধারনোর জন্য, ওর হাজব্যন্ডের ওর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আমি এসব করেছি। কারণ আমি ওকে এভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। মায়ের কথায় ওকে রিফিউজড করলেও এবার হারে হারে টের পাচ্ছি কী রত্ন হারিয়েছি আমি। ভাইয়েরা আমার আপনারাও তো কাউকে না কাউকে ভালোবাসেন। আপনাদের ভালোবাসার মানুষটা যদি অন্যকারো সঙ্গে ঘরবাঁধে আপনার বুকে কি আগুন জ্বলবে না? সেই আগুন আমি সহ্য করতে পারছিলাম না বলেই ওদের ঘরে আগুন ধরাতে চেয়েছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। আমি মাহেরের পা ধরে মাফ চাইব। প্রয়োজনে সূচনার পা ধরেও মাফ চাইব। আমাকে ছেড়ে দিন। ”

আকস্মাৎ ফুঁপিয়ে ওঠল সূচনা। তরিৎবেগে ভিডিয়োটা বন্ধ করে দিল মাহের। চমকে তাকাল সূচনার দিকে। প্রচণ্ড খারাপ লাগায় বুকটা বিষিয়ে ওঠল তার। এত কিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিল সূচনা লিমনকে ভালোবাসতো! সূচনাকে ছেড়ে দিয়ে থমথমে স্বরে বলল,
-” আ’ম সরি সূচনা। ওরা এভাবে ওকে মারবে আমি জানতাম না। সে সময় আমি কক্সবাজার ছিলাম। আমি বলেছিলাম শান্ত ভাবে বুঝিয়ে জাস্ট ওর মুখ থেকেই সত্যিটা বের করা৷ সত্যিটা আমি জানতাম, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে চেয়েছি শুধুমাত্র আপনার মনের স্বস্তির জন্য। কারণ আমি মুখে যতই বলি আমি আপনাকে বিশ্বাস করি আপনি গিল্টি ফিল করতেন। ইভেন করছিলেনও। তাই সত্যি টা বের করার জন্য বন্ধুদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ওরা সহজ ভাবে লিমনকে বুঝিয়েছিল। যেহেতু আপনাদের একটি সম্পর্ক ছিল, সে সম্পর্কে সম্মান রেখেই যেন সত্যি বলে। শুরুতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এভাবে সবটা উন্মোচন করেছে। ওদের হয়ে আমি আবারো সরি। ”

সূচনার কান্নার বেগ বাড়ল। পাশাপাশি রাগে, অভিমানে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাঙা আওয়াজে বলল,
-” আপনি আমাকে সরি বলছেন কেন? ”

ওঠে দাঁড়াল মাহেরও। সূচনার মুখোমুখি হয়ে বলল,
-” আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ”

-” আমি কেন কষ্ট পাবো? ”

-” কাঁদছেন তো! ”

অসহায় কণ্ঠে বলল মাহের। সূচনা নাক টেনে, হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছল। বলল,
-” আপনি আমায় এতটুকু বিশ্বাস করেন এটা জেনেই কাঁদছি মাহের! যার কাছে যা আশা করি তার কাছে তা পাই না৷ অথচ যার কাছে আশা সীমিত সেই সবটা উজার করে দেয়। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব বলুন তো? ”

ঈষৎ হেসে হাত বাড়িয়ে আঙুল ছুঁয়ে চোখের পানি মুছে দিল মাহের। সূচনা নত মাথায় দাঁড়িয়ে। মাহের তার চিবুক ছুঁয়ে স্নেহময় কণ্ঠে বলল,
-” কষ্ট কমাতে চেয়ে কি বাড়িয়ে দিলাম। ”

মাথা নাড়িয়ে সূচনা না বোঝাল। মাহের আবারো বলল,
-” যেই রাতে আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে এসেছিলেন সেই রাতে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। ইচ্ছে করছিল কয়েকটা মার দিয়ে বুঝিয়ে দিই মাহের লিমন নয়। আর সে সময় আপনার থেকে দূরে থেকেছি, অভিমান করে থেকেছি এর পিছনে কারণ একটাই, তা হলো আপনি কোন সাহসে অমন একটা বেইমানকে ভালোবেসেছিলেন? যে কিনা সুযোগ পেয়ে এভাবে অসম্মান করে? ”

-” ভুল হয়ে গেছে আমার৷ ”

চট করে ভুল স্বীকার করে দায় ছাড়া হলো সূচনা। মাহেরকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
-” ভুল আপনারো আছে। ”

অবাক হয়ে মাহের বলল,
-” আমার ভুল! ”

-” হ্যাঁ আপনি কেন আরো আগে আমার জীবনে এলেন না? যে পৃথিবীতে নেই তার কত ভাগ্য ইস সেই ভাগ্যটা যদি আমার হতো৷ পৃথিবীতে না থেকেও আপনার গভীর ভালোবাসা পেতাম। ”

-” সূচনা! ”

মৃদু ধমক দিয়ে সহসা সূচনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মাহের। অদ্ভুত স্বরে বার বার করে বলল,
-” এমন কথা আর কখনো বলবেন না আপনি। দ্বিতীয়বার এমন কথা শুনলে ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে ফেলব বলে দিলাম। আপনি ভাগ্যবতী, বরং ওই অভাগী। তাই তো আমার ভালোবাসা না-পেয়েই হারিয়ে গেল। একজনকে হারিয়েছি নিজের করে না পেয়েই। আপনাকে নিজের করে পেয়েছি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি, আপনি হারালে আমিটাই হারিয়ে যাব। এমন কথা আর কখনো বলবেন না কক্ষোনো না। ”

দু’হাতে শক্ত করে সূচনার পৃষ্ঠদেশ চেপে ধরে কথাগুলো বলছিল মাহের। তার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস গুলো একের পর এক সূচনার ঘাড় ছুঁয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শরীরের লোমকূপ গুলোও কেঁপে ওঠছে সূচনার। দীর্ঘক্ষণ পর মাহের শান্ত হলো। সূচনা তার পিঠে আলতো ছুঁয়ে নরম সুরে বলল,
-” সরি এমন কথা আর কখনো বলব না, প্রমিজ। ”

লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলল মাহের। কিন্তু সূচনাকে ছাড়ল না। সূচনা ওভাবেই পড়ে রইল তার বুকে। কিছুসময় পর হঠাৎ কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের পাশাপাশি ফিসফিসে আওয়াজ শুনল,
-” আই ক্যান হ্যাভ টু কিসেস প্লিজ.

ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ছোটো করেই সম্মতি দিল সূচনা। মাহের ধীরে ধীরে মাথা তুলে তার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁটে দিল। সন্তর্পণে চোখজোড়া বদ্ধ করে ফেলল সে। বুকের ভিতর একনাগাড়ে শব্দ হতে লাগল ধিকধিক ধিকধিক। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে স্বল্প আলোয় সূচনার ভীতু, লাজুক মুখটায় দৃষ্টিপাত করল মাহের। ধীরেধীরে ঠোঁটজোড়া নামিয়ে নিল সূচনার অধর সুধা পান করার জন্য। দু’জোড়া ঠোঁট খুব কাছাকাছি আসার পর সহসা চোখ বন্ধ করে ফেলল মাহেরও। অতি সন্তর্পণে নিজ ওষ্ঠাধর ফাঁক করে সূচনার নরম অধর নিজ অধিকৃত করে নিল। একহাত সূচনার কোমরে রেখে অপরহাতে কান এবং ঘাড় বেষ্টন করে নিল। কয়েক পল পেরোতেই একজোড়া নর, নারীর উত্তপ্ত নিশ্বাসে রাতের আঁধার, থমথমে পরিবেশ মুখরিত হয়ে ওঠল। সূচনার চোখের কোণ বেয়ে ঝরতে লাগল সুখাশ্রু। মাহেরের সুললিত ওষ্ঠ চুম্বনে হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে ওঠল বড্ড বেসামাল। এমন আদর মেখে যত্ন নিয়ে পাওয়া চুমুটায় যেন সুখে মরণ যন্ত্রণা পেল সে। শেষে প্রকৃতির কোন নিয়ম মেনে আপনাআপনিই দু-হাত চলে গেল মাহেরের পৃষ্ঠদেশে জানেনা। প্রচন্ড জোরে খামচে ধরল পিঠে। মাহেরের দখলে থাকা ওষ্ঠজোড়া যেন একটু সুযোগ পেলেই লাজুক স্বরে বলে বসবে,
-” এই সারপ্রাইজ আমি কীভাবে সহ্য করি, কোথায় লুকিয়ে রাখি? এই মুহূর্তটা আমি কীভাবে ভুলি? ”
______
সোহান, রোশানের দু’টো শর্ত পূরণ করার জন্য রাত আটটার দিকে হৈমীকে ছাদে যেতে হলো। বিচ্ছু দু’টো বলেছিল বারোটার পর ছাদে গিয়ে একা একা আধাঘন্টা কাটাতে হবে। সে রাজি হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে তারা সময় নির্ধারণ করেছে রাত আটটা। রোশান, সোহানের জন্য সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আজ হৈমীকে তারা দারুণভাবে জব্দ করবে। কেউ বাঁধা দেবে না। কারণ বাড়িতে এ সময় কেউ নেই। দাদিন আর কুসুম নিচেই থাকে তারা এ সময় উপরে আসবে না। সূচনা গেছে স্বামীর সঙ্গে একটু বাইরে সময় কাটাতে। রুদ্র কোথায় গেছে জানে না৷ সাদমান গেছে এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে, ফিরতে রাত দশ, এগারোটা বাজবে। তাই পুরো দমে জমে যাবে তাদের দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা।

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১
অন্ধকারে আচ্ছন্ন নিরিবিলি নিস্তব্ধ ছাদে প্রবেশ করল হৈমী। একদলা হিমশীতল বাতাস আচমকা ধাক্কা দিল ওকে। নিমিষেই চোখ বুজে ফেলল, কেঁপে ওঠল ওষ্ঠাধর। দুরুদুরু বুকে ছাদের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলল। ওষ্ঠাধর নাড়িয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে নিল বুকপটে। লম্বা করে দম ছেড়ে পিছু তাকাল। রোশান, সোহান মিটিমিটি হাসছে, চোখের ইশারায় এগুতে বলছে। তারজন্য নাকি ছাদের মাঝখানে টুল রাখা হয়েছে। যেখানটায় তাদের দেয়া সময় পর্যন্ত একাকী বসে থাকতে হবে। সেসব কথা স্মরণ করেই মৃদু হাসার চেষ্টা করল সে। মুখশ্রীতে ভর করা সমস্ত ভয়টুকু লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টাও করল। তীব্র সাহস সঞ্চয় করে মুখ ফিরিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বসল ছাদের মাঝ বরাবর। তৎক্ষনাৎ ছাদের লাইট অফ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সোহান। আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমী। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” একি! এটাত কথা ছিল না। সোহান, সোহান, রোশান… ”

দু’ভাই দরজা লাগিয়ে দৌড়ে চলে গেল নিজেদের ঘরে। মোবাইলে সময় দেখে নিল। ত্রিশ মিনিটের আগে ঘর ছেড়েই বের হবে না পণ করল৷ সময় কাটাতে দু’জন বেশ আয়েশ করে মুভি দেখতে বসল। ওদিকে হৈমী দরজায় করাঘাত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ভয়ে, উত্তেজনায় শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। চারপাশে ভীতু চোখে তাকিয়ে আকস্মিক জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ল। শীতের মৌসুম চলছে তবুও আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ফলশ্রুতিতে জোৎস্নার বালাই নেই চারদিক কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে শুধু গুটিকয়েক বিল্ডিংয়ে আলোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। যা খুবই স্বল্প। সেদিকে তাকিয়েই ঘনঘন ঢোক গিলল হৈমী। মনে মনে নিজেকেই বকুনি দিল খুব। কেন সে লুকিয়ে ফোন আনল না? ওরা না করবে বলেই তাকে কেন এতটা ইনোসেন্ট হতে হবে? গায়ে জড়ানো চাদরটা দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ঠাঁই বসে রইল সে। বিরবির করে একাধারে পড়তে লাগল দোয়া, দরূদ। এ পৃথিবীতে কিছু দুর্বল হৃদয়ের নারী থাকে। যারা জানে দুনিয়াতে ভুতপ্রেত বলতে কিছু নেই। এই সত্যিটা জানা সত্ত্বেও দিনশেষে রাতের আঁধারে একাকী তারা ভুতে ভয় পায়। অসম্ভব রকমের ভয়। হৈমী হচ্ছে সেই দুর্বল নারীদের মধ্যেই একজন। সে জানে পৃথিবীতে ভুত পেত্নী বলে কিছু নেই। তবুও সে ভুত, পেত্নীর ভয় পায়। আর এই ভয় মারাত্মক রকমের ভয়। তীব্র শীতে যেমন হাড় কাঁপে তেমনি ভুতের তীব্র ভয়ে হাড় কেঁপে ওঠে তার। আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তার প্রতিকূলে। তাই তো নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে থমথমে করে তোলার জন্য আকস্মাৎ দূরপানের একটি শেয়াল ডেকে ওঠল। অতিরিক্ত ভয়ের তাড়নায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে ছিল হৈমীর। তাই আকস্মাৎ এই ডাকটি তার ভয়ের মাত্রা চূড়ান্তে পৌঁছে দিল। ভীতু মেয়েটা দু’হাতে খামচে ধরা চাদর ছেড়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দরজায় করাঘাত শুরু করল। শরীরে জড়ানো চাদর খুলে পড়ল, কয়েক পল পর ওড়না পড়ে গেল। দূর থেকে ধেয়ে আসা শেয়ালের ডাকগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হলো। বেড়ে গেল হৈমীর ভয় সেই সাথে দরজার করাঘাত।

সূচনা ফোন করে জানাল তাদের ফিরতে দেরি হবে। আজ রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে। বাড়ির সবাইকে যেন জানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি হৈমীর যত্নেরও যেন ত্রুটি না হয়৷ কুসুমকে সবটা বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল সূচনা। কুসুমও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারণ রাতে খাবারের সময় এখনো হয়নি। সময় হলে সবাইকে একসঙ্গেই খেতে দেবে। রুদ্র বাড়িতে ঢুকতেই কুসুম তাকে সূচনার কথা জানিয়ে দিল। রুদ্র গম্ভীর স্বরে ‘ হুম ‘ বলে পা বাড়াল দোতলায়। সে যখন তার ঘরের লক খুলতে উদ্যত হলো ঠিক সে মুহুর্তেই অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ছোটোবেলায় বাথরুম ঢুকে দরজা লাগিয়ে জোরে কথা বললে যেমন প্রতিধ্বনি হয়, কণ্ঠের স্বাভাবিকতা হারিয়ে অদ্ভুত শোনায় ঠিক তেমনি কণ্ঠস্বর। এই স্বর আরো তীব্র, ভীতিকর, সবচেয়ে বড়ো কথা এটি একটি নারী কণ্ঠস্বর! রুমের দরজা খোলা বাদ রেখে ভ্রু কুঁচকে কিয়ৎকাল দাঁড়িয়ে রইল সে। এরপর কানখাড়া করে এক পা, দুপা করে এগুতে লাগল। থামল গিয়ে ছাদের সিঁড়ির সামনে। তৎক্ষনাৎ চমকে ওঠল তার অন্তরআত্মা। এ বাড়িতে মেয়ে বলতে তো গুটিকয়েক জনই। কুসুম নিচে, সূচনা বাইরে তাহলে ছাদে কে হৈমী? মেজাজ কিছুটা বিগ্রে গেল৷ পরোক্ষণেই আবার থমকেও গেল। চটজলদি জিহ্বা দিয়ে অধর ভিজিয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে ওঠল। ছাদের দরজা লাগানো দেখে আরেক ধাপ অবাক হলো। বিষয়টি বোধগম্য না হলেও হৈমীর কান্নার শব্দ, চিৎকারই যথেষ্ট ছিল তার শ্বাস, প্রশ্বাস গুলো বেসামাল করে দেয়ার। আর এক মুহুর্ত সময়ও সে নষ্ট করল না। ঝড়ের গতিতে দরজা খুলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-” তুমি, তুমি এখানে, কী হয়েছে? ”

তৎপরতার সঙ্গে ছাদের লাইট অন করল রুদ্র। রুদ্রকে দেখে দু’হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে বসে পড়ল হৈমী। বিধ্বস্ত হৈমীকে দেখে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠল রুদ্রর। হতভম্ব হয়ে এক হাঁটু গেড়ে সেও বসল। হাত বাড়িয়ে হৈমীর কাঁধ স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল,
-” এই মেয়ে এভাবে কাঁদছ কেন? একি তোমার শরীর তো কাঁপছে, কী হয়েছে, ভয়ে পেয়েছ? লিসেন, হৈমী শুনছ? ”

লাল টকটকে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী তুলে এক পলক রুদ্রকে দেখল হৈমী। রুদ্র বিচলিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। তার সে দৃষ্টিকে আশ্চর্যান্বিত করে দিয়ে সহসা হৈমী জড়িয়ে ধরল তাকে। তার বলিষ্ঠ বুকটায় মুখ গুঁজে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উচ্চারণ করল,
-” ভুভুত! ”

চোখ, মুখ কুঁচকে গেল রুদ্রর। ভুত মানে? কিন্তু কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না, হৈমীর কান্না দেখে। যা সত্যি বোঝাচ্ছে ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু এই ভয়ের উৎস কোথায় থেকে? হৈমীই বা ছাদে আটকা পড়ল কীভাবে? এ সকল প্রশ্ন মনে চেপে দু’হাতে বুকপটে আগলে নিল ভয়ে তটস্থ মেয়েটাকে। পৌষের আবহাওয়াতেও হৈমীর উত্তপ্ত দেহের অবিশ্রান্ত স্বেদজলে ভিজে ওঠল রুদ্রর বক্ষপট। শরীরে জড়ানো সাদা কাবলী, সেন্ডো গেঞ্জি লেপ্টে গেল বুকের পাটাতে। বাকরুদ্ধ রুদ্র আর কিছু বলতে পারল না। কেবল অতি সন্তর্পণে জড়িয়ে রাখল মেয়েটাকে। যতক্ষণ না ভয় কাটছে, যতক্ষণ না শান্ত হচ্ছে ততক্ষণ এই বুক থেকে রেহাই নেই তার। যদি সময়টা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তও যায় তবুও রেহাই দেবে না। ঠিক এভাবেই জড়িয়ে রাখবে। ভয় কাটুক, শান্ত হোক, কান্না থামুক তবেই এই বুক থেকে ছাড় পাবে তার আপন পাখিটা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here