বেসামাল_প্রেম,২৭,২৮

0
3113

#বেসামাল_প্রেম,২৭,২৮
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৭
ড্রয়িংরুমে স্তব্ধীভূত হয়ে বসে আছে হৈমী। ক্ষণে ক্ষণে তার হৃৎযন্ত্রটা লাফিয়ে ওঠছে। এক ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাচ্ছে দূরে কোথাও। কিন্তু যাবে কোথায়? তার কি আর কোথাও ঠাঁই হবে? একজন গুমরা মুখো রাক্ষসের বউকে কে ঠাঁই দিবে? তার আম্মু তো বলে দিয়েছে সে তার কাছে মৃত! মা’য়ের বলা এ কথা মনে পড়ে এতক্ষণের হওয়া অনুভূতি মিলিয়ে গেল। মুখটা থমথমে হয়ে গেল আচমকা। বুক ভার হয়ে কান্না পেল খুব। রুদ্র ফোন কানে ড্রয়িংরুমে এসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল হৈমীর দিকে। ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” সূচনার সাথে কথা বলো। ”

সূচনার নাম শুনতেই তড়াক করে ফোনটা নিল সে। কানে দিয়েই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল,
-” ও ভাবি তুমি ফোন দিয়েছ! আম্মু ফোন করতে বলেছে তাই না? আমিত জানি আম্মু আমার ওপর খুব বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারে না। আর ভাইয়া সেও রাতে ঘুমাতে পারেনি তাই না। ইস ভাইয়া যে কী টেনশন করে আমাকে নিয়ে। ও ভাবি তুমি আম্মু আর ভাইয়াকে টেনশন করতে না করে দিও। ও ভাবি তুমি একটু আমার হয়ে সরিও বলে দিও ওদের প্লিজ। ”

-” হৈমী, হৈমী শান্ত হও। আমরা সবাই তোমাকে খুব মিস করছি। তুমি চিন্তা করো না। কেউ তোমার ওপর রেগে নেই। শুধু একটু অভিমান করে আছে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। ”

-” তুমি একটু উনাকে বলো আমাকে বাড়ি দিয়ে আসতে। এখানে আমার ভালো লাগছে না, মানুষ নেই, আলো, বাতাস কিছু নেই। উনি যেমন গুমোট এই বাসাটাও গুমোট দম বন্ধ লাগে আমার। ”

-” আচ্ছা আচ্ছা বলব। এবার খুশির খবর শোনো, টিশার ছেলে হয়েছে। মা আর মাহের এখন হসপিটালে। একটু পর মাহের আমাকে নিতে আসবে। টিশা আর বাবুর ছবি তুলে পাঠিয়ে দিব তোমাকে। ”

চোখ বড়ো বড়ো করে লাফিয়ে ওঠল হৈমী। টিশার বাবু হয়েছে! ছেলে বাবু! খুশিতে লাফাতে শুরু করল মেয়েটা। সূচনা বলল,
-” আচ্ছা এবার রাখি তুমি ভালোভাবে থেকো। মন খারাপ করো না এদিকে সব ঠিক আছে। মনে করো তোমরা বিয়ের পর ঢাকা বেড়াতে গিয়েছ কেমন? ”

সূচনা ফোন রেখে দিল। অতিরিক্ত খুশিতে হৈমীর হাত, পা কাঁপছে। রুদ্র ফোন নিতে হাত বাড়ালেও সে ফোন দিল না৷ রুদ্র জোরপূর্বক ফোন নিতে চাইলে যে হাতে ফোন সে হাত পিছনে নিয়ে গেল৷ বাচ্চাদের মতো করে বলল,
-” দিব না৷ বাবুর ছবি দেখব আমি। ”

রুদ্র নিরাশ হয়ে রুমে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরই বেজে ওঠল কলিং বেল। হৈমী তখন রুদ্রর ফোন ঘাটতে ব্যস্ত। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে রুদ্র বেরিয়ে এসে হৈমীকে আপাদমস্তক দেখল। পরনে সাদা রঙের ল্যাগেন্সের সাথে হালকা গোলাপি কামিজ। গায়ে ওড়না নেই তবে কটি পরা আছে। ফলশ্রুতিতে
চেস্ট স্ট্রাকচার বোঝা যাচ্ছে না। তবুও গম্ভীর স্বরে সে হৈমীকে আদেশ করল,
-” রুমে গিয়ে ওড়না পরো। ”

হৈমী চমকে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
-” আমার বন্ধু আর তার ওয়াইফ এসেছে। মাথায় ওড়না রাখবে ওদের সামনে। ”

হৈমী বুঝতে পেরে বাধ্য মেয়ের মতো রুমে গেল। রুদ্র তার জন্য এত এত শপিং করেছে সেখানের ওড়নার সংখ্যাই বাইশটা। বাইশটা ওড়না থেকে বেছে বেছে পরিহিত জামার সাথে মিলিয়ে হালকা গোলাপি রঙেরই একটা ওড়না বের করে মাথায় দিল। মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খেল রুদ্রর কোন বন্ধু এসেছে? শুনেছে পনির আর ঝিনুক টাঙ্গাইল রওনা দিয়েছে। তাহলে এই বন্ধু কে? এই প্রশ্নের মাঝে আবার মনে পড়ে গেল পাশের রুমটার কথা! আজ যে তার বাসররাত! পুরো মুখশ্রী ভয়ে থমথম করতে লাগল তার। ডাক পড়ল রুদ্রর,
-” হৈমী বাইরে এসো। ”

ধীরপায়ে রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল পরিচিত মুখ। হ্যাঁ ছেলেটার নাম আবির, রুদ্রর বন্ধু। আবির হাসি হাসি মুখে লম্বা এক সালাম দিল তাকে,
-” আসসালামু আলাইকুম ভাবি। ”

হকচকিয়ে গেল সে। সালাম ফিরিয়ে আবিরের পাশে তাকাতেই অবাক হলো। আবিরের পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির পরনে অনেক সুন্দর একটি শাড়ি, হালকা গহনা, হালকা সাজে দারুণ লাগছে। মেয়েটা হাসি হাসি মুখে বলল,
-” কেমন আছো? আমি আদ্রিতা। ”

রুদ্র বলল,
-” আবিরের বউ। ”

পরিচয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল হৈমী,
-” ভালো আছি, তুমি কেমন আছো? না মানে আপনি কেমন আছেন? ”

রুদ্র ওদেরকে বসতে ইশারা করল। ওরা বসল। আদ্রিতা শান্ত এবং মিষ্টি গলায় বলল,
-” আমাকে তুমি বলতে পারো সমস্যা নেই। ”

খুশিতে আটখানা হয়ে গেল হৈমী। রুদ্র ওকে চাপা স্বরে বলল,
-” কিচেনে ফল কাটা আছে, ফ্রিজে জুস আছে নিয়ে এসো। ”

হৈমী মাথা নাড়িয়ে গেল। রুদ্র ওদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও হৈমী এলো না। দেরি হচ্ছে বলে রুদ্র আবিরকে বলল,
-” তোরা কথা বল আমি দেখে আসি। ”

কিচেনে গিয়ে সে দেখল ট্রেতে কয়েকরকম ফল কেটে রাখা। সে ফ্রিজ থেকে জুসের গ্লাসগুলো রাখল। এরপর সেটা হাতে নিতে গিয়ে আবার রেখে দিল। কয়েক পল তাকিয়ে থেকে কি যেন গভীর চিন্তা করল। রুদ্র এসে তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” কী ব্যাপার ইডিয়টের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই সামান্য কাজটুকুও তুমি পারছ না? ”

-” ট্রেটা অনেক ভারী আমি নিতে ভয় পাচ্ছি যদি পড়ে যায়? ”

উদাস গলায় হৈমী কথাটা বলতেই রুদ্র বিরবির করে ওকে বকল। এরপর নিজেই ট্রে হাতে বেরিয়ে গেল৷ পিছন পিছন হৈমীও এলো৷ আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলল,
-” অনেক ভারী ছিল, আমি আনতে পারছিলাম না। ”

মুচকি হেসে নিচু স্বরে আদ্রিতা আবিরকে বলল,
-” সো সুইট! এই বাচ্চা টাইপ মেয়েটাকে কথায় পেল রুদ্র ভাইয়া। ”

আবির বলল,
-” বন্ধু আমার এতবছর পর এরে দেখেই পিছলা খাইছে। কিছু তো স্পেশালিটি আছেই। ”

-” তা তো আছেই অমিতাভ বচ্চন আর জয়া বচ্চনের মতোন। ”
_________
ভয়াবহ রকমের ছ্যাঁকা খেয়ে হৈমী স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, বিরস মুখে রুমে বসে আছে। কারণ কিছুক্ষণ পূর্বেই সে জানতে পেরেছে বাসরঘরটা আবির আর আদ্রিতার৷ বিয়ের ক’টাদিন আদ্রিতার মাস জনিত কারণে আবিরের সঙ্গে বাসর হয়নি। যেহেতু তারা একে অপরের পূর্ব পরিচিত। দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল সেহেতু জোরাজোরির ব্যাপারটাও ছিল না। আনুষ্ঠানিক ঝামেলা শেষ হলো, আদ্রিতাও সুস্থ হয়ে ওঠল। চারদিন পর তার আবার ছুটিও শেষ। দূরে কোথাও হানিমুনেও যেতে পারবে না। তাই রুদ্র তাকে অফার করেছিল ঢাকায় বেড়াতে আসার জন্য । বাসর না হয় ঢাকায় রুদ্রর নিরিবিলি ফ্ল্যাটেই হবে। অফারটি পছন্দ হয় আবিরের। তাছাড়া শুনেছে হৈমী রান্নাবান্না কিছু জানে না। একেবারে ইমম্যাচিওর মেয়েটা। আর আদ্রিতা ম্যাচিওর। তার রান্নার হাতও বেশ ভালো। যদি ক’টাদিন তারা এসে থাকে পাশাপাশি হৈমীকেও আদ্রিতা বড়ো বোন হয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায় মন্দ হয় না। তাই দুই বন্ধু মিলে প্ল্যান করেই এতসব আয়োজন করে। সব শুনে হৈমীর মনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। একদিকে যেমন গোপন ভয় কেটেছে অপরদিকে বড়ো দুঃখও পেয়েছে। কারণ টিশার ছেলে হয়েছে অথচ তার মেয়ের খবর নেই! মনে মনে হাসল হৈমী। আসলে সে যতই দুষ্টুমি করুক রুদ্রর সঙ্গে তার বাসর ব্যাপারটা ভাবলই ভয়ে দু, তিনবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল সে। মনে মনে কয়েকবার শুকরিয়া জানালো উপরওয়ালাকে। সে রুদ্রকে চায় অবশ্যই চায় কিন্তু একটু রয়েসয়ে। আগে নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। মানুষটার কঠিন হৃদয়ে একটু মায়া জাগাতে হবে। ভালোবাসা সে তো দু’জনেরই আছে। নেই শুধু মায়া আর বোঝাপড়া।

রুদ্র কাউচে বসে ল্যাপটপে কিছু জরুরি কাজ করছে আর একটু পরপর হৈমীর দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখমুখে স্পষ্ট দুষ্টু হাসি খেলা করছে। কারণ হৈমীর মনোভাবনা টের পেয়েছে সে। বাসরঘরটা যে তার ভেবেছিল ঠিক বুঝতে পেরেছে সে। অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে বসে থাকার পর রুদ্রর হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল হৈমী। সূচনা বাবু আর টিশার অনেকগুলো ছবি দিয়েছে। সে ছবিগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এমন সময় কারো মৃদু কান্নার শব্দ শুনল! কান খাড়া করতেই বুঝতে পারল পাশের রুম থেকে আসছে শব্দটা। ক্ষণকাল পেরোতেই আবার শব্দটা মিলিয়ে গেল। রুদ্র পরিস্থিতি বুঝে হৈমীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” ওদিকে কী? নিজের কাজ করো। ”

হৈমী ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্রর দিকে। সে পুনরায় নিজের কাজে মগ্ন হয়েছে। বুঝে অট্যানশন পেতে প্রশ্ন করল,
-” মনে হলো কেউ কাঁদছে। ”

-” ভুল শুনেছ। ”

-” না ভুল শুনিনি ঠিক শুনেছি। ”

ল্যাপটপ অফ করে রুদ্র এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
-” ওদের ফার্স্ট নাইট আজ আশা করি বাকিটা বোঝাতে হবে না৷ ”

-” ফার্স্ট নাইট হলেই কাঁদতে হবে কেন? এখানে কান্নার কী আছে? ”

ঢং করে প্রশ্নটা করল হৈমী। অথচ সে সবই বুঝতে পারছে৷ বিয়ের পর একটি মেয়ের ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে টিশা তাকে ভালোই জ্ঞান দিয়েছে। তবুও রুদ্রর সঙ্গে মশকরা করল সে। তার মশকরাকে অবুঝতা ভেবে অধৈর্য্য হয়ে গেল রুদ্র। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” এসো কান্নার কারণটা তোমাকে প্র্যাক্টিকেলি বোঝাই? ”

লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল হৈমী। ভীত স্বরে বলল,
-” অ্যাই একদম না। আমাদের মধ্যকার শর্তটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ”

রুদ্র বিরবির করে কি যেন বলে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। হৈমী এলোমেলো কিছু ঘুরাঘুরি করল। রুদ্র চোখ বুজে। ঘুমিয়ে গেল নাকি? তার তো ঘুম পাচ্ছে না। সময় কাটাতে রুদ্রর ফোনটা নিল স্ক্রিনে রুদ্রর ছবি ভেসে ওঠতেই সে ছবিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গুনগুন করে গাইল,
-” আমার হৃদয় একটা আয়না, এই আয়নায় তোমার মুখটি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না ”

বদ্ধ চোখ সহসা খুলে থম মেরে তাকিয়ে রইল। বলল,
-” চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ো। ”

হৈমী চুপচাপ তার পাশে বসল। বলল,

-” একটা প্রশ্ন করি? ”

ভ্রু কুঁচকে রাশভারি স্বরে রুদ্রর অনুমতি,
-” হুম ”

হৈমী উৎসুক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

-” শাবনূর বেশি সুন্দরী নাকি আমি? ”

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। কিয়ৎকাল তাকিয়ে রইল হৈমীর মুখ পানে। বিছানা থেকে মাপলার ওঠিয়ে গলায় পেঁচিয়ে
ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়ল। কোনো প্রকার উত্তর না দিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে গেল বেলকনিতে। হৈমী মুখভার করে বসে রইল বিছানায়। বিরবির করে আওড়াল,
-” কী একটা যন্ত্রমানব আমার জামাই হলো! একটুও রসকষ নেই, ভাল্লাগে না ধ্যাৎ। ”

নিমিষেই চোখদুটো টলমল। আকস্মাৎ রুদ্রর আগমন। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীর্ঘাকৃতির শরীরটা ঝুঁকে এলো তার ওপর। হৈমী ঢোক চিপে বিছানায় দু-হাত ভর করে পিছনদিকে কিঞ্চিৎ হেলে গেল। রুদ্রও হৈমীর দু’পাশে দু-হাত ভর করে যতটা সম্ভব ঝুঁকে রইল। বরাবরের কঠিন দৃষ্টিজোড়ায় অন্যরকম ভাব। কী ভীষণ প্রগাঢ়তা ঐ দু’টি ছোটো ছোটো চোখে। হৈমীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। সে স্পন্দনকে আরো বেশি কাঁপিয়ে তুলতে রাশভারি কণ্ঠে মাদকতার সুরে বলল,
-” আমি কাকে বিয়ে করেছি? শাবনূর না হৈমী? ”

চোখ বড়ো বড়ো করে কম্পিত কণ্ঠে হৈমী বলল,
-” হৈমী, হৈমীকে। ”

-” তাহলে কে বেশি সুন্দরী হলো? ”

এ পর্যায়ে হৈমীর হাত, পা শিউরে ওঠল। মাথা ভনভন করছে তার। রুদ্র মুহুর্তেই পরিবেশ অন্যরকম করে দিতে বাঁকা হাসল। গলায় ঝুলিয়ে রাখা দুপাশে দুহাত দিয়ে মাপলার টেনে ধরে বলল,
-” যাকে অর্ধাঙ্গিনী করেছি নিশ্চয়ই সে… ”

বাকিটুকু আর বলল না। নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়ার ইঙ্গিত করে পুনরায় বেলকনিতে চলে গেল। ঘুম তারও আসছে না। অদ্ভুত এক অস্থিরতা শরীরের শিরা-উপশিরা বিষিয়ে তুলছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক ওলটপালট হচ্ছে। অনুভূতিরা হয়ে পড়ছে বড্ড বেসামাল।

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮
কারো ঘনঘন উষ্ণ নিশ্বাস বক্ষপটে ধারালো হয়ে বিঁধছে। আচমকা দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকাল মাহের। দেখতে পেল রোজকার মতোই অত্যাশ্চর্যকর দৃশ্যটা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সূচনার সুশ্রী মুখটা দেখে নিত্যদিনের মতোই বিরবির করে আওড়াল,
-” আমার একেকটা দিনের সূচনা ঘটে আপনার এই নিষ্পাপ মুখটা দেখে। আমার আকাশ ভরা মেঘের ঘনঘটায় আপনি আমার এক টুকরো রোদের আলো।”

অধর কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে তার৷ প্রতি রাতে দু’জন যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমালেও সকালটা আজকের মতোনই অমায়িক সুন্দর হয়। অপলকে তাকিয়ে সূচনার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখায় মগ্ন মাহের। তার এই মগ্নতায় বাঁধ সাধল সেলফোনের রিংটোন। নাম্বার দেখে কেটে দিল সে। মৃদুস্বরে ডাকল সূচনাকে। কারণ হৈমীর বইপত্র নিয়ে সকাল সকালই সূচনাকে শেখ বাড়ি যেতে হবে। সেখানে ঝিনুক আর পনির অপেক্ষায় থাকবে তার জন্য। হামিদা বাড়িতে নেই, সে আছে টিশার দেখভাল করার জন্য হসপিটালে। এরপর হয়তো টিশার বাচ্চাটার জন্য টিশার বাসায়ও থাকবে দীর্ঘদিন। একদিকে ভালোই হলো, এই সময়টায় টিশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। হৈমীর শোকটাও কাটিয়ে ওঠতে পারবে। মাহেরের এত চিন্তার মাঝে আরো একটি চিন্তা যোগ হয়েছে। তা হলো তার মা এবং সূচনার বাচ্চার প্রতি গভীর ভালোবাসা। গতরাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সূচনা কী মন খারাপটাই না করল! এক প্রকার জোর করেই আনা হয়েছে তাকে। নেহাতই মেয়েটা শান্ত মনের, বুঝদার। তাই রাগ করেনি, মন খারাপ করলেও তা দীর্ঘ করেনি। একবার তার ইচ্ছে করেছিল বলতে,
-” মন খারাপ করবেন না সূচনা। একদিন আমাদেরও এমন বাচ্চা হবে। তাকে সব সময় আপনার কাছে রাখবেন। আমি বাঁধা দেব না, কেউ বাঁধা দেবে না৷ কারণ তার ওপর আপনার অধিকার সর্বোচ্চ। ”

কিন্তু বলেনি। হাজার হোক মেয়ে মানুষের মন। এদের রক্তে, মাংসে মা, মা অনুভূতি লুকিয়ে আছে। দেখা গেল এ কথা শুনে এখনি বাচ্চা কনসিভ করতে চাইবে। প্রেমের বীজ অলরেডি হৃদয়ে বপণ করে দিয়েছে৷ এবার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করার পালা। এসবে মাহেরের বাঁধা নেই, নেই জড়তা। সে নিজেও সূচনাকে পূর্ণরূপে নিজের করে চায়। তবে এই চাওয়া পূর্ণ করার আগে সূচনার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়৷ তার যে স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নিজের আলাদা একটি পরিচয় গড়ে তোলার। তাই সে স্বামী হিসেবে পাশে থেকে, সাপোর্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চায় নিজের স্ত্রীকে। যেন আজ থেকে বিশ বছর, বা ত্রিশ বছর পর মেয়েটা নিজের সফলতা নিয়ে গল্প করার সময় অর্ধাঙ্গের দিকে একটিবার ফিরে তাকায়। বুকে মাথা গুঁজে তৃপ্তি সহকারে বলে,
-” আপনি আমার সাহস, আপনি আমার শক্তি। ”

জীবদ্দশায় যদি পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তবুও যেন প্রিয়তমা তাকে একটি বার স্মরণ করে, যে স্মরণ থাকবে শ্রদ্ধা, এক সমুদ্র ভালোবাসা।
_______
সকাল আটটা। ঘুম ভেঙে চোখ কচলে ওঠে বসল রুদ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডানপাশে তাকাতেই ঘুম ছেড়ে গেল তার। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছে হৈমী। পাশাপাশি মেকআপ বক্স বের করে সাজগোজও করছে। সাতসকালে মানুষ বই খাতা নিয়ে বসে, টুকটাক কাজ থাকলে করে, ব্রেকফাস্টে কী খাবে তাই নিয়ে চিন্তা করে, সে অনুযায়ী রান্নাবান্নাও করে। আর এই মেয়ে মেক-আপ বক্স নিয়ে বসেছে! চোখ, মুখ শক্ত করে নিল সে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,
-” এত সাজগোজের মানে কী? ”

হৈমীর মন কাল রাত থেকেই বেশ ফুরফুরে। রুদ্র সরাসরি তাকে সুন্দরী না বললেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে। এতেই সে ফিদা হয়ে গেছে। বুঝে গেছে রুদ্রর চোখে সে আগুন সুন্দরী। শাবনূরের চেয়ে সুন্দরী মানে তো আগুন সুন্দরীই। সাথে এও বুঝেছে রুদ্র তাকে পছন্দ করে, ভালোও বাসে। সব মিলিয়ে সে খুব খুশি। সেই খুশিকে কেন্দ্র করেই সকাল সকাল একটু সাজতে বসেছে। যাতে ঘুম ভাঙতেই রুদ্র তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে মুগ্ধতায় মুখ ফস্কে প্রপোজও করে দেয়,
-” হৈমী আই লাভ ইউ। ”

রুদ্রর প্রশ্ন শুনে উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকাল সে। চঞ্চলিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আমাকে কেমন লাগছে? ”

-” খুব বাজে! ”

কাঠ কাঠ জবাব রুদ্রর। জবাব শুনে চোখ বড়ো করে মুখটা গুমড়া করে ফেলল সে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” এত কষ্ট করল সাজলাম। আর আপনি বাজে বললেন? সাজগোজের কী বুঝেন আপনি? আমাকে সুন্দরই লাগছে। দাঁড়ান আমি আদ্রিতা আপু আর আবির ভাইয়াকে দেখিয়ে আসি। ”

চট করে ওঠে পাশের ঘরে যেতে উদ্যত হলো হৈমী। রুদ্র তড়াক করে ওর হাত টেনে ধরল। ব্যস্ত গলায় বলল,
-” অ্যাই ওঘরে যাবে না। ”

-” আমি যাবই। ”

ত্যাড়ামি করল হৈমী। রুদ্রও দ্বিগুণ ত্যাড়ামি দেখিয়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরল। টেনে বসাল বিছানায়। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” দেখো এই সব নাটক বন্ধ করো। একটু সিরিয়াস হও, আমি কিন্তু ধৈর্য্যশীল পুরুষ নই। মেরে একদম হাড়গোড় ভেঙে দেব। ”

আঁতকে ওঠল হৈমী। ঢং করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-” আপনি আমাকে আবার মারবেন? আমি এখানে থাকব না, এক্ষুনি দিয়ে আসুন আমাকে। আপনার জন্য আমি আমার মা, ভাইকে কষ্ট দিয়েছি আর আপনিই কিনা আমার হাড় ভাঙার পরিকল্পনা করছেন! আমি এখানে থাকব না, আমি আম্মুর কাছে যাব। ”

-” চুপপ! একদম চুপপ। মাথাটা ধরিয়ে ফেলছ আর একটা কথা বললে হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখব। বেয়াদব মেয়ে! বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে যাও। ঝিনুক আজ তোমার বইপত্র নিয়ে আসবে। সংসার করবে আর পড়াশোনা করবে ব্যস। ”

কাচুমাচু হয়ে বসে রইল হৈমী। রুদ্র ধমকি-ধামকি দিয়ে ওঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। দেখল হৈমী বসে আছে, চোখ দু’টো টলমল করছে তার। সত্যি বলতে সিরিয়াস ধমক খেয়ে এবার তার মা, ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। তারা তাকে কখনো এমন করে ধমক দেয়নি। তার মুখোভঙ্গি দেখে রুদ্র বলল,
-” মেয়ে হয়ে জন্মেছ অথচ কিছুই পারো না। বিছানা গোছাতে জানো না, রুম ঝাড় দিতে পারো না, রান্না করতে পারো না, খেতে পর্যন্ত পারো না! শুধু পারো বকবক করতে। শুনেছি পড়াশোনায়ও কাঁচা। শুধু কথায় পাকা, অ্যাই শোনো তোমাকে যদি মানুষ না বানাতে পারি আমিও রুদ্র না। ”

তীব্র অপমানে গাল ফুলে ওঠল হৈমীর৷ থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন! ”

-” নো, যা সত্যি তাই বলছি। ”

কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করতে করতে বলল রুদ্র। হৈমী নাক ফুলিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। টিশার্ট পরতে পরতে রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করল,
-” কয়েক মাস পরই তো পরীক্ষা, সেদিকে মন আছে? মন আছে সাজগোজ, আর হাঁসের মতো পকপক করাতে ”

মেজাজ খারাপ হলো হৈমীর। বিছানা থেকে নেমে এসে রুদ্রর সামনে দাঁড়াল। তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-” মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমার পড়াশোনা আমি ইচ্ছে হলে করব, আমার মুখ আমি হাজারটা কথা বলব। ”

চোয়াল শক্ত করে হাত বাড়িয়ে রুদ্র তার তর্জনি চেপে ধরল। কিছুটা ব্যথা সহকারেই ধরল। হৈমী ” আহ ” করে ওঠতেই বলল,
-” বেয়াদবি নট এলাউ। যা বলেছি তাই শুনবে। বোঝাপড়া করব পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর! ”

ঢোক গিলল হৈমী। রুদ্র এবার হাতটা নরম করল। সে বলল,
-” আপনাকে কে বলেছে আমি পড়াশোনায় খারাপ? শুনুন, বিসিএসে আসা প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি। ”

ভ্রু বাঁকিয়ে রুদ্র বলল,
-” তাই? ”

মনে মনে হৈমী বলল,
-” এই রে বেশি বলে ফেললাম নাকি! ”

-” বিশ্বে কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল? ”

-” দুইটি, দুইটি। ”

-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে জানো?”

-” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে। ”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রুদ্র। চোখ, মুখের আকৃতি কিছুটা বিকৃতি করে পুনরায় প্রশ্ন করল,
-” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে?

উল্লসিত কণ্ঠে হৈমী উত্তর দিল,
-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। ”

উত্তরটা দিয়ে মনে মনে বলল,
-” সাল ভুলে গেছি তাই বলে আমি খারাপ স্টুডেন্ট নই। লজিক দেখিয়ে ঠিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। ”

দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল,
-” বাহ তোমাকে তো স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ারে এওয়ার্ড দেয়া উচিৎ। আর এ মুহূর্তে তোমাকে আমার মিউজিয়ামে রেখে আসা উচিৎ। ”

কথাটা বলেই হেঁচকা টানে ছোট্ট শরীরটা নিজের বক্ষে এনে ফেলল। তার বুকপটে কপাল ঠেকল হৈমীর। গম্ভীর মুখটায় মাথা তুলে তাকাল সে। রুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েক পল চুপ থাকার পর বলল,
-” সত্যিই নির্বোধ একটা! ব্যাপার না সোজা বানিয়ে ফেলব। ”
________
কফি বানানোয় পারদর্শী থাকায়, হৈমীকে দিয়ে তিন কাপ কফি বানালো রুদ্র। এরপর কল করল আবিরের ফোনে। আবির ফোন রিসিভ করতেই সে বলল,
-” কী রে আজ ওঠবি না? ”

-” এই তো বন্ধু ওঠতেছি। ”

ফোন কেটেই বেরিয়ে এলো আবির। সোফায় বসা ছিল রুদ্র। তাকে দেখে তৃপ্তিময় হেসে এগিয়ে এসে পাশেই বসল। রুদ্র কফি খেতে ইশারা করলে আবির কফির মগ হাতে নিয়ে বলল,
-” ভাই আমি অনেক ভাগ্যবান পুরুষ। প্রেম থাকাকালীন কত ঝগরা করেছি, কত কষ্ট দিয়েছি। অথচ মেয়েটা আমাকে কাল সেরা উপহারটাই দিল। আমি ওকে আর বিন্দুমাত্র কষ্টও দিব না। ও যা বলবে তাই শুনব। জানিস কেমন ফিল হচ্ছে? এই মেয়েটা যদি এখন আমাকে বিষপান করতেও বলে আমি তাই করে ফেলব! ”

বাঁকা হাসল রুদ্র। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আবির আবারো বলল,
-” আমি সত্যি ভাগ্যবানরে ওর মতো বউ পেয়ে। ”

রান্নাঘর থেকে হৈমী বেরোতেই আবিরের এই কথা শুনে চোখ পিটপিট করে এগিয়ে এলো। আবিরকে বলল,
-” শুধু আপনি একা একাই ভাগ্যবান না ভাইয়া উনিও ভাগ্যবান তাই আমার মতো বউ পেয়েছে। আপনি ভালো মানুষ তাই স্বীকার করলেন, কিন্তু উনি মোটেই ভালো মানুষ নন এজন্য স্বীকার করবে না। ”

রুদ্র চোখ গরম করে তাকাল। কথার আগা মাথা না বুঝে এই মেয়েটা ফোঁড়ন কাটতে এলো। মান, সম্মান আর রাখবে না দেখছি! হৈমীর কথা শুনে আবির মিটিমিটি হাসতে লাগল। তার খুব বলতে ইচ্ছে করল,
-” ওর মুখে ভাগ্যবান শুনতে চাইলে তোমাকে যে অনেক সেক্রিফাইস করতে হবে বোন। ”

কিন্তু বলল না। রুদ্র বিষয়টা পছন্দ করবে না। তাছাড়া হৈমী তার ছোটো বোনের চেয়েও ছোটো। তাই ওর সঙ্গে এসব মজা করতেও বিবেকে বাঁধে।

রুদ্রর গরম চাহনি দেখে হৈমী বলল,
-” দেখেছেন কীভাবে তাকাচ্ছে? আপনি কখনো আপুর দিকে এভাবে তাকান? ”

আপুর কথা স্মরণ হতেই খেয়াল করল সে উপস্থিত নেই। তাই বলল,
-” এমা আপু কোথায়? কফি তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি কেমন? ”

কফির মগ নিয়ে আদ্রিতার কাছে গেল হৈমী। আবির খিলখিল করে হাসতে লাগল। বলল,
-” বন্ধু তুমি সব সময় এত হট থাইকো না। তোমার বাচ্চা বউ সইতে পারবে না। ”

রুদ্র চোখ কটমট করে তাকাল। আবির বলল,
-” দোস্ত, তোর মুখে ভাগ্যবান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রইলাম। শুধু আমি না আমাদের ছোট্ট মিষ্টি ভাবিটাও বসে আছে। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here