বেয়াইনসাব?,পর্বঃ০২
Arshi Ayat
বেয়াইনসাব!বেয়াইনসাব শুনতে শুনতে মাইশার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।এতো বেয়াদব ছেলে মাইশা ওর বাপের জন্মেও দুটো দেখেনি।আইরিন,মিহি আর ইশিকা সুন্দরভাবে আহানের সাথে আড্ডা দিচ্ছে কিন্তু মাইশার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।ওর জন্য শান্তিমতো আড্ডা দেওয়া যাচ্ছে না।সবার এটেনশন ওই বাল টার দিকে।মাইশা ভেতরে ভেতরে আহানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছে যা আহান ওর মুখের এক্সপ্রেসনে বুঝতে পারছে।তবুও আহানের কেনো জানি মাইশাকে ইচ্ছামতো বিরক্ত করতে মজা লাগে।
একটুপরই ট্রেন একটা স্টেশনে থামলো।আহান সিট থেকে উঠে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল”কি গো বেয়াইনসাবেরা ঝালমুড়ি খাবেন?”
ইশিকা দাঁত কেলিয়ে বলল”বেয়াই খাওয়ালে অবশ্যই খাবো।”
ইশিকার কথায় সবাই হাসলো।মাইশা না হাসলেও মনে মনে বলল’কচুর বেয়াই তুই।আমি পারলে তোরে ঝাটা দিয়া পিটাইতাম।’
আর কেনো যে আমার বোনেরা এই ফাউল ছেলেটাকে এতো প্রশ্রয় দিচ্ছে!
একটু পর আহান চার প্যাকেট ঝালমুড়ি আনলো।তারপর সবাইকে দিয়ে দিলো।না চাইতেও মাইশাকে প্যাকেট টা নিতে হলো।মিহি বলল”তুমি খাবে না আহান?”
“আমি বেয়াইনদের থেকে ভাগ বসাবো।” আহান হেসে বলল।
প্রথম ইশিকার থেকে এরপর আস্তে আস্তে সবার থেকেই একটু একটু করে নিলো।শুধু মাইশা বাদে।পুরোটা জার্নি নিজের সিটে যায় নি আহান সারাক্ষণ মাইশাদের এখানে ছিলো।সবার সাথে অনেক ভালো আড্ডা চললো।কিন্তু মাইশা আড্ডায় আসলো না।কেনো জানি মাইশার এই ছেলেটাকে সহ্য হয় না।
বান্দরবান পৌঁছে আহান ওর দাদুর বাসায় চলে গেলো আর ওরা চারজন মিহিদের বাসায় গেলো।
বাসায় পৌঁছেই মাইশা ঘুমিয়ে পড়লো।অনেক টায়ার্ড লাগছে তাই।মাইশার সাথে ইশিকাও শুয়ে পড়লো।
মাইশার যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত নয়টা।ঘুম থেকে উঠে দেখলো ইশিকা এখনো ঘুমাচ্ছে।আইরিন গান শুনছে আর মিহি রুমে নেই।মাইশা ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে খালা খালুর সাথে গল্প করলো কিছুক্ষণ।তারপর রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমাতে গেলো।
সবাই ঘুমালেও ইশিকা আর মাইশার একফোঁটা ঘুমও আসছে না।তাই ইশিকা বসে বসে ওর ফ্রেন্ডস গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছে আর মাইশা যেই মাত্র ডাটা ওপেন করে ইউটিউবে যাবে তখনই মেসেজ এলো।তাও আহান দিয়েছে মেসেজ।মাইশা মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে ফেসবুক স্ক্রল শুরু করলো।দুইমিনিট পর আরেকটা মেসেজ এলো।মাইশা এবার মেসেজ সিন করলো।আহানের লাস্ট মেসেজটা ছিলো বেয়াইনসাব কাল আপনাদের বাড়িতে আসছি!”
মাইশা জবাবে কি লিখবে বুঝতে পারছে না।পাঁচ মিনিট ভেবে তারপর লিখলো”ভালো”
সাথে সাথেই আহান রিপ্লাই দিলো’পাচ মিনিট লাগিয়ে মাত্র ‘ভালো’ বললেন।আমিতো মনে করেছিলাম আপনি আবার প্যারাগ্রাফ লিখতে বসে গেলেন নাকি!
“আচ্ছা পরে কথা বলবো আমি ব্যাস্ত।” লিখে সেন্ড করতেই ওপাশ থেকে আহান রাগের ইমুজি দিয়ে বলল”কি নিয়ে ব্যাস্ত?
“ঘুমাবো।”
“ঘুমিয়েই তো উঠলে।এখন আবার ঘুমাবে?”
মাইশা অবাক হয়ে বলল”আপনি জানলেন কিভাবে?”
“এগুলো জানা ব্যাপার না।আচ্ছা বেয়াইনসাব এখন আল্লাহ হাফেজ।কালকে দেখা হবে।”
বলে আহান অনলাইন থেকে চলে গেলো।আর মাইশা ইউটিউবে নাটক দেখা শুরু করলো।
—————–
নাস্তা শেষ করে মাত্র উঠতে না উঠতেই আহান এসে উপস্থিত।আহানকে দেখে মিহি উঠে ওর কাছে গিয়ে বলল”আরে আহান আসো।নাস্তা করো।”
“না ভাবি নাস্তা করেই এসেছি।তোমাদের সাথে দেখা করতে আসলাম।”
মিহি ওকে সোফায় বসিয়ে দিলো।মিহির বড় ভাই আর ওর মা এসে আহানের সাথে কথা বলতে শুরু করলো।একটু পর আইরিন,ইশিকা আর মিহি এসেও ওর সাথে আড্ডা দেওয়া শুরু করলো।কথা বলতে বলতে আহান মাইশাকে দেখতে না পেয়ে বলল”ভাবি আরেক বেয়াইন কই?”
“মাইশাতো ঘরে।ওর ফিয়েন্সের সাথে কথা বলে।”
মিহির কথা শুনে আহান মনে হয় আকাশ থেকে পড়েছে।মাইশার ফিয়েন্সে মানে!আহান বিষয়টা ক্লিয়ার করার জন্য মিহিকে জিগ্যেস করলো”ওনার কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
“হ্যা।মাইশার ইন্টারে থাকতেই আংটি বদল হয়।মাইশার অনার্স শেষ হলে বিয়ে।”আইরিন বলল।
আইরিনের কথায় আহান কেমন যেনো কষ্ট হচ্ছে।বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে!কেনো হচ্ছে আহান বুঝতে পারছে না।ওর তো খুশী হওয়ার কথা কিন্তু।কেনো জানি আহান একফোটাও খুশী হতে পারছে না।অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে!কিন্তু কেনো?আহানের আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।তাই একটা বাহানা দিয়ে চলে গেলো।বাইরে এসে মাইশাকে কল দিলো।
মাইশা মাত্রই ইভানের সাথে কথা বলে ফোন রাখলো আর সাথে সাথেই আহানের ফোন এলো।মাইশা ফোন রিসিভ করতেই আহান বলল” কি করো?”
“কিছু না।”
“তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”
মাইশা একটু অবাক হলেও নিজেকে সামলে বলল”হ্যা।”
“কংগ্রাচুলেশন বেয়াইনসাব।”
“ধন্যবাদ।”
তারপর আহান আর কথা বলল না।ফোন রেখে দিলো।কংগ্রাচুলেশন দিলেও আহান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।হাটতে হাটতে একটা টং দোকান থেকে ব্যানসন কিনলো।তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে হাটতে লাগলো।হাটতে হাটতে হঠাৎ ফোন এলো।ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো ইভান ফোন দিয়েছে।আহান রিসিভ করতেই বলল”কি রে শালা।ভুলে গেলি?”
“তুই আমার শালা কুত্তা।তোর বইন রে আমি বিয়া করমু।আর আমার কোনো বইন নাই সেইজন্য তুই আমারে শালা ডাকতে পারবি না।বেড লাক।” আহান হাসতে হাসতে বলল।
ইভানও হাসতে হাসতে বলল”আহাদ ভাইয়া আসবে কবে?”
“শুনলাম কাল আসবে।”
“বাহ!আমি যদি আসতে পারতাম।ইশ অনেকদিন তোদের সাথে দেখা হয় না।”
“থাক আর তো মাত্র ছয়মাস তারপরই তো আসতে পারবি।”
“হুম।সেই আশায়ই বসে আছি।”
“আর শোন দেশে আসার পর ভাবিরে না দেখালে তোর হাড্ডি ভাঙবো আমি।”
ইভান হেসে বলল”আচ্ছা ঠিকাছে দেখাবো।
দুইবন্ধু আরো কিছুক্ষণ বকবক করে ফোন রেখে দিলো।আহান আর ইভান দুইজনই ভালো বন্ধু বেষ্টফ্রেন্ড যাকে বলে।ছোট থেকে ইন্টার পর্যন্ত একসাথে পড়াশোনা করলেও অনার্স করতে ইভান আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলো।তবে প্রতিবছরই ছুটিতে দেশে আসে।মাইশা আর ইভানের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হবে।ইভানের বাবা আর মাইশার বাবা বন্ধু সেই সুবাদে মাইশা আর ইভানের আংটি বদল করে রেখেছে।মাইশার অনার্স শেষ হলেই ইভানের সাথে বিয়ে হবে।ইভানের বিয়ের কথা ওর ফ্রেন্ডরা জানলেও কেউ জানে না মেয়েটা কে।ইভান এটা সবার জন্যই সারপ্রাইজ রেখেছে।
দুইদিন পরের কথা…
আজ মিহির আংটিবদল।সকাল থেকে সবাই ব্যাস্ত।আইরিন আর ইশিকা বড় খালার সাথে কাজে হাত দিচ্ছে।আর মাইশা শুয়ে আছে।মাইশার প্রচুর জ্বর কাল রাত থেকেই।ঔষধ খেয়েছে একটু আগে।আর আইরিন গেছে পার্লারে।আগে থেকেই গেছে যদি সিরিয়াল না পাওয়া যায় তাই।আস্তে আস্তে মেহমানে বাড়ি ভর্তি হচ্ছে।মাইশার বাবা মাও রওনা দিয়েছে ইতিমধ্যে।
মাইশা বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছিলো।হঠাৎ কল আসায় চোখ খুলে ফোনের স্ক্রিনে দেখলো আহান ফোন দিয়েছে।মাইশা ফোন রিসিভ করতেই আহান বলল”মাইশা একটু বাইরে আসতে পারবে?”
“কেনো?”
“প্রয়োজন আছে বলেই ডাকছি।”
“আমার শরীর খারাপ আসতে পারবো না।”
“আমি কিছু জানি না। তুমি আসবে।আমি ওয়েট করছি।দশমিনিটের মধ্যে না আসলে আমি নিজেই এসে নিয়ে যাবো।”
মাইশা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলো।তারপর আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই খালা বলল”কি রে তোর না শরীর খারাপ।তুই যাচ্ছিস কোথায়?”
“এখন ঠিকাছি।শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না তাই একটু হেটে আসি।”
“না না এই শরীর নিয়ে বাইরে যাওয়া লাগবে না।”
মাইশা করুণ গলায় বলল”কিচ্ছু হবে না।আর আমি বেশিদূর যাবো না।কাছাকাছিই আছি।”
“তাড়াতাড়ি ফিরবি।”
‘আচ্ছা’বলে মাইশা বেরিয়ে গেলো।বাইরে এসে দেখে।আহান বাইকের ওপর দাড়িয়ে সিগারেট টানছে।মাইশা ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বলল”কি বলবেন বলেন।”
আহান মাইশার দিকে তাকাতেই দেখলো মাইশা বিরক্তি মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।ঠোট শুকিয়ে কাঠ, সামনের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।চোখগুলো হালকা লাল।বাস্তবিকই মাইশাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।আহান সিগারেট টা ফেলে দিয়ে মাইশার কপালে হাত দিতেই মাইশা ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল “কি বলেবেন সেটা বলুন।”
“জ্বর এখন একটু কম আছে।ঔষধ কখন খেয়েছো?”
“আমার সময় নাই।যা বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।”
“জ্বর আসলো কিভাবে?”
“প্লিজ।আমার মাথা ধরছে।”
“নিজের একটুও খেয়াল রাখো না তাই না?”
“আপনি কি কিছু বলবেন নাকি আমি চলে যাবে?”
এটা বলেই মাইশা উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করতে যাবে তখনই আহান ওর হাত টেনে ধরে বলল”আমি চলে যেতে বলি নাই।বাইকে উঠে বসো।”
মাইশা বিরক্তিকর গলায় বলল”দেখেন এটা আমাদের ভার্সিটি না যে আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।ভার্সিটির বাইরেও সিনিয়র গিরি দেখানো বন্ধ করেন।”
আহান শান্ত কন্ঠে বলল”তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।আর সেগুলো আমি এখানে বলতে পারবো না।কাছেই একটা কফিশপ আছে সেখানে গিয়ে বলবো।তাই তোমাকে যেতে হবে।”
মাইশা কৌতূহলী হয়ে বলল”আচ্ছা চলুন।”
মাইশা আর আহান কফি-শপে এলো।
কফি অর্ডার করে আহান মাইশার দিকে তাকিয়ে কোনো ভণিতা ছাড়াই বলা শুরু করলো”মাইশা তোমাদের নবিন বরণের দিন আমি তোমাকে চিনেছি।তা নাহলে আমি জানতামও না তোমার কথা।সেদিন নবীন বরণের দিন তোমার নাচ দেখে আমি ফিদা হয়েছিলাম।তারপর আস্তে আস্তে তোমাকে জ্বলানো শুরু করলাম।কোনো এক অদ্ভুত কারণে তোমাকে জ্বালাতে আমার ভালো লাগতো।শুধু তোমাকেই জ্বালাতাম।আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার ইন্টারেস্ট তেমন ছিলো না।হ্যাঁ তবে আমার আগে দুইটা রিলেশন ছিলো।এখন আর নাই।ওদের সাথে ব্রেকাপের পর আমার আর কাউকে ভালো লাগে নি।তখন তোমাকে ভালো লাগতো কি না জানি না কিন্তু তোমাকে জ্বালানোর পর তোমার ভয় পাওয়া চেহারা,তোমার চোখমুখ কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করার ঢং টা হেব্বি লাগতো আমার।সেইজন্যই তোমাকে জ্বালাতাম।আমি দুইদিন আগেও বুঝতে পারি নি আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমার বোনেরা বলার পর আমি রিয়েলাইজ করেছি।এই দুইটা দিন আমি একটুও ঘুমাতে পারি নাই।অস্থিরতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।তারপর আর কন্ট্রোল করতে না পেরে আজ বলেই দিলাম।আমি জানি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।তবুও কি কোনো ভাবে বিয়েটা ভাঙা যায় না?দরকার হলে আমি তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলবো।”
মাইশা কিছু বলতে যাবার আগেই জ্ঞান হারালো।আকষ্মিক ঘটনায় আহান হতভম্ব হয়ে গেলো।কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আবার এসেছি।আহান মাইশার চোখেমুখে পানি দিতেও মাইশা চোখ খুললো।চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।আহান ওকে কফিশপে বসিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আসলো।তারপর ওর সামনে বসে ওকে খাইয়ে দিতে নিলে মাইশা একহাত দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও লাভ হয় নি আহান জোর করে একটু খাইয়ে দিলো।তারপর কাছের একটা ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে খাওয়ালো।দশমিনিট কফিশপে মাইশা হেড ডাউন করে রাখলো।আর আহান ওর পাশে বসে ছিলো।আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ কেউ বলল বাহ কি ভালোবাসা!একটু বেটার ফিল হতেই মাইশা উঠে দাড়ালো।আহানও দাড়িয়ে বলল”এখন ঠিকাছো?”
“আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিন প্লিজ।”
আহান আর মাইশা বাসার সামনে আসতেই মাইশা আহানের বাইক থেকে নেমে চলে যেতে নিলেই আহান পিছন থেকে বলল”আমার জবাবটা বাকি আছে।”
মাইশা ওর দিকে না তাকিয়েই বলল”আজ সন্ধ্যায় জবাব পাবেন।
বলে ভেতরে চলে গেলো।আর আহানও চলে গেলো।
চলবে…..