বৈধ_ধর্ষণ,১০,১১

0
1173

#বৈধ_ধর্ষণ,১০,১১
#মিমি_সুলতানা

পর্ব-১০
———————

গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলো ফাহাদ। কারণ লোকটিকে ফাহাদ চেনে। এবং খুব ভালোভাবে চেনে। ফাহাদের সন্দেহ সত্যি হলে সেটা ফাহাদের নিজের জন্য ও অনেক ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।
আরোহীর বাবার লাশ গোরস্থানে কবর দিতে নেওয়ার জন্য সবার সাথে পায়ে পা মিলালো ফাহাদ।
.
.
পরদিন সকাল..
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হতে লাগলো ফাহাদ। আজ একবার আরশীর সাথে দেখা করতেই হবে। অনেক কিছু জানা বাকি তার।

রোজার সম্পর্কে মোটামুটি অনেক কিছুই জানতে পেরেছে সে । তবে ইভাদের সম্পর্কে অনেকটাই অজানা। আসল অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছাতে যেগুলো জানা খুবই জরুরি।
দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে জেলের দিকে রওনা হলো ফাহাদ।
.
.
.
ফাহাদকে দেখে কান্না আর বাঁধ মানলো না।
ফাহাদ আসতেই আরোহী ও মা ও বাবার মৃত্যু নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করলাম।
ফাহাদ আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিলো।
এই প্রথম কেউ জেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো।
কথার মাঝেই হঠাৎ ফাহাদ বলে উঠলো,
-আমার পূর্ণ বিশ্বাস আপনি ইভাদকে খুন করেন নি।আপনি কেন ইভাদের খুনের দায়টা নিজের উপর নিচ্ছেন আমি জানি না তবে আমি ইভাদের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
ইভাদ কে? হঠাৎ করে শুভর বাসায় তার এভাবে আগমন! দুইদিন পরেই স্টোর রুমে তার খুন হওয়া সবটা একটা রহস্যের জালে জড়ানো কিছু অজানা তথ্য যেটা আমাকে জানতে হবে।
তাছাড়া সবচেয়ে অবাক করা কথা হচ্ছে আপনি অতো রাতে স্টোর রুমে কেন গিয়েছিলেন?

ফাহাদের কথা শুনে আমি কিছু টা চমকে উঠলাম।
তাহলে পুরো বিষয়টা এখন ফাহাদ তদন্ত করছে!
এরমানে খুনী সেটা জানতে পারলে সে ফাহাদের ও ক্ষতি করার চেষ্টা করবে!
অকারণেই ঝড়ে পরবে আরেকটি প্রাণ!
না না এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না।
আমাকে সাহায্য করতে আসা মানুষগুলোর নিথর দেহ পরে থাকতে দেখেছি নিজের চোখে।
আর কোনো মৃত্যুর ভার আমি নিতে পারবো না। এমন অপরাধবোধ নিয়ে মুক্ত হয়ে বাঁচার থেকে আমার এই অন্ধকার বন্দী জীবনই ভালো।
আমি ফাহাদের কথার প্রতি উত্তর টা একটু শক্তভাবেই দিলাম,
-আপনাকে তো আমি বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি যে এতোটা বোকা সেটার ধারণা আমার ছিলো না।
যেখানে অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে সেখানে আপনি তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন! বেশ অবাক হলাম। সব কথার একই কথা, আমিই ইভাদকে খুন করেছি। কেন করেছি, ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক বা শত্রুতা ছিলো কি-না সেটা আমি আপনাকে বলতে বাঁধ্য নই।
ফাহাদ বেশ বিরক্তবোধ করতে লাগলো।
সে বুঝতে পেরেছে আরশী তাঁকে কিছুই বলবে না।
এক রাশ বিরক্তি নিয়েই ফাহাদ পা বাড়ালো।
দু-একপা আগাতেই আবার পিছন ফিরে আমাকে বললো,
-আসল অপরাধী কে সেটা কিন্তু এখনো জানা যায়নি। কে বলতে পারে সে আরোহী বা আপনার মা’য়ের কোনো ক্ষতি করবে না!
আর শুনুন, শুভ ও কিন্তু কিছুদিন ধরে নিখোঁজ।

ফাহাদের শেষে বলা কথাগুলো আমাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিলো।
.
.
.
.
আরশীর কাছ থেকে বের হয়ে আরোহীর বাসার দিকে রওনা দিলো ফাহাদ। এই সময়ে আরোহীদের পাশে থাকা খুব জরুরী।
পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে সামনে আগাতেই ফাহাদের মনে হলো কেউ তার পিছু করছে।
কিন্তু পিছু ফিরে সন্দেহজনক কাউকে না দেখে মনের ভুল ভেবে আরোহীর বাসার দিকে রওনা হলো সে।
.
.
আরোহীর বাসায় ঢুকেই দেখতে পেলো রেহানা বেগম কান্না করছে। প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা এসে তাঁকে স্বান্তনা দিচ্ছে।
আশেপাশে তাকিয়ে আরোহীকে দেখতে না পেয়ে তার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো ফাহাদ।
রুমের ভিতর ঢুকে আরোহীর পাশে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো সে।
ছেলেটা দেখতে বেশ স্মার্ট। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফরসা না হলেও শ্যামলা বা কালো ও বলা যায় না।
এমন একটা ছেলেকে আরোহীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপারটা ফাহাদ হজম করতে পারলো না।
ফাহাদকে দেখে আরোহী তার দিকে চেয়ার টা এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-আসো পরিচয় করিয়ে দেই।
এর নাম “হিমেল”। আমার কাজিন। বাবার মৃত্যুর কথা শুনে এসেছে।
হিমেল, ওনার নাম “ফাহাদ”। আমার ফ্রেন্ড।
হিমেল হাই বলে ফাহাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে ফাহাদ বেশ কিছুক্ষণ পরে হাত মেলালো।
একটা কথাও বলছে না ফাহাদ।
আরোহীর সাথে হিমেলের ঘেঁষে ঘেঁষে কথা বলাটা ওর একটুও সহ্য হচ্ছে না। আঁড়চোখে বার বার ওদের দিকে তাকাচ্ছে ও। আরোহীর প্রতি হিমেলের এতোটা কেয়ার যেন বিষের মতো চোখে বিঁধছে।
ফাহাদ ততক্ষনাৎ আরোহীকে কিছু না বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো, রেহানা বেগমকে বিদায় জানিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো।
প্রচুর বিরক্তিকর একটা দিন গেল আজ। মনে মনে হিমেলকে হাজারটা বকা দিয়ে আনমনে হাঁটছে সে।
আবারও ফাহাদের মনে হলো তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে পেছনে তাকাতেই একটা ছায়া সরে যেতে দেখলো।
রাস্তায় নামলে এখন এমনকিছু পরিস্থিতির শিকার হতে হবে সেটা ফাহাদ ভালো করেই জানতো।
তার জন্য সবভাবেই প্রস্তুত সে।
ফাহাদ সোজা হাঁটতে লাগলো। বেশ কিছুদুর পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। অনুসরণকারী এখনো তার পিছু করছে। তাঁকে বুঝতে না দিয়েই আচমকাই ফাহাদ পেছনের দিকে দৌড় দিলো অনুসরণকারী বুঝে পালানোর আগেই ফাহাদ তাঁকে ধরে ফেললো। অল্পবয়সী একটা ছেলে।
ছেলেটা কে, তার পিছু কেন করছে এমন অনেক প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না ফাহাদ।
রেগে গিয়ে নাক বরাবর একটা ঘুষি দিতেই ছেলেটা তার পা ধরে কান্না করে বলতে লাগলো
” স্যার,আমি নিজের জন্য আপনার পিছু করিনাই আমারে একজন চাঁদর পরা লোক আইসা কাল অনেকগুলো টাকা দিয়ে বলেছিলো আপনার পিছু করতে। আপনি সারদিন কোথায় কোথায় যান,কার কার সাথে দেখা করেন সব তথ্য তারে দিতে। আমি গরীব মানুষ স্যার টাকা দেইখা আর না করতে পারিনাই। আমার কোনো দোষ নাই আমারে ছাইড়া দেন স্যার।”
ছেলেটার কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে তার। ছেলেটিকে টেনে তুলে “পরবর্তীতে যদি এমন কিছু করতে দেখি খুব খারাপ হবে মনে রাখিস” বলে ছেড়ে দিলো।
এক দৌড়ে ছেলেটা চক্ষু আড়াল হয়ে গেলো।
দুশ্চিন্তার এক মস্তবড় ঘাঁটি নিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে আগাতে লাগলো ফাহাদ।
.
.
.
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেলো সে।
পুরো রুমটা অগোছালো। বালিশ, চাদর,ছোট বড় জিনিসপত্র সব এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে “খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার ” মতো কেউ একজন রুমের মধ্যে কিছু একটা খুঁজেছে। কিন্তু তার রুমে কে আসতে পারে!
সিদ্দিক সিদ্দিক বলে কয়েকবার ডাক দিতেই
বস বস বলে কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হয় দারোয়ান সিদ্দিক।
বাসায় কেউ ঢুকেছিলো কি-না জিজ্ঞাসা করলে মাথা চুলকিয়ে চুলকিয়ে সিদ্দিক উত্তর দেয়,
-কেন ঢুকবে বস? আর কিভাবেই বা ঢুকবে?
প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করায় প্রচন্ড রেগে গেলো।
“তোকে যতটুকু জিজ্ঞাসা করেছি তুই ততটুকুরই উত্তর দে” বেশ জোর গলায়ই বললো ফাহাদ।
আচমকা ফাহাদকে এভাবে রেগে যেতে দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায় সিদ্দিক।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তোতলাতে তোতলাতে বলে,
-ন ন না বস। আমি তো এমন কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেখিনি।
-দেখবি কি করে! আমি যখন ঢুকেছিলাম তখনও তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলি। দুর হ আমার সামনে থেকে।
সিদ্দিক এক সেকেন্ডের মধ্যে ওখান থেকে কেটে পরে।
প্রচুর পরিমাণে রাগ ক্ষোভ আর চরম বিরক্তি নিয়ে বাথরুমে চলে যায় ফাহাদ।
.
.
.
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়।
সিদ্দিককে ডেকে রুমটা আগের মতো গোছাতে বলে।
টেবিলের উপর রাখা সিদ্দিকের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বেলকনিতে চলে যায় ফাহাদ।
ফাহাদ কখনোই সিগারেট খায়না। তবে আজ তার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। সিগারেট না-কি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয় সেটা সত্যি হোক বা মিথ্যা আজ এটাই মন থেকে মানতে চাইছে সে।
.
.
.
সিগারেট এর ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা মেলাতে লাগলো ফাহাদ।
সবকিছু মিলিয়ে একটা জিনিস সে ভালোভাবে বুঝতে পারছে সামনে আসতে চলেছে একটা কঠিন সময়।
যখন তার দিতে হবে এক ভয়ংকর পরীক্ষা।
হয়ত রুখে দাঁড়াতে হবে নিজের বিরুদ্ধেই!
.
.
.
.
.
চলবে……

লেখিকা- মিমি সুলতানা
#বৈধ_ধর্ষণ
#মিমি_সুলতানা

পর্ব -১১

————————-
সিগারেট এর ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা মেলাতে লাগলো ফাহাদ।
সবকিছু মিলিয়ে একটা জিনিস সে ভালোভাবে বুঝতে পারছে সামনে আসতে চলেছে একটা কঠিন সময়।
যখন তার দিতে হবে এক ভয়ংকর পরীক্ষা।
হয়ত রুখে দাঁড়াতে হবে নিজের বিরুদ্ধেই!
.
.
.
আরো একটা দিন কেটে গেলো।
মন বলছে আজ হয়ত আরশীর কাছে গেলে কিছু জানতে পারা যাবে।
ভাবা মাত্রই ফাহাদ দ্রুত প্রস্তুত হয়ে বের হয়।
.
.
.
ফাহাদকে আসতে দেখে খুব খুশি হলাম।
মনে মনে ওকেই খুঁজছিলাম। সত্যি ই তো আসল অপরাধী যে আমি জেলে আছি শুনে থেমে থাকবে তার গ্যারান্টি কি?
সবচেয়ে ভালো হবে আসল অপরাধীকে খুঁজে তাঁকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া।
ফাহাদ কাছে আসতেই আমাকে কোনো ধরণের প্রশ্ন করার আগে আমি নিজের থেকে সবটা বলতে লাগলাম।
ইভাদের হঠাৎ করে শুভর বাসায় আসা, আমাকে দেখে তার সেই রহস্যময় হাসি দেখে তাঁকে আমার সন্দেহ করা, রোজার রুম খুঁজতে গিয়ে গভীর রাতে ইভাদের সাথে দেখা হওয়া তারপর তার আসার কারণটা জানা, স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া, এমনকি বাবার এক্সিডেন্টটা যে সাধারণ কোনো এক্সিডেন্ট ছিলো না সেটাও সেই রাতে জানতে পারার বিষয়টা সবটাই আমি ফাহাদকে খুলে বললাম।
বাবার এক্সিডেন্ট টা সাধারণ এক্সিডেন্ট ছিলো না এটা শুনে বেশ অবাক হলো ফাহাদ।
কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলে উঠলো,
“যেই রাতে ইভাদ খুন হয়েছে সেই রাতের কথাটাও বলুন, আপনি অতো রাতে স্টোর রুমে কিভাবে পৌঁছালেন? ”
ফাহাদের কথার আবার সেই ভয়ংকর রাতটার কথা মনে পড়ে গেলো যেটা আমি ভুল করেও মনে করতে চাই না।
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সেই রাতের কথা বলতে শুরু করলাম,
-রাতে হঠাৎ করে ইভাদের থেকে আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে। সে আসল অপরাধী কে তা জানতে পেরেছে এমনকি বাবার এক্সিডেন্ট এর পিছনে কার হাত ছিলো সেটাও জানতে পেরেছে।
বাসায় কেউ আমাদের একসাথে দেখলে সন্দেহ করতে পারে সেজন্য ১২ টার দিকে স্টোর রুমে সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে বলে জানায়।
আমি অনেক উত্তেজনার সহিত সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকি।
১২ টা বাজতেই সতর্কতার সহিত স্টোর রুমের দিকে যাই কিন্তু গিয়ে স্টোর রুমটা অন্ধকার দেখে বেশ অবাক হই। ইভাদকে আমি অনেক ডেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে রুমের ভিতরে ফোনের আলো নিয়ে আগাতেই ইভাদের রক্তাক্ত শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আমি পড়ে যাই।
ওর শরীরের ওইরকম ভয়ংকর অবস্থা দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
পরের সবটাই আপনি জানেন।
-কিন্তু সব দায়ভার নিজের উপর কেন নিয়েছেন?
-এটাই ভালো হবে মনে করেছিলাম তাই।
“সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রাধান্য দিলে কখনো সেটা ভালো কিছু বয়ে আনে না।”
আশা করি সেটা ভালো করেই বুঝেছেন।
আর হ্যা শুনুন,খুব শীঘ্রই আসল অপরাধী ধরা পড়বে আপনিও এই অন্ধকার জীবদ্দশা থেকে মুক্তি পাবেন। এক নাগাড়ে কথাগুলো চলে গেল ফাহাদ।
তার যাওয়ার দিকে আমি এক নজরে তাকিয়ে রইলাম।
.
.
.
বাসায় ফিরে রুমের ভেতর এলোমেলো ভাবে হাঁটছে ফাহাদ। কোনোকিছুই যেন মিলছে না।
বার বার শুধু মনে হচ্ছে সবকিছু চোখের সামনে দেখেও অনেককিছু দেখা যাচ্ছে না।
পড়ন্ত বিকেল হয়ত ছাঁদে গেলে একটু ভালো লাগবে সেই আশায় ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো সে।
যাওয়ার পথেই ফাহাদের বাবা “হানিফ চৌধুরীর”
রুমের সামনে দরজা থেকে ভেতরে থাকা খাটের নিচে চোখ যেতেই কিছু একটা দেখে ফাহাদ থমকে দাঁড়ালো।
ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে খাটের নিচ থেকে কালো চাদরটি টেনে বের করলো।
এটা সেই চাদর যেটা পড়ে কাল তাঁকে কেউ অনুসরণ করছিলো।
চাদরটা নাকের কাছে আনতেই সেই চিরচেনা স্প্রের গন্ধটা নাকে এসে লাগলো।
ফাহাদ হানিফ চৌধুরীর পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো।
খুঁজতে খুঁজতে টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে একটা ডিস্ক দেখতে পেলো। ডিস্কটা নিয়ে ফাহাদ তার রুমে এসে প্লে করতেই একটা ফুটেজ দেখতে পেলো।
হ্যা এটা তো শুভর বাসার সামনের রাস্তায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ মনে হচ্ছে। এমনকি যেই রাতে ইভাদের খুন হয়েছে সেই তারিখটাই দেখাচ্ছে।
কিন্তু এটা বাবার কাছে কেন!
আরেকটু সামনে প্লে করতেই ফাহাদ দেখতে পেলো হানিফ চৌধুরী গভীর রাতে শুভর দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। কথা বলার এক মূহুর্তে দু’জনেই বাসার ভিতরে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে দু’জনেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো।
হানিফ চৌধুরীর হাতে একটা ছুড়িও দেখা যাচ্ছে।
ফাহাদের সামনে এখন সবটা পানির মতো পরিষ্কার।
তার বাসার গার্ডেন এ ঔষধের প্যাকেটটি পাওয়া, কালো চাদরে ঘেরা লোকটার থেকে পরিচিত গন্ধ পাওয়া,কালো চাদরটি তার বাবার রুমে পাওয়া,সিসিটিভির আসল ফুটেজ সব যেন একদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
“আমি শিওর আরশীর কথা অনুযায়ী রোজার নখের আঁচড়টাও খুঁজলে পাওয়া যাবে”
ভেবে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো ফাহাদ।
.
.
.
পরদিন সকাল।
ফাহাদের বাসায় আজ অনেক মানুষের আনাগোনা। ভারাক্রান্ত মনে বেলকনির এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে সে। বেশ কয়েকজন পুলিশ ও এসেছে। হানিফ সাহেব আর শুভর বাসার দারোয়ানের হাতে হাতকড়া পড়ানো।
অনেক প্রশ্ন জানা বাকি ফাহাদের।
কিন্তু এই মূহুর্তে হানিফ সাহেবের মুখোমুখি হওয়ার মত দুঃসাহস তাঁর নেই। ছোটকালেই মা’কে হারিয়েছে সে। তারপর থেকে এই বাবা-ই তাঁকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা ছেলের মাঝে মতের অমিলের কারণে দুরত্ব বাড়লেও ভালোবাসাটা যে কমেছে সেটাও নয়। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কি করতো সেটা ফাহাদের জানা নেই তবে সে যেটা করেছে সেটা এতোটা সহজ ও ছিলো না।
নিজের বাবাকে সবার সামনে এভাবে মাথা নত করে থাকতে দেখে তার একদমই ভালো লাগছে না কিন্তু তাই বলে সে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারে না।
নিজের বাবাকে বাঁচাতে যদি নিরপরাধ কাউকে শাস্তির মুখে ঠেলে দিতে হয় তাহলে সেটা হবে একটা অমানুষিক কাজ যেই শিক্ষা সে নিজের ভেতরে ধারণ করে নি।
কিন্তু কেন করলো বাবা এমন?
কি স্বার্থ আছে এতে তাঁর?
আর বাবা আমাকেই বা কেন মারতে গিয়েছিলো?
হাজারটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরছে কিন্তু এখন ফাহাদের আর কিছুই ভালো লাগছে না।
বেলকনি থেকে সোজা রুমে চলে গেলো ফাহাদ।
.
.
.
আসল অপরাধী ধরা পড়ায় আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেলাম ঠিকই কিন্তু আমিও বেশখানিকটা অবাক হলাম।
ফাহাদের বাবা কেন এমনটা করবেন!
তিনি না-কি কোনো প্রশ্নের উত্তর ও দিচ্ছেন না।
সবটাই যেন ঠিক আছে তাও কোথাও কিছু একটা দেখেও আমরা দেখছি না।
যা ই হোক আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি তাঁর থেকে নিয়েই ছাড়বো আপাতত আমার মাথায় আরোহী আর মায়ের কথাই ঘুরছে।
.
.
বাসায় ফিরতেই আরোহী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
মায়ের শরীর ভেঙে পড়েছে।
আরোহীকে সামলে মায়ের কাছে যেতেই মা জোরে কান্না করে উঠলো।
“আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমি তোর মা হওয়ার যোগ্য না। আমার জন্য তোদের কতো কিছু সহ্য করতে হয়েছে সবটার জন্য আমি পাপী। ”
এমন নানা ধরনের কথা বলে মা কান্না করছে।
মা তাঁর নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে সেটাই আমার কাছে অনেক। মা’কে সান্তনা দেওয়ার মত কোন ভাষা আমার জানা নেই।
বাবার রুমে ঢুকতেই চারপাশ থেকে বাবার হাজারটা স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। আলমারিটা খুলে বাবার চশমা টা সুন্দর করে মুছে রাখলাম। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন এটাকে যত্ন করে মুছে সাজিয়ে রেখেছি আমি। অনেকদিন আসা হয়না চশমাটায় ও ধুলা জমে গিয়েছে।
বাবা-র বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছিলাম। চারপাশ থেকে বাবার প্রতিটা স্মৃতি আমাকে যন্ত্রণা দিতে লাগলো।
কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে আমার চলবে না।
এখনো অনেক কিছু জানা বাকি আমার।
বাবার এক্সিডেন্ট এর পিছনে কার হাত ছিলো সেটা এখনো ঘোলাটে। আসল অপরাধী যদি ফাহাদের বাবা হয় তাহলে শুভর নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কারণটা কি সেটাও আমার জানতে হবে।
.
.
.
একদিন হয় গেলো আমি এই অন্ধকার কুঠুরি থেকে মুক্ত।
তবে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আবারো এখানে আসা। হানিফ সাহেবের সাথে আমার দেখা করাটা খুব জরুরী।
হানিফ সাহেবের সামনে গিয়ে সালাম দিলাম।
হালকা মাথা তুলে সালামের উত্তর না দিয়েই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি।
সবকিছুই অদ্ভুত লাগছে।
মনের ভিতরে চেপে রাখা সব প্রশ্ন আমি করলাম তাঁকে। তার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আমি হতাশ হয়ে গেলাম।
খুন তিনি করেছেন তাঁর যথেষ্ট প্রমাণ আছে পুলিশের কাছে কিন্তু কেন করেছেন এটা জানা খুবই মুশকিল।
কোন উত্তর না পেয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন হানিফ সাহেব।
এই হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে অনেক ভৎসনা।
জড়িয়ে আছে শুনতে না পাওয়া হাজার প্রশ্নের উত্তর।
সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগছে।
কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা সবাই যেখানে শেষ ভাবছি সেখান থেকেই হয়ত নতুন কিছুর শুরু হতে চলেছে…
.
.
.
.
চলবে…
লেখিকা-মিমি সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here