বৈধ_ধর্ষণ,৮,৯

0
1047

#বৈধ_ধর্ষণ,৮,৯
#মিমি_সুলতানা

পর্ব-৮

—————————
নিজেকে আজকাল অভিশপ্ত মনে হয়। আমার সংস্পর্শে থাকা প্রত্যেকটি মানুষেরই আমার জন্য ক্ষতি হচ্ছে। নিজের বোনটাও তার সম্মান হারালো, আমার হাত ধরে আঁধারে নিমজ্জিত জীবনকে আলোর পথে আনতে চাওয়া বন্ধু রোজারও অকালে তার জানটা দিতে হলো।
সবশেষে দিশেহারা পথের সঙ্গ দিতে আশা ইভাদও এতো নৃশংসভাবে খুন হলো।
আজ যদি আমি এভাবে থাকি তাহলে না জানি আরও কত নিরপরাধী মানুষের প্রাণ যাবে।
অভিশপ্ত এই জীবনে আর কাউকে জড়ানোর সুযোগ দেবো না।
.
.
আরশী চলে যাওয়ার পরে অনেক কান্নাকাটি করে আরোহী। নিজের সবকিছু গুছিয়ে তৎক্ষনাৎ নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। বের হওয়ার সময় শুভ বাঁধা দিলে নির্ভয়ে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে আরোহী বললো,
-যেটার ভয় ছিলো সেটা হয়েই গিয়েছে এখন আর আমার কোনো পিছুটান নেই।
কথাটি বলে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেলো আরোহী।
এমন অপমানটা শুভ ঠিক হজম করতে পারলো না।
.
.
.
পরদিন ভোরবেলা।
প্রতিদিনের মত কানে ইয়ারফোন গুজে আজও হাঁটতে বের হয়েছে শুভ। কিছুদুর যেতেই সে অনুভব করলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।
পিছু ফিরতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বস্তার ভিতর ওর মাথা ভরে গলা পেঁচিয়ে ধরে।
চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না শুভ। সবটা বুঝে ওঠার আগেই তার উপর শুরু হয়ে গেল লাঠির প্রহার। ভালোভাবে চিৎকার ও করতে পারছে না সে। কেউ যেন শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করছে। শরীরের কিছু কিছু অংশ কেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে শুভর। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পরে যায় সে।
.
.
.
.
জেলখানার পরিবেশটা আমার সাথে মানিয়েছে বেশ। অভিশপ্ত জীবনের জন্য অন্ধকারের এই চার দেওয়ালই ভালো। এখানে শুভ নামক কোনো জানোয়ার নেই আমাকে নানাভাবে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। এখানে আমার চরিত্র নিয়ে,আমার মা বাবাকে তুলে করা গালিগালাজ শোনানোর জন্য কোনো “অনু” নেই।
আমার জন্য আবার কার কোন ক্ষতিটা হবে, কে কি হারাবে এসব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে না। শুধু একটা কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে “এই সমাজের কাছে অত্যাচারিত নিপিড়ীত মানুষগুলোই প্রধান অপরাধী” খুনী নামটা নিয়েই হয়তো বাকি জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে হবে।
.
.
.
ফাহাদ আর আরোহী দু’জন পাশাপাশি বসে আছে। দুই বোনের এভাবে অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নেওয়াটাকে তীব্র নিন্দা জানায় ফাহাদ।
ফাহাদ বুঝতে পারে তারা দু’জনেই নিরুপায় ছিলো তবুও ফাহাদ আরোহীকে বলে,
আমার মতে “অন্যায়কে মেনে নিয়ে চুপ করে থাকাটা কোনো সমাধান না। আর না তো এক অন্যায়কে থামাতে অন্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক। এতে হীতে বিপরীত হয় যেমনটা তোমার আপুর সাথে হয়েছে। আমার কাছে শুভ’র সাথে সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করায় অপরাধী তুমি আর তোমার আপুও।”
তবুও আমি তোমার সাথে আছি। দু’জন মিলে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করবো আর তোমার আপুকেও জেল থেকে বের করে আনবো।
আরোহী চুপ করে থাকে। নিজের ভুলটা বুঝতে পারে সে। ওর উচিৎ ছিল আগেই ফাহাদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করা যেটা করার মত সাহস সে করে উঠতে পারে নি। একটা ভুল সীদ্ধান্তের কারণে হারিয়ে ফেললো কতকিছু।
সবকিছু থেকেও যেন কোনকিছুই ঠিক নেই।
ফাহাদ তার পাশে আছে তো ঠিকই কিন্তু ভালোবাসাটা আছে কি-না সেটা নিয়ে সন্দিহান।
সেদিন আরোহী ফাহাদকে সবটা জানানোর পর থেকে একান্ত দরকার ছাড়া একটা কথাও তাদের মাঝে হয়নি। ভালোবেসে ফাহাদের “রুহী” বলে ডাকটাও যেন আজ অতীত। সেদিনের মত জরুরী কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দু’জনই বিদায় নিয়ে যে যার বাসায় ফিরে গেলো।
.
.
.
গেট থেকে ঢুকতেই সিদ্দিকের দিকে চোখ গেল ফাহাদের । কানে ইয়ারফোন দিয়ে পা নাচিয়ে নাচিয়ে গান শুনতে ব্যস্ত সে। ওকে আজ একটু বেশিই খুশি খুশি দেখাচ্ছে। গেট দিয়ে কে ঢুঁকছে কে বের হচ্ছে সেদিকে যেন তার কোনো খেয়ালই নেই। ফাহাদ এগিয়ে গিয়ে জোরে কান টেনে ধরতেই “বস,বস” বলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সিদ্দিক। কাজে এতো অবহেলা কেন জিজ্ঞেস করতেই সবগুলো দাঁত বের করে হেঁসে দিয়ে সিদ্দিক বলতে লাগলো-
-আজ একটা পূন্যের কাজ করেছি। কাজটা শেষে আজ সারাটাদিন আমার খুব ভালো কেটেছে। নিজেকে বীরপুরুষ মনে হচ্ছে।
“কি কাজ? ” প্রশ্ন করতেই সিদ্দিক অনেক উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো-
-ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে হেঁটে একটু দুরেই গিয়েই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরি। তখনই আমার পাশ থেকে শুভকে যেতে দেখি। আশেপাশে কাউকে না দেখে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমি রাস্তার পাশেই পরে থাকা একটা বস্তা দিয়ে ওর মুখটা বেঁধে জানোয়ারটাকে উদুম কেলিয়েছি। বিশ্বাস করেন বস একটা কাকপক্ষীতেও ঠিক পায়নি এমনকি শুভ নিজেও না, হা- হা-হা কেমন দিলাম বস!
সিদ্দিকের কথা শুনে ওর কাঁধ চাপড়ে “সাবাশ” বলে বাসায় ঢুকে গেল ফাহাদ।
.
.
.
শরীরের অনেক জায়গায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শুভ। সকালে রাস্তায় পরে থাকতে দেখে কয়েকজন মিলে বাসায় দিয়ে যায় তাঁকে।
কে এমন করেছে? কি তাঁর উদ্দেশ্য আর আমার সাথে কার এমন শত্রুরা থাকতে পারে? এমন হাজারটা প্রশ্ন নিজেকে করেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না শুভ। তবে যেদিন তাঁকে পাবে সেদিন তার শাস্তিটা কতটা ভয়ানক হবে সেটা ভেবেই ভেতরে ভেতরে এক পৈশাচিক আনন্দ পেলো শুভ।
.
.
.
রাত ৩ টা।
কালো একটা চাঁদর গায়ে জড়িয়ে শুভর বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরে ফাহাদ। বাসার বর্ণনা আগেই আরোহীর থেকে নিয়ে সেই অনুযায়ী সবটা প্লান করে রেখেছে সে। বাসার ভিতরে ঢোকা অনেকটাই সহজ শুধু পথিমধ্যে বাঁধা হিসেবে আছে দারোয়ান। আর দারোয়ানকে কাবু করার ব্যবস্থাও ফাহাদ করে রেখেছে।
সিদ্দিক আগের থেকে গিয়েই শুভর বাসার দারোয়ানের সাথে ভাব জমিয়ে নিলো। পাশের আরেক বাসার বুয়ার কথা নিয়ে আলোচনা বেশ জমিয়ে তুলেছে। এক পর্যায়ে সিদ্দিক শুভর বাসার দারোয়ানকে সিগারেট অফার করলে সে ও না করে না। ফাহাদের প্লান অনুযায়ী বেশ চালাকির সাথে হাঁটতে হাঁটতে সেই বুয়াকে নিয়ে নানারকম খোশ আলাপ করতে করতে শুভর বাসার দারোয়ানকে নিয়ে একটু দূরে এগিয়ে যায় দুজনেই। সেই সুযোগে দেয়াল টপকে বাসায় ঢুকে পরে ফাহাদ।
আরোহীর কাছ থেকে আগেই শুনেছিল আরোহী যে রুমটায় থাকতো তার পাশের রুমে জানালার গ্রিল ছিলো না, থাই গ্লাসটার লকটাও নষ্ট ছিলো। ঠিক করবে করবে বলে এইসব ঝামেলার মধ্যে কাউকে বাসায় আনতে সাহস পায়নি তারা।
ফাহাদ সেই অনুযায়ী পাইপ বেয়ে দোতালার রুমটায় ঢুকে যায়। দরজা খোলার টেকনিক তার আগের থেকেই জানা তাই বেশি চাপ ও নিতে হয়নি তার।
দরজা খুলেই ফাহাদ সবকটা রুমের দরজার নিচ দিয়ে বেশ কড়া মাত্রার ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে নেয়।নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। যারা ঘুমাচ্ছে তারা আরো বেশ কয়েকঘন্টা অজ্ঞান হয়ে থাকবে। কোনো চাপ নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করতে হবে না। নিশ্চিন্তে ঠান্ডা মাথায় কাজ শুরু করে ফাহাদ।
রোজার রুমে প্রবেশ করে সবকিছু খুঁটে খুঁটে দেখতে শুরু করে সে।
হঠাৎ করেই ড্রেসিং টেবিলের নিচে এক কোণে চোখ চলে যায় তার।
একটা খোলা ঔষধের বড়ি পরে আছে। তুলে নিয়ে ফাহাদ সেটাকে নিজের কাছে রেখে দেয় । ঔষধ গুলো এখানে পাওয়া মানে ঔষধের প্যাকেট টা রুমে কোথাও অথবা রোজার রুমের জানালা দিয়েই ফেলা হবে।
ফাহাদ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও কোনো ঔষধের প্যাকেট পায় না। আরও সন্দেহজনক কিছু প্রমাণ নিয়ে জানালার পাইপ বেয়ে নিচে নেমে আসে সে। গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে দারোয়ান এখনো ফেরেনি। গঞ্জিকার নেশায় হয়ত বুঁদ হয়ে আছে সিদ্দিকের সাথে। রোজার রুমের জানালা বরাবর নিচে গিয়ে ঔষধের প্যাকেটটা খুঁজেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ায় সে আর রিস্ক নিতে চায় না। তাড়াতাড়ি শুভর বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে, সিদ্দিককে মেসেজ করে জানিয়ে দেয়,কাজ কম্পলিট
.
.
.
সকাল ১০ টা।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত আজও ব্রাশ করতে করতে ফাহাদ গার্ডেনের দিকে যায়।
গার্ডেন এ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় একটা প্যাকেটের উপর।
প্যাকেটটি তুলে হাতে নিতেই কি যেন ভেবে
ফাহাদ প্যাকেটটি নিয়ে দ্রুত রুমে চলে আসে।
রাতে শুভর বাসা থেকে পাওয়া ঔষধের সাথে সাথে মিলিয়ে বুঝতে পারে প্যাকেটটি ওই ঔষধেরই। নিজেদের গার্ডেনে এই ঔষধের প্যাকেট কিভাবে আসলো তা ভেবে অবাক হয় ফাহাদ।
তার জানামতে এমন ঔষধ তার বাসার কেউ ই খায় না তাহলে এই প্যাকেটকি এখানে আসলো কি করে?
গভীর চিন্তায় পরে যায় ফাহাদ। তার মন বলছে এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় এর ভিতরে রয়েছে এক বিরাট যোগসূত্র সবার আগে সেই যোগসূত্রটাই ওর খুঁজে বের করতে হবে।
.
.
“বস, বস” বলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সিদ্দিকের প্রবেশ।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই “সকাল থেকে শুভকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বস। রাতে না-কি সে নিজের রুমেই ছিলো। সবার সাথে শেষ দেখা রাতেই হয়েছিল সকালে ডাকতে গিয়ে দেখলো শুভ লাপাত্তা। শুভর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে বস?”
এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে আবার হাঁপাতে লাগলো সিদ্দিক। এতো প্রশ্ন করেও ফাহাদের থেকে কোনো উত্তর পেলো না সিদ্দিক শুধু দেখতে পেলো ফাহাদের ঠোঁটের কোনে এক বাঁকা হাসি…
.
.
.
চলবে…
লেখিকাঃ মিমি সুলতানা

#বৈধ_ধর্ষণ
#মিমি_সুলতানা

পর্ব-৯
—————
“বস, বস” বলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সিদ্দিকের প্রবেশ।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই “সকাল থেকে শুভকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বস। রাতে না-কি সে নিজের রুমেই ছিলো। সবার সাথে শেষ দেখা রাতেই হয়েছিল সকালে ডাকতে গিয়ে দেখলো শুভ লাপাত্তা। শুভর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে বস?”
এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে আবার হাঁপাতে লাগলো সিদ্দিক। এতো প্রশ্ন করেও ফাহাদের থেকে কোনো উত্তর পেলো না সিদ্দিক শুধু দেখতে পেলো ফাহাদের ঠোঁটের কোনে এক বাঁকা হাসি…
.
.
শুভর আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আরোহীও চিন্তায় পরে যায়।
ফাহাদকে কল করে তার সাথে দেখা করতে বললে, কিছুক্ষণ পরে ফাহাদ আর আরোহী দেখা করে।
ফাহাদের কাছে শুভর ব্যপারে প্রশ্ন করে তেমন কোনো উত্তর পায় না আরোহী। পাশাপাশি দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ করে ফাহাদের ফোনটা বেজে উঠে।
ফাহাদ ফোনটা রিসিভ করেই “হ্যা,সোনা বলো” বলে একটু পাশে সরে যায়।
কথাটা শুনেই আরোহীর কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে।ফাহাদ কাকে “সোনা” বলছে ? তাহলে কি ও নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে? নিজেকে এমন অনেকগুলো প্রশ্ন করে, নিশ্চুপ একটা কষ্টে ভিতরে ভিতরে পুড়তে থাকে।
কথা বলা শেষে ফাহাদ এগিয়ে এলে প্রশ্ন করে বসে আরোহী,
-কে কল করেছিলো?
ফাহাদের থেকো কোনো উত্তর না পেয়ে চিল্লিয়ে প্রশ্নটা আবার করে আরোহী।
“কে কল করেছিলো সেটা তোমাকে কেন বলতে হবে? আমাকে কি কেউ কল করতে পারে না! নিজের সীমার কথাটা ভুলে যেওনা। “আমি তোমার কাছে জবাবদিহি করতে বাঁধ্য নই” কথাটা বলেই ফাহাদ উঠে চলে গেলো।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না আরোহী। এই ফাহাদ যে তার কাছে একেবারেই অচেনা। ও যে ফাহাদ কে চিনত সে তো সর্বক্ষণ “রুহী,রুহী” বলে মাতিয়ে রাখতো। রুহী ই ছিলো তার পৃথিবী। সেই ফাহাদ আর এই ফাহাদের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ফাহাদের ভিতরে এই অদ্ভুত পরিবর্তন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না আরোহী। কান্না করতে করতে বাসার দিকে রওনা হলো সে।
.
.
.
রুমে বসে সংগ্রহ করা প্রমাণগুলো খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো ফাহাদ। সবচেয়ে রহস্যময় লাগছে ঔষধের প্যাকেটটি তাদের গার্ডেন এ পাওয়ার বিষয়টা। আসল অপরাধী খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে পুরোটা প্লান। প্রথমে রোজাকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে নাম দিলো আত্মহত্যা। আরশী সেটা বুঝতে পেরে প্রমাণ সংগ্রহ করতে গেলে তার নিজেরই বোন আরোহীর বিরুদ্ধে এমনভাবে সব প্রমাণ সাজিয়ে রাখলো যার জন্য আরশী বাঁধ্য হলো তাঁকে সন্দেহ করতে। যদিও পরে সবটা বুঝতে পেরেছিলো আরশী কিন্তু ইভাদের মৃত্যু নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েই গেলো ফাহাদের মনে। আরশীকে সেদিন কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি ফাহাদ। তাই সে একবার আরশীর সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করে নেয়।
.
.
.
.
টানা দুই ঘন্টা ধরে সমানে কান্না করেই চলেছে আরোহী। সবকিছু তার কাছে মূল্যহীন মনে হচ্ছে। ফাহাদ নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে। এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। নিজেকে আজ নিঃস্ব মনে হচ্ছে আরোহীর। হাজার কষ্ট মেনে নেওয়া মানুষটাও অনেক সময় ভালোবাসার মানুষের অবহেলার কাছে দূর্বল হয়ে পরে। ভালোবাসার মানুষের অবহেলার মোকাবেলা করার ক্ষমতা সবার থাকে না যেমন টা আরোহীর ও নেই। আরোহী নিজের এমন জীবনকে মেনে নিতে চাচ্ছে না। দৌড়ে সে বাথরুমে চলে গেলো। হাতের কাছে হারপিকের বোতল পেয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলো।
.
.
.
আরশীর সাথে দেখা করবে বলে ফাহাদ রেডি হতে থাকে ঠিক এমন সময়েই তার কাছে খবর আসে আরোহী হাসপাতালে ভর্তি। দেরি না করেই দ্রুত রওনা হয় হাসপাতালের দিকে।
হাসপাতালে পৌঁছেই আরোহীর কাছে চলে যায় ফাহাদ। তাকে ওয়াশ করানো হয়েছে। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসাতে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গিয়েছে। আরোহী ফাহাদের দিকে তাকাতেই কেঁপে ওঠে। তার সামনে সুন্দরী একটা মেয়েকে নিয়ে ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে । আরোহী তাকাতেই “কেমন আছো এখন ” প্রশ্ন করলো ফাহাদ। আরোহী কিছু না বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
তোমার সাথে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো না ও লাইসা। আমার বর্তমান। “লাইসা? এ হলো আরোহী, আমার প্রাক্তন।
প্রাক্তন কথাটা শুনে আরোহীর পৃথিবীটা পুরো অন্ধকার হয়ে গেলো। ফাহাদ তাঁকে প্রাক্তন বলে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এটা সে মেনে নিতে চাচ্ছে না। কেন করছে ও এমন! কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না আরোহী। এমন কিছু শোনার থেকে মৃত্যু কষ্ট সহ্য করাটা হয়ত বেশি সহজ হতো বলে আরোহীর ধারণা।
এর মাঝেই হঠাৎ করে জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো আরোহীর মা। ফাহাদ এগিয়ে গিয়ে যা শুনলো সেটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।
কি হয়েছে বার বার প্রশ্ন করেও কারও মুখ থেকে একটি শব্দ ও পাচ্ছে না আরোহী।
অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজেও উঠে যেতেও পারছে না।
তবে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছে সে। একজন নার্সকে ডেকে বেশ অনুরোধ করে জিজ্ঞেস করে আরোহী জানতে পারলো তার বাবা আর পৃথিবীতে নেই।
হঠাৎ করেই আরশীর জেলে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকেই শারীরিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে শুরু করে।
এরপর আরোহী এমন একটা কান্ড ঘটানোর পরে সবকিছুর প্রেসার আর নিতে পারেনি ওদের বাবা।
.
.
.
অন্ধকার কুঠুরিতে বসে নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত হওয়া নিজের ভাগ্যকে নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ করে জেলার সাহেব এসে আমাকে জানালেন আমার বাবা আর বেঁচে নেই।ছোট বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বাবা মারা গিয়েছে, বাবার জন্য আমার এতকিছু করা, নিজের ভালোবাসা ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করা। নিজেকে ধ্বংসের হাতে তুলে দেওয়া।এমন সময়ে বাবার এভাবে চলে যাওয়া, এটা যেন নিয়তির ভয়ংকর একরুপের সাথে সাক্ষাৎ। এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগী একটা মেয়ে মনে হচ্ছে।
যা হচ্ছে সবকিছুর পেছনে আমি দায়ী। অবশ্য আমি না, আমার মা দায়ী। সে ই শুভর সাথে আমাকে জোড় করে বিয়ে দিয়েছিল।একটা বিয়েতে নষ্ট হয়ে গেল বেশ কয়েকটা জীবন।
.
.
.
এক মেয়ে জেলে অন্য মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ে ফিরলো, নিজের স্বামীর মৃত্যু সবটা এক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে আরশীর মা রেহানা বেগমের।
নিজেকে আজ অনেক স্বার্থপর মনে হচ্ছে তার। স্বামীর ভালোর জন্য আর সাচ্ছন্দ্য একটা জীবনের লোভে নিজের মেয়েকে অভিশপ্ত একটা জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো সে। দিনের পর দিন আরশীর উপর হওয়া অত্যাচারের কথা জেনেও “মেয়েদের একটু মানিয়ে চলতে হয়” বলে সবটা এড়িয়ে যাওয়া,এক মেয়ের উপর হওয়া অত্যাচার আটকাতে নিজেরই আরেক মেয়ের সম্মান বিসর্জন সবটা যেন তারই পাপের কর্মফল।
নিজেদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে মেয়েদের এতো বড় বড় সমস্যা গুলো দেখেও পাশ কেটে যাওয়ার কারণেই আজ সে স্বর্বহারা। যেমন চলছিলো ভালোই তো চলছিলো। সাময়িক কিছু টাকার লোভ অন্ধ করে দিয়েছিলো তাঁকে।
এসব ভেবে আরো ভেঙে পরলেন রেহানা বেগম।
.
.
.
.
মা’কে কি বলে স্বান্তনা দেবে আরোহী ভেবে পাচ্ছে না। পুরো সংসার একটা বিষন্নতার ঘাঁটিতে রুপান্তর হয়েছে। এসময় আরশীকে খুব প্রয়োজন তার। আরশীর মতো কেউ পরিবারটাকে সুন্দর করে সামলাতে পারে না। কিন্তু সে জানে এটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব না।
.
.
পুরো বাসায় মানুষের আনাগোনা।
রেহানা বেগম খুব ভেঙে পড়েছেন। সবাই তাকে স্বান্তনা দিতে ব্যস্ত। ফাহাদ আরোহীদের বাসার সামনে একটা চেয়ারে বসে কিছু একটা নিয়ে গম্ভীর হয়ে ভাবছিল। হঠাৎ করে কালো চাদরে ঢাকা একটা লোকের দিকে চোখ পড়ে তার। এই গরমে ওভাবে কালো চাঁদরে আবদ্ধ হয়ে থাকার অর্থ সে নিজেকে আড়াল করতে চায়। কিন্তু কেন সে নিজেকে আড়াল করতে চাচ্ছে! ব্যাপারটা খুবই সন্দেহজনক।
ফাহাদ চেয়ার ছেড়ে লোকটির দিকে আগাতেই লোকটিও ফাহাদের দিকে আগাতে শুরু করল।
এক পর্যায়ে চাদরের আড়ালে থাকা লোকটি হঠাৎ করেই এক হাতে চাকু বের করে ফাহাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
ফাহাদ একটু পাশে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। হাতে চাকু থাকা লোকটির চোয়াল বরাবর একটা জোড়ালো ঘুষি মারতেই লোকটা উল্টে পড়ে যায়। ফাহাদ তাকে ধরার জন্য আগাতেই সাথে সাথে লোকটি দৌড়ে একটা বাইকে উঠে চলে যায়। ওখানে একজন বাইক নিয়ে আগেই অপেক্ষা করছিলো।

গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলো ফাহাদ। কারণ লোকটিকে ফাহাদ চেনে। এবং খুব ভালোভাবে চেনে। ফাহাদের সন্দেহ সত্যি হলে সেটা ফাহাদের নিজের জন্য ও অনেক ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।
আরোহীর বাবার লাশ গোরস্থানে কবর দিতে নেওয়ার জন্য সবার সাথে পায়ে পা মিলালো ফাহাদ।
.
.
.
চলবে…..

লেখিকা – মিমি সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here