বোবা বর,দ্বিতীয় পর্ব
লেখা :মরিয়ম খাতুন হাওয়া
শ্বশুর সাহেব হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন আজ। বাড়িতে অনেক আত্নীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর সমাগম । সবমিলিয়ে ভালোই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি।
এ বাড়ির সবাই অনেক ভালো, সবার সাথে অল্প সময়ে বেশ ভাব হয়েছে আমার। শুধু ওই লোকটাকেই এখন পর্যন্ত সহ্য করতে পারছি না যদিও এ কয়দিন হাসপাতালে বেশির ভাগ সময় বাবার সাথে ছিলো।
এবার বাড়িতে গেলে আর আসবো না আমি, তাতে যা হবার হবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।
এখন শুধু অপেক্ষা কখন বাড়িতে যেতে পারবো, কিন্তু হঠাৎ শ্বশুরের অসুস্থতার জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কবে যে আর বাড়িতে যেতে পারবো আমি ।
এইকয়দিন আমি পিউ আর আশা আপু একসঙ্গে ছিলাম। ছোট ভাইয়া, মা আর লোকটা হাসপাতালে ছিলো। ছোট দেবর বাড়িতেই ছিলো।
আজ রাতে লোকটা আমার পাশে শোয়াতে আমি উঠে ফ্লোরে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। ওনার বাড়ি ওনার ঘর উনি থাকুক খাটের উপর, তাছাড়া এইকয়দিন হাসপাতালে ঠিকমতো ঘুম হয়নি লোকটার শ্বাশুড়ি মা বলছিলেন।
সকালে উঠে দেখি লোকটাও রুমের অন্য পাশে ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে, কি নিষ্পাপ লাগছে ঘুমন্ত মুখটা লোকটার মনে হয় সারাজীবন চেয়ে থাকি।
ছি, আমি কেনো এই লোকটাকে দেখছি ওনার জন্য আমি আমার রবিকে হারালাম, ওনার জন্যই রবি আমার সাথে কথা বলে না এখন। আর সেই আমি কিনা,
ঘৃণা করি আমি লোকটাকে অনেক ঘৃণা করি। এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে রান্নাঘরে যাই আপুকে সাহায্য করার জন্য।
সকালের নাস্তা করে, যে যার অফিসে চলে যায়। একি লোকটাও কোট, টাই পড়ে হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন। শ্বাশুড়ি মা বলেন — বাবা আজ অফিসে না গেলে হয়না, বউমা তো নতুন মানুষ তাকে তোর সময় দেওয়া উচিত।
লোকটা মা কে কি যেনো বলে বেড়িয়ে গেলেন, যাওয়ার সময় মা তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে বলেন।
বোবা একটা লোকেরো অফিস আছে, আমি ভাবছি।সারাদিন সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে থাকলেও একটা কথাই ভাবি কিভাবে লোকটাকে হেনস্তা করা যাবে।
আপু সহ দুপুরের খাবার রান্না করি, আর মা সবসময় বাবার পাশেই থাকেন।
লোকটাও দুপুরের খাবার খেতে আসে, খাওয়া শেষে রুমে যায় বিশ্রাম করার জন্য। আশা আপু আমাকেও জোর করে রুমে পাঠায়, রুমে যাওয়ার পর আয়নার পাশে কিছু বেলি ফুল দেখতে পাই।
বেলি ফুলতো আমার পছন্দের অনেক, ফুল দেখে আনন্দিত হয়ে হাতে নিলাম, তখন লোকটা ইশারায় ফুলটা মাথার খোঁপাতে গেঁথে নিতে বললেন।
আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফুলটা হাত দিয়ে ছিড়ে কুটি কুটি করলাম লোকটার সামনেই।
খোঁপায় বাঁধবো না আমি ওই লোকটার আনা বেলি ফুলের মালা। আজ কেন, আমি আর জীবনে কখনো খোঁপায় বেলীফুলের মালা বাঁধবো না।
লোকটা তবুও আমার দিকে চেয়ে আছে, সত্যি লজ্জা বলতে কিচ্ছু নাই লোকটার। ফুলের মালাটা সামনেই ছিড়ে এতো অপমান করলাম, তারপরেও যদি একটু ওনার আত্মসম্মানে লাগতো।
সহ্য করতে পারছি না লোকটার তাকানোটা,
রুম থেকে বের হয়ে ছাঁদে গেলাম। ছাঁদে লাগানো বাগানে অনেক রঙ্গের ফুল ফুটে আছে, ফুল গুলো দেখে আমার সেই ফুলের গাছ হতে ইচ্ছে করছে।
আমি যদি ফুলের গাছ হতাম তাহলেই আর এই লোকটাকে বিয়ে করতে হতো না। ছাঁদে অতিরিক্ত রোদ থাকা স্বত্বেও চেয়ারে পা তুলে আয়েশ করে বসে কোন ফুলের কি রং, কার আকৃতি কেমন তা মনোযোগ দিয়ে দেখছি। মাঝে মধ্যে কোথা হতে যেনো ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছিল, রোদের তাপ ও কমে যাচ্ছে
সবমিলিয়ে মনোরম একটা পরিবেশ ভালোই লাগছে আমার।
আজ আর ছাঁদ থেকে রুমে যাবো না আমি, ফুল গুলোর সাথেই সময় কাটাবো আর ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করবো ভাবছি । বিকেল হয়ে গেছে, আছরের আযান শুনা যাচ্ছে পাশের মসজিদ থেকে।
কিছুক্ষণ পর লোকটা সেখানে উপস্থিত হয়ে ক্যাবলার মতো একটা হাসি দিয়ে ঈশারায় বোঝালেন এই ফুলের বাগানটা তার নিজের হাতে গড়া।
আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে আছি।
আমার মুখটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে লোকটার জন্য ভালোই ছিলাম এতোক্ষণ, লোকটা এসে আমার মুডটাই নষ্ট করে দিলো।
লোকটা পানি দিচ্ছেন ফুলের গাছগুলোতে অনেক খুশি মনে, আমি ওনার জন্য ছাঁদ থেকে নেমে আসলাম।
শ্বাশুড়ি মা — আশা, তোমার ভাবি কে চা করে দাও ছাঁদে তোমার ভাইয়ার জন্য নিয়ে যাবে । বিকেলের চা’ তো তোমার ভাইয়া ছাঁদে বসেই খায়।
আমি — আপু আমি চা করে নিয়ে যাচ্ছি ওনার জন্য, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। সরাটাদিন কতো পরিশ্রম করেন আপনি।
আশা আপু — ঠিক আছে কিন্তু ভাইয়া একবারে ঠান্ডা চা খান আর চায়ে চিনি বেশি লাগে।
আমি — ঠিক আছে আমি করে নিবো আপু, বলে চা অনেক গরম করলাম আর চিনির বদলে একটু ডিটারজেন্ট পাউডার এর গুড়া মিক্স করছি।
ছাঁদে চা নিয়ে গেলাম লোকটার জন্য, লোকটা চেয়ারে বসে আছে। আমি পাশে গিয়ে হাসি মুখে চা ওনার সামনে এগিয়ে দিলাম।
লোকটাও খুশি মনে চায়ের কাপে এ মুখ লাগালো আর সাথে সাথে আআআআআ করে হালকা চিৎকার করলো, অসাবধানতার কারনে সব চা ওনার পায়ে পড়াতে পানির বালতিতে পা চুবালেন।
আমি এবার আশেপাশে কেউ নেই জন্য মুচকি হাসতে লাগলাম। লোকটা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এমন কাজ ইচ্ছে করেই করেছি আমি, মাথা নিচু করে বিষন্ন মনে বসে থাকেন।
আমি চায়ের কাপটা তুলে সেখান থেকে চলে আসলাম। জিহ্বা পুড়ে যাওয়ার জন্য সেদিন রাতে লোকটা আর কিছু খেতে পারলো না, না খেয়েই শুয়ে পড়লো।
আজো লোকটা বেলি ফুলের মালা এনে রাখছেন আয়নার পাশে। আজ না ছিড়ে এমনিতেই লোকটার সামনে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম।
রাতে আবার অনেক চকলেট, চিপ্সের প্যাকেট এনে আমার বালিশের পাশে রাখছে।
খেতে ইচ্ছে করলেও খেলাম না।
ফ্লোরে শুয়ে ঘুমায় পড়লাম, একটা স্বপ্ন দেখে হঠাৎ মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার তখন দেখলাম লোকটা চার্জার লাইটের আলোয় কি যেনো লিখছে আর কাঁদছে। লোকটাকে দেখে আমার মনে একটু মায়া হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে পিউ রুমে আসলে, লোকটার সামনে সব চকলেট আর চিপ্সের প্যাকেট বের করে পিউ কে দিলাম। পিউ খুশি হয়ে, প্রথমে লোকটার গালে তারপর আমার গালে আদর দিলো।
পিউ এর কান্ড দেখে লোকটা মুচকি হাসছে, আর আমার নিজের গালটাই ছিলে ফেলতে মন চাচ্ছিলো।
পিউ কে কোলে তুলে বাইরে বেড়িয়ে আসলাম।
আজ কলেজে আমার অনার্স প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে যাবো আমি, শ্বাশুড়ি মা লোকটার সঙ্গে আমায় কলেজে পাঠালেন, যা আমি একদম চাই নি।
কলেজের কাজ শেষ করে, একটা পার্কের সামনে গাড়ি থামলো লোকটা।
কিন্তু আমি গাড়ি থেকে নামলাম না। লোকটা তখন আমার দিকে তাকাচ্ছিলো, বললাম বাড়িতে যাবো আমি । আবার সেখান থেকে ফিরে বাড়িতে আসলাম।
এক সপ্তাহ কেটে গেছে এভাবে লোকটা প্রতি দিন বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসে আর আমি ফেলে দিই। আজ আয়নার পাশে বেলি ফুলের মালা না দেখে মনটা কেমন করে উঠলো। পিছন ফিরে দেখলাম লোকটা হাত দিয়ে আমার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিচ্ছে। এক ঝটকায় হাত সরায় দিলাম, লোকটা কষ্ট পেলেও কিছু বললো না।
এতোকিছুর পরেও রাতে একটা নীল রঙের শাড়ী আর চুড়ি এনে আমার হাতে দিলো, সাথে সাথে আমি শাড়ি, চুড়ি লোকটার হাতে দিয়ে বললাম লাগবে না আমার এসব। লোকটা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইলো আবার আমার দিকে।
বাবা এখন পুরোপুরি সুস্থ, কিন্তু আরো কিছু দিন বিশ্রাম নিতে হবে। তাই লোকটার উপর কাজের চাপ বেশি শুনলাম।
বড় ননদ এর কাছে বাড়ির সবাই আজ সকালে বেড়াতে গেছে হয়তো দুই এক দিন থাকবে সেখানে।
লোকটার অফিসের জন্য যেতে পারেনি সেই সাথে আমিও বাড়িতেই আছি।
ছোট মেয়েটা সহ রান্নার কাজ শেষ করে দুপুরে খেয়ে নিলাম, আর মেয়েটাকে ঘুমাতে বললাম।
আধাঘন্টা পরে লোকটা বাড়িতে আসে, ফ্রেশ হয়ে খাবারের টেবিলে গিয়ে বসে খাওয়ার জন্য প্লেট কাছে নিলো। কিন্তু সব খাবারের বাটি ফাঁকা ছিলো, তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় লোকটা আমি দুর থেকে দেখছি এসব।
রান্নাঘরেও কোনো খাবার না পেয়ে তিন গ্লাস পানি দ্রুত পান করে চেয়ারে বসে রইলো সেখানে লোকটা। সব খাবার আমি আগেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম যাতে লোকটা খেতে না পারে।
রুমে আসলাম, লোকটার ফ্লোরে ঘুমানোর বিছানা, বালিশ অগোছালো হয়ে আছে। সেগুলো গুছানোর সময় একটা ডাইরি পাই।
কারো ব্যক্তিগত ডাইরি পড়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না কখনো, কিন্তু আজ লোকটার লেখা ডাইরি পড়ার আগ্রহ যেনো আমায় গ্রাস করে বসলো।
ডাইরির প্রথম পাতা খুললাম,
আমি মুরাদ আহমেদ।
জন্মসাল : ১৯৮৪
লোকটার নাম তাহলে মুরাদ,,,,,,
( চলবে)
(ভুল ক্রটি মার্জনীয়)