ব্যস্ত_শহর_আজ_নিরবতায়,প্রথমাংশ

0
1370

#ব্যস্ত_শহর_আজ_নিরবতায়,প্রথমাংশ
#মাইশাতুল_মিহির

হাসবেন্ডের কাছ থেকে ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে স্বব্ধ হয়ে গেলো নিঝুম। মৌনতার সঙ্গে ধীর পায়ের কদম ফেলে রুমে চলে আসলো। নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। ভালোবাসা মিথ্যে। সম্পর্ক নামক ভেড়াজালে কেউ আবদ্ধ থাকতে চায়না। কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সন্তান জন্ম দিতে না পারার ব্যর্থতায় আজ এগারো বছরের সম্পর্কের ফাটল ধরলো। হাতে থাকা সদ্য চকচকে সাদা কাগজটার দিকে তাকালো নিঝুম। তুরান এতো সহজে সাইন করে দিলো? কিভাবে পারলো তুরান? শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দিতে না পারায় তাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো? চোখ দুটো অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে আছে নিঝুনের। পানি শূন্যতায় আছে চোখ দুটো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আজ সে কাঁদছে না। নিষ্ঠুর দুনিয়ার এই লীলাখেলায় আজ তার কান্না পাচ্ছে না। কাঁদবে না সে। একদম না। ডিভোর্স পেপার টা নীল চাদড় মোড়ানো বিছানার উপর স্বযত্নে রাখলো। বুক চিঁড়ে চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসলো তার। ইয়া খোদা! ইয়া গাফুরুর রাহিম! তোমার দরবারে কি এতোই অভাব ছিলো? একটা রত্ন আমার কোলে দিতে পারলে না? কি এমন মহাপাপ করেছিলাম যার শাস্তির ফলস্বরুপ আমায় এতো কঠিন শাস্তি দিচ্ছো তুমি? বিচ্ছেদের এই দিন দেখার আগে আমার ম’র’ণ দিলে না কেন? আঁখি যুগল বন্ধ করতেই এক ফোটা তপ্ত জলের কণা গাল দিয়ে বেয়ে পরলো। আজ যদি অন্যান্য নারীদের মতো সন্তার প্রশব করার মতো ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়তো সেও আটপাঁচজন নারীর মতো সুখে দাম্পত্যজীবন পার করতো। তুরান-ও হয়তো তার উপর ক্ষুব্ধ হতো না। আর না সম্পর্কে তিক্ততা আসতো। সম্পূর্ণ দোষ তার। সে ব্যর্থ নারী। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার তার নেই। তুরানের সাথে বিচ্ছেদের পর মরার মতো দূর্ভাগ্য সে চায়না। সম্পর্কে থেকেই মরতে চায় সে। ধীর পায়ে স্টাডি টেবিলের কাছে আসলো নিঝুম। বিভিন্ন রকমের জনরা সম্মিলিত টেবিল-খানা সাজানো। তুরান খুব বইপ্রেমী। কলেজ থাকাকালীন সময় থেকেই দেখে আসছে নিঝুম। বিয়ের আগে এতোটাও ধারনা ছিলো না। কিন্তু বিয়ের পর জানতে পেরেছে এই ছেলে ঠিক কি পরিমানের বই পড়তে ভালোবাসে। ভাবতেই ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটে এলো তার। মনে পরে গেলো স্কুল জীবনের কথা।

নিঝুম আর তুরানের প্রেমকাহিনী স্কুল জীবন থেকেই। নিঝুম যখন ক্লাস টেইনে পড়তো তুরান তখন কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে। একবার বিকেলের শেষভাগ সময়ে প্রাইভেট শেষে বাড়ি ফিরছিলো নিঝুম। হাতে তার দুইটা বই। পরনে লাল কুর্তি। রাস্তাটা ছিলো নির্জন। দুইপাশে কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছ। পিচ ঢালা রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল গুলো বিছিয়ে পরে আছে। গুটিগুটি পায়ের কদম ফেলে হাঁটছে নিঝুম। তখুনি তুরান নামক এক সুদর্শন তরুণ এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ভরকে গেলো নিঝুম। তুরান খুব নার্ভাস ছিলো তখন। শুকনো ঢুক গিলে তুরান পিছু ফিরে তাকালো। গাছের আড়ালে থাকা বন্ধু নামক দুইজন ছেলে তাকে ইশারা করলো বলার জন্য। নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো তুরান। হাল্কা কেশে গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করলো। বলার জন্য উদ্বেগ নিলেই তার আগে নিঝুম বলে উঠলো, ‘রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন ভাইয়া?’

ভাইয়া ডাক শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো তুরান। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো নিঝুমের দিকে। যেই মেয়েকে প্রেমিকা বানাতে আসলো, সেই মেয়ে তাকে ভাইয়া ডেকে দিল। মানা যায় বিষয়টা? কেমন দৃষ্টিকটু। মুখ অন্ধকার হয়ে এলো তার। কপাল কুঁচকে বলল, ‘আমি তোমার কোনো জন্মের ভাই লাগি না। আমাকে ভাই বলে ডাকবে না।’

‘তাহলে কি বলে ডাকবো ভাইয়া?’ নিঝুমের সহজ সরল প্রশ্ন। বিস্মিত হলো তুরান। কি বলে ডাকবে বলে আবারো ভাইয়া ডেকে দিলো? সে কি এখানে ভাই ভাই ফিলিংস নিতে এসেছিলো? পাশ থেকে চাপা হাসির হাল্কা ঝাপসা শব্দ তার কানে আসলো। চোখ পাকিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকালো। দেখলো দুইজন পেটে হাত ধরে হাসছে। দাঁতে দাঁত পিষলো তুরান। একটু পর তোদের ব্যবস্থা করবো। ভাবতে ভাবতে নিঝুমের দিকে তাকালে দেখতে পায় নিঝুম তার দিকে প্রশ্নের উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। আলতো ভাবে হাসলো তুরান। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘আমি তোমার ভাই নয়, বরং জীবনসঙ্গী হতে চাই।’

‘কিন্তু জীবনসঙ্গী হতে তো এখনো অনেক দেড়ি।’

‘ততোদিন নাহয় প্রেমিক রূপে থেকে যাই?’

নিশ্চুপ রইলো নিঝুম নিস্প্রভ চোখের দৃষ্টি তার। তুরানের কথার ব্যাখ্যা বুঝে আসলো তার। লজ্জাভূতি হলো সে। গাল লাল হয়ে এলো। তুরানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি রাখলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লজ্জা নিভানোর চেষ্টা করলো।

অতঃপর প্রেমিক বানানোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো নিঝুম। শুরু হলো সকলের আড়ালে আবডালে নতুন এক প্রেমকাহিনী। তাদের সময়ে তখন সকলের হাতে হাতে মোবাইল ছিলো না। আর না ছিলো ভার্চুয়াল জগতের ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হুয়াট’স এপ। দেখা করার একমাত্র পথ ছিলো স্কুলে নিয়মিত আসা। হলোও তাই। নিয়মিত স্কুলে কলেজে আসতো দুজন। একই স্কুল কলেজ হওয়ায় সুবিধে হলো দিগুণ। ক্লাস শেষে এক পাশে বসে জমিয়ে আড্ডা দিতো দুজন। প্রাইভেট শেষে বাড়ি ফিরার রাস্তায় সঙ্গ দিতো তুরান। এক ক্লাস থেকে অপর ক্লাসের জানালা দিয়ে একেওপরের দিকে তাকিয়ে থাকার অনুভূতি টা ছিলো সুন্দর। নিঝুম এখন এই অনুভূতি টাই প্রচন্ড রকমের মিস করে। আজও তাই হলো প্রথম দিনের অনুভূতি টা প্রগাঢ়তা লাগে তার কাছে। দুনিয়ার সেরাহ্ অনুভূতি। প্রছন্ন হাসি দিলো নিঝুম। ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা গাঢ় নীল রঙের ডাইরী বের করলো। এই ডাইরী টা তুরানের দেওয়া। নিঝুম যখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছিলো তখন তুরান তাকে এই ডাইরী টা দিয়েছিল। অনেক যত্নে রেখেছে এই ডাইরী। আজও যত্নের তালিকা থেকে বাদ যায়নি। মুচকি হেসে প্রথম পাতা উল্টালো। দেখলো তুরানের লিখা কয়েকটা লাইন।

‘যখনই তোমাকে দেখি,
আবার নতুন করে প্রেমে পরতে ইচ্ছে করে।’

‘যদি বৃষ্টি হতাম তোমার দৃষ্টি ছুঁয়ে দিতাম,
চোখে জমা বিষাদ টুকু এক নিমিষেই ধুয়ে দিতাম,
মেঘলা বড়ন অঙ্গ জুড়ে, তুমি আমায় জড়িয়ে নিতে।
কষ্ট আর পারতো না তোমাকে অকারণে কষ্ট দিতে।’

হাসলো নিঝুম। চোখে জমে এলো বিন্দু বন্দু জলের কণা। সত্যি কি তুমি বৃষ্টি হয়ে এসে দৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে তুরান? ধুয়ে দিতে চোখে জমা বিষাদ গুলো? তাহলে আজ করছো না কেন? কেন বৃষ্টি হয়ে চোখের বিষাদ ধুয়ে দিচ্ছো না? বরঞ্চ নিজেই আমার চোখের বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়ালে। সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা নিয়ে আসলে? সত্যি কি আমার প্রতি ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে তোমার? এতো সহজে? সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখার জন্য কত কি না করেছি। শত দুঃখ, কষ্ট, পিড়া সহ্য করে সম্পর্ক এগিয়েছিলাম আমি। দিন শেষে কি মিললো? তীব্র যন্ত্রণাদায়ক বিচ্ছেদ! এতো কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না তুরান। বিশ্বাস করো আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তুমি সই করে দিলে কিভাবে? তোমার সাক্ষর দেখেই বুকের কলিজাটা ছিঁড়ে গেছে আমার। রক্তক্ষরণ হচ্ছে তীব্রভাবে। প্রমান করে দিলে দিন শেষে কেউ থাকে না। নিরবতায় ছেঁয়ে এলো এই ব্যস্ত শহরে। চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো তপ্ত কয়েক ফোটা নোনাজল। দুই হাতে চুল খামচে ধরলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নিঝুম। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। এই যন্ত্রনা আর সহ্য করার মতো নয়।

ডাইরীর নতুন পাতা বের করে ছিঁড়ে নিলো। কলম হাতে নিয়ে লিখে ফেললো সুইসাইড নোট। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। টেবিলের সামনেই কাগজটা রাখলো। তার উপর একটা কলমটা রাখলো যেন বাতাসে উড়ে না যায়। ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো নিঝুম। শরির তার জমে আছে। পা দুটো একদম অচল। চোখের পানি তার বাধ মানছে না। জোরপূর্বক শুকনো ঢুক গিললো একটা। ছোট ছোট পায়ের কদম ফেলে আলমারির সামনে আসলো। দরজা খুলে হাতিয়ে পুরনো শাড়িটা বের করলো। পুরনো হলেও শাড়ির রঙ একদম নতুন রয়েছে। খুব প্রিয় কিনা! শাড়িটা তুরান তার প্রথম মাসিক বেতনে কিনে দিয়েছে তাকে। রঙটা তার প্রিয়। হলুদ রঙ! শাড়িটা নিঝুমের হাতে দিয়ে তুরান বলেছিলো,

‘হলুদ রঙে হাজারো সৌন্দর্য রয়েছে। আগে উপলব্ধি করিনি। কিন্তু তোমাকে হলুদ শাড়িতে দেখার পর বুঝলাম তার সৌন্দর্য সূর্যমুখী ফুলের চেয়েও অধিক।’

অতীতের মোহনীয় মুহূর্ত গুলো আজ তিক্তকর হয়ে উঠেছে। ধূসর বর্ণ ধারন করেছে। স্বপ্নের শহর আজ ব্যস্ত নগরীর রূপ ধারণ করেছে। কেউ কোথাও ভালো নেই। শহরটাই বিষন্নতায় ভরে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিঝুম। শাড়িটা বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলো। এতোক্ষণে নিরবে কাঁদলেও এবার ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কেন তার জীবনটা এমন হলো? সবই ছিলো জীবনে। কিন্তু কোথায় না কোথায় নিঃসন্তানের শূন্যতা ছিলো মনে। ভালোবাসা উঠে গেছে হৃদয় থেকে। নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় বেঁচে থেকেই কি লাভ? চোখের পানি মুছলো। জুড়ে জুড়ে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। চোখ ফিরিয়ে তাকালো সিলিংয়ে ঝুলন্ত ফ্যানের দিকে। লম্বা দম ফেলে বিছানায় একটা চেয়ার রেখে নিজে উঠে দাঁড়ালো। শাড়িটা ফ্যানে বেধে নিজের গলায় বাধলো। পা থেকে চেয়ার ফেলার আগে মনে করে নিলো তুরানের মুখশ্রীর কথা। আজ সে চিরতরের মতো না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। তুরান তাকে ছাড়া থাকতে পারবে? নিশ্চয় পারবে। নাহলে সম্পর্কের এতো বছর পর কেউ বিচ্ছেদ চাইতো না। চোখ বন্ধ করে করে বাবা মা ও ছোট বোনের কথা মনে করলো একবার। এক এক করে সবার চেহারা চোখে ভাসিয়ে পা দিয়ে ঠেলে চেয়ার ফেলে দিলো। ক্যাচ করে ধ্বনি হলো সিলিং’এ ঝুলন্ত ফ্যানে। শরিরের সম্পূর্ণ ভর পরলো ফ্যানের মাঝে। বাতাসে প্রভাহমান বিষাক্ত নিশ্বাসের শব্দ। ভারী হয়ে এলো শ্বাসপ্রশ্বাস। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। জিভে পরলো কামড়। অদৃশ্য মায়া ত্যাগ করে চলে গেলো না ফেরার দেশে। পরে রইলো ডাইরীর পাতাটা। বাতাসের তপ্ত শ্বাসের পাশাপাশি শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো কালচে হয়ে আসা এক জোড়া চোখ। পরে রইলো বিছানার পাশের মিনি কেবিনেটের ফ্রেমে তুরান ও নিঝুমের হাস্যউজ্জল চেহারা। কলম চালানো সেই ডাইরী পরে রইলো টেবিলের এক কোণে। যার মাঝে নিঝুমের স্বযত্নে লিখেছে দুইটা লাইন। শব্দ গুলো বাকশূন্য হয়ে আছে। হয়তো দেহে তাদের প্রাণ থাকলে আটকাতো একটি প্রাণ। কিন্তু তারা ব্যর্থ। পারলো না কিছু। নির্বিকার ভাবে দেখে রইলো ঝুলন্ত লাশের দিকে।

‘আমার মৃত্যুর পর আমাকে ছুবেনা। সে অধিকার তুমি রাখোনি।’

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here