ভালবাসার_স্পর্শ পর্বঃ ০৬

0
670

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৬
লেখকঃ আবির খান

দেখলাম মায়ার চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এসেছে। সে আড়ালে মুছে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো,

~ আমি কাউকে ভালবেসে ঢাকাতে আসিনি। কিংবা আমার এখানে পরিচিত কেউই নেই। আপনাকে রাতে যা বলেছি সবই মিথ্যা ছিল। শুধুমাত্র আপনি যেন আমাকে একটু জায়গা দিন তাই মিথ্যাগুলো বলেছি।

মায়ার কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এই মেয়ে বললটা কি! তার কোন প্রেমিক নেই! সে আমাকে মিথ্যা বলেছে! তাহলে সত্যটা কি? আমি অবাক কণ্ঠে মায়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

– আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন! কেন? আর সত্যটা তাহলে কি? আমাকে সব খুলে বলুন।

মায়া অঝোরে কান্না করতে করতে বলে,

~ আমার আপন মা মারা গিয়েছে আমার বয়স যখন পনেরো বছর। মা মারা যাওয়ার ঠিক তিনমাস পরই বাবা আরেকটা বিয়ে করে। আমি তখন ছোট হলেও সব বুঝি। খুব অবাক হই সেদিন, যে কিভাবে বাবা মা মারা যাওয়ার মাত্র তিনমাসের মাথায় আরেকজনকে বিয়ে করে বাসায় আনে। আমার মায়ের গর্ভে শুধু আমি একাই ছিলাম। মাকে হারিয়ে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার সাজানো সুন্দর জীবনটা হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে যায়। কিন্তু যখন নতুন মা আসে বাবার উপর কিছুটা রাগ হলেও নতুন মায়ের ভালবাসা দেখে আমি আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছিলাম। কিন্তু যেই বিয়ের ছয়মাস পাড় হয় আপন মা আর সৎ মায়ের তফাৎটা আমি হারে হারে বুঝতে শুরু করি। আমার সৎ মা আর আমাকে কাছে ডাকে না, আমাকে খেতে বলে না, আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে না, আমি যদি নাও খেয়ে থাকি একটাবার এসে কোন খবরও নেয় না। একদিন খুব অসুস্থ হয়ে সারাদিন বিছানায় পড়েছিলাম। না বাবা না আমার সৎ মা আমাকে দেখতে এসেছিল। ভাগ্য ভালো সেদিন কোথা থেকে যেন ছোট মামা আমার প্রিয় ফল মানে লিচু নিয়ে আসছিল আমার কাছে। এসে দেখে আমার এই অবস্থা। সেদিন মামা যদি আমাকে হাসপাতালে না নিতো তাহলে হয়তো আপনার আজ এতটা সমস্যা হতো না। শুধু আপনার না আমার পরিবারও আমার বোঝা থেকে বেঁচে যেত। হাহা। যাইহোক, সেদিন থেকে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। আমি বুঝে যাই, যে আমার আপন মায়ের সাথে আমার আপন বাবাও চলে গিয়েছে। কারণ সৎ মা আমাকে সরাতে চাচ্ছিল। সেটা বাবা বুঝেও সৎ মাকে কিছু না বলে সেও উঠে পড়ে লাগে আমাকে ভাগানোর জন্য। মামা বাড়ি, নানা বাড়ি পালিয়ে পালিয়ে কোন রকম ইন্টারটা আমি পাশ করি। আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ আমার মামারাই দিত। কারণ আমার সৎ মা আমাকে বের করতে সক্ষম হয়েছে বাসা থেকে। বের করবেই বা না কেন, তার অনাগত সন্তান যেন বাবার সব সয়-সম্পত্তি পায় সে জন্যই আমাকে সরানো। আমি পালিয়ে পালিয়ে পাঁচটা বছর পাড় করি। কিন্তু এখন আর পারছিলাম না৷ বাবা আমাকে বাসায় বন্দি করে ফেলে। যাতে সে আর সৎ মা মিলে তাদের ঠিক করা এলাকার সবচেয়ে বড়ো গুন্ডাটার কাছে আমাকে বিক্রি করতে পারে। বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আমি তখনও ঘরে বন্দি। কিছুই জানিনা। আমাদের বাসায় সেই প্রথম থেকে কাজ করা একটা খালা ছিল। যে মায়ের সাথে থাকতো সবসময়। সে সবকিছু বুঝে তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। আবির সাহেব সে আর কি করেছে জানেন? তার জমানো ৩ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে বলেছে, মা তুই এখান থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যা। আর কোন দিন আসিস না। তুই যা মা। আমি রাত এগারোটার ট্রেনে উঠে সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছাই। আমি জানতাম ঢাকাতে হাতিরঝিল নামে সুন্দর একটা জায়গা আছে। তাই এখানে এসে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বসে থাকি। আমি কোন ফোন আনিনি। নাহলে ওরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে। রাত যত গভীর হতে থাকে আমি দিশাহীন হতে থাকি। খুব ভয় করছিল। কারণ অনেকেই আমার দিকে কেমন কেমন ভাবে জানি তাকাচ্ছিল। আমার খুব ভয় করছিল। তাও সাহস করে কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য অনেকবার ইশারা করি। কিন্তু কেউ গাড়ি থামায়নি। তাই আপনার বাইকের সামনেই চলে আসি আমি। আপনাকে দেখে কেমন জানি স্বস্তি পাই। তাই আমার এত বড়ো গল্প না বলে একটা মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলি যাতে আপনি আমাকে একটু সাহায্য করেন। কিন্তু আমি মোটেও ভাবিনি আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন বা খারাপ ভাববেন। আমি হতাশ হয়ে যাই যখন আপনি চলে যান৷ ঠিক করি এই পানিতে ঝাপ দিয়েই মায়ের কাছে চলে যাব৷ ঠিক তখনই আপনি আবার আসেন। আর তারপর তো সব আপনার জানাই। একটা গুন্ডার কাছে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ হওয়া থেকে বাঁচতেই এই অজানা ইটপাথরের শহরে চলে এসেছি। জানিনা সামনে কি আছে আমার কপালে। আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন। আসলে আমি চাইলে হয়তো আরও অনেকদিন আপনাকে এই মিথ্যা বলে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমার মনটা ভারী হয়ে আসছিল। আপনি খুব ভালো একটা মানুষ। তাই আজ সত্যিটা বলেই দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার যদি আমার এই সত্য শুনে আমাকে খারাপ মনে হয়, আপনি বলুন আমি এখনই চলে যাবো।

কথাগুলো শেষ করে মায়া ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। দুনিয়ায় এমন বাবা-মাও হতে পারে! তাহলে কি এই চাপা কষ্টের জন্যই মায়া এভাবে কেঁদে কেঁদে উঠছিল? মায়ার এই অপ্রিয় সত্য শুনে আমার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। আমি জানতাম বাবা-মার মতো আপন আর কেউ হয়না। সেই বাবা-মাই যে সন্তানের কাল হয়ে যাবে তা কল্পনাও করিনি। আমি এখন সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছি মায়া কতটা কষ্টে আছে। আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো। এই রাগটা মায়ার উপর নয়, তার পরিবারের উপর হচ্ছে। আমি দু’হাত দিয়ে আমার পুরো মুখটা একবার মুছে নিলাম। তারপর উঠে মায়ার কাছে গিয়ে তার সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরি। সে অবাক হয়ে কান্নাসিক্ত নয়নে আমার দিকে তাকায়। আমাদের দুজনের চোখ এখন সম্পূর্ণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এবার বলতে শুরু করি,

– প্রথমত আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে। এতকিছু না জেনেই কত খারাপ ব্যবহার করেছি আপনার সাথে। আপনার কোথাও যেতে হবে না৷ আপনার যতদিন ইচ্ছা আপনি এখানে থাকুন। আমি মাকে সব বুঝিয়ে বলবো। মা যদি আমার কথা নাও মানে আমি আপনাকে আলাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে দিব। আপনি সেখানে যতদিন খুশি থাকবেন। কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না প্রমিজ করছি।

মায়া মুচকি হাসে আর বলে,

~ পাগল হবেন না আবির সাহেব। আমার জীবনটা তো শেষ, যেদিন আমার আপন মা মারা গিয়েছে। আপনার মাকে আমার কথা বলে অযথা কষ্ট আর ঝামেলা দিতে হবে না। আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি। আপনার মা আসার আগেই আমি আবার আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবো। তবে তার আগে জীবনটা শেষবারের মতো করে বাঁচতে চাই। জানি আপনার কাছে কোন কিছু চাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। তবুও শেষবারের মতো একটা আবদার ভিক্ষা হিসেবে চাইবো। রাখবেন?
– বলুন।
~ আপনার শহরটা আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন আপনার বাইকে করে? আমি কখনো কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনি। আনন্দ কি জিনিস আমি ভুলেই গিয়েছি। তাই শেষবারের মতো এই আবদারটুকু রাখবেন আমার? আমি আর কিছুই চাইনা এই সাদাকালো জীবনে।
– আপনি যা বলবেন তাই আমি রাজি। কিন্তু আপনার কি ফিরে না গেলে হয়না? আমিই তো বলছি আপনাকে থাকতে।

মায়া হাত দুটো ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেস্ট রুমে যাওয়ার আগে বলে,

~ আপনি সবকিছু যতটা সহজ ভাবে নিচ্ছেন, এই সমাজ কখনো তা নিবেনা। আমি চাইনা আমার জন্য আপনার কোন সমস্যা হোক। আপনি আমার জীবনের শেষ আবদারটা পূরণ করুন আমি তাতেই খুশি। আমি তাতেই খুশি….

বলেই মায়া তার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বুঝলাম আমার সামনে সে আর কাঁদতে চাইছে না। আমি তার কথাগুলো শুনে কষ্টে নিথর হয়ে মাটিতেই বসে থাকি। তাকে কিছু বলার মতো আমার কাছে আর কিছুই নেই। আমি অনেকটা সময় ওভাবেই বসে থাকি। তারপর…

চলবে..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here