#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৯
লেখকঃ আবির খান
মায়া অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের রান্না আমি আজ প্রথম খাবো। জানিনা কেমন হবে। তাও আমি একটুকরো রুটি ছিড়ে ভাজি নিয়ে মুখে দিলাম। কিছুটা খাবার পরই মায়া খেয়াল করে আমার মুখটা কেমন জানি হয়ে এসেছে। মায়া এই দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট পায়। সে অসহায় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ ভালো হয়নি তাইনা? আমি জানতাম আমার দ্বারা রান্না হবে না৷ আমি কিছুই পারিনা।
আমি গম্ভীর কণ্ঠে তাকে বললাম,
– এ যে সম্পূর্ণ আমার মায়ের হাতের রান্না। আপনি শিখলেন কিভাবে? ওয়াও!
আমি ভীষণ অবাক হয়ে মজা করে খাচ্ছি। আর ওদিকে আমার কথা শুনে মায়া পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। সে ভেবেছে রান্না খুব খারাপ হয়েছে দেখে আমি ওরকম করেছি। কিন্তু আসল কাহানী হলো রান্নার স্বাদটা অনেকটাই আমার মায়ের মতো হয়েছে। মায়া তার মাথায় হাত দিয়ে হেসে দেয়। আমি খেতে খেতে তার দিকে তাকিয়ে হাসি। আর বলি,
– কি ভয় পেয়েছিলেন নাকি? হাহা।
~ আমি জানি আপনি ইচ্ছা করেই ওমন করেছেন। আপনি খুব খুব পঁচা।
– হাহা। দাঁড়ান আগে খেয়েনি। তারপর কথা হবে।
আমি আয়েশ করে খাচ্ছি আর মায়া অপলক দৃষ্টিতে মন জুড়িয়ে আমার খাওয়া দেখছে। তার কাছে এটা প্রথম। কারণ এর আগে কেউ তার রান্না এত মজা করে খায় নি৷ আমি খেতে খেতে বললাম,
– আপনি তো ভালোই রান্না পারেন। শুধু শুধু বললেন যে রান্না পারি না৷ আপনাকে যে বিয়ে করবে সে অনেক ভাগ্যবান। এত মজার রান্না সে খেতে পারবে।
মায়া মলিন মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে, সে চায় তার রান্না আমার মতো কেউ খাক। কিন্তু তার কপালে সেই গুন্ডাটাই হয়তো আছে। মায়া এখন ওসব কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে মুহূর্তটা নষ্ট করতে চায় না। তাই সব চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু আমার খাওয়াই দেখছে। আমি খেতে খেতে দেখি মায়া খাচ্ছে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– কি ব্যাপার শুধু আমাকে দেখলে কি পেট ভরবে? খেতে হবে তো। আপনিও খাবার নিন।
মায়া ভীষণ লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমি মুচকি হেসে নিজেই তাকে খাবার বেড়ে দিয়ে বলি,
– আপনি লজ্জা পেলে আপনাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে।
এরপর আমি আর মায়া মজা করে সকালের নাস্তাটা করলাম। নাস্তা শেষ করে আমরা দুজন হল রুমে বসে আছি। আমি মনে মনে ভাবছি আজ সারাদিনে কোথায় কোথায় যাবো। মায়া লজ্জাসিক্ত হয়ে আড়চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আসলে তার মনে গতরাতের আমার বলা কথাগুলো এখনো লেগে আছে। গত রাতে চাইলে অনেক কিছুই হতে পারবো। কিন্তু কিছুই হয়নি। আমি হঠাৎ করেই মায়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনার কেমন জায়গায় ঘুরতে ভালো লাগে?
মায়া তার আপন ভাবনায় ডুবে ছিল। আমার প্রশ্ন শুনে সে থতমত খেয়ে বলে,
~ আ….আম….কি?
– বলেছি আপনার কেমন জায়গা পছন্দ? যেখানে গেলে আপনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন?
মায়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
~ খোলামেলা সবুজ প্রকৃতির মাঝে। যেখানে কোন কোলাহল নেই। একদম নিরিবিলি, শুধু পাখিদের ডাক আর ফ্রেশ অক্সিজেন। এমন কোন জায়গা কি আছে আবির সাহেব?
এবার আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম কিন্তু এমন কোন জায়গা আছে কিনা মনে পড়ছে না৷ তাই ফোনটা বের করে নেটে খোজাখুজি শুরু করলাম। পাশ থেকে মায়া বলে উঠলো,
~ আরে আপনি এত চিন্তিত হয়েন না। এমন জায়গা কোথাও নে…
– পেয়েছিইইই….
~ কি! পেয়েছেন? কোথায়?
– বলবো না, আপনাকে ডিরেক্ট নিয়ে যাবো। আপনি সাওয়ার নিয়ে রেডি হন তাড়াতাড়ি। যাক এত খোঁজাখুঁজির পর পেলাম। মাথাটা পুরো হ্যাং হয়ে গিয়েছিল।
মায়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমিই তার থেকে বেশি খুশি হয়েছি। আমি মায়ার দিকে তাকিয়ে তাকে এভাবে দেখে বললাম,
– ওমা! আপনি বসে আছেন কেন? দৌড় দেন৷ নাহলে দেরি হয়ে যাবে৷ জায়গাটা একটু দূরে। তাও সমস্যা নেই।
~ যাচ্ছি যাচ্ছি।
বলেই মায়া উঠে গেস্ট রুমে যেতে নেয়। কিন্তু হঠাৎই সে থমকে দাঁড়ায়৷ আবার আমার সামনে চলে আসে। আমি তার দিকে তাকিয়ে পুরো অবাক। সে মুখটা সম্পূর্ণ মলিন করে আছে। আমি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
– আবার কি হয়েছে আপনার?
~ আপনি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছেন আবির সাহেব।
আমি আরও অবাক হয়ে বললাম,
– কি ভুলে যাচ্ছি আমি?
~ আপনি যে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন, নিচে দারোয়ান চাচার সামনে থেকে আমাকে নিয়ে কিভাবে যাবেন? সে তো আমাদের একসাথে দেখে ফেলবে। আর এই দিনের বেলা লুকিয়েও যাওয়া আসা করা যাবে না। তাহলে কিভাবে কি?
আমি মায়ার কথার শুনে পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই। আসলেই তো, মায়া ঠিকই বলেছে৷ এই দিনের বেলা দারোয়ান চাচার সামনে থেকে কিভাবে লুকিয়ে যাবো? সাথে আবার বাইকটাও আছে। এ কেমন ঝামেলায় পড়লাম আমি! মায়াকে কথা দিয়েছি তার শেষ ইচ্ছাটা আমি রাখবোই। তাহলে এখন কিভাবে আমি কি করবো! মাথা পুরো আগুন হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে। আমি আর ভাবতে পারছি না। উঠে দাঁড়ালাম। মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
– আমি নিচে যাচ্ছি তার সাথে কথা বলতে। আপনি এই ফাকে রেডি হতে থাকেন। আমরা যে প্ল্যান করেছি সেই অনুযায়ী সব হবে।
~ আপনি পাগল হয়েছেন! আপনি আর আমি এভাবে একসাথে…জানাজানি হলে তুলকালাম অবস্থা হবে৷ না না আপনি বাদ দিন এসব। আমি কোথাও যাবো না। আমি এখানেই ভালো আছি।
আমি মায়ার কাছে এসে তাকে ধরে চোখেচোখ রেখে বললাম,
– আমি আপনাকে কথা দিয়েছি আপনার আবদারটা পূরণ করবোই। সো এতে যদি আমাকে সমস্যায় পড়তেই হয় হোক। আমি তার কেয়ার করিনা। আপনি রেডি হন আমি আসছি। বলেই বাইরে থেকে লক করে সোজা নিচে চলে আসলাম। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। একমাত্র তিনিই এই মহা বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারেন। আমি লিফট দিয়ে নিচে এসে আস্তে আস্তে দারোয়ান চাচার কাছে গেলাম। তিনি বসে বসে পান খাচ্ছিলেন আর সবাইকে দেখছিলেন। হঠাৎ আমাকে তার কাছে দেখে তিনি অবাকও হন আবার খুশিও হন৷ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন,
– আরে আবির বাবা! আজকে এহনো অফিসে যান নাই যে? কোন সমস্যা অইছে নি?
– না না চাচা কিছুই হয়নি। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।
– হ হ কন কন।
– চাচা আগে ওয়াদা করেন আপনি আমাকে নিজের ছেলের মতো করে কথা গুলো শুনবেন। সব শুনে আপনার যদি মনে হয় আমি ভুল করেছি তাহলে আপনি গুরুজন হয়ে আমাকে শাস্তি দিয়েন।
দারোয়ান চাচা এবার একটু চিন্তায় পড়লেন। তিনি কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– বাবা কি কতা তাড়াতাড়ি কইয়া লাও। সমস্যা নাই।
এরপর আমি চাচাকে মায়ার সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললাম। তার পরিবার, কেন পালিয়ে আসা সবকিছু। প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলো তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে৷ আমি ভিতরে ভিতরে খুব ভয় পাচ্ছিলাম যে চাচা সবকিছু কিভাবে নিবে৷ তিনি সবকিছু শুনে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। আমি তার রিয়েকশন দেখার জন্য অপেক্ষা করছি আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। তিনি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– বাপ সমাজের চোহে হয়তো এইডা খারাপ দেখাইবো যে তুমি একটা মাইয়ার লগে এইভাবে আছো। তবে আমার চোখে তুমি ঠিক করছো। যেই মাইডা এইটুকু জীবনে এত কষ্ট সহ্য করলো তারও তো একটু মন চায় জীবনডারে উপভোগ করতে। তুমি কোন চিন্তা কইরো না। ওরে আমার নিজের মাইয়া মনে কইরা তুমি ওর খেয়াল রাইখো। আমার মাইডার দায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম। যাওয়ার সময় একটু দেহা কইরা যাইও। আমিও মাইয়াডারে একটু দেখতে চাই।
– অসংখ্য ধন্যবাদ চাচা। আপনি বাঁচালেন আমাকে। আমি অবশ্যই আপনার সাথে তাকে দেখা করায় নিয়ে যাবো।
– ঠিক আছে। খুশি থাকো।
এরপর চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে আসতে নিলাম। মায়াকে দ্রুত খুশির খবরটা দিতে হবে৷ আসলে মায়ার জীবনের গল্পটা শুনলে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ই গলে যাবে৷ তার মতো অসহায় মেয়ে বোধহয় আর একজনও নেই। যাইহোক আমি আবার লিফট দিয়ে বাসায় চলে আসি। এসে লক খুলে ভিতর ঢুকে দরজা দিয়ে খুশিতে সোজা আমার রুমে চলে আসি। ভাবি মায়া হয়তো আমার রুমে অপেক্ষা করছে বারান্দায়। আমি যেই আমার রুমে ঢুকি আমি দেখি মায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছিল। যার জন্য আমি তার সামনের পেটের অংশটা দেখে ফেলি। আমি পুরো মুগ্ধ হয়ে হা করে তাকিয়ে আছি। মায়া কুচি ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য যেই আয়নাতে তাকায় দেখে আমি হা করে দাঁড়িয়ে আছি। সেও আমাকে দেখে জোরে একটা চিৎকার দেয়। আমি এক দৌড়ে তার কাছে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরি হাত দিয়ে। আর আশ্চর্য হয়ে বলি,
– একি! আপনি চিৎকার করছেন কেন?
মায়া উম উম উম করছিল। কারণ আমি তার মুখ চেপে ধরে আছি তাই কথা বলতে পারছিল না। সে আমার হাত ধরে মুখ থেকে সরানোর জন্য চেষ্টা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– আর চিৎকার দিবেন নাতো?
সে মাথা নাড়িয়ে না বলে। আমি যেই হাত সরাই সে পিছু হেঁটে জোরে জোরে বলে,
~ পঁচা, লুচ্চা, খারাপ, বদমাশ কোথাকার আপনি সত্যিই খুব খারাপ। আপনি কিভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা মেয়েকে এমন অবস্থায় হা করে দেখছিলেন! ছিঃ ছিঃ।
আমি মায়ার কথা শুনে ভ্রুকুচকে রাগী ভাব নিয়ে তার দিকে তাকাই আর বলি,
– আমাকে এত কিছু বললেন? আচ্ছা আপনি আমার রুমে কি করছেন? বুঝলাম শাড়ি ঠিক করছিলেন। তো দরজাটা লাগান নি কেন? আমি কি জানি আপনি এমন অবস্থায় আছেন। যান আপনার সাথে আর কথাই নাই। আমি খারাপ তাই না ঠিক আছে।
মায়ার সাথে একটু রসিকতা করার জন্য এমন ভাবে বললাম। আসলে আমি মোটেও রাগ হয়নি। বরং হাহা থাক নাই বা বলি। আমি রাগী ভাবের অভিনয় করে অন্যদিকে ফিরে আছি। মায়া এবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখে, আসলেই তারই দোষ। আমি কিভাবে জানবো যে সে আমার রুমে বসে শাড়ি ঠিক করছে। মায়া জিহবায় কামড় দেয়। সে বড্ড বেশি বকা দিয়ে ফেলেছে আমাকে। এখন তার অনেক খারাপ লাগছে। মায়া আস্তে আস্তে আমার পিছনে এসে আমাকে ডাক দেয় আর বলে,
~ আবির সাহেব এই যে আবির সাহেব সরিইই। আমি আসলে রাগের মাথায় আপনাকে যাতা বলে ফেলেছি। সরি প্লিজ আপনি রাগ করবেন না৷ আবির সাহেব…
আমি আগের মতোই রাগের অভিনয় করে দাঁড়িয়ে আছি। এবার মায়া আমার সামনে এসে তার কান দুটো ধরে অসহায় কণ্ঠে বলে,
~ এই যে কান ধরেছি আমি আর কখনো আপনাকে খারাপ বলবো না। আপনি তো অনেক ভালো। অনেক অনেক বেশি ভালো। নাহলে আমার মতো মেয়েকে ক…
আমি হেসে দিয়ে মায়ার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিলাম। সে ভীষণ অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে লজ্জাও পেতে শুরু করেছে। আমি তার মিষ্টি নরম ঠোঁটে আঙুল রেখেই বললাম,
– আমি আপনার উপর রাগ করতে পারি? আমি তো মজা করছিলাম বোকা। আর আপনি সবসময় এটা কি বলেন আপনার মতো মেয়ে মানে! আপনি যথেষ্ট সম্মানিত একটা মেয়ে আমার কাছে। আপনার অনেক মূল্য রয়েছে আমার কাছে। নিজেকে ছোট করবেন না কখনো। অন্তত আমার সামনে না। আর শুনুন, যেটা বলার জন্য এত খুশিতে আপনার কাছেই আসছিলাম, তা হলো দারোয়ান চাচা আপনার সব কথা শুনে সে বলেছেন আমি যেন আপনার খেয়াল রাখি।
মায়া খুশি হয়ে বলে,
~ কি উনি কিছু বলেনি? (অবাক হয়ে)
– না। সেও চান আপনি যেন একটু জীবনটাকে উপভোগ করেন। ভালো থাকেন।
মায়া খুব খুশি হয়। খুশিতে তার মুখখানা অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আমি আস্তে করে আঙুলটা নামিয়ে ফেলি। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। মায়ার মুখেও মিষ্টি একটা হাসি, আমার মুখেও হাসি। আমি এবার ভালো করে মায়াকে দেখলাম। আমি দেখি সে…
চলবে…?