#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ১১(শেষ পর্ব)
লেখকঃ আবির খান
আমি মায়াকে বুঝাতে বুঝাতে বের হচ্ছিলাম ওমনি হঠাৎ করেই পিছন থেকে,
~ আবির!
আমি আর মায়া দুজনই অবাকও হই আবার ভয়ও পাই। আমার পরিচিত কে আমাকে না না আমাদেরকে দেখে ফেললো! হায় হায়! এখন কি হবে? আমি মায়ার দিকে ভয়ে তাকাই, মায়াও সেইম আমার দিকে ভয়ে তাকায়। তারপর আমরা দুজনই একসাথে পিছনে তাকাই। দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া মেয়েটাকে না চিনলেও আমি ঠিকই তাকে এক নজরেই চিনে ফেলি। সে আর কেউ নয়, সে আমার প্রাক্তন, নীলা। নীলা আমাদের কাছে এসে বলে,
~ কেমন আছো আবির?
– ভালো। তুমি?
~ আছি।
নীলা মায়ার দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
~ ও কে?
– কেন আমার একমাত্র বিয়ে করা স্ত্রী। আমার প্রিয়তমা, আমার ভালবাসার মানুষ।
মায়াকে হাত দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললাম। মায়া সম্পূর্ণ অবাক, সাথে লজ্জাও পাচ্ছে। নীলা মলিন একটা হাসি দিয়ে বলল,
~ ওহ! ভালো। দোয়া করি তোমরা হ্যাপি হও। আসি।
– ঠিক আছে।
বলেই নীলা দ্রুত চলে গেল। মায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ উনি কে ছিলেন?
– আমার প্রাক্তন।
~ কিহ! তাহলে আপনি ওনাকে মিথ্যা বললেন কেন? আমরা তো…
আমি মায়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম চুপ করার জন্য। তারপর ওকে ধরে নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে আসি। পার্কিং লটে বাইকের কাছে এসে মায়াকে বললাম,
– তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিব আগে তোমাকে তোমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাই চলো।
~ ঠিক আছে চলুন।
এরপর আমি মায়াকে বাইকে নিয়ে রওনা হই সেই অপেক্ষাকৃত গন্তব্যে। দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই। বাইক থামাতেই মায়া দ্রুত বাইক থেকে নেমে নিজেই হেলমেট খুলে আশেপাশে তাকায়। ও পুরো অবাক। ও ঠিক যেমনটা চেয়েছিল এখানের পরিবেশ এবং আশপাশটা সম্পূর্ণ তেমনই। মায়া অসম্ভব খুশি হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে৷ ফ্রেশ ঠান্ডা হাওয়া এসে আমাদের গায়ে লাগছে। আমি মায়াকে ডাক দিলাম। এখানে বসার জন্য ব্যবস্থা করা আছে। মায়া দ্রুত এসে আমার পাশে বসলো। আমাদের ঠিক পিছনেই বড়ো একটা গাছ ছিল। যার জন্য আরও ভালো লাগছিল তখন। মায়ার মনটা একদম ভরে গিয়েছে এই দৃশ্য দেখে আর এমন জায়গায় এসে। আমি ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি বলেছিলাম না, যে তোমার মনের মতো জায়গায় আমি তোমাকে নিয়ে আসবো। জায়গাটা পছন্দ হয়েছে?
~ পছন্দ মানে অসম্ভব পছন্দ হয়েছে। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব আমার জানা নেই। তাও অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। সত্যিই আজ আপনি আমার সব আবদার পূরণ করে দিলেন। আমি যদি কাল মরেও যাই আমার আর কোন আফসোস নেই। আমার ইচ্ছা যা ছিল আপনি একদিনেই তা সব পূরণ করে দিয়েছেন। আমার মনটা আজ সম্পূর্ণ ভরে গিয়েছে।
– কি যে বলো না, এখনো আর কত জায়গা ঘোরাঘুরি বাকি। লালবাগ কেল্লায় নিয়ে যাবো কাল তোমাকে। ওখানে অস্থির মজার বিরিয়ানি আর কাচ্চি পাওয়া যায়। কেল্লা দেখে আসার সময় কাচ্চি আর বিরিয়ানি দুটোই খেয়ে আসবোনি।
মায়া হাসে আমার কথা শুনে। তার খুব ভালো লাগে আমার কথা শুনতে। আসলে শুধু কথা না আমার সবকিছুই তার অনেক ভালো লাগে। মায়া আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
~ এবার আপনার প্রাক্তন সম্পর্কে বলুন। তার কাছে এভাবে বললেন কেন আমরা বিবাহিত?
– আসলে ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। টানা চারটা বছর আমরা একসাথে সম্পর্কে ছিলাম। তখন আমার আর্থিক অবস্থার খুব খারাপ ছিল। নীলা বড়ো লোকের একটা ছেলে পেয়ে আমাদের চার বছরের সম্পর্ককে নিমিষেই শেষ করে ওই ছেলের কাছে চলে যায়। সেদিন খুব কষ্ট পাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নি যে অনেক টাকা কামাবো জীবনে। দেখো আজ আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। টাকার কোন অভাব আমার নেই আল্লাহর ইচ্ছায়। অভাব শুধু একটা মনের মানুষের। যে সারাটা জীবন আমার পাশে থাকবে আমার হাত ধরে৷ যার মাঝে আমি ডুবে থাকবো শেষ দিনটা পর্যন্ত।
শেষের কথাগুলো আমি মায়াকে উদ্দেশ্য করেই বললাম। মায়া আমার কথা শুনে চুপচাপ বসে রইলো। আমি আবার বললাম,
– নীলা যখন তোমাকে আমার পাশে দেখলো তার মুখটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়। কারণ সে কখনোই চায়নি আমি ভালো থাকি। তোমার মতো মিষ্টি একটা বউ পেয়েছি দেখে দেখোনি ওর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে। ও যে ভালো নেই তা ওর মুখের ছাপেই স্পষ্ট। তাই ওকে আরও কষ্ট দিতেই তোমাকে আমার স্ত্রী বলেছি। তুমি কি মাইন্ড করেছো তার জন্য?
~ না না একদম না৷ একটুও মাইন্ড করিনি। শুধু একটু অবাক হয়েছি। মনে হচ্ছিল কোন সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম। হাহা।
আমি মায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। আজ আর নিজেকে আটকাতে ইচ্ছা করছে না। আমি উঠে ঠিক মায়ার সামনে গিয়ে বসলাম। ও আবার অবাক হলো। আমি ওর হাত দুটো সুন্দর করে আমার দু’হাতের মধ্যে নিলাম। মায়া আর আমি এখন একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমি ধীর কণ্ঠে মায়াকে বললাম,
– নীলাকে যে মিথ্যাটা বলেছি সেই মিথ্যাকে যদি সত্যি করে ফেলি তুমি কি আমাকে বাঁধা দিবে মায়া?
মায়া বিচলিত হয়ে বলে,
~ ঠিক বুঝতে পারছি না কি বললেন আপনি? কোন মিথ্যা?
– এই যে তুমি আমার স্ত্রী না হয়েও তোমাকে আমি আমার স্ত্রী বলেছি। এই মিথ্যাটাকে আমি সত্যি করতে চাই।
মায়া এবার সব বুঝে যায়। ও পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তাও কোনরকম নিজেকে সামলে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
~ আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান? আমাকে?
– হ্যাঁ তোমাকে। শুধু তোমাকে। কারণ আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমি চাই তুমি তোমার বাকি জীবনটা আমার নামে করে দেও। আমি তোমাকে আমার পাশে পেতে চাই। আমাদের এই সম্পর্কটাকে আমি একটা পবিত্র নাম দিতে চাই। মায়া আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করে আমার স্ত্রী বানাতে চাই। কাউকে ভালবাসার জন্য সহস্র সময়ের প্রয়োজন হয়না। আমার কাছে এক মুহূর্তই যথেষ্ট কাউকে ভালবাসার জন্য।
মায়া ভীষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর আমার কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ ও কি কোন স্বপ্ন দেখছে? মায়া চায় না এই স্বপ্ন ভেঙে যাক। মায়াও মনে মনে আমাকে চায়৷ কিন্তু? মায়া মাথা নিচু করে বলে,
~ না আবির সাহেব না। এটা হয়না৷ আমার কোন পরিবারই নেই। আপনার মা কখনো এমন পরিবারহীন মেয়ের সাথে আপনাকে বিয়ে দিবে না৷ সমাজে আপনাদের অনেক নাম দাম আছে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে আমার জন্য। নাহ আবির সাহেব এটা হয়না। এত সুন্দর একটা স্বপ্ন কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। কখনো না…(মায়া অঝোরে কেঁদে দেয়)
আমি মায়াকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি,
– আমি দরকার হলে মায়ের পা ধরে তার কাছে তোমাকে চাইবো। মা না করতে পারবে না। আর রইলো সমাজ! আমি তো সমাজকে বিয়ে করবো না আমি তোমাকে বিয়ে করবো। সমাজ কোন দিন আমাদের পাশে থাকে না এবং থাকবেও না। সমাজ তাদের জন্য যারা সমাজের ভয়ে নিজের ইচ্ছা ভালবাসা সবকিছুকে ত্যাগ করে। আমার এমন সমাজ দরকার নেই যেখানে অন্যরা কি ভাববে তার জন্য আমি আমার ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে দিব। তোমার কোন পরিবার লাগবে না। আজ থেকে আমিই তোমার সব। তোমার দুনিয়ায় আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না৷ আমি তোমাকে আমার থেকে দূর করতে পারবো না। তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালবাসার স্পর্শ। আমি দ্বিতীয় কোন নারীকে আর কখনো স্পর্শ করতে পারবো না। আমার দ্বারা তা সম্ভব হবে না৷ তুমি আমার এই বুকে থেকে যাও, আমি তোমাকে নিয়ে সারাটা জীবন পাড় করে দিব। কখনো তীল পরিমাণ কষ্ট তোমাকে ছুতে দিব না, কথা দিলাম। আমি তোমাকে স্পর্শ করে যে শান্তি পাই, সে শান্তি আমি আর কোথাও পাইনা। আমাদের এই অবাধ্য মেলামেশাকে পবিত্র একটা বন্ধনে নিয়ে আসি চলো। তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালাও খুশি হবেন।
মায়াও এবার আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জোরে কান্না করতে করতে বলে,
~ আমিও আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমিও আপনাকে চাই। আমারও আর কাউকে ভালো লাগে না, বিশ্বাস হয় না আপনি ছাড়া। আমারও শুধু আপনাকেই চাই। কিন্তু আপনার মা যদি আমাকে মেনে না নেয়? তখন কি করবেন?
আমি মায়াকে সামনে এনে বললাম,
– আমি আমার জান প্রাণ সব লাগিয়ে মাকে বুঝিয়ে বলবো। সে সব শুনে বুঝে যদি বলে তুমি আমার জন্য না, তাহলে আমি নিজ হাতে তোমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসবো। কারণ মায়ের মনে আঘাত করে আমাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেলে হয়তো সাময়িক ভালো থাকবো আমরা কিন্তু বেশি দিন এই ভালো থাকা হবে না। আমার মা তো আমার খারাপ চায় না৷ তার মনে আঘাত করলে আমরা কখনো সুখী হতে পারবো না। বাবা-মার দোয়া সবচেয়ে বড়ো দোয়া। তবে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো যাতে মা রাজি হয়।
~ একদম ঠিক বলেছেন আপনি। যে মা আপনাকে এত কষ্ট করে বড়ো করলো এখন বিয়ের মতো একটা বড়ো সিদ্ধান্ত আপনি একা নিতে পারেন না। আমি আপনার কথায় একমত। আন্টি যদি রাজি না হয় আমি চুপচাপ চলে যাবো। আমি সত্যি বলছি আমি খুব খুশি। কারণ আপনার মতো কাউকে আমি একবার হলেও জীবনে পেয়েছি। কিছু সময় পাড় করেছি। আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই এই জীবনে। শুধু একটাই ইচ্ছা, আপনি যদি আমার হতেন৷
– আমি মাকে ফোন দিয়ে বলছি সে যেন কালই চলে আসে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
~ ঠিক আছে। চলুন না একটু ওদিকটায় একসাথে পাশাপাশি হাঁটি। যদি কালকে আমার শেষ দিন হয় আপনার সাথে। তাহলে তো আর কোন দিন আপনাকে পাবো না।
– এভাবো বইলো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমরা খারাপ কিছু চাচ্ছি না৷ আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমাদের ইচ্ছাটা আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন।
~ আমিন।
এরপর আমি আর মায়া একসাথে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। মায়া আমার হাতটা নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিল। কারণ ওর মনে হচ্ছিলো আমার মা ওকে কখনোই মেনে নিবে না। আমরা এরপর বাসায় চলে আসি। আমাদের দুজনেরই মন ভীষণ খারাপ। আমরা দুজনক অনেক ভয়ে আর চিন্তায় আছি। আমি সন্ধ্যায় মাকে ফোন দিলাম। মা ফোন রিসিভ করলে আমি বলি,
– মা…
~ হ্যাঁ বাবা বল।
– মা তুমি রাতে ঢাকার জন্য রওনা দিতে পারবে? তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।
~ কিহ! কিছু হয়েছে তোর বাবা? তুই ঠিক আছিস? বাইক এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি! (খুব উত্তেজিত হয়ে)
– আরে না না। আমি একদম ঠিক আছি। তুমি ঢাকা আসলে সব বুঝতে পারবে।
~ আমি তোর মামাকে বলে এখনি রওনা হচ্ছি দাঁড়া।
– ঠিক আছে। তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। তুমি সাবধানে আসো।
~ ঠিক আছে।
এরপর ফোন রেখে দিলাম। মা সকাল নাগাদ ইনশাআল্লাহ চলে আসবে। মায়াকে জানালাম। ও উঠে সম্পূর্ণ ঘর সুন্দর করে পরিষ্কার করতে শুরু করলো। আমি ওকে বললাম এসবের দরকার নেই। কিন্তু মায়া শুনলোই না। ও পুরো ঘর গুছিয়ে পরিষ্কার করে মুছে চকচক করলো। আমি বুঝলাম মায়া আমাকে কতটা চায়। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে বসিয়ে ওর মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললাম,
– ইনশাআল্লাহ মা আমাদের মেনে নিবে। আমরা তো খারাপ কিছু চাচ্ছি না। এরপরও যদি সে না মানে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের কপালে এক হওয়া নেই।
~ আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমাকে হুকুম করবেন।
আমি মুচকি হেসে মায়ার মাথাটা আমার কাঁধে রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার নিজেরও খুব ভয় আর চিন্তা হচ্ছিলো। রাতটা আমরা দুজন নির্ঘুম পাড় করলাম। পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ মা বাসায় আসলো। আমি মায়াকে আমার রুমে লুকিয়ে রেখেছি। মা রীতিমতো অস্থির হয়ে এসেছে। বাসায় ঢুকেই আমার মাথা শরীর হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ বাবা তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে তোর? এই যে আমি আসছি। বল আমাকে কি হয়েছে।
– মা শান্ত হও। সব বলবো। আগে তুমি ফ্রেশ হও একটু রেস্ট নেও। অনেক দূর থেকে এসেছো।
~ আচ্ছা ঠিক আছে।
মাকে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আমার রুমে আসলাম। মায়া এক কোণায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে গিয়ে দেখি বোকাটা কাঁদছে। আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম,
– কান্না করছো কেন তুমি? আল্লাহ ভরসা।
~ আন্টি যদি রাজি না হয়, আমাকে যদি বের করে দেয়। আমি তো আর কখনো আপনাকে পাবো না৷
– আমারও কষ্ট হচ্ছে। গলা একদম শুকিয়ে আসছে চিন্তায়। মা আমাকে অনেক ভালবাসে। আমি তার পা ধরে বসে থাকবো। তুমিও আমার পাশে থেকো। দেখি মা মানে কিনা৷
~ ঠিক আছে আপনি যা বলবেন তাই।
এরপর মা ফ্রেশ হয়ে এসে হল রুমে বসে। সে বসতেই আশেপাশে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
~ কিরে আবির বাসাটা এমন চকচক করছে কেন? কে পরিষ্কার করেছে?
আমি আস্তে আস্তে মায়ের সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ি। মা ভীষণ অবাক হয়ে বলে,
~ কি হয়েছে? আমার পা ধরছিস কেন?
– মা আমি তোমার কাছে আজকে একটা জিনিস চাবো। তুমি প্লিজ না করবানা।
~ আমার কাছে কি চাবি? এই বাড়িঘর টাকা পয়সা সবই তো তোর। আমি আর কি দিব তোকে?
– মায়া…
আমি মায়াকে ডাক দিলাম। মায়া আমার রুম থেকে বের হয়ে এসে আমার পাশে এসে বসলো। মা পুরো সকড। সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি মাকে বললাম,
– মা আমি ওকে চাই তোমার কাছে।
মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্থীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ তুই কি ওকে বিয়ে করেছিস?
– না না মা। কি বলো তুমি! তোমার অনুমতি ছাড়া আমি এত বড়ো একটা কাজ কিভাবে করবো! তবে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তোমার অনুমতি চাই বলেই তোমাকে গ্রাম থেকে ঢাকা আসতে বলেছি।
~ তুই ওকে কোথায় পেলি? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা৷ তোকে আমি সবসময় জিজ্ঞেস করে এসেছি তোর কোন পছন্দের মেয়ে আছে কিনা। তুই বলেছিস না। তাহলে ও কোথা থাকে আসলো আবির? উত্তর দে। (মা রেগে গিয়েছে)
আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। তাও আল্লাহর নাম নিয়ে আমি মায়ের পা জড়িয়ে ধরেই মায়ার সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সবকিছু খুলে বললাম। সব শেষে বললাম,
– মা ও খুব ভালো একটা মেয়ে। দেখো কত সুন্দর করে তোমার ঘর গুছিয়েছে তুমি আসবে বলে। তোমার মতো রান্নাও পারে। সেই ওকে কিভাবে আমি জেনে শুনে ওদের কাছে পাঠিয়ে দি বলো? আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমার ওকে ভালো লেগেছে। তাই মা আমি চাই তুমি আমাদের বিয়ে দিয়ে দেও। তুমি আজ আমাদের অনুমতি দিলে ওর জীবনটা বেঁচে যাবে আর আমি আমার মনের মতো কাউকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পাবো। এখন তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমরা দুজন তা মাথা পেতে নিব। তুমি যদি না করে দেও আমি ওকে এখনি পাঠিয়ে দিব৷ তোমার দোয়া আর অনুমতি ছাড়া আমরা কিছুই করবো না।
মা আমাদের দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মায়া মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছিল। মেয়েটা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। মা ওর হাত ধরে উপরে তার পাশে বসায়। মায়ার মুখখানা তুলে সে ভালো করে দেখছে। দু’হাত দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে মা বলে,
~ এত মিষ্টি মেয়ের মুখে কান্না মানায় না৷
আমি সাথে সাথে খুশিতে মায়ের দিকে তাকাই। মায়াও অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে কান্না করে দেয়। মা ওকে তার বুকে নিয়ে বলে,
~ আমি খুব কষ্ট পেতাম যদি তোরা আমাকে কিছুই না জানিয়ে বিয়েটা করে ফেলতি। তোরা যে আমাকে মা হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিস, আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেছিস আমি এতেই খুশি। আর ওকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছে। কি মিষ্টি মায়াবী মুখ। আহরে! মা তুমি আর কান্না করো না৷ তোমার আপন মা তোমাকে ছেড়ে গেলেও আজ তুমি আরেকটা নতুন মা পেলে। আমার ছেলেটা অনেক ভালো। তোমার কোন কষ্ট হবে না। মায়া মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
~ মা আপনি বললে আমি আপনাদের জন্য আমার জীবনটাও দিয়ে দিব। তাও আমাকে আপনাদের ছায়াতল থেকে সরিয়ে দিবেন না কখনো।
~ ধুর বোকা মেয়ে এগুলো বলেনা। আমি চাই তোমরা দুজন সারাজীবন সুখী হয়ে থাকো। আমি আবিরকে সেই কবে থাকে বিয়ে করতে বলছি। কিন্তু ও করছেই না। আমি এবার রাগ করেই চলে গিয়েছিলাম৷ যাক আমার ছেলেটা যে শেষমেশ কাউকে পছন্দ করেছে বিয়ে করতে চাচ্ছে আমি এতেই খুশি। একটা মা কি চায় জানো, তার ছেলে মেয়েরা এমন কাউকে বিয়ে করুক যাকে সে মন থেকে পছন্দ করে। যাতে তারা সারাজীবন সুখী থাকে। আমিও তাই চেয়েছি। আজ ওর বাবা থাকলে সেও অনেক খুশি হতেন। আমি নিজ হাতে তোমাদের বিয়ে দিব। আবির তোর মামা খালাদের ফোন দে। তাদের সবাইকে আসতে বল। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি তোদের বিয়েটা দিব। তোকে বিয়ে দেওয়াটা আমার অনেক বড়ো একটা দায়িত্ব ছিল। আজ সে দায়িত্ব থাকে আমি মুক্ত। এখন যদি আমি তোর বাবার কাছেও চলে যাই আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। তবে নাতির মুখখানা দেখে গেলে মন্দ হয় না। হাহা।
মায়ের কথা শুনে আমরা দুজন কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলাম। মা আমাদের দুজনকে তার দুপাশে নিয়ে দোয়া করে দিলেন। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। কিন্তু এটাই বাস্তব। বাবা-মা আমাদের ভালো চান৷ তারা আমাদের কাছে কখনোই কোন কিছু আশা করেন না। তারা শুধু আমাদের ভালো দেখতে চান। মায়া আর আমি আজ অনেক খুশি। আমাদের আলাদা হতে হবে না। আমরা আমাদের ভালবাসা নিয়েই সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবো। এরপর মায়ের পরিবারের সবাই ঢাকা আসলো। তারাও সবাই মায়াকে খুশি মনে মেনে নিল। এবং খুব বড়ো আর ধুমধাম করে আমাদের দুজনের বিয়ে হলো। আমরা যদি সমাজের ভয়ে চুপ হয়ে যেতাম তাহলে হয়তো আজ আমরা এক হতে পারতাম না। মায়াকে আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য। মায়া আমার বুকে মাথা রেখে বলছে,
~ আবির সাহেব, আপনি আজ আমার জীবনটা ভরে দিলেন সীমাহীন আনন্দ আর ভালবাসা দিয়ে। আমি কল্পনাও করিনি, আপনাকে আমি আমার করে পাবো। আমি সারাজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকবো। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
– ছিঃ ছিঃ দাসী কেন বলছো। তুমি আমার ভালবাসার বউ। আমার রাণী হয়ে থাকবে তুমি। তুমি আমার সম্পূর্ণ পৃথিবীটা জুড়ে থাকবে তুমি।
এরপর মায়াকে একদম আমার নিজের করে আলিঙ্গন করে নিলাম। ভরিয়ে দিলাম ওকে ভালবাসার স্পর্শে। আমাদের অপেক্ষার ফল আজ মিষ্টি হলো। আর সেই সাথে নতুন এক জীবনের গল্প শুরু হলো।
– সমাপ্ত।
গল্পটা আর বেশি বড়ো করলাম না। নাহলে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল হয়ে যাবে। যেটা আমার বরাবরই পছন্দ না। এই গল্পটা লেখার পিছনে কয়েকটা উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো, সব বাবা-মাই আপন হয় না। কিছু বাবা-মা সন্তানের সবচেয়ে বড়ো শত্রুও হতে পারে। যেমন মায়ার বাবা আর সৎ মা। এদেরকে ত্যাগ করাই ভালো। আবার কিছু বাবা-মা হয় আপনের মতো আপন৷ যাদের ছায়াতলে থাকলে আপনি কখনো কষ্ট পাবেন না। আর সেটা হলো আবিরের বাবা-মার মতো। এইসব বাবা-মাকে কখনো মনে কষ্ট দিতে হয়না। তাদের মনে আঘাত দিয়ে কিছু করতে হয়না। নাহলে সুখী হওয়া যায় না। যেমনটা আবির আর মায়া করেছে। আরেকটি শিক্ষা হলো, কোন অসহায় মেয়েকে কাছে পেলেই তার ফায়দা না লুটে বরং মেয়েটাকে তার বিপদ থেকে রক্ষা করা। তাহলে সমাজে পুরুষদের সম্মান অনেকগুণ বেড়ে যাবে। একটা মেয়ের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা একটা পুরুষের কাছেই। আবার সবচেয়ে বিপদজনক জায়গাও একটা পুরুষের কাছেই। সমাজে ভালো পুরুষের চেয়ে খারাপ পুরুষই আজ বেশি। আমি চাই এই গল্পের মাধ্যমে যেন একটা পুরুষ মানুষ হলেও বুঝে যে মেয়েদের প্রতি তাদের দায়িত্বটা কি। সর্বশেষ শিক্ষা হলো, সবসময় মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখা। সেটা যত বড়ো প্রতিকূল অবস্থাই হোক না কেন। ধন্যবাদ।
জানি না গল্পটা কেমন লেগেছে আপনাদের। আমার যতটুকু শিক্ষা এই গল্পের মাধ্যমে দেওয়ার ছিল আমি তা দেয়ার চেষ্টা করেছি। এখন আপনারাই বলুন আমি কতটুকু পেরেছি কিংবা পারিনি। ধন্যবাদ যারা এতটা সময় সাথে ছিলেন।
আবির খান।