ভালবেসে রাখব কাছে পর্বঃ১৭

0
2132

ভালবেসে রাখব কাছে পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম

বঁধুবেশে মুখটা কাচুমাচু করে মামুর বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে আপু,তার পাশেই মেঘ ভাইয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আর তাদের সামনে মামা বুকে হাত গুজে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে,আর মামি মা গেছে বরনডালা সাজাতে।অন্যদিকে আমি আর হিয়া দুজনে আপুর ট্রলিব্যাগের উপর বসে বসে হাই তুলছি।আপুকে কিডন্যাপ করার আগে আপুর প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম এই ব্যাগে।আমাদের ভাব এমন যেন কিছুই হয় নি,কিন্তু মামুর মোটেও শয্য হচ্ছে না এসব কিছু তাই তিনি রেগে বলে উঠে,,,

“তোকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে আমার,ছিঃ তুই কীভাবে পারলি এভাবে পালিয়ে বিয়ে করতে?পরিবারের বিরুদ্ধে কীভাবে গেলি তুই!”

আমি এবার আরেকটা হাই তুলতে তুলতে বলে উঠলাম,,,

“মামা তুমি না অনেক বেশি খারাপ হয়ে গেছো।এক চোখে নুন আরেক চোখে মরিচ দেখো।”

“কী বলতে চাইছিস তুই?”(রেগে চিৎকার করে)

“আহ্হা মামা এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?আমি ত কানে কালা না,সবই শুনতে পাই তাই আস্তে বলো।”

“বেশি কথা না বলে বল কী বলতে চাইছিস এক চোখে নুন আরেক চোখে মরিচ দেখি মানে কী?”

“সেটা এভাবে শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেই পারো,এত চেঁচানোর কী আছে?”

“এবার কিন্তু কানের নিচে দিব একটা।”

“এত হাইপার হয়ো না ত,আমি কথাটা দিয়ে বুঝাতে চাইছি যে তুমি দুজনকে দুই চোখে দেখো।কাব্য ভাই এতকিছু করল সেটা তোমার চোখে পড়ে না,আর তুমি কাব্য ভাইকে কিছু বলোও না উল্টো সাপোর্ট করো।আর মেঘ ভাইয়া বিয়ে করছে তার জন্য ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতেই তোমার লজ্জা করছে!বাহ!বাহ!বাহ! মামু তোমার নামটা ত স্বর্নাক্ষরে লেখা দরকার।নিজেরই ত দুইটা ছেলে কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কাজকর্ম করে প্রকাশ করো যেন একজন পানিতে ভেসে এসেছে।আরেকজন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে।কী রে ঠিক বলেছি না আমি?”

কথাগুলো আমি তাচ্ছিল্য হেঁসে বললাম,আমার কথাশুনে হিয়া বোকার মত একবার আমার দিকে তাকায় আরেকবার মামুর দিকে তাকায়।বেচারি পড়ে গেছে মহাবিপদে কার পক্ষ নিবে বুঝতে পারছে না।আমার পক্ষ নিলে মামা দোলাই দিব আর মামার পক্ষ নিলে আমি হিয়াকে ডিটারজেন্ট ছাড়াই ধুয়ে দিব।এসব ভেবে হিয়া আমতা আমতা করে বলে উঠল,,,

“আআআমি কককী বলব?”

“আছাড় দিয়া ব্যাঙ বানাইয়া ফেলমু তরে,যেটা বলতে বলছি তার উওর দে।”

এবার হিয়া ফিসফিসিয়ে আমার কানের কাছে এসে বলে উঠল,,,

“বইন ছাইড়া দে,আব্বুর পক্ষে কথা না বললে পরে আমাকে উস্টা দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে ফালাইব।যেটা আমি একদমই চাইছি না,প্লিজ বইন মাফ কর আমারে।”

“কথাটা একবার যখন বলেই দিয়েছি তখন ত তকে বলতেই হবে রে বইনা,নয়ত তোরে আমি যে কী করব নিজেও জানি না।”

“হিয়াকে এত চাপ না দিয়ে তোর বোন আর জিজুকে বল ঠিক করে দাঁড়াতে বরন করতে হবে নাকি!”

মিসেস লতা বরনডালা নিয়ে এসে কথাটা বলল,সাবিহা বলে উঠল,,,

“মামি মা তুমি না এত্তগুলো ভালো,কী সুন্দর আপু আর ভাইয়া থুক্কু জিজুকে মেনে নিয়েছো।আমার মামার মত ভিটকেল মার্কা না তুমি।”

আমার কথাশুনে সবাই মুখ টিপে হাসছে আর মামা রেগে বলে উঠল,,

“এই তুই কী বললি আমাকে?আমি ভিটকেল?আমি?”

“তুমি চুপ করে ঘরে যাও ত,এখানে যত থাকবে তত বেশি বকবক করবে।যাও এখান থেকে,ভালো মুডটা নষ্ট করো না।”

মামিমার কথা শুনে মামা কিছু না বলে রেগে হনহনিয়ে তার ঘরে চলে যায়।আমি এবার মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠি,,,

“মামাটা যে কেন তোমার মত এত ভালো হলো না গো!”

“হয়েছে ছাড় এবার,ভালবাসা পড়ে দেখাস আগে বরন ত করি।”

আমি হাসিমুখে সম্মতি জানিয়ে মামিমাকে ছেড়ে দাঁড়াই,আর মামিমা এক গাল হেঁসে বরন করে নেয় আপু আর জিজুকে।কিন্তু আপু আর ভাইয়ার মুখে কোন হাসির আবাস নেই,যেটা আমাকে বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে।

“এভাবে মুখটা গোমড়া করে না থেকে একটু হাসি দে দুজনে।এতদিন ত দুজনের একজনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিস নি,এখন যখন দুজনে এক হলি ত এভাবে ওপ করে আছিস কেন?”

মামিমার কথা শুনে আপু আর নিজেকে সামলাতে পারে না।মামিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে,আর বলে উঠে,,,

“বববাবা মেনে ননননিবে না,ববাবা খখুব রাগ কককরবে।”

“এই পাগলী মেয়ে এভাবে কাঁদছিস কেন?শান্ত হ,তোর বাবার সাথে আমি কথা বলব।সব ঠিক হয়ে যাবে,কাঁদিস না মা আমার।”

আপুর কান্না দেখে আমার খুব খারাপ লাগে,আমি আপুর কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠি,,,

“আপু তুই কাঁদিস না,আমি বাবাকে মেনেজ করে নিব।আর বাবাকে মেনেজ করে দুইদিনের মধ্যেই তোর সাথে কথা বলিয়ে দিব।তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না আপু,নতুন জীবনটা সুন্দর করে সাজা।তোর এই বোন থাকতে কোন কষ্ট পেতে দিবে না তকে।”

আমার কথাশুনে আপু মামিমাকে ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,,,

“তোর মত বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার,জীবনে হয়ত কোন ভালো কাজ করেছি যার ফল আল্লা আমাকে তোর মত একটা বোন দিয়েছে।তুই যে আমাকে কোন কষ্ট পেতে দিবি না সেটা আমি বুঝতে পেরেছি রে।তুই না থাকলে হয়ত আমার আর মেঘের বিয়েটা হত না।দুজনেই হয়ত গুমরে গুমরে মরতাম,কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারতাম না।তারপর তুই যেভাবেই হোক আমাদের দুজনকে এক করেছিস।কিন্তু বাবা মেনে নিবে না আমাদের,বাবা খুব রাগ করবে।হয়ত আমাকে মেয়ে বলে পরিচয়ই দিবে না,আর এমনটা হলে আমি বাঁচব না।”

“আপু প্লিজ বাজে কথা বলিস না,আমি তকে কথা দিচ্ছি এমন কিছুই হবে না।আমি বাবাকে রাজি করাব তদের যাতে মেনে নেয়।তুই এভাবে কাঁদিস না প্লিজ,এই জিজু আপুকে বলো না কান্না থামাতে।এভাবে কাঁদলে এবার আমিও আপুর দুঃখে দুঃখিত হয়ে হেঁসে ফেলব।”

আমার কথা শুনে আপু আমাকে ছেড়ে আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলে উঠে,,,

“সিরিয়াস মোমেন্টেও তোর মজা না করলে চলে না তাই না!”

“এত সিরিয়াস মোমেন্ট টোমেন্ট আমি মেইনটেইন করতে পারব না,যখন মজা করতে ইচ্ছে করবে করব।আবার যখন হাসতে ইচ্ছে করবে তখন হাসব।”

“হয়েছে হয়েছে এবার থাম তোরা,মেঘ শীলাকে ঘরে নিয়ে যা।কোলে করে নিয়ে যাবি কিন্তু আর হিয়া ফোনটা নিয়ে ভিডিও কর।এমন একটা মুহুর্তের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিব,পরে নিজেদের ছেলে মেয়েদেরও দেখাতে পারবি তোরা?।”

মামিমার কথা শুনে মেঘ ভাইয়া চোখ বড়বড় করে আপুর দিকে তাকায়।আপুও অবাক চোখে মেঘ ভাইয়ার দিকে তাকায় সেটা দেখে মামিমা বলে উঠে,,,

“এত অবাক হওয়ার কিছু নেই,এটা নিয়ম আমাদের বাড়ির।তাই তাড়াতাড়ি কাজ সার,আর হিয়া তকে ওখানে বসে থাকতে বলি নি এখানে আয়।”

অতঃপর মামিমার কথামত মেঘ ভাইয়া ইতস্তত করে আপুকে কোলে তুলে নেয়।আর আপু লজ্জায় লাল হয়ে ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে ফেলে।আর সবটা হিয়া ক্যামেরা বন্দি করে ফেলে,সব কাজ সম্পন্ন হলে আমি মামিমার কাছে গিয়ে বলি,,,

“মামিমা আমি এবার আসি,তুমি আপুকে একটু দেখো।”

“রাত ৯ টা বাজে,এত রাতে তুই বাড়িতে যাবি এখন!এত রাতে বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই।আজ এখানেই থেকে যা,কাল সকালে চলে যাস।”

“মামিমা বাবা জানতে পারলে রাগ করবে,বাবা এখনও জানে না আপু আর ভাইয়ার বিয়ের কথা।বাবাকে বলেছি দুইবোন আজ রীতা আপু মানে আপুর বান্ধবীর বাসায় এসেছি।আর বাবা যদি আজ রাতের মধ্যে অন্য কারো থেকে বিয়ের কথাটা জানতে পারে তবে রাগ করবে খুব।তাই আমাকে তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবাকে মেনেজ করতে হবে।”

“কাল করিস,এখন এত রাতে তকে একা ছাড়ব না আমি।তুই তোর বাবাকে ফোন দিয়ে বল তোরা কাল সকালে চলে আসবি।”

তারপর মামিমাকে শত জোড় করার পরও উনি যেতে দিবে না বলে দেয়।তাই বাধ্য হয়ে রয়ে যাই এখানে,আর বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি।কিন্তু তারপরও বাবা চিন্তা করছে,বড় দুইটা মেয়ে বাড়ির বাইরে আছে চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক।কিন্তু তারপরও বাবাকে মেনেজ করে নিয়েছি।আর এখানে আসার পর কাব্য ভাইয়ের কোন দেখাই মিলল না।বেচারা কী পালালো নাকি?কিন্তু নিলয় ভাইয়া ত বলেছে কাব্য ভাইকে একজন আড়ালে থেকে সবসময় ফলো করে।তবে কাব্য ভাই কই গেলো?দূর বাবা এতকিছু ভেবে লাভ নেই,আপুর বিয়ের ঝামেলাটা সারুক তারপর কাব্য ভাইয়ের ব্যাবস্থা করব।এখন খিদে পেয়েছে খুব,ত খেয়ে আসি।

_____________________________________

রাত ১ টা বেজে ১৩ মিনিট,সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার পাশে আছে,কেউ আমাকে গভীরভাবে দেখে চলেছে।কথাটা ভেবেই ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম,আর চোখ খুলে যেই না চিৎকার দিব ওমনি সাদাফ ভাই আমার মুখ চেপে ধরে।

“হুসসস,মুখ থেকে হাত সরাচ্ছি একদম চিল্লাবে না।”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালে সাদাফ ভাই আমার মুখ থেকে হাত সরায়।আর আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠি,,,

“আপনি এত রাতে এখানে কী করছেন?আর ঘরেই বা আসলেন কীভাবে?”

“এখানে আসা কোন ব্যাপার না,আর এখানে এসেছি তোমাকে নিতে।চলো আমার সাথে!”

আমি উনার কথাশুনে অবাক হয়ে যাই,মানেহ!উনি এতরাতে আমাকে নিতে এসেছে কিন্তু কেন?

“আপনার মাথা ঠিক আছে?এতরাতে কী সব পাগলের প্রলাপ বকছেন?”

“আমার মাথা ঠিকই আছে আর কোন পাগলের প্রলাপও বলছি না।তাই কোন কথা না বলে চলো এখান থেকে।”

“আমি যাব না আপনার সাথে,আপনি এখান থেকে চলে যান নয়ত ভালো হবে না।”

“আর কী ভালো হওয়ার বাকি আছে!সিংহের গুহায় এসে পড়েছো আর এখানে নিজেকে সেফ মনে করে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছিলে!তুমি কী ভুলে যাচ্ছো এখানে কাব্য আছে,আর যখন তখন তোমার বিপদ হতে পারে।”

“আমি কিছু ভুলি নি,আর আমাকে নিয়ে আপনার এত চিন্তা করতে হবে না।আমি নিজের রক্ষা নিজেই করতে পারব তাই আপনি আসুন।”

“আমার সাথে তুমিও যাবে।”

“আপনি কী আমাকে জোড় করছেন?”

“তোমার যদি মনে হয় জোড় করছি তবে তাই,এখন চলো আমার সাথে।”

“আমি যাব না আপনার সাথে,আপনি এখান থেকে যান নয়ত আমি কী করব নিজেও জানি না।”

“আমি ভালো করেই জানি কী করবে তুমি,ত আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।তোমাকে নিতে যখন এসেছি ত নিয়েই যাব।”

কথাটা বলে সাদাফ ভাই আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই আমায় কোলে তুলে নেয়।আমি ছোটার চেষ্টা করে চলেছি কিন্তু উনি আমার দুই হাত উনার এক হাত দিয়ে চেপে ধরেছে,যার জন্য হাত কোন কাজে লাগাতে পারছি না।তাই পা দিয়ে উনাকে আঘাত করতে থাকি,কিন্তু তাতে উনার বিন্দুমাত্র ভাবাবেগ দেখা গেলো না।উনি দিব্যি আগের মতই হেঁটে চলেছেন,তাই আমি এবার আর কোন উপায় না পেয়ে উনার নাকে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দেই।আর তখনই উনি আমাকে ছেড়ে দেয়,আর আমি ধপাস করে নিচে পড়ে যাই।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here