#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব – ১৬
#অজান্তা_অহি
সেই ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় রাজ ভাইয়া ভ’য়ংকর এক কাজ করলো। ঝড়ো হাওয়ার মতো কাছে এসে ঠোঁটে চুমু খেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেলো ব্যাপারটা। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেলাম না। ধাক্কা দেওয়ার জন্য হাত উঠানোর আগে-ভাগে সে সরে দাঁড়িয়েছে। আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,
‘কী করলেন আপনি?’
রাজ ভাইয়া উত্তর দিলো না। প্রচন্ড ভয়ে শরীর কাঁপছে আমার। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেছে। বহুদিন পর চোখের সামনে মেজো আপার চেহারা ভেসে উঠলো। আপাকে কেউ বা কারা বাজে ভাবে ছুঁয়েছিল। আপা আমার এক সমুদ্র অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে। আমার সাথেও কি এমন কিছু হবে? না! ছুটে পালানোর জন্য ফাঁক ফোকর খুঁজছিলাম। কিন্তু আমাকে পালাতে হলো না। রাজ ভাইয়া কিছুক্ষণ অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর নিজে থেকে হনহন করে নিচে নেমে গেল।
দু চোখে আঁধার ঘনিয়ে এলো আমার।হাতের ধরে রাখা কাপড় খসে পড়েছে অনেক আগে। সে যেতে ধপাস করে ছাদে বসে পড়লাম। বারংবার শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে! ভয়ে দম বন্ধ হয়ে এলো। অবশেষে কী এ বাড়ি ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এলো?
চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ঝর্ণার মতো অবিরত, অবিচল! হাতের আঙ্গুল আনমনে ঠোঁটে বিচরণ করছে। আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষ আমাকে এভাবে স্পর্শ করেনি। আমার দেহে বুঝি কালিমা লেপন হলো। এই স্পর্শ ভুলবো কি করে!
বুকের ভেতর হুঁ হুঁ করছে। খালি খালি মনে হচ্ছে। ঝাপসা চোখে চারিদিকে তাকাতে মনে হলো পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। আশপাশে অক্সিজেনের অভাব। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দু চোখ হন্যে হয়ে মায়ের আঁচল খুঁজল। মায়ের আঁচলের তলায় লুকালে বোধ হয় কেউ আর ছুঁতে পারবে না আমায়। কেউ ধরতে পারবে না!
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে। দ্বিক-বিদিক থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আমি হাঁটুতে মাথা ভাঁজ করে ছাদে রয়ে গেলাম। আর নিচে নামার শক্তি রইলো না। রাজ ভাইয়া যদি সুযোগ বুঝে বড় কোনো ক্ষতি করে! তার মতলব বুঝে গেছি আমি। ফাইজান ভাই নিষেধ করেছিল তার থেকে দূরে থাকতে। দূরে দূরে ছিলাম। তবুও হুটহাট আচমকা সামনে চলে আসে। এর থেকে এখন নিজেকে রক্ষা করবো কী করে?
ছাদ থেকে নিচে নামলাম যখন তখন চারিদিকে অন্ধকার। অনেকখানি রাত হয়ে গেছে। বার বার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম যেন রাজ ভাইয়ার নজরে না পড়ি। বসার ঘরে আসতে বড় মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই কখন থেকে খুঁজছি।’
চমকে উঠলাম আমি। টেনে টেনে বললাম,
‘কাপড় আনতে গেছিলাম।’
‘ছাদ থেকে কাপড় আনতে এত সময় লাগে? সন্ধ্যা থেকে খুঁজছি।’
‘কিছু করতে হবে?’
‘খাবারের বক্স গুলা কে পরিষ্কার করবে? হ্যাঁ? দুপুর বেলা এঁটো নিয়ে আসা হয়েছে।’
সোফার একপাশে এলোমেলো কাপড় চোপড় রেখে আমি রান্না ঘরে গেলাম। খালাকে দেখছি না। হয়তো নামাজ আদায় করছে। আমি দ্রুত হাতে সবগুলো বক্স ধুয়ে ফেললাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ একজন যে আমার কতবড় সর্বনাশ করতে নিয়েছিল কেউ টের পেল না।
__________
সামান্তা আপু হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। শুকিয়ে কেমন পুতুল হয়ে গেছে। চেহারা অত্যধিক ফ্যাকাসে। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। হুঁ, হ্যাঁ আর মাথা নাড়ানো ছাড়া তেমন কথা বলে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে লাজুক হাসে। কেমন প্রাণহীন, নির্জীব সে হাসি। আমার বড্ড ভয় হয়।
ফাইজান ভাই বাড়িতেই আছে। এবার খুলনা ফেরার জন্য তেমন ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। ভাই ভয় পেয়ে গেছে। সামান্তা আপুর আকস্মিক কাজ তাকে অবাক করে দিয়েছে। মৃত্যুর মতো এতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেওয়া কি খুব সহজ? সহজ নয়!
অথচ আপু অকপটে সেই কাজ করতে নিয়েছিল।
আপু বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বই পড়ছিল। আমি স্যুপের বাটি হাতে ভেতরে গেলাম। ডাক্তার কিছুদিন তরল খাদ্য খেতে বলেছেন। আপুর গলা ব্যথা এখনো ঠিক হয়নি।
‘আপু এটা খেয়ে নিন।’
‘রেখে যা! পরে খেয়ে নিবো। এখন বই পড়ছি।’
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপু বই পড়ছে না। শূন্য দৃষ্টি বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ রেখেছে শুধু। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
‘এটা খেয়ে নিন না! ঠান্ডা হলে ভালো লাগবে না!’
‘বললাম তো রেখে যা। খেয়ে নিবো পরে।’
‘আপনি এখনি খান। খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।’
আচমকা রেগে গেল সামান্তা আপু। ধাক্কা দিয়ে স্যুপের বাটি ফেলে দিল। পিলে চমকে উঠল আমার। গরম স্যুপের বেশ খানিকটা যে হাতে পায়ে ছড়িয়ে পড়লো তার খেয়াল রইলো না। সে চেঁচিয়ে বলল,
‘কাজের মেয়ে আছিস, কাজের মেয়ের মতো থাকবি। সবসময় বাড়াবাড়ি করিস কেন জুঁই? এমন ভাব করিস যেন আমাদের বাড়ি তুই নয়! বরং তোর বাড়ি আমরা থাকি।’
তার কথা শুনে বিমূর্ত হয়ে গেলাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
‘এসব কি বলছেন আপু?’
আপু ফের চেঁচিয়ে উঠল। চেঁচামেচির শব্দে সবাই রুমে হাজির হলো। বড় মা বুঝতে না পেরে কাছে এলো। চিন্তিত মুখে বলল,
‘কি হয়েছে রে? রাগারাগি করছিস কেন?’
আপু কিছু বললো না। চুপচাপ কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। বড় মা চোখ গরম করে তাকালো আমার পানে। আমি কোনো রকমে অশ্রু আটকে রাখলাম। সালেহা খালা কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। খালা আমার আগে আগে নেমে পানির বালতি হাতে নিল। ফ্লোর পরিষ্কার করার জন্য!
নিজের রুমে ঢুকে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললাম আমি। সামান্তা আপু আমার বিশেষ একজন। আমার দূর্বলতা। আমার সাথে আপু সবসময় ভালো আচরণ করে। খুঁটিনাটি ভুল হলে হেসে উড়িয়ে দেয়। অন্য কেউ বকাঝকা করতে নিলে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। আজ তার এই আচরণ নিতে পারলাম না। ভীষণ কষ্ট হলো।
হাত পায়ের কিছু কিছু অংশ জ্বলছে। বাথরুম থেকে পানি ঢেলে বের হলাম। কাঠের টেবিলটার ড্রয়ার থেকে মলমের টিউব বের করলাম। এই বাড়িতে প্রথম যখন এসেছিলাম এই টিউবটা কেউ একজন দরজার বাইরে রেখেছিল। ভারী কৌতূহল হয়েছিল। এই কাজ কার! এর বহুদিন পরে আপনা আপনি বুঝে গেলাম। এটা জাবিরের কাজ! জাবির ছেলেটা বিশেষ যত্ন নেয় আমার। সবার অগোচরে!
ফাইজান ভাই রাত করে বাড়ি ফিরলো। মোটামুটি বাড়ির সবাই তখন ঘুমে। খালা নিজে দরজা খুলে দিল। যত্ন নিয়ে খেতে দিল। আমি দরজার আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করছিলাম। একসময় বের হলাম। ফাইজান ভাইকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে। সে কী সত্যি সত্যি বিয়ে করেছে? নাকি সামান্তা আপুর থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে! অনধিকার চর্চা হলেও জানতে হবে আমায়।
আমায় কিছু করতে হলো না। রুম থেকে বের হতে ফাইজান ভাই নিজে ডাক দিল। কাছে এগিয়ে গেলাম।
‘ফুলি খেয়েছিস রাতে?’
‘হুঁ। খেয়েছি।’
‘চেয়ারে বোস। কথা বলি।’
জড়সড় হয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। মাথা নুইয়ে হাতের নখ খুটা শুরু করলাম। ফাইজান ভাই খাওয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল,
‘তোর পড়াশুনার কী খবর?’
আমি জানতাম তার প্রথম প্রশ্ন এটা হবে। ক্ষীণ স্বরে বললাম,
‘ভালো। আপনি কতদিন আছেন?’
‘চলে যেতে হবে আমায়। কত কাজ পড়ে আছে। গিয়ে সব গুছাতে হবে। সামান্তার হঠাৎ অসুস্থতার খবর শুনে কি যে ভয় পেয়ে গেছিলাম। সবকিছু ফেলে রেখে চলে এসেছিলাম।’
‘ওহ্।’
গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা প্রশ্নটা করার সাহস হচ্ছে না। ফাইজান ভাইয়ের সাথে আমি কখনো সহজ হয়ে কথা বলিনি। মালিক আর ভৃত্যের মতো আমাদের মাঝেও কিছু একটা আছে। কিছু একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে। যার জন্য আমি সহজ হয়ে কথা বলতে পারি না। সে যা যা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দিয়ে যাই।
‘তোর আব্বার সাথে যোগাযোগ করতে পারিস নি?’
‘না!’
‘ব্যাপার না। একা বেঁচে থাকার অভ্যাস কর। একটা সময় গিয়ে প্রত্যেকটা মানুষ একা হয়ে যায়।’
ফাইজান ভাইয়ের খাওয়া শেষ। প্লেটে হাত ধুয়ে ফেলল সে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে ভেজা হাত মুছে ফেলল। হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘বুঝলি! মানবজীবন বহমান এক নদী। হাসি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা এগুলো থাকবেই। এগুলো নিয়ে সদা বয়ে যেতে হবে। দুঃখ, বেদনা সবার আছে। ভয় পাবি না কখনো। তবে কিছু কিছু দুঃখ আমরা যেচে গিয়ে সৃষ্টি করি। যেটা না করলে বেঁচে থাকা কয়েক ধাপ সহজ হয়ে যায়।’
আমি চোখ তুলে তাকালাম। ফাইজান ভাইকে কেমন অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে তার এই সুদর্শন মুখশ্রীর ঠিক নিচে গভীর এক দুঃখের বাগান। যে বাগানে পরিচর্চা ছাড়াই নিয়মিত দুঃখের চাষ হয়। লাল, নীল কত দুঃখ! সে একটু থেমে বলল,
‘অনুভূতি! এই একটা জায়গা এসে প্রত্যেকটা মানুষ ধরা খায়। নিজের অজান্তে এমন একজনের জন্য মায়ার সৃষ্টি হয় যার আমার হওয়ার কথা নয়। এই অযাচিত মায়ার জন্য বুকের গহীনে সৃষ্টি হয় এক গভীর ক্ষত। না চাইতেও যে ক্ষত সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।’
খালা বসার ঘরে আছে। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখছে। এখান থেকে তার হাসি হাসি মুখ দেখা যাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে অকপটে বললাম,
‘আপনি সত্যি সত্যি বিয়ে করেছেন?’
‘হ্যাঁ!’
সময় নিল না ফাইজান ভাই। মাথা নেড়ে সায় জানালো। উল্টো আগ্রহ নিয়ে বললো,
‘তুই সন্ধিকে দেখবি ফুলি? দ্বারা দেখাই।’
বলে প্যান্টের পকেট হাতড়াল। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
‘ফোন রুমে রেখে এসেছি। পরে দেখাবো। সন্ধি অনেক ভালো একটা মেয়ে। বছর খানেক আগে বলেছিল, আমায় নাকি পছন্দ করে। তখন কোনো রেসপন্স করিনি। হুট করে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে করবে আমায়? ও এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। আমাকে পেয়ে কি যে খুশি মেয়েটা!’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। হাসি মুখে বললাম,
‘বাহ। খুবই ভালো।’
‘থাক তাহলে। উঠি!’
ফাইজান ভাই দাঁড়িয়ে পড়লো। খালার সাথে দু চারটে কথা বলে উপরে উঠে গেল। আমি মূর্তির মত আগের জায়গা বসে রইলাম। খালা গলা উঁচিয়ে ডাকলো।
‘ফুল আয়। দেখ কি সুন্দর কইরা নাচতেছে। বাচ্চা এক মাইয়া।’
‘তুমি দেখো খালা। মাথা ব্যথা করে আমার।’
‘গিয়া ঘুমা তাইলে। আমি খানিক পর আসতাছি।’
খালাকে বসার ঘরে রেখে চলে এলাম আমি। সব দ্বিধা দূর হলো। ফাইজান ভাই তাহলে সত্যি সত্যি বিয়ে করেছে। তার কথা শুনে মনে হলো সামান্তা আপুর প্রতি কিছুটা দূর্বল ছিল। যার দরুণ এত দ্রুত বিয়ে করে ফেলেছে।
সামান্তা আপু পাগলামো করলে কি হবে! এক বাড়িতে এদের দুজনের বিয়ে প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া নওশাদ আঙ্কেল ফাইজান ভাইকে ততটা পছন্দ করে না। তার মা যে গ্রামের কোনো এক সাধারণ নারী ছিল। সামান্তা আপুর বিয়ে হবে বড় কোনো পরিবারে। যে ছেলের কি না ঢাকাতে রাজকীয় বাড়ি, ডজন খানেক গাড়ি থাকবে। যার বিদেশের ডিগ্রি থাকবে। অত্যন্ত প্রভাবশালী কেউ হবে! তিনি ফাইজান ভাইয়ের সাথে কোনোদিন আপুর বিয়ে দিতেন না। উল্টো পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হতো। সারাজীবনের জন্য একে অপরের অস্বস্তি হয়ে থাকতো। যার জন্য সে আগে ভাগে নিজের পায়ে বেড়ি দিয়েছে। অযাচিত ভাবনার সুতোয় লাগাম টেনেছে।
কিন্তু আপুর কী হবে? সে কি অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকতে পারবে? এটা কি এতই সহজ! পৃথিবীর উপর বড্ড অভিমান জমলো আমার। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলা সেইসব হতভাগাদের জন্য কষ্ট হলো। যে যাকে ভালোবাসে সে কেন তাকে পায় না? তারা তো বেশি কিছু চায় না। প্রিয় মানুষটাকে পাশে চায় শুধু। কাছে চায় শুধু। এটা কি অনেক বড় চাওয়া? পূরণের অযোগ্য? তা না হলে প্রকৃতি এতো দুঃখ কেন দেয়? মন ভাঙ্গার কষ্ট কেন দেয়!
________
বড় মা বিশেষ যত্ন করে খাবার রান্না করছে। রাজ ভাইয়ার পছন্দের সব খাবার। রাজ ভাইয়া বেশ কিছুদিন এখানে ওখানে কাটিয়েছে। দিন দুই হলো বাড়ি এসেছে। আমি যথা সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলেছি। হঠাৎ করে চোখে চোখ পড়লে দ্রুত মাথা নত করে নিয়েছি। অন্যত্র সরে গেছি। সে কিন্তু স্বাভাবিক। সেদিন সন্ধ্যায় যে ভয়ানক কাজ করেছে তা যেন কিছুই নয়। তার মতো বিদেশি সংস্কৃতি গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ানো ছেলের জন্য হয়তো এটা তেমন কিছু নয়। কিন্তু আমার জন্য ভয়ের, আতঙ্কের। মরণ যন্ত্রণার মতো কষ্টের!
বড় মা কে রান্নায় সাহায্য করছিলাম। এমন সময় সামান্তা আপু এলো। বড় মা জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু লাগবে রে সামান্তা?’
‘না!’
আপু না বললেও কেমন অস্থির মনে হলো তাকে। গ্লাসে পানি ঢেলে ঠোঁট ভেজাল শুধু। অহেতুক রান্নাঘরে পায়চারি করলো। এক সময় থেমে গেল। বলল,
‘বড় আম্মু একটা কথা বলবো।’
‘বল।’
‘আমি বিয়ে করতে চাই। সিরিয়াসলি বলছি। ছেলে দেখো।’
সেকেন্ডের মধ্যে বলে দৌঁড়ে চলে গেল। বড় মা আমার দিকে তাকালো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে বলল,
‘বিয়ের কথা বললো না? তাই তো শুনলাম।’
‘বিয়ের কথা বলেছে।’
বড় মা অবাক হলো ভীষণ। সাথে খুশিও হলো। আপু যে ফাইজান ভাইয়ের প্রতি দূর্বল সেটা আপনা-আপনি সবাই বুঝে গেছে। কিন্তু আপুর শরীরের কথা ভেবে কেউ আর প্রতিক্রিয়া করেনি। তাছাড়া ফাইজান ভাই বিয়ে করে ফেলেছে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে খটকা লাগলো আমার মনে। আপু সত্যি সত্যি বিয়ে করবে? আমি হেঁটে বসার ঘরে এলাম। আপু উপরে যায়নি। সোফায় বসে টিভি দেখছে। টিভিতে লাক্সের অ্যাড হচ্ছে। আমি গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম।
‘জুঁই? বসে পড়। একটা দারুণ অনুষ্ঠান হবে এখন।’
আমি বসে পড়লাম। আপুর খিটখিটে মেজাজ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিছুদিন অদ্ভুত আচরণ করেছে। কারণে অকারণে রেগে যাওয়া, কারও কথা না শোনা, সবার সাথে ধমকা ধামকি ছিল নিত্য কাজ। এখন ঠিক হয়ে গেছে। হয়তো সব দুঃখ ছাপিয়ে একটু ভালো থাকার মাধ্যম খুঁজছে। আমার ভাবনার মাঝে আপু বলল,
‘আমার জন্য ফাইজান ভাই বাড়িতে বউ নিয়ে আসতে পারছে না। বড় মুশকিল ব্যাপার। এজন্যে খুব তাড়াতাড়ি তার মুশকিল আশান করার ব্যবস্থা করছি।’
‘কি বলছেন এসব?’
‘একবার আমি এই বাড়ি ছেড়ে গেলেই দেখবি ফাইজান ভাই বউ নিয়ে এসেছে। আমি তো এমনি এমনি কোথাও যেতে পারবো না। পার্মানেন্টলি বাড়ি ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিয়ে করে ফেলবো। একবার বিয়ে করলে জীবনে আর এ বাড়িতে পা রাখবো না। তুই দেখিস জুঁই!’
‘এতো অভিমান কেন করছেন আপু? কার উপর অভিমান করছেন?’
‘অভিমান করছি না। অভিমান করার জন্য হলেও একটা নিজের মানুষ লাগে, আপন মানুষ লাগে। এ পৃথিবীতে আমার একান্ত নিজের বলতে কেউ নেই!’
‘বিয়ে করে তাকে মেনে নিতে পারবেন? সংসার করতে পারবেন?’
আপু অসহায় ভাবে হাসার চেষ্টা করলো। তার চেপে রাখা কষ্টগুলো তবুও যেন বের হয়ে আসছে। সে হেসে বলল,
‘ধুর বোকা! সংসার করতে বেশি কিছু লাগে নাকি? ছিটেফোঁটা মায়ার উদ্রেক হলেই সংসার করা যায়। মানুষ কুকুর, বিড়ালের সাথে বসবাস করতে গিয়ে একটা সময় তার মায়ায় পড়ে যায়। আর আমি আস্ত এক মানুষের সাথে দিনের পর দিন কাটাবো। তার প্রতি মায়া জন্ম নিবে না? সংসার করার জন্য ওই মায়াটুকু যথেষ্ট।’
আমি কথা খুঁজে পেলাম না। আপু ঠিক বলেছে। এই দুনিয়ায় ঠিক কজন মানুষ তার পছন্দের মানুষের সাথে সংসার করতে পারে? হাতে গোনা কয়েকজন। বাকিরা সংসারের মায়ায় পরে সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দেয়। কাটাতে হয়!
_________
আব্বা অসুস্থ। গ্রাম থেকে এই খবর এলো সন্ধায়। মঈন চাচা নিজে এসে জানালো। আমি সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে পড়লাম। গুরুতর অসুস্থ না হলে তো আমাকে জানানোর কথা না। আব্বা আমার থেকে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তবুও প্রতিটা মুহূর্ত তার অভাববোধ করি। প্রতিনিয়ত আলাদা এক টান অনুভব করি। তার রক্ত যে এই দেহে বইছে!
চাচাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম আব্বার কি হয়েছে। চাচা ঠিকঠাক উত্তর দিলো না। শুধু জানালো ভোরবেলা আমায় নিয়ে গ্রামে ফিরবে। ট্রেনে করে! আমি যেন তৈরি হয়ে থাকি।
(চলবে)