ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_১৮

0
718

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_১৮
#অজান্তা_অহি

একদিন দুপুর বেলা আব্বাকে দেখতে এলো তার দূর সম্পর্কের এক বোন। মোমেনা ফুপু। এসে অস্থির হয়ে উঠলো। আব্বার অবস্থা দেখে কষ্ট পেল। তার চেয়ে অবাক হলো যে এই মুহূর্তে আব্বা একা। তার কাছে কেউ নেই। পাশে কেউ নেই। ফুপু অতকিছু জানে না হয়তো। আব্বা যে কতো অন্যায় করেছে তার হিসেব রাখা কঠিন।

ফুপুর সেদিনই চলে যাওয়ার কথা। তাকে যেতে দিলাম না। অনুরোধ করে রেখে দিলাম। আমার বড্ড ভয় হয়। একা একা একদম পারছিলাম না। ফুপুকে রেখে দিতে একটু সাহস বাড়লো।

পরদিন আব্বাকে ভ্যান গাড়িতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সাথে ফুপু আছে। সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তার দেখাতে দেখাতে সারাটা দিন চলে গেল। বিকেল বেলা বাড়ি পৌঁছালাম। সমস্ত দেহ তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। ফিরে বসে রইলাম না। আব্বার হাত-মুখ ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিলাম। সেই সময়টা খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা বেঁচে থাকলে আব্বার অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পেতো। আব্বা যত দুঃখ দিক, কষ্ট দিক তবুও আমি বুঝতাম মা এই মানুষটাকে খুব সমীহ করে। মায়ের বড় দূর্বলতা আব্বা ছিল। টানাপোড়েনের সংসার। তবুও জ্ঞান হওয়ার প্রথম দিকে দেখতে পেতাম, আব্বা মায়ের জন্য লুকিয়ে কিছু কিছু উপহার নিয়ে এসেছে। যৎসামান্য! তবুও মা কি যে খুশি হতো!

মন খারাপ ভাব বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ মাকে দেখতে যাবো। ফুপুর কাছে আব্বার দায়িত্ব দিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম। ফুপু বাঁধ সাধলো। সন্ধ্যা হবে হবে। কিন্তু আমার মন মানলো না! তার নিষেধ না শুনে বের হলাম।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে কবরস্থানে পৌঁছে যাই। গ্রামে আসার পর আরেকবার এসেছিলাম। দূর থেকে দেখে চলে গিয়েছিলাম। আজও দূর থেকে দেখলাম। মা বোনের কবরগুলো মাঝামাঝিতে। এতদূর থেকে দেখতে কষ্ট হয়। মেয়েদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। দূর থেকে অপলক চেয়ে রইলাম। কবরগুলো দেখে এখন চেনার উপায় নেই। জঙ্গল দিয়ে ভরে গেছে। কেউ পরিষ্কার করেনি। কবরের উপর নতুন করে কবর খোঁড়া হয়েছে কি না বোঝা গেল না।

মা বোনের পরিণতি দেখে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়লো। মানুষের জন্ম একটাই। জীবন একটাই। একবার মৃত্যু হলে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বার আসার সুযোগ নেই। অথচ এই একটা জীবন! একটা জনম এদের কত কষ্টে কাটলো। এই দুনিয়ায় কি রেখে গেল? কেউ মনে রাখেনি তাদের! আমারও আজকাল মনে পড়ে না। এতশত দুশ্চিন্তা, এতশত দায়িত্ব, প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই! সময় কোথায় তাদের স্মরণ করার। তবে মনে পড়ে। যখন কেউ দুঃখ দেয়, দুটো কটু কথা শোনায় বা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যখন চারপাশ অন্ধকার দেখি তখন তাদের কথা মনে পড়ে। ভীষণ করে মনে পড়ে!

_______

শেষরাতের দিকে একটুখানি চোখ বুজে এসেছিল। আচমকা ধাড়াম করে কিছু পড়ার আওয়াজ কানে এলো। সাথে মৃদু চিৎকার। লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। অন্ধকারে ফোনের আলো জ্বালাতে চমকে গেলাম। আব্বা চৌকির উপর নেই। নিচে পড়ে ছটফট করছে। ধাক্কা দিয়ে পাশ থেকে মোমেনা ফুপুকে তুলে দিলাম। দৌঁড়ে আব্বার কাছে গিয়ে ডাকলাম। আব্বা কোনো প্রতিত্তর করলো না। ফুপুর সাহায্য নিয়ে তাকে বিছানায় তুললাম। ঘরে একটা মাত্র চৌকি। সেখানে আব্বাকে ঘুমাতে দিয়েছিলাম। আমি আর ফুপু মাটিতে বিছানা করে শুই। আব্বা হঠাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেল কি করে? মাটিতে কিছুদিন থেকে তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। যার জন্য বিছানায় নিয়েছি।

কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করলাম। নতুন ঘর তোলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাতির লাল আলোতে দেখলাম আব্বা কেমন যেন করছে। ছটফট করছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। ভীত হয়ে গেলাম আমি। আব্বাকে ডেকে বললাম,

‘আব্বা কষ্ট হচ্ছে? কথা বলো। কিছু বলো।’

আব্বার শরীর কুঁকড়ে আসছে। ফুপু বললো হাতে পায়ে তেল দিতে। ছুটে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে তেল নিয়ে এলাম। কালোজিরা মিশ্রিত পড়া তেল। ঈমান কবিরাজের দোয়া দরুদ পড়ে ফু দেওয়া। আমি তেল হাতের তালুতে নিয়ে আব্বার পায়ে মালিশ করলাম। ফুপুকে বললাম,

‘আব্বা এমন করছে কেন ফুপু?’

‘বুঝতেছি না। ডাক্তার ডাকতে হইবো মনে হয়।’

‘এতো রাতে ডাক্তার ডাকতে যাবো কি করে?’

‘হেইডাই তো! ডাক্তার থাকে গাঙের ওপার। একা মাইয়া মানুষ কেমনে যাবি! ভালো কইরা তেল মালিশ কর। একটু আলো ফুটুক।’

‘হুঁ!’

ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। রাজ্য সমান ভয় নিয়ে ভোরের অপেক্ষায় রইলাম। কখন একটু আলো ফুটবে, আর কখন একটু ডাক্তার ডাকতে পারবো। কিন্তু বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে পারলাম না। আব্বার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা নির্গত হচ্ছে। চেঁচিয়ে কিসব বলছেন তিনি। নড়চড় বিহীন দেহ টা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,

‘ফুপু পাশের বাড়ির কাউকে ডাক দাও। মদিনার মাকে ডাকো।’

‘যাইতাছি।’

ফুপু দৌঁড়ে বাইরে গেল। আশপাশের মানুষ ডাকতে। বাড়ির কাছে কেউ নেই। এজন্য চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পারছে না। একমাত্র মদিনাদের বাড়ি একটু কাছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই এলো। দুজন ছুটলো গ্রাম্য ডাক্তার ডাকতে। কেউ কেউ কালিমা পড়তে লাগলো। আমি ভয়ার্ত চোখে দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীর কাপছে থরথর করে। আর পারছি না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। আমি দরজায় ভর ছেড়ে দিলাম।

ছোট গাঙের ওপার থেকে ডাক্তার আসতে আসতে আব্বা মারা গেল। আমার চোখের সামনে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। আব্বার মরণ সময় কি যে যন্ত্রণা হলো! মনে হলো কারো অভিশাপ লেগেছে। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। ছুটে পালানোর জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পা নাড়াতে পারলাম না। একচুল সরতে পারলাম না। চেয়ে চেয়ে আব্বার যন্ত্রণা দেখলাম। একসময় আব্বা স্থির হয়ে এলো। তার সব যন্ত্রণার অবসান ঘটলো। চোখজোড়া বন্ধ। ওই নেত্র এ জীবনে আর খুলবে না।

মৃত্যুর গন্ধ দ্রুত ছড়ায়। আব্বার খবর বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়লো। অনেকে এলো। বাড়ির কয়েক হাত উঠানে ভিড়। তবে মরা বাড়ি হলেও কান্নার আওয়াজ নেই। কে কাঁদবে? আব্বার আপনজন কেউ নেই। আব্বা কখনো কারো উপকার করেনি। দুটো ভালো কাজ করেনি যে কেউ তার জন্য চোখের জল ফেলবে। গাল ভিজাবে। কেউ কাঁদলো না।

এক সময় মোমেনা ফুপু গুনগুন করে কাঁদা শুরু করলো। আমি বাইরে বের হয়ে আসলাম। ভোরের আলো ফোটার সময় হয়ে গেছে। ওড়নার আঁচল থেকে খুলে ফোনটা হাতে নিলাম। আব্বার ফোন। কল লিস্টে গিয়ে মঈন চাচাকে ফোন দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চাচা ফোন ধরলো। চিন্তিত মুখে বলল,

‘কি হইছে জুঁই? এতো ভোরবেলা ফোন দিছো?’

‘আব্বা বেঁচে নাই চাচা।’

বলতে গিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। বুকে তীব্র জ্বলুনি। দম আটকে আসছে। আব্বা আর বেঁচে নেই। এই অমোঘ সত্যটা টের পেলাম। ফোন রেখে দিলাম আমি। চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করলো। দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললাম।

________

মরা বাড়ি! অথচ কি নিঃশব্দ। নিদারুণ নিস্তব্ধ! কান পাতলে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। আব্বাকে খুপড়ির ঘরের মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে। তাকে ঘিরে দু-চারজন অল্প বয়সী মেয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আমি বেড়ার সাথে থিতু হয়ে বসেছিলাম। মোমেনা ফুপু ঘন ঘন চোখ মুচছে। আর আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই। জীবনে এর চেয়ে কত বড় বড় দুঃখ পেয়েছি! পরক্ষণে মনে হলো, দুঃখে ছোট বড় বলতে কিছু নেই। দুঃখ তো দুঃখই! সব দুঃখে ব্যথা অনুভূত হয়। কষ্ট অনুভূত হয়।

দুপুরবেলা মঈন চাচা এলো। তার সাথের ব্যক্তিটিকে দেখে ওই অবস্থায়ও কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম। রাজ ভাইয়া এসেছে।

চাচা আসতে বাড়ি আর নিরব রইলো না। হইচই করে কান্না শুরু করল সে। আমি বুঝতে পারলাম আব্বা অন্তত একজন মানুষের কাছে মহানুভব। আব্বা মঈন চাচার কি উপকার করেছিল বা তাদের মধ্যে ঠিক কিসের বন্ধুত্ব সঠিক জানি না। মঈন চাচাকে কয়েক বার জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাইনি। কিন্তু এটা বুঝি যে চাচা আব্বাকে ভীষণ মান্য করে। ভালোবাসে! চাচার কান্না আর আহাজারি দেখে নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো।

রাজ ভাইয়া কাছে এসে বলল,

‘কান্না করে না জুঁইফুল। কেউ মারা গেলে কাঁদতে নেই।’

আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। অনুভব করলাম এই এতোবড় দুনিয়ায় আমার আপনজন কেউ নেই। আমার রক্তের কেউ নেই। একা একা বাকি পথ পাড়ি দিবো কি করে! আমি ভীষণ অসহায়।

সন্ধ্যার পর পর আব্বাকে কবর দেওয়া হলো। লোকমুখে শুনলাম জানাযায় তেমন মানুষ হয়নি। এটা জানা ছিল আমার। সাধারণ মানুষদের জানাযায় মানুষ হয় না। সবাই যার যার জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত। চরম ব্যস্ত। একজন মরা মানুষের পিছনে সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয়? হয় না! ওই সময়টুকু পরিশ্রম করে, রিকশা চালিয়ে দু পয়সা আয় করা যাবে। ছেলের জন্য পছন্দের খেলনা কেনা যাবে। বা অন্যকিছু করা যাবে।

তবে ধনীদের হিসাব আলাদা। তাদের মৃত্যুতে সবাই দুঃখ প্রকাশ করে। লোক দেখানো যাওয়া হলেও তাদের জানাযায় গাদা গাদা মানুষ হয়। পুতুলের জন্মের সময় এ গ্রামের মেম্বার মারা গেল। সবার মধ্যে সে কি আহাজারি! তার জানাযায় কয়েক গ্রাম লোক হলো।

নির্জন রাতের বেলা আব্বাকে রেখে এলো। বাড়ি তখন খালি। সেই রাতের বেলা আমার ভয় হলো। তীব্র ভয়। আমি এক সেকেন্ডের জন্য মোমেনা ফুপুর হাত ছাড়লাম না। তাকে বাথরুমে যেতে দিলাম না। ভয়ে, আতঙ্কে জমে রইলাম। মনে হলো আব্বার চিৎকার কানে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে আব্বা একা। তার সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু কিছু করতে পারলাম না।

__________

আব্বা নেই তিনদিন হয়ে গেছে। আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেছি। আর ছুটে চলার ইচ্ছে নেই, শক্তি নেই। ভেতরে বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাস নেই। আপনজন ছাড়া, ভালোবাসার মানুষ ছাড়া, কাছের মানুষ ছাড়া বেঁচে থাকা কি যে যন্ত্রণার!

বিকেল বেলা ঘরের বাইরে বসে ছিলাম। মাটিতে পা মেলে। মঈন চাচা এলো। বলল,

‘কাল ভোরে ঢাকা রওনা দিবো। জিনিসপত্র গুছায় রাইখো। আর হয়তো কখনো গ্রামে ফেরা হবে না।’

শেষের কথাটা চাচা নিচুস্বরে বললো। চাচা এখানকার সব হিসাব মিটিয়ে দিয়েছে। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, আমি আর ঢাকা ফিরবো না। এখানে থাকবো। এই গ্রামে থাকবো। এই গ্রামে আমি প্রাণ খুঁজে পাই। আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আমি আর ওই যন্ত্রের শহরে ফিরবো না।

বলা হলো না। আমি নিরূপায়। ঢাকা ফেরা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘ঠিক আছে।’

চাচা চলে যেতে রাজ ভাইয়া এলো। গত তিনদিনে তার সাথে আমার কথা হয়নি। সে নিজের মতো কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেরিয়েছে। এসে বলল,

‘কাল তো ঢাকা ফিরবে। আজ একটু বের হবে নাকি? গ্রাম দেখার জন্য?’

আমি উত্তর দিলাম না। শহুরে মানুষকে গ্রাম দেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার উত্তর না পেয়ে সে বলল,

‘কাল ঢাকা ফিরলে কিন্তু আর সহজে গ্রামে ফেরা হবে না জুঁইফুল। শেষবারের মতো তোমার আপনজনদের দেখবে না?’

চমকে তার মুখপানে তাকালাম। আমি জানি এইবার ঢাকা গেলে আর কোনোদিন এখানে ফেরা হবে না। অথচ এই গ্রামে আমার কতকিছু রয়ে গেছে। জীবন এমন নিষ্ঠুর কেন?

সন্ধ্যার পর বের হলাম। সাথে রাজ ভাইয়া। চাচার কাছে সব জেনে গেছে সে। আমার মা বোনের হারিয়ে যাওয়া অতীতসহ সব। প্রথম শুনে রাগ উঠলেও পরক্ষণে রাগ পড়ে গেছে। অন্তত একজন তো আমার নিষ্ঠুর অতীত জানে! অন্তত এই একজনের কাছে তো আমার নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে না। আড়ালে রাখতে হবে না।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের রাস্তায় ঝলমলে আলো নেই। চারপাশ অন্ধকার। রাস্তা দিয়ে দীর্ঘ সময় পর পর একটা করে রিকশা যাচ্ছে। কখনো বা সাই করে একটা বাইক ছুটে যাচ্ছে। রাজ ভাইয়া আর আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। তাকে নিয়ে রাতে বের হয়েছি যাতে পরিচিত কারও নজরে না পড়ি। রাজ ভাইয়া নিশ্চুপ হেঁটে চলেছে। এই ছেলেটা এক সন্ধায় আমার জীবনের প্রথম চু’মুটা কেড়ে নিয়েছে। তাকে যে ঢাকায় থাকতে প্রচন্ড ভয় পেতাম, তার থেকে দূরে দূরে থাকতাম সেটা ভুলিনি। তবুও আমার মনে হলো কোথায় যেন কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। অদ্ভুত রহস্যময় হলেও ছেলেটাকে আমি আর ভয় পাচ্ছি না। গ্রামের নির্জন রাস্তা ধরে সম্মুখে হাঁটছি। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। রাজ ভাইয়াকে নিশ্চুপ দেখে বললাম,

‘আপনি গ্রামে এসেছেন বাড়ির কেউ জানে?’

‘জানে না! লুকিয়ে এসেছি। চাচার সাথে ট্রেনে উঠার পর বাড়িতে ফোন দিয়েছি। বলেছি যে আমি সিলেট যাচ্ছি। এক বন্ধুর বাড়ি।’

‘ওহ্!’

এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে থেমে গেলাম। মনে হলো রাজ ভাইয়া যে উত্তর দিবে তা শুনতে চাই না আমি। বুকের ভেতর প্রচন্ড খালি খালি লাগছে। এই গ্রাম, এই পথ, এই পরিচিত ঘ্রাণ আর কখনো পাবো না। এই রাস্তা ধরে রাফি ভাইকে দেখতে দেখতে কত হেঁটেছি। সে রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটতে থাকতো। আমি ওপর পাশে। পিছিয়ে যেতাম তার থেকে। যাতে দেখতে সুবিধা হয়। তার হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন, হাসি সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। এতশত স্মৃতি ভুলবো কি করে! হঠাৎ করে বলে উঠলাম,

‘জানেন, আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম। নিজের অস্তিত্ব ভুলে এই গ্রামের এক ছেলেকে ভালোবেসে ছিলাম। ছেলেটা নিজের ভাবনার সাথে এতটা মিশে গিয়েছিল যে প্রায়ই তাকে নিয়ে হ্যালুসিনেশন হতো।’

রাজ ভাইয়া কিছু বললো না। তবে তার হাঁটার গতি কমে গেল। আমিও ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগলাম। বললাম,

‘এইবার আড়াই বছর পর গ্রামে এসেছি। তার সাথে আমার দেখা হয়নি। গ্রামে ফেরার পর এক বিকেলবেলা হঠাৎ দেখি সে হেঁটে এসে উঠানে দাঁড়ালো। খুপড়ি দরজা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম আমি। গায়ের ওড়না ঠিক করে দ্রুত বের হয়ে দেখি সে নেই। উঠোন সম্পূর্ণ ফাঁকা। দৌঁড়ে রাস্তায় গেলাম। এদিক ওদিক খুঁজলাম। তার দেখা পেলাম না। কোথাও সে নেই। পরদিন তার বাড়ি গিয়ে শুনি সে গ্রামেই নেই। ঢাকাতে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে বিদেশ চলে যাবে।’

বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাজ ভাইয়া বুঝতে পারল হয়তো। বলল,

‘কষ্ট পেয়ো না। জীবন অসংখ্য দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি। না পাওয়ার বেদনা, হারিয়ে ফেলার কষ্ট নিয়ে তবুও রোজ ভালো থাকার যুদ্ধ করে যেতে হয়। এই পৃথিবীতে কেউ সুখে নেই। সবারই কিছু গোপন দুঃখ রয়েছে। কিছু একান্ত ব্যক্তিগত হাহাকার রয়েছে। কুড়েঘরে থেকে কেউ সুখে নেই। বিশ তলার উপর ঘুমিয়েও কেউ সুখে নেই। দিনশেষে সবাই অসুখী। পৃথিবীর আনাচে কানাচে কেউ ভালো নেই। এটা নির্মম সত্য!’

‘আগে আমি বুঝতাম শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয়। দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসলে সংসার করা যায়। কিন্তু তা হয় না! শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয় না।’

‘শুধু ভালোবাসা দিয়ে কখনো সংসার হয় না। সংসার একটা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো। বিক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপে সম্পন্ন হওয়ায় জন্য অসংখ্য প্রভাবক লাগে। তা না হলে সেটা মাঝপথে থেমে যায় বা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংসার করার জন্যও তেমন টাকাপয়সা, ধৈর্য্য, দায়িত্ব-কর্তব্য, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, বড়দের আশীর্বাদ সহ অসংখ্য প্রভাবক লাগে। শুধু ভালোবাসা দিয়ে স্থায়ী সংসার হয় না।’

আমি আর কিছু বললাম না। বুকের কোণে চেপে রাখা কষ্টগুলো দাপাদাপি করছে। আমি জানি রাফি ভাইয়ের সাথে আমার কখনো সংসার করা হবে না। তার সাথে সংসার না করতে পারার আফসোস আমার এই জীবনে শেষ হবে না।

কবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। রাজ ভাইয়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সম্মুখে এসে বলল,

‘সামান্তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুনেছ?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here