#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_১৯
#অজান্তা_অহি
কবর স্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। রাজ ভাইয়া হঠাৎ সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। বলল,
‘সামান্তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। শুনেছ?’
‘হুঁ? কার বিয়ে?’
‘সামান্তার বিয়ে! বাসায় তো হুলস্থূল অবস্থা। বড়সড় আয়োজন করা হবে। পরিবারের একমাত্র মেয়ে ও। সবার ভীষণ আদরের।’
হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। সামান্তা আপুর সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে? আমি ভেবেছিলাম আপু হয়তো মজা করছে। সাময়িক দুঃখ দূর করার জন্য বলছে। কিন্তু এতদূর গড়াবে বুঝতে পারিনি। ভেতর থেকে গভীরতর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বিয়ে না করেই বা কি করবে! আপুর পছন্দের মানুষটাকে কাছে পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। ফাইজান ভাই তার ভালোবাসার পথে এক দূর্ভেদ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। এই দেয়াল ভেদ করে অপরপাশের মানুষটির কাছে পৌঁছানো যায় না। উল্টো ঘোরা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।
তবুও একগাদা প্রশ্নে মনে উঁকি দিল। সেগুলো ধামাচাপা দিয়ে রেখে দিলাম। কাল সকাল বেলা ঢাকা ফিরছি। তখন আপনা-আপনি সব জানতে পারবো। রাতটুকু অপেক্ষা মাত্র। আপাতত জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপু কি রাজি এই বিয়েতে?’
‘হ্যাঁ রাজি। তোমার সন্দেহ হচ্ছে, তাই না? আমারও এমন সন্দেহ হয়েছিল। ঝোঁকের মাথায় এসব করছে কি না! এজন্য আমি পার্সোনালি ডেকে জিজ্ঞেস করেছি। সামান্তা উত্তর দিয়েছে সে সত্যি রাজি।’
‘কিন্তু?’
রাজ ভাইয়া বাঁধা দিলো। বলল,
‘তুমি কি বলবে বেশ বুঝতে পারছি। সেটা সম্ভব না। ফাইজান ইতোমধ্যে বিবাহিত। অবিবাহিত থাকলেও এটা কখনো সম্ভব ছিল না। মাথা খারাপ নাকি! জীবন ফাজলামো করার জায়গা?’
রাজ ভাইয়ার কণ্ঠে কঠোরতা। অহেতুক তেজ! মুহূর্তের মধ্যে কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ফাইজান ভাইয়ের কথা উঠলে অস্থির হয়ে উঠে সে। আমি কথা ঘুরালাম। বললাম,
‘এদিকে আসেন।’
এগিয়ে গেলাম কবরস্থানের দিকে। জায়গাটা আগের থেকে উন্নত হয়েছে। চারপাশে ইটের প্রাচীর তোলা। বুক পর্যন্ত উচুঁ প্রাচীর। আগে বাঁশের বেড়া ছিল। তার ভেতর দিয়ে শেয়াল, কুকুরসহ সব জ’ন্তু জা’নোয়ারের প্রবেশ ছিল। বেদনাতুর বিষয়। কবরস্থান মানুষের শেষ আশ্রয়। দেশ ঠিকানা! দীর্ঘস্থায়ী সময় কাটাতে হবে এখানে। মনে হলো এই জায়গাটার বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।
রাজ ভাইয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। আমি একদৃষ্টিতে মা বোনের কবরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে প্রশ্ন জাগলো। বড় আপা কেমন আছে? আপার স্বামীর কী একবারও আপার কথা মনে পড়ে না? আপা কি পরিমাণ ভালোবাসতো তাকে! প্রথম বার পেটে সন্তান আসার পর আপা কি যে খুশি হয়েছিল। প্রায়ই মাঝরাতে আমায় ডেকে তুলতো। বলতো, ‘জুঁই ঘুমায় গেছিস?’
দুচোখ তখন আমার রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর। মন তখন কল্পনার রাজ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখ জোড়া খুলতাম না। আপা মৃদু ধাক্কা দেওয়া শুরু করতো তখন। বিরক্ত হয়ে একসময় বলতাম,
‘বলো। শুনছি আপা।’
‘দেখ! বাবু নড়াচড়া করছে। তুই হাত দিয়ে দেখ! এইতো মাত্র লাথি দিল।’
আপার কণ্ঠে পৃথিবীর সব উচ্ছ্বাস এসে জড়ো হতো। বাচ্চাদের মতো ঝলমলে কণ্ঠ। খুশির জোয়ারে ভাসছে সে সুর। এতটুকু ভণিতা নেই। আমার ঘুম তখন পুরোপুরি উধাও হয়ে যেত। আমি জানতাম আপার পেটের বাবুর লাথি দেওয়ার বয়স হয়নি। অল্প কয়েক মাস মাত্র। তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম,
‘হ্যাঁ। তাই তো মনে হচ্ছে আপা। নড়াচড়া করছে।’
আপা খুশিতে কাছে ঘেঁষে আসতো। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলতো,
‘তোর দুলাভাই আসতেছে না কেন রে? কতদিন হয়ে গেল। বাবুর জন্য জামা আনতে বলছিলাম।’
‘আপা, পাগল নাকি তুমি? ছেলে বাবু হবে নাকি মেয়ে বাবু হবে সেটা তো জানো না। জামা কিভাবে আনবে?’
‘ছেলে বাবু হবে রে। তোর দুলাভাইয়ের মতো হবে। দেখিস।’
আমি অবাক হয়ে বলতাম,
‘কি যে বলো! তুমি কিভাবে বুঝলে?’
‘মেয়েরা মা হলে সব বুঝতে পারে। টের পায়। একদিন মা হবি যখন তখন বুঝবি। মা হওয়া মধুর এক অনুভূতি।’
আপা লজ্জা পেতো। মুখ লুকিয়ে ফেলতো বালিশের চিপায়। আমি আবছা অন্ধকারে আপার সুখী সুখী মুখ দেখতাম। বাচ্চা পেটে আসার পর আপা ঠিকমতো খেতে পারতো না। কাজ করতে পারতো না। রাতে ঘুমাতে পারতো না। তবুও আলাদা এক প্রশান্তি তার চেহারা জুড়ে থাকতো।
চোখের কিনার অশ্রুতে ভরে উঠলো। আপার অনাগত সন্তান কেমন আছে? সে কি সত্যি সত্যি ছেলে হতো? জানার উপায় নেই। এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আসার আগে ভাগে তার জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেললাম।
আব্বাকে কোন পাশে শুইয়ে রেখেছে জানতাম না। কিন্তু কবর চিনতে অসুবিধা হলো না। গত তিনদিনে গ্রামের কেউ মারা যায়নি। নতুন কবর একটাই! দক্ষিণ দিক ঘেঁষে কবরটা। নতুন বাঁশের বেড়া দেওয়া।
রাস্তার পাশের লাল আলোয় কেমন রহস্যময় লাগছে সে কবর। চকিতে আমার মনে হলো, আব্বা ভালো আছে তো?
_________
ভোরবেলা খালি পেটে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। ভিটেতে কিছু নেই। কয়েকটা চকচকে টিন ছাড়া। সে টিনও বিক্রি হয়ে গেছে। শাকের কাকা কিনে নিয়েছে। আমরা আজ যাওয়ার পর এসে টিন গুলো খুলে নিয়ে যাবে। ঘরেও কিছু নেই। টুকটাক যা জিনিসপত্র ছিল সব বিক্রি করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আব্বা বেশকিছু টাকা ঋণ ছিল। মঈন চাচা সব মিটিয়ে দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মনে ক্ষীণ আশা ছিল। ছোট মা হয়তো খানিক সময়ের জন্য আসবে। কিন্তু সে এলো না। আব্বার মৃত্যু খবর শুনেছে কি না জানা নেই। শোনার কথা! আব্বার মৃত্যুর সংবাদ আশপাশের কয়েক গ্রাম রটে গেছে। অসুস্থ হয়ে ভুগে ভুগে মৃত্যু। এখনো সবার মুখে মুখে। আলোচনার শীর্ষে! মৃত্যু খবর শোনার পরও ছোট মা আসেনি।
বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। এলোমেলো পায়ে হাঁটছি। মোমেনা ফুপু সাথে সাথে আসছে। ফুপু যায়নি। আরেকটু বেলা হলে চলে যাবে। বড় রাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়ালাম। ফুপু হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। বলল,
‘তোরে না হয় আমার লগে নিয়া যাইতাম। কিন্তু আমার হাতে কি কিছু আছে! ছেলেপুলে বড়ো করছি। তাগো বউ-বাচ্চা আছে। তারাই এহন পরিবারের মাথা। তোর ফুপা মারা যাওয়ার পর থিকা দুঃখের সীমা নাই আমার। কত যে কষ্ট কইরা মুখ গুঁজে পড়ে আছি! দিনরাত বউ গো কথা হুনতে হয়। এই যে কতদিন হইলো তোগো এইহানে আছি। একজন খবর নিচে? নেয় নাই! আরো একমাস বাইরে থাকলেও খোঁজ নিবো না। বাইচা আছি নাকি মইরা গেছি খোঁজ নিবো না। এমন জা’নোয়ার পেটে ধরছিলাম। তোরে আর কোথায় নিয়া রাখবো।’
‘ফুপু আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ঢাকাতে ভালো থাকবো।’
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো ফুপু। মঈন চাচা রিকশা নিয়ে ফিরছে। আমি পা বাড়াতে হাতে টান পড়লো। ফুপু মুঠোয় কিছু গুঁজে দিল। হাতটা সামনে নিয়ে দেখি কিছু মোচড়ানো টাকা। বহুদিনের পুরোনো আর ময়লাযুক্ত। পরিমাণও অল্প। অথচ তাতেই আমার চোখ ভিজে উঠলো। এইটুকু উপহারের মধ্যে কত যে ভালোবাসা লুকায়িত আছে! চোখের জল লুকাতে আমি তড়িঘড়ি করে গিয়ে রিকশায় বসে পড়লাম।
রিকশা ছাড়লো। কিছুদূর যেতে পেছন ঘুরে তাকালাম। ফুপু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেমন ছবির মতো লাগছে তাকে। গ্রাম বাংলার অসহায় এক নারীমূর্তি। যার জনমটা দুঃখের সাথে যুঝতে যুঝতে যাচ্ছে।
চেয়ে থাকতে থাকতে জীবন্ত ছবি অদৃশ্য হয়ে গেল। রিকশা ওয়ালা মামা বাঁক নিয়েছে। আমি ভোরের প্রকৃতির পানে চেয়ে রইলাম। বিষণ্ণ দৃষ্টি আসতে আসতে ঝাপসা হয়ে এলো। সবুজ গাছপালা ধোঁয়াসে হয়ে এলো। আহারে জীবন! এই জীবন আমার গ্রাম, আমার আপন মানুষ, আমার ভালোবাসার মানুষ সব কেড়ে নিল।
গ্রাম থেকে বেশ দূরে রেল স্টেশন। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্মে তখন প্রচন্ড ভীড়। ভ্যাপসা গরম। এসবের মধ্যে ঘামতে লাগলাম। মঈন চাচা যাত্রী ছাউনীতে আমায় বসিয়ে দিলো। বলল,
‘কাউন্টার থেকে ঘুরে আসি। দেখি ট্রেন কখন আসে।’
‘ঠিক আছে!’
চাচা চলে গেল। গলা শুকিয়ে আছে। দৃষ্টি মেলে চারপাশের ছুটন্ত মানুষ দেখছিলাম। পাশ থেকে কেউ বলল,
‘চা খাও।’
বুকের ভেতর হালকা কেঁপে উঠলো। তাকিয়ে দেখি রাজ ভাইয়া। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনিচ্ছা সত্বেও হাতে নিলাম। ছাউনিতে বসার জায়গা নেই। এক চিলতে জায়গা নিয়ে কোনরকমে বসে আছি। এজন্য রাজ ভাইয়াকে বসতে বলতে পারলাম না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল।
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসলো বেশ দেরিতে। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট তিরিশেক পর। ভিড় ঠেলে সিট পর্যন্ত পৌঁছাতে নাজেহাল দশা। জানালার কিনার ঘেঁষে বসে অবশেষে হাঁফ ছাড়লাম। ছোট ছোট দুটো কাপড়ের ব্যাগ। মঈন চাচা সেগুলো উপরে রেখে আমার পাশের সিটে এসে বসলো।
আড়চোখে রাজ ভাইয়া কে লক্ষ্য করলাম। আমাদের সিট সোজা অপরপাশে বসেছে সে। ছেলেটা জীবনের অনেকটা সময় বিদেশে কাটিয়েছে। আজ ভিড় ঠেলে উঠতে গিয়ে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বুঝলাম কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তার এই অহেতুক কষ্ট করার কারণ উদ্ধার করতে পারলাম না। ট্রেনের জানালা দিয়ে পানির বোতল কিনলো সে। ছিপি খুলে কয়েক ঢোক গেল। পরমুহুর্তে ঝকঝকে বোতলটা উচুঁ করে ইশারায় বলল,
‘খাবে?’
আমার দৃষ্টি তার পানে ছিল। মাথা নেড়ে না সম্বোধন করলাম। দ্রুত তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকালাম।
ট্রেন ছেড়েছে। লোহাতে মৃদু ঝংকার তুলে ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ বাইরের প্রকৃতি দেখলাম। জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপটা আসছে। বাতাসের ধাক্কায় চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। কতরাত হলো ঘুম হয় না। বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন শ্বাস নিতেও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম।
__________
কমলাপুর যখন পৌঁছলাম তখন বেলা গড়ে গেছে। শহর জুড়ে বিষণ্ণ বিকেল। রাজ ভাইয়া এগিয়ে এলো। বলল,
‘সারাদিন তো কিছু খেলে না। এখানে হোটেল আছে। খাবে চলো।’
‘খাবো না কিছু। খিদে নেই।’
মঈন চাচা ব্যাগ দুটো নামিয়ে রাখলো। বলল,
‘খাইলে ভাত খাও তাইলে। ভাতের হোটেল আছে।’
‘আমি কিছু খাবো না চাচা। এতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম। অসুস্থ লাগছে।’
‘ঠিক আছে। তাইলে সরাসরি বাড়ি যাই।’
ট্রেনে কলা খেয়েছিলাম শুধু। আর কিছু পেটে পড়েনি। আগে ভালো খাবার খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। আব্বা হাটবারে বড় বড় মাছ কিনে আনতো। সস্তা ধরনের মাছ। তবুও কত মজা নিয়ে খেতাম। এখন রাজ ভাইয়াদের বাড়িতে কত পদের রান্না হয়। নিজে সাথে থেকে সব করি। তবুও আগ্রহ পাই না। সময়ের সাথে সাথে মুখের রুচি কবে যে উধাও হয়ে গেছে টের পাইনি।
মঈন চাচা গাড়ির খোঁজে গিয়েছে। রাজ ভাইয়া এসব কাজে আনাড়ি। সে ফিটফাট পোশাক পরিহিত। পাশ দিয়ে গমনরত প্রতিটি ব্যক্তি তাকে দেখছে।
আমার মাথায় মাছ নিয়ে ছোট্ট এক ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ছোটবেলার ঘটনা। কাউকে না বলে শান্তি পাচ্ছি না। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে অবশেষে রাজ ভাইয়াকে ডাকলাম। উচ্ছ্বাস নিয়ে বললাম,
‘একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। জানেন, ছোটবেলায় ইলিশ মাছ চিনতাম না আমি। সিলভার কার্প মাছকে ইলিশ মাছ বলে জানতাম। গ্রামে প্রতি বৃহঃস্পিবার সাপ্তাহিক হাটের দিন ছিল। ওইদিন মাছ, তরিতরকারি সস্তা পাওয়া যেত। আব্বা প্রতি হাটবারে মাছ কিনে আনতো। এশার আযানের পর ব্যাগ ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতো সে। বড় আপা মাছ কুটতে বসত। মা নামাজ শেষ করে আরেকটা বটি দিয়ে তরিতরকারি কাটা শুরু করতো। মাকে ঘিরে আমরা বসে থাকতাম। কখন রান্না হবে। কখন খাবো! সেদিন মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে যেত। স্কুলের বান্ধবীরা প্রায়ই খাবার নিয়ে আলোচনা করতাম। ক্লাসে যেতে সবাই বলাবলি করতাম, কে কী দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছি। এই আলোচনায় আমি প্রায়ই বলতাম, ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছি। ওরা অবাক হতো। একদিন তো বন্যা বলে বসলো, তোরা এত ইলিশ মাছ খাস? ইলিশ মাছের তো অনেক দাম। সেদিন মনে সন্দেহ ঢুকে গেল। এরপর আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম ইলিশ বলতে যে মাছটা চিনে এসেছি সেটা ইলিশ নয়।’
পুরনো দিন মনে পড়ে ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো আমার। অভাবের সংসার ছিল। তার মধ্যে এতগুলো বোন। আব্বা-মা এমন কতশত ধোঁকা দিতো। ইদে একশো তিরিশ টাকার জামা কিনে এনে বলতো পাঁচশো টাকা নিয়েছে। বাজারে আর নেই। এই একপিস ছিল। ছলনার দিন! তবুও কি মধুর ছিল!
রাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে চুপসে গেলাম আমি। সাথের এই ব্যক্তির সাথে আমার যে আমার যোজন যোজন দূরত্ব ভুলতে বসেছিলাম। তার সাথে ঘনিষ্ঠ সুরে কথা বলার মতো সম্পর্ক নয়। জাবির বা ফাইজান ভাই অথবা সামান্তা আপু হলে অন্যকথা ছিল। অস্বস্তি নিয়ে এদিক সেদিক চাইলাম। দূর থেকে মঈন চাচা দেখা দিল। গাড়ি ডেকে নিয়ে এসেছে।
চাচা কাছে আসতে রাজ ভাইয়া বলল,
‘আপনারা যান।’
‘তুমি কই যাবে? বাড়ি ফিরবে না?’
চাচার প্রশ্নে সে উত্তর দিল,
‘আমি যে আপনার সাথে গ্রামে গিয়েছিলাম বাড়ির কেউ তো জানে না। একসাথে ফিরলে সন্দেহ করবে। আপনি বরং আজ বাড়ি যান। আমি দুদিন পর ফিরবো।’
‘দুদিন কোথায় থাকবেন আপনি?’
মুখ ফসকে প্রশ্ন টা বের হয়ে গেল। পরক্ষণে বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। এতো কৌতূহল থাকা ভালো নয়। রাজ ভাইয়া অবশ্য দ্রুত উত্তর দিল। বলল,
‘আমার থাকার জায়গার অভাব নেই। আমি আসি।’
কাকে যেন ফোন করতে করতে সে চলে গেল। কিছুদূর যেতে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল। আর দেখতে পেলাম না। চারিদিকে মানুষের ছুটোছুটি। চরম ব্যস্ত সবাই। জীবনের উপর আফসোস হলো। প্রতিনিয়ত ছুটে চলা এই মানুষগুলো একদিন আপনা-আপনি স্থির হয়ে আসবে। সেদিন বুঝবে যে পৃথিবীর সবকিছু আপেক্ষিক। শুধু দুঃখটা চিরস্থায়ী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাচার সাথে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
________
সামান্তা আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসের সাত তারিখ। শুক্রবার। বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে। সে কার্ড সারা শহর ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার খানেকের বেশি মানুষ দাওয়াত করা হয়েছে। পুরোদস্তুর এলাহি কাণ্ড।
সালেহা খালার থেকে শুনলাম ছেলে ব্যারিস্টার। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া। প্রচুর সম্পদের মালিক। ছেলের বাবা ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা কিছুর অভাব নেই। বিয়ের পর নাকি বিদেশে স্থায়ী হয়ে যাবে।
এই বিয়েতে বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি। হেসে খেলে সবাই আয়োজন করছে। ঘর বাড়ি সাজাচ্ছে। জিনিসপত্র কিনছে। অথচ যাকে ঘিরে এই আয়োজন সেই সামান্তা আপু পাথরের পুতুল হয়ে গেছে। নিশ্চুপ! কথা নেই, হাসি নেই, নিয়ম মত খাওয়া নেই। আপুর অবস্থা দেখে আমার ভারী কষ্ট হয়। আপুর ঠোঁটে কি সেই আগের মতো প্রাণবন্ত হাসি ফুটে উঠবে না? আর কি আগের মত উচ্ছ্বসিত হতে পারবে না? বুক ভার হয়ে আসে আমার। প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করি! জীবন এতো নিষ্ঠুর!
রাতের বেলা মগ ভর্তি চা নিয়ে উপরে উঠলাম। আপুর রুমের দরজা ভেড়ানো ছিল। মৃদু টোকা দিতে ভেতর থেকে উত্তর এলো,
‘কে?’
শুষ্ক কণ্ঠ। আমি জড়সড় হয়ে উত্তর দিলাম,
‘আপু আমি। জুঁই!’
‘ওহ্। ভেতরে আয় জুই।’
আমি ভেতরে ঢুকলাম। আপু টেবিলে বসে ছিল। মসৃণ কাগজে কি যেন লিখছে। আমার হাতে চা দেখে বলল,
‘চা তো চাইনি রে!’
‘সন্ধায় বললেন যে আজ রাত জেগে কি যেন কাজ করবেন। সেজন্য চা বানিয়ে আনলাম।’
‘এখন জেগে থাকার জন্য চায়ের প্রয়োজন পড়ে না। এমনিতে রাতে ঘুম আসে না। কতরাত হলো ঠিকঠাক মতো ঘুমাতে পারি না।’
বলার পর পরই লাজুক হাসলো আপু। হয়তো ভাবলো, অতিরিক্ত বলে ফেলেছে। সে বলল,
‘বিছানায় বোস তো। চা টা খেয়ে ফেল তুই।’
আমি বিছানায় বসলাম। তবে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম না। মন ভালো নেই। আপু ডায়েরি বন্ধ করলো। চেয়ার ঘুরিয়ে আমার মুখোমুখি বসে বলল,
‘তোর বাবা নাকি আর নেই! সালেহা খালার থেকে শুনলাম। কিন্তু দেখ তুই গ্রাম থেকে ফেরার পর একবারও জিজ্ঞেস করিনি। ঠিক আছিস তো তুই?’
‘হুঁ। আমি ঠিক আছি।’
‘খুবই ভালো। নিজে দুঃখে থাকি বলে আর কারো দুঃখের খবর রাখা হয় না। একমাত্র সুখী ব্যক্তিরা মনোযোগ দিয়ে অন্যদের দুঃখের গল্প শুনে। তবে তুই ঠিক আছিস শুনে ভালো লাগলো। কত ঝড় যাবে, কত ঝড় আসবে! মনোবল শক্ত রাখবি সবসময়।’
‘হুঁ!’
মাথা নাড়লাম। আপু কি যেন বলতে নিল। কিন্তু তার আগে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোন বিছানার অপর পাশে ছিল। আপুর মধ্যে কোনো উত্তেজনা দেখা গেল না। আমি শরীর বাঁকিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। আপুর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়লো। স্ক্রিনে ‘ব্যারিস্টার আকাশ মাহমুদ’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।
(চলবে)