#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_২১
#অজান্তা_অহি
‘মিরপুরে বাসা নিয়েছি তো। সেখানে কিছুদিন থেকে আসবি। তোর ভাবি খুলনা গিয়েছিল। গতকাল ফিরেছে।’
ফাইজান ভাইয়ের কথা শুনে খেই হারিয়ে ফেললাম। পাগল নাকি! বড় মা সহ বাড়ির সবাই মেরে ফেলবে আমায়। না হয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। সবাই মুখিয়ে রয়েছে। সুযোগের অপেক্ষায়। ছিটেফোঁটা ভুল হলে আর রক্ষা নেই। ঢাকা শহরে কাজের লোকের অভাব পড়েছে নাকি! আমি জোরালো নিষেধ করে বললাম,
‘যেতে পারবো না আমি। বাড়িতে কত কাজ এখন।’
‘সালেহা খালা আছে। কাজ হয়ে যাবে। তুই চল।’
‘এভাবে যাওয়া যায়? বাড়ির কেউ জানে না। মেরে ফেলবে একদম।’
‘আরে গাধা! সবাই জানে। বাড়িতে গেছিলাম তোকে আনতে। খালা বললো কলেজে তুই। এজন্য এখানে আসলাম। মাকে বলেছি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। আর ভয় নেই। বেশি দূরের পথ নয়। এখান থেকে সরাসরি মিরপুরের বাসে উঠবো।’
দো মনা করতে করতে অবশেষে রাজি হলাম। ফাইজান ভাইয়ের বউকে দেখার তীব্র লোভ হলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। শেষমেশ তার সাথে বাসে উঠে পড়লাম।
পাশাপাশি বসে আছি দুজন। তবুও যোজন যোজন দূরত্ব। এখনো তার সাথে সহজ হয়ে কথা বলতে পারি না। জানালা ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইলাম। কাচ সরানোর জন্য ইতি-উতি করতে ফাইজান ভাই বাম হাতে টেনে খুলে দিল। তৎক্ষনাৎ বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগলো। ঘর্মাক্ত দেহটা আস্তে আস্তে শীতল হয়ে উঠলো। মিরপুর কতদূর জানা ছিল না। ফাইজান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?’
‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবো। তুই খাবি কিছু? খিদে পায়নি?’
‘না! এখন খাবো না।’
সে আর কিছু বললো না। পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নিল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশ থেকে ফাইজান ভাইয়ের গলা ভেসে এলো। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমি মনোযোগ দিতে পারলাম না। এভাবে রাজি হয়ে গাড়িতে উঠলেও মনে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? কিচ্ছু করতে পারবো না আমি। রাস্তায় গিয়ে পঁচে মরতে হবে। বুক চিঁড়ে আফসোসের সুর ভেসে এলো।
‘আপা শসা খাইবেন?’
আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। বাচ্চামতন এক ছেলে। আমার দিকে কাটা শসার প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছে। চেহারা ময়লাযুক্ত। গায়ের গেঞ্জির কত জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মলিন মুখ জোড়ায় তীব্র আক্ষেপ। এই আক্ষেপ বেঁচে থাকার আক্ষেপ। দারিদ্রতার সাথে প্রতিনিয়ত যুঝতে থাকার আক্ষেপ। বুকে ব্যথা অনুভূত হলো আমার। কি কষ্টের জীবন!
ফাইজান ভাই একটা শসার প্যাকেট কিনে হাতে ধরিয়ে দিল। দিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। আমি হাতের কাটা শসার দিকে অপলক চেয়ে রইলাম।
________
মোটামুটি বড়সড় এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ফাইজান ভাই। ছয় তলা উচুঁ বিল্ডিং। তাকালে আকাশ দেখা যায় না। বেলকনিতে শুকাতে দেওয়া কাপড় চোপড় চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে দু একটা বেলকনিতে অবশ্য সবুজ গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো। তিন তলার ডানদিকের বেলকনির গ্রিল ধরে বাচ্চা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরণে টকটকে লাল পোশাক। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। পুতুল বেঁচে থাকলে এতবড় হয়ে যেতো! আপা আপা বলে ডাকতো। হৃদয়ে গেঁথে থাকা সূক্ষ্ম এক ব্যথা নড়াচড়া করে উঠলো।
‘চল।’
ফাইজান ভাইয়ের ডাকে হুঁশ ফিরলো। তার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম। পানির তেষ্টা পেয়েছিল সেই সকালে। পরীক্ষার মাঝে। খাতায় লিখতে লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার সেই তেষ্টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে মরুভূমি! পা চলতে চাইছে না। টেনে টেনে সিঁড়ি উঠলাম। চার তলা অবধি পৌঁছাতে পা ধরে এলো। আর পারছিলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
‘আর কয় তলা উঠতে হবে?’
ফাইজান ভাই হাসলো। বাচ্চাদের মতো অবুঝ হাসি। আমার আগে আগে যাচ্ছিল সে। হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ঘুরে বলল,
‘পৌঁছে গেছি। পাঁচ তলায় বাসা। এতো উপরে বাসা নিয়েছি বলে তোর ভাবি বকা দেয়। দিনের মধ্যে কতবার যে কথা শোনায়!’
সিঁড়ির বাম পাশের ফ্ল্যাট। ফাইজান ভাই কলিং বেল চাপলো। মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে গেল। যেন দরজার ওপাশে কেউ অপেক্ষারত ছিল। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। আবিষ্কার করলাম ছিপছিপে গড়নের এক মেয়ে। কলাপাতা রঙের থ্রি পিস পরিহিত। খুবই সাধারণ দেখতে। তবুও এই সাধারণের মাঝে কোথাও অসাধারণ কিছু রয়েছে। হয়তো সেই অসাধারন কিছু ফাইজান ভাইয়ের দৃষ্টি কেড়েছে। আমি বিনয়ের সাথে সালাম দিলাম। সে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছো জুঁই?’
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিলাম। সে আমার নাম ধরে ডাকলো দেখে অবাক হলাম। ছোটখাটো এক ফ্ল্যাট। দুইটা রুমের মাঝে কয়েক হাত ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং রুমের একপাশে রান্নাঘর। রান্নাঘরের সাথে ছোট্ট বাথরুম। কয়েক সেকেন্ডে নজর বুলিয়ে নিলাম। ভাবি গেস্ট রুমে বসতে দিল আমায়। ফাইজান ভাই ড্রয়িং রুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল,
‘হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয় ফুলি। বিকেল হয়ে গেল। দুপুরে তো খাসনি।’
ভাবি তার সাথে সায় মিলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়ে নাও। শুনলাম তোমার পরীক্ষা চলছিল। কেমন দিয়েছো?’
‘ভালো দিয়েছি ভাবি।’
তাকে ভাবি ডাকতে কেমন যেন লাগলো। সে দু চারটে কথা বলে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠে গিয়ে জানালার পাল্লা সরিয়ে দিলাম। জানালা দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মন বিষণ্ণ হয়ে এলো। এমন একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন ছিল আমার। সে সংসার সাজাতে কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। রাফি ভাই আর আমার সংসার হবে। টোনাটুনির ছোট্ট সংসার। এক পৃথিবী ভালোবাসায় ভরপুর থাকবে সে সংসার। মাঝে মধ্যে মান-অভিমান হবে। সে সব কাজ ফেলে অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। রাত জেগে আরো কতশত স্বপ্নে বিভোর থাকতাম! এখন স্বপ্ন দেখার সময় নেই। প্রিয় মানুষও নেই।
তবে আমার সে স্বপ্ন দেখার দিনগুলো রঙ্গিন ছিল। ভীষণ আনন্দের ছিল। তখন কারণে অকারণে হাসতাম। সবকিছুতে আনন্দ খুঁজে পেতাম। এখন স্বপ্ন ছাড়া জীবন বর্ণহীন কষ্টের। জ্বালাময় ব্যথার! স্বপ্ন ছাড়া বেঁচে থাকার যন্ত্রণা সবাই বুঝে না।
ড্রয়িং রুমে ফাইজান ভাই একটু পর পর সন্ধি বলে ডেকে উঠছে। সন্ধি এটা দিয়ে যাও, ওটা দিয়ে যাও! সন্ধি ফোন খুঁজে পাচ্ছি না, ছাই রঙা টিশার্ট খুঁজে পাচ্ছি না ইত্যাদি। আমি এপাশে আফসোসের মালা গাঁথতে লাগলাম। কেউ কী কোনোদিন এমন আদর মেখে আমায় নাম ধরে ডাকবে?
_________
গোছগাছ করা রুমের একপাশে ঝকঝকে বিছানা। এতো বড় বিছানায় ঘুমানো হয়নি কখনো। ও বাড়িতে ছোটো-মোটো এক খাটে আমি আর সালেহা খালা ঘুমাই। আগে খাট ছিল না। মেঝেতে ঘুমাতাম। এরপর কেউ বলে হয়তো খাটটা এনেছে। আজ বিশালাকার বিছানায় আমি একা। বাল্ব বন্ধ করে এসে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। তবে শান্তি পেলাম না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। চরম অস্বস্তি। ও বাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখানে একদম ভালো লাগছে না।
ঘুমানোর জন্য সবেমাত্র চোখ বুজেছি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠলো। পুরনো বাটন ফোনের বিদঘুটে শব্দ। বালিশের চিপা থেকে দ্রুত বের করলাম। দেখি অচেনা নাম্বার। আব্বার ফোন এটা। কেউ কল করলে ধরি না। কল ধরে সবাই আব্বাকে খুঁজবে। সে তো নেই!
আমার ভাবনার মাঝে কল কেটে গেল। মিনিটের কাটা গত হওয়ার আগেই আবার ফোন বেজে উঠলো। বিকট শব্দ! ফাইজান ভাইয়ের রুম থেকে যদি শোনা যায়? তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলাম। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কে বলছেন?’
‘জুঁইফুল আমি!’
এইটুকুই। আর কিছু বলতে হলো না। তাতেই আমি চিনে গেলাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
‘রাজ ভাইয়া আপনি? এতো রাতে কেন ফোন দিয়েছেন?’
‘দরকার আছে। কোথায় আছো তুমি?’
‘মিরপুরে। ফাইজান ভাইয়ের এখানে।’
বলে চুপ হতে গেলাম। রাজ ভাইয়া কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ রইলো। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। সে কোনো কারণে ফাইজান ভাইকে পছন্দ করে না। চোখের বালি মনে করে। এখানে আছি বলে নিশ্চয়ই রেগে যাবে। পরক্ষণে মনে প্রশ্ন জাগলো। কেন রেগে যাবে সে? তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ও বাড়ির সামান্য কাজের মেয়ে। ওপাশের নিঃশব্দতা ভেঙ্গে ভেসে এলো,
‘কবে বাড়ি আসবে?’
‘জানি না। ফাইজান ভাই কয়েকদিন থাকতে বলেছে।’
‘কালকের মধ্যে বাড়ি চলে আসবে। প্রয়োজন আছে।’
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘কি প্রয়োজন? কার প্রয়োজন?’
‘এলে বুঝতে পারবে। অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখো।’
আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল। হাতের ফোনটার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়া কি বলছে এসব? কিসের সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে? মনে একাধিক অপশন এলো। কোনোটাই যুতসই মনে হলো না। তার সাথে তো আমার তেমন বন্ধুত্ব বা কথা বলা কোনোটাই হয়নি। তবুও কি সব বললো! নাম্বার কোথা থেকে নিয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছি। সামান্তা আপু অথবা সালেহা খালা। কারো থেকে নাম্বার জোগাড় করেছে। কিন্তু এত আয়োজন করে কি বলতে চায় সে? ভয় হতে লাগলো আমার। বালিশে মাথা রাখলাম ঠিকই। কিন্তু ঘুম এলো না।
________
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে টের পেলাম মাথা ধপধপ করছে। চোখ জ্বালা করছে। রাতে সত্যি সত্যি ঘুমাতে পারিনি। শেষরাতের দিকে শুধু ঘুম এসেছিল। চোখ মুছে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে মোটামুটি অন্ধকার। ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। জানালার গ্রিলে মাথা রেখে বসে রইলাম। আস্তে আস্তে সমস্ত রাতের ক্লান্তি দূর হতে লাগলো। ভেতর ও বাহির শান্ত হয়ে এলো।
ড্রয়িং রুমে কথাবার্তার আওয়াজ হচ্ছে। বুঝতে পারলাম ওনারা উঠে গেছে। আমি এখনি বের হবো কি না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি। আবার বাইরে গিয়ে একটু কাজ করলে ভালো হতো। লাট সাহেবের মতো বসে থাকার জন্য আসিনি তো। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। বন্ধ দরজার উপর কান রাখলাম। ড্রয়িং রুমে কি কথাবার্তা হচ্ছে সেটা ঠাওর করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না। কথা বোঝা যাচ্ছে না। শেষমেশ আস্তে করে দরজা খুলে বের হলাম।
ফাইজান ভাই ড্রয়িং রুমের টেবিলে বসে ল্যাপটপে কিছু করছিল। আমাকে দেখে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো। বলল,
‘আজ কি কলেজে যাবি?’
‘ভাবছি ক্লাসে যাবো না। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ ক্লাস হবে না!’
‘ওহ্। না গেলি তাহলে।’
ফাইজান ভাই আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। আমি কিছুক্ষন ইতস্তত করে বলে ফেললাম,
‘ও বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে। আজই ফিরতে বলেছে।’
‘কে ফোন দিয়েছে?’
ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলো সে। চেয়ে আছে সন্দিহান দৃষ্টিতে। আমি চট করে উত্তর দিতে পারলাম না। উত্তর না পেয়ে সে নিজে থেকে বলল,
‘ও বাড়িতে আর না গেলি। আমাদের এখানে থাক। একদিন গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে আসলে হবে। আমি একটু পর অফিস যাবো। তোর ভাবি সারাদিন একা একা থাকে। তুই থাকলে ভালো লাগবে।’
ফাইজান ভাই বললে কি হবে। আমি জানি আমি থাকলে সন্ধি ভাবির ভালো লাগবে না। নতুন বিয়ে করেছে তারা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে! হয়তো নিজেদের মত সংসার করবে। নিজেদের মতো সময় কাটাবে। আমি উটকো ঝামেলা। আমার জন্য তাদের সর্বদা তটস্থ থাকতে হবে। আরো কত ঝামেলা। গতকাল রাতে খাওয়ার সময় ফাইজান ভাই আমার প্লেটে একটা চিংড়ি তুলে দিয়েছিল। সন্ধি ভাবির মুখটা কেমন চুপসে গিয়েছিল তখন। ভাই হয়তো খেয়াল করেনি। কিন্তু আমার নজরে ঠিক পড়েছে। আমার এখানে থাকা সমীচীন নয়। তাছাড়া আমি নিজে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। ও বাড়িতে আমার নিজস্ব একটু জায়গা আছে। আমার কিছু আপন মানুষ আছে। তাদের সঙ্গ ভালো লাগে। তাদের কথাবার্তা ভালো লাগে। তাদের ছেড়ে থাকা অসম্ভব!
সন্ধি আপু রান্নাঘরে ছিল। বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে ভাই বলল,
‘সন্ধি! জুঁই কে বলছি থেকে যেতে। তুমি কী বলো?’
‘থাক। ভালো হবে। অনেকটা সময় একা একা থাকতে হয় আমাকে।’
মুখে বললেও ভাবির কেমন মিইয়ে যাওয়া গলার স্বর। সে স্বরে লুকোনো ভয়। যদি থেকে যায়! ফাইজান ভাই এবারো কিচ্ছু টের পেল না। সে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলো। উৎসাহ দিলো থেকে যাওয়ার জন্য। সন্ধি ভাবির কথাবার্তা শুনে বুঝেছি আমি যে তাদের বাড়ির কাজের লোক সেটা জানে না। মনে হলো বড় মায়ের দূর সম্পর্কের কোনো বোনের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছে। ফাইজান ভাইয়ের পাতানো বোন বলে পরিচয় দিয়েছে।
বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে রুমে এলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আজকের দিনটা থেকে কাল ভোর হলে চলে যাবো। সালেহা খালাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।
_________
পরদিন সকাল বেলা ফাইজান ভাইয়ের সাথে বের হলাম। সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে বাসা থেকে বের হয়েছি। আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে সে অফিস গেল। বিকেল বেলা অফিস শেষ করে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলেছিল। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আজ সকালেই ফিরতে হবে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাসে উঠে তবে শান্তি পেলাম।
বাস একেবারে আমার কলেজের সামনে থামবে। সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছানো সমস্যা হবে না। তবুও ফাইজান ভাই বার বার করে বলে দিল। পৌঁছে যেন তাকে ফোন দেই। রাজ ভাইয়া পরশু দিন রাতে ফোন দিয়েছিল। ভেতরে কৌতূহল ঢুকিয়ে দিয়ে চুপ হয়ে গেছে। আর কোনো খোঁজ নেই। একটা ফোন নেই! বাসের সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম।
কলেজের মোড়টাতে বাস থামলো। নেমে হেঁটে বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলাম। বাইরের গেটে দারোয়ান মামা নেই। ফাঁকা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কলিং বেল চাপলাম। একবার চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। সালেহা খালার কানে গেলে দৌঁড়ে এসে খুলে দিবে। সময় অতিক্রান্ত হলো। সুন্দর এক মিউজিক বেজে শব্দ মিলিয়ে গেলো। কেউ দরজা খুললো না। দ্বিতীয় বার সুইচে চাপ দিলাম। অন্য গানের মিউজিক বেজে উঠলো। খালা দরজা খুলছে না কেন? এতো সময় তো লাগার কথা না।
এপাশে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলের নখ কামড়ানো শুরু করলাম। অবশেষে দরজা খুলে গেল। কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে পেলাম। খালা আমায় দেখে ভারী অবাক হলো। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী করছিলে খালা? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘তুই আজ আইবি বইলা আইবি না? ফোন করতি!’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘কিছু হয় নাই। ঘরে আয়।’
খালাকে চিন্তিত মনে হলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভয় হতে লাগলো আমার। আমার অবর্তমানে কোনো অঘটন ঘটেনি তো? চট করে জাবিরের কথা স্মরণ হলো। বছর খানেক আগে জাবির একটা বই উপহার দিয়েছিল। সেই বইয়ের প্রথম পাতায় কিছু লেখা। সেই লেখা কারো নজরে আসেনি তো? কিন্তু বইটা তো আমি লুকিয়ে রেখে গেছি। খালার পিছু পিছু ঘরে ঢুকলাম।
(চলবে)