ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_২২

0
613

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব_২২
#অজান্তা_অহি

খালার পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম। সমস্ত বাড়ি নিঃশব্দ। কেমন থমথমে। শরীর বারংবার শিউরে উঠলো। বসার ঘরে কেউ ছিল না। রান্নাঘরে থালাবাসন নাড়াচাড়ার শব্দ হচ্ছে। ওদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে খালা হাত চেপে ধরলো। একপ্রকার টেনে নিয়ে রুমে ঢুকলো। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,

‘খালা কী হয়েছে? এমন করছো কেন?’

খালা গলার স্বর নামিয়ে বলল,

‘কেলো হইয়া গেছে। রাজ কি করছে হুঁনছোস?’

‘কী করেছে?’

‘গতকাইল রাতে সবাই খাইতে বসছে। হগ্গলে আছে। এই সময় রাজ উপর থেইকা নিচে নামলো। সরাসরি কইলো, আমি বিয়া করতে চাই। সামান্তার বিয়ের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে। একসাথে দুটো বিয়ে হলে সমস্যা হওয়ার কথা না। বিয়া করবো ভালো কথা। কেউ কেউ মনে মনে খুশি হইলো। ওর দাদী জিগাইলো, খুবই ভালো। অবশেষে একটু বুদ্ধির উদয় হইছে। কাল থেকে মেয়ে দেখা শুরু করি। কিন্তু রাজ হুইনা কইলো, মেয়ে ঠিক করা আছে। জুঁইকে বিয়ে করতে চাই।’

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো। বুকে একের পর এক হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। কোনো রকমে বললাম,

‘এসব কী বলছো খালা?’

‘হ। পোলার মাথা খারাপ হইয়া গেছে। এইডা কখনো সম্ভব? এইগুলা বাস্তবে কখনো হয়? আজাদ ভাই তো প্রথমে চিনতেছিল না যে জুঁই কে! যখন হুনছে তুই খুব রাইগা গেছে। কাল ভাতের প্লেট ছড়ায় ছিটায় চইলা গেছে। রাজও রাগারাগি কইরা বাড়ির বাইরে গেছে। আর ফিরে নাই। তোরে নাকি বিয়া করবই করবো।’

কান্না পেয়ে গেলো আমার। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। এ বাড়ির সবাই এখন নিশ্চিত আমায় মেরে ফেলবে। রাজ ভাইয়া এটা কী করেছে! মাথা খারাপ নাকি তার? এটা তো কখনো সম্ভব নয়। জীবন নাটক সিনেমা পেয়েছে? নাটক সিনেমা হলে এতকিছু হারাতে হতো না আমায়। রাফি ভাই ঠিক আমায় বুঝতো। আমার ভালোবাসার বিনিময়ে আমায় ভালোবাসতো। নিজের পরিবার হারাতে হতো না আমায়। জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতো না। জীবন ভীষণ নিষ্ঠুর! কণ্টকাকীর্ণ পাহাড়ের চূড়া। দিনশেষে যেখানে শুধু দুঃখের জায়গা হয়। এখানে সুখের স্থান নেই। ভুলবশত একটু আধটু সুখ এসে উঁকি দিতে বড়সড় কোনো দুঃখ এসে তাকে পিষে মেরে ফেলে। নতুবা চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় গভীর অতলে।

খালা অসহায় কণ্ঠে বলল,

‘কী করবি এহন ক তো? সুযোগ বুইঝা ওরা তো বাড়ি থেইকা বের কইরা দিবো। কই যাবি তহন?’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালাম। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। গাল ভিজে উঠলো। রাজ ভাইয়ার এই একটা কথা আমায় যে কোথায় দাঁড় করাবে ভাবতে গলা শুকিয়ে এলো। খালার হাত চেপে ধরে বললাম,

‘খালা কী করবো এখন? ওরা নিশ্চিত মেরে ফেলবে আমায়। মেরে লাশ গুম করে দিবে। কেউ টের পাবে না। ঢাকা শহরে নিত্যদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কতজন খুন হচ্ছে। কে খবর রাখছে তার।’

ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। খালা মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। বলল,

‘থাক কাঁদিস না। দেহি কি করা যায়।’

কান্না থামলো না। রান্নাঘর থেকে বড় মায়ের গলা ভেসে আসছে। থমথমে সুর। খালাকে ডাকছে। খালা মাথার চুল খোঁপা করতে করতে বের হয়ে গেল। আমি বিমূর্ত হয়ে বসে রইলাম। এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? ওরা কী সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে? সমস্ত রাগ গিয়ে রাজ ভাইয়ার উপর পড়লো। এই কাজ কেন করেছে সে!

কিছুক্ষণ পর মুখ ধুয়ে বের হলাম। রান্নাঘরে বড় মা রয়েছে। ভেতরে ঢুকলাম প্রচন্ড ভয় নিয়ে। খালা পাটায় ডাল বাটছে। মসুর ডাল। পিয়াজু হবে হয়তো। বড় মা কি যেন ভাজছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম শাক। আমি খালার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম,

‘খালা আমি ডাল বাটি। তুমি অন্য কিছু করো।’

খালা বাটা থামিয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। বড় মা-ও খুন্তি হাতে পেছন ঘুরে তাকালো। এক পলক দেখে আবার ভাজি নাড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। খালা পাটা ছেড়ে উঠে বলল,

‘নে কর। ভালো কইরা বাটিস।’

‘হুঁ!’

বসে পড়লাম। ভয়ে ভয়ে রইলাম। বড় মা কিছু বলে কি না! কিন্তু কিছু বললো না। অভিমান করেছে হয়তো। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি নির্দোষ। তবুও সব দোষ, সব অভিযোগ আমার ঝুলিতে পড়বে। রাজ ভাইয়ার মতলব বুঝতে পারছি না। সে কী আমার ভালো করতে চাইছে? নাকি আরো ক্ষতি করতে চাইছে? ভালো চাইলে তো এই পদক্ষেপ নিত না।
দুশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলাম।

_________

সামান্তা আপুর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। মাঝে আর দুটো দিন আছে। পরিকল্পনা মাফিক সব হচ্ছে। সমস্ত বাড়ি লাইটিং করা হচ্ছে। বাগানে রান্নার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ইতোমধ্যে এসে গেছে। বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। এসবের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকজনের মুখ চুপসানো। যারা রাজ ভাইয়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনো চিন্তিত। রাজ ভাইয়া একগুঁয়ে। ছোটবেলা থেকে একরোখা। নিজে যা ভালো মনে করে বরাবর সেটা করে এসেছে। প্রচন্ড অবাধ্য! যার জন্য সবাই চিন্তায় আছে। কিন্তু আমি তো বিয়ে করছি না তাকে। আমি না চাইলে তো আর সে জোর করে কবুল বলাতে পারবে না।

ডাইনিং এর টেবিল পরিষ্কার করছিলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা খেয়েছে। এখন বড়রা খেতে বসবে। ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিলাম। এমন সময় জাবির এসে ডাক দিল।

‘জুঁই।’

আমি উত্তর দিলাম। জাবির হোস্টেল থেকে গতকাল এসেছে। তার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়নি। এখন ভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রচন্ড পড়ার চাপ। তাকে দেখলেই বোঝা যায়। আমি ভেজা কাপড়টা চিপে বললাম,

‘কিছু লাগবে?’

‘হ্যাঁ। চা বানিয়ে খাওয়া তো।’

‘এই দুপুর বেলা? ভাত খাবেন না এখন?’

‘চা খেয়ে ভাত খাবো।’

আমি কিছু বললাম না। জাবির আনমনে বলল,

‘কতদিন হলো তোর হাতের বানানো চা খাই না। ভীষণ মিস করেছি।’

আমি কাজে মনোযোগ দিলাম। তার কথা কানে তুললাম না। জাবিরকে দেখে মনে হচ্ছে সে রাজ ভাইয়ার ঘটনা জানে না। সে এসেছে গতকাল। তাকে জানানো হয়নি হয়তো। এটা কী জানানোর মতো ঘটনা? লজ্জাজনক ব্যাপার! বিশিষ্ট রাজ’নীতি’বিদ আজাদ রহমানের ছেলে কি না কাজের মেয়ের প্রতি দূর্বল। তাকে বিয়ে করতে চায়। এসব জানানো যায়? যত কম মানুষ জানবে তত ভালো!

জাবির এখনো যায়নি। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এই ছেলে কাজের মেয়ের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে। কেমন দৃষ্টি কটু দেখতে। রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে আনতে বললাম,

‘আপনি গিয়ে বসুন। আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা। তাড়াতাড়ি করিস।’

জাবির অবশেষে চলে গেল। কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাজ ভাইয়া বাড়ি নেই। তার সাথে আমার এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। কিছু যে জিজ্ঞেস করবো সে সুযোগ পাইনি। সবার মনে আগুন লাগিয়ে দিয়ে কোথায় পালিয়ে আছে কে জানে! সামান্তা আপুও আমায় এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বাড়ির সবার মুখ গম্ভীর। কিন্তু কেউ এই বিষয় তুলেনি। আমি যেন কিছু জানি না এমন ভাব সবার। এতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।

তবুও মনের কোনো এক কোণে ভয়। তীব্র খচখচানি। সামান্তা আপুর বিয়ের জন্য সবাই চুপচাপ আছে। বিয়েটা সমাধা হতে গেলে বড়সড় ঝড় আসবে। সেই ঝড়ে এ বাড়ির আশ্রয় উড়ে যেতে পারে। চিরদিনের জন্য। তখন কী হবে!

_________

আজ ধুমধাম করে সামান্তা আপুর গায়ে হলুদ হয়েছে। কাল বিয়ে। বাহিরের বাগানে বক্স বাজছে। হৈ-হুল্লোড় আর চেঁচামেচিতে নাজেহাল দশা। বসার ঘরে লোকে লোকারণ্য। রান্নাঘরে আমরা কয়েকজন পেঁয়াজ, রশুনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। তখন জাকারিয়া এলো দৌঁড়ে। আমার কাছে এসে বলল,

‘তোমায় বুবু ডাকে। এক্ষুণি যেতে বলেছে।’

বলে পিচ্চি ভো দৌঁড় দিল। কারণ জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না। সামান্তা আপু কেন ডাকছে? আপুর কাছে তো অনেকে রয়েছে। এদিকে কত কাজ। সব কেটে রাখতে হবে। আবার রাতের জন্য রান্না করতে হবে। একবার রান্না হয়েছিল। সব শেষ। একের পর এক লোক আসছে। তাদের খেতে দিতে হবে। খালাকে বলে উঠে এলাম। আশপাশে জাবিরকে চোখে পরলো না। হয়তো বাগানে রয়েছে। অনেক দায়িত্বশীল ছেলেটা। একমাত্র বোনের বিয়ে! সুন্দর মতো বেশ কয়েকটা দিক সামলাচ্ছে।

আনমনে উপরে উঠছিলাম। সিঁড়ির কাছে রাজ ভাইয়ার সাথে দেখা হলো। ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলেও পরক্ষণে হেঁটে উপরে গেলাম। চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। সে কিছু বলার সুযোগ পেল না। আমিও না!

সামান্তা আপু রুমে একা ছিল। হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় বসে। তার কাছের বান্ধবীদের দাওয়াত করেনি। অথচ বিয়েটা যদি তার প্রিয় মানুষটির সাথে হতো কত আনন্দে থাকতো সে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কত মজা করতো। তার স্বপ্নের কোনো এক অংশে হয়তো হাসিখুশি এক বিয়ের চিত্র ছিল। সময় সব পাল্টে দিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

‘একা বসে আছেন কেন? আপনার মামাতো বোনেরা ছিল। ওনারা কই?’

‘বের করে দিয়েছি। বলেছি আমি একটু ঘুমাবো। মাথা ব্যথা করছে। ব্যাস! ওরা চলে গেছে।’

‘সত্যি সত্যি মাথা ব্যথা করছে আপনার? ওষুধ খাবেন?’

‘বুকে ব্যথা করছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি জুঁই।’

চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আপুর কাছে যেতে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। তার দুহাত ভর্তি মেহেদী। প্রগাঢ় রঙের। বাম হাতের তালুতে আকাশ নামটা জ্বলজ্বল করছে। আপু আরেক হাতে সেই নাম ঘষে উঠানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম,

‘এমন করছেন যেন আপু? শান্ত হোন।একটু শান্ত হোন।’

টেবিলের উপর থেকে পানি এনে দিলাম। কয়েক ঢোক খেয়ে আপু শান্ত হলো। দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বললো না। একসময় মাথার এলোমেলো চুলগুলো কাঁটা দিয়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

‘চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি।’

চমকে গেলাম আমি। আপু ছাদে উঠবে কেন? তার মন এখন বিক্ষিপ্ত। যদি কোনো অঘটন ঘটায়? আমি রাজি হলাম না। বললাম,

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন যেতে হবে না। বিয়ের কনেদের এতরাতে বাইরে বের হতে হয় না। ভূত-প্রেত ভর করে।’

আপু হেসে উঠলো। ক্ষীণ হাসির ঝংকারে শরীর দুলে উঠলো তার। বলল,

‘তুই ভয় পাচ্ছিস জুঁই। তাই না? যদি ছাদে থেকে লাফ দেই! আরে পাগল। একভুল মানুষ জীবনে একবারই করে। তুই জানিস, ঘুমের ওষুধ গুলো খাওয়ার পর যখন জ্ঞান হারাচ্ছিলাম, গভীর কোনো অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম। তখন বার বার মনে হচ্ছিল কেউ এসে আমায় বাঁচাক। আল্লাহর কাছে বার বার সাহায্য চাইছিলাম। বেঁচে থাকার জন্য কত আকুতি করেছিলাম। ওই ভুল আর করছি না!’

ছাদের পথে পা বাড়ালাম দুজন। যাওয়ার সময় আপুর ছোট খালামণি দেখলো। বলল,

‘কোথায় যাস রে?’

‘ছাদে যাই। রুমে গরম লাগছে খালামনি।’

আপুর উত্তরে সে বলল,

‘তাড়াতাড়ি চলে আসিস। বেশিক্ষণ থাকবি না কিন্তু।’

আপু মাথা নেড়ে সায় দিল। ছাদে উঠে আসলাম আমরা। ছাদে শীতল বাতাস বইছে। আকাশ অন্ধকার। চাঁদ নেই। দু চারটে তারা মিটিমিটি আলো দিচ্ছে। সে আলো এতটা ক্ষীণ যে এই নিকষ কালো অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আপু চুপচাপ আকাশের পানে চেয়ে রইলো। একসময় বলল,

‘তোর ফোনটা দে তো জুঁই।’

খানিক আশ্চর্য হলাম। কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করলাম না। ওড়নার গিঁট খুলে ফোন বের করে দিলাম। আপু হাতে নিয়ে বলল,

‘ফাইজান ভাই হলুদের অনুষ্ঠানে কেন এলো না বল তো?’

‘জানি না! ব্যস্ত হয়তো। কাল আসবে।’

আপু তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিল। বলল,

‘আসবে না। কালও আসবে না। আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারি।’

প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমারো মনে হচ্ছে ফাইজান ভাই আসবে না। আপু কল লিস্টে গিয়ে ফাইজান ভাইকে ফোন দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

‘হ্যালো ফুলি। বল কি খবর?’

আপু ফোন কানে নিয়ে বলল,

‘আমি সামান্তা!’

সরে এলাম আমি। বেশ দূরে চলে এলাম। উপরের অন্ধকার আকাশ যেন মিটিমিটি হাসছে। তার ছায়ায় থাকা মানুষদের দুঃখ দেখে বড় আনন্দ পাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ গত হলো। আপু হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘আপনি কাল না এলে আমি কবুল বলবো না!’

বলে সে ঠাস করে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো। দৌঁড়ে কাছে গেলাম আমি। হাতের ফোনটা ছুঁড়ে রেখে আপু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুহাতে মুখ ঢেকে অবিরত কান্না করে গেল। তার গা ঘেঁষে বসে থাকা ছাড়া কিছু বলার পেলাম না।

________

দুপুরের দিকে বরযাত্রী এলো। বাড়িতে তখন লোক সমাগম। পার্লার থেকে কয়েকজন এসে আপুকে সাজিয়ে দিয়েছে। সারাটা দিন আপু মূর্তির মতো রইলো। কারো সাথে কথা বললো না। কিছু খেল না। মাঝে মধ্যে উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। আমি জানি নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজছিল। কিন্তু সেই একজন তখনো এসে পৌঁছায়নি। তার নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে একজনের জন্য অপেক্ষা লক্ষ্য করলাম। এই অপেক্ষা শেষ অপেক্ষা। এই চোখ দুটো আজকের পর থেকে বাধ্য হবে অন্য একজনের অপেক্ষায় থাকতে। তখন হাজার চাইলেও এই মানুষটার অপেক্ষায় থাকা হবে না!

বিকেলের দিকে কাজী এলো। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। পুরোটা সময় অনেক ভয়ে ছিলাম। আপু কবুল বলতে গিয়ে হয়তো কান্না করবে। সহজে বলতে চাইবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে কাজীর সাথে সাথে পর পর তিনবার কবুল বলে দিল। একফোঁটা চোখের জল ফেললো না। কেমন পাথরের মতো রইলো। ভয় হতে লাগলো আমার।

ঘরভর্তি মানুষ। আমি বেরিয়ে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে কারো হাত এসে বু’কে লাগলো। ভয়ে চমকে উঠলাম আমি। গা ঘিনঘিন করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি রাজ ভাইয়ার মামা। আলতাফ মামা! অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিচ্ছু হয়নি! কিন্তু আমি জানি উনি ইচ্ছে করে এই কাজ করেছে। ঘৃনা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে বেরিয়ে এলাম। কান্না পেয়ে গেল। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খানিক কাঁদলাম। এ বাড়ির কেউ জানলো না। কেউ টের পেল না!

সন্ধার আগে আগে বাড়ি খালি হতে লাগলো। আজাদ আঙ্কেলের পরিচিত অনেক ব্যক্তি বর্গ এসেছিল। তারা খেয়ে তখনই চলে গেছে। সন্ধার পর বরযাত্রী রওনা করার জন্য উঠলো। ফাইজান ভাই তখনো আসেনি। কয়েক বার ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। জাবির নিজে থেকে গাড়ি নিয়ে মিরপুর গিয়েছিল। তাকে আনতে! খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। ফাইজান ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তালা। তারা নাকি খুলনা গিয়েছে। এই সংবাদ সামান্তা আপুর কানে গেছে।

পরিশেষে, বিদায়ের সময় সামান্তা আপু হাউমাউ করে কান্না করলো। সারাদিনের সমস্ত কাঠিন্যতা গলে তরল হয়ে গেল। আর আড়ালে রাখতে পারলো না নিজেকে। শক্ত খোলসে আবৃত রাখা নিজেকে মেলে দিল সবার সামনে। কান্না করতে করতে অসুস্থ প্রায়! তাকে ধরে বরযাত্রীর গাড়িতে তুলে দিল। বাগানের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেখলাম। একটা মেয়ের এতগুলো বছরের সাজানো সংসার ভেঙ্গে যেতে দেখলাম। বুকের ভেতর দহনে পুড়ে উঠলো।

এই মানুষটা তবুও বেঁচে থাকবে। নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনবে। একটা গভীর ক্ষত সারাজীবন নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখবে। মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ মনে করে বালিশ ভিজাবে। শ্রাবণঝরা সন্ধায় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বে। কোনো একাকী বিষণ্ণ বিকেলে হুট করে মনে পড়ে যাবে। মনের কোনো কোণে জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে কাছে না পাওয়ার আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে। ভালোবাসায় এতো যন্ত্রণা কেন?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here