#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,পর্ব__২৬
#অজান্তা_অহি
‘আমি ভালো আছি। আপনার কথা বলুন আপু। ও বাড়ির সবার কী খবর? সালেহা খালা ভালো আছে? খালা এলো না?’
আমার একগাদা প্রশ্নে সামান্তা আপু মজা করে বলল,
‘আহা, বলবো সব। এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? তোর এই বিচলিত স্বভাব কখনো গেল না জুঁই।’
মঈন চাচা হাতের ব্যাগপত্র নামিয়ে রেখেছে। মিষ্টি সহ আরো অনেক রকমের জিনিস দেখা যাচ্ছে। চাচা বলল,
‘বাসায় আর কেউ নাই মা?’
‘আছে চাচা। আমার ননদের স্বামী আছে।’
চাচাকে নিয়ে দুলাভাইয়ের রুমে গেলাম। দুলাভাই বিছানায় শুয়ে ছিল। চাচাকে দেখে সালাম দিল। আশা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি পরিচয় করিয়ে দিয়ে সরে এলাম। আশাকে টানলাম কোলে নেওয়ার জন্য। সে এলো না। বসার ঘর থেকে সামান্তা আপুকে রুমে নিয়ে এলাম।
‘এটা তোদের ঘর?’
‘হ্যাঁ আপু।’
আড়ষ্ট গলায় বলে মাথা নত করে নিলাম।
কেন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে। নতুন বিয়ে হওয়া সবাই কী এমন লজ্জা পায়? লজ্জায় তাদের সবার চক্ষুর অন্তরালে লুকাতে ইচ্ছে করে? আপু শাড়ির আঁচল টেনে বিছানায় বসে পড়েছে। আমি বললাম,
‘সত্যি করে বলুন তো আপনি কেমন আছেন? সব ঠিক আছে?’
আপু মুখের পানে তাকালো। চোখে চোখ রেখে বলল,
‘হ্যাঁ রে। ঠিক আছে সব। তবে বাসায় ফিরে যখন তোর ঘটনা শুনলাম ভারী অবাক হয়ে গেছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম অনেক। না জানি কী করছিস, কেমন আছিস! চিন্তায় অস্থির দশা। বড় আব্বুর উপর রাগ হয়েছিল। আকাশ তো আমার অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজ তোকে প্রাণবন্ত দেখে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। ভালো লাগছে।’
কণ্ঠ বুজে আসছে আমার। ও বাড়ির সবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। খুব আপন করে নিয়েছিলাম সবাইকে। প্রকৃতি এমনই। সে ভীষণ একা বলে প্রিয় মানুষদের সঙ্গ সইতে পারে না। আপন মানুষদের সাথে বেশিক্ষন থাকতে দেয় না।
‘বড় মা ভালো আছে?’
‘হ্যাঁ। ভালো!’
উসখুস করছি আমি। রাজ ভাইয়া, ফাইজান ভাই, জাবির তাদের কী খবর? আমার আকস্মিক বিয়েতে ধাক্কা খায়নি তারা? হয়তো সামলে নিয়েছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষমেশ প্রশ্ন করলাম,
‘রাজ ভাইয়া শুনেছে? আমার বিয়ের কথা?’
আপু যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল। বলল,
‘হ্যাঁ শুনেছে। আমি বাসায় ফিরে তোর খোঁজ করছিলাম। কেউ ঠিকমত উত্তর দিচ্ছিলো না। সালেহা খালা টানা কান্না করছিল। তখন বড় আম্মু বলে দিল। রাজ ভাইয়া শুনে হতভম্ব। সাথে আমরাও। জাবির তো বিশ্বাসই করছিল না। দৌঁড়ে গিয়ে সারা বাড়ি খুঁজলো। ভেবেছে হয়তো মজা করছে। তখন বড় আব্বুর ধমকানি শুনে বিশ্বাস করেছি। রাজ ভাইয়ার ছোড়াছুড়ি স্বভাব। সে ডাইনিংয়ের কয়েকটা গ্লাস, প্লেট ছুঁড়ে মেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। আর ফেরেনি।’
‘এসব কী আকাশ ভাইয়ার সামনে হয়েছে?’
সামান্তা আপু অপ্রস্তুত হাসলো। বলল,
‘আরে হ্যাঁ রে! এসব ঘটনা ওর সামনে। ও বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। পরে একসময় ফাঁকা পেয়ে আমার কাছে তোকে দেখার কৌতূহল প্রকাশ করলো। বাড়ির কাজের মেয়ের বিয়েতে এতগুলো মানুষের উদ্বিগ্নতা দেখে ও তো খুব অবাক।’
আপু ঠিক বলেছে। অবাক হওয়ার কথা। সে ফের বলল,
‘আসলে আমরা ছোটবেলা থেকে অন্যভাবে বড় হয়েছি। আর দশ জন বড়লোকদের মতো করে নয়। ছোটবেলা থেকে সবার সাথে বিনয়ী হওয়া শিখিয়েছে। আমার এখনো মনে আছে। এক মহিলা বাসায় প্রতি শুক্রবার কাজ করতে আসতো। একবার সে তার পাঁচ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে এলো। জাবির তখন বাচ্চা। কী কারণে যেন মেয়েটাকে মেরেছিল। বড় মা এতে খুব রেগে গেল। শাস্তিস্বরূপ সারাদিন জাবিরকে খেতে দিল না।’
‘আপু জাবির আসলো না?’
‘ও হোস্টেলে চলে গেছে। তোর বিয়েতে কষ্ট পেয়েছে খুব। আসলে জাবির ছোটবেলা থেকে একটু চাপা স্বভাবের জুঁই। তেমন করে কারও সাথে মিশতে পারে না। কথা বলতে পারে না। কিন্তু তোর সাথে স্বস্তি নিয়ে কথা বলতে দেখেছি। এজন্য আমি কখনো বাঁধা দেইনি। একটা কথা কী জানিস? আমাদের সবসময় বর্তমানটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ঠিক বর্তমানে, এই মুহূর্তে আমি কার সাথে ভালো থাকবো, কী করলে ভালো থাকবো তাই করা উচিত। ভবিষ্যৎ! সেটা তো ধোঁয়াশাময়। কী হবে না হবে কে জানে। কিন্তু ঠিক বর্তমানে আমি একটু হাসিখুশি আছি কি না, ভালো আছি কি না এটাই প্রধান। এটাই দেখার বিষয়। এজন্য জাবিরকে আমি কখনো বাঁধা দেইনি। যদিও জানতাম তোদের এই বন্ধুত্ব অল্প সময়ের। তবুও এই অল্প সময়টা খুব গুরত্বপূর্ণ।’
বেশ কিছুক্ষন নিরব রইলাম দুজন। এক সময় উঠে দাঁড়ালাম আমি। খাবার দাবার কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
‘আপু বসেন আপনি। আমি আছি।’
আপু যেতে দিল না। হাত টেনে আবার বসিয়ে দিল। বলল,
‘কিছু খাবো না আমি। রুচি নেই। একদম নষ্ট হয়ে গেছে।’
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে বলল,
‘বিয়ের সময় ফাইজান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলি?’
‘করেছিলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল।’
‘কত ভয় পায় আমাকে দেখেছিস। সামান্তা মানেই তার কাছে আতঙ্ক। কিন্তু আমি তার আতঙ্ক হতে চেয়েছিলাম না। অন্যকিছু হতে চেয়েছিলাম।’
ফাইজান ভাইয়ের ফোন খোলা ছিল। হলুদের দিন রাতের বেলা আপু যখন আমার ফোন দিয়ে কল করে কান্নাকাটি করেছিল তখন হয়তো ফোন বন্ধ করেছে। সেই বন্ধ ফোন বিয়ের পরদিন পর্যন্ত ছিল। আচমকা মস্তিষ্কে অন্য একটা প্রশ্ন এলো। ফাইজান ভাই সিম পাল্টে ফেলেনি তো? তার নাম্বার সামান্তা আপুর অন্তরে গাঁথা। সহজে ভুলতে পারবে না সে সংখ্যাগুলো। সিম পাল্টে ফেলা আহামরি কিছু নয়।
‘ফাইজান ভাই আমার বিয়ের খবর জানে আপু?’
‘জানে হয়তো। এতোবড় ঘটনা অজানা থাকার কথা না।’
মনঃক্ষুণ্ণ হলো আমার। ফাইজান ভাই জেনেও একটিবার খোঁজ নিল না? ইতোমধ্যে তিনদিন হয়ে গেছে। সামান্তা আপু বুঝতে পারলো। আমার ধরে রাখা হাতে চাপ দিয়ে বলল,
‘নিজে ভালো থাকলে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। কিন্তু নিজে যদি ভালো না থাকি? সুখে না থাকি? তখন কী করে অন্যের কথা ভাববো বল। কী করে তার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াব? আমরা সাধারণ মানুষ। কোনো মহানুভব বা মহাপুরুষ না যে নিজে যাতনা সহ্য করেও আরেকজনের দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। ফাইজান ভাইয়ের তেমন হয়েছে। সে হয়তো ভালো নেই। সেজন্য তোর খোঁজ নিচ্ছে না। কিংবা এমনও হতে পারে। দূর থেকে একটু আধটু খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে তুই ভালো আছিস। জল আর ঘোলা করেনি তখন।’
‘হতে পারে।’
খারাপ লাগছে। আপুর কথাবার্তা থেকে অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে ফাইজান ভাই ভালো নেই। কিন্তু তার তো প্রেমের বিয়ে বলা চলে। তাহলে ভালো নেই কেন? সুখে নেই কেন? আপু একসময় নিজে থেকে বলল,
‘ভালোবাসা স্নিগ্ধ সুন্দর। কিন্তু সংসার জীবন স্নিগ্ধ সুন্দর নয়। এর পথ অমসৃণ, বন্ধুর। এ পথে হাঁটার জন্য অপর ব্যক্তিটির হাত শক্তপোক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরতে হয়। অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। ছোটখাট অনেক শখ, আহ্লাদ স্যাক্রিফাইস করতে হয়। সংসার জীবনে দুজন মানুষের স্বপ্ন এক হতে হয় নাহলে ছোটবেলা থেকে লালন করা স্বপ্ন ভেঙ্গে নতুন স্বপ্ন দেখতে হয়। তেমন করে নিজেকে গড়তে হয়। তবে হয়তো একটু সুখে থাকা যায়।’
‘হুঁ!’
‘তবে অদ্ভুত কী জানিস জুঁই? সম্প্রতি একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি। এই শহরে কিছু মানুষ ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পেয়ে দুঃখে আছে। আর কিছু মানুষ ভালোবাসার মানুষটাকে না পেয়ে দুঃখে আছে। দিনশেষে সবাই দুঃখে আছে। কষ্টে আছে। এটাই স্বাভাবিক। দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা এসব জীবনের ধর্ম। জীবনের নিজস্ব অর্থ!’
জীবনের ধর্ম নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুরতার জন্য এত যাতনা। এতো বেদনা। দুজনের কেউ আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। আপু নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। আমিও নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। কেন কাঁদছি জানি না। কার জন্য কাঁদছি তা-ও অজানা।
_________
দিন কে দিন সোহরাবের ব্যস্ততা বাড়ছে। সকাল হতে হতে বেরিয়ে পড়ে। ফিরে রাত করে। কোনো কোনো দিন তো মাঝরাত হয়ে যায়। আমার জীবন কাটছে পানসের মতো। বাইরে বের হওয়া নেই, কলেজে যাওয়া নেই। সারাদিন ঘরবন্দী। দিনটা বাড়ির কাজ করতে করতে চলে যায়। ভোরবেলা উঠে নাস্তা রেডি করি। সবাই খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি ততক্ষনে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে ফেলি। দুপুরের আগে আগে আবার রান্না করি। আশাকে চোখে চোখে রাখি। এসব করেই দিন যাচ্ছে।
দুলাভাইয়ের শরীর সুস্থ হয়ে উঠছে। পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়েছে। তবে আগের মতো ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করে। সেই অবস্থায় দুদিন হলো অফিসে যাওয়া শুরু করেছেন। বেসরকারি এক ব্যাংকে কর্মরত তিনি। সকাল হতে অফিসে চলে যায়। সারাদিন আমি আর আশা বাড়ি থাকি। আশা আর আমার মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। সে এখন মামার চেয়ে মামী প্রিয়। প্রায় রাতে আমার সাথে ঘুমানোর বায়না ধরে। সন্ধার পর পর এসে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে যায়। সোহরাব তা নিয়ে কপট মিথ্যে রাগ দেখায়। একসময় নিজে গিয়ে আশাকে নাহার আপার রুমে রেখে আসে।
মাঝে মাঝে সোহরাবের পাগলামি দেখে হাসি পায়। অবুঝ মনে হয়। এতোবড় একটা মানুষ। ঠিক তার ভেতর লুকোনো বাচ্চা সুলভ মনোভাব। সেটা একমাত্র আমার সামনে প্রকাশ পায়। আমি খুব কাছে থেকে অবাক নয়নে একজনের বাচ্চামো দেখি।
রাতের বেলা আশাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলাম। সিদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত। ডিমের কুসম আশার পছন্দ না। কিন্তু ছোটবেলা কুসুমের জন্য একদম পাগল ছিলাম আমি। ছোটবেলা বললে ভুল হবে। বড় বেলাতেও পাগল ছিলাম। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় আস্ত একটা ডিম কখনো খাওয়া হয়নি। তখন বাজারে আলুর দাম কম থাকতো। সব সবজির আকাশচড়া দাম। কিন্তু আলুর দাম হাতের নাগালে থাকতো। যার জন্য আব্বা ব্যাগ বোঝাই করে ছোট, বড়, মাঝারি সব আকারের আলু কিনে আনতো। মা সেই আলু দিয়ে বিভিন্ন পদ করতো। প্রায়ই আলুর ডাল হতো বাড়িতে। রান্নার সময় সে ঘন তরল পদার্থের মধ্যে মা একটা কাঁচা ডিম ভেঙ্গে দিতো। তরকারির স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যেতো।
কখনো বা আলু দিয়ে ডিম রান্না হতো। একটা ডিম চারভাগ করে ঝোলের মধ্যে ছেড়ে দিত। এতগুলো মানুষ। এক টুকরো করে ডিম সবার হতো না। আমি আড়চোখে খেয়াল করতাম মা শুধু ঝোল দিয়ে খেয়ে উঠতো। আব্বার পাতে যে ছোট্ট এক টুকরো দেওয়া হতো সে চুপিসারে সেটা তরকারির বাটিতে রেখে দিতো। মা দেখতো কিন্তু প্রতিবাদ করতো না। সন্তানেরা আরেকবার খাবে এই আশায় চুপ হয়ে থাকতো।
বোনদের মধ্যে সেজো আপা ছিল সবচেয়ে বুঝদার। চোখের পলক ফেলার আগে সব বুঝে যেতো। বড় আপা যেখানে বাচ্চাদের মত বড় মাছটার জন্য বায়না করতো সেখানে সেজো আপা শুধু তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠে যেতো। কখনো মা মাছ তুলে দিলে সে বার বার বলতো, ওরা সবাই খেয়েছে? বাকি সবার হবে তো?
কত দায়িত্বশীল, বুঝদার বোন আমার। এখন কোথায় রয়েছে? কেমন রয়েছে? চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে জল আটকালাম।
কলিং বেল বাজছে। আশার খাওয়া শেষ হয়নি। উঠলাম না আমি। নাহার আপা বোধ হয় খুলে দিল। কিছুক্ষণ পরেই সোহরাব ঘরে ঢুকলো। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালাম। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। গায়ের শার্ট ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। সে এক পলক আমার পানে চেয়ে বিছানায় বসলো। পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বলল,
‘আশামনি কী করে?’
আশা পুতুল নাড়াচাড়া করছে। পুতুলটা দুদিন হলো নাহার আপা এনে দিয়েছে। আশার এতো পছন্দ হয়েছে যে হাত থেকে নামাচ্ছে না। ঘুমানোর সময়ও পাশে নিয়ে ঘুমায়। সে কিন্নর কণ্ঠে বলল,
‘আশা মনি ভাত খায়।’
‘তার খাওয়া কতদূর?’
আশা কিছু বললো না। সে মনোযোগ দিয়ে পুতুলের চুল বাঁধার চেষ্টা করছে। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম,
‘খাওয়া শেষ। আসছি আমি।’
আশাকে নিয়ে বসার ঘরে এলাম। পানি খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছে দিলাম। সে দৌঁড়ে তার মায়ের রুমে গেল। আমি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ধুয়ে বের হলাম।
ঘরে ঢুকতে চোখেমুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সোহরাব খালি গায়ে বসে আছে। অর্ধভেজা শার্ট আলনার উপর ছড়ানো। প্রায় প্রায়ই সে এই কাজ করে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। সোহরাব টের পেল হয়তো। কাছে টেনে বলল,
‘একি অবস্থা! লজ্জা কেন পাচ্ছো? মনে হচ্ছে খালি গায়ে আমি নয়। তুমি বসে আছো।’
ঠোঁটের কিনারায় অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আমি মাথা আরো নত করলাম। সে বলল,
‘এতগুলো দিন হয়ে গেল বিয়ের। এখনো এতো লজ্জা পেলে চলে?’
‘খিদে পায়নি? হাতমুখ ধুয়ে আসুন। ভাত বেড়ে দিচ্ছি।’
‘খাবো। একটু চুপচাপ বসো তো পাশে।’
বসে রইলাম তার পাশে। সোহরাব তার মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে হাত চেপে রইলো। আমি সন্তর্পনে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। দরজা সামান্য ভেড়ানো। যখন তখন যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। সতর্ক দৃষ্টি সেদিকে রেখে বললাম,
‘আপনি ইদানিং কী কাজ করেন? অনেক ক্লান্ত মনে হয় আপনাকে।’
‘হুঁ। অনেক ক্লান্ত। সারাদিন মি’ছিল, সমাবেশ আর ছুটোছুটি উপর দিয়ে যায়।’
বুকের গহীনে সূক্ষ্ম এক ব্যথার উপস্থিত টের পেলাম। সোহরাব আজাদ আঙ্কেলের হয়ে কাজ করে। এখনো সে কাজ চলমান। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সোহরাব নিজে থেকে বলল,
‘তুমি তো ঠিকমত খবর রাখো না। টিভি দেখো না। এ মাসের একুশ তারিখ নি’র্বাচন। সেজন্য দৌঁড়াদৌঁড়ি বেড়ে গেছে। নি’র্বাচন শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন একদম রিলাক্সে থাকতে পারবো।’
সোহরাবের অতিশয় ক্লান্ত স্বর। কথা শেষ করে হাই তুলল সে। আমার বড্ড মায়া হলো। মানুষটা কত পরিশ্রম করছে। একবার মনে হলো এই কাজ থেকে সরে আসতে বলি। পরক্ষণে বুঝলাম এটা কখনো সম্ভব নয়। সোহরাব তার কাজে যেই পরিমান দায়িত্বশীল সে কখনো সরে আসবে না। রা’জনীতিতে একবার কেউ জড়িয়ে পড়লে, ভালোবাসা জন্মে গেলে তারা আর পিছু ফিরতে পারে না। পিছু ফেরার অবকাশ পায় না।
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সোহরাবের চুলের ভাঁজে হাত রাখলাম। এই ছেলেটার প্রতি আমার মায়া জন্মে গেছে। একটা সংসার করার জন্য যতটুকু মায়ার প্রয়োজন তার থেকে একটু বেশি। না! একটু নয়, অনেকখানি বেশি মায়া জন্মে গেছে।
__________
শুক্রবারের বিকেল। সোহরাব আজ সারাদিন বাড়ি ছিল। একবারও বের হয়নি। আজ কোনো কাজ নেই। যার দরুণ বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমালো সে। রান্নাবান্না শেষ করে তাকে ডাকতে এলাম। তার ঘুম ভাঙাতে অনেক বেগ পেতে হলো। শেষমেশ আমার জোরাজুরিতে উঠে বাথরুমে গেল।
সে বাথরুমে ঢোকার পর ফোন বেজে উঠলো। প্রচুর ফোনকল আসে সোহরাবের। আমি না দেখলেও বুঝতে পারি সে দলের মধ্যে মোটামুটি জনপ্রিয়। আজও সমানে ফোন বেজে উঠছে। একবার কল কেটে দু সেকেন্ড অতিক্রম করতে না করতেই আবার কল বেজে উঠছে। রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুম নেই। সোহরাব ড্রয়িং রুমের পাশের বাথরুমে ঢুকেছে। আমি দরজায় চাপড় মেরে বললাম,
‘ফোন বাজে আপনার। তাড়াতাড়ি বের হোন।’
‘বের হচ্ছি।’
কিয়ৎক্ষণ বাদে টিশার্ট পরে বের হলো সে। ভেজা চুল ভালো মতো না মুছে ফোন কানে ধরলো। ওপাশে কী কথাবার্তা হলো জানি না। কিন্তু সোহরাব চমকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে কল কাটলো। কাঁধের তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে রেখে দিল। হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজলো। আমি পেছন থেকে বললাম,
‘কিছু হয়েছে? এমন করছেন কেন?’
আমার কথা শুনে তার খেয়াল হলো যেন। দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে তাকালো। চিন্তিত মুখে বলল,
‘আজাদ ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। মারাত্মক অবস্থা। আইসিইউতে ভর্তি আছে।’
কলিজা কেঁপে উঠলো আমার। সোহরাব হঠাৎ বলল,
‘তুমি দেখতে যাবে? গেলে ঝটপট কাপড় পাল্টে নাও।’
(চলবে)