ভালোবাসারা_ভালো_নেই,১০,১১

0
780

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,১০,১১
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১০

‘জুঁই!’

স্কুল গেট অতিক্রম করতে কেউ দূর থেকে ডাক দিল। পেছনে তাকাতে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেল। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। আলতাফ মামা ডাকছে। এদিকে কেন উনি?

আমাকে এগিয়ে যেতে হলো না। তিনি দ্রুত হেঁটে কাছে এলেন। চোখে মুখে গদগদ ভাব। বললেন,

‘মা গো! কেমন আছো? পড়াশুনা কেমন চলতেছে?’

আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম,

‘ভালো।’

‘আমি কয়েক মাস হলো অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এইজন্য যেতে পারতেছি না। ও বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

মাথা নাড়লাম শুধু। গত মাস গুলোতে উনি দুই বার মাত্র এসেছিল। থাকার সুযোগ হয়নি। কাজ পড়ে গিয়েছিল বলে চলে যেতে হয়েছে। যখন এসেছে আমি পুরোটা সময় খালার সাথে সাথে ছিলাম। একা পায়নি। আজ কি করবো?

‘চলো ওদিকে যাই। কিছু খাইবা।’

‘আমি খাবো না কিছু মামা। বাড়ি যাবো। কাজ আছে।’

‘আরে চলো। কিছু হইবো না।’

কাঁধে হাত রেখে একপ্রকার জোর করলেন উনি। তবুও রাজি হচ্ছি না বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। কান্না পেয়ে গেলো আমার। ভীষণ ভয় হতে লাগলো। মামা বেশিদূর এগোতে পারলেন না। ভোজবাজির মতো জাবির এসে সামনে দাঁড়ালো। এতক্ষণে ভরসার একজন কে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। চোখের কিনারে অশ্রুরা ভিড় জমালো।

‘মামা নাকি? কেমন আছেন? এদিকে কেন?’

ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলো জাবির। মামা হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন।ফের হাতটা মাথায় রেখে বললেন,

‘আছি ভালো। এইদিকে একটা কাজ পরে গেছিলো। ফেরার পথে দেখি জুঁই মা। পরে কইলাম আসো কিছু কিনে দেই। খেয়ে নেও। বাচ্চা মানুষ। তুমি এইদিকে কেন?’

‘লাইব্রেরিতে যাবো। বই কিনতে হবে কিছু। ভাবলাম জুঁইকে সাথে নিয়ে যাই।’

‘ও, আচ্ছা। কিছু খাও তাইলে দুজন। আসো।’

জাবির একপলক তাকালো আমার পানে। আমার মন পড়তে পারলো কিনা জানি না। শীতল সুরে বলল,

‘আজ থাক মামা। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আজ যাই। জুঁই আয়!’

অবশেষে মুক্তি মিললো। দ্রুত পা চালিয়ে জাবিরের পিছু পিছু এগিয়ে চললাম। মামার দৃষ্টির অগোচরে যেতে তবে স্বস্তি মিললো। সামনের গলিটা ক্রস করে বড় রাস্তায় উঠলাম। জাবির হঠাৎ হাঁটা থামল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত চোখে তাকাল। কড়া সুরে বললো,

‘জীবনে খাসনি তুই? একটা মানুষ বললো আর তার সাথে সাথে খেতে যাওয়া শুরু করলি?’

‘আমি কই গেলাম। উনি হাত ধরে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল।’

‘তুই হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে পারলি না?’

‘এতোবড় মানুষ!’

ছাড়া ছাড়া ভাবে বললাম আমি। জাবির কড়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। বার কয়েক এদিক-ওদিক চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো,

‘একজন জোর করবে আর তুই চুপচাপ থাকবি? এটা ঢাকা শহর জুঁই! প্রতিনিয়ত কতশত ঘটনা ঘটছে। তোকে তো স্ট্রং হতে হবে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মনোবল থাকতে হবে। বোল্ডলি কথা বলতে হবে। মিনমিন করলে হবে?’

জাবির কে হঠাৎ বড় বড় মনে হলো। কেমন গুছিয়ে কথা বলছে। এভাবে আমার সেজো আপা বকা দিতো। ধমকাতো। আমি মাথা নেড়ে বললাম,

‘ঠিক আছে।’

জাবিরের রাগ পড়ে গেল। গাড়ি দেখে রাস্তা পার করিয়ে নিল। কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে সে। লাইব্রেরীতে গিয়ে বেছে বেছে বই কেনা শুরু করলো। আমি পুরোটা সময় ছটফট করছিলাম। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। কত কাজ জমে আছে। দুপুরের থালাবাসন পরিষ্কার করতে হবে। বিকেলের নাস্তা তৈরি করতে হবে। রাতের তরকারির জন্য কুটা-বাছা করতে হবে। এতকিছু তো খালা করতে পারবে না। তাড়া দিলাম তাকে।

ফেরার পথে দুটো আইসক্রিম কিনলো জাবির। আমি নিবো না। তবুও জোরপূর্বক হাতে ধরিয়ে দিল। কত দামী আইসক্রিম। এই ছেলের হাত খরচ মাসে যে কত যায়।

রিকশা করে দুজন বাড়ি ফিরলাম। একসাথে ঘরে পা রাখতে বসার ঘরে দাদীর সম্মুখীন হলাম। তার আবছা চোখের দৃষ্টি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল যেন। আমি দ্রুত বই খাতা রেখে কাজ শুরু করলাম।

________

সেদিন রাতের বেলা আমার ডাক পড়লো। বসার ঘরে। তখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত জেগে গল্পের বই পড়ছিলাম আমি। পড়া বন্ধ করে গিয়ে দেখি বড় মা, দাদী আর জাবিরের আম্মু বসে আছে। জাবিরের আম্মু কাজের প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না। আবার অহেতুক ধমকা-ধামকি করা, সেটাও করে না। তবে আজ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। কোনো ভুল করেছি কি না চিন্তা করতে লাগলাম।

‘আজ জাবিরের সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল তোমার?’

প্রশ্ন করলো জাবিরের আম্মু। ভদ্র মহিলা শিক্ষিত মানুষ। প্রচন্ড ভয় পাই তাকে। আমি কম্পিত সুরে বললাম,

‘স্কুল থেকে ফেরার পথে। ঐদিকে লাইব্রেরিতে বই কিনতে গেছিলো।’

ভদ্র মহিলা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সুশ্রী মুখটা হঠাৎ হিংস্র রূপ ধারণ করলো। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই গালে ঠাস করে চ’ড় পড়লো আমার। মাথা ভনভন করে উঠলো। চকিতে আব্বার মুখটা ভেসে উঠলো। আব্বা এভাবে পুরুষালি হাত দিয়ে চ’ড় মারত। দিন দুনিয়া ভুলে যেতাম। আজও ব্যতিক্রম হলো না। ব্যথায় কেঁদে দিলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পর তাকালাম। বড় মা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ফারিত চোখে তিনি বললেন,

‘এটা কি করলি জুলি? পাগল হয়ে গেছিস?’

‘হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। এই ছোটলোকের বাচ্চার সাহস কি করে হয় আমার ছেলের সাথে ঘোরার?’

‘তাই বলে গায়ে হাত তুলবি? কি বিশ্রী ব্যাপার! ছেলেমেয়েরা সব বাড়িতে।’

বড় মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে গর্জে উঠলো দাদী।

‘মারছে বেশ করছে। আরো মাইর দরকার। আন্ডার মতন মানুষ। বাড়ির কাম করার জন্য আসছোস কাম করবি। আবার পড়াশুনা করতে হইব। দেখেই বুঝছিলাম এই মাইয়ার বদ মতলব আছে। এই বাড়ির পোলাগো মাথা নষ্ট করবো। এই বাড়িত পাকাপোক্ত জায়গা তৈরি করতে চায়। কইলাম ঘাড় ধইরা বের কইরা দেও। হুনবা না তো কথা।’

‘আমি তো সেটাই চাইছিলাম মা। কিন্তু ফাইজান? শুনেছেন তার কথা? এমনিতে বছরে একবার-দুবার বাড়ি আসে। এই মেয়েকে বের করে দিলে নাকি জীবনে আর বাড়ি আসবে না। যত্তসব ছোটলোকের দল।’

জাবিরের আম্মু আবার তেড়ে আসতে নিতে বড় মা থামিয়ে দিলেন। সোফায় বসিয়ে শান্ত হতে বললেন। আমাকে বললেন,

‘জাবিরের থেকে দূরে থাকবি জুঁই। অল্প বয়স দুজনের। কখন কি ঘটে যায়। দূরে থাকবি।’

এতক্ষণে সব পরিষ্কার হলো। বুঝতে পারলাম সব। চোখ বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি নিজেকে শক্ত করে মাথা নাড়লাম। সব দোষ মেনে নিয়ে ক্ষমা চাইলাম। বললাম,

‘ঠিক আছে। দূরে থাকবো। আর এমন হবে না!’

‘আচ্ছা, যা ঘরে যা।’

বড় মায়ের কথা মতো রুমে চলে আসলাম। কোনরকমে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। বুকে কি যে কষ্ট হতে লাগলো। ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে কেঁদে গেলাম। পাশে সালেহা খালার ঘুম যেন না ভাঙ্গে।

পরের দিন এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে আড়ালে আড়ালে রইলাম। এই ফোলা গাল জাবিরের চোখে না পড়ে যেন। জানতে পারলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দিবে। ছেলেটার প্রচন্ড রাগ। খুবই জেদি। একবার মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে তিনদিন না খেয়ে ছিল।

চ’ড় খেয়ে কারও প্রতি বিদ্বেষ জন্মেনি। কারো প্রতি অভিমান পুষে রাখি নি। এটা আমার প্রাপ্য ছিল। কিছু জিনিস থেকে দূরে দূরে থাকতে হয় সবসময়।

সারাটা দিন গেল। জাবিরের চোখ থেকে পালিয়ে পালিয়ে। সন্ধ্যার পর খালা জানালো জাবির বাড়ি নেই। ওর ছোট ভাই জাকারিয়াকে আনতে গিয়েছে। জাকারিয়া এ বাড়িতে খুব কম থাকে। ছোটবেলা থেকে নানাবাড়ি বড় হয়েছে। তার মা নানুর কাছে রেখে কলেজে যেত। সেটা অভ্যাস হয়ে গেছে। মায়ের থেকে নানু প্রিয় বেশি। যাক! জাবির তাহলে বাড়ি নেই। অবশেষে একটু স্বস্তি মিললো। চিন্তামুক্ত হয়ে কাজ করতে লাগলাম।

_______

তারপরের কিছু দিন একই রকম কাটলো। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে স্কুল ছুটি দিয়েছে। যার দরুণ সারাদিন বাড়িতে। জাবিরকে এ কয়েকদিন তেমন চোখে পড়লো না। আমিও নিজের মত কাজ করে গেলাম।

সপ্তাহ খানেক যেতে এক অবিশ্বাস্য খবর কানে এলো। জাবিরকে নাকি কলেজ হোস্টেলে পাঠানো হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তার নতুন কলেজ বাড়ি থেকে বেশ দূরে হয়ে গেছে। তাই বলে হোস্টেলে চলে যাবে? ভয়াবহ মন খারাপ হয়ে গেল আমার। নিজের ভেতর অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। বার বার মনে হলো আমার জন্য ছেলেটাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমার জন্য পরিবার ছাড়া থাকবে সে।

সেদিন সারা বিকেল চিন্তা করলাম। সারা সন্ধ্যা, সারা রাত্রি চিন্তা করলাম। উপায় খুঁজলাম। শেষ রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। আমি চলে গেলেই তো সব ঝামেলা শেষ। ইদানিং সবাই আমার জন্য ফাইজান ভাইকেও কথা শোনায়। মানুষটা নেই, তবুও প্রতি মুহূর্ত কথা শুনছে। থাকবো না আমি এই বাড়ি!

মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো পরক্ষণে মনে প্রশ্ন জাগলো, কোথায় যাবো আমি? যাওয়ার তো জায়গা নেই। আব্বা খোঁজ নেয় না বহুদিন। এ বাড়িতে কাজ করে, খাওয়া বাদে মাস শেষে কয়েক হাজার টাকা দেয়। সে টাকা থেকে পড়াশুনা বাবদ খরচ রেখে বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখি। ফাইজান ভাইয়ের কথামতো একাউন্ট খুলেছি। তাতে আর কত টাকা হয়েছে! ওই দুই পয়সা নিয়ে কোথায় যাবো?

ভোর হতে হতে আমার চিন্তারা উড়াল দিলো। বুঝলাম আমার এই বাড়ি ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা নেই।

_______

দিন চারেক পর জাবির হোস্টেল চলে গেল। সত্যি সত্যি গেল। কেউ বাঁধা দিলো না। হোস্টেলে নাকি পড়াশুনা ভালো হবে। জাবির যদি সুস্থ মতো হোস্টেলে যেত আমার আফসোস ছিল না। কিন্তু আমার জন্য জোর জবরদস্তি করে পাঠাচ্ছে এটা বেশি পীড়া দিল।

চলে যাওয়ার আগের দিন সন্ধায় জাবির লুকিয়ে দেখা করলো। আমার থাকার ঘরটাতে! তখন চারিদিকে আযান পড়ছে। ওযু করে বের হতে দেখি সে রুমে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে ভয় পেয়ে গেলাম। কেউ দেখে ফেললে?

আমাকে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ দিল না সে। ঝটপট বললো,

‘আমি কাল হোস্টেলে চলে যাচ্ছি। পড়াশুনা করিস ঠিকমত। মোটামুটি কাছে-ই কলেজ। কয়েক দিন পর পর এসে ঘুরে যাবো।’

আমার মনে তখন তীব্র ভয়। এই বুঝি কেউ দেখে ফেলবে। সালেহা খালা একটু হাঁটতে বের হয়েছে। এই বুঝি এসে পড়ল। আমার ছটফটানি দেখে কাছে এগিয়ে এলো জাবির। হঠাৎ একটা বাটন ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘এটা রাখ। লুকিয়ে রাখবি। ফাইজান ভাই, তোর বাবা এদের সবার সাথে কথা বলবি।’

একটু সময় নিয়ে বললো,

‘মাঝে মাঝে আমিও ফোন দিবো।’

‘অসম্ভব! এটা রাখতে পারবো না আমি।’

তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলাম। সত্যি অসম্ভব। আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। একটু বেচেঁ থাকতে চাই। বেচেঁ থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে আমার জন্য। জাবির কেমন আনমনা হয়ে গেল। আমি এভাবে ফোন ফিরিয়ে দিবো আশা করেনি হয়তো। ফোনটা চোখের পলকে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে ফেলল।

‘ঠিক আছে। আসি। পড়াশুনা করিস ঠিকমতো। আর একটু কষ্ট হলেও এ বাড়িতে থেকে যাস। তোকে খুঁজে বের করার আর কোনো পথ জানা নেই আমার।’

উত্তর দিলাম না। মাথা নত করে রইলাম। জাবির ভারী কিছু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো। চেয়ে দেখি উপহার। ফুলেল কাগজ দিয়ে মোড়ানো। বাহিরের দেহাবরণ দেখে মনে হচ্ছে মোটা কোনো বই। দরজার পানে তাকালাম আমি। আস্তে আস্তে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বেচেঁ থাকা এতো অদ্ভুত কষ্টের কেন?

_________

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আজ। পৃথিবী কাঁপিয়ে বাতাস বইছে। রুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে সেসব দেখছিলাম আমি। বিষণ্ণ দৃষ্টি বার বার ঝাসপা হয়ে আসছে। ভেতর জুড়ে হাহাকার শুধু। এই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে মন চাইছে। এই জীবন ছেড়ে দূরে, বহুদূরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

বৃষ্টির ছাঁটে অর্ধভেজা হয়ে গেলাম প্রায়। ভাগ্যিস খালা রুমে নেই। বসার ঘরে সে বড় মায়ের মাথায় তেল দেয়। নয়তো বকা দিতো। জানালা বন্ধ করে সরে এলাম। পুরনো ব্যাগ থেকে বের করলাম উপহার। জাবিরের দেওয়া। খুলে দেখা হয়নি। ছেলেটা মাস দেড়েক হলো হোস্টেলে গেছে। বলেছিল, কিছুদিন পর পর আসবে। কিন্তু আসছে না। কার উপর অভিমান করেছে?

মোড়ানো কাগজ সরাতে বই দেখতে পেলাম। মোটাসোটা, পুষ্ট বই। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’। মাঝে কিছুদিন টুকটাক গল্পের বই পড়তে দেখেছে। তার থেকে ধারণা করে কিনে দিয়েছে। আনমনে হেসে উঠলাম। ভেতরে ভালো লাগার সৃষ্টি হলো। বইয়ের পাতা উল্টাতে গুটি গুটি অক্ষরের কিছু লেখা ভেসে উঠলো। পড়ার আগেই বাহির থেকে সামান্তা আপুর গলা ভেসে এলো।

‘জুঁই! দ্রুত বের হ।’

বই লুকিয়ে রেখে দৌঁড়ে বের হলাম আমি।উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,

‘হ্যাঁ আপু।’

‘চল বৃষ্টিতে ভিজবো। ছাদে যাই।’

আমার মনটা নেচে উঠল। কিন্তু পরমুহুর্তে থেমে গেলাম। আপুর আম্মু যদি আবার রেগে যায়! মন খারাপ করে বড় মায়ের দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় তিনি যেতে বললেন। তার প্রয়োজন পড়লো না। সামান্তা আপু ততক্ষণে আমার হাত ধরে ছুট দিয়েছে।

বাড়ির ছাদে প্রায়ই আসা হয়। কাপড় চোপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তখন কাজের চাপ থাকে বলে চারিদিক খেয়াল করা হয় না। আজ বাদল মুখর দিনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। কি চমৎকার প্রকৃতি! আপু একটানে ছাদের মাঝে নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিল। বৃষ্টির শীতল স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠলো আমার। বহুদিন পর আলাদা প্রশান্তিতে দেহ-মন ভরে উঠলো। আপু বৃষ্টির পানি দিয়ে ছোড়াছুড়ি করছে। কিছু পানি আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। ঝলমলে সুরে বলল,

‘জুঁই জানিস। আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। দীর্ঘদিন হলো। অথচ মানুষটা কিচ্ছু বুঝে না। এত্তো গর্দভ! গাধাটাকে কি করে বুঝানো যায় বলতো?’

‘কোন গাধা?’

‘তোদের পরিচিত এক গাধা!’

(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১১

‘জুঁই জানিস! আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু মানুষটা এতো গর্দভ। কিচ্ছু বুঝে না। গাধাটাকে কি করে বুঝানো যায় বলতো।’

‘কোন গাধা?’

‘তোদের পরিচিত এক গাধা!’

সামান্তা আপুর চোখে মুখে ভালো লাগার রেশ। ঠোঁটে ঝলমলে হাসি। আমি আগ্রহ নিয়ে তার পানে চেয়ে রইলাম। তার উত্তরের অপেক্ষায়। আপু দু দিকে হাত ছড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলো। তারপর একসময় বললো,

‘কাউকে বলবি না তো? কেউ জানে না কিন্তু।’

‘বলবো না!’

‘ফাইজান গাধাটাকে।’

বৃষ্টির বেগ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। কাছে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়লো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে আপু হাতে টান দিল। তারপর এক দৌঁড়ে চিলেকোঠার ঘরে পৌঁছে গেলাম। চিলেকোঠার ছাদে উঠার জন্যে আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা। সেই সিঁড়িতে বসে পড়লো সামান্তা আপু। আমায় নিশ্চুপ দেখে হাসলো। ভেজা চুলের পানি সরিয়ে বললো,

‘বিশ্বাস করলি না জুঁই?’

‘কবে থেকে এসব আপু?’

‘অনুমান করতো! ফাইজান কে আমি কতদিন হলো ভালোবাসি।’

‘জন্মের পর থেকে?’

‘তুইও তো দেখি গাধা!’

আপু হেসে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড পর হাসি থামিয়ে বললো,

‘ফাইজানের সাথে দেখা-ই তো হলো কয়েক বছর আগে। বুঝলি! সে বড় আম্মুর নিজের সন্তান না। বড় আব্বুর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান।’

এই ঝড় বৃষ্টির বিকেলে দ্বিতীয় বাজ পড়লো যেন। আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। কি বলছে এসব? আপু দীর্ঘ সময় নিল না। আমার চোখে মুখে ফুটে উঠা সব প্রশ্ন দূর করতে বলতে শুরু করলো।

‘শোন তাহলে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। ঝড়-বৃষ্টির এক সন্ধায় ফাইজান প্রথম এ বাড়িতে এলো। বড় আব্বুর সাথে। বড় আব্বু সবাইকে ডেকে বললো যে, এটা তোমাদের বড় ভাই। ফাইজান ওর নাম। বাড়ির বড়রা বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটরা ভীষণ অবাক। পরে আস্তে আস্তে শুনলাম এটা বড় আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।

বড় আম্মুকে দাদা-দাদী সবাই পছন্দ করে সংসারে এনেছিল। অনেক বড় ঘর থেকে। বছর দুই পরে রাজ ভাইয়া গর্ভে আসে। ওই সময় বড় আব্বু দাদুর পুরোনো কিছু জমি জমার কাজে গ্রামে গিয়েছিলো। সেখানে এক মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে। সবার অগোচরে। বছর না ঘুরতেই ফাইজান ভাই হয়। আরো একটা মেয়ে নাকি ছিল। ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। রাজ ভাইয়া আর ফাইজানের বয়সের তফাৎ খুব নয়। সমবয়সী প্রায়!’

আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,

‘ফাইজান ভাইয়ের মা কোথায় তাহলে?’

‘তাকে আমরা কেউ দেখিনি। বড় আব্বু ঢাকা থেকে তাদের খরচ পাঠাতো। মাঝে মধ্যে নাকি যেত। বড়রা জানতো এসব। আমরা পরে শুনেছি। তিনিও নাকি মারা গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ফাইজান একা হয়ে পরে। বড় আব্বু তাকে তখন এ এ বাড়িতে নিয়ে আসে।’

আমি বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলাম। এসব কি শুনালো আপু? এতো বড়লোক পরিবার। তবুও লুকোনো কত ছবি। লুকোনো কত দীর্ঘশ্বাসের গল্প। সামান্তা আপু মন খারাপ করে বললো,

‘ফাইজান ভাইয়ের অনেক কষ্ট আছে। গোপন দুঃখ আছে। শুনেছি তার মা নাকি বছরের পর বছর দুশ্চিন্তা করে করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। যার সবটা দায় বড় আব্বুর। এজন্য সে বড় আব্বুর মুখের পানে তাকায় না। বড় আব্বুর অবস্থানকালে বাড়িতে পা রাখে না। দেখেছিস, সবার অমতে গিয়ে খুলনা ভর্তি হয়েছে।’

‘তাহলে বড় মার সন্তান একটা?’

‘হ্যাঁ। রাজ ভাইয়া। সে-ও বড় আব্বুর ঘটনা শোনার পর রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে।’

‘রাজ ভাইয়া কত বছর হলো বিদেশ?’

‘যখন প্রথম যায় তখন জাবিরের সমান ছিল। এসএসসি পাসের পর গেছে।’

হুঁ হুঁ করে বাতাস বইছে। তোলপাড় করা বাতাস। গাছের ডালপালা দাপাদাপি করছে। ভেজা কাপড়ে রয়েছি অনেকক্ষণ হলো। শীতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্তা আপুকে তাড়া দিলাম।

‘আপু চলেন নিচে যাই।’

‘এখনি যাবি? আরেকটু ভিজি চল।’

‘আমার শীত লাগছে আপু। দাঁতে দাঁত আটকে আসছে।’

সত্যি সত্যি কথা পেঁচিয়ে যাচ্ছে। শীতে ক্রমাগত কাঁপছি। আপু আর বাঁধ সাধলো না। দুজন নিচে নেমে এলাম।

সে রাতে আমার জ্বর এলো। আকাশ পাতাল এক করে। সেকি জ্বর! নিজের দেহের তাপমাত্রা নিজের কাছে অসহ্য লাগছিল। চোখে ঘোলা ঘোলা দেখি সব। বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ রাখতে পারি না। আবার বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারি না। কি যে কষ্ট!

জ্বরের মধ্যে আলাদা এক ঘোরের জগতে চলে গেলাম যেন! মস্তিষ্ক জুড়ে কত পুরোনো স্মৃতি। কতশত জল্পনা-কল্পনা। চারপাশে আমার গ্রাম ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে আমার বাড়ি। আমার শৈশব! আমার ছোটবেলা! কখনো বা রাফি ভাই। একের পর এক ছবি ভেসে উঠছিল। ঘোলা চোখে একবার দেখলাম আমি বারান্দায় শুয়ে আছি। মাটির উপর বিছানা পাতানো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উঠোনে বড় আপা পুতুলকে নিয়ে খেলা করছে। খানিক বাদে বাদে আপা পুতুলের সুরে সুর মিলিয়ে হেসে উঠছে। সেজো আপাকে কোথাও দেখছি না। আমি সেজো আপাকে দেখলাম অনেক পর। আপা যখন পাশে এসে বসলো তখন চারপাশে ঘন অন্ধকার। আপার সুন্দর চাঁদের মতো মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারছি না। আমি দূর্বল গলায় বললাম,

‘আপা চারপাশে এতো আঁধার কেন?’

‘পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে। কিছু নির্দিষ্ট মানুষের জন্য! তার মধ্যে আমরা আছি জুঁই। তবে পৃথিবীর আলো ফুরায়নি। আলো জ্বলছে। ও আলো আমাদের জন্য নয়। ও আলো চোখে পড়লে আমাদের চারপাশ আরো ঝাপসা হয়ে আসে।’

আমি আকুল সুরে বললাম,

‘বুঝি না আপা। একটু সহজ করে বলো না! তুমি বরাবর একই রকম থেকে গেলে আপা। এমন সব কথা বলো।’

আপা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেই ভয়ংকর রাতের দৃশ্য। যে রাতে ঘুমানোর জন্য ঘরে পা রেখে চার চারটে নিষ্প্রাণ দেহ আবিস্কার করেছিলাম।

চোখ বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি দূর্বল দেহ নিয়ে বিছানায় লুটিয়ে আছি। এতটুকু নড়ার শক্তি নেই। কানের কাছে কেউ ফুল বলে ডাকছে। একবার মনে হলো সালেহা খালা। পরক্ষণে মনে হলো এটা তো মায়ের কণ্ঠ! আমি আরো অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম।

_________

দিন চারেক পর আমি সুস্থ হয়ে হলাম। শরীরের দুর্বলতা যদিও রয়ে গেছে! শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি। এটা নজরে পড়লো শুধু সালেহা খালার। খালার কি যে আফসোস। ইদানিং আমার পরিশ্রম আরো বেড়ে গেছে। জাবির নাকি নিজে থেকে হোস্টেলে গেছে। তার আম্মু যে আমার গায়ে হাত তুলেছে তা জানতে পেরেছে। কে বলেছে জানি না। তবে সেটা নিয়ে নাকি রাগারাগি করেছে। যার জন্য তার আম্মুর সব রাগ আমার উপর। প্রতিটা মুহূর্ত কথা শোনায়। পরিষ্কার কাপড় আবার ধুতে দেয়, রাত বিরাতে গরম পানি, চা, কফি সহ যত ধরনের হেনস্থা আছে সব করায়। সব সহ্য করছি। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

সেদিন রাতে ফাইজান ভাই ফোন দিয়ে আমাকে চাইলো। সালেহা খালার বাটন ফোনে। আমি জড়তা নিয়ে ফোন কানে নিলাম। সালাম দিতে সে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ফুলি? তোর নাকি জ্বর এসেছিল? আমাকে জানাস নি কেন রে? জ্বর আছে এখনো?’

আমি আশ্বস্ত করে বললাম,

‘জ্বর নাই। সেরে গেছে। আপনি কেমন আছেন ভাই?’

‘আমি ভালো আছি। জ্বর আসলো কি করে? অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে তোর?’

‘উঁহু। একদমই না!’

আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। ফাইজান ভাই বা জাবির। কেউ আমার পক্ষ নিয়ে দু-তিন কথা বললে দিনশেষে তার অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হয়। তারা তো সবসময় পাশে থাকে না। বাড়ি থাকে না!

ফাইজান ভাই ফোন রাখলো কয়েক মিনিট পর। তার কথা শুনে মনে জোর পেলাম। অদৃশ্য শক্তিতে নিজের ভেতরটা পুলকিত হলো। বিছানা গুছিয়ে দ্রুত বই নিয়ে বসলাম। আমায় পড়াশুনা করতে হবে। কঠোর হতে হবে। ধৈর্যশীল হতে হবে। সামনের দিনগুলো মোকাবেলা করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।

___________

‘আজ মঙ্গলবার। গ্রীষ্মের শেষ প্রায়! বছর দুই আগে আজকের এই দিনে আমি অচেনা এক শহরে পা রেখেছিলাম। তখন সাথে কিছু ছিল না। ছিল শুধু বিক্ষিপ্ত মন, ভাঙ্গা হৃদয়, এক বুক দুঃখ আর প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা। ইতোমধ্যে এতগুলো দিন কেটে গেছে। এখনো সাথে তেমন কিছু নেই। শুধু শক্ত মন আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া।

ও হ্যাঁ! যে খুশিতে আজ ডায়েরি লিখতে বসা। দুদিন আগে পরীক্ষার ফল বের হয়েছে আমার। এসএসসি পরীক্ষার ফল। এ+ মিস হয়েছে। তবে অনেক ভালো জিপিএ নিয়ে পাস করেছি। সামান্তা আপু, জাবির ওদের এসএসসি রেজাল্টের থেকে আমার রেজাল্ট ভালো। ফাইজান ভাই ভীষণ খুশি হয়েছে। সালেহা খালার ফোনে কল দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালো। ভাইয়ের মাস্টার্স পরীক্ষা চলে। কিছুদিন পর ছুটি পেলে চলে আসবে। আমায় ভালো কলেজে নাকি ভর্তি করিয়ে দিবে বলেছে। জাবির একবার……..’

‘জুঁই। কোথায় গেলি?’

বড় মা ডাকছে। আমি ডায়েরি বন্ধ করে দ্রুত লুকিয়ে ফেললাম। গভীর রাতে লেখা যাবে। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হলাম। বড় মা রান্নাঘরের সামনে ছুটোছুটি করছে। এগিয়ে যেতে ধমকে উঠলেন।

‘এতো কাজ বাইরে। ঘরে গিয়ে বসে আছিস কেন? কাজে হাত দে।’

‘করছি।’

বড় মা আবার ছুট শুরু করলেন। আমি আশপাশে এক নজর তাকালাম। চারপাশে চেঁচামেচি আর শোরগোলের আওয়াজ। এ বাড়িতে আজ একটা বিশেষ দিন। আত্মীয় স্বজন দিয়ে ভরা। যার বেশিরভাগ আমার অচেনা। গত দুই বছরে যাদের জীবনে দেখিনি তারাও উপস্থিত।

আজ এই বিশেষ দিনের প্রধান আকর্ষণ রাজ ভাইয়া। তিনি বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরছেন। অনেকগুলো বছর পর। আত্মীয় স্বজন সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। তাকে দেখবে বলে।

বাহিরের খোলা বাগানে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড় বড় পাতিলে করে রান্না বসানো। এক রান্না হচ্ছে। এক খাওয়া হচ্ছে। হুলস্থুল অবস্থা! ফাইজান ভাইয়ের বাবা আজাদ রহমান খান। তিনিও আজ বাড়িতে। তার সাথে উপস্থিত রাজনীতির বড় বড় নেতারা। তাদের জন্য বিশেষ উপায় আলাদা রান্না করা হচ্ছে। আরেকটা রান্না হচ্ছে। রাজ ভাইয়ার জন্য। এই রান্নাটা বড় মা নিজে করছে। আমি গিয়ে তাকে সাহায্য শুরু করলাম।

‘বুবু, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো।’

‘পারবো না। এনে খা।’

‘এনে দাও না!’

‘দেখছিস না কাজ করি।’

রান্নাঘরের বাইরে জাবির আর সামান্তা আপুর গলা শোনা যাচ্ছে। পানি নিয়ে দুই ভাইবোন তর্ক করছে। জাবির হোস্টেল থেকে এসেছে। গতকাল! বড় মা ভাজা ইলিশ উল্টাতে উল্টাতে বললো,

‘জাবিরকে পানি দিয়ে আয়। ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে যা।’

‘দিচ্ছি।’

ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করলাম। বোতলের পানি বেশি ঠান্ডা। গ্লাসে অর্ধেক ঠেলে বাকি অর্ধেক জগ থেকে মিশিয়ে নিলাম। সামান্তা আপু সোফায় বসে এক বাচ্চার হাতে মেহেদি দিচ্ছে। পাশে জাকারিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ডাইনিং এ জাবির বসে ছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে পানির গ্লাসটা সম্মুখের টেবিলে রাখলাম। চলে আসার জন্য উদ্যত হতে জাবির বললো,

‘মানুষ কুত্তা-বিলাইকে খেতে দিয়েও দু-চার মুহুর্ত দাঁড়ায়। আর তুই? বড়লোক হয়ে গেছিস? খাবো না পানি। নিয়ে যা!’

‘অনেক কাজ পড়ে আছে। বিকেল হয়ে আসছে। রাজ ভাইয়া এসে পড়বে।’

দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। জাবির বড় হয়ে গেছে। আগে চেহারায় অস্থিরতা ছিল। এখন নেই। গম্ভীর হয়ে এসেছে। ক্লিন শেভড এ কেমন অদ্ভুত লাগছে। অচেনা লাগছে। আমি বসার ঘরে নজর রাখছিলাম শুধু। জাবিরের আম্মু দেখে না ফেলে যেন। ছেলেটার থেকে দূরে দূরে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। আর কোনো ঝামেলা না হোক। আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম,

‘আমি যাই।’

‘খাবার এনে দে। সকাল থেকে খাইনি।’

বাইরের বাগানে খাবারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ির মতো চেয়ার টেবিল বসানো। সেখানে না খেয়ে ঘরে কি খাবে?

‘কি আনবো? বাগানে রান্না….’

‘রান্নাঘরে যা থাকে নিয়ে আয়।’

আমি সরে এলাম। বড় মাকে বলে প্লেটে খাবার নিলাম। পাঠিয়ে দিলাম সালেহা খালাকে দিয়ে। আর বের হলাম না।

___________

এয়ারপোর্টে রাজ ভাইয়াকে আনতে যাওয়া গাড়ি ফিরলো সন্ধার আগে আগে। যাকে আনতে যাওয়ার জন্য এতো আয়োজন। সেই রাজ ভাইয়া বাদে বাকি সবাই ফিরেছে। এক কান দু কান করে সারা বাড়ি রটে গেল। এয়ারপোর্ট থেকে সে পালিয়েছে। বাথরুম ব্যবহার করার কথা বলেছিল। বাথরুমে ঢুকতে দেখা গেছে। কিন্তু কখন বের হয়েছে, কোথায় গেছে আর হদিস পাওয়া যায়নি।

বড় মা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ভয়ংকর রেগে গেল একজন। রাজ ভাইয়ার বাবা। সব দোষ গিয়ে পড়লো বড় মায়ের উপর। তাকে বকাঝকা করে বের হয়ে গেলেন তিনি। সবাইকে চিন্তিত দেখে আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজন বিদায় হলো। সন্ধ্যার পর পর বাড়ি খালি প্রায়। যাকে নিয়ে এতো আনন্দ, উৎফুল্লতা তার অনুপস্থিতি সব মাটি করে দিলো। জাবির আর সামান্তা আপু কয়েক সেকেন্ড পর পর ফোন দিতে লাগলো। সবগুলো নাম্বার বন্ধ!

সবাই অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করল। বসার ঘরে রইলো এই আশায় যে হয়তো রাজ ভাইয়া ফিরবে। একা ফিরবে। পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে ফিরবে হয়তো। কিন্তু সে ফিরলো না। একসময় ক্লান্ত হয়ে সবাই ঘুমাতে গেল।

ড্রয়িং রুমের কলিং বেল বাজল। একবার, দুবার! রাতের শেষ ভাগ তখন। আমি চমকে উঠলাম। সবেমাত্র চোখ বুজে এসেছিল। ধড়ফড় করে বিছানায় বসে পড়লাম। পাশে সালেহা খালা গভীর ঘুমে। খালাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললাম,

‘খালা কলিং বেল বাজছে। কেউ এসেছে!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here