#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,৪,৫
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০৪
আমি অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড় করলাম,
‘আমার ভালবাসার মানুষগুলো তীব্র অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছাড়লো। তোমরা কেউ দেখলে না। কেউ নাহ!’
___________
চোখ মেলতে দেখি ভোরের আলো ফুটে গেছে। চারপাশে চেঁচামেচি আর শোরগোলের আওয়াজ। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আশপাশের দুই তিন গ্রামের মানুষ চলে এসেছে। বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা নেই। আব্বা নতুন বউ আনার পরো এত মানুষ হয়েছিল না। আজ পরিচিত অপরিচিত মানুষ দিয়ে বাড়ি ভর্তি। আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। এতো মানুষ কেনো বাড়িতে? ঐতো মায়ের দূর সম্পর্কের বোন টা দাড়িয়ে আছে। সবার চোখ মুখ এমন শুকনো কেন! বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি।
বারান্দার ছোট্ট খুপড়িতে আছি। আমাকে ঘিরে জনা-দশেক মানুষ। মাথার উপরে স্যালাইন ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। আমাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে? কখন? আর কেন? আচমকা মস্তিষ্ক খোলাসা হলো আমার। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দৌঁড়ে বড় ঘরের দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে চোখের সামনে দেখতে পেলাম চার-চারটে লাশ। মাটিতে শায়িত। হিতাহিত বোধশূণ্য হয়ে গেলাম যেন! দৌঁড়ে মায়ের কাছে যেতে যেতে বললাম,
‘মাকে মাটিতে শুইয়ে রেখেছ কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো। মায়ের শ্বাসকষ্ট আছে! সর্দি হলে মা শ্বাস নিতে পারে না।’
মায়ের শরীর স্পর্শ করে শিউরে উঠলাম আমি। ঠান্ডা বরফের মতো হয়ে গেছে। কেমন যেন থমকে গেলাম। একে একে বড় আপা, সেজো আপাকে স্পর্শ করলাম। সবার শরীর এতো শীতল কেন? এক লাফে পুতুলের কাছে গেলাম। পুতুলের শুকনো ঠোঁট জোড়া হালকা প্রসারিত। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে মিষ্টি কোনো স্বপ্ন দেখে হাসছে। ঘুমানোর আগে এক বাটি দুধ পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিল নিশ্চয়ই! আহারে পুতুল। আমার পুতুল!
বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো আমার। দুনিয়া এতো নিষ্ঠুর কেন! তবে কি সেজো আপার কথা সঠিক? বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন? তা না হলে মা সবাইকে নিয়ে আত্ম’হ’ননের পথ বেছে নিলো কেন! হুট করে বুকের ভেতর বিপুল শূন্যতা অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম আমার এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। এই যে চারপাশের এত লোকজন! এদের কেউ আমার আপন নয়। কেউ আমার ভালবাসা নয়। আমার প্রিয়জন নয়! সন্ধ্যা মেলাবার আগে আগে সবাই চলে যাবে। পালিয়ে যাবে। আমার কি হবে এখন?
কয়েক জন ধরে রেখেছিল আমায়। তাদের থেকে ছুটে দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে গেলাম। বাঁকানো হিজল গাছটার গোড়ায় সাদা বিড়ালটা মরে পড়ে আছে। কাল রাতে এখানেই খেতে দিয়েছিলাম ওকে। বেচারা আর নড়বার সুযোগ পায়নি। আহারে জীবন! হাঁটু ভাঁজ করে ওর পাশে বসে পড়লাম। গায়ে হাত বুলাতে মন বলে উঠলো,
‘আমার মৃত্যুটা এভাবে নিজের করে কেন নিলি? এখন আমি এই পৃথিবীতে একা বাঁচবো কি করে? কি করে!’
কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো শুধু। আর কাঁদলাম না। কান্না পেলো না আমার। লোকজন ধরে উঠোনে নিয়ে এলো। আমি রান্নাঘরের এক কোনায় বসে সবকিছু দেখতে লাগলাম। নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। চারপাশের এতো কান্না, আহাজারি, লোকজনের আহা উঁহু কিছুই স্পর্শ করছিল না আমায়। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলাম।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের জিপ আসলো। তাগড়া তাগড়া কয়েকজন পুলিশ এসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো। আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমি উত্তর দিলাম না। ঘৃণায় দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। এতদিন এরা কোথায় ছিল? যখন আমরা দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছি। পুতুল তার স্বরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। বড় আপাকে এত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এতদিন তারা কোথায় ছিল যখন আমাদের সাথে একের পর এক অন্যায় হচ্ছিল! কোনো উত্তর দিলাম না পুলিশকে। তাদের ডেকে নিয়ে গেলো রাফি ভাইয়ের বাবা জাকির কাকা। জাকির কাকার সাথে কি কথা হলো জানি না। অনেক তর্ক বিতর্কের পর পুলিশ চলে গেলো। সন্ধ্যার পর পর গ্রামবাসী কবর খুঁড়ে ফেললো।
গোসলের পর আমি শুধু সেজো আপাকে দেখলাম। সেজো আপার ভালো নাম জ্যোতি। আব্বা ময়না বলে ডাকতো। বোনদের মধ্যে আপাকে আমি বেশি ভয় পেতাম। আপার ভয়ংকর রাগ। এই রাগসহ আপা আমার কত আপন ছিল। ভালবাসার ছিল! আমার ভালোবাসার ময়না সাদা কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। আমার আপার চেহারায় কত অভিমান জমানো। বেচেঁ থাকতে এই অভিমান সে সযত্নে লুকিয়ে রাখত। আজ আপার কোনো লুকোচুরি নেই। সে যেনো পৃথিবী বাসীকে বলছে, দেখো আমি কত অভিমান নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তোমরা কেউ খোঁজ নেওনি!
আমার সমস্ত অভিমান গিয়ে মায়ের উপর জমলো। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম মা কম কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছাড়েনি! আমি রাফি ভাইকে নিয়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলে মায়ের কষ্ট উপলদ্ধি করিনি। জন্মের পর থেকে মা যুদ্ধ করছে। বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই করছে। পর পর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় কত লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছে। আব্বার হাতে জখম হয়েছে। আব্বার লাঠির আ’ঘাতে পাঁজরের হাড় ভাঙ্গার পরও মা হাল ছাড়েনি। জীবনযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করেনি। আজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমার মা নিরুপায় হয়ে নিয়েছিল। মা যে ইতোধ্যে হাজার বার ম’রে গেছে!
রাত হতে না হতে আমার ভালবাসা গুলো চোখের আড়ালে চলে গেলো। তাদের দূরে কবর দিয়ে এলো। প্রিয়জনদের আমার অলক্ষ্যে রেখে আসলো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু। কিচ্ছু করতে পারলাম না। কয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেললাম না। এতো নিষ্ঠুর কেন আমি?
সেদিনের রাতটা কি বিভীষিকাময় কাটলো। আমার নতুন মা এলো পরদিন। বাড়ি তখন সুনসান। কয়েক জন স্বজন ছাড়া কেউ নেই। নতুন মা এসে আমায় সান্ত্বনা দিলেন। আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। এক ফাঁকে বললাম,
‘আমি ঠিক আছি। আপনার কিছু বলতে হবে না!’
সে তবুও থামলো না। আমার কাছ ঘেঁষে এসে বলল,
‘তুমি কি ভয় পাচ্ছো জুঁই?’
‘ভয় কেন পাবো? আশ্চর্য! আর কাকে ভয় পাবো?’
‘নতুন মা কিছুক্ষণ উসখুশ করল। পরে বললো,
‘এ বাড়িতে তোমার একা থাকা নিরাপদ না জুঁই। বুঝছো? তোমারে আমার সাথে নিয়ে যাবো ভাবতেছি। কি বলো?’
‘আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকবো।’
বলে সরে এলাম আমি। তখনও বুঝতে পারিনি, এই জীবনে ঠিক কি কি হারিয়ে ফেলেছি আমি!
___________
এতগুলো প্রাণ চলে গেলো দুনিয়া ছেড়ে। এক রাতের বিনিময়ে। অথচ তাতে পৃথিবীর কিচ্ছু হলো না। রোজকার মত সকাল হতে লাগলো, পাখিরা কিচির মিচির শুরু করলো। দখিনা হাওয়া বইতে লাগলো। দু-চারদিন কানাঘুষা করে গ্রামবাসী থেমে গেলো। তাদের কাছে সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। শুধু আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন। সবকিছু আগের মতো থেকেও আমার চারপাশে কি যেন নেই! বাতাসে মায়ের গায়ের গন্ধ নেই। হুটহাট পুতুলের কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না এখন। বড়ো আপা ঘোমটা খুলে আর ডেকে উঠে না। সেজো আপার গা ছাড়া স্বভাব আর চাইলেও দেখতে পাই না। এই এতো এতো শুন্যতা আমার ছোট্ট হৃদয় আস্তে আস্তে উপলব্ধি করতে লাগলো।
আব্বা এলো বেশ কিছুদিন পর। এতদিন অনেকটা পলাতক ছিল। পুলিশ নাকি আব্বাকে খুঁজেছে। তার জন্য পালিয়ে পালিয়ে ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আব্বা লুকিয়ে এলো। আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আব্বার প্রতি আমার ঘৃণার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতটা বেড়ে গেছে যে আমি তার মুখ পর্যন্ত দর্শন করলাম না।
রাতের বেলা বারান্দার খুপড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাফি ভাই আসছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি বিভ্রম মনে হলো আমার। পরে দেখি নাহ! সত্যি রাফি ভাই এসেছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে আব্বা বেরিয়ে এলেন। তাড়াহুড়ো করে এসে তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ বিমূর্ত রইলাম। আব্বা রাফি ভাইকে কেন ডেকেছে কারণ উদঘাটন করতে পারলাম না।
সময় বয়ে যাচ্ছে। ওপাশের ঘরে কি কথা হচ্ছে জানা নেই আমার। কিছুক্ষণ এ ঘরে ছটফট করে বের হলাম। উচিত-অনুচিতের তোয়াক্কা না করে ভেড়ানো দরজার এপাশে কান রাখলাম। আব্বা কয়েক মিনিট এ কথা, সে কথা বললেন। হুট করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাবাজী তুমি কি জুঁই মাকে পছন্দ করো? ওরে বিয়া করতে পারবা?’
দরজার এপাশে বুক দুরুদুরু বেড়ে গেলো আমার। সেই সাথে আব্বার উপর রাগ হলো। আব্বা কি বলছে এসব? ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও মনের কোনো একটা অংশ রাফি ভাইয়ের উত্তর শুনার জন্য অপেক্ষায় রইলো। রাফি ভাই দীর্ঘ সময় নিল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘চাচা আমি আপনার সেজো কন্যা জ্যোতিকে পছন্দ করতাম। ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। কি এক অঘটন ঘটে গেলো।’
রাফি ভাইয়ের কণ্ঠে দুঃখ ফুটে উঠেছে। কাছের কেউ, আপন কেউ হারানোর দুঃখ। কিন্তু আব্বা হাল ছাড়লেন না। বললেন,
‘যা হইবার তা তো হইয়া গেছে। জ্যোতি মা তো আর ফিরা আইবো না। তুমি বাজান আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিতে পারবা? বাচ্চা মেয়ে আমার! জীবনটা উলোট-পালোট হইয়া গেছে। বহুত কষ্ট পাইতেছে। তুমি রাজি থাকলে আমি আইজ রাইতেই তোমার আব্বার লগে কথা কমু। তোমার আব্বা আমার বন্ধু মানুষ। ওরে তোমার হাতে তুইলা দিলে আমি এট্টু নিশ্চিন্ত হই।’
‘চাচা মাফ করবেন। আমি পারবো না। জুঁইকে আমি অন্য নজরে কখনো দেখি নাই।’
আমি আর দাঁড়ালাম না। ছুটে ঘরে চলে আসলাম। যা শোনার, যা বোঝার তা হয়ে গেছে আমার।
_________
লোকমুখে শুনতে পেলাম আব্বা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়ি ছাড়া গ্রামে আমাদের আর কোনো সম্পদ ছিল না। বাড়ি বিক্রির সব কথা কানে এসেছে আমার। কিন্তু প্রতিবাদ করিনি। কেন করবো? কার জন্য করবো? এই বাড়িতে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল! আমি এই বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, পরিচিত মানুষ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাই। এই জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাই। দূরে, বহুদূরে!
আব্বা বেশ কিছুদিন হলো আমার সাথে এ বাড়িতে থাকে। একদিন নতুন মা এলো। পরদিন ভোরবেলা মা-বোনদের কবর জিয়ারত করা হলো। বিকেলবেলা নতুন মা আমায় কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিতে বললো। বুঝতে পারলাম, পুরোনো স্মৃতি ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সেদিন রাতের আঁধারে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। প্রিয় জায়গা ছেড়ে, প্রিয় মানুষগুলো ছেড়ে! শেষ বারের মতো পুকুর পাড় থেকে রাফি ভাইয়ের বাড়ির দিকে তাকালাম। রাফি ভাই বারান্দা দিয়ে একবার হেঁটে গেলো। পূর্বের মত এবারো টের পেলো না কেউ একজন তাকে দেখে চোখের শান্তি মেলালো। শেষবারের মতো!
আমি সম্মুখে পা রাখলাম। আমার পনেরো বছরের সমস্ত আবেগ, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আর প্রিয় মানুষগুলোর সমস্ত স্মৃতি ফেলে রেখে এগিয়ে চললাম। এতটুকু দুঃখ পেলাম না, কষ্ট পেলাম না। কাঁদলাম না! পাথর হয়ে গেছি যেন। আমার শুকনো চোখের নদীতে জোয়ার আসলো খানিক পরে। অবশেষে মায়ের কবরের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম, আমার ভালবাসারা ভালো নেই!
(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা অহি
#পর্ব – ০৫
অবশেষে মায়ের কবরের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম, ‘আমার ভাল বাসারা ভালো নেই!’
__________
অনেকটা রাত! ঘন অন্ধকার আকাশ। গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে গিয়ে আব্বা আর নতুন মায়ের ঝগড়া লেগে গেলো। বিধ্বস্ত মস্তিষ্ক আমার। এতক্ষণ তাদের কথোপকথন কিছু খেয়াল করিনি। আব্বা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতে তাকালাম। নতুন মা-ও চুপচাপ রইলো না। প্রচন্ড রেগে গেলো। কিছুক্ষণ দৃষ্টিপাত করে বুঝতে সক্ষম হলাম ঝগড়া লেগেছে আমাকে নিয়ে। আমার থাকার জায়গা নিয়ে। নতুন মা যেখানে নিয়ে যাবে আব্বা রাজি হচ্ছে না। কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে এরা?
ছোট মা হঠাৎ আরো বেশি রেগে গেলো।মুখ দিয়ে বিশ্রী কিছু শব্দ বের করে বললো,
‘কোথায় নিয়ে যাবি তুই? তোর হিম্মত আছে? ওরে কোথাও রাখার জায়গা আছে? নিজেই তো আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছিস।’
আব্বা চুপ হয়ে গেল। আর কোনো উত্তর দিল না। মুহূর্তে আব্বার চরম অসহায়ত্ব প্রস্ফুটিত হলো। টের পেলাম আব্বার ছটফটানি। সারাজীবন মায়ের উপর ছুরি ঘুরানো মানুষটার উপর এখন অন্য কেউ ছুরি ঘুরাচ্ছে। অন্য কেউ তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ইশ! আমার অসহায় মাকে কতটা নির্যাতন করেছে এই মানুষটা। আব্বার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একটা ছেলে সন্তানের জন্যে কতো আকুলি বিকুলি করতো মা। শুধু আব্বার ভয়ে সর্বদা কতটা তটস্থ থাকতো। আহারে মা আমার!
গাড়ির আশপাশের কিছু মানুষ ইতোমধ্যে মাথা ঘুরিয়ে তাকানো শুরু করেছে। আমি আবার গাড়িতে মাথা এলিয়ে দিলাম। জানালা দিয়ে দৃষ্টি নিপাত করলাম বাহিরের ঘন কালো অন্ধকারে। বেশ বুঝতে পারছি বাহিরের ওই নিকষ কালো অন্ধকারের চেয়ে আমার জীবনের অন্ধকার আরো তীব্র। আরো ঘন!
গাড়ি থেকে নেমেছি অনেকক্ষণ হলো। হাতে ছোট্ট এক ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছি। নতুন মা আমার পাশে। আব্বা মুখ ভার করে পেছন পেছন আসছে। আস্তে আস্তে লোকালয় ছাড়লাম। এদিকটা ফাঁকা। বাড়িঘর নেই। সরু এক রাস্তা চলে গেছে বরাবর। রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত। কাছে মাঠের মত জায়গাটা আলোকিত। মানুষ দিয়ে গিজগিজ করছে। বিয়ে বাড়ির মতো চাদর দিয়ে সম্পূর্ণ মাঠ ঢাকা।
বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো আমার। নতুন মা কি আমাকে তার যাত্রাপালায় নিয়ে এলো? তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। সাথে আব্বা আর ছোট মা দুজনই দাঁড়িয়ে পড়লো। ছোট মা বুঝতে পারলো। ভরসা দিয়ে বললো,
‘তুমি যেমন ভাবছো এমন কিছু না মা। আসো আমার সাথে। ভয় নেই!’
একপ্রকার জোর করে সে ভেতরে নিয়ে গেলো। পুরো প্যান্ডেল মানুষ দিয়ে ভরা। উচ্চ শব্দে গান বাজছে। অদ্ভুত সব গান। নোংরামিতে ভরা। আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। নতুন মা গোপন এক পথ দিয়ে প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকলো। আমাকে নিয়ে গেলো টিন দিয়ে তৈরি ছাপড়ার দিকে। দুরুদুরু বুক নিয়ে ভেতরে গেলাম। আমাদের দেখে চারপাশ থেকে জেঁকে এলো সবাই। নতুন মায়ের সঙ্গী সাথীরা। যাত্রাপালার বাকি লোকজন। সবার পোশাক-আশাক দেখে গা গুলিয়ে উঠলো আমার। অজানা আতঙ্কে মন ছেয়ে গেলো।
মোটা কাপড় দিয়ে ঝুপড়ির মতো করা একটা কোণায় বসে রয়েছি আমি। নতুন মায়ের চাচাতো ভাই বলে পরিচয় দেওয়া লোকটা ঝুপড়ির ওপাশে ঘুরঘুর করছে। লোকটার চাহনি অসহনীয়! নিঃশ্বাস আটকে পরে রইলাম আমি। প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো। আব্বা এলো অল্প পরেই। এই মানুষটাকে আমি বিশ্রী ভাবে ঘৃণা করি। তবুও এই মুহূর্তে তাকে দেখে বুকে একটু সাহস পেলাম যেনো।
আব্বা এখানকার পরিচিত মুখ। সবাই আব্বাকে চিনে। বেশ বুঝতে পারছি আব্বার এখানে যাতায়াত নতুন নয়। বহু পুরনো। আব্বা হঠাৎ ফিসফিস করে বললো,
‘দোয়েল, মা। তোরে এইহানে রাখা যাইবো না। আমি যা কইতেছি তাই হুন। ভোরবেলা এইহান থেইকা পালায় যাব আমরা। এরা কেউ টের পাইবো না। সারারাত গান বাজনা করে ওরা ভোরের দিকে ঘুমায় যায়। তোর নতুন মা পরে জানলে জানবো। সমস্যা নাইকা!’
‘পালিয়ে কোথায় যাবো?’
উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি। আব্বা ইশারায় চুপ করতে বললো। গলার স্বর আরো নিচু করে বললো,
‘তোর কিচ্ছু চিন্তা করতে হইবো না। সব ব্যবস্থা করছি আমি। ঢাকা যাবো আমরা।’
আর কোনো কথা হলো না। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বুক ফুঁড়ে ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো। ঢাকা! নাম শুনেছি কতবার। যাওয়া হয়নি কখনো। মাঝে মাঝে রাফি ভাইয়ের পরিবারকে যেতে দেখতাম। ঢাকায় নাকি তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। ঘুরতে যেত তারা! ঢাকা নিয়ে আমার সুখস্মৃতি নেই। রাফি ভাইয়ের ঢাকা থাকার দিনগুলো ভীষন কষ্টে কাটত আমার। টানা কয়েক দিন তাকে চোখের দেখা দেখতে পেতাম না। কি দুর্বিষহ!
________
আব্বার সাথে যখন স্টেশনে নামলাম তখন দুপুর। অবশেষে ঢাকার মাটিতে পা রাখলাম। আজ প্রথম ট্রেনে ভ্রমণ ছিল আমার। এই ভ্রমণে যদি মা আর বোনেরা সাথে থাকতো কত মজা-ই না হতো! পুতুল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতো খুশিতে। বড় আপা আর মা গল্প করতো জমিয়ে। ক্ষণে ক্ষণে বড় আপা শব্দ করে হেসে উঠতো। আপা বড্ড সহজ সরল ছিল। ছেলেমানুষী দিয়ে ভরা! বাচ্চাদের মত অল্পতে খুশি হতো।
আর সেজো আপা? সেজো আপা গম্ভীর মুখে বসে থাকতো। গম্ভীরতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা আপার উৎফুল্লতা শুধু আমি ধরতে পারতাম।
স্টেশনে আমার চারপাশ লোকে লোকারণ্য। রোগা, পাতলা, হ্যাংলার মতো এক বাচ্চা ছেলে এসে আমার ওড়না টেনে ধরলো। বায়না করলো টাকার। আব্বা ঝামটা দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে দিলো। ছেলেটা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আমি তার চেয়েও অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালাম। কারণ আমার কাছে এক পয়সাও নেই! দৃষ্টি বিনিময় হতে ছেলেটা বুঝতে পারলো বোধ হয়। সময় ব্যয় না করে অন্যদের পেছন ছুটলো।
কিছুদূর গিয়ে আব্বা আমায় বসিয়ে দিলেন। পুরনো মডেলের বাটন ফোনটা কানে ধরে কাকে যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন। আমি চেয়ে চেয়ে আব্বার ব্যস্ততা দেখছি। চোখে মুখে তার এখন চিন্তার ছাপ। ছুটোছুটি করছে ক্রমাগত। অথচ এই মানুষটা একটা গোছানো পরিবারকে হত্যা করেছে। আস্ত এক পরিবারকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তার জন্য আমি মা হারা, বোন হারা! তার জন্য আমি আজ বাড়ি ছাড়া, প্রিয়জন ছাড়া। এই মানুষটার উপস্থিতি কি সহ্য করা যায়? করা যায় না! কিন্তু আমাকে করতে হচ্ছে। আর তো উপায় জানা নেই। আমি পাথরের খাঁজে আটকে পড়া মাছ। তড়পানো ছাড়া কিছু করার নেই।
কিছুক্ষণ পর আব্বা আমায় নিয়ে সিএনজি তে উঠলো। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে দেখলাম এটা কমলাপুর স্টেশন। আজ প্রথম এই নামটা জানলাম।
গাড়ি চলছে। আব্বার সাথে আমার কথা বলা হয় না। আজ সারাটা পথ একটা কথা বলিনি। কিন্তু এখন তো জানতে হবে আমি কোথায় যাচ্ছি। এই মানুষটিকেও আমি বিশ্বাস করি না! আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। এক বুক দুঃখ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কোথায় যাচ্ছি আমি?’
আব্বা যেনো এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলেন। বড্ড খুশি হয়ে উঠলেন। ঝলমলে সুরে বললেন,
‘বড় এক বাড়ি তোমারে রাইখা আসতেছি। কোনো কিছুর কষ্ট হইবো না দোয়েল। ভালো ভালো খাবার খাইতে পারবা। শুধু টুকটাক কাম করবা আর খাইবা। কামও বেশি নাই। আরো লোক আছে। কোনো চিন্তা নাই তোমার। আমি মাঝে মাঝে আইসা খোঁজ নিয়া যাবো।’
আব্বা তুই থেকে তুমি করে বলছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। ঠোঁটে শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। এই ঢাকা শহর নিয়ে আমার দুচোখে কতো স্বপ্ন ছিল। রাফি ভাইয়ের সাথে আসবো। ঘুরবো! অথচ এই শহরে আমার জায়গা হলো কাজের মেয়ে হিসেবে। এই শহর আমাকে কাজের মেয়ে পরিচয় দিল।
আব্বা নতুন বাড়ির গুণ কীর্তন করছে। আমার সেদিকে মনোযোগ নেই। আমি চলমান গাড়ি দেখছি। পাশের লেন দিয়ে বড় বড় বাস, ট্রাক যাচ্ছে। একবার মনে হলো চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি? তাহলে তো এই জীবনের, এই দুঃখ কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে! আব্বা পাশে তখনও বকবক করে যাচ্ছে। আচমকা অন্য এক চিন্তা এলো। হঠাৎ করে মনে হলো আব্বাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই? এই মানুষটার কি শাস্তি প্রাপ্য না?
আমি কিছুই করতে পারলাম না। কোনোটারই সাহস হলো না। ছোটবেলা থেকে ভীষণ ভীতু আমি। রাফি ভাইকে ভালোবাসা ছাড়া জীবনে আর কিচ্ছু করিনি। এই জীবন কি করে পাড়ি দিবো এখন?
গাড়ি থামলো। আব্বা আমায় সাথে নিয়ে হাঁটা ধরলো। কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়াল নেই। অবশেষে বড়ো এক বাড়ির সামনে আব্বা থামলো। বাড়ি দেখে বুক দুরুদুরু শুরু হলো। সাথে প্রচন্ড ভয়। এই আমার চিন্তা জুড়ে রাফি নামক ছেলেটা ছাড়া আর কিছু ছিল না। এখন আমি কি করে এই ঝড় সামাল দিবো? কি করে এই শহরে একা থাকব? চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।
আব্বা ফোনে দুটো কথা বলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নতুন এক জীবনে পা রাখলাম আমি। ভেতর বাড়িতে ঢুকতে একঝাঁক অচেনা মানুষ নজরে এলো। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা আমায় কাছে টেনে নিলেন। তার হাসিমুখ দেখে কিছুটা স্বস্তি মিললো।
আব্বা দেরি করলেন না। তাকে আবার ফিরতে হবে। সোফায় বসে ছিলাম আমি। আব্বা কাছে এসে বললেন,
‘আমি যাই তাইলে দোয়েল।’
চমকে তাকালাম আমি। এতক্ষণ চেপে রাখা কষ্টগুলো যেনো কুঠুরি মুক্ত হলো। একের পর এক আঘাত হানলো বুকের দেয়ালে। আমি আর শক্ত থাকতে পারলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। এখানে আমি একা থাকবো কি করে?
__________
আমার থাকার জায়গা হয়েছে রান্নাঘরের পাশের রুমটাতে। আমি একা নই। সাথে আরেকজন মহিলা আছে। কাপড় চোপড় রেখে রুমের বাইরে বের হলাম আমি। মন ভার হয়ে আছে। আব্বা চলে গেছে অনেক আগে। যাওয়ার আগে তিনি বলে গেছেন খোঁজ খবর নিবে। কিন্তু কেনো জানি আমার মন বলছে আব্বা আর খোঁজ নিবে না।
আশা ছেড়ে দিয়েছি। নিজেকে বুঝিয়েছি এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। রক্তের কেউ নেই। দেখি জীবন তরী আমাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যায়। আরো কি কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
এ বাড়িতে সাজ সাজ রব। সবার মধ্যে উৎফুল্লতা। সবাই ছুটোছুটি করে কাজ করছে। ঘর দুয়ার পরিষ্কার করছে। আমি টিপে টিপে পা ফেলে ড্রয়িং রুমে আসলাম। সালেহা খালা মেঝে পরিষ্কার করছিল। সে-ও এই বাড়িতে কাজ করে। খালার সাথে কথা হয়েছে। আমি কাছে যেতে বললো,
‘তুমি আইজ ঘুমাও গা! শরীল অসুস্থ না?’
‘এখন ঠিক হয়ে গেছি খালা। মাথা ব্যাথা ছিল। সেরে গেছে। আমি কি কাজ করবো?’
খালা আমায় কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে নিচ তলা দেখালো। এ বাড়িতে লোকসংখ্যা অনেক। বড়সড় পরিবার। বাড়ির কর্তা বড় দুই ভাই! তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সবাই একত্রে বাস করে। ছোটবড় সব মিলিয়ে চার-পাঁচটা সন্তান। বয়স্কা দাদী আরো লোকজন দিয়ে ভরা। এতবড় বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিবো কি করে! আমি ভীত চেহারা নিয়ে নিয়তিকে দোষারোপ করছিলাম।
সালেহা খালা আমায় জিজ্ঞেস করলো,
‘রান্না পারোনি?’
আমি মাথা নাড়লাম। অসম্মতি জানিয়ে বললাম,
‘ভালো পারি না। শিখে নিব!’
‘বড় বু’র ছেলে আইছে বাড়িত। রান্না ভালো না হইলে খাইবো না। তুমি বরং ঘর মুছে ফেলো। আমি কুটাবাছা করে বু রে সাহায্য করি।’
মেঝে মোছার দায়িত্ব দিয়ে সালেহা খালা চলে গেলো। আমি এক বুক কষ্ট নিয়ে পানির বালতি হাতে তুলে নিলাম।
(চলবে)