#ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি (পর্ব -১)
#মৌমিতা হোসেন
তাসফিয়া আর জারিফ দুজন চাচাতো ভাইবোন। তাসফিয়া এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং শুরু করেছে। অপরদিকে, জারিফ একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।জারিফ জার্মানিতে থাকে ।
আজ তাসফিয়া কোচিং শেষ করে বাসায় এসেই দেখে বাসায় মা-বাবা, দাদির মধ্যে কেমন এক অন্য রকম আনন্দ। ভালো রান্নার বেশ তোড়জোড় চলছে।দাদি বুয়াকে দিয়ে বাসায় সবকিছু পরিষ্কার করাচ্ছে। কিছু বুঝতে না পেরে তাসফিয়া দাদিকে জিজ্ঞেস করলো,’দাদি বাসায় কি আজ কেউ আসবে নাকি?’
দাদি কিছু বলার আগেই মা জেসমিন বেগম তড়িঘড়ি করে রান্না ঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এসে বলে,
‘তুই আজ এতো দেরি করে এলি কেনো? বাসায় মেহমান আসবে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে আমাকে একটু কাজে সাহায্য কর।’
তাসফিয়া মায়ের এতো তাড়াহুড়ো দেখে বলে ,
‘কে আসবে সেটা কি বলবে মা?’
মা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,’তোর বড় চাচাতো ভাই জারিফ আসবে।প্রায় বারো বছর পর দেশে আসছে ছেলেটা।তাও মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। অফিসের কাজে আসছে। এখানে একটা মিটিং আছে।আরো কি কি কাজ আছে জানিনা। আসার পর শুনবো।তুই তাড়াতাড়ি আয় কাজ আছে।’
তাসফিয়ার বাবা আশরাফ খান ।ওনারা পাঁচ ভাই বোন। তিন ভাইয়ের মধ্যে আশরাফ খান সবার ছোট। বাকি দুই ভাই পরিবার নিয়ে জার্মানি তে থাকে।আর দুই বোন থাকে ইটালি। বড় ভাইয়ের চার ছেলের মধ্যে জারিফ সবার বড়। জার্মানিতেই বড় হয়েছে। ওখানেই ভালো জব করে।ভদ্র, মার্জিত, দেখতে খুব সুদর্শন।আর বেশ রাগী। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে।সব সময় কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে।সব কাজিনরা জারিফ কে প্রচন্ড ভয় পায়। ফোনে যখনই অন্য কাজিনদের সাথে কথা হতো তখনই সবাই জারিফের ব্যাপারে ওর রাগের কথাই বলতো। যেহেতু সবার বড় আর রাগ বেশি তাই কোনো কাজিনের সাথেই জারিফের খুব আন্তরিক সম্পর্ক নেই।আর তাসফিয়া ও এই জন্যই সব কাজিনদের সাথে কথা বললেও জারিফের সাথে খুব দরকার ছাড়া কখনো তেমন একটা কথা বলতো না।
তাসফিয়া আশরাফ খান এর একমাত্র মেয়ে। মাত্রই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটি তে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখতে খুব আহামরি না হলেও মোটামুটি ভালো। পরিপাটি হয়ে থাকে সবসময়। একটু বেশি বাস্তবধর্মী চিন্তা ভাবনা ওর। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বাবার স্বপ্ন পূরণ। পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।অন্যের ওপর কোনো কিছুতেই নির্ভরশীল হতে চায়না। তাসফিয়ার আত্মসম্মানবোধ একটু বেশি। অনেক সাহসী, সহজে কারো কাছে মাথা নতো করেনা। উচিত কথা বলতে পিছপা হয়না।
তাসফিয়ার বড় চাচি একটু বেশি বিত্তশালী হওয়ায় বেশ অহংকারী।তাই উনি নিজেকে গুটিয়ে রাখে সবার কাছ থেকে।এই কারনেও অনেকটা চালাকি করেই ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই স্বপরিবারে জার্মান চলে যায়।আর এজন্য সব সময়ই ওদের মধ্যে একটু দুরত্ব ছিলো।
যাই হোক বড় ভাই আসবে তাই কিছুটা বিরক্ত হয়েই তাসফিয়া মায়ের কথায় কাজ শুরু করলো। বাসায় তিনটা বেডরুম। একটা দাদির, একটা তাসফিয়ার আর একটা ওর বাবা-মায়ের। জারিফের জন্য জেসমিন বেগম তাসফিয়ার রুমটা রেডি করে রেখেছে। তাসফিয়ার বিরক্ত হবার পেছনে এটা হলো একটা কারন।
ইতিমধ্যে আশরাফ সাহেব এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দেয়। জারিফ কে উনি রিসিভ করে নিয়ে আসবে। এতো বছর পর বংশের বড় ছেলেকে দেখবে তাই একটু বেশি আবেগপ্রবণ হতে থাকে বারবার।খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এই ত্রিশ বছরে আশরাফ সাহেব এর ভাইয়েরা দেশে আসেনি।জারিফকেও আসতে দেয়নি। এবার অফিসের কাজ পরায় নিরুপায় হয়ে জারিফ কে অনুমতি দিয়েছে দেশে আসার। জারিফের মা নিগার সুলতান অবশ্য বারবার বলে দিয়েছে জারিফ যেনো কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে ওঠে।
এদিকে,জারিফের মনে মনে পরিকল্পনা ছিলো যে ও এবার ছোট চাচার বাসায় উঠবে।দাদির সাথে দেখা করবে। ছোটবেলা যখন একবার এসেছিল তখন চাচি জেসমিন বেগম বেশ আদর করে।সেই আদর , ভালোবাসা জারিফ আজও ভোলেনি। তাসফিয়া তখন খুব ছোট ছিলো।কেনো জানি আবার চাচির আদর পেতে,চাচির হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। জারিফ ভাবছে ,এখন নিশ্চয়ই তাসফিয়া অনেক বড় হয়ে গেছে।প্লেন থেকে নেমে এসব ভাবতে ভাবতেই চাচার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে জারিফ।
সালাম বিনিময় করে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। আশরাফ সাহেব আবেগি হয়ে কেঁদে দেয়। সেই ছোট্ট জারিফ আজ কতো বড় হয়ে গেছে।কুশল বিনিময় করে দু’জন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
এদিকে দাদি আর জেসমিন বেগম এর অপেক্ষা যেনো শেষ হচ্ছেনা।রাস্তায় যানজট থাকায় জারিফ কে নিয়ে আশরাফ সাহেবের বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়। কলিং বেল বাজতেই জেসমিন বেগম তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেন।সেই ছোট্ট জারিফ কতো বড় হয়ে গেছে। সুদর্শন এক পুরুষ।বয়স ছাব্বিশ চলছে। বাসায় সবাই বিয়ের জন্য চাপ দিলেও এ পর্যন্ত মন মতো কাউকে না পাওয়ায় এখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারেনি।যাই হোক জারিফকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় চাচি জেসমিন বেগম। এদিকে দাদিও এসে জারিফ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। দাদির খুব আদরের নাতি হলো জারিফ। জারিফের মায়ের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে পাঁচ বছর ধরে দাদি আর জার্মান যায়নি।তাই অনেক বছর পর জারিফকে দেখে একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পরে দাদি।
আশরাফ সাহেব বলেন,’ এখন কান্না বন্ধ করে ছেলেটাকে আগে ভেতরে নিয়ে যাও,ফ্রেশ হতে দাও।’
জেসমিন বেগম আর দাদি তাড়াতাড়ি জারিফকে ভেতরে এনে বসতে দিয়ে তাসফিয়া কে ডেকে বলে সরবত নিয়ে আসতে। তাসফিয়া দ্রুত সরবত এনে জারিফকে দেয়। জেসমিন বেগম বলেন,’জারিফ বাবা দেখতো চিনতে পারিস কিনা?’
জারিফ অপলক তাকিয়ে থাকে তাসফিয়ার দিকে।নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা,লম্বা চুল, দেখতে মিষ্টি খুব সাধারণ এক মেয়ে। প্রথম দেখাতেই জারিফ তাসফিয়া কে চিনতে পারে।
জারিফ বলে,’এই কি সেই ছোট্ট তাসফিয়া?’
জেসমিন বেগম বলেন,’হুম এই সেই ছোট্ট তাসফিয়া।’
‘মাশাআল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছে।’
তাসফিয়া জারিফ কে সালাম জানায়।
জারিফ সালামের উত্তর দেয় ।আর কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই তাসফিয়া দ্রুত ওর রুমে চলে যায়।যেহেতু ও জানে যে জারিফ একটু রাগি তাই আর বেশি কথা না বলে ভেতরে চলে যায়। তাসফিয়ার এমন আচরনে জারিফ কিছুটা অবাক হয়।চাচি জারিফ কে তাসফিয়ার ঘরে নিয়ে যায় আর ফ্রেশ হতে বলে।জারিফ ফ্রেশ হয়ে আসলে সবাই একসাথে খেতে বসে। অনেক বছর পর এভাবে পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। বিষয়টা জারিফের খুব ভালো লাগে।
জারিফের মা সোস্যাল ওয়ার্ক, বিভিন্ন পার্টি আর সাজসজ্জা নিয়ে সারাক্ষন ব্যস্ত থাকায় ছোটবেলা থেকেই ওদের খুব কম সময় দিতো। জারিফ আর ওর ভাইবোনদের দিকে খেয়াল দিতেই পারতো না।মায়ের আদর খুব কম সময়ই পেয়েছে জারিফ। তাই আজ জেসমিন বেগম এর ভালোবাসা আর এতো কেয়ারিং দেখে বারবার আবেগি হয়ে যাচ্ছিলো।
এদিকে তাসফিয়া জারিফ কে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে।ওর কাছে জারিফ কে খুব সাধারণ একজন মনে হয়।খাওয়ার সময় সবাই মিলে বেশ গল্প করে এতে তাসফিয়া আরো স্বাভাবিক হয়ে যায়।আর এক পর্যায়ে বেশ মজাও করতে থাকে।এসব বিষয় জারিফের খুব ভালো লাগে।কারন ওর সাথে এখনো পর্যন্ত কোন কাজিন কখনো স্বাভাবিক ভাবে এতো গল্প করেনি। তাসফিয়া ও ফোনে কখনো প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলেনি।যাই হোক এভাবে হাসি গল্পে দুই দিন কেটে যায়।
এই দুই দিন সকাল হলেই জারিফ ওর কাজে বের হয়ে যেতো।সন্ধ্যায় ফিরেই একসাথে নাস্তা খাওয়া, সবাই মিলে গল্প করা এভাবেই সময় কাটে। তৃতীয় দিন জারিফ সবাই কে নিয়ে শপিং এ নিয়ে যায়। ওখানে জারিফ সবার জন্য কেনাকাটা করে। তাসফিয়া কে কি কিনবে জানতে চাইলে তাসফিয়া বলে,’ আমার কিছু লাগবে না ভাইয়া।’
তাসফিয়া যদিও জারিফ কে ওর জন্য কিছু কিনতে বারবার নিষেধ করে তবুও জারিফ ওর কথা শোনে না। অনেক কিছুই কেনে তাসফিয়ার জন্য।বাসায় আসার পর শপিং ব্যাগ তাসফিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় জারিফ।আর বলে,’ এগুলো তোমার। আমি বসছি চেয়ারে। তুমি খুলে দেখো কি কি কিনেছি।’
দাদি,চাচিও এসে বসে ওদের পাশে। তাসফিয়া ব্যাগ খুলে। দেখে ওর জন্য ড্রেস, চুড়ি আর একটা মগ কিনেছে।এতো কিছু কোন সময় কিনেছে টের পায়নি তাসফিয়া। তবে এতো গিফট পেয়ে বেশ খুশি হয়।
জারিফ বলে,’আজ থেকে তুমি এই মগে করে পানি খাবে।তাহলে যখন আমি থাকবো না তখন এই মগ দেখলেই আমাকে তোমার মনে পড়বে।’
তাসফিয়া একটু অবাক হয়।বলে, ‘ভাইয়া আপনাকে মনে রাখতে হলে এই মগে কেনো খেতে হবে? আপনি আমাদের সবার বড় ভাই আপনাকে এমনি মনে থাকবে।’
জারিফ কি বলবে বুঝতে পারেনা।চারজন মিলে কিছু সময় গল্প করার পর সবাই যে যার রুমে চলে যায়। এদিকে দাদি পুরোটা সময় তাসফিয়ার প্রতি জারিফের ব্যবহার লক্ষ্য করতে থাকে।
সারাদিন ঘোরাফেরা করায় জারিফ খুব ক্লান্ত।ভেবেছে বিছানায় গেলেই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু কেনো জানি আজ ঘুম ওর চোখে ধরা দিতে চাচ্ছেনা। জারিফের মাথায় শুধু তাসফিয়ার চিন্তা ঘুরপাক খায় সারারাত। এভাবে আরো তিনটি দিন চলে যায়। এখন অফিস করে এসে তাসফিয়ার সাথে সময় কাটানোই যেনো জারিফের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। তাসফিয়ার হাসি, ঠাট্টা,গল্প,সাহসিকতা, আত্মবিশ্বাস, সাবলীল কথাবার্তা জারিফের খুব ভালো লাগতে শুরু করে। তাসফিয়া যখনি কথা বলে তখনই জারিফ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে। তাসফিয়ার সাথে কথা বলতে,সময় কাটাতে জারিফের খুব ভালো লাগে। এমনটা এতো গুলো বছরে অন্য কোনো মেয়েকে দেখে কখনো অনুভব করেনি জারিফ।জীবনের যেনো এক নতুন স্বাদ খুঁজে পেয়েছে জারিফ।আর এসবের কোন কিছুই দাদির নজর এড়াতে পারেনি।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে যায়। শুক্রবার সবাই মিলে বেড়াতে যেতে চাইলে আশরাফ সাহেব এর কাজ থাকায় ওনারা কেউ আর যায়না। তাসফিয়া আর জারিফ দুজন মিলে বেড়াতে যায়, বাইরে খাওয়া দাওয়া করে। খুব আনন্দ করে সারাদিন। এদিকে জারিফের মনে ইতিমধ্যে তাসফিয়ার জন্য অন্য এক অনুভূতি আসলেও তাসফিয়া এসব কখনো মাথায় আনেনি।এসব কিছু তাসফিয়ার ভাবনার বাইরে ছিলো।
চলবে…….