#ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি (পর্ব -২)
#মৌমিতা হোসেন
বাসায় এসে জারিফ চাচাকে জানায়, রবিবার দুই দিনের জন্য অফিসের কাজে সিঙ্গাপুর যেতে হবে। ওখানে কাজ শেষ করে এখানে এসে দুই অথবা তিন দিন থেকেই আবার জার্মান চলে যাবে।
পরদিন যাওয়ার আগে জারিফ তাসফিয়া কে বলে,’তাসফিয়া তোমার জন্য কি কি আনবো বলো।’
তাসফিয়া একটু অবাক হয়ে বলে,’ভাইয়া কিছু আনতে হবে না। কতো কিছু কিনে দিয়েছেন।আর কিছু লাগবে না।’
জারিফ তবুও বার বার জানতে চায়।এতো জোর করার কারনে তাসফিয়া বলে, একটা পুতুল আনতে। তাসফিয়ার বড় বড় পুতুলের খুব শখ ।তাই জারিফের বারবার অনুরোধ করার পর পুতুলের কথাই মাথায় আসে।যাই হোক, জারিফ বিদায় নিয়ে চলে যায়। সিঙ্গাপুরে জারিফ এতো এতো কাজের মাঝেও সারাক্ষন শুধু তাসফিয়ার ধ্যানেই মগ্ন থাকে।সব সময় চোখের সামনে তাসফিয়ার চেহারা ঘুরপাক খেতে থাকে।
দুই দিন পর জারিফ কাজ শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসে। জারিফ অপেক্ষায় থাকে কখন তাসফিয়া কে একবার দেখবে।এই দুই দিন চোখের সামনে সারাক্ষন শুধু তাসফিয়ার চেহারাই ভেসেছে। খেতে, ঘুমাতে, জাগতে সব জায়গায় শুধু তাসফিয়া কে দেখেছে। নতুন এই মিষ্টি অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে জারিফের বেশ ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো ও যেনো কোন সুখের রাজ্যে বাস করছে।
জারিফ সবার জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসে। তাসফিয়ার জন্য লাগেজ ভর্তি কসমেটিকস,চকলেট আর দুটো পুতুল আনে। এটা দেখে তাসফিয়া বেশ লজ্জায় পরে যায়।কারন এতো গিফ্ট এ পর্যন্ত কেউ কখনো ওকে দেয়নি। তাই এতো কিছু ও নিতে চায়না। তবুও জারিফ এর জোড়াজুড়ি আর বাবার বলায় তাসফিয়া গিফট গুলো রেখে দেয়। দাদি শুধু নাতির এসব কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করে আর মনে মনে হাসতে থাকে।
পরদিন সকালে জারিফ নাস্তার টেবিলে, টিভি দেখার সময় তাসফিয়ার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করতে থাকে।এমন ভাবে গল্প করতে থাকে মনে হয় যেনো ওর আশেপাশে আর কেউ নেই। ধীরে ধীরে তাসফিয়ার সব কিছুতেই আচ্ছন্ন হয়ে পরছে জারিফ।গল্পের এক পর্যায়ে জারিফ তাসফিয়া কে বারবার ওর পাশে বসতে বলে। কিন্তু তাসফিয়া বিভিন্ন অজুহাতে জারিফের এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। তাসফিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে জারিফের এমন টুকটাক বারাবারিতে তাসফিয়া নিজেই কিছুটা বিরক্ত হয়।
তবে দাদি বিরক্ত হয়না। বরং খুশি হয়ে এক পর্যায়ে বলে,’এতো ঝামেলার দরকার কি?তাসফিয়ার সাথে কথা বলতে যখন তোর এতো ভালো লাগে তাহলে ওকে তোর সাথে একবারে নিয়েই যা দাদাভাই।’
কথাটা শুনেই জারিফ বলে,’হুম দাদি ভাবছি তাই করতে হবে।এর পরের বার এসে তাসফিয়া কে একবারেই নিয়ে যাবো আমার সাথে জার্মানি। সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো।’
কথাটা শুনে তাসফিয়া একটু বেশি অবাক হয় ।রেগে গিয়ে বলে,’এদেশ আর মা-বাবা কে ছেড়ে আমি কখনো কোথাও যাবো না ভাইয়া।’
জারিফ মনে মনে বলে ,’তাহলে নাহয় আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে নিজ দেশে থেকে যাবো।’
দাদির আর জারিফের সব কথার কোন কিছুই তাসফিয়া বুঝতে পারে না।
জারিফের জীবনে প্রথম কাউকে এতো ভালোলেগেছে। সেটাও আবার নিজের চাচাতো বোনকে।আর মনে হচ্ছে এই ভালো লাগাটা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রুপান্তরিত হচ্ছে।তাই জারিফ বেশ দ্বিধায় পরে যায়। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছিলো না। তবে এটুকু বুঝতে পারলো যে ,দাদি হয়তো শুনলে রাজি হবে। জারিফ ঠিক করে আগে চাচাকে বলবে।চাচাকে রাজি করিয়ে তারপর জার্মান গিয়ে মা-বাবাকে জানাবে। জারিফ তাসফিয়ার বিষয়টা বলার জন্য সুযোগ খুজতে থাকে। যেহেতু হাতে সময় নেই তাই রাতেই জারিফ দাদির সাথে তাসফিয়ার বিষয়ে কথা বলে।দাদি জারিফের কথা শুনে বেশ খুশী হয়।দাদিও যেনো মনে মনে এটাই চাচ্ছিলো।দাদির আপত্তি নেই দেখে জারিফ বলে,’চলো দাদি চাচাকে গিয়ে সবটা বলি। আমার তো ফেরার সময় হয়ে আসছে।তার আগেই সবটা ঠিক করো তুমি।’
জারিফের অস্থিরতা দেখে দাদি হেসে দেয়।দাদি বলে ,”আমার তরফ থেকে কোন আপত্তি নেই সেটা ঠিক দাদাভাই। তবে তোমার চাচা এই সম্পর্কে মত দেবে কিনা সেটা কিন্তু আমি জানি না।কারনটা হয়তো তুমি জানো। তোমার মা খুব প্যাচানো আর অহংকারী।আমরা রাজি হলেও সে রাজি হবে কিনা সেটা আল্লাহ পাক জানেন।তাই আরেকটু সময় নাও।জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়া ঠিক না। তুমি বড় হয়েছো দেশের বাইরে বিলাসিতা করে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে।আর তাসফিয়া বড় হয়েছে দেশে কোন বিলাসিতা না করে খুব সাধারনভাবে।তাসফিয়া দাদুকে তুমি সত্যি ভালোবাসো নাকি এটা ক্ষনিকের মোহ সেটা আগে যাচাই করে দেখো। তাসফিয়ার প্রতি ভালোবাসা বোঝার জন্য নিজেকে আরো একটু সময় দাও।তারপর নাহয় তোমার চাচাকে প্রস্তাবটা দাও।আর আমিতো তোমার সাথেই আছি দাদাভাই ।তাই চিন্তার কোন কারন নেই।’
দাদির কথা শুনে জারিফ বলে,’ঠিক আছে দাদি। তুমি যা বলছো তাই হবে। তবে তাসফিয়াকে সত্যি আমার খুব ভালো লাগে। ওকে দেখলেই আমার ভেতরে কেমন জানি এক অস্থিরতা শুরু হয় যেটা এতো গুলো বছরে অন্য কারো জন্য আমি কখনো অনুভব করিনি। ওর মধ্যে কিছু একটা আছে দাদি যা আমাকে খুব করে আকর্ষণ করে। তাই আমি ওকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।তবুও তোমার কথামতো আমি আরেকটু সময় নিয়ে ভেবে দেখবো।তারপর নাহয় চাচার কাছে প্রস্তাব দেবো।’
জারিফের কথা শুনে দাদি খুব খুশি হয়। জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমাতে যেতে বলে।জারিফ দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে আসে। সারারাত তাসফিয়ার ভাবনাই ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। মনে মনে ভাবে, তাসফিয়ার মাঝে কিছু একটা তো আছে যা ওকে খুব আকৃষ্ট করছে। তারপরেও দাদির কথা চিন্তা করে ঠিক করে হাতে আরো দুই দিনতো আছে।এই দুই দিনে আরো একটু জানার সুযোগ পাবে তাসফিয়া কে। ভালোভাবে বুঝতে পারবে তাসফিয়ার প্রতি নিজের অনুভূতিকে।তারপর নাহয় চাচাকে মনের ইচ্ছার কথাটা জানাবে।
পরবর্তী দুই দিন জারিফ সকালে অফিসের কাজ শেষ করে আসার পর থেকেই তাসফিয়ার সাথে সময় কাটায়। অফিসে গেলেও জারিফের মন পরে থাকে তাসফিয়ার কাছে।জারিফ উপলব্ধি করে যে ও সত্যি তাসফিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে।না তাসফিয়া আহামরি সুন্দরী নয়। খুব সাধারন একটা মেয়ে। জার্মানিতে যেসব মেয়েদের দেখেছে,যারা জারিফ কে পছন্দ করতো তারা সবাই বেশ সুন্দরী ছিলো। তাসফিয়ার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট ছিলো।চালচলন,পোশাকে ছিলো আধুনিকতার ছোঁয়া। এসবের কিছুই তাসফিয়ার মধ্যে নেই। তবে ওর মধ্যে যেটা আছে সেটা হলো আত্মবিশ্বাস,সরলতা,শালিনতা। কুটিলতা ছাড়া খুব সাধারন,হাস্যোজ্জল একটা মেয়ে।এই সরলতা আর আত্মবিশ্বাসই জারিফ কে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে।জারিফ অনুভব করতে পারছে যে তাসফিয়ার প্রতি ওর অনুভূতি কোন ক্ষনিকের মোহ নয়।
কাল জারিফ চলে যাবে তাই ঠিক করে চাচাকে আজকেই তাসফিয়ার কথা বলবে।জারিফ ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম তাই তাসফিয়ার আগে চাচাকে বলাই ভালো মনে করে। পারিবারিক সম্মতি নিয়ে বৈধভাবেই সুন্দর সম্পর্ক শুরু করার ইচ্ছা ওর। দাদিকে জারিফ আবার মনের কথা জানায়।বলে যে,’তাসফিয়া আমার ক্ষনিকের মোহ নয় দাদি। ওকে সত্যি আমার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে।আর ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।তাই প্লিজ এবার তুমি আমার সাথে চাচার কাছে চলো।কাল যাওয়ার আগেই আমি এই ব্যাপারটা ফাইনাল করে যেতে চাই।’
দাদি হেসে বলে,’ঠিক আছে দাদাভাই চলো।আমিতো আগে থেকেই রাজি ছিলাম। তবুও তোমাকে ভালোভাবে ভাবতে বলেছিলাম। তোমার যেহেতু এতো পছন্দ সেহেতু চলো।’
দুজন মিলে চাচা আশরাফ সাহেবের কাছে গিয়ে সবটা জানায়।চাচা -চাচি যখন শোনে যে, জারিফ তাসফিয়া কে পছন্দ করে , ওকে বিয়ে করতে চায় তখন খুব খুশি হয়।কারন এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তারা জারিফের মায়ের ব্যাপারেও ভালোভাবেই অবগত ।তাই একটু চিন্তায় পড়ে যায়।আর এজন্য চাচা জারিফ কে বলে,’আমাদের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই। তবে আগে ভাবিকে সব জানাও। উনি আর ভাই রাজি থাকলে তারপরেই নাহয় বিষয়টি তাসফিয়া কে জানাবো। ভাই রাজি হবার আগে আমি তাসফিয়া কে এসব ব্যাপারে কিছু জানাতে চাইনা।’
আশরাফ সাহেবের কথায় ওনার মা ও সম্মতি জানায়।তিনিও বলেন,’ঠিক বলেছিস আশরাফ সব ঠিকঠাক হবার আগে তাসফিয়াকে কিছু না জানালেই ভালো।ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এতেই ব্যস্ত থাকুক।এসব শুনলে শুধু শুধু পড়ালেখায় ডিস্টার্ব হবে।কি দরকার ঝামেলার।’
এরপর জারিফের দিকে তাকিয়েও একই কথা বলে।আর এখন এসব ব্যাপারে তাসফিয়া কে কিছু জানাতে নিষেধ করে।
জারিফ চাচার কথা শুনে বেশ খুশি হয়।আর ঠিক করে যে ওর মাকে রাজি করিয়ে তারপরেই নাহয় তাসফিয়া কে ভালোবাসার কথাটা জানাবে। পরদিন কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে সবার সাথে গল্প করে বেশ ভালো সময় কাটায় জারিফ। তবে রাতে চলে যাবে তাই মনটা ভীষন খারাপ থাকে। বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে। জীবনে প্রথম কাউকে ভালোবেসেছে জারিফ। তাই কোনভাবেই সেই ভালোবাসা হারাতে চাচ্ছেনা। মনে মনে ঠিক করে,যেকোন মুল্যে বাবা-মাকে রাজি করাবে।
সারাটা দিন বেশ ভালো কাটলেও অবশেষে বিদায় নেবার সময় চলে আসে।তাসফিয়ার মনটাও ভীষন খারাপ হয়।গতো কদিনে জারিফের সম্পর্কে ওর আগের সব ধারনা ভুল প্রমানিত হয়। গল্প, দুষ্টামি সব মিলিয়ে বেশ ভালো সময় কাটে। চলে গেলে আবার কবে দেখা হবে তার ঠিক নেই এসব ভেবেই তাসফিয়ার মনটা বারবার খারাপ হচ্ছে। জারিফ এর অনুরোধে বাবার সাথে তাসফিয়া ও এয়ারপোর্টে যায় ওকে বিদায় জানাতে।যাওয়ার সময় বারবার জারিফ তাসফিয়ার দিকে তাকাতে থাকে। তাসফিয়া কে মনে জমানো ভালোবাসার কথাটা বলে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু চাচা আর দাদির নিষেধাজ্ঞা কীভাবে অমান্য করে তাই আর কিছু বলেনা।
এদিকে জারিফের কিছু এলোমেলো আচরনে তাসফিয়া বেশ অবাক হয়। তাসফিয়ার মনে হতে থাকে যে ,জারিফ হয়তো ওকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বলছেনা। তবে জারিফ যে ওকে ভালোবাসতে পারে বা ওকে নিয়ে এমনটা ভাবতে পারে সেটা তাসফিয়ার ধারনার বাইরে রয়ে যায়। জারিফ চলে যাওয়ার পর আশরাফ সাহেব আর তাসফিয়া বাসায় চলে আসে। ভাইয়ের ছেলে চলে যাওয়ায় আশরাফ সাহেব ও মন খারাপ করে।
চলবে……