#ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি (পর্ব -৩)
#মৌমিতা হোসেন
বাসায় ফিরে বেশ খারাপ লাগতে থাকে তাসফিয়ার।গতো দুই সপ্তাহ জারিফ ভাইয়ের সাথে বেশ ভালো সময় কাটে ।গল্প, একসাথে খাওয়া দাওয়া,বেড়ানো সব কিছু খুব মনে পড়তে থাকে। জারিফের জন্য দাদিসহ অন্যদেরও খারাপ লাগে।রাতে খেতে বসে তাসফিয়ার মা বলে,’এই অল্প কিছু দিনে ছেলেটা মায়ায় ফেলে আবারো চলে গেলো অনির্দিষ্টকালের জন্য।বিদেশে বড় হয়েও ছেলেটা এদেশের নিয়ম কানুন সব মেনে চলে। বড়দের সম্মান দিয়ে চলে।সত্যি এমন সভ্য ,ভদ্র ছেলে এ যুগে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল।’
আশরাফ সাহেবও স্ত্রীর কথায় সায় দেয়।আর দাদি মন খারাপের মাঝেই মজা করে বলে যে,’দেখতে হবে না কার নাতি?আর অনির্দিষ্টকালের জন্য বলছো কেনো বৌ মা? আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে জারিফের সাথে।’কথাটা শুনতেই সবাই হেসে দেয়।
তাসফিয়া এবার একটু রাগ নিয়ে বলে,’বাহ! জারিফ ভাই এই কদিনেই তোমাদের সবার এতো আপন হয়ে গেলো?আর আমাকে পর করে দিলে?আমি এখন আর ভালো নেই তাইনা?ভাইয়া এসে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসিয়ে গেলো।’
তাসফিয়ার কথা শুনে দাদি বলে,’দাদুভাই তুই দেখি অনেক হিংসুটে হয়ে গিয়েছিস।আগে তো এমন ছিলিনা।’সবাই এই কথা শুনে আবারো হাসতে থাকে।আর তাসফিয়া রেগে নিজের রুমে চলে যায়।
পরদিন জার্মান পৌঁছানোর পর জারিফ চাচাকে ফোন করে ঠিকমতো যে পৌঁছিয়েছে সেই খবর জানিয়ে দেয়।আর তাসফিয়ার খবরটাও নেয়। এদিকে জারিফ আর তাসফিয়ার ব্যাপারে ভাই ভাবী কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা শোনার অপেক্ষায় থাকে আশরাফ সাহেব।
জার্মান যাওয়ার পর প্রতি মুহূর্তই জারিফ তাসফিয়া কে খুব মিস করতে থাকে।সময় পেলেই ফোন করে তাসফিয়ার খবর নিতে ভোলে না। তবে বেশি ফোন করলে কে কি ভাবে তাই হিসেব করেই ফোন দেয়। জারিফের আচরনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে যেটা ওর মা-বাবার চোখেও এড়ায়না। তবে এর পেছনে কি কারণ সেটা তারা ঠিক বুঝতে পারেনা। কিছু দিন যাওয়ার পর জারিফ ঠিক করে দ্রুতই মা-বাবাকে তাসফিয়ার কথা বলবে। কারন যতো তাড়াতাড়ি বলবে ততোই তাড়াতাড়ি তাসফিয়া কে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারবে ।এসব ভেবে আর দেরি না করে ওর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে তাসফিয়ার ব্যাপারে কথা বলে। তাসফিয়া কে জারিফ পছন্দ করে এটা শুনে ওর বাবা খুব খুশি হলেও মা নিগার সুলতান রেগে যায়। তিনি রাজি হয়না।তিনি বলেন,’এতো সাধারন একটা মেয়ে কখনোই আমার বংশের বৌ হতে পারবে না।এই যোগ্যতাই ওর নেই। আমাদের সাথে ওর যায়না।তাই এ প্রসঙ্গে আর কখনো কোন কথা বলো না জারিফ।’
মায়ের কথা শুনে প্রথমে জারিফ রেগে গেলেও পরে বাবার ইশারায় ঠান্ডা হয়। ঠান্ডা মাথায় মাকে রাজি করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু কোন কাজ হয়না।আর জারিফও আশা ছাড়েনা। পরবর্তী কয়েকদিন নানাভাবে জারিফ ওর মা’কে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। কোনভাবেই যখন মা নিগার সুলতান তাসফিয়ার ব্যাপারে রাজি হচ্ছিলো না ।তখন একদিন জারিফ রেগে বলে যে,’বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে তাসফিয়াকেই করবে। নতুবা কখনো বিয়েই করবে না।’
ছেলের মুখে এই কথা শুনে মা নিগার সুলতান খুব রেগে যায়।তবে তিক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ায় জারিফের বিপরীতে কথা না বলে চুপ থাকে।আর বলে যে,এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জারিফ ভাবে, হয়তো এক সময় মা রাজি হয়ে যাবে তাই অপেক্ষা করতে থাকে।আর এসব বিষয় ফোনে দাদি এবং চাচাকে জানিয়ে রাখে। দাদি অবশ্য আগে থেকেই জানতেন যে ,তার এই ছেলের বৌ তাসফিয়ার ব্যাপারে রাজি হতে চাইবে না।জারিফ দাদির কাছে তাসফিয়াকে মনের কথাটা জানিয়ে রাখার অনুমতি চায়। কিন্তু যেহেতু জারিফের মা রাজি না সেহেতু তাসফিয়া কে এসব ব্যাপারে কিছু বলতে নিষেধ করে। এমনকি এখন থেকে তাসফিয়ার সাথে ফোনেও কম কথা বলতে বলে।এতে জারিফ খুব মন খারাপ করে।কি করবে, কীভাবে সবাইকে রাজি করাবে এসব নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে যায়।
এদিকে এসব বিষয়ের কিছুই তাসফিয়া জানতে পারেনা। কারন দাদির নিষেধ থাকায় জারিফ কখনো এমন কোন ইঙ্গিত তাসফিয়া কে দেয়নি। তাসফিয়াও তাই কাজিন ভেবেই জারিফের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে যায়।এর মাঝে অবশ্য হঠাৎ করে জারিফের ফোন কম এলে তাসফিয়া ভাবে হয়তো জারিফ ভাই ব্যস্ত সব কিছু নিয়ে তাই ফোন কম দিচ্ছে। দাদিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে দাদিও জারিফের ব্যস্ততার কথা বলে কাটিয়ে দেয়।
সময় থেমে থাকে না । তাসফিয়া মন দিয়ে পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কেটে যায় কয়েক মাস। তাসফিয়া পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এর মাঝে অবশ্য প্রতি সপ্তাহে যখনি দাদির সাথে জারিফ কথা বলতো তখনি তাসফিয়ার সাথেও টুকটাক কথা বলতো। তবে জারিফের মা রাজি না হওয়ায় দাদি খুব বেশি কথা বলতে দিতেন না।
একদিকে মাকে রাজি করাতে না পারা,দাদির অভিমান, অন্যদিকে তাসফিয়ার সাথে ঠিকমতো কথা বলতে না পারা সব মিলিয়ে জারিফ খুব হতাশায় ভুগতে থাকে ।এক দিন সিদ্ধান্ত নেয় যে ,মায়ের অমতেই দেশে এসে তাসফিয়া কে বিয়ে করবে। দাদিকে ফোন করে বিষয়টা জানাতেই তিনি না করে দেন। আশরাফ সাহেবও না করেন।তিনি জারিফ কে পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে,ভাই ভাবি রাজি না থাকলে এই সম্পর্ক কোন ভাবেই আগাবেনা। তাই কোন উপায় না পেয়ে জারিফ মায়ের রাজি হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।
কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন বড় ভাই আশরাফ সাহেব কে ফোন দিয়ে জানায় যে, নিগার সুলতানা স্ট্রোক করেছেন ।বেশ অসুস্থ।কখন কি হয় ঠিক নেই।তাই তার পছন্দের এক জার্মান মেয়ের সাথে জারিফ এর বিয়ে ঠিক করেছেন।পরের সপ্তাহে বিয়ে।এসব শুনে আশরাফ সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না যে আসল ঘটনা কি।তাই কিছু না বলে ফোন রেখে দেয়। বাসায় সবাই কে জানায় যে পরের সপ্তাহে জারিফের বিয়ে। এটা শুনে তাসফিয়াও বেশ খুশি হয়। পরিবারের বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। তবে বিয়েতে যেতে পারবে না তাই বেশ মন খারাপ করে।
দাদি খবরটা শুনে খুব মন খারাপ করেন।এসব যে বড় বউয়ের চালাকি সেটা তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন।বড় বউয়ের ওপরে তিনি প্রচন্ড রাগ করে। মা হয়ে কীভাবে ছেলের পছন্দকে অবমুল্যায়ন করে সেটা তিনি ভেবে পায়না।কোন মা যে নিজ ছেলের সাথে এভাবে ছলচাতুরি করতে পারে সেটা ভেবেই তিনি খুব বিরক্ত হন।নাতির মনের অবস্থা চিন্তা করেই তার বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা অনুভব করতে লাগলেন।এমন অবস্থায় কোনভাবেই দাদি জারিফকে দেখতে পারবেন না ।তাই ঠিক করেন বড় ছেলের সাথে এ ব্যাপারে একবার কথা বলে দেখবেন। হয়তো কোন কাজ হবেনা। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি?
ঐ রাতেই জারিফ দাদির কাছে ফোন করে মায়ের অসুস্থতাসহ সবকিছু খুলে বলে।দাদি বড় বউয়ের চালাকি বুঝলেও জারিফকে কিছু জানায় না। বরং নাতিকে শান্ত হতে বলে শেষবারের মতো ছেলের বৌ এর সাথে তাসফিয়ার ব্যাপারে কথা বলবে বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু না; কোনভাবেই জারিফের মা রাজি হয়না। উল্টো বেশি জোর করলে নিজের ক্ষতি করবে জানিয়ে দাদিকে হুমকি দেয়।এই সব বিষয় এই বৃদ্ধ বয়সে মেনে নিতে না পেরে দাদি অসুস্থ হয়ে যায়।স্ট্রোক করে। অসুস্থতার কারনে তিনি নিগার সুলতান এর এসব চালাকি জারিফ বা ছেলেদের কাউকেই জানাতে পারেনা।স্ট্রোক এর কারনে দাদির এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে যায়। আশরাফ সাহেব, তাসফিয়া সবাই এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আশরাফ সাহেব অভিমান করে মায়ের অসুস্থতার খবর ভাই বা জারিফ কাউকেই জানায় না ।
এদিকে জারিফ দাদির ফোনের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু দাদির কোন ফোন না আসায় ভাবে যে তিনি হয়তো রেগে আছেন।দাদির রাগ দেখে এবার জারিফেরও অভিমান হয়। বাবা-মাকে রাজি করাতে না পারার লজ্জায় চাচার সাথে আর কথা বলেনা। অভিমান করে দাদিকেও জারিফ আর ফোন দেয়না। কথা দিয়ে এসেও কথা রাখতে না পারার কষ্ট, তাসফিয়া কে না পাওয়ার কষ্ট সব মিলিয়ে একদম চুপ হয়ে যায়।জারিফ মায়ের চালাকির বিন্দুমাত্র ধরতে পারেনা। চুপচাপ মায়ের কথামতো বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।আর পরের সপ্তাহে মায়ের পছন্দ করা সেই মেয়ের সাথে জারিফ এর বিয়ে হয়ে যায়। জারিফের মা কোনভাবেই তাসফিয়ার সাথে জারিফের বিয়েতে রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু যখন দেখে জারিফ খুব জেদ করছে তখন অসুস্থতার ভান করে জারিফ কে তার নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য করে।
মায়ের কথায় জারিফ বিয়ে করলেও সংসার জীবনে কখনোই সুখি হতে পারেনা।ওর মনে সব সময় তাসফিয়াই ঘুরপাক খায়। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরে দাদির কাছে ফোন দিলে মায়ের চালাকি করে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা জানতে পারে জারিফ।সত্যিটা জেনে জারিফ খুব কষ্ট পায়।কোন মা শুধু মাত্র নিজের অহমিকা,জেদ পুরনের জন্য যে সন্তানের সুখকে এভাবে বিসর্জন দিতে পারে সেটা জারিফের জানা ছিলোনা।মায়ের সাথে সাথে বাবার প্রতিও অনেক ক্ষোভ জন্মায় জারিফের মনে।ও বাবা- মায়ের সাথে কথা বন্ধ করে দেয়।কিছু দিন বেশ এলোমেলো জীবন যাপন করে।আর জারিফের স্ত্রি কেট ও বেশ উছৃঙ্খল হওয়ায় ওদের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়না।এক বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায়।
তাসফিয়া কে হারানোর কষ্ট, মায়ের মিথ্যা নাটক সব মিলিয়ে জারিফ হতাশায় ভুগতে থাকে।বেশ কিছু সময় পর সব সামলে জারিফ ঠিক করে চাচার কাছে আবার তাসফিয়া কে চাইবে। অনেক সাহস করে ফোন দেয় চাচাকে।কিন্তু এবার জারিফের জানাতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারন এতোদিনে তাসফিয়ারও বিয়ে হয়ে গেছে। জারিফের বিয়ের পর আশরাফ সাহেব মায়ের অনুমতি নিয়ে দ্রুত তাসফিয়াকে বিয়ে দেয়।
এলাকায় এক সিনিয়র ভাই রাজন তাসফিয়াকে খুব পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।রাজন এমবিএ করে একটা ব্যাংকে চাকরি করছে।বাসা থেকে ওর জন্য মেয়ে খুঁজছিলো এমন সময় তাসফিয়া কে দেখে পছন্দ হলে খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তাসফিয়া এতো তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি না থাকলেও বাবার জোড়াজুড়িতে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। তাছাড়া কথা বলে দেখে রাজন বেশ ভালো আর ভদ্র ছেলে।তাই আর অমত করেনা।
জারিফের ডিভোর্স এর পর সব মিলিয়ে হতাশায় সবার সাথে কিছু দিন যোগাযোগ বন্ধ রাখে।আর তাই তাসফিয়ার বিয়ের ব্যাপারটা ও জানতে পারেনি। এতো দিন পর যখন আবার তাসফিয়া কে নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয় তখন ওর বিয়ের খবর শুনে জারিফ আবারো শকড হয়।ডিপ্রেশনে চলে যায়।তাই রাগে, কষ্টে আবার দেশে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। সারাক্ষন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে সারাদিনে অফিস এর কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাত হলেই একাকিত্ব ঘিরে ধরে জারিফ কে।ভাবে জীবনে এমন একজন কে কেনো ভালোবাসলো যাকে কোনদিন পাওয়া হবে না। ভালোবাসা এতো কষ্ট দেয় আগে জানলে কখনো কাউকে এতো ভালোবাসাতো না।
এদিকে বিয়ের পরে তাসফিয়া ওর পড়াশোনা শেষ করে।আর এই পুরো সময়টা রাজন তাসফিয়া কে অনেক সাপোর্ট করে। পড়াশোনা শেষ করে তাসফিয়া একটা স্কুলে চাকরি নেয়। এতো সবের মাঝে, এতো এতো ব্যস্ততায় তাসফিয়া ও জারিফের সাথে আর যোগাযোগ করেনা।সময়ও হয়না। তাছাড়া জারিফ এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় মনে বেশ অভিমান জন্মে ।বিয়ের পাঁচ বছর পরে তাসফিয়া এক কন্যা সন্তানের মা হয়।রাজন এর সাথে বেশ সুখেই দিন কাটতে থাকে তাসফিয়ার।
চলবে…….