#ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি (পর্ব -৪ এবং শেষ )
#মৌমিতা হোসেন
তাসফিয়ার বাচ্চা হবার আগে দাদি মারা যান। মৃত্যুর আগে দাদি তাসফিয়া কে জারিফের ব্যাপারে সব জানিয়ে যায়। তাসফিয়া খুব অবাক হয় কারন ও কল্পনাও করতে পারেনি যে জারিফ ওকে এমন দৃষ্টিতে দেখতে পারে বা পছন্দ করতে পারে।কারন তাসফিয়া এমন কোন আচরন কখনোই করেনি যাতে করে জারিফের মনে এমন অনুভূতি আসতে পারে।আর এই কয়দিনের দেখায় যে কেউ কাউকে এতোটা পছন্দ করতে পারে সেটা ওর কল্পনার বাইরে ছিলো।এসব জানার পর অনেকটা ইচ্ছা করেও তাসফিয়া আর জারিফের সাথে যোগাযোগ করেনা।কারন সংসার জীবনে তাসফিয়া বেশ সুখী।তাই নতুন করে কোন ঝামেলা ও চাচ্ছিলো না। তাছাড়া এক্ষেত্রে আশরাফ সাহেবেরও নিষেধ ছিলো।
হঠাৎ একদিন জারিফ তাসফিয়া কে ফোন করে। এতো বছর পর জারিফ ভাইয়ের ফোন পেয়ে তাসফিয়া বেশ অবাক হয়।আসলে ফেসবুকে তাসফিয়ার পরিবারের হাস্যোজ্জল ছবি দেখে জারিফের খুব ইচ্ছে করে কথা বলতে তাই ফোনটা করেছিলো জারিফ।ফোন রিসিভ করতেই জারিফ কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো তাসফিয়া? অনেক বছর তোমার সাথে কথা হয়না।’
তাসফিয়া বলে,’ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?’
তাসফিয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়েই জারিফ বলে,’তোমার কি কখনো আমার কথা মনে পড়েনি?’
‘হ্যা পড়েছে জারিফ ভাইয়া।তবে খুব কম। আপনি যেমন ব্যস্ত ছিলেন আমিও তেমনি ব্যস্ত ছিলাম।তাই….’
তাসফিয়া কে আর কথা বলতে না দিয়ে জারিফ বলে,’তোমার মনে আছে তাসফিয়া আমরা দুজন ঐ বার অনেক অনেক গল্প করেছিলাম? একসাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম?আচ্ছা, আমি যে তোমাকে একটা মগ কিনে দিয়েছিলাম ওটাতে কি তুমি এখনো পানি খাও?আ…আমার দেয়া পুতুল দুটো আছে তো তোমার কাছে? আর আমি আসার পর তোমার মন খারাপ হয়নি?বলো তাসফিয়া বলো?’
এতো আবেগ দিয়ে এতো প্রশ্ন শুনে তাসফিয়ার ভেতরটা কেমন যেনো করে ওঠে।ওর মনে হলো জারিফ ভাই ঠিক নেই।আর এর কারন হয়তো ও নিজেই।খারাপ লাগলেও জারিফ ভাইকে প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা তাই একটু কঠিন হয়ে তাসফিয়া উত্তর দেয়,’হুম ভাইয়া তখন তো আমরা কতো গল্পই করেছিলাম। এতো বছর আগের কথা কি এখনো মনে আছে?আর মগতো কবেই নষ্ট হয়ে গেছে ফেলেও দিয়েছি।’
মন খারাপ হলেও জারিফ বলে,’মগটা ফেলে দিয়েছো?সত্যি তোমার কিছু মনে নেই?আচ্ছা ,পুতুল গুলো কি করেছো তাসফিয়া? ওগুলো তো তোমার পছন্দের ছিলো। ওগুলো আছে তো?’
তাসফিয়া বলে,’ওগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে আমি নিজেও জানিনা ভাইয়া।আর এতো বছর পর ওগুলোর কথা কেনো জানতে চাইছেন? কতো ব্যস্ত আমি আমরা সংসার নিয়ে। এসবের মাঝে এতো পুরোনো পুতুল কোথায় ফেলেছি সত্যি মনে নেই ভাইয়া।’
কথাগুলো শুনে জারিফের খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর কেমন যেনো অসহ্য যন্ত্রনা হতে থাকে। প্রচন্ড মন খারাপ করে বলে,’ শেষ আরেকটা প্রশ্ন করি?’
‘হুম করুন ভাইয়া।’
‘ তোমার মনে কি সত্যি কখনো আমার জন্য অন্য কোন অনুভূতি আসেনি তাসফিয়া? মানে আমি তোমাকে যেভাবে পছন্দ করি তেমন পছন্দ কখনোই কি তুমি আমায় করোনি?’
তাসফিয়া এমন প্রশ্ন শুনে খানিক বিব্রতবোধ করে। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,’কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছিনা জারিফ ভাই। আপনি আমার কাজিন।বড় চাচাতো ভাই।ব্যস এতোটুকুই। আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি আমি। ভালো মানুষ আপনি।এর বেশি আর কি জানতে চাচ্ছেন? সত্যি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
জারিফ নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হাসে।যাকে ভালোবেসে ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে তার মনে ওর জন্য কোন অনুভূতিই নেই? খুব কষ্টে নিজেকে সামলে একবার ভিডিওতে ছোট বাবুকে দেখতে চায়। তাসফিয়া বেশি কিছু না ভেবে বাবুকে দেখায়।
ছোট্ট বাবুকে দেখে মুখে হাসি এনে জারিফ বলে,’সুখে থেকো তাসফিয়া। অনেক ভালো থেকো। তোমার জন্য সব সময় অনেক অনেক দোয়া রইলো।আর জীবনের যেকোন সময় যেকোন প্রয়োজনে যদি কখনো আমাকে প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই আমাকে জানিও। মনে কখনো কোন সংকোচ এনোনা যেনো।জারিফ সব সময় তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকবে কথাটা মাথায় রেখো।’কথাগুলো বলেই তাসফিয়া কে এক পলক দেখে জারিফ ফোন কেটে দেয়।
এরপর কেটে গেছে দশটি বছর।এতো বছরে আর কোনদিন তাসফিয়ার সাথে জারিফ কথা বলেনি। তবে পেছনে থেকে সব সময় যেকোন বিপদে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। সেই সাহায্য কখনো ছিলো আর্থিক আবার কখনো মানসিক ।কখনো সাহায্য করেছে অন্য কাজিনদের মাধ্যমে, আবার কখনো চাচার সাথে যোগাযোগ করে।এসব দেখে চাচা আশরাফ সাহেবের ও এখন আর জারিফের ওপর কোন রাগ নেই।এক সময় তাসফিয়াকেও এসবের সবটাই জানায় ওর বাবা। তাসফিয়ার আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি।তাই অনেক সময় তাসফিয়া জারিফ ভাইয়ের আগ বাড়িয়ে সবার অগোচরে থেকে দায়িত্ব পালন এড়িয়ে চলতে চাইতো। এতে জারিফ বেশ রাগ হয় আর একদিন ফোন করে জানায় যে, ‘আমি যা করছি সেসব চাচার প্রতি আমার দায়িত্ব থেকে করছি।আর তাই এই বিষয়ে আমি তোমার কোন কথা শুনবো না তাসফিয়া।’
জারিফের রাগান্বিত কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে তাসফিয়া বুঝতে পারে যে জারিফ এ বিষয়ে কারো কথা শুনবে না।তাই তাসফিয়া আর কখনো এসব বিষয়ে কিছু বলেনা।
তাসফিয়ার সংসারে এর মাঝে অনেক ঝামেলা,বিপদ আসলেও সব কাটিয়ে এখন ও বেশ ভালো আছে।সব ঝামেলায় জারিফ আড়ালে থেকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাই ওর প্রতি তাসফিয়ার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে তাসফিয়া ভাবতো ,জারিফ এর ব্যাপারটা যদি আগে জানতো আর ওর মনেও যদি জারিফের জন্য কোন অনুভূতি থাকতো তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। পরমুহূর্তেই আবার ভাবে যে,তাহলেতো ও রাজনের মতো একজন জীবনসঙ্গী পেতো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। খুব করে দোয়া করে যে,’জারিফ যেনো খুব ভালো একজন জীবনসঙ্গী পায়।জীবনটা যেনো নতুন করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে নেয়।’
জীবন কারো জন্য আসলে থেমে থাকে না। জারিফের জীবনেও আসে অন্য এক নারী।কাজের সুবাদেই বছর দুয়েক আগে পরিচয় হয় এক ভারতীয় নারী সামান্তার সাথে।ডিভোর্সি সামান্তা এক সন্তানের মা।জীবনে চলার জন্য একজন সঙ্গি খুব প্রয়োজন।আর সেই প্রয়োজন থেকেই বাঁচার তাগিদে দুজন বন্ধু হিসেবেই প্রথমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।দুজনের পক্ষেই প্রথম ভালোবাসা ভোলা খুব কঠিন ।তবে দু’জনই নতুন করে আবার ভালোবাসা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলো।আর এখন অনেকটাই সফল হয়েছে।
জারিফের বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকে তাসফিয়ার মনে হতে থাকে যে ,ও এখন অনেকটা ভারমুক্ত হয়েছে।তাই ও ওর মতো সুখে সংসার করে যাচ্ছে।
অপরদিকে ,জারিফ সংসার জীবনে সুখী হলেও মাঝে মাঝে এখনো তাসফিয়ার ছবি দেখলে বুকের বাঁ পাশে কেমন যেনো করে ওঠে ।চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়।সব আছে ওর ।শুধু সবচেয়ে মুল্যবান ওর জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে হারিয়েছে।তাই রাতের তাঁরা ভরা আকাশ দেখতে দেখতে জারিফ ভাবে প্রথম ভালোবাসায় একটা মিষ্টি অনুভূতি থাকে, থাকে স্নিগ্ধতা, কোমলতা। থাকে এক অন্য রকম আবেশ, ভালোলাগা।এমন অনুভূতি জীবনে আর কখনো আসেনি ওর মনে। ভালোবাসা টা একতরফা বলেই হয়তো ও তাসফিয়া কে ভুলে গিয়ে সুখি হবার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে।পুরোপুরি ভুলতে না পারলেও অনেকটাই সফল হয়েছে। তবে যখনি ব্যস্ততা কমে আসে তখনই তাসফিয়ার সাথে কাটানো ঐ অল্প কয়েকটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু সামান্তার ভালোবাসায় আবার সব ভুলে যায়।জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মে।
প্রথম ভালোবাসাটা পুরোপুরি ভুলতে না পারলেও নতুন করে আবার যে কাউকে ভালোবাসা যায় সেটা জারিফ বুঝতে পেরেছে। এভাবেই এক সময় সামান্তার ভালোবাসায় তাসফিয়ার প্রতি ওর ভালোবাসা টা চাপা পরে যায়। তাসফিয়া কে ভুলতে না পারলেও ভালোবাসার জায়গা পুরোটা দখল করে নেয় সামান্তা।
সমাপ্ত।