ভালোবাসার প্রান্ত,১২,১৩

0
1506

ভালোবাসার প্রান্ত,১২,১৩
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-১২)

আমাদের দিনগুলো আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল সেই আগের মত।
সকালে সে অফিসে বের হবার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি তার ঘড়ি ওয়ালেট কলম সব এগিয়ে দিয়ে তার শার্টের বোতাম লাগাতে গিয়ে হাসলাম। কেন হাসলাম তা আমি নিজেও জানি না। কারণ খুঁজে না পেয়ে আরও হাসি পেলো। দিন দিন আমি বোধহয় পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার হাসি দেখে সে থমকে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম তীর বিঁধেছে ডাকাতের বুকে। মনে মনে খুব খুশি হলাম। আমার ইচ্ছে করে হাসি দিয়ে তাকে আটকে রাখতে। কীসের এত অফিস টফিস হুম? লেখাপড়া আর চাকরি বাকরি মানুষের জীবনটাই নষ্ট করে দিলো। জীবনের কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত মানুষ নষ্ট করে অফিসের চেয়ারে বসে আর স্কুল কলেজের বেঞ্চে বসে। আমার তেমন ক্ষমতা থাকলে স্কুল কলেজ অফিস আদালত নিষিদ্ধ করে দিতাম। আমার বরটা তাহলে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকতো। কতই না ভালো হতো! কোন হতচ্ছাড়া যে এই লেখাপড়া আবিষ্কার করেছে, তাকে সামনে পেলে মরিচ থেরাপি দিতাম আর বলতাম, কিরাম লাগে রে হতভাগা? কোটি কোটি মানুষের জীবন তুই নষ্ট করেছিস। এখন দেখ মরিচ থেরাপির স্বাদ কেমন!
আমি সীমান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে অতল গভীরে ডুবে গেলাম।
সে বলল-
__তোমার হাসি দেখে সেই প্রথম দিনের মতোই ফিদা হয়ে যাই আমি, কী করি বলো তো সোনাবউ?

আমি ডোন্ট কেয়ার মুখ করে বললাম-
__আরো ফিদা হয়ে যাও। কে বারণ করেছে?

সে দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বলল-
__সব ষড়যন্ত্র, আমি সব বুঝি। গুন্ডী একটা!

কিছুই জানি না এমন ভান করে বললাম-
__কী ষড়যন্ত্র করলাম?

__এই যে আমি অফিস যাবার আগে তুমি এখন কেন এত হাসছো সেটা কী আমি বুঝতে পারছি না ভেবেছো?

আমি নির্দোষ মুখভঙ্গি করে বললাম-
__কেন হাসছি?

__আমাকে ঘায়েল করে আটকে দেবার জন্য।

__কে বলেছে? মোটেও না।

__আমি বলছি। মোটেও হ্যাঁ।

আমি মুখ ভেংচি কেটে বললাম-
__বয়েই গেছে আমার তোমাকে আটকাতে। আমার কত কাজ আছে জানো? এখনি আমার কিচেনে যেতে হবে।

__জানি তো কত কী কাজ আছে মহারাণীর।

__কী কী জানো?

__আমি ওটিতে ঢুকার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পর তুমি মেসেজ করতে শুরু করবে। আর কী কী মেসেজ করবে সেটাও জানি।

আমি লাজুক চোখে তাকিয়ে বললাম-
__কী কী মেসেজ করবো?

__লিখবে- “আমার এটার পিপাসা পেয়েছে, ওটার পিপাসা পেয়েছে।”
লিখবে- “তোমার পেছনে দাড়িয়ে আছি একটু পেছন ফিরে তাকাও সুয়ামী।”
লিখবে- “বাড়ি ফিরবে কখন?”
লিখবে- “বউকে ভুলে গেলে চলবে?”
লিখবে- “তোমায় মিস করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছি ডাকুরাজ।”

এই ডাকাত তো দেখছি সব ফাঁস করে দিচ্ছে। কী লজ্জার কথা! মেসেজ করি ঠিক আছে, তাই বলে এমন করে বলতে হবে?
আমি মুখ ভেংচি কেটে বললাম-
__একদিন লিখেছি বলে রোজ এসব লিখবো নাকি হুহ?

__তুমি তো এসব বছরের পর বছর ধরে লিখে আসছো। আরও কত কিছু লেখো। দাঁড়াও মনে করে বলছি।

আমি হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে বললাম-
__এই চুপ, আর বলতে হবে না।

সে আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল-
__কেন? আর গুলোও বলি? সারাদিনে আমার বউ কী কী কাজ করে সেগুলো বলতে দাও সোনা!

আমি লজ্জা লুকিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বললাম-
__আমার বরকে আমি মেসেজ করি তাতে পড়শীদের কী আর তোমারই বা কী? তুমি নিজের কাজ করো।

__কিছু না তো, আমার কী হবে? এই আমার লেট হয়ে গেল। ঘরে বখাটে বউ থাকলে অফিসে লেট হবেই। এই যে এখনও আমাকে আটকে রেখেছো। ছাড়ো বলছি ছাড়ো!

আমি তার কথা শুনে টাস্কিত হলাম। সে এমন ভাবে ছাড়ো ছাড়ো বলছে যেন আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আছি। আমি হতবাক চোখে তাকিয়ে বললাম-
__ও মোর খোদা! তোমায় আমি বেঁধে রেখেছি নাকি? হ্যালো সাহেব আপনার আর আমার সামনে এক হাত দূরত্ব, সো ছাড়তে বলার কোনো মানেই নেই।

সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল-
__ওহ তাই তো! আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ধরে রেখেছো।

আমি মুখ ভেংচিয়ে বললাম-
__বয়েই গেছে আমার তোমার মতো ডাকুরাজকে ধরে রাখতে হুহ।

__কার সাথে কথা বলছো তুমি সোনাবউ? আমি কখন তোমায় ধরে রাখতে বললাম?

আমি চমকে উঠে সরে দাঁড়ালাম। তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে হতবিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই রে এতক্ষণ ধরে আমি কল্পনায় ওর সাথে কথা বলছিলাম? আমি কী সত্যিই পাগল হতে চলেছি? বেবি কন্সিভ হলে কী মেয়েরা এমন আধ পাগলি হয়ে কল্পনায় কথা বলে? আমি আহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম-
__কী বলেছি? কী কী শুনেছো?

__বললে, “বয়েই গেছে আমার তোমার মতো ডাকুরাজকে ধরে রাখতে।” তারপর মুখ ভেংচি কাটলে।

যাক বাবাহ, তাহলে সব সে শোনেনি। থ্যাংকস গড! সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতে টাই ধরিয়ে দিয়ে বলল-
__তোমার কী দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? একাই কথা বলে চলেছো। কী হয়েছে?

আমি হুট করেই চুপসে গেলাম। কেন জানি আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। আমি টাই বেঁধে দিতে দিতে বললাম-
__কিছু না।

সে দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বলল-
__আমার বউ বোধহয় চাইছে আমি আজ অফিসে না যাই।

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম-
__জানি না।

__না জানলে হবে কী করে?

__তাও জানি না।

__তাহলে আমাকে আটকে রাখার কথা একা একা কেন বলছিলে?

হঠাৎ আমার খুব অভিমান হলো। অভিমানে চোখে জল চলে এলো। সে আর আমার হাসিতে ঘায়েল হয় না। আগের মতো আমাকে ভালোও বাসে না। আমি বোধহয় সত্যিই পুরোনো হয়ে গেছি। আমার হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
আমার চোখে জল দেখে সে আরও অবাক হয়ে বলল-
__কী হয়েছে তোমার সোনাবউ? একটু আগেই তো সুন্দর করে হাসছিলে। হঠাৎ কী এমন হলো যে, হাসি কাঁন্নায় রূপান্তরিত হলো?

আমি কাঁন্না জড়ানো কন্ঠে বললাম-
__তুমি একটা নিষ্ঠুর পাষাণ হৃদয়হীন। আমি পুরোনো হয়ে গেছি তাই তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না।

কথাগুলো শুনে সে হাবার মতো হা করে তাকিয়ে রইল। আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।


নাস্তা রেডি করছি সে নাস্তা করেই বের হবে। দশ মিনিট পরে সে ডায়নিং এ এলো। তাকে দেখে আমার চোখ কপালে উঠলো। সে ড্রেস চেঞ্জ করে এসেছে। মানে সে অফিসে যাবে না। হঠাৎ তার আবার কী হলো? সে চেয়ার টেনে বসতেই নানান এসে বসলেন। তার দিকে তাকিয়ে নানান বললেন-
__আজ তোমার অফিস নেই?

সে নাস্তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল-
__না

__ছুটি নিয়েছো?

সে মুখ না তুলেই বলল-
__হ্যাঁ।

নানান অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন-
__হঠাৎ এই আকস্মিক ছুটির কারণ?

সীমান্ত আমার দিকে তাকিয়ে নানানকে বলল-
__এক পাগলি নাকি ঘুরতে যাবে।

মনে মনে বললাম, এমা কী ডাহা মিথ্যা বলছে ডাকাতটা! আমি কখন ঘুরতে যেতে চাইলাম? কিন্তু সে কী সত্যিই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে?
নানান দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বললেন-
__শুধু শুধু অফিস কামাই করে সরকারকে ফাঁকি দেয়ার দরকার নেই। কত রোগী তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। তুমি হসপিটালে যাও আমি পাগলিকে ঘুরিয়ে আনবো। জাস্ট আমি রঙিন একটা পাঞ্জাবি পরবো শুধু।

সীমান্ত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল-
__নিজের বউ নাই আপনার?

নানান হতাশ সুরে বললেন-
__আছে তো এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা।

সীমান্ত গম্ভীর স্বরে বলল-
__তাকে নিয়েই ঘুরতে যান। আর অন্যের বউকে নিয়ে ঘুরার স্বপ্ন দেখা ছাড়েন। এসব ভালো কথা নয়।

__সে তো আমার ছোট রাণী। পর কেউ তো নয়। আমারও অধিকার আছে। আচ্ছা আমাদের সাথে তোমাকেও নেবো, তুমি রাগ করো না।

কথাটা বলেই নানান ঠোঁট টিপে হাসলেন। সীমান্ত অবাক হয়ে বলল-
__মানে?

__মানে আমরা তিনজন যাচ্ছি।

সীমান্ত রাগ করে বলল-
__আমি যাব না কোথাও। নাস্তা শেষ করে অফিসে যাব।

নানান মুচকি হেসে বললেন-
__এই হাফ প্যান্ট পরেই যাবে অফিসে?

সীমান্ত নিজের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নিয়ে তারপর অবাক চোখে নানানের দিকে তাকিয়ে বলল-
__এটা কোয়াটার প্যান্ট। আপনি আর আপনার ছোট রাণী এটাকে হাফ প্যান্ট কেন বলেন বুঝি না!

__ঐ একই কথা। হাফ আর কোয়াটারের মধ্যে মাত্র কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান।

__আজব মিল আপনাদের দু’জনার মধ্যে। আমি রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে তারপর অফিসে যাব আপনি চিন্তা করবেন না।

__আচ্ছা যাও। আমি ছোট রাণীকে নিয়ে ঘুরতে যাব।

সীমান্ত আর কোনো জবাব দিলো না। নানুন এসে নানানের কাছে দাঁড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন-
__ওরা একটু নিজেদের মতো করে ঘুরবে। তুমি কেন সবসময় ওদের পিছু নিয়ে থাকো? তোমার লজ্জা করে না?

নানান কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা নির্দোষ মুখভঙ্গিমায় বললেন-
__ লজ্জা করবে কেন? আমি কী তাদের বেডরুমে উকি দিচ্ছি নাকি? আর পিছু নেয়ার এই মজা তুমি বুঝবে না। নাতি আমার ডুবে ডুবে জল খেয়ে বিয়ে করেছে। বলে কী না, এই মেয়ে ছাড়া আমি জীবনে বিয়েই করবো না। আমি তার ডুবে ডুবে জল খাওয়ার সময় একটুও টের পাইনি। এখন আমি ওদের সব জল খাওয়া দেখব। ডিসিশন ফাইনাল।

নানুন রেগে উঠে বললেন-
__তোমার আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমাকে পাগলা গারদে রেখে আসা উচিত।

নানান মুচকি হেসে নানুনের দিকে তাকিয়ে বললেন-
__তোমাকে সাথে নিচ্ছি না বলে জ্বলছো নাকি? পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।

নানুন রাগ করে সরে গেলেন।
নানান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__সবার পোড়া মনে ঘি ঢেলে রেডি হও ছোট রাণী। আমরা আজ ঘুরতে যাব। আর ওদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করবো।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নানান খেয়েই চলেছেন। সীমান্ত খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল। আর আমাকে চোখের ইশারায় রুমে ডেকে গেল। এই অবেলায় রুমে ডাকলো কেন?

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১৩)

রুমে ঢুকে দেখি সে শুয়ে আছে। ঢং করে ঘুরতে নিয়ে যাবার কথা বলে এখন শুয়ে থাকা হচ্ছে! সব ছলনা। সবাই বলে মেয়েরাই নাকি শুধু ছলনা করে। এখন তো দেখছি ছেলেরাও কম যায় না! বরং এরা তো কয়েক ধাপ এগিয়ে। মুখ ভেংচিয়ে বললাম-
__ঘুরতে নিয়ে যেতে চেয়ে এখন শুয়ে আছো কেন?

__আমি ঐ বুড়োটাকে সাথে নিয়ে কোথাও যাব না।

__তাহলে অফিসে যাও। আমি নানানের সাথে ঘুরতে যাব।

__অফিসেও যাব না। ঘুমাবো আজ।

আমি আর কিছু না বলে সেজে গুজে রেডি হলাম। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, কিচ্ছু বলল না। আমি রেডি হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখি নানান গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে নতুন বরের মতো লাগছে। আমিও লাল শাড়ি পরেছি। বয়সের বিস্তর ব্যবধান থাকলেও দু’জনকে মনে হয় দারুণ মানাবে। সীমান্ত যদি ফটোগ্রাফারের কাজটা করতো তাহলে দারুণ হতো। কাঠ তক্তা তো তা করবে না। সে এসব পারে নাকি? পারে তো শুধুই হুংকার করতে হুহ।
ভাবলাম কফি খেয়েই বের হই। কফি বানিয়ে কিচেন থেকে বের হতেই দেখি সীমান্ত রেডি হয়ে বের হয়েছে। হলুদ রঙের গেঞ্জি পরেছে সে। এই গেঞ্জিটা আমার দেয়া প্রথম উপহার। এই ছেলেটা যে রঙের গেঞ্জিই পরুক না কেন তাকে চমৎকার লাগে। তার বাবরি চুল, মায়াবী চোখ, হাসি হাসি ঠোঁট সব মিলেই আমি ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেই নিজের বরকে নজর দিয়ে ফেলছি। কত শাকচুন্নি যে আমার বরকে হা করে চেয়ে দেখে তা আল্লাহই জানে। ওদের কারও ভালো হবে না (অভিশাপ)

গাড়িতে তিনজন বসলাম। ডান পাশে সীমান্ত আর বাম পাশে নানান বসলেন। অনেকগুলো দিন পরে ঘুরতে বের হয়েছি। সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু পাশের দু’জন বেজার মুখে জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে। মনে হচ্ছে দুই রাজ্যের দুই রাজা। যুদ্ধ অনিবার্য এক রাজকন্যার জন্য। আর সেই হতভাগী রাজকন্যা সয়ং আমি। কখন যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমি মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছি। সবকিছু ঠিকই ছিল। একটা কথায় নানা নাতির যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নানান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কী খেতে ইচ্ছে করছে? শুধু বলেছি আচার খেতে ইচ্ছে করছে। এটা শুনে নানান ড্রাইভারকে বললেন আচারের দোকানে যেতে কিন্তু সীমান্ত যেতে দেবে না। দু’জন চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। আমি দুই কানে হাত চেপে ধরে বসে আছি। নানান ধমকে উঠে বললেন-
__বউ আচার খেতে চেয়েছে আর তুমি তাকে আচার খেতে দেবে না? কী এমন চেয়েছে সে?

সীমান্ত গম্ভীর স্বরে বলল-
__আচার খেলে তার পেটব্যাথা করবে। আমি কিছুতেই তাকে আচার খেতে দেবো না।

নানান হংকার ছেড়ে বললেন-
__ডাক্তারি করছো? যাকে তাকেই রোগী মনে হয়? সবাইকেই ট্রিটমেন্ট করতে ইচ্ছে করে? শেষমেশ ঘরের বউকেও ছাড়লে না? ঘরের বউকেও রোগী বানিয়ে ফেললে? তাহলে এখানে ঘুরতে কেন এসেছো? চলো তোমার হসপিটালে যাই। তোমার অপারেশন থিয়েটারে আমরা ঘুরে বেড়াবো।

নানানের একদমে বলা কথা শুনে সীমান্ত কিছুটা চুপসে গেল। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে বেচারা ডাক্তার হয়ে ফাঁসি হবার মতো অপরাধ করেছে। সে আসামির মতো তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল-
__বাহিরের আচার অস্বাস্থ্যকর তাই।

__এখন তার আচার খেতে ইচ্ছে করছে, তাহলে কী বাড়ি গিয়ে তাকে স্বাস্থকর আচার খাইয়ে আনবো?

__যখন বাড়িতে ফিরবে তখন আচার খাবে। তবে এক চামচ।

__নিকুচি করেছি তোমার চামচের! আজকাল কী চামচ দিয়ে মেপে রোগীর ট্রিটমেন্ট করো?

সীমান্ত অভিমানী সুরে বলল-
__আপনার ছোট রাণীকে ট্রিটমেন্ট করার সুযোগ কী সে আমাকে দিয়েছে? যেটা করতে বারণ করি সেটাই তো বেশি করে। সে আমাকে ডাক্তার মনে করে নাকি?

__তাহলে কী মনে করে?

__চোর ডাকাত নাইটগার্ড এসব মনে করে।

নানান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন-
__কিহ?

__জিজ্ঞেস করে দেখেন তাকে।

আমি আসামির মতো তাকিয়ে রইলাম। নানান আমার দিকে বললেন-
__সে তোমার মন চুরি ডাকাতি করেছে সেই সূত্রে না হয় তুমি তাকে চোর ডাকাত মনে করতেই পারো কিন্তু নাইটগার্ড কেন মনে করো ছোট রাণী?

আমি আসামির মতো মাথা নিচু করে বললাম-
__যখন তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন আমি তাকে নাইটগার্ড মনে করে ছিলাম। তাই এখনও তাকে নাইটগার্ড বলে ডাকি।

__নাইটগার্ড মনে করার কারণ?

__সে ঈদের দিনে অনেক রাতে মেসেজে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল আর সেখানে লেখা ছিল সে ডিউটিতে আছে। ঈদের দিন রাতে নাইটগার্ড ছাড়া আর কে ডিউটি করবে?

নানান হাহা করে হেসে উঠে বললেন-
__তখন সে নাইটগার্ড না হলেও এখন সে তার বউয়ের নাইটগার্ড তা আমি জানি। যাই হোক, এখন চলো আচার খাবে।

সীমান্ত বলল-
__বাহিরের কোনো আচার সে খাবে না। বাড়ি গিয়ে এক চামচ আচার খাবে।

আমি ঢোক গিলে করুণ সুরে বললাম-
__আমার আর আচার খেতে ইচ্ছে করছে না।

নানান সীমান্তর দিকে তাকিয়ে ধমকে বললেন-
__এই তোমার কারণে আমার ছোট রাণীর আচার খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেল।

এবার নানান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__কার সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছো দেখো ছোট রাণী। এ তো দেখছি তুমি প্রেগনেন্ট হলেও আচার খেতে দেবে না।

নানানের কথায় আমি বিষম খেলাম। নানান বললেন-
__টেনশন করো না, আমি তোমাকে আচার খাওয়াবো।


আমরা একটা আইসক্রীমের দোকানে গেলাম। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আইসক্রীমের বড় একটা বক্স হাতে নিতেই সীমান্ত বলল-
__এই সব আইসক্রীম তুমি এখন খাবে নাকি?

আমি আইসক্রীম পেয়ে এতটাই খুশি যে, হুজুকেই বলে দিলাম-
__হ্যাঁ সব খাবো।

সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল-
__কিহ?

আমি ভীত চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__না, একটু খাবো।

__ছোট বক্স নাও।

__আচ্ছা।

নানান রেগে উঠে বললেন-
__ছোট বক্স নেবে কেন? কিপ্টামি শুরু করেছো? তুমি তো এমন ছিলে না। আর এসবের বিল আমি দেবো, তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।

__আসলে এই বক্সের সব আইসক্রীম খেলে ওর ঠান্ডা লেগে যাবে। সর্দি লাগবে।

নানান আবার হুংকার ছেড়ে বললেন-
__আবার ডাক্তারি শুরু করেছো? রাস্তা ঘাট কিছুই মানছো না? এই চলো তো আগে হাসপাতালে বেড়িয়ে আসি। আমরা তো কোনো কালেও হাসপাতাল দেখিনি, আজ দেখবো।

এবার নানানের কথায় সীমান্ত ঘাবড়ে না গিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল-
__আপনি যত যা-ই বলেন, আমি তাকে বেশি আইসক্রীম খেতে দেবো না। বড় বক্স নিক আপত্তি নেই তবে খাবে অল্প।

নানান ঝাঁজালো স্বরে বললেন-
__সে সবটুকু খাবে।

সীমান্ত বোঝানোর ভঙ্গিতে বেশ শান্ত স্বরে বলল-
__বোঝার চেষ্টা করেন! ওর কোল্ড এলার্জী আছে। ঠান্ডা খাবার বেশি খাওয়া যাবে না। বেশি খেলেই হাচি শুরু হবে।

নানান চোখ রাঙিয়ে বললেন-
__আবার ডাক্তারি?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম-
__বাড়ি যাব, শরীর ভালো লাগছে না।

নানান বললেন-
__গাড়িতে বসে আইসক্রীম খাও। আমরা এরপর ফুচকা খেতে যাব।

ফুচকার দোকানে গিয়ে সীমান্ত দোকানদারকে বলল-
__কম ঝাল দেবেন।

সবাই জানে আমি ঝাল পছন্দ করি। নানান বললেন-
__কম ঝাল দেবে কেন? তুমি ঝাল খাও না, তোমারটায় ঝাল না দিক। কিন্তু ছোট রাণীরটায় কম দেবে কেন?

__বেশি ঝাল খেলে ওর পেটব্যাথা করবে। এমনিতেই এসব বাইরের খাবার অস্বাস্থ্যকর।

নানান এবার বিশাল হুংকার ছেড়ে বললেন-
__আবার ডাক্তারি? এই চলো তো আগে হসপিটালে যাই! একটা ক্যাবিন নিয়ে বসে থেকে খোশগল্প করবো। পৃথিবীতে কত রকমের রোগ আছে সব গল্প আজ ওখানে বসে করা হবে, চলো। আর ফুচকা না খেয়ে ওখানে বসে স্বাস্থ্যকর স্যুপ খাবো সবাই। আগে বললে তো আসার সময় বাড়ি থেকে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসতাম।

সীমান্ত নানানের কথার জবাব না দিয়ে ফুচকা ওয়ালাকে বলল-
__কম ঝাল দেবেন।

নানান বললেন-
__তুমি পেট বিশেষজ্ঞ কবে থেকে হলে? তুমি তো সার্জারীর ডাক্তার।

__আমার কাজই তো পেট কাটাকুটি করা।

__তা ঝাল খেয়ে পেট ব্যাথা করলেও কী তুমি পেট কেটে ফেলো?

সীমান্ত হতভম্ব হয়ে নানানের দিকে তাকিয়ে রইল। নানান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-
__ছোট রাণী বাংলা সিনেমা দেখতে চেয়েছে। এখন আমরা সিনেমা দেখতে যাব।

সীমান্ত বলল-
__বাংলা সিনেমা? এসব দেখার পরিবেশ আছে এখন? হলে গিয়ে কেউ মুভি দেখে নাকি? যত্তোসব পাগলামি কথাবার্তা!

__কীসের পাগলামি? তুমি কী বলতে চাইছো আমি আর ছোট রাণী পাগল? আর তুমি সুস্থ?

__আমি এসব বলছি না। আমি বলছি, হলে গিয়ে মুভি দেখাটা অস্বাস্থ্যকর। কতটা নোংরা পরিবেশ! আর বাংলা সিনেমা গুলোও তো দেখার মতো নয়। দেখলেই হাসি পায়। কোনো কাহিনী আছে এসব সিনেমাতে?

নানান রেগে উঠে বললেন-
__এই তুমি কী এখন হলের ট্রিটমেন্ট করাও শুরু করবে নাকি? সাথে তো বাংলা সিনেমার ট্রিটমেন্টও করবে বলে মনে হচ্ছে। ঠিক করে বলো তো কী বিষয় তুমি নিয়ে ডাক্তারি পড়েছো?

নানানের কথা শুনে সীমান্ত হাবার মতো তাকিয়ে রইল। নানান বললেন-
__আমার বিশিষ্ট ডাক্তার নাতি দেশের সব কিছু ট্রিটমেন্ট করে শেষ করে ফেলবে। আমি তো রাতারাতি ফেমাস হতে চলেছি। কী আনন্দ!

আমি বললাম-
__আমার মাথা ঘুরছে। বাড়ি চলো প্লিজ!

কথাটা বলেই আমি নিচে বসে পড়লাম। ওরা দুজনই আমার দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here