ভালোবাসার প্রান্ত,১৪,১৫
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-১৪)
দিনগুলো বেশ কাটছিল হেসেখেলে। তবুও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। কারণ আমি তো জানি সামনে ঝড় আসতে চলেছে। অজানা আশঙ্কায় মাঝে মাঝেই আমার বুক কেঁপে উঠে। পাগলটাকে যে সামলে উঠতে আমি বড্ড হিমশিম খেয়ে যাই। মাঝে মাঝে এই হিমশিমে খুব ক্লান্ত লাগে। মনে হয়, যা ইচ্ছে করুক সে, আমি আর সামলাবো না। কিন্তু ভালোবাসার অপার শক্তি নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দেয়।
ঝড় এলো দেড় মাস পরে….
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে গিয়ে বমি হয়ে গেল। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই এ্যান্টাসিডের মতো স্বাদের এই পেস্টে দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে আমি রোজ বমি করতে গিয়েও বেঁচে যাই। আজ আর বাঁচা হলো না। বমি হয়েই গেল।
সীমান্ত নাস্তা করে বেরিয়ে যাবার পরে কিচেনে ঢুকলাম। কী এক গন্ধ এসে নাকে লাগতেই বমি চলে এলো। দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে বমি করে ফেললাম। তারপর থেকে নিয়মিত বমি চলছে। আমার আর বুঝতে বাকী নেই যে, কোন রোগে আমি আক্রান্ত হয়েছি। এখন ভেতর ভেতর তীব্র ভয় যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয়টা শুধুই সীমান্তকে নিয়ে। সে যে কী রিয়্যাক্ট করবে তা উপরওয়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি মামনির বিছানাতে শুয়ে থেকে মনে মনে দোয়া ইউনুস পাঠ করছি আর মামনি আমার পাশে বসে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোন খাবার খেয়ে আমার পেটে অসুখ হলো সেই আশঙ্কায় তিনি তীব্র অসহায় বোধ করছেন। বললেন-
__আমি এখনই বাবুসোনাকে ফোন করছি। কীসের এত ডিউটি করা? বাড়িতে রোগী আর সে পড়ে আছে হসপিটালের রোগী নিয়ে। কেমন চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে তোর।
__সেরে যাবে তো মামনি। শুধু শুধু তাকে কেন বিরক্ত করছো?
তাকে বিরক্ত করতে আমি পছন্দ করি এটা সবাই জানে আর সেই আমিই আজ বিরক্ত করতে নিষেধ করছি এটা শুনে মামনি হয়তো একটু অবাক হলেন। তারপর দৃঢ় স্বরে বললেন-
__কীসের বিরক্ত? এটা তার দায়িত্ব।
__জানোই তো আজ তার ভিআইপি ওটি আছে। কল কিছুতেই ধরবে না। শুধু শুধু ফারুককে বকা খাইয়ে নিও না।
__তাহলে কী করবো? তানিকে কল করি।
__লাগবে না তো।
__সকাল থেকে ছয়বার বমি করেছিস তারপরেও বলছিস লাগবে না?
__এমনিই সেরে যাবে।
মামনি আমার কথা না শুনে তানিকে কল করলো। আধা ঘন্টা পর ডাঃ তানিয়া এলেন। পুরাই ডাক্তারনি ভাব নিয়ে আমাকে চেক করলো সে। তারপর বলল-
__ইউরিন টেস্ট করাতে হবে। আর এখনি।
__থাক না তানি!
__থাকাথাকি নেই সোনাভাবী। বেশি কথা বলবে না। যা বলছি করো।
__আমার ইউরিনে কী ইনফেকশন হয়েছে?
__হুম
সত্যিই কন্সিভ হয়েছে কী না সেটা আমিও নিশ্চিত ছিলাম না। আর নিশ্চিত হওয়াটা সত্যিই দরকার। আর ইউরিনে ইনফেকশন তো হতেই পারে। তাই আমি ইউরিন টেস্ট করাতে আপত্তি করলাম না।
সে বাড়িতেই ইউরিন টেস্ট করলো। পাজি মেয়ে ইনফেকশন বলে প্রেগনেন্সী টেস্ট করে ঢাকে ঢোলে বাড়ি দিলো। চিৎকার করে উঠে মামনিকে জড়িয়ে ধরে বলল-
__মামনি তুমি দাদুন হতে চলেছো?
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। মামনি তো খুশিতে কেঁদেই দিলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন-
__আমার বাবুসোনার সন্তান!
নানুন এসে কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। বাবা অফিসে আছেন। তানি বাবাকে ফোন করে গম্ভীর স্বরে বলল-
__বাবা সোনাভাবী গুরুতর অসুস্থ। তুমি আমানকে সাথে নিয়ে এখনি চলে এসো।
বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো সে। তারপর সে নানানকে ফোন করলো। তাকেও গম্ভীর স্বরে বলল-
__আপনার ছোট রাণীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনি বাড়িতে এলে তবেই তাকে হাসপাতালে নেয়া হবে।
নানানকেও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তানি কল কেটে দিলো। আমি ওর কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
বাবা আর আমান ভাই অফিস ফেলে ছুটে এলেন বাড়িতে। এসে দেখেন মামনির চোখে জল, নানুন আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। তানির মুখ গম্ভীর। বাবা ভীত স্বরে বললেন-
__কী হয়েছে?
কারও মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ তানি চিৎকার করে বলল-
__বাবা তুমি দাদান হতে চলেছো।
বাবা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকালেন। লজ্জায় মরে যাই, মরে যাই এমন অবস্থা আমার। আমি মুখ তুলে কারও দিকেই তাকাতে পারছি না। বাবা আমার পাশে এসে বসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-
__এত সুখের একটা খবর শুনে আমি কী বলবো বুঝে পাচ্ছি না। আমার নাতি নাতনি আসছে, এটা ভাবতেই তো…
এরমধ্যে নানানের গলার আওয়াজ পেলাম। তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলেছেন। তানি দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে এই রুমে আসতে বলল। তিনি ছুটতে ছুটতে রুমে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে উনি উড়ে টুড়ে এসেছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন-
__কী হয়েছে আমার ছোট রাণীর? কোথায় আমার ছোট রাণী?
সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে। নানানের চোখমুখ আরও ভীত হয়ে গেল। তার দৃষ্টি বলছে, কেন আমাকে ঘিরে নিয়ে সবাই আছে?
নানান উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-
__কেউ কথা বলছো না কেন?
তানি নম্র স্বাভাবিক ভাবে বলল-
__নানান আপনার বান্দর নাতি বাবা হতে চলেছে।
নানান সোফায় বসে পড়লেন। হতবাক সুরে বললেন-
__সে এসব কবে করলো?
সবাই হতভম্ব হয়ে নানানের দিকে তাকালো। তখনও নানান বুঝতে পারেননি যে, সবার সামনে তিনি বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছেন। নানান হয়তো ভেবেই অস্থির যে, তার শিশু সুলভ আলাভোলা নাতি কেমন করে আরেকটা শিশুর পিতা হতে চলেছে!
⭐
সীমান্ত বাদে সবাই বাড়িতে আছে। যেন আজ ঈদ। অনেক কিছু রান্না করার পরামর্শ চলছে। কিন্তু আমাকে ফেলে কেউ সরবে না। তাহলে রান্না কে করবে?
আমার জীবনের প্রথম এবং সেরা প্রাপ্তি হলো সীমান্ত। আর দ্বিতীয় প্রাপ্তি পেতে চলেছি। এটা পুরোপুরি পাবার জন্য আমাকে নয়টা মাস অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে আমার সীমান্তকে খুব করে আমার কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। সে কখন আসবে কে জানে। এসেই কী রিয়্যাক্ট করবে তা নিয়েও আমি ভীত। না জানি আবার বালিশ দিবস শুরু হয়।
সে এলো রাত আটটায়। তার গাড়ির আওয়াজ শুনে সবাই হৈচৈ থামিয়ে চুপ করে রইল। তানি দরজার পর্দা একটা ফাঁক করে উকি দিয়ে দেখছে সীমান্ত বাড়ির ভেতরে ঢুকে কী করে। হঠাৎ তানি ধারাভাষ্যকার হয়ে গেল। উকি দিয়ে সে দেখছে আর বলছে-
__ সে এখন বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে সোনাভাবীকে খুঁজছে। মুখটা ম্লান হয়ে গেছে তার। কারণ চোখের সামনে তার বউ নাই। এখন একটু দূর থেকে সে কিচেনে উকি দিলো। কিচেনে কেউ নেই দেখে তার চোখমুখ হতাশ হয়ে গেল। এখন সে উপরে যাচ্ছে তার সোনাবউকে খুঁজতে।
সবাই হা করে তানির দিকে তাকিয়ে আছে। মিনিট দুয়েক পরে আমার নম্বরে কল এলো। সবাই বুঝে ফেলেছে যে, কে কল করেছে। কল রিসিভ করলাম-
__সোনাবউ তুমি কোথায়?
ভয়ে আমার গলার স্বর আটকে আছে। অনেক কষ্টে স্বর বাইরে এলো।
__মামনির রুমে।
__আমি সারাদিন পর বাড়ি ফিরেছি আথচ তুমি রুম থেকে বের হলে না? বাড়ির বাকী সবাই কোথায়? কাউকে দেখছি না কেন? বাড়ি এত নিঃস্তব্ধই বা কেন?
__তুমি এখানে এসো।
সে রাগ করে বলল-
__পারব না। আমি চেঞ্জ করছি।
কথাটা বলেই সে ফোন কেটে দিলো। আমার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই মিনিট না হতেই সে মামনির রুমে এলো। আমি শুয়ে আছি আর সবাইকে চুপচাপ দেখে সেও যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখমুখ জুড়ে ভয় ছেয়ে গেল নিমেশেই। আমার কী হয়েছে এই প্রশ্নটা করতেও যেন তার গলা ধরে আসছে। তার দৃষ্টি বলছে, না জানি ভয়ানক কী খবর সে শুনতে চলেছে। তবুও কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সে বলল-
__কী হয়েছে?
সবাই সীমান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। সে অসহায় চোখে আমাকে দেখছে। সারাটা দিনে আমার পেটে কিছুই রাখতে পারিনি। আয়নায় নিজেকে না দেখলেও বুঝতে পারছি আমার মুখটা শুকিয়ে আছে। আমি যে সুস্থ নেই সেটা যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। সীমান্তরও বুঝতে বাকী নেই। সে বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে মামনির দিকে তাকিয়ে বলল-
__মামনি কী হয়েছে ওর? তাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? ওর মুখটা শুকিয়ে আছে কেন? আর সবাই চুপ করেই বা আছো কেন?
তানি গম্ভীর মুখ করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
__নিজেকে শক্ত কর ভাই। ভেঙে পড়া যাবে না।
সে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলল-
__কী হয়েছে?
__তোর বউয়ের ভয়ানক রোগ হয়েছে।
সীমান্তর চোখ দুটো আরও ভীত হয়ে গেল।
__কী হয়েছে বলবি তো?
নানান সোফায় বসে ছিলেন। উনি উঠে দাঁড়িয়ে সীমান্তর কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর মুখ করে ফিসফিস করে বললেন-
__কবে এসব হলো?
সীমান্ত অবাক হয়ে বলল-
__কী সব?
__বাহ্ মনে হচ্ছে কিছুই বুঝো না! অবশ্য আমরা এতদিন ভেবে এসেছি যে, তুমি কিছুই বুঝো না। এখন তো দেখছি সবই পারো।
__আমি কী করলাম সেটা বলবেন তো?
__এই যে তুমি আমার ছোট রাণীকে মা বানিয়ে দিয়েছো।
__মানে?
__মানে তুমি বাবা হতে চলেছো।
__মানে?
নানান মুচকি হেসে বললেন-
__বাবা হবার মানে বুঝো না? ভেতরে ভেতরে এতদূর চলে গেছো আর উপরে বুঝাচ্ছো কিছুই বোঝো না।
নানানের কথা শুনে সে হাবলার মতো হা করে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই এবার একসাথে হাসতে শুরু করলো। শুধু আমিই লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। আর ভেবে অবাক হলাম যে, নানানের এমন সব কথাবার্তায় আমি ব্যতিত কেউ লজ্জা পেলো না। সীমান্ত আমার দিকে তাকালো, তার দৃষ্টিতে বিস্ময় নেই, সহানুভূতি নেই, ভালোবাসাও নেই। আছে শুধু….
বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।
পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna
“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১৫)
রাতে রুমে ঢুকে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে আমি কী বলবো। সীমান্তর চোখভরা জল দেখে আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হতে শুরু করলো। এতদিন ছিল তার কপট রাগ নিয়ে আমার ভয় ভীতি। কিন্তু তার আজকের রূপ আমাকে আতঙ্কিত করছে। তার এই অশ্রুস্রোত আমি কেমন করে সইব আল্লাহ? এতটাও সহ্য ক্ষমতাও কী আছে আমার? আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে ভারি গলায় বলল-
__তুমি খুব স্বার্থপর সোনাবউ। নিজেকে ছাড়া তুমি কিচ্ছু বোঝো না তুমি। অন্যের ব্যাথা তোমার হৃদয় ছুঁতে পারে না কখনও। তুমি বলো আমি নাকি কাঠ। আমার হৃদয় নাকি কাঠের তৈরি। আমি রসহীন মানুষ বলে তোমার এসব উপাধি দ্বিধাহীন ভাবেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু পৃথিবীতে কেউ কী জানে যে, তোমার হৃদয় পাথরের তৈরি? কাঠ তবুও সহজেই ভাঙা যায়। কিন্তু তোমার হৃদয়ে কপাল ঠুকে রক্তাক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো পরিণতি নেই। এই যে আমার এত চেষ্টা, কষ্ট রাগ অভিমান কিছুই তোমার হৃদয় টলাতে পারেনি। একদিন তুমি লেখিকার ভাষায় বলেছিলে, অশ্রু নাকি হৃদয় চিরে প্রবাহিত হয়, হৃদয় চিরে ভেতরটা যখন রক্ততে মাখামাখি হয় তখন নাকি ভেতর থেকে জল এসে চোখ ভিজিয়ে দেয়। দেখো সোনাবউ হৃদয় চিরে রক্তারক্তি হয়ে আমার চোখে জল এসেছে। দেখো তুমি দেখো! বিমুগ্ধ চোখে দেখো!
আমার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই পৃথিবীটা ভেঙেচুরে হাত পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেন এমন কষ্ট আমার জীবনে লেখা হলো। জীবনের এই অধ্যায়টা না ভাগ্যে পা লেখা থাকলে কী চলতো না? খুব কষ্টে আমি কাঁন্না চেপে রেখেছি। কিন্তু চোখ এসব চাপাচাপি মানে না। শুধু একটা ব্যাপারেই চোখ বড্ড বেপরোয়া। মানুষ চাইলেই কিছু না দেখার জন্য চোখ বন্ধ করতে পারে কিন্তু অশ্রু প্রতিরোধ করতে পারে না। সীমান্তর অভিমানের জমাট দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি তো নিরুপায়। তার চোখের জল স্পর্শ করার সাহস নেই আমার।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম-
__আমি এখন ঘুমাবো।
সে হতবাক হয়ে তাকালো আমার চোখের দিকে। আমি জানি সে এমন কথা এই মুহূর্তে আশা করেনি। আমার “পাথর” উপাধিটার সত্যতা প্রমান হোক সেটাও হয়তো সে চায়নি। সে নিষ্পলক আমার দিকে তাকিয়ে রইল। খরস্রোতা নদীর মতো তার চোখে বয়ে চলেছে অশ্রুস্রোত। শত পিপাসাতেও আমি সেই জল ছুঁয়ে দেখলাম না। তোমার চোখের জল ছোঁয়ার মতো এতটা সাহসী আমি নই সাহেব। আমাকে ক্ষমা করে দিও!
আমি সব উপেক্ষা করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
আমাকে শুতে দেখে সে কাঁন্না জড়ানো গলায় বলল-
__তুমি তো এমন ছিলে না। এমন হৃদয়হীনাকে আমি ভালোবাসিনি। বিয়েও করিনি। তোমায় বড্ড অচেনা লাগছে সোনাবউ।
কিছুই শুনতে পাইনি এমন ভান করে আমি ওপাশ ফিরে শুলাম। তার কথার কী জবাব দেবো আমি? নারী মানেই তো সর্বরূপে রূপায়িত। নারী কখনও দূর্গা, কখনও চন্ডী। তুমি তো আমার চন্ডী রূপ দেখেই আমাকে ভালোবেসেছিলে সাহেব। আমার ভেতরের সুতীব্র তরল্যতা আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলার পরে তোমাকে দেখিয়েছি। যা আজও অন্য কেউ দেখতে পায়নি। সবাই আমার বাহিরের কঠিনটুকুই দেখে এসেছে সারাজীবন। সবার সাথে তুমিও তো এক সময় সেই কঠিন রূপ দেখেছো। তখন তো জানতেও পারোনি যে, এই কঠিন মনের মেয়েটার ভেতরে একটা তরল মন থাকতেও পারে! তাহলে আজ এত অবাক কেন হচ্ছো?
আমাকে নিরুত্তর দেখে সে বলল-
__কেন এমন স্বার্থপরের মতো কাজ করলে তার জবাব দাও সোনাবউ! আমার কথা একটিবারও কেন ভাবলে না? কেন বদলে গেলে তুমি?
আমি তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম-
__শান্ত হয়ে ঘুমাও সাহেব। রাত অনেক হয়েছে। আর আজ তুমি সকাল থেকে ডিউটিতে ছিলে, তোমার শরীর ক্লান্ত। প্লিজ ঘুমিয়ে যাও!
সে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি কতটা শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এতে হয়তো তার হৃদয় আরও ভেঙে চুরে যাচ্ছে। আমার ভেতরেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে অথচ বাহিরে আমি কতটা শান্ত। কেমন করে বিধাতা নারী সৃষ্টি করেছেন তা আমার কাছেও রহস্য! কেমন করে আমি এসব পারছি তা আমি নিজেও জানি না।
সে ভারি গলায় বলল-
__আজ আমাকে ঘুম পাড়াতে ইচ্ছে করছে না? আমার বুকে মুখ গুজে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে না? ঘুমানোর নাম করে আমার চুল ধরে টানতে ইচ্ছে করছে না?
কথাগুলো বলতে বলতে সে আবার কেঁদে ফেললো। মনে মনে বললাম, খুব করছে। কতটা ইচ্ছে করছে তা তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারবো না পাগলটা। কিন্তু একটু করে কষ্ট সহ্য করার অভ্যেস তো তোমায় করতেই হবে। বড় বড় কষ্ট নেবার আগে সহনশীলতা দরকার। আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম-
__আমি নিজেই অসুস্থ। শক্তি নেই আমার।
সে চেঁচিয়ে উঠে বলল-
__তোমার শক্তি নয়, মন নেই। তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না। তুমি ভেতর বাহির বদলে গেছো সোনাবউ। এই সোনাবউকে আমি চাই না। তুমি আমার আগের সোনাবউকে ফিরিয়ে দাও। যে আমাকে না খাইয়ে খায় না, আমাকে ঘুম না পাড়িয়ে ঘুমায় না। ফিরেয়ে দাও প্লিজ!
আমি জবাব দিলাম না। আমার গলাটাও ধরে আসছে। আমি আমার ভেতরের কষ্টটা তাকে বুঝতে দিতে চাই না। আমি ওপাশ ফিরে শুলাম যেন সে আমার মুখটা দেখতে না পায়।
আমার চোখে ঘুম এলো না। ঘুম তো আসার কথাও নয়। সেও জেগে বসে রইল। দু’জন মানুষ দহনে পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। অবসাদের এই রাতে আকাশ ভরা চুইয়ে পড়া চাঁদের জোছনা থাকলেও আমার ঘরটা আজ বড্ড আঁধার। আমার চাঁদে যে আজ মেঘের কালো ছায়া পড়েছে। সেই কালো ছায়ার প্রবল শ্বাসাঘাত আমার ভেতর বাহির তছনছ করে ফেলছে।
⭐
বাকী রাতটুকুতে আমি একটিবারও তার দিকে মুখ ঘুরাইনি। সকাল হতেই সে ফ্রেশ হয়ে রেডি হলো। আমি বিছানা থেকে নামতেই সে বলল-
__উঠছো কেন?
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__তোমার নাস্তা রেডি করতে হবে।
__বাড়িতে আরও লোকজন আছে। তুমি রেস্ট নাও।
তার চোখমুখ জুড়ে গাঢ় অভিমান। কেন জানি আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। কী এক অপরাধ বোধ আমাকে থমকে দিলো। কষ্টমাখা অনুভূতির মিছিলে আমি আপোষ হয়ে থেমে রইলাম। সে বেরিয়ে গেল কিছু না বলেই। আমি নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলাম।
সীমান্ত রুম থেকে বেরিয়ে যাবার আরও বেশ কিছুটা সময় পরে আমি ডায়নিং এ গেলাম। দেখলাম বাবা আর নানান ডায়নিংএ বসে আছেন। সীমান্তকে দেখতে পেলাম না। এত দ্রুত তার নাস্তা করা হয়ে গিয়েছে ভেবেই অবাক হলাম। কী খেয়ে বের হয়েছে কে জানে! নানান আমাকে দেখে বললেন-
__ছোট রাণী তোমার আধা পাগল বর কী নাস্তা করে বেরিয়েছে জানো?
আমি উৎকন্ঠা নিয়ে বললাম-
__কী?
__উনি স্যালাইন খেয়ে বের হয়েছেন। শুনেছি প্রেগনেন্ট মহিলারা খেতে পারে না। কিন্তু প্রেগনেন্ট মহিলাদের স্বামীরাও যে খেতে পারে না তা এই প্রথম দেখলাম।
আমি বিষম খেয়ে বললাম-
__আমিও এই প্রথম দেখলাম।
মামনি এগিয়ে এসে বললেন-
__এত সকালেই কেন উঠেছিস? এখন তোর প্রচুর রেস্ট দরকার। তুই রুমে যা আমি নাস্তা নিয়ে রুমে আসছি।
__মামনি আমার শুয়ে থাকতে ভালোলাগছে না।
__এখন তোর শরীর কেমন লাগছে?
__শরীর কেমন লাগছে জানি না, তবে গা গুলিয়ে চলেছে।
__কাল থেকে তো শুধুই স্যালাইন খেয়ে আছিস। এখন অন্তত কিছু একটা খাবার খা।
__খাবার শব্দটা শুনলেই বমি পাচ্ছে মামনি।
__এসময়ে এমন একটু লাগবেই, তবুও খেতে হবে মা।
মামনির কথাগুলো যেন আমার কানে ঢুকছে না। সীমান্তর কথা মনে হতেই আমার চোখে জল এলো। মানুষটা সারারাত একফোঁটাও ঘুমায়নি। শুধুমাত্র স্যালাইন খেয়ে অফিসে চলে গিয়েছে, কখন ফিরবে কে জানে। মন খারাপ থাকলে তো বাড়িতেও ফিরতে চায় না।
মামনির ডাকে চেতনায় ফিরলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি বাবা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি চোখ মুছে নিলাম। মামনি জুসের ক্লাসটা আমার মুখে ধরলেন। নিরুপায় হয়েই আমাকে খেতে হলো। তবে তা পাঁচ মিনিটও পেটে রাখতে পারলাম না।
রুমে গিয়ে ডাকাতটাকে কল করে বললাম-
__তুমি স্যালাইন খেয়ে অফিসে গিয়েছো কেন?
__তুমি তো এটাই চেয়েছিলে?
সে অভিমানের সুরে বলল-
__আমি এটা কখনও চাইনি।
__জানতে না যে, তুমি যা খাবে আমিও তাই খাবো?
__তাই বলে স্যালাইন?
__হুম
__শাস্তি দিচ্ছো?
__নিচ্ছি।
ফোন রেখে দিলাম। তুমি এমন করে আমাকে শাস্তি দিয়ে কী সুখ নাও তা আজও আমার বোধগম্য নয়। স্বামী অভুক্ত আছে, এই যন্ত্রণা যে ঠিক কোথায় গিয়ে আঘাত করে তা তোমরা পুরুষরা কখনও বুঝবে না। তোমার এই দান তোমার সোনাবউ হাসিমুখে গ্রহণ করবে আজনম। বিরহ যাতনায় শেষ হয়ে যাব তবুও উহ্ শব্দটাও করবো না।
⭐
সীমান্ত রাতে বাড়ি ফিরলো। সারাটা দিন তার কেটেছে একগ্লাস স্যালাইন খেয়ে। তার মুখটা শুকিয়ে আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ঠেলে কাঁন্না আসছে। সব দোষ তো আমার! বাড়ি ফিরে সে আমার দিকে শুধু একবার তাকালো, একটাও কথা বলল না। আমি নিজে থেকেই তার কাছে গিয়ে বললাম-
__আমি চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছি।
__না। আমি একাই পারবো। তুমি রেস্ট নাও।
আমি কেন যেন তাকে জোর করতে পারলাম না। এতগুলো বছর ধরে কাছে দূরে যেমন ভাবেই থেকেছি, আমি তাকে জোর করেছি। এজন্যই সে আমাকে ডাকুরানী বলে ডাকে। আজ সেই জোর করার জোরটাই যেন নেই আমার। না আছে শরীরে জোর, না আছে মনে।
সে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে বসলো। নানান তার পাশে বসতে বসতে বললেন-
__শুনলাম আজকাল নাকি তুমি নিয়মিত স্যালাইন খাচ্ছো? তা ডায়রিয়া সারবে কবে তোমার?
সীমান্ত টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল-
__আমার তো ডায়রিয়া হয়নি।
নানানও টিভির দিকে তাকিয়ে বললেন-
__তো স্যালাইন দিবস পালন করছো কেন?
__এমনি।
নানান দুষ্টুমির সুরে বললেন-
__বউ প্রেগনেন্ট হলে কী স্বামীরও অরুচি আর বমি হয়? আসলে আধুনিক যুগে তো নতুন নতুন রোগ বের হয়েছে, সব তো আর আমি জানি না। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
সীমান্ত জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে ডিনার করার জন্য মামনি ডাকলেন কিন্তু সে বলল, ক্ষুধা নেই। তার ক্ষুধা কেন নেই তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। কেউ যে তাকে জোর করেও খাওয়াতে পারবে না তাও আমি জানি। আমি অনেক কষ্টে চোখমুখ বন্ধ করে ডিনারে ভাত খেলাম। সীমান্ত তখনও ডিনার করতে আসেনি। ডিনার শেষ করে আমি খুব দ্রুত রুমে চলে গেলাম। এরপর ওয়াশরুমে সব বমি করে ফেললাম। সীমান্ত জানলো আমি ভাত খেয়েছি তাই সেও ভাত খেলো। এই অভিনব বুদ্ধিটা আমাকে ভীষণ আনন্দিত করলো। এখন থেকে এটাই করবো। তার সামনে যেমন করেই হোক খাবার খাবো। সে স্যালাইন খেয়ে সারাদিন থেকে আমাকে শাস্তি দেবে, এটা ডাকুরানী মানবে না কিছুতেই।
পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna