ভালোবাসার প্রান্ত,১৬,১৭

0
1199

ভালোবাসার প্রান্ত,১৬,১৭
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-১৬)

রাতে রুমে ঢুকতেই সীমান্ত আমাকে দেখে কপট রাগ দেখিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল। আমরা নারীরা জন্মের পরে থেকেই জেনে এসেছি যে, মেয়ে হয়ে জন্ম নিলেই কষ্ট সহ্য করতে হবে। এই জানাটা কিন্তু আমাদের মায়ের থেকেই জানা হয়। বাবারা কখনও এসব বলে না। এমনকি মেয়ের জীবনে কষ্টের আঁচ আসবে এই বিষয়টা কোনো বাবাই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না।
এই যে আমার স্বামী আমাকে কতটা সুখে রেখেছে! আমার সুখের জন্য পৃথিবীটা এনে আমার পায়ের তলায় রেখে দিয়েছে। তবুও আমি ভেতর ভেতর কষ্ট পাচ্ছি। এই কষ্ট কোনো সুখের অভাবে নয়, এই কষ্ট ভালোবাসার অভাবে নয়, এই কষ্ট কোনো বিশ্বাহীনতার জন্য নয়, এই কষ্ট আমার প্রতি তার কোনো অবহেলাতে নয়। এই কষ্ট হলো, আমার স্বামী কষ্টে আছে তাই আমিও দ্বিগুণ কষ্ট পাচ্ছি। নারীর এই কষ্টের হদিস কী পুরুষরা জানতে পারে কখনও? হয়তো পারে না। এটা শুধুমাত্র নারীদেরই গোপন কষ্ট। নারী হয়ে জন্মেছি তাই এমন শত সহস্র কষ্টকে বুকে ধারণ করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। নারীদের এই কষ্টটা শুধু রীতিনীতি নয়, এটাই স্রষ্টার সৃষ্টি।

নিতান্ত এই রাগী ভদ্রলোকের উপরের দেখানো রাগ থেকে ভালোবাসা নিংড়ে নিই আমি। বেশিরভাগ সংসারে এই রাগটাকে স্ত্রীরা বুঝতে না পেরে ভুল বোঝে। অনেকেই বুঝেই উঠতে পারে না যে, রাগের ভেতরে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। অনেক মেয়ে তো ভেবেই বসে যে, স্বামী একদম ভালোবাসে না। কিন্তু রাগ তো মানুষ তার উপরেই করতে পারে, যাকে উজাড় করে ভালোবাসা যায়। কিন্তু এই ব্যাপারটা কী স্বামীরা বোঝে? স্ত্রীর রাগ অভিমানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা কী তারা উপলব্ধি করতে পারে? তারা কী এটা জানে যে, একটা মেয়ের রাগ অভিমান করার স্থান শুধুই তার স্বামী? স্বামীকে ঘিরেই নারীর প্রেম ভালোবাসা রাগ অভিমান অভিযোগ। কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে একটা মানুষের প্রতিই শুধু অভিমানের কারণটা কী তারা জানে?

আমি সীমান্তর রাগগুলো গায়ে মাখি না। কারণ আমি জানি যে, আমার কাঠঠোকরা বর একটু বেশিই অভিমানী। তার এই অভিমান বাড়তে দিলে তা জমাট বেঁধে পাহাড় হয়ে যাবে। অভিমান কখনও বাড়তে দেয়া উচিত নয়। স্বামী স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই অতি দ্রুত অভিমান ভাঙতে হয়। কারণ ছোট ছোট অভিমান ভালোবাসা বৃদ্ধি করলেও বড় বড় অভিমান ভালোবাসা হত্যা করে। আর আমি আমাদের ভালোবাসাকে কখনই হত্যা করতে দেবো না। আমি তার গা ঘেষে শুয়ে তার বাহুতে হাত রাখলাম। সে রোবটের মতো একটুও নড়লো না। শুনেছি মেয়েদের শরীরে নাকি বিদ্যুৎ থাকে। আমার শরীরে বোধহয় লোডশেডিং চলছে। অথবা আমার রোবট বর এখন চার্য নিচ্ছে। এসব আবল তাবল ভেবে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। হাসি চেপে রেখে অভিমানী সুরে বললাম-
__অসুস্থ বউয়ের উপর কেউ রাগ করে থাকে?

সে আমার দিকে মুখ না ঘুরিয়েই জবাব দিলো-
__কীসের অসুস্থ? এসব তো শখ করে দাওয়াত করে এনেছো।

আমি ইচ্ছে করেই আহ্লাদী সুরে বললাম-
__শখ করে দাওয়াত করেছি বেশ করেছি।

নিজের আহ্লাদী সুর শুনে নিজেই অবাক হলাম। ঠ্যালায় পড়ে আমার মতো কর্কশ নারীও ন্যাকামী করছে, ভাবা যায়! ভালোবেসে ভালোবাসার জন্য সব কিছু করাই যায়েজ বলে আমি মনে করি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রতিটা নারীই স্বামীর কাছে আহ্লাদ প্রকাশ করতে পছন্দ করে। এটা বেশিরভাগ নারীর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। আরেকটা কারণ হলো, এতটা কাছাকছি নিবিড়ভাবে শরীর মন স্বামী ব্যতীত পৃথিবীর আর কোনো মানুষের সাথে মিলেমিশে একাকার হতে পারে না। তাই কিছু অঘোষিত অধিকাবোধ এখানে কাজ করে। যে অধিকার কোনো আইনের ধারাতে নেই।

সে আমার দিকে পাশ ফিরলো। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
__কী হতে চলেছে তা কী একটিবার ভেবে দেখেছো?

আমি অবলীলায় বললাম-
__ভাবতে চাই না।

সে আবার পাশ ফিরে শুয়ে বলল-
__কেন আমার এই আপত্তি তা তুমি ভালো করেই জানো।

মনে মনে বললাম, ভালো করেই জানি বলেই তো পাথরের মতো নিশ্চুপ আছি।
আমার আবার বমি পাচ্ছে। আমি যে বরের সাথে একটু ঝগড়া করবো সেই পরিস্থিতিও নেই। শরীর একদম দূর্বল। আমি আবার ওয়াশরুমে গেলাম। এত বমি কোথায় থেকে যে আসছে তা আল্লাহই জানেন। সারাদিনে বমিতে যত পানি বের হয়, এত পানি তো আমি খাই না। পেটে কী ঝরনা ট্যাপ এসব কিছু সেট হয়েছে নাকি মাবুদ! যদি তাই হয় তবে সব অফ করে দাও আল্লাহ!
ফ্রেশ হয়ে তার পাশে এসে শুলাম। তার ইচ্ছের বাহিরে আমি মা হতে চলেছি, সে যে আমাকে একটু বকবে সেই সুযোগও তার নেই। আমার এত ঘনঘন বমি হচ্ছে যে, সে নিজেই আপসেট হয়ে গিয়েছে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে চোখ রাঙিয়ে বলল-
__মা হবার সাধ পূরণ হচ্ছে? কেমন আনন্দ লাগছে বমি করতে? কর কর বেশি করে বমি করো।

আমি রাগী চোখে তার দিকে তাকালাম। কী নিষ্ঠুর মানুষ! বউ সারাদিন বমি করছে, কোথায় বুকে টেনে নিয়ে বলবে, “কষ্ট হচ্ছে সোনা?” তা নয় উনি উল্টা বকছেন। এই ভদ্রলোককে আমার বশীকরণ তাবিজ করা উচিত। ভাবছি কালকেই মামনিকে বলব, তিনি যেন আমাকে একটা তাবিজ এনে দেন।
আমি রাগ করে বললাম-
__বমি তো আমি করছি, তোমার কী?

__আমার বউ করছে তাই আমার অনেক কিছু।

আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম-
__বকবে না একদম। প্রেগনেন্ট বউকে বকলে কিন্তু বেবি কষ্ট পাবে।

স্বামীর এই মেজাজ দেখার ভয়ে আমাকে কারণে অকারণে কাঁন্নার পোজ নিতে হয়। আল্লাহ কী সব আমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন!
সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল-
__মানে? তোমায় বকলে বেবি কষ্ট পাবে কেন?

আমি জ্ঞানীদের মতো ভাব নিয়ে বললাম-
__মায়ের নাড়ির সাথে বাচ্চার নাড়ি আটকানো থাকে জানো তো?

সে উপহাস করে বলল-
__আমি এসব জানবো কী করে? সব তো তুমি জানো। ডাক্তার তো তুমি।

__এসব জানার জন্য ডাক্তার হতে হয় না। মেয়েরা এমনিতেই অনেক কিছুই জানে।

__আমি তো জানিই যে, আমার বউটা একটু বেশিই জানে, বেশিই বুঝে।

__যতটুকু দরকার ততটুকুই বুঝি।

__তারপর

__মায়ের খাবার যদি বেবি টেনে নিতে পারে তবে বকাঝকাও টেনে নেবে। কষ্ট পেয়ে বলবে বাবাই পঁচা। এসব বলে সে কাঁন্নাকাটি শুরু করবে। আমার বাচ্চাটা তোমার জন্য এমন কষ্ট পাবে? হায় আল্লাহ!

সে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এমন করে তাকানোর কী আছে হু? তার তাকানো দেখে তো আমার লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কিছু বলেছি।
সে বলল-
__বিশ্বাস করো আমার এই জীবনে আমি অনেক প্রেগনেন্ট রোগী দেখেছি কিন্তু এমন কথা এর আগে কখনও শুনিনি।

সারাজীবন ধরে আরও অনেক বিস্ময়কর কথা শুনবে গো ডাক্তার সাহেব। এইটুকুতেই যদি হতভম্ব হও তাহলে চলবে কী করে?


একটা মাস কেটে গেল সীমান্তর অভিমানী মুখ দেখে। কতশত ব্যাথা যে, সে চোখেমুখে ছড়িয়ে নিয়ে থেকেছে তা শুধুই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। কিন্তু কিছু বলার সাহস পাইনি। তারপর সে ধীরে ধীরে বদলে গেল। সে কেমন যেন ফাঁকিবাজ হয়ে গিয়েছে। অফিস যেতে চায় না। গেলেও লেট করে বের হয়, তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। অফিসে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার কল করে আমার খবর নেয়। এসব আমার বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে প্রতি বছর একটা করে বেবি নিলে মন্দ হয় না। কিন্তু বাড়ি ফিরেই সে শুরু করে খাবারের অত্যাচার। এদিকে আমি কিছুই খেতে পারি না। পৃথিবীর কোনো খাবারেই যেন স্বাদ নেই। খাবারের নাম শুনলেই আমার বমি পায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমি কেন খাচ্ছি না? আমি না খেলে বেবি খাবার পাবে কোথায় থেকে? বেবির কথা যদি না-ই ভাবি তাহলে জোর করে কেন বেবি কন্সিভ করলাম? ইত্যাদি কথার দংশনে আমি ভীষণ আহত। এরমধ্যে সে ১৪৪ ধারা জারি করে দিলো, আমার বেড রেস্ট। ওয়াশরুম যাবার জন্যই শুধু বেড থেকে নামা যাবে। আমি তার এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করলাম-
__প্রতিদিন কোটি কোটি নারী গর্ভবতী হচ্ছে, তাদের স্বামীরা এমন ১৪৪ ধারা জারি করে না।

সে দৃঢ় স্বরে বলল-
__আমি করি।

__আমি বেড রেস্ট নিতে পারবো না। তুমি তো জানোই যে, আমি ঘুম না এলে শুয়ে থাকতে পারি না। কেমন যেন ছটফট লাগে।

সে রেগে উঠে বলল-
__তা তো লাগবেই। হাড়গোড় তো সব বানরের, লাফালাফি না করলে তো থাকতে পারবে না।

__আমি বেড রেস্ট নেবো না। বাকী সব মেয়ের মতো আমি স্বাভাবিক সব কাজ করবো। ইনফ্যাক্ট রান্না বান্নাও করবো।

সে বিশাল এক ধমক দিলো-
__চুপ একদম চুপ।

কেন জানি আমি তার ধমকে একটুও ভয় পেলাম না। বললাম-
__চুপ করবো না। আমি দিনরাত শুয়ে থাকতে পারবো না।

__আমি কেন তোমায় বেড রেস্ট দিয়েছি তা তুমি ভালো করেই জানো। তোমার এই গর্ভধারণ যে স্বাভাবিক নয় সেটা না বোঝার মতো অবুঝ তুমি নও।

আমি আর কিছু বললাম না। কারণ আমি জানি যে, কিছু বলেও লাভ নেই।


তিনমাস ধরে বমি দিবস পালন করার পরে বমি বন্ধ হলো। ভাবলাম এবার বেঁচে গেছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু বাঁচা আর হলো না। নানুন খাবার এনে আদর করে বলেন-
__আমার সখী, আমার বাবু মশাইয়ের বউ তো খুব ভালো মেয়ে, গুড গার্ল। এখন সে খাবে আমি জানি।

এমন করে পটালে কেউ না পটে পারে? অগত্যা আমাকে খেতে হয়। আধা ঘন্টা না হতেই মামনি আবার কিছু না কিছু নিয়ে হাজির হন। না খেলে করুণ চোখে চেয়ে থাকেন। যেন মেয়ে তার মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাধ্য হয়েই খেতে হয় আমাকে। মামনি সারাক্ষণ আমার জন্য এটা ওটা রান্না করেন, যদি আমি একটু খাই সেই আশায়। পৃথিবীতে কারও বলার সাধ্য নেই যে, উনি আমার জন্মদাত্রী নন, আমার শাশুড়িমা। আমি নিজেও প্রথম থেকেই তাকে শাশুড়িমা ভাবতে পারিনি।
আজকাল বাবাও বেশ অফিস কামাই করেন। অফিসে গেলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর আমার সামনে এসে অধির হয়ে বসে থাকেন। তিনি যেন পৃথিবীর সব খাবার কিনে আনার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আছেন। শুধু আমার মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা। পৃথিবীর সব ভালোবাসা যেন এই মানুষটার বুকে সঞ্চিত আছে। তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলেন-
__তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে শুধু একবার বল!
বাবাকে খুশি করার জন্য কিছু একটা তো বলা উচিত। অনেক ভেবে বের করলাম আমার করমচার আচার খেতে ইচ্ছে করছে। বাবা আধা ঘন্টার মধ্যে দুই কার্টুন আচার আনালেন। তবে শুধু করমচার আচার নয়। তেতুল জলপাই আম বরই খেজুর চালতা সব রকমের আচার। আমি চোখ কপালে তুলে বসে রইলাম। তবে সীমান্ত বাড়ি ফেরার আগেই আচারগুলো লুকিয়ে ফেললাম।
আমার জন্মদাতা পিতা, আমার আব্বুকে ছেড়ে এই ২২৭ কিলোমিটার দূরে থাকতে পারার বিশাল এই অবদান বাবার। তিনি কখনও আমাকে পুত্রবধূ নন, তার মৃত মায়ের স্থানটা দিয়েছেন। শুধু তিনি নন, বড় আব্বুর কাছেও আমি তার মা। তাই তো বিয়ের মুহূর্ত থেকেই গর্ভধারণ ছাড়াই আমি এই দুই পুত্রের মা হয়ে গেছি। এটা আমার জন্য বিশাল একটা গর্ব। বড় আব্বু বিদেশে থেকেই রোজ আমার খবর নেন। আমার খেতে না পারা নিয়ে তার কষ্টের সীমা নেই। অভুক্ত মাকে রেখে আমার দুই ছেলে যে ভালো করে খেতে পারে না এটা আমার জন্য খুব কষ্টের।

বমি হওয়া বন্ধ হবার পর থেকে আমার ডাকুরাজ বরের রাজত্ব চলছে। আদর টাদর নাই, তিনি ধমকে জোর করে খাওয়ান। তার হাবভাব দেখে মনে হয়, সে নিজে হাতে খাইয়ে দিলে তবেই যেন তার সন্তান পুষ্টি পাবে। আর আমি নিজে হাতে খেলে পুষ্টি উধাও হবে। আরেকটা বিষয় হলো, তার ধমকের ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, এই ধমকে এ টু জেড ভিটামিন বিদ্যমান। তাই বেবিকে সঠিক পুষ্টি প্রদানে এই ধমক অপরিহার্য। নানান ঠিকই বলেন, আমার বর আগে আধা পাগল ছিল, তবে ফুল পাগল হয়েছে আমি প্রেগনেন্ট হবার পরে।
আমার দুঃখ এরা কেউ না বুঝলেও নানান বুঝেন। তিনি আমাকে চুপিচুপি আচার খাওয়ান। আমি যখন আচার খাই তখন তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দেন। এসব আমার কাঠ তক্তা বর জানে না। জানলেই তো ডাক্তারি শুরু করে আচার খাওয়া পন্ড করবে। পৃথিবীর যেসব মেয়েদের ডাকাত মার্কা স্বামী আছে, তাদের সবারই এমন একজন নানান থাকা উচিত।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১৭)

যখন দু’জন মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয় তখন থেকে শুরু করে স্বপ্ন দেখা আর ফিউচার প্ল্যান শুরু হয়ে যায়। বিয়ের সময় আসার আগেই একই স্বপ্ন লক্ষবার দেখা হয়ে যায়। একই প্ল্যান লক্ষবার করাও হয়ে যায়। রিলেশন চলাকালীন প্রথম যেদিন সীমান্তকে বলেছিলাম আমার বেবি চাই এখনই। সে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে শুরু করেছিল। মূলত তাকে নার্ভাস করার লক্ষ্যেই কথাটা বলেছিলাম। তারপর একডজন বেবি চেয়ে তাকে নার্ভাস করা শুরু করলাম। একটাও বেবি নিতে যে মানুষটা রাজী নয় সে এক ডজনের কথা শুনে শেষমেশ একটা বেবি নিতে রাজী হলো। কিন্তু আমার তো এক ডজনই চাই। সে বলল, আমাদের বাচ্চার নাম ডজন রাখবো তাহলেই তো তুমি ডজনের মা হয়ে যাবে। কী বুদ্ধিমান স্বামী আমার! তারপর সেই একটামাত্র ডজনই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল। আমার একটা ছেলে হবে, যে অবিকল হবে তার বাবার মতো। আমি তার নামটাও তার বাবার নামের সাথে মিল রেখে ঠিক করে ফেললাম। বাবার নামের মিনিং আর ছেলের নামের মিনিং সেম। নামটাও সুন্দর। নামটা এখন গোপনেই থাকুক। তবে আমি তার আরেকটা নাম রাখলাম আমাদের দুজনের লুকিয়ে রাখা নামের সাথে মিল রেখে। আমি অনেক বছর আগে আমার ভেতরের মনের নাম রেখেছিলাম টুনি। সীমান্তর সাথে রিলেশন হবার পরে তার ভেতরের মনের নাম রাখলাম টুনা। আমাদের এই টুনা টুনির সাথে মিল রেখে আমাদের ছেলের নাম রাখলাম টুনটু পাখি। যে নামে শুধুই আমি তাকে ডাকবো। সীমান্তকেও টুনটু পাখির বাবাই বলে ডাকতাম। আমি চোখ বন্ধ করে দিনরাত আমার টুনটু পাখিটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এক সময় আমি রিয়্যালাইজড করলাম যে, আমি যেন সত্যিই মা হয়ে গিয়েছি আর আমার সেই অনাগত সন্তানের বাবা সীমান্ত। অথচ তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। তারপর একটা প্লাবণ এলো আর সব স্বপ্ন ভেসে গেল। মানুষটা বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছে। সন্তানের বিনিময়ে আমাকে হারাতে চায়নি। কী আজব ভালোবাসা তার! সীমান্তর মন জুড়ে সন্তানের স্বপ্ন আর নেই। কিন্তু আমি খড়কুটোর মতো আমার স্বপ্নটাকে খুব গোপনে বাঁচিয়ে রাখলাম। আমাদের বিয়ে হলো সংসার হলো, কিন্তু যখনই আমি বেবির জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছি তখনই সীমান্ত চুপসে গিয়েছে। দিনে দিনে আমিও থেমে গেছি। তাকে আর কখনও বলা হয়নি যে, আমি বেবি চাই এখনি! কিন্তু আমার টুনি মন খুব গোপনে সহস্রবার বলেছে “আমার টুনটু পাখিটাকে চাই।” একজন পুরুষ কখনও বাবা ডাক শুনবে না, এটা মেনে নিয়েও সে আমাকে ভালোবেসেছে। আমি স্বার্থপরের মতো কখনও তাকে বলিনি যে, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। আমার শুধু মনে হয়েছে সীমান্ত আমার শুধুই আমার। সে মরলেও আমার সাথেই মরবে আর বাঁচলেও আমার সাথেই বাঁচবে। আমাদের মাঝে আর কেউ ঢুকবে না। দরকার নেই আমাকে ছাড়া তার সুখী হবার। আমি সত্যিই বড্ড স্বার্থপর। আমার জীবন রক্ষার জন্য যে মানুষটা বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিতে পেরেছে, তাকে বাবা বানানোর জন্য আমি জীবন দিতে পারবো না, তা কী করে হয়? ভালো কী শুধু সে-ই বাসতে পারে? আমি পারি না? নিঃসন্তান নারীর সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো, সে মা হতে পারবে না এটা নয়। বরং সে তার স্বামীকে বাবা বানাতে পারবে না এটাই বড় কষ্ট।

গর্ভধারণের পরে যে কথাগুলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয় যেমন, ছেলে চাই নাকি মেয়ে চাই, সন্তানকে ডাক্তার বানাবো নাকি ইঞ্জিনিয়ার বানাবো, তার কী নাম রাখা হবে, সে দেখতে কার মতো হবে, কার বৈশিষ্ট্য পেলে ভালো হবে ইত্যাদি। এই সব কথাই আমাদের বিয়ের আগে কয়েকশ বার বলা হয়ে গিয়েছে। তখন আমাদের জীবনে একটা সন্তানের স্বপ্ন ছিল। এখন তাই আর এসব কথা বলা হয় না। বলতে ইচ্ছে করলেও সাহস পাই না। তবে এখন এমন কিছু হয় যেটা আমাদের বিয়ের আগে দেখা স্বপ্নের ভেতরে ছিল না। শরীর ঠিক নেই বলে চুল চিরুনি করতে ইচ্ছে করে না, শ্যাম্পু করতেও ইচ্ছে করে না। কাজল টিপ পরা তো অনেক দূরের কথা। ফ্যাকাশে এই চেহারা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ইচ্ছে করে না। মনে হয় এটা আমি নই। মামনি আমাকে শ্যাম্পু করিয়ে গোসল না করালে হয়তো আমার গোসল শ্যাম্পু কিছুই হতো না।

আমার বর একদিন চিরুনি হাতে আমার পাশে বসে বলল-
__মা হবার সাধ ছিল, হয়েছো। তাই বলে নিজের একটুও যত্ন করবে না?

__তুমিই তো আমাকে খাট থেকে নামতেই দাও না।

সে কিছু না বলে আমার পেছনে বসে চুল চিরুনি করতে শুরু করলো। আমি তো হতভম্ব হয়ে হা করে বসে রইলাম। হঠাৎ সে আমার চুলে নাক ডুবালো। আমি চোখ বন্ধ করে বললাম-
__গর্ভবতী বউয়ের চুলে নাক ডুবাতে নেই।

সে বিস্ময়ের স্বরে বলল-
__কেন?

আমি দুষ্টুমি করে বললাম-
__নেশা ধরে যাবে।

__নতুন করে কী আর নেশা ধরবে? এসব নেশার বশীকরণ তাবিজ করেই তো রেখেছো।

আমি অবাক হয়ে বললাম-
__কীসের নেশার বশীকরণ করেছি?

__চুলের ঘ্রাণের নেশা, হাসির শব্দের নেশা, চোখের চাহনির নেশা। আরও কত নাম না জানা নেশা।

__তাহলে তো আমি তান্ত্রিক হয়ে গেছি দেখছি।

__কবিরাজ তো আগে থেকেই ছিলে। বিয়ের আগে ফোনে দোয়া পড়ে ফু দিতে, মনে আছে? ডাক্তারকেও তুমি ঝাড়া দিতে ছাড়োনি ডাকাত মেয়ে।

আমি হাহা করে হাসলাম। সে সুন্দর করে চুল আচড়ে বেনিও করে দিলো। আমি এবার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে বললাম-
__এই তুমি বেনি করা শিখলে কার কাছে থেকে?

__গত সাত দিন ধরে ইউটিউবে বেনি করার ভিডিও দেখছি। চুল তিন ভাগ করে কার মধ্যে ঢুকিয়ে কোন দিক দিয়ে বের করলো সেটা বুঝতে আমার সাত দিন লেগেছে। আসলেই তোমরা মেয়েরা খুব পেঁচুক। তাই তো এমন কঠিন প্যাঁচ দিয়ে তোমরা চুল বাঁধতে পারো।

আমি হেসে বললাম-
__তুমিও তো মেয়েদের মতো পেঁচুক হয়ে গেছো দেখছি।

__বউয়ের জন্য বাধ্য হয়েই হতে হলো।

__এরপর সবাই তোমাকে বউ পাগল বলবে।

__যার যা ইচ্ছে বলুক।

__তুমি কী বউ পাগল?

__আমি বউ পাগল কী না জানি না, আমি শুধু জানি আমি আমার বউকে ভালোবাসি।

__আমি কিন্তু মোটেও বর পাগল না, বুঝলে?

__সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

কথাটা বলেই সে আমার বেনির ভাজে ভাজে কাঠগোলাপ গুজে দিলো। তারপর আমার কপালে ছোট্ট একটা টিপ পরিয়ে দিয়ে বলল-
__এমন সেজে থাকবে সব সময়। এখন চলো তোমাকে আকাশ দেখাবো।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-
__মানে?

সে আমার হাত ধরে বলল-
__চলো তো।

সে আমাকে ধরে ধীরে ধীরে ছাদে নিয়ে গেল। আমি আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে বিকেলের হালকা মিষ্টি বাতাসের গন্ধ নিলাম। এই বিকেলটা স্নিগ্ধ নয়, সীমান্ত বিকেলটাকে স্নিগ্ধ করে দিয়েছে। আচ্ছা সবার স্বামীই কী এমন করে বউকে ভালোবাসে? সব মেয়ের স্বামীই কী সীমান্তর মতো ভালোবাসার হিমালয়? সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছাদেই থাকলাম। সে আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো। বর সাহিত্য প্রেমী হলে এই একটা সুবিধা। আল্লাহ আমার কপালে সুবিধা লিখেছেন, কি আর করা!

সেদিন থেকে আমার বরের ডিউটি হয়ে গেল, আমার চুল বেনি করে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে তারপর ছাদে আকাশ দেখাতে নিয়ে যাওয়া। আর আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, তার বেনি করতে এতই ভালোলাগে যে, সে কম পক্ষে দশবার বেনি করবে আর খুলবে। শেষমেশ আমার কপালে আধা পাগল বর জুটলো আল্লাহ!


শুনেছি প্রেগনেন্ট হলে প্রতি মাসে চেকআপ করতে হয়। খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ পর পর করা যায়। তাই বলে প্রতিদিন চেকআপটা আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে। আমার ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির বাহিরে তানি আর আমান ভাইয়ের রাত্রিবাস নিষিদ্ধ করেছেন বাবা। ডাঃ তানিয়া রোজ রাতে আমাকে চেকআপ করে তবেই সে ঘুমায়। কতবার বলেছি, সপ্তাহে একবার করলেই তো হয়। কে শোনে কার কথা! বাড়িতে দুইজন ডাক্তার থাকলে সেই বাড়ির প্রেগনেন্ট অবলা মেয়েটার কী হাল হয় তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। স্বাস্থ্যকর আর অস্বাস্থ্যকর এর বিড়ম্বনায় আমার তো মাঝে মাঝে হাসফাস লাগে।

এদিকে আমার বর আমাকে বেড থেকে একা নামতে দিতে চায় না। সে অফিসে বেরিয়ে গেলে তবেই আমি একা একটু হাটাচলা করার সুযোগ পাই। তাও একটু জোরে হাটা যাবে না। নানুন সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখেন। এসব নিয়েই যেন বাড়িতে রোজ আমাকে ঘিরে উৎসব হয়। আমি অবশ্য এটা আগে থেকেই জানতাম। বংশের একমাত্র সন্তানের সন্তান আসতে চলেছে, উৎসব হওয়াটাই স্বাভাবিক। নানান তো ইদানিং বাহিরে যেতে ভুলেই গিয়েছেন। আমাকে রোজ নিয়ম করে জিজ্ঞেস করেন, “নড়াচড়া টের পাচ্ছো ছোট রাণী?”
আমি লজ্জা পাবার চেয়ে বেশি অবাক হই। তিন মাসে কী এমন নড়াচড়া হবে? কিন্তু নানানের যেন তর সইছে না। তার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, বাচ্চা আজকেই নড়ুক আর কালকেই ডেলিভারি হোক তবেই তার শান্তি। নড়াচড়া টের পাই না শুনে তিনি হতাশ চোখে চেয়ে থাকেন।

ভালোবাসার অনুভূতিগুলো সত্যিই অদ্ভুত। কাছের এই মানুষগুলোর এত ভালোবাসা, এত যত্ন ছেড়ে কোন মানুষটা মরতে চাইবে? তবুও মা হবার এই ভয়ানক ভাগ্য পরীক্ষায় আমরা মেয়েরা অবলীলায় দাঁড়িয়ে যাই। মা হবার সুপ্ত বাসনার কাছে মৃত্যুভয় যেন পরাজিত। কিন্তু সীমান্ত তার স্ত্রী হারানোর ভয়টাকে পরাজিত করতে পারেনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যখন দেখি স্বামী নির্ঘুম দুশ্চিন্তায় বিভোর হয়ে শুয়ে আছে, তার চোখদুটো ভিজে চুপসে আছে তখন যে ভয়টা পাই তা কিছুতেই পরাজিত করতে পারি না।
তার ইচ্ছের বাহিরে আমার এই মা হতে চলাটাকে সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। অথচ আমি ঘুমিয়ে গেলে সে আমার পেটে হাত রেখে তার সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে। চুপিচুপি চুমু খায়। আমি চুপচাপ ঘুমের ভান করে থাকি। তার এই প্রকাশ্য কষ্ট আর অপ্রকাশ্য সুখের রহস্যটা আমি আর সে ছাড়া কেউ জানে না।

পরের পর্ব আসছে…
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here