ভালোবাসার প্রান্ত,১৮,১৯
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-১৮)
আকাশ জুড়ে আজ মেঘের ঘনঘটা। কখন যেন হুড়মুড়িয়ে ঝড় বৃষ্টি নামে। মেঘের গর্জন আর বিজলির ঝলকানি সেটারই জানান দিচ্ছে। সীমান্ত বেলকোণ বারান্দায় বসে আছে। বাহিরের বজ্রপাত সবাই শুনতে পেলেও তার মনের ভেতরের বজ্রপাত আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না। তবুও আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছি না।
সাত মাসের শেষের দিক থেকেই হাটাচলা করতে ভীষণ কষ্ট হয়। শুয়ে থেকে পাশ ফিরতেও পারি না একা। আজ সাত মাস শেষ হলো। কাল থেকে আটমাস শুরু হবে। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট এসেছে। আর এটাই আমার স্বামীর বিষণ্নতার কারণ। বেবি সুস্থ আছে তবে পজিশন ঠিক নেই। আমার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। বেবি নরমাল ডেলিভারি হবে না। সিজারিয়ানে আমার ব্লাড লাগবে। সীমান্ত প্রথম থেকেই টেনশনে ছিল। আর এসব তো হবারই ছিল। তবুও আমি দিনরাত তাকে বুঝিয়েছি যে, উপরে আল্লাহ আছেন। তিনি সব ঠিক করে দেবেন। আসলে অন্য প্রফেশনের মানুষগুলোকে যতটা সহজে বোঝানো যায় ততো সহজে কোনো ডাক্তারকে বোঝানো যায় না। তার উপরে সীমান্ত সার্জারীর ডাক্তার। তাকে বোঝাতে গেলেই উল্টে রেগে যায়। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে বলেছি।
আমি খুব কষ্টে একপা দু’পা করে বেলকোণ বারান্দায় তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়েও সে আমার দিকে তাকালো না। বিজলির আলোতে তার ভেজা চোখ দেখতে পেলাম। আমি আস্তে করে তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে একটু নড়ে উঠলো। দু’জন বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করার পর আমি বললাম-
__রুমে চলো ঘুমাবে।
সে আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো-
__এখানে ঠান্ডা বাতাস বইছে, তুমি এখানে কেন এসেছো? রুমে যাও।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__চলো একসাথে যাব।
সে নির্লিপ্ত ভাবে বলল-
__আমি এখানেই থাকবো সারারাত।
বাহিরের ঝড় শুরু হতে চলেছে। কিন্তু আমার ভেতরে তীব্র ঝড় শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। ভেতরের সেই ঝড়ের প্রতিক্রিয়ার বৃষ্টি আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে চাইছে বারবার। বললাম-
__এমন করে আমাকে শাস্তি দিও না প্লিজ! আমি আর নিতে পারছি না।
সে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__শাস্তি কে কাকে দিচ্ছে? জীবনে এই ঝুঁকিটাকে ইনভাইট করে না আনলে কী তোমার চলছিল না সোনাবউ?
আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম-
__পৃথিবীতে সব কিছুতেই ঝুঁকি আছে। তুমি সুখী হতে চাইলে কষ্টের ঝুঁকিও নিতে হবে তোমাকে।
__আমি কী তোমায় নিয়ে সুখী নই যে আমাদের বেবি নিতেই হবে?
আমি উদাসীন সুরে বললাম-
__আমি হয়তো শুধু তোমাতে সুখী ছিলাম না তাই বেবি নিয়েছি।
সে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__কী অপূর্ণতা রেখেছি তোমার জীবনে? আজ পর্যন্ত তো মুখফুটে কিছু চাওনি, তাই বলে কী আমি দিইনি? বাচ্চাটাই শুধু দিতে চাইনি। মুখফুটে কিছুই চাওনা বলেই জোর করে বাচ্চা নিলে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম-
__যা হবার হয়ে গেছে। বাকীটা ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দাও!
সে চিৎকার করে বলল-
__কতটা সাধনায় তোমাকে জীবনে পেয়েছি তা আর কেউ না জানলেও তুমি তো জানো। জানো না? এখন একটা সন্তানের জন্য যদি তোমাকে হারাই তাহলে আমি বাঁচবো কী করে?
আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম-
__বাঁচতে হবে। আমার টুনটু পাখির জন্য বাঁচতে হবে তোমায়।
__তোমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন যে, মা হবার উপযোগী ছিল না তা আর কেউ না জানলেও তুমি আর আমি জানতাম। কেন এমন করলে সোনাবউ, কেন?
আমি বারান্দার গ্রীলে হাত দিয়ে দূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে বললাম-
__বাড়িতে সবার খুশিমাখা মুখগুলো কী তোমার চোখে পড়ে না? সবাই কত্তো খুশি!
__তোমার কী ধারণা, তুমি না থাকলে তাদের মুখগুলো এমন খুশিমাখা থাকবে?
__কেন এত ভয় পাচ্ছো সাহেব? আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
সে তীব্র অভিমান নিয়ে বলল-
__সহমরণে যাবার শপথ করেছিলে। মিথ্যাবাদী একটা!
আমি চুপ করে রইলাম। সে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__মনে রেখো, তোমার যদি কিছু হয় তবে আমি ওখানেই নিজেকে শেষ করে দেবো। কারণ আমিও সহমরণে যাবার শপথই করেছিলাম। আর আমি তোমার মতো মিথ্যা বলি না। মিথ্যা আশ্বাস দিই না আমি।
আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম-
__চলো এখন ঘুমাবে।
সে দৃঢ় স্বরে বলল-
__না।
__ঠিক আছে আমিও এখানে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবো। তোমার বাচ্চাও কষ্ট পাক। তারও তো কষ্ট পাওয়া উচিত! বাবা মা কষ্ট পাবে আর সে পাবে না তা কী করে হয়?
বিজলির আলোতে এক ঝলকে দেখলাম সে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। করুণ সুরে সে বলল-
__তোমায় ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। তুমি আমার অনেক বিরহ ব্যাথা আর যন্ত্রণার ভালোবাসা। তোমাকে জীবনে পেতে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে। আমার সেই সাধনার ভালোবাসা পৃথিবীতে নেই, এটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই সোনাবউ।
তুমি আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম ভালোবাসা। জীবনের সব সঞ্চিত ভালোবাসা তোমাকে দিয়েছি। একফোঁটাও এদিক ওদিক ছিটিয়ে নষ্ট করিনি। সেই আগলে রাখা ভালোবাসা হারিয়ে গেলে আমি বেঁচে থাকবো কী করে? আমি মরে যাব, মরে যাব।
কথাগুলো বলতে বলতে সে শব্দ করেই কেঁদে ফেললো। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার কাঁন্না যে আমার জন্য কত বড় শাস্তির তা হয়তো সে জানেই না। তাকে কেমন করে বোঝাবো যে, সেও আমার অনেক তপস্যা অনেক প্রার্থনার ভালোবাসা। সে আমার সুখের চেয়েও যে বড় অসুখ। যে অসুখ কখনও সারবার নয়। তাই তো তাকে ছাড়া আমি শ্বাস নিতে পারি না। তাকে ছাড়া একটা রাত কোথাও গিয়ে থাকতে পারি না। সেই আমিটা তাকে ছেড়ে পৃথিবীর বাহিরে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছি। রিলেশনের শুরু থেকেই তাকে একটা কথাই আমি সহস্রবার বলে এসেছি, “আমি তোমার জন্য সব করতে পারি। সব মানে সব।” এই “সব” এর মধ্যে যে মরণ নামক ব্যাপারটাও আছে। পৃথিবীর সবার কাছে অপ্রকাশিত হলেও আমি তো জানি যে, বাবা হতে না পারার আক্ষেপটা তার হৃদয়ে কতটা গভীর ক্ষত করে রেখেছে। পাগল ছেলে এসব আমার থেকে লুকিয়ে রাখে। তার হৃদয়ে যে, আমার ঘর বসতি, আমার ঘর বসতিতে ক্ষত থাকবে আর তা আমি জানতে পারবো না সেটা কী করে হয়? তাকে কখনও বলতে পারিনি, “তোমায় যেদিন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই আমার মনের জোর এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, তোমায় ভালোবেসে হাসতে হাসতে আমি হেমলোক পান করতেও পারবো।”
এই কথাগুলো না হয় চিরকাল তার অজানাই থাকুক। এমন কতশত অনুভূতি অঙ্গিকার সব তো অপ্রকাশ্যই রেখেছি।
বাহিরে ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি সীমান্তর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলাম।
⭐
গত সাতদিন ধরে সীমান্ত অফিসে যায় না। বিগত কয়েকমাস ধরে সে যা ফাঁকিবাজ হয়েছে তাতে ছুটি নিতেই পারে। আমি প্রেগনেন্ট হবার পর থেকেই সে ঘনঘন ছুটি নেয়। তাই ছুটি নিয়ে কিছু মনে করি না। তাই বলে টানা সাতদিন ধরে সে ছুটি নেবে এটা অভাবনীয়। সাতদিন আমি তাকে ছুটি নিয়ে কিছুই বলিনি। কিন্তু সাত দিন পেরিয়ে গেলেও তার অফিস যাবার কোনো নামই নেই। খুব করে ধরার পরে বলল সে দুই মাসের ছুটি নিয়েছে। এটা নিয়ে সন্ধ্যায় কফির আসরে নানান শুরু করলেন।
__শুনেছি চাকরিজীবী মহিলারা মাতৃকালীন ছুটি পায়। কিন্তু চাকুরিজীবী পুরুষরা যে পিতৃকালীন ছুটি পায় তা আমার জানা ছিল না।
সীমান্ত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল-
__এটা নতুন নিয়ম শুরু হয়েছে ২০২০ সাল থেকে। তবে এটা শুধুই সীমান্তর জন্য।
নানান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন-
__কপাল করে একটা বর পেয়েছো ছোট রাণী। হিন্দু ধর্মে নাকি বর দান করে, এ হলো তোমার সেই বর।
সীমান্ত বলল-
__আপনার এত জ্বলছে কেন?
__দিনরাত আমার ছোট রাণীর আশেপাশে ঘুরঘুর করছো বখাটে ছেলেদের মতো আর আমার জ্বলবে না?
সীমান্ত কপট রাগ দেখিয়ে বলল-
__কিহ আমি বখাটে ছেলের মতো ঘুরছি?
__হ্যাঁ
__হ্যালো স্যার, এটা আমার বিয়ে করা বউ। অসংখ্যবার তাকে বিয়ে করেছি, তাই সে অনেক স্পেশাল।
__ছোট রাণী তোমার বর তো দেখছি কাঠ থেকে আখ হয়ে গেছে। বলি, এত রস এলো কোথায় থেকে? বউ প্রেগনেন্ট হলে বুঝি বরদের রস বেড়ে যায়?
__আপনিও আমার মতো রসালো হতে চান?
__অবশ্যই চাই।
__একদম ইজি, আপনিও আপনার বউকে প্রেগনেন্ট করে ফেলুন। আর হ্যাঁ, এবার কিন্তু টুইন চাই। কারণ আমার একটা খালা আর একটা মামা চাই। আপনার পিতৃকালীন ছুটির ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। অবশ্য টুইন এর পিতা হিসেবে আপনাকে চার মাস ছুটি দেয়া হবে। আপনি তখন বখাটে ছেলেদের মতো আপনার বউয়ের পিছে পিছে ঘুরঘুর করবেন।
নানান বিষম খেয়ে বড় বড় চোখে তাকালেন। সীমান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিলো, যেন সে কিছুই বলেনি। নানান আর জবাব দিলেন না।
নানান লাজুক মুখ করে বললেন-
__তাহলে তোমার নানুনকে রাজী করাও। আমার তো আপত্তি নেই।
সীমান্ত নানানের কথা শুনে কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল।
⭐
আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ফোন টিপছি। সীমান্ত সোফায় বসে মেইল চেক করছে ল্যাপটপে। অনেক ইতস্ততা নিয়ে বললাম-
__একটা কথা বলি?
সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল-
__বলো
__আম্মু আজ ফোন করে বলল, তারা কবে নিতে আসবে!
__এসময়ে নিতে আসবে মানে?
__এসময়ে সব মেয়েরাই বাপের বাড়িতে যায় তারপর বেবি হবার পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আনুষ্ঠানিক ভাবে গিয়ে বেবিসহ মাকে নিয়ে আসে।
সীমান্ত এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
__কেন, খুলনায় কী হাসপাতাল ক্লিনিক ডাক্তার এসব নেই? বেবি হতে নাটোরে কেন যেতে হবে?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম-
__তা কেন হবে? সব মেয়েরাই তো যায় তাই বললাম।
__এটা কী নাটোরের রীতি?
__হ্যাঁ
__খুলনায় এমন রীতি নেই। আর যদি থেকেও থাকে তবুও সেই রীতি ক্যান্সেল।
__কেন?
__বুঝতে পারছো না কেন? তোমার শরীরের কন্ডিশন নিজে তো বুঝতে পারছো। আর আমার পক্ষে তো এতদিন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকা পসিবল না। আর তোমাকেও আমি একা রাখতে পারবো না। এই যে দুই মাস ছুটি কী এমনি এমনিই নিয়েছি?
আমি চুপ করে রইলাম। সে বলল-
__বিয়ের পর থেকে কখনও তোমাকে নাটোরে যেতে বাঁধা দিইনি। যখন যেভাবে যেতে চেয়েছো সেভাবেই নিয়ে গিয়েছি। কন্সিভ করার পরে জার্নি করলে ক্ষতি হবে তাই এতদিন যেতে দিইনি। আর এখন তো পরিস্থিতিই অন্য রকম। প্লিজ মন খারাপ করো না!
আমি জবাব দিলাম না। সে বলল-
__কালকেই আমি আব্বু আম্মুকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো। তারা কয়েকদিন এখানে থাকলে তোমার ভালোলাগবে। আর বড় আব্বু, বড় আম্মু, আপিও তো সামনের সপ্তাহে আসছেন। তোমার আর একা অনুভব হবে না।
আমি জানি সে আমাকে নিয়ে এক বিন্দুও রিস্ক নিতে পারবে না। প্রতিটা মেয়েই তাদের এই আনন্দ আর আশঙ্কা মিশ্রিত সময়টাতে সারাক্ষণ স্বামীকে পাশে চায়। আমি মুখ ফুটে চাইবার আগেই সীমান্ত সেটা আমাকে দিয়েছে। শুধু এই বিষয়েই নয়, কোনো কিছুই তার কাছে আমার মুখ ফুটে চাইতে হয়নি।
গর্ভকালীন সময়টা হলো প্রতিটা নারীর জন্যই দূর্যোগকালীন সময়। প্রতিটা গর্ভবতী নারীই এই সময়ে মনে করে তারা হয়তো ডেলিভারির সময় আর বাঁচবে না। অনেক নারী সত্যিই বেঁচে ফিরে আসে না। যারা বেঁচে ফিরে আসে তারাও মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েই থাকে। এমন আশঙ্কা আমার মনেও আছে। যদিও আমি ভুলেও তা প্রকাশ করি না। কিন্তু সীমান্তর চোখমুখে সেই ভয় আর আশঙ্কা সুস্পষ্ট। দিন যত যাচ্ছে তার ভয় ততই বাড়ছে। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে সে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাই না। বুঝতে পারি তার যত্ন আর আগলে রাখাটা শুধুই ভালোবাসা নয়, হারানোর একটা বিশাল ভয়ও।
পৃথিবীতে কতগুলো সৌভাগ্যবতী নারী আছে তা আমি জানি না। তবে নিঃসন্দেহে আমি একজন সৌভাগ্যবতী নারী।
পরের পর্ব আসছে…
Written by- Sazia Afrin Sapna
“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১৯)
আমার টুনটু পাখির বাবাই সোনা,
আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ কারণ তুমি সীমান্ত। তোমার জন্যই আমি সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি। কতটা নির্মল শুভ্র এই বেঁচে থাকা। কয়জন নারী এমন সীমান্তময় ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে বলো? সেই সৌভাগ্য নিয়ে আমি এসেছি। এরচেয়ে বড় স্বার্থকতা আমার জীবনে আর নেই। এই স্বার্থকতা আমি কখনও বিশ্লেষণ করে বোঝাতে পারবো না।
প্রথম প্রেমের অনুভূতির কথা তোমার মনে পড়ে সাহেব? আমার তো খুব পড়ে। সারাক্ষণ তোমার ভাবনায় মগ্ন থেকে কতদিন যে চা পুড়িয়ে ফেলেছি তার হিসেব আমার কাছেও নেই। কী অদ্ভুত সুখের এক অনুভূতি। থেমে থেমে মনে শিহরণ জাগিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে। সারাদিন তোমায় নিয়ে ভেবে ভেবে কখনও না ক্লান্ত হয়েছি, না বোর হয়েছি। ভালোলাগাটা যেন সেই প্রথম দিনের মতোই থেকে গিয়েছে। আর কতশত সহস্রবার যে ঘুরে ফিরে তোমার প্রেমেই পড়েছি তার হিসেব নেই।
জীবনের অনেক কঠিন সময় আমি পার করেছি। তখন আমাদের প্রেম চলছিল খুব গোপনে, কোনো কারণে আম্মু যখন আমাকে বকতো বা কেউ কিছু বলতো তখন তোমাকে ফোন করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেটে কেজি কেজি চোখের জল ফেলে অভিযোগের ডালি নিয়ে বসতাম। আমাকে কেউ বকলে বা দুটো কটু কথা বললে তুমি সহ্য করতে পারতে না, হোক সেটা আমার বাবা মা। তুমি প্রকাশ না করলেও তোমার টুনা মন চেঁচিয়ে বলে উঠতো, “আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কটু কথা বলার রাইট কারোর নেই। সে শুধুই আমার। আমি তাকে বকবো, রাগ দেখাবো, অভিমান করবো, কষ্ট দেবো। আবার আমিই তাকে আদর ভালোবাসায় সব ভুলিয়ে দেবো।”
তোমার এই অপ্রকাশ্য কথাগুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, এই পৃথিবীতে সবাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে একজন আছে, যে কখনও আমার দিক থেকে কোনো কারণে কোনো পরিস্থিতিতেও মুখ ফিরিয়ে নেবে না। যার মনের পৃথিবীর সবটা আমার দখলে। যার জীবনটা আমিময়। যে শত ব্যস্ততার ভীড়েও আমার কথা ভেবে উদাস হয়। যে আমার এতটুকু অসুস্থতার খবরে অস্থির হয়ে যায়। যার বন্ধ চোখের আঙিনায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
জানো সাহেব, এই বিশ্বাস ভরসা আর আস্থা আমাকে সব লড়াইয়ে জিতিয়ে দিয়েছে, আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি যখনই ভেঙে পড়তে চেয়েছি ঠিক তখনই তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়েছো। সেই তুমিটাকে ছাড়া আমার জীবনের একটা মিনিটও নেই। কিন্তু জীবনের এই বড় রিস্কটা আমাকে নিতেই হতো। প্রথমত আমি তোমাকে একটা সন্তান উপহার দিয়ে তোমাকে বাবা হবার স্বাদ অনুভব করাতে চাই। দ্বিতীয়ত, তোমার এই বিশাল রাজ্যে একটা রাজপুত্র দরকার। যে বংশের দীপ হয়ে জ্বলবে। খুশি আনন্দে ভরিয়ে দেবে বাবা আর মামনির জীবন। এর জন্য যদি আমি মরেও যাই তবুও আমি খুব আনন্দিত। তোমার সাথে কাটানো অল্প কয়েকটা বছরকে আমি অপ্রকাশ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলাম। এই সুখের দিনগুলোর অনুভূতি নিয়েই আমি হাসিমুখে পৃথিবী ছাড়বো।
আমার গর্ভে তোমার সন্তান বেড়ে উঠছে তোমার বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সে দেখতে হবে অবিকল তোমার মতো। তোমার চোখ, তোমার নাক, তোমার ঠোঁট, তোমার চুল, সব অবিকল তোমার মতো হবে। তাই তো তার এমন একটা নাম রেখেছি যে নামের অর্থ আর তোমার নামের অর্থ একই।
সে আমার কিছুই পায়নি বা পাবে না বলে, আমার কিঞ্চিত আফসোস নেই। কারণ আমি সবসময় চেয়েছি সে তার বাবার মতো হোক।
তোমার মতোই সে কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকবে। তার মন চাইবে তার মায়ের গল্প তোমার থেকে শুনতে। কিন্তু তোমাকে সেটা মুখফুটে বলতে পারবে না। তুমি আমার ছেলেটার মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করবে কিন্তু। তাকে তার ডাকুরানী বখাটে মায়ের সব গল্প রোজ একটু একটু করে শোনাবে। সব গল্প শেষ হবার পরেও তার মন আবার প্রথম থেকে তার মায়ের গল্প শুনতে চাইবে। তুমি তাকে আবার প্রথম থেকে শোনাবে। মানুষ প্রিয়জনের গল্প বারবার শুনতে চায়। শতবার শুনে মুখস্ত হয়ে যাবার পরেও শোনার তৃষ্ণা থেকেই যায়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
সাবধান! গল্প শোনানোর সময় তোমার চোখে যেন জল না আসে। তাহলে সে আর গল্প শুনতে চাইবে না, কারণ পৃথিবীর কোনো সন্তানই বাবার চোখের জল সহ্য করতে পারে না। তোমার কাঁন্নার কারণে সে তার মাকে জানতে না পারার আক্ষেপ তার ভেতরে পুষে রাখবে। হয়তো ভাবছো, এসব ভবিষ্যৎ আমি কেমন করে জানলাম? এই প্রশ্নটা যে কেউ করবে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই, নেই কোনো ব্যাখ্যা। তবে আধ্যাত্মিক বলেও কিছু একটা হয়। যেটার জোরে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আমি তোমার মন পড়ে এসেছি। প্রথম প্রথম তো তুমি ভীষণ অবাক হতে। তোমার না বলা কথা আমি নিখুঁত ভাবে বলছি কী করে এটা নিয়ে তোমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বারবার আমাকে প্রশ্ন করতে, আমি তোমার মনের কথা জানলাম কী করে। আমি বরাবরই বলে এসেছি, সব আমার টুনি মন বলে দেয়। আজকেও সেটাই বলছি সাহেব। আমার রাজপুত্তুরকে নিয়ে বলা ভবিষ্যৎ কথাগুলো আমার টুনি মন বলেছে। আমাদের ভালোবাসাও যে ঐশ্বরিক ছিল তা তোমার অজানা নয়। তার অসংখ্য প্রমান তোমার আমার কাছে আছে। এসব তুমি আর আমি ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না, করার দরকারও নেই। আর ওসব আমি কখনও প্রকাশ করতেও চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, দক্ষিণ বঙ্গের সীমান্ত আর উত্তর বঙ্গের এই আমিটার মিলন আধ্যাত্মিক ভাবেই হয়েছে।
তোমাকে রাগানোর জন্য অনেকবার বলেছি, আমার ছেলেকে ডাক্তার বানাবো না। তাকে নায়ক বা গায়ক বানাবো। তুমি বারবারই বলেছো, তোমার ছেলেকে তুমি ডাক্তারই বানাবে। আজ বলছি, আমাদের ছেলেটাকে তুমি তোমার মতো সৎ ডাক্তার বানাবে। সে যেন তোমার মতোই অসহায় দরিদ্র মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেও যেন তার বাবার মতো রোজগারের সব টাকা অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দেবার মানুষিকতা নিয়ে বড় হয়।
জানো সাহেব, তোমার সাথে আমার হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে। সূর্যটাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর সব ঘড়িগুলো নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করে, যেন সময় আমাদের জন্য একজায়গায় থেমে থাকে। তা তো বাস্তবিক ভাবে সম্ভব নয়। ইচ্ছে ছিল দারুণ একটা প্রবীণ জীবন হবে আমাদের। আমরা ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে হৈহৈ করে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে একসাথে সহমরণে যাব। যেন একজনের মৃত্যু আরেকজনকে কষ্ট দিতে না পারে। আসলে ভাগ্য বড্ড বেঈমান তাই মনের স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা গুলো অপূর্ণই থেকে যায়। জীবনটা কেন আমার লেখা গল্পগুলোর মতো সাজানো গোছানো হয় না? কেন গল্পের মতো চাইলেই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া যায় না? কেন সাহেব?
আমি আল্লাহর কাছে এতগুলো বছর ধরে প্রার্থনা করেছি যে, আমি আমার স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে চাই। সেই প্রার্থনা যদি কবুল হয়ে থাকে তবে আমি নিশ্চয়ই তোমার বুকে আবার ফিরে আসবো। তারপর কোনো এক শুভক্ষণে আমরা একসাথে পৃথিবী ছাড়বো। আর যদি ফিরে আসতে না পারি তবে ক্ষমা করে দিও তোমার সোনাবউকে।
__তোমার টুনটু পাখির মা
চিঠিটা ভাজ করে আমার ডায়েরির ভেতরে রাখলাম। আমি জানি সীমান্ত একদিন ঠিক এই ডায়েরিটা দেখবে। যদি ভাগ্য আমাকে ফিরিয়ে আনে তবে সে দেখার আগেই চিঠিটা ছিড়ে ফেলবো। আর যদি ফিরে না আসি তবে আমার টুনটু পাখির জন্য এই চিঠিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মনটা খুব বিচলিত আজ। শরীরটাও ঠিক লাগছে না। ডেলিভারির ডেট আসতে আরও দশ দিন বাকী আছে। এখন রাত বারোটা বাজে, সীমান্ত অল্পক্ষণেই রুমে আসবে। ইচ্ছে করছে আজ না ঘুমিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটা রাত পার করে দিই। কিন্তু আমার রাগী ভদ্রলোক বর সেটা কিছুতেই মানবে না।
⭐
রাত দুইটায় আমার হালকা ব্যাথার অনুভবে আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সীমান্ত ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সীমাহীন মায়া উপছে পড়তে শুরু করলো। তাকে ডাকতে বুক কেঁপে উঠছে। অন্য কাউকেও এতরাতে ডাকতে বিবেকে বাঁধা দিচ্ছে। ব্যাথা বাড়ছে, আমি আর শুয়ে থাকতে পারছি না। যেন আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে শুয়ে থাকতে। বিছানা থেকে খুব কষ্টে নামলাম। মেঝেতে হাটাহাটি করছি। এতে একটু ভালো লাগছে। ডেলিভারির ডেট আরও দশদিন পরে, তাহলে এমন করে পেটব্যাথা কেন করছে? এটা লেবার পেইন কী না বুঝতেও পারছি না। ঘুমন্ত সীমান্তর দিকে তাকালাম। কেমন শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে সে। মুখটাকে বড্ড নিষ্পাপ আর পবিত্র লাগছে। পেটব্যাথা থেমে থেমে খুব চাড়া দিয়ে উঠছে। তাকে ডাকতে মন চাইছে না কিছুতেই। অনেকদিন হলো মানুষটা ঠিকমতো ঘুমায় না। সারাক্ষণ আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে তটস্থ থাকে। আমাকে হারিয়ে ফেলবে সেই ভয়ে সে বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিয়েছিল সেই বিয়ের আগেই। আমাদের রিলেশন চলাকালীন আমি একবার অসুস্থ হয়েছিলাম। কিছু টেস্ট করানোর পর সেই রিপোর্ট গুলো সীমান্তই দেখেছিল। গর্ভধারণে আমার জীবনে ঝুঁকি আছে। আর বেবিটাও সুস্থ হয়ে জন্ম নেবার সম্ভাবনা খুব কম। এসব কিছু জানার পরে সে বাবা হবার স্বপ্নটাকে বলি দিয়ে দিলো। শুধু এই কারণেই সে আমার এই গর্ভধারণকে মেনে নিতে পারেনি। বিগত নয়টা মাস ধরেই সে দিনরাত আতঙ্কিত থাকে। হয়তো প্রথম দিন থেকেই সে আমার জীবনের শেষ প্রহরটা গুনে চলেছে।
আমি বেলকোণ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রুমের ভেতরে হাটাহাটি করলে তার ঘুম ভেঙে যাবে। রাতটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও, লাইট এর আলোতে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিরব নিস্তব্ধ শহর। এখানে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া পর্যন্ত আমাকে যেমন করেই হোক অপেক্ষা করতে হবে। আমি কী তবে জীবনের শেষ সকালটা দেখতে চলেছি? সত্যিই যদি আমি আর ফিরে না আসি তবে ঐ মানুষটাকে বাকী জীবন কে সামলাবে? সে কী নিজের খেয়াল রাখতে পারবে? রাখতে পারলেও রাখবে না জানি। তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দেবে। হে আল্লাহ জীবনে স্বামীর ভালোবাসা যখন এত উড়ার করেই ঢেলে দিলে আমার জীবনে, তবে আয়ু এত কম দিলে কেন?
পরের পর্ব আসছে…
Written by- Sazia Afrin Sapna