ভালোবাসার প্রান্ত,২০,২১
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-২০)
পনেরো মিনিট ধরে বারান্দায় হাটছি আর ভোর হবার প্রহর গুনছি। ব্যাথা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। কী তুচ্ছ মানুষের জীবন! আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি অথচ কাল কোথায় থাকবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আজ আমার পাগলটা শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে কাল এই সময়ে আমিহীন সে কেমন পাগলামি করবে তা আল্লাহই জানেন। আমিই বা তাকে ছেড়ে কেমন করে থাকবো? মরণের পরের জগৎটা কেমন হয়? সেখানে গিয়ে কী আমার এই ভালোবাসা মাখা মধুর স্মৃতিগুলো মনে থাকবে? আমি চাইলেই কী আমার টুনটু পাখিকে দেখতে পাবো? চাইলেই কী সীমান্তর স্বপ্নে এসে রোজ তাকে ছুঁয়ে দিতে পারবো?
আর ভাবতে পারছি না, আমার বুকটা চেপে আসছে।
__এতরাতে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন সোনাবউ?
সীমান্তর কথায় চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালাম। সে উৎকন্ঠা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নির্বাক থাকলেও আমার পেটব্যাথা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে যা আমার চোখেমুখে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ফেলেছে অলরেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বলল-
__তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? কী হয়েছে বলো? চুপ করে কেন আছো?
তার অসহায় চাহনি আর অস্থিরতা আমার গলার স্বর আটকে দিলো। কেমন করে বলবো যে, আমার ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে? শুনেই তো সে ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু বলতে তো হবেই। তবুও আমি বলতে পারছি না।
সে আরও অস্থির হয়ে বলল-
__চুপ করে আছো কেন? বলো কী হয়েছে? আমার টেনশন হচ্ছে অস্থির লাগছে সোনাবউ। প্লিজ চুপ করে থেকো না!
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__আমার পেটব্যাথা করছে সাহেব।
সে ভীত চোখে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল-
__কিহ? এতক্ষণ আমাকে ডাকোনি কেন? কখন থেকে ব্যাথা শুরু হয়েছে?
আমার এতটাই হাসফাঁস লাগছে যে, না দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি, না কথা বলতে পারছি। এতক্ষণ অবশ্য এতটা খারাপ লাগেনি। স্বামী বড্ড বিস্ময়কর জিনিস, এতটাই ভরসার স্থান এটা যে, তার সামনে পৃথিবীর সব স্ত্রী যেন অবলীলায় আহ্লাদে রোগী হয়ে যায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। তার আদরেই যেন আমি স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে গেলাম মুহূর্তের মধ্যেই। এজন্যই আমি বারবার বলি, “তুমি আমার সুখের চেয়েও বড় অসুখ রাজাসাহেব।”
হঠাৎ মনে হলো, যেসব স্ত্রীরা স্বামী সোহাগী নয় তারা এই ব্যাথামাখা সুখের স্বাদ থেকে চির বঞ্চিত। তারা কখনও হয়ত জানেই না যে, সুখের চেয়েও বড় অসুখের সুখটা আসলে কেমন হয়।
সীমান্ত আমাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সবাইকে খবর দিলো। নাটোরেও খবর পাঠানো হয়েছে। তারা আসছে। বাড়িতে এক রকম হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছে। সবাই কেমন অস্থির চোখমুখ নিয়ে ছুটাছুটি করছে। মামনি আমাকে ভরসা দিয়ে চলেছেন। আর সীমান্ত একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। যেখানে যা ফোন করার সব বাবা আর নানান করছেন। সীমান্তর যে মাথা কাজ করছে না তা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। আমি তার হাত ধরে বললাম-
__একটুও টেনশন করো না। আমি ঠিক ফিরে আসবো। স্বর্গের মতো আমার এই ঘর ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলো তো?
সীমান্ত কিচ্ছু বলল না। শুধু টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি ম্লান হেসে বললাম-
__এই পাগল ছেলে, তুমি না ডাক্তার! ডাক্তার কখনও এত ভীতু হয়?
এবারও সে কিচ্ছু বলল না। কিন্তু তার টুনা মন যেন বলে উঠলো, “ডাক্তারদেরও একটা দূর্বল স্থান থাকে। সেই স্থানে আঘাত লাগার ভয়ে তারাও আতঙ্কিত থাকে। এসব তুমি বুঝবে না সোনাবউ।”
আমি তার টুনা মনের সব কথা কী করে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মানুষটা বাহিরে যতটা কাতর হয়ে আছে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভেতর ভেতর কাতর হয়ে আছে। তাকে সান্ত্বনা দেবার যুক্তিযুক্ত ভাষা আপাতত আমার কাছে নেই। ব্যাথায় আমার সবকিছুই এলোমেলো লাগছে।
মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। অলরেডি কল করে ওটি রেডি করতে বলা হয়েছে। আমাকে এখন ওটিতে ঢুকানো হবে। এরপর কথা বলার আর সুযোগ নেই। সীমান্তর অস্থিরতা কেউ থামাতে পারছে না। বাবা মামনি নানান নানুন বড় আব্বু বড় আম্মু আপি কেউই যেন তাকে সামলে উঠতে পারছে না। জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক এবং করুণ মুহূর্তে আছি আমি। নিজের জীবনের আশঙ্কার চেয়ে স্বামীর এই করুণ অসহায় পরিস্থিতি আমাকে চুরমার করে ফেলছে। আমি খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক করে তাকে আমার কাছে ডাকলাম। আমার ডাক্তার স্বামী রাজ্যের ভয় আতঙ্ক সব চোখেমুখে মেখে নিয়েছে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। সে আমার দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে থাকতেই পারছে না। চোখের জল মুছতে মুছতেই যেন সে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে আমি যেন গভীর ভাবে উপলব্ধি করছি, আমি যদি সত্যিই ফিরে না আসি? আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠলেও আমি তা ভেতরেই রাখলাম। ব্যাথায় আমার চোখমুখের অবস্থাও ভালো না। সে একটা হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরলো। আরেকটা হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে চলেছে। আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-
__একদম শান্ত হয়ে যাও। আমার কিচ্ছু হবে না পাগল ছেলে।
যদি ফিরতে না পারি সেক্ষেত্রে যে তাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যাব সেই সাহসও নেই আমার।
সে কাঁন্নায় ভেঙে পড়ে কোনো কথাই বলতে পারলো না। আমি তার চোখ মুখ নাক ঠোঁট হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বললাম-
__আমি যাচ্ছি সাহেব।
সে চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল-
__যাচ্ছি মানে? কতদিন না বলেছি, যাচ্ছি বলবে না? বলো, আসি।
আমি নির্বাক তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল-
__আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও তুমি ফিরে আসবে! তুমি কিন্তু শপথ করেছিলে যে, আমরা সহমরণে যাব। এখন কথা দাও!
বাড়ির সবাই নিশ্চুপ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা পাবার অবকাশ নেই আমার। সত্যিই ফিরতে পারবো কী না জানি না তবে এখন আমাকে যে কথা দিতেই হবে। বললাম-
__কথা দিচ্ছি ফিরে আসবো তোমার বুকে। আর শোনো!
কথাটা বলেই আমি থেমে গেলাম। সেও থমকে গিয়ে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। আমি রাজ্যের মায়া মমতা ঢেলে বললাম-
__আমি তোমায় ভালোবাসি সাহেব।
আমার কথা শুনে সে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁন্না জুড়ে দিলো। মামনি সীমান্তকে জড়িয়ে ধরে বলল-
__বাবুসোনা সে ঠিক ফিরে আসবে, তুই এমন করে ভেঙে পড়লে ওর প্রেসার ঠিক থাকবে না। একটু শান্ত হ!
সীমান্ত কাঁন্না জড়ানো সুরে বলল-
__মামনি আমি নিজেকে বিগত নয় মাসে বুঝিয়েই উঠতে পারিনি। সে কেন এমন একটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে আমাকে ফেলল? আমি কত অনুরোধ করেছি তাকে, বেবি কন্সিভে তার জীবনে ঝুঁকি আছে। সে শুনলোই না। মা হবার বাসনা আজ আমাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে দেখো! ওর কিছু হলে আমার এই দূর্বল হৃদপিন্ড তা নিতে পারবে বলো? নিষ্ঠুর মেয়েটা আমাকেও শেষ করে দিলো।
⭐
ওটি রেডি। প্রেফেসর ম্যাম আমার ওটি করবেন। সাথে তানিও আছে। সীমান্তও থাকতে চাইছে কিন্তু বাবা মামনি রাজী নন। রোজ অসংখ্য অপারেশন করা সার্জারী বিভাগের ডাক্তার নিজের স্ত্রীর অপারেশন করতে তার হাত শুধু নয় তার হৃদপিন্ডও কাঁপছে। সে সবার কথা অমান্য করে ওটির ভেতরে ঢুকে আমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে বারবার বলছে-
__ভয় নেই সোনাবউ, তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!
আশঙ্কা আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দের ত্রিমুখী সংঘর্ষে সে একদম ক্ষতবিক্ষত। বৈশাখের ঝড়ো হাওয়ার মতোই ছিন্নভিন্ন তার ভেতর বাহির। আমার ভয় আমি মরে যাব এটা নিয়ে নয়। আমার ভয় আমার মন্দ কিছু হয়ে গেলে এই মানুষটা একদম মেন্টালি পাগল হয়ে যাবে। কে সামলাবে তাকে? অথবা এরচেয়েও ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে যা আমি ভাবতেই পারছি না। আমার চোখ তুলা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, কিছুই দেখতে না পেলেও সবই শুনতে পাচ্ছি। আমি টের পারচ্ছি সে অবিরাম চোখ মুছে চলেছে।
সে ম্যামকে বললেন-
__আমার সন্তানকে আমিই প্রথম স্পর্শ করবো ম্যাম। এটা আমার রিকুয়েস্ট।
সীমান্ত আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার আওয়াজ কানে এলো। একজন নার্স বললেন-
__স্যার বেবির শরীর থেকে রক্ত মুছে দিই। রক্ত তো আপনার শার্টে লেগে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।
সীমান্ত কাঁন্না জড়ানো স্বরে বলল-
__এটা আমার সন্তান, সে সৃষ্টি হয়েছেই তো আমার রক্ত থেকে। তার শরীরের এই রক্ত আমার একটা শার্টে শুধু নয় শত শত শার্টে লাগলেও ক্ষতি নেই। এটা আমার সন্তান, আমার ছেলে, আমার প্রান্ত।
আমার চোখ থেকে তুলা সরিয়ে দিয়ে সীমান্ত আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল-
__আমার ছেলে, আমার প্রান্তকে দেখো সোনাবউ, অবিকল আমার মতো দেখতে হয়েছে।
সদ্য হওয়া সব বাচ্চাদের চেহারা একই রকমের লাগে। জানি না সে কোথায় নিজের সাথে মিল পেল! আমার ছেলেটা কেমন শান্ত হয়ে বাবার বুকে মিশে আছে। আমি হাসলাম। আমার ভেতরটা প্রাণ খুলে হাসছে। আমি আমার স্বামীকে বাবা বানাতে পেরেছি। এই বংশে একটা প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছি। আমার জীবনের প্রথম ইচ্ছে ছিল সীমান্তকে নিজের করে পাওয়া। আর দ্বিতীয় ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ হলো। হঠাৎ শরীরটা যেন শীতল শক্ত হয়ে আসছে। দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি নিষ্পলক দেখছি সীমান্ত প্রান্তকে কোলে নিয়ে চোখভরা জল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে আমার ঝাঁপসা দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে গেল। আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার ছেলের কাঁন্নার আওয়াজের সাথে শুনতে পেলাম সীমান্তর ভীত স্বরের একটা ডাক “সোনাবউ।”
তবে কী আমি আমার কথা রাখতে পারবো না? কী হবে আমার সীমান্তর? কেমন করে সে নিজেকে সামলে নেবে? পৃথিবীর সব রঙ, সব শব্দ নিমেষেই থেমে গেল। আমি শেষ প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ আমার স্বামীর জীবনের জন্য আমাকে আয়ু দান করুন!
পরের পর্ব আসছে…
Written by- Sazia Afrin Sapna
“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-২১)
চোখ মেলে দেখলাম আমি কেবিনে শুয়ে আছি। প্রথমেই আমার দৃষ্টি পড়লো সীমান্তর দিকে। হৃদয় মন্দিরে লুকিয়ে রাখা মানব দেবতা আমার হাত ধরে বসে আছে। কাজী নজরুলের চোখের মতো আমার বরের চোখ দুটো। চুলগুলোও কাজী নজরুলের মতোই বাবরি। বেচারি কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। এখনও চোখের পাপড়িগুলো ভিজে জপজপে হয়ে আছে। আমি যে কী বলবো তা বুঝে পাচ্ছি না। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে যেন অনেক প্রার্থনায় তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তার চোখদুটো কত কী বলে চলেছে অথচ তার মুখে কোন শব্দ নেই। একটা মানুষকে কী ভয়াবহ আকর্ষণে কাছে টেনে আনে ভালোবাসা নামক বিস্ময়কর অনুভূতিটা। ভালোবাসা শুধুই এক অনুভূতিই নয়, ভালোবাসা হলো অসীম শক্তির খনি। সেই শক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। যেমন তার ভালোবাসার শক্তির প্রার্থনায় আমি আজ ফিরে এলাম। মূলত আমার ফিরে আসার কথা ছিল না।
আমরা দুজন নির্বাক দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। কোথায় থেকে শুরু করবো সেই ভাবনায় আমরা দুজনই নিশ্চুপ।
সে তার আরেকটা হাত গভীর মমতায় আমার চুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার টুনা মন বলল, “কতটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলেছিলে আমায়। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তবে এই আমিটা যে একটাও শ্বাস নিতে পারতাম না। তুমি আমার হৃদস্পন্দন। তুমি থেমে যাওয়া মানেই তো প্রাণহীন লাশ আমি। ফিরে এসে বাঁচিয়ে দিলে আমায়।”
তার টুনা মনের কথা শুনে আমার টুনি মন বলল, “তোমার বুকের বা পাশে কবর রচনা করতে গেছিলাম। অথচ তোমার বুকের প্রতিটা লোমের গোড়ায় গোড়ায় পৃথিবীর সব শান্তি জমে আছে। সেই বুকটার ঠিক বাম পাশের পাজরে আমার ছোট্ট কুটির আছে, যেটা আমার ঘর বসতি। সেখানেই হয়ত আমার সামাধি রচিত হতো। কিন্তু ভালোবাসার শক্তি দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনলে তুমি। নতুন করে শুরু হলো আমার জীবন। আমাকে যে ফিরতেই হতো সাহেব। তোমার হৃদয়ের গন্ডির ভেতরে মৃত্যুও যে ঢুকতে পারেনি।”
আমি তার হাতটা আলতো চেপে ধরে বললাম-
__কথা রেখেছি কিন্তু।
সে অভিমানের সুরে বলল-
__কতটা যন্ত্রণাময় যে ভালোবাসা হয় তা তোমায় ভালোবেসে বুঝেছি। আর কখনও আমাকে ভয়ানক কোনো পরিস্থিতিতে ফেলবে না। এখনি আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও!
তার গলার স্বর একদম ভেঙে গেছে। জানি না কতটা কেঁদেছে পাগলটা। আমি তার গালে হাত ছুঁইয়ে বললাম-
__কথা দিলাম। তুমি কেমন আছো? আমার প্রান্ত কোথায়?
রুমের ভেতরে সবাই আছে অথচ এতক্ষণ আমি কাউকে খেয়ালই করিনি। মামনি হাসিমুখে আমার সামনে এসে প্রান্তকে আমার পাশে শুইয়ে দিলেন। আমি নিষ্পলক আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার টুনটু পাখিটার চোখ দুটো সীমান্তর চোখের মতো হয়েছে। ঠোঁটও অবিকল। টপটপ করে আমার চোখ থেকে জল পড়ছে। এই অশ্রু খুব মূল্যবান। আমি আমার সীমান্তকে জীবনের সেরা উপহার দিতে পেরেছি, সেই আনন্দ অশ্রু এটা। একটা সন্তান পৃথিবীতে আনার জন্য একজন মা মৃত্যুর সাথে কতটা লড়াই করে তা নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। আমি তাকে আমার বুকে জড়িয়ে নিয়ে শ্বাস নিলাম। এটাকেই হয়ত মাতৃসুখ বলে।
তানি রুমে ঢুকে ডাক্তারনি ভাব নিয়ে বলল-
__সবাই এখন রুম থেকে বের হন। এখন বেবিকে ফিডিং করাতে হবে।
আমি সারাঘর তাকিয়ে দেখলাম, বাড়ির সবাই রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও সবার আতঙ্ক কাটেনি বোঝাই যাচ্ছে। আমার আব্বু আম্মুকেও দেখছি। তারা কখন এসেছে তাও আমি জানি না।
তানির কথামতো সবাই এক এক করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সীমান্ত আমার পাশে ঠায় বসেই থাকলো। নানান বেরিয়ে যেতেই দরজায় দাঁড়িয়ে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন-
__এই যে শিশুর পিতা, তোমাকে রুম থেকে বের করার জন্য কী উকিল নোটিশ পাঠাতে হবে?
__আমি থাকলে কী প্রবলেম? আপনি বাইরে যান।
তানি মুচকি হেসে সীমান্তকে বলল-
__প্রবলেম আছে। বাড়ি গিয়ে দেখিস বাচ্চারা কীভাবে ফিডিং করে। এখন বাইরে যা।
সীমান্ত করুণ চোখে তাকিয়ে বাইরে গেল। যেন তার ফাঁসির হুকুম হয়ে গিয়েছে। পাগল একটা!
⭐
হাসপাতাল থেকে আজ বাড়ি ফিরেছি। আজ আবার সেই চাঁদের হাট বসেছে। তবে আজকে ঘরে আমার চাঁদ উপস্থিত আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত সে বেজার মুখে সোফায় বসে আছে। খাট জুড়ে সবাই চাপাচাপি করে বসে আছে। খাটের এককোণে আমি শুয়ে আছি। নানুন প্রান্তকে কোলে নিয়ে বসে আছেন খাটের মাঝখানে। আর তাকে ঘিরেই বসে আছে সবাই। শুধু আমার বেচারা বরটাই খাটে বসার জায়গা পায়নি। সে মুখ বেজার করে একা একা সোফায় বসে আছে। কেউ যেন তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বাবা তো প্রান্তকে ছেড়ে অফিস যাওয়াও বাদ দিয়েছেন। আমার খাওয়ার অত্যাচার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
তানি রুমে ঢুকে বলল-
__এখন সোনাভাবীর ঘুম জরুরি। সবাই এই রুমে বসে হৈচৈ করলে সে ঘুমাবে কী করে?
তানির ভাবসাব আজকাল সারাক্ষণ ডাক্তারনির মতো। মাঝে মাঝে আমার হাসি পায়। অথচ এই আমি ছোটবেলায় ইনজেকশন এর ভয়ে ডাক্তারদের আশেপাশেও যেতাম না। ইনফ্যাক্ট ডাক্তারদের আমার কখনও আমাদের মতো মানুষ মনে করতে পারতাম না। অথচ আমার কপালে ডাক্তার লেখা ছিল।
নানান তানিকে বললেন-
__আমরা তো কেউ কথা বলছি না। আমরা শুধু প্রান্তকে দেখছি। তুমি অযথা বাড়িটাকে হসপিটাল বানিও না তো! তারচেয়ে বরং প্রান্তকে দেখো।
কথাগুলো বলেই নানান প্রান্তর কপালে চুমু খেয়ে বললেন-
__দেখো প্রেয়সী প্রান্ত আমার মতো দেখতে হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে হিরো। আমি জানতাম আমার ছোট রাণীর ছেলে আমার মতোই হবে। আরে আলট্রাসনোগ্রাফির ছবি দেখেই তো আমি বুঝেছিলাম যে, সে আমার কপি হয়ে আসছে।
তানি হতবাক হয়ে নানানের দিকে তাকিয়ে রইল। নানান খুব খুশি খুশি চোখে তাকিয়ে আছেন।
হঠাৎ বাবা নানানকে বললেন-
__বাবা প্রান্ত তো তার দাদানের মতো দেখতে হয়েছে। মানে আমার মতো দেখতে। দেখেন ওর ভ্রু চোখ সব আমার মতো।
নানান হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বড় আব্বু বাবাকে ধমক দিয়ে বললেন-
__কী সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছো? প্রান্ত তো তার বড় দাদান মানে আমার মতো দেখতে হয়েছে। তার ঠোঁট চিবুক গায়ের রং সব আমার মতো। হাসলে তো মনে হয় আমিই হাসছি।
বড় আব্বু খুব খুশি। তিনি প্রান্তর কপালে চুমু খেলেন।
আমি সীমান্তর দিকে তাকালাম। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে আমার খুব হাসি পেলো। তবে সত্যি এটাই যে, আমার ছেলের চেহারার সাথে আমার কোনোই মিল নেই। এসব নিয়ে আমার কোনো আফসোসও নেই। চেয়েছিলাম সে তার বাবার মতো হোক, সেটাই হয়েছে। এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।
তানি সবাইকে রুম থেকে বের করে দিলো। নানুন প্রান্তকে নিয়েই অন্য রুমে গেলেন। এক এক করে সবাই তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু আমার বর ঠায় বসে রইল। নানান বললেন-
__আজকেও কী তোমাকে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে রুম থেকে বের করতে হবে?
__এখন তো ফিডিং চলছে না, আমি থাকলে কি প্রবলেম?
__ছোট রাণী এখন ঘুমাবে। তুমি রুমে থাকলে তার ঘুম হবে না।
__আমিও ঘুমাবো। আপনি এখন বাইরে যান। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পরপুরুষ থাকতে নেই।
__কিহ আমি পরপুরুষ?
সীমান্ত জবাব দেবার আগেই তানি নানানের হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে গেল। তিনি রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে থেমে গেলেন।
সবাই বাইরে যেতেই সীমান্ত আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। আমার মাথায় হাত রেখে বলল-
__আমার জন্য কেন এমন ঝুঁকি নিয়েছিলে পাগলি?
আমি তার বুকে মুখগুজে বললাম-
__ওসব তুমি বুঝবে না।
__তোমাকে তো কাছে পাওয়াই দুষ্কর। বড় আম্মু আর মামনিকে কতবার বললাম আমি তোমার কাছে শোবো। মামনি বললেন, রাতে অনেকবার প্রান্তর কাঁথা চেঞ্জ করতে হয়। তোমাকে জাগিয়ে তাকে ফিডিং করাতে হয়। এসব নাকি আমি পারবো না। বড় আম্মু তো আমার কথা শুনে খুব হাসলেন।
আমি বললাম
__ মামনি তো ঠিকই বলেছেন। তুমি এসব পারবে নাকি?
__আমার সাথে তো তারাও থাকবেন।
__থাকতে হবে না। তিন মাস তুমি আলাদা ঘুমাবে।
সে অভিমানের সুরে বলল-
__তোমার আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে না?
__না তো।
সে তীব্র অভিমান নিয়ে তাকিয়ে বলল-
__তা ইচ্ছে করবে কেন? আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি।
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম-
__হ্যাঁ গো।
সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল-
__যাও দূরে সরো। আমার বুকে কী বের হয়েছে? সরো তো সরো!
__কেন?
__ভেবেছিলাম তুমি আর একটু সুস্থ হলে তারপর সবাই যখন রাতে ঘুমিয়ে যাবে তখন তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম-
__কোথায় পালিয়ে যাবে? আর কেন?
__অন্য রুমে। তার তো আর দরকার নেই।
__কেন দরকার নেই?
সে মুখভার করে বলল-
__আমার বউ তো আমাকে চায় না। আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি।
আমি শব্দ করে হেসে বললাম-
__তুমি আসলেই আধা পাগল না, ফুলপাগল। সব আমার কপাল। শেষে কী না আমি একটা পাগলের বউ।
কথাটা বলেই আমি তার বুকে মুখ গুজলাম।
হঠাৎ নানান দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন-
__এই তোমাদের ঘুমের নমুনা?
সীমান্ত লাফ দিয়ে বসে বলল-
__আপনি এখানে কেন?
নানান বেশ ভাব নিয়ে বললেন-
__বিয়ের আগে ডুবে ডুবে জল খেয়েছো দেখার সুযোগ ছিল না। বিয়ের পরে তোমাদের দরজায় অনেকবার উকি দিতে গেছি কিন্তু তুমি দরজা লক করতে ভুল করো না। আজকের চান্সটা মিস করি কি করে বলো তো?
সীমান্ত বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল-
__আপনি আমার বেডরুমেও উকি দিতে গিয়ে ছিলেন?
নানান খুব সাহসী ভঙ্গিমায় বললেন-
__হ্যাঁ
সীমান্ত করুণ সুরে বলল-
__এসব দুঃখের কথা আমি কাকে বলবো আল্লাহ!
নানান দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বললেন-
__আচ্ছা তোমরা ঘুমাও আমি দরজায় পাহারা দিচ্ছি যেন কেউ এই রুমে না ঢুকে।
আমরা দুজন মাঝখানে একহাত দূরত্ব রেখে শুয়ে রইলাম। কী এক বিপদ! দূর্বল শরীরে সত্যিই ঘুম চলে আসছে। সীমান্ত কাঁথার নিচে আমার হাত ধরে শুয়ে রইল। তার স্পর্শ যেন বলছে, “ছুঁয়ে থাকার মধ্যেও শান্তি আছে। কিছু হোক না হোক তুমি তো পাশে আছো।”
আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখলাম। সে ফিসফিস করে বলল-
__বুড়ো কিন্তু আবার রুমে উকি দেবে।
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম-
__দিক না উকি।
__তোমার লজ্জা করবে না?
__না
__আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে, লজ্জা টজ্জা ওসব আমার বউয়ের নাই।
আমি মাথা উচু করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম-
__কিহ?
সে তার বুকের সাথে আমার মাথা হালকা চেপে ধরে বলল-
__কিছু বলিনি তো। তুমি চুপ করে ঘুমাও তো। তোমার অনেক ঘুম দরকার।
শেষ পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna