ভালোবাসার প্রান্ত,২,৩

0
2028

ভালোবাসার প্রান্ত,২,৩
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-২)

ডাকুরাজ দরজা বন্ধ করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে অগ্নি নিক্ষেপ করা শুরু করলো। মনে হচ্ছে চোখের আগুনেই আমি ভষ্ম হবো আজ। এমন চোখ থাকলে দেশে বন্দুকে বা আগ্নেয়াস্ত্রের দরকার নেই। ইয়া আল্লাহ্ বউয়ের দিকে কেউ এমন করে তাকায়? আরেহ বিরোধী দলও তো এমন করে তাকায় না। আমি কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর মাথা নিচু করে লাজুক মুখ করে বললাম-
__দিনে দুপুরে এমন করে দরজা বন্ধ করলে বাড়ি ভরা লোকজন কী ভাববে বলো তো দুষ্টু? দরজা খুলে দাও।

সে আমাকে ইয়া বড় ধমক দিয়ে বলল-
__চুপ একদম! নাটক শুরু করে দিয়েছে। আমি দরজা খুলে রাখি আর তুমি মনের আনন্দে নাচতে নাচতে পালিয়ে যাও। বাদর পাজি মেয়ে একটা!

আমি লাজুক ভাব অটুট রেখে বললাম-
__পালাবো কেন গো? আমি চোর না ডাকাত হুম?

__ডাকুরানী তুমি। কালরাতে তো লুট করেছো আমাকে। আমার সর্বনাশ করে দিয়েছো।

সে এমন ভাবে কথাটা বলল যেন সে একটা মেয়ে আর আমি ছেলে, আমি তার সব কেড়ে নিয়ে সর্বনাশ করে দিয়েছি। তার কথা শুনে মনে মনে আমি সত্যিই খুব লজ্জা পেলাম। পৃথিবীর কোনো স্বামী তার বউকে কখনও এমন অপবাদ দেয়নি। হে আল্লাহ এমন লজ্জা জনক অপবাদও তুমি আমার কপালে লিখে রেখে ছিলে? কী শরমিন্দা! কী শরমিন্দা!
আমি লাজুক ভাব ছেড়ে নির্দোষ ভাব করে বললাম-
__এমা তুমিই তো সব করলে আর এখন আমাকে দোষ দিচ্ছো? কী কী করেছো সব বলবো?

__চুপ একদম ফাজিল মেয়ে! আমি করেছি ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কী করেছো? সব শেষ করে দিয়েছো তুমি। দস্যি পাজি বদ বখাটে মেয়ে একটা।

আমি ফাজিল, পাজি, বদ, বখাটে, গুন্ডী, চন্ডী, দস্যি, ডাকুরানী, এসব উপাধি আমি প্রেম হবার পর থেকেই শুনে আসছি। এসব কথা আমার গায়ে লাগে না। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও নিজেকে এসবই মনে করি। বরং সে যখন আমাকে ভালোবেসে লক্ষী বউ বলে ডাকে তখন আমার মনে হয় অন্য কাউকে ডাকছে। নিজেকেই আমার আজব লাগে। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম-
__এ আর নতুন কী? নতুন কোনো উপাধি দেবার থাকলে দাও। যেমন, ছিনতাইকারীনি, কিডন্যাপারনী, গড মাদার, ডনী ইত্যাদি।

__ফালতু কথা বাদ দিয়ে এখন এই ট্যাবলেট দুটো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো আমার ডাকুরানী।

সে ট্যাবলেট বের করে পানির গ্লাস আমার সামনে ধরলো। এই রে, এত কথার মধ্যে তো ট্যাবলেটের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন এই ডাকাত ডাক্তার আমাকে চেপে ধরে ট্যাবলেট খাওয়াবে নাকি? খাওয়ালে তো খুব খারাপ হবে। আমি দিশাহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললাম-
__আমি কিছুতেই ট্যাবলেট খাবো না। ওমাগো আমার বমি পাচ্ছে ওয়াক্ক ওয়াক্ক।

আমি দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম তারপর ওয়াক্ক ওয়াক্ক করে বমি করার ভান করলাম। মরার বমিও বের হচ্ছে না, কী জ্বালা মাবুদ! বের হ না বমি বাপ! বের হয়ে আমাকে বাঁচা এই ডাকাতের হাত থেকে। হে আল্লাহ তুমি কী কিছুই দেখতে পাচ্ছো না? হয় এই অসহায় নারীকে বমি দাও নইলে এই ডায়নোসরের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। প্লিজ তোমার দোহাই লাগে!
সে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
__বাহ চব্বিশ ঘন্টা পার না হতেই তুমি প্রেগনেন্ট হয়ে গিয়েছো? আমাকে ভূগোল বুঝাচ্ছো?

আমি করুণ চোখে তার দিকে তাকালাম। নিষ্ঠুর একটা! বউ বমি বমি কষ্ট পাচ্ছে, কোথায় সে সহানুভূতি দেখাবে, তা না তিনি তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ যেন বলছে, ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসো এক কোপে তোমার মাথা কাটবো।
আমি করুণ সুরে বললাম-
__বমি পেলে আমি কী করবো?

__এখন মেডিসিন খাবে। আমি জানি তোমার বমি পাচ্ছে না। তুমি বমির অভিনয় করছো। কবে থেকে এসব অভিনয় শিখেছো?

আমি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বললাম-
__আমার সত্যিই বমি পাচ্ছে। এখন খেলে বমি হয়ে সব উঠে যাবে। রেখে দাও পরে খাবো।

সে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল-
__আমার চোখের সামনেই খাবে। হা করো।

__কিছুতেই খাবো না। আমি আজ রোজা আছি।
কথাটা বলেই আমি দুই হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলাম।
সে ধমক দিয়ে বলল-
__একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। হা করো বলছি!

আমি ওর হাত থেকে ট্যাবলেট দুটো নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম।
সে ডায়নোসরের মতো করে আমার দিকে তাকালো। কখন যেন ফুঁ দিয়ে আগুন ছুড়ে দেবে আমার দিকে। তারপর ধমকের স্বরে বলল-
__মেয়ে মানুষ বলে বেঁচে গেলে। যদি ছেলে হতে তবে থাপ্পড় দিয়ে গালের সবগুলো দাঁত ভেঙে দিতাম।

তার কথা শুনে আমি অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেললাম। আমায় হাসতে দেখে তার দৃষ্টি যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল। আমি হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে হাসি আটকালাম। আমি কী করব, সে এসব বললে আমার খুব হাসি পায়। যে পুরুষ বউয়ের শরীরে একটা সুচ ফুঁড়তে পারে না, সে নাকি থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ভাঙবে! মানুষটা পাগল টাগল হয়ে কথার ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছে। ওর মাথায় একটু নিদ্রাকুসুম তেল দিয়ে দেবো নাকি? না থাক, ওর এসব পাগলামি ভালোই লাগছে। আমি হাসি চেপে রেখে বললাম-
__কোনো ছেলেকে বিয়ে করলেই তো পারতে। রোজ তাহলে পিটাতে পারতে। সে তোমাকে সুয়ামী ডাকতো আর তুমিও তাকে সুয়ামী ডাকতে। আহ্ কী দারুণ হতো!

সে একটা বিকট ধমক দিয়ে বলল-
__চুপপপ! একদম ফালতু কথা বলবে না বলে দিলাম। ট্যাবলেট তোমাকে আমি খাইয়েই ছাড়বো।

__আগে এক হাজারটা চুমু খাবে গুনে গুনে। একটাও কম হলে হবে না। তবেই আমি ট্যাবলেট খাবো।

সে নরম স্বরে বলল-
__আগে ট্যাবলেট খাও তারপর দুই হাজার চুমু খাবো প্রমিস।

মনে মনে বললাম, কচু খাবে। আমি তোমাকে চিনি না নাকি? এসব বলে পটিয়ে ট্যাবলেট খাইয়ে আমার সর্বনাশ করবে।
আমি এক পা দু পা করে পিছাতে পিছাতে দরজার কাছে গিয়ে থামলাম। তারপর দরজা খুলে ভোঁ দৌড় দিলাম। একদম নিচের সিঁড়িতে এসে গেলাম পড়ে। পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেলাম। ওরে আল্লাহ্ আমার পা ভেঙে গেল নাকি? এখন আমার কী হবে? সব হলো ঐ ডাকাতটার জন্য। মামনি ছুটে এসে আমাকে টেনে তুলে বললেন-
__তোর আজ কী হয়েছে বল তো? তখন দৌড়ে উপরে গেলি আবার এখন দৌড়ে পড়ে গেলি, হয়েছেটা কী?

উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম পা ভাঙেনি। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি কিন্তু ভীষণ ব্যাথা করছে। আমি ব্যাথা চেপে রেখে হাসির ভান করে বললাম-
__আমার আজ দৌড়াতে খুব ভালোলাগছে মামনি। মনে হচ্ছে শুধু দৌড়াই আর দৌড়াই।

মনে মনে বললাম, সাধে দৌড়াচ্ছি নাকি? তোমার সিংহ মার্কা ডাকাত ছেলে আমাকে দিয়ে দৌড়িয়ে নিচ্ছে। সময় আসুক আমিও তাকে এমন করে দৌড় করাবো।
মামনি হতবাক হয়ে বললেন-
__”তোর মনে হচ্ছে শুধু দৌড়াই আর দৌড়াই? এই তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? বাচ্চাদের মতো দৌড়াতে ইচ্ছে করবে কেন?

__মাথা ঠিকই আছে আমার। এখন আমি কিচেনে যাচ্ছি, কাজ আছে আমার।

মামনির প্রশ্নের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে কিচেনে গেলাম। লাঞ্চের আগে সীমান্ত নিচে আর এলো না। দুইটায় সে ডায়নিংএ আসবে তার আগেই আমি মামনির রুমে গিয়ে বসে রইলাম। সে চুপচাপ লাঞ্চ করে রুমে চলে গেল। আমি খেলাম কী না তার খবরটাও নিলো না। নিষ্ঠুর একটা! এজীবন রেখে কী হবে আল্লাহ?
আমি সারাদিনে নিজের শোবার ঘরে যাবার সাহস পেলাম না। মামনি সারাদিন ধরেই যে আমাকে খেয়াল করছেন তা আমি জানি। সন্ধ্যার পরে মামনিকে বললাম-
__শোনো আমি কিন্তু আজ তোমার কাছে ঘুমাবো বলে রাখলাম।

মামনি রহস্যজনক ভাবে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন-
__দুজনার ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

আমি মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম-
__সে আমাকে খুব বকেছে। খুব পঁচা তোমার ছেলে।

মামনি অবাক হয়ে বললেন-
__কেন বকেছে?

এই রে, কেন বকেছে সেটা বলবো কী করে? কিছুতেই বলা যাবে না। মুখে তালা মেরে রাখতে হবে। নইলে মুখ ফসকে সব বেরিয়ে যাবে। আমি অভিমানী মুখ করে বললাম-
__নিজের ছেলের থেকেই শুনে নাও না! আমি বলতে পারব না। আমার শরীরটা কেমন যেন লাগছে। আমি এখনি শুয়ে পড়ছি, ডিনার আজ করবো না।

হঠাৎ শরীর খারাপ শুনে মামনি হতবাক হয়ে তাকালেন। বললেন-
__ দুপুরেও তো ক্ষুধা নেই বলে কিছুই খেলি না। এখন বলছিস ডিনারও করবি না। জ্বর টর এলো নাকি দেখি।

মামনি আমার কপালে হাত রেখে বললেন-
__শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে। তাহলে কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোর?

ওরে আল্লাহ কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলবো কী করে? কষ্ট তো কোথাও হচ্ছে না। তাহলে এখন কী বলি? এত বানিয়ে বানিয়ে কী বলা যায় মাবুদ! সেই সকাল থেকেই বিভিন্ন পদের ঢং করে চলছি। এত ঢং নিজেরই ভালোলাগছে না। ধুর! সব দোষ ঐ ডাকাতটার। কেন যে সে আমার সাথে এমন করে? মামনি উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হুট করেই বলে ফেললাম-
__বুকে কষ্ট হচ্ছে। কেমন যেন ধড়ফড় করছে।

কথাটা বলেই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলাম, যেন আমার ছোটখাট হার্ট এ্যাটাক হতে চলেছে। মামনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন-
__ওরে আল্লাহ কী সর্বনাশ! এখনি বাবুসোনাকে ডাকছি দাঁড়া।

এই রে সেরেছে! ঐ ডাকাত এলে তো আমার সত্যি সত্যিই হার্ট এ্যাটাক হবে। ঘরে ডাক্তার থাকলে একটু অসুখের ভান করাও বিপদ। মনে মনে বললাম, তোমার বাবুসোনা ট্রিটমেন্ট করতে আসবেন বন্দুক নিয়ে। সে আমার বুকে স্টেথোস্কোপ না ধরে বন্দুক ধরবে।
আমি বললাম-
__না না ডাকতে হবে না। খুব বেশি ধড়ফড় করছে না, ঘুমালেই ঠিক হবে।

মামনি যেন বুঝেই ফেললেন আমি এসব ভান করছি। তার ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা হঠাৎ দুষ্টুমিতে রূপান্তরিত হলো। মুচকি হেসে বললেন-
__তা আমার রুমে ঘুমালে কী বুক ধড়ফড় সারবে?

মামনির দুষ্টু হাসিতে আমি মহা লজ্জা পেলাম। আমি যে বর পাগলি এটা বাড়ির লোকজন শুধু নয়, প্রতিবেশীরাও জেনে গিয়েছে। ওদিকে হাসপাতালে তার স্টাফরাও জেনে গিয়েছে। হুটহাট বরকে দেখার জন্য হাজির হয়ে যাই হাসপাতালে। না জেনে ওদেরই বা উপায় কী?
আমি লজ্জা প্রকাশ না করে বললাম-
__সারবে সারবে। আমি যাই।

কথাটা বলেই আমি দ্রুত মামনির রুমে ঢুকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ঘুমের ভান করে রইলাম। মরার ঘুম তো চোখে নাই। এহকালে আসবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। কখন যেন ঐ ডাকাতটা রুমে ঢুকে আমার বুকে বন্দুক ধরে বলবে, “বখাটে সুন্দরী এখন যদি না উঠো তাহলে সব গুলি তোমার বুকে ঢুকবে।”
এই বুকের ভেতরে যে তার জন্য গড়া একটা সীমান্ত মহল আছে তার প্রতিও ঐ ডাকাতটার মায়াদয়া হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে রাত এগারোটা বেজে গেল। টংটং করে ফোনে মেসেজ এলো। এই রে মরেছি! এটা ঐ ডাকাত ছাড়া আর কারও মেসেজ হতেই পারে না। খুব ভয় লাগছে মেসেজ ওপেন করতে। দোয়া কালিমা পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু দেখলাম আমি সব ভুলে গেছি। এখন আমার কী হবে আল্লাহ গো!
মেসেজ ওপেন করলাম।
“এক মিনিটের মধ্যে উঠে ডায়নিংএ বসবে। তারপর ডিনার করে সোজা নিজের রুমে যাবে। অন্যথা তোমার কপালে কী আছে তা তুমি ভাবতেও পারবে না।”

এমন থ্রেড কেউ তার বউকে করে? কী আজব মানুষকে আমি বিয়ে করেছি আল্লাহ! আমি ধুচমুচ করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পায়ে কাঁথা পেঁচিয়ে পড়ে গেলাম। এমনিতেই সিড়িতে পড়ে পায়ে ব্যাথা, এবার মনে হয় কোমরে ব্যাথা পেলাম। পড়ে যাবার শব্দ শুনে মামনি ছুটে এসে দেখেন আমি মেঝেতে কাঁথা জড়িয়ে পড়ে আছি। মামনি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বললেন-
__তুই তো ঘুমিয়ে ছিলি। মেঝেতে এলি কী করে? একটা শব্দ হলো, সেটা শুনেই রুমে এলাম। এই তুই বিছানা থেকে পড়ে গেছিস নাকি?

__আমি মনে হয় ঘুমের ঘোরে পড়ে গেছি মামনি। আসলে স্বপ্নে আমি দৌড়াচ্ছিলাম।

মামনি অবাক হয়ে বললেন-
__দৌড়াচ্ছিলি কেন?

আমি মাথা নিচু করে করুণ সুরে বললাম-
__একটা ডাকাত আমার পিছু নিয়েছিল। ডাকাতটা খুব ভয়ানক। এখন আমার ক্ষুধা লেগেছে। আমাকে এক মিনিটের মধ্যে ডায়নিং এ যেতে হবে।

আমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কাঁথার জট খুলছেই না। অনেক কষ্টে কাঁথার জট খুলে ছুটে ডায়নিং এ গিয়ে বসলাম। হুজুকের মাথায় বসে পড়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আমার ডাকুরাজ বর আমার সামনের চেয়ারে বসে আমার দিকে খাইয়ালামু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে খাবার বেড়ে নিলাম। সব গোলমাল হয়ে গিয়ে ভাত না নিয়ে আগে প্লেটে তরকারি নিলাম। তারপর নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলাম।

ডিনার শেষ করে রুমে যাচ্ছি আর ভাবছি, রুমে ঢুকে রেডি হয়ে থাকবো। সে রুমে ঢুকতেই তাকে জড়িয়ে ধরে উরাধুরা কিচি শুরু করে দেবো। এতে সে আমাকে ওষুধ খাওয়ানোর কথা ভুলেই যাবে। উফ্ কী সুন্দর বুদ্ধি আমার! নিজের বুদ্ধি দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রুমে ঢুকে আমি রেডি হয়ে আছি। চোখ বন্ধ করে রিহার্সেল করছি। আগে কোথায় কিচি করে শুরু করবো। কিন্তু আমার খুব লজ্জাও করছে। পৃথিবীর কোনো বউ এমন অভিনব গুণের অধিকারী নয়। দরজায় তার পায়ের আওয়াজ শুনে আমি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ভাব নিলাম, এখনি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরবো।
এমা আমার বুক ধড়ফড় করছে কেন? হৃদপিন্ড বাইরে বেরিয়ে আসবে নাকি? পা দুটোও তো কাঁপছে মনে হচ্ছে। ঘেমেও তো যাচ্ছি দেখছি। হেটে দরজা পর্যন্ত যেতে পারব তো? মনে শক্তি এনে দরজার দিকে এগুলাম। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আমি পায়ের কাঁপুনিতে ব্যালেন্স হারিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলাম।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-৩)

ব্যালেন্স হারিয়ে এমন করে যে পড়ে যাব তা আমি ভাবতেই পারিনি। আমি পড়ে গিয়েছি দেখে সে দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শরীর এতটাই কাঁপছে যে, আমি উঠে দাঁড়াতেও পারছি না। তাকে কী বলে দিতে হবে যে আমাকে টেনে তুলো? কবে এসব বুঝবে সে? লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম-
__আমি উঠতে পারছি না, আমায় টেনে তুলো।
সে আমার হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল-
__পড়ে গেলে কী করে? নাকি এটাও অভিনয় সিমপ্যাথী নেবার জন্য?

মনে মনে খুব কাঁন্না পেলো। মানুষটা কখনই আমাকে বোঝার চেষ্টা করে না। সবসময় উল্টাই বুঝে। অভিনয় যখন মনে করেই নিয়েছে তখন অভিনয়ই হোক। সে আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করাতেই আমি তার গায়ের উপর পড়ে গেলাম। এমন ভাবে পড়লাম যে, আমাকে তার বুকের উপর নিয়ে সে চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়লো। কেমন সিনেমার সীন ঘটিয়ে ফেললাম ভেবে খুব আনন্দিত হলাম। মনে মনে নিজেকে সিনেমার নায়িকা মনে হলো। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে নায়িকা ভাব ভ্যানিস হয়ে গেল। কারণ সিনেমার সাথে একটু পার্থক্য আছে এখানে। সিনেমায় নায়করা রোমান্টিক চোখে নায়িকার দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়িকাও নায়কের বুকে শুয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। আর এখানে আমার বর এ্যানাগন্ডা চোখে তাকিয়ে আছে আর আমি ভীত চোখে তাকিয়ে আছি। আমার হঠাৎ খুব লজ্জা লাগছে। ভয় আর লজ্জা মিলেমিশে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মানুষ ভয় পেলে তো জড়িয়েই ধরে। এমা জড়িয়ে ধরতে না ধরতেই সে আমাকে তার বুকের উপর থেকে ঠেলে ফেলে দিলো। পাষাণ কাঠ তক্তা একটা হুহ!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলাম। তাকে যে চুমু খাওয়ার প্ল্যান ছিল সেটা তো ভুলেই গিয়েছি। এখন তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে কেমন হবে? আমি তার দিকে তাকালাম। তার চোখ রাগে লাল হয়ে আছে। থাক বাবাহ কাজ নেই আমার চুমু টুমু খেয়ে। আমি বরং ঘুমাই। আমি বিছানায় শুতেই সে বালিশ ঠিক করতে করতে বলল-
__বিছানায় শুতে চাইলে ট্যাবলেট খেতে হবে। এখন ভেবে দেখো কোথায় শোবে।

আমি অসহায় চোখে তার দিকে তাকালাম। আহত স্বরে বললাম-
__আচ্ছা আমি মামনির কাছে যাচ্ছি।

সে নম্র স্বরে বলল-
__রুমের বাহিরে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।

আমি কিছু না বলে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় গিয়ে শুলাম। ভাবলাম একটু পরে মনে হয় সে আমাকে ডেকে বিছানায় নিয়ে যাবে কিন্তু রাত শেষ হতে চললো তবু সে ডাকলো না। নিষ্ঠুর একটা হুহ।
সারারাতে একটুও ঘুম এলো না। কষ্টে আমার চোখে জল এলো। আমার বিবাহিত জীবনে তাকে ছাড়া যতগুলো রাত পার করেছি সবগুলো রাতই নির্ঘুম অশ্রু মাখা ছিল। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলাম। সে বিছানায় সারারাত ছটফট করলো। আমি চোখ একটু ফাঁক করে ওর ছটফটানি দেখলাম। ভোররাতের দিকে সে কাঁথা দিয়ে আমার শরীর ঢেকে দিলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপাল বারাবর ঝুঁকে সরে গেল। বুঝলাম একটা চুমু খেতে চেয়েও খেলো না। মনে মনে রাগ হলো। আরেহ বাবাহ আমি তো ঘুমিয়েই আছি, একটা চুমু খেলে আমি তো আর টের পাবো না। চুরি করে বউকে কী একটা চুমু খাওয়া যায় না? নিষ্ঠুর একটা!

✴️
আমি সকালে উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিল রেডি করলাম। সে আটটার মধ্যেই বের হবে। আমাকে তার প্লেট সাজাতে দেখে সে বলল-
__আমি নাস্তা করবো না আজ।

__কেন?

__জবাব তোমার কাছে।

আমি করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম-
__প্লিজ না খেয়ে বের হইয়ো না! কিছু একটা মুখে দিয়ে যাও!

সে দৃঢ় স্বরে বলল-
__না

__অনুরোধ করছি প্লিজ!

সে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। আমারও খাওয়া হলো না। যে যুদ্ধে নেমেছি তাতে দূর্বল হলে হার নিশ্চিত। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। সে বেরিয়ে যেতেই মামনি এসে বললেন-
__বাবুসোনা নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল। তোদের মধ্যে কী ঝগড়া টগড়া কিছু হয়েছে নাকি?

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
__কই না তো।

মামনি মন খারাপ করে বললেন-
__ছেলেটা না খেয়ে থাকবে দুপুর পর্যন্ত। আমি খাই কী করে বল তো? তোদের মধ্যে কিছু হলে মিটিয়ে নে। জানিসই তো যে, সে একটু পাগল পাগল।

✴️
আমি হটপটে নাস্তা নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। আমি যেতেই আমাকে দেখে ফারুক খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। বললাম-
__ভাই তোমার মহারাজকে গিয়ে বলো আমি এসেছি।

সে মাথা নিচু করে অসহায় সুরে বলল-
__ওটিতে ঢুকলে মহারাজ রাগ করেন। আজ ওটিতে ঢুকার আগে বলেছেন, কেউ যেন তাকে একদম বিরক্ত না করে।

আমি যে আসব সেটা সে আগে থেকেই বুঝে ফেলেছে। তাই আগেই ফারুককে এসব বলে রেখেছে। কেমন ডাকাত হলে এমনটা করতে পারে আল্লাহ! আমি স্বাভাবিক ভাবে ফারুককে বললাম-
__আমি তোমাকে ঢুকতে বলেছি শুনলে সে রাগ করবে না। যাও।

কয়েক মিনিট পর ফারুক এসে মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে বলল-
__বৌরাণী স্যার এখন আসতে পারবেন না। আপনাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন।

__আমি অপেক্ষা করছি, সে যখন আসে আসুক।
ফারুক অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার জমিদার বের হলেন পাক্কা দেড় ঘন্টা পর। বেরিয়ে আমাকে বসে থাকতে দেখে বলল-
__কেন এসেছো?

অভিমানে তার চোখমুখ অন্য রকম দেখাচ্ছে। এত অভিমানী হলে কী চলে? কবে যে পাগলটা সব বুঝবে?
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__নাস্তা করাতে এসেছি।

আমার কথায় যেন তার অভিমানের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সে তমসাচ্ছন্ন মুখে তাকিয়ে বলল-
__আমি খাই এটা তো তুমি চাও না। যদি চাইতে তাহলে ট্যাবলেট খেতে।

আমি সব বুঝেও প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে দূর্বলতাকে সামনে নিয়ে আসতে হয়। আসলে আমি তার দূর্বলতার সুযোগ নিতে চাই না। কিন্তু আমি বড্ড নিরুপায়। আমি খাইনি এটা তার হৃদয় পোড়াবে। পুড়ুক না একটু, তবুও সে যেন অভুক্ত না থাকে এটাই আমার প্রচেষ্টা। আমি আহত চোখে তাকিয়ে বললাম-
__আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।

সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল-
__তোমার হাত পা কে বেঁধে রেখেছে? খাওনি কেন?

__তুমি না খেলে আমি খেয়েছি কখনও?

__এখন থেকে ওসব আদিখ্যেতা বাদ দিবে।

__দেবো না

__তর্ক করবে না একদম।

__করবো।

__ধুর। আমি ওটিতে যাচ্ছি।

আমি তার হাত টেনে ধরে বললাম-
__প্লিজ না খেয়ে যেও না!

সে আমাকে উপেক্ষা করে ওটিতে চলে গেল। আমার ভেতরটা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার হাউমাউ করে কাঁন্না এলো কিন্তু কাঁন্না আটকে রাখলাম অনেক কষ্টে। কাঁন্না আটকে রাখার মতো নিদারুণ যন্ত্রণা আর নেই। এখন যদি কাঁদি তবে সবাই ভাববে আমার বর আমাকে পিটিয়ে রেখে ওটিতে ঢুকেছে। যদিও সে খুবই ভদ্রলোক তাই সবাই এটা বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু বকতে পারে এটা তো বিশ্বাস করবে। স্বামীর বদনাম হোক সেটা আমি চাই না। এ কেমন বর আল্লাহ!

✴️
বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়াতেই দেখি অঙ্কুর এগিয়ে আসছে। আমাকে দেখে বিজয়ে হাসি দিয়ে বলল-
__আরেহ রাজার বউ যে দেখছি! সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে তা তো খেয়াল করিনি। তা কী মনে করে এত সকাল সকাল? বরের নাইট ডিউটি ছিল নাকি? সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে সকাল হতেই বুঝি ছুটে এসেছো থাকতে না পেরে? বিশ্বাস করো তোমার মতোই একটা বর পাগলি বউ চাই আমার। কোথায় পাই বলো তো? তোমার তো আবার বোনও নাই! সব আমার কপাল!

এত দুঃখের মাঝেও অঙ্কুরের কথা শুনে হাসি পেলো। অন্যদিন হলে হয়তো খুব হাসতাম। আমি মুচকি হেসে বললাম-
__পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও।

__ধুর ওসবে কিচ্ছু হয় না। তুমি বরং আমার জন্য একটা বর পাগলি ঠিক করো। বোন নেই তো কী হয়েছে? বান্ধবী তো আছে।

__বিয়ের আগেই মেয়ে বর পাগলি হবে কী করে? এরচেয়ে বরং তুমি একটা প্রেম করো। সেই মেয়ে বর পাগলি কি না সেটা বিয়ের আগেই বুঝতে পারবে। ফ্রীতে কী দারুণ এডভাইজ দিলাম তোমায় দেখো!

সে মুখটাকে শুকনো করে বলল-
__তোমার বরের জন্য অমাদের প্রেম হবার উপায় আছে নাকি? সব মেয়ে তো ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে।

আমি বড় বড় চোখ করে অঙ্কুরের দিকে তাকালাম। হায় আল্লাহ কোন মেয়ে আমার বরের দিকে তাকিয়ে থাকে? কতগুলো মেয়ে তাকিয়ে থাকে? ইন্টার্নীর সব হারামী বেশরম মেয়েগুলোই নিশ্চয়ই ! শয়তান মেয়ে তোদের কপালে বিয়ে জুটবে না দেখিস। অন্যের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকার ফল তোরা নিশ্চয়ই পাবি। চিরকাল রোগী দেখেই তোদের জীবন পার হবে, বর জুটবে না। এই সোনাইয়ের অভিশাপ বিফলে যাবে না।
আমি সিরিয়াস মুখ করে ঝাঁজালো স্বরে অঙ্কুরকে বললাম-
__কোন মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে বলো?

সে আমার সিরিয়াস চোখমুখ দেখে ঘাবড়ে গেল। তার যে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে তা আমি নিশ্চিত। মনে মনে আমার হাসি পেলো। সে আমতা আমতা করে বলল-
__কোন মেয়ে, কোন মেয়ে! তাই তো কোন মেয়ে?

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here