ভালোবাসার প্রান্ত,৪,৫

0
1670

ভালোবাসার প্রান্ত,৪,৫
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-৪)

কোন মেয়ে আমার বরের দিকে তাকিয়ে থাকে তাকে অঙ্কুর খুঁজে না পেয়ে আমাকেই প্রশ্ন করছে কোন মেয়ে? নিশ্চয়ই সে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। আমার বরের দিকে তাকিয়ে থাকে এত বড় সাহস কোন মেয়ের? আমি আজ তাকে মরিচ থেরাপি দেবো এবং তার সব চুল ছিড়ে নিয়ে বাড়ি যাব। বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠছে, হায় আল্লাহ এমন করে আমার বরের দিকে কুনারীর নজর পড়লে আমার বর তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। এমনিতেই তো তার হৃদয় কাঠ দিয়েই বানানো, এখন শরীরও কাঠ হবে নাকি?
আমি চোখ পাকিয়ে অঙ্কুরকে বললাম-
__বলো বলছি কোন মেয়ে তাকিয়ে থাকে?

সে আসামি মতো আমার দিকে তাকালো। যেন সে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে, এখনই আমি তাকে ফাঁসি দিয়ে দেবো। তার জীবনের ইতি এখানেই। জীবনে তার বিয়ে করা আর হলো না। সে করুণ সুরে বলল-
__আমাদের হসপিটালের কোনো ডাক্তার বা অন্য স্টাফ কোনো মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে না বিশ্বাস করো! কারণ ওরা সবাই তো তোমাকে চেনে। ওদের ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে, তোমার বরের দিকে তাকাবে?

হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে সে কথাগুলো বলল। তার গলা দিয়ে যে স্বর বের হতে চাইছে না তা বুঝতেই পারছি। বেচারা অনেক কষ্টে স্বর টেনে বের করেছে। তার কন্ঠস্বর, কথা বলার ভঙ্গিমা আর আসামি টাইপের চাহনি দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। হাসি চেপে রেখে গম্ভীর ভাব ঠিক রাখতেই আমি যেন শেষ হয়ে যাচ্ছি। কখন যেন আমার পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসে।
আমি চোখ পাকিয়ে রেখেই বললাম-
__তাহলে কোন মেয়ে তাকিয়ে থাকে?

সে বিষম খেয়ে বলল-
__পথে ঘাটে চলার সময় পথিক মেয়েরা তাকিয়ে থাকে। মেয়েগুলো আসলেই খুব অসভ্য আর বেশরম। আরেহ বাবা বিবাহিত ছেলের দিকে তোরা কেন তাকাবি? আমরা ব্যাচেলাররা কী মরে গেছি? আমাদের দিকে দিনরাত তাকিয়ে থাক না বাপু, কেউ মাইন্ড করবে না। আমাদের তো আর বউ নেই যে, কোমরে আঁচল গুজে তেড়ে আসবে।

কথাটা বলেই সে নির্দোষ মুখভঙ্গিমায় তাকালো। যেন কথাটা বলে সে খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। কারণ পথিক মেয়েদের তো আর আমি ধরতে যাব না।
আমি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম-
__তোমার বন্ধু পথে ঘাটে চলাফেরা কবে করলো? সে তো বাড়ি আর হসপিটাল ছাড়া একা কোথাও যায় না। তাও আবার গাড়িতে যায়। এর বাহিরে যেখানেই যায় সাথে আমি থাকি। তাহলে কোন মেয়ে তাকালো?

ফেঁসে গিয়েছি এই টাইপের মুখভঙ্গি করে সে আহত স্বরে বলল-
__কোনো মেয়ে তাকায়নি। বিশ্বাস করো আমরা বন্ধুরাই শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কী যে ভালো লাগে তাকিয়ে থাকতে! চোখ সরাতেই মন চায় না জানো! এত হ্যান্ডসাম তোমার বর যে, আমরা নিজেদেরকে নিয়ে খুব হতাশ আছি।

আল্লাহ হাসি আর চেপে রাখতেই পারছি না। খুব কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে হালকা হেসে বললাম-
__এত ভালোলাগে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে? এজন্যই বুঝি তোমরা বন্ধুরা যখন ডান্স করো তখন তুমি তার সাথে মেয়ে চরিত্রে নাচো? মাঝে মাঝে তো তার কোলেও উঠে যাও শুনেছি।

সে লাজুক হাসি দিয়ে বলল-
__ঠিকই ধরেছো। আই লাভ হিম।

__একদিন তোমারও প্রেম হবে, বিয়ে হবে। আর আমার বরের দিকে এত তাকিয়ে থেকো না দেবররাজ। কারণ হতাশায় মরে টরে যেতে পারো। বিয়ের স্বাদ না নিয়ে মরে গেলে তোমার অতৃপ্ত আত্মা কষ্ট পাবে।

সে হাহা করে হাসলো। এবার বোধহয় তার জানে পানি এসেছে। একটু আগে তো আমার প্রশ্নের তীরে মরেই যাচ্ছিল। বললাম-
__যাই হোক, বাসায় এসো চুটিয়ে আড্ডা দেবো। এখন আমার একটু তাড়া আছে।

সে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলল-
__তোমার হাতে খাবারের হটপট দেখছি। সব বরকে খাইয়ে ফিনিশ করে দিয়েছো? দেবরের কথা একটুও মনে পড়েনি? এত নিষ্ঠুর তুমি?

আমার মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা না খেয়ে ওটিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তো আমার উপরে রাগ করে একফোঁটা পানিও খাবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম-
__তার খাওয়ার সময় আছে নাকি? এটা তুমি রেখে দাও। খেয়ে নিও।

সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
__তোমার মন খারাপ বৌরাণী?

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
__না তো।

__শালা এত সুন্দরী বউকে খাবারসহ ফিরিয়ে দিচ্ছে, কবে বুদ্ধি হবে গাধাটার? আরেহ বউ সুন্দরী হলে তার হাতের বিষ ফলও অমৃত লাগবে। গাধা একটা!

আমি অঙ্কুরের এমন পাম মার্কা কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সে বেশ ভাব নিয়ে বলল-
__আচ্ছা তোমার আফসোস হয় না এই ভেবে যে, তোমার দেবরের মতো তোমার বরটা রোমান্টিক নয় কেন?

__উহু, আফসোস হয় না।

সে অবাক হয়ে বলল-
__কেন?

__তাকে আনরোমান্টিক দেখেই প্রেম করেছি এবং বিয়েও করেছি।

হঠাৎ তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। বলল-
__তোমার ভালোবাসা দেখলে মন ভরে যায়। তবে এখনও ভেবে অবাক হই, হাদারামটা তোমায় পটালো কেমন করে!

আমি কিছু না বলে ম্লান হেসে বললাম-
__এ রহস্য তুমি বুঝবে না।

__বলো প্লিজ! আমিও পটাতে চাই।

__ডাকুরাজের থেকে শিখে নিও।

__ঐ আলাভোলা হাদারামটা ডাকুরাজ? ওহ মাই গড!

__ডাকুরাজ না হলে এই ডাকুরানীর মন ডাকাতি করা এত সহজ নয়।

সে আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলল-
__তুমি ডাকুরানী ঠিক আছে কিন্তু সে কোন এ্যাঙ্গেলে ডাকুরাজ?

আমি শুধু মুচকি হাসলাম।

বিষণ্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরছি। মানুষটার রাগ কেমন করে যে ভাঙাই সেটা ভেবেই কূলকিনারা পাচ্ছি না। মরার ট্যাবলেট যে কোন বজ্জাত আবিষ্কার করেছে তাকে পেলে আচ্ছা মতো ধোলাই করে ট্যাবলেট বানানোর সাধ মিটিয়ে দিতাম। তার বানানো সব ট্যাবলেট তাকে আর তার বউকে খাওয়াতাম। না খেতে চাইলে আবার ধোলাই দিতাম। অসভ্য বেয়াদব লোক হাবিজাবি ওষুধ বানিয়ে আমার জীবনটা শেষ করে দিলো। এখন ট্যাবলেট না খেলে যদি আবার বর খাবার খাওয়া বাদ দেয় তাহলে তো খুব বিপদ। জানি না আজ রাতে আমার কপালে কী আছে! আবার সেই সোফাতে ঘুমানো। তা না হয় ঘুমালাম। কিন্তু চেপে ধরে যদি জোর করে ট্যাবলেট খাইয়ে দেয় তাহলে কী হবে? কী পাষাণকে বিয়ে করেছি আল্লাহ! তার মন গলিয়ে দাও প্লিজ!


লাঞ্চ এর সময় পেরিয়ে গেলেও সে বাসায় এলো না। অথচ শুধু আমার সাথে লাঞ্চ করবে বলে শত ব্যস্ততার মাঝেও সে আধা ঘন্টার জন্য হলেও বাড়িতে আসে। লাঞ্চ শেষে আমাকে শপথ করায় আমি যেন তার আবেশ নিয়ে এখন ঘুমিয়ে যাই। সেই মানুষটা আজ বাড়িতে এলো না। সকালেও খায়নি সে। বুকে অনেক কষ্ট চেপে রেখে কল করলাম। সে ওটিতে আছে তাই কল ধরলো না। আধা ঘন্টা পরে কল ব্যাক করে বলল-
__যদি ট্যাবলেট খাও তবেই লাঞ্চ করতে বাড়িতে যাব।

আমি কাঁন্না আটকে রেখে বললাম-
__তুমি কী কোনো কালেও আমার মন বুঝবে না?

সে কঠিন ভাবে বলল-
__তুমি তো আমার মন খুব ভালো বোঝো তাহলে এটা কেন করলে?

আমি কাঁন্না জড়ানো গলায় বললাম-
__আমি বেবি চাই তাই করেছি। মা হতে চাওয়া কোনো অপরাধ নয়।

ভারি গলায় সে বলল-
__স্বামীকে নেশার ওষুধ খাইয়ে পৃথিবীর কোনো মেয়ে এমন কাজ কখনও করেনি এটা আমি নিশ্চিত। তুমি আসলেই একটা ডাকুরানী।

মনে মনে বললাম, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠলে কী আর তোমাকে নেশার ওষুধ খাইয়ে মাতাল করতাম?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। পৃথিবীর কোনো পুরুষ এসব নিয়ে এমন রিয়্যাক্ট করে না। কী আজব মানুষের বউ আমি আল্লাহ!
বললাম-
__আমি ডাকুরানী এটা জেনেই প্রেম করেছো এবং বিয়েও করেছো। এখন এসব বলে কী লাভ? এসব বললেই তো আর আমি ডাকুরানী থেকে সরলারাণী হয়ে যাব না।

__তাই বলে স্বামীর ইচ্ছেটাকে তুচ্ছ করে দেখে ডাকাতি করবে?

আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম-
__প্লিজ খেতে এসো! আমার কষ্ট হচ্ছে। সবাই না খেয়ে আছে। সকাল থেকে আমরা কেউ খাইনি।

সে কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিলো ফোন। আমি রুমে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। একটা বেবির জন্য আমাকে এত কিছু সইতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বেঁচে থাকার কোনো মানেই নেই। কেন যে সে এত পাষাণ!


রাত এগারোটায় বাবা তাকে জোর করে ধরে বাড়িতে আনলেন। তারপর জোর করে খাইয়েও দিলেন। আমার বুকে যেন প্রাণ এলো।
ডিনার করে সে রুমে চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর দুরুদুরু বুকে আমিও রুমে ঢুকলাম। আমি রুমে ঢুকেছি সেটা টের পেয়েও সে আমার দিকে তাকালো না। কষ্টে বুকটা চেপে এলো। আমি মনে হয় পুরোনো হয়ে গেছি। আমাকে তার আর ভালোলাগে না। আবেগে চোখ ভিজে এলো জলে। এত আবেগ যে কোথা থেকে আসে বুঝি না!
অভিমানের সুরে বললাম-
__তুমি যখন চাও না তখন আমি অন্য রুমে থাকবো। আমার সব কাপড় চোপড় বের করে নিয়ে যাচ্ছি।

কথাটা বলেই আমি আমার কাপড় বের করার জন্য আলমারির দিকে এগিয়ে যেতেই সে ধমক দিয়ে বলল-
__একদম ঠ্যাং ভেঙে দেবো যদি রুমের বাইরে যাও। অপরাধ করে আবার ঢং দেখানো হচ্ছে। এসব বলে আমার মন গলাতে পারবে না।

এমন মানুষ জীবনে দেখা তো দূরে থাকুক, আমি কখনও শুনিনিও। কোনো নাটক সিনেমাতেও দেখিনি। সিনেমা নাটকেও বউকে মেঝেতে শোয়াতে দেখেছি কিন্তু ওদের তো বউ পছন্দ না তাই বউকে বিছানায় শুতে দেয়নি। কিন্তু আমি তো তার পছন্দের বউ। খাঁটি প্রেমের বিয়ে আমাদের। বিয়ের আগে আমরা ফিসফিস করে চুরি করে ফোনে কথা বলেছি। দুই পরিবারকে মানিয়ে তারপর বিয়ে করতে আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আর সেই প্রেমের স্বামী আমাকে সোফায় শোয়াচ্ছে। বউ অভিমান করেছে, কোথায় আদর টাদর করে মান ভাঙাবে। তা নয় ঠ্যাং ভাঙতে চাইছে। কতটা হৃদয়হীন হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে! আসলে আমার বেঁচে থাকার কোনোই অধিকার নেই।
অসহায় চোখে তাকিয়ে বললাম-
__তাহলে কী চাও তুমি?

সে নির্লিপ্তভাবে বলল-
__আমি যন্ত্রণা দেবো আর তুমি তা সহ্য করবে।

আমি কিছু না বলে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম তারপর সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আজব মানুষ একটা! নিজেও শান্তি পাচ্ছে না আর আমাকেও শান্তি দিচ্ছে না। কোথায় স্বামীর বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো, তা নয় সোফা নামক জাহান্নামে শুতে হলো। এই সোফা আবিষ্কার করেছিল কোন বজ্জাত? তাকেও তো ধোলাই করা উচিত। খুব ভালো হতো যদি সোফাটা এখন ভেঙে যেত। ভাঙবো নাকি? না থাক, এতে আরও রেগে যাবে। শেষে দেখা গেল সোফা ভাঙার দায়ে আমাকে ট্যাবলেট খেতে হলো। ওহ নো! সব শোধ নেবো আমি ডাকাতটার।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-৫)

আমাকে সোফায় শোয়ানো? মানি না মানবো না। হরতাল হবে, অন্বেষণ হবে। মিডিয়া ডাকবো, সবাইকে বলে দেবো। এক বোতলের বাকী সবটুকুও আমি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। বাহ্ এসব খেতে তো দারুণ দেখছি। আরও এক বোতল খাওয়া উচিত। কিন্তু আর তো নেই। দুঃখ তো শেষ হলো না, তার আগেই বোতল শেষ হয়ে গেল! আমার নিজেকে এতটাই হালকা লাগছে যেন আমি এখনি উড়ে যাব। এই আমি পাখি টাখি হয়ে গেলাম নাকি? আমার শরীর টলছে তো দেখছি। এমা আমি তো মাতাল হয়ে গেছি! আমি মেঝেতে দাঁড়িয়ে টলছি, হেলে দুলে ডান্স করার মতো। মেঝেতে ধাপ পড়ছে নাকি শূন্যে পড়ছে সেটা অনেকক্ষণ ধরে বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না। ধ্যাত্তেরি! যেখানে ইচ্ছে সেখানে ধাপ পড়ুক, আই ডোন্ট কেয়ার। এই রে, আমি সব কিছু দুইটা দেখছি। দুইটা বিছানা, কোনটায় শোবো? দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইটা দরজায় চারটা সীমান্ত দাঁড়িয়ে আছে। ওমা এত বর এলো কোথায় থেকে? আসল বর কোনটা তাহলে? বর কী তবে বরযাত্রী নিয়ে এলো নাকি? আমি তার দিকে তাকিয়ে মাতালের স্বরে বললাম-
__এই ডাকাত সুয়ামী তুমি কোনটা আসল গো?

সীমান্ত আমার অবস্থা দেখে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল। হাত ইশারা করে বললাম-
__আসল সুয়ামী কাছে এসো কুইক। নকল সুয়ামীগুলো দরজার বাইরেই থাকো। তোমরা ভেতরে আসবে না একদম। এলেই পিটাবো।

সীমান্ত রুমে ঢুকে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে গান ধরলাম-
“আমার ইচ্ছে করে ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে চড়িয়া
আমি তোমায় নিয়া প্রেম যমুনায় যাব ভাসিয়া….”
এই টুকু গাইতেই সে আমার মুখ চেপে ধরে আস্তে করে বলল-
__চুউউউপ।

আমি মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম-
__নো চুপ, কীসের চুপ? কেন চুপ? গান গাইতে দেবে না? ডাকাত ছেলে একটা। গান গাওয়া আমার নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, পারিবারিক অধিকার, বউগত অধিকার। অথচ তুমি গান গাইতে দিচ্ছো না। বাবাকে বলবো তোমায় পুলিশে দিতে। কাল থেকে তুমি জেলে থাকবে। এই বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা নেই। জেলে যাবার সময় সোফাটা সাথে নিয়ে যাবে। তুমি ওখানে সোফায় ঘুমাবে। এই ঐতিহাসিক সোফা আমি এই রুমে আর রাখবো না। ছাড়ো আমায়, আমি এখনি সোফাটা ভেঙে ফেলবো।

সে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল-
__এই তুমি কী খেয়েছো?

আমি হেচকি তুলে টলতে টলতে বললাম-
__তোমায় কেন বলবো হুম? তুমি কে জিজ্ঞেস করার? কাউকে বলবো না আমি কী খেয়েছি। আমার যা ইচ্ছে তাই খেয়েছি। আরও খাবো। রোজ খাবো। এখন এসো নাচবে তুমি।

সে চোখ কপালে তুলে বলল-
__মানে?

__মানে তুমি এখন নাচবে আর আমি দেখবো।

সে আগুন চোখে আমার দিকে তাকালো। যেন এখনই চোখ দিয়ে আমাকে ভষ্ম করে দেবে আর আমি ছাই হয়ে উড়ে যাব। সে ধমক দিয়ে বলল-
__চুপ একদম। যা মনে আসছে তাই বলছো তাই না? কাকে কী বলছো?

আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললাম-
__একটা নিষ্ঠুর পাষাণ রাগী ডাকাতকে বলছি। যে তার বউকে সোফায় শুইয়ে রাখে। আমার কত দুঃখ জানো?

আমি টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছিলাম, সে আমাকে ধরতেই আমি বললাম-
__নৌ একদম ধরবে না। ডোন্ট টাচ, ডোন্ট টাচ! আমি এখন নাচ দেখবো।

__তুমি ড্রিংক করেছো?

__করেছি। বেশ করেছি। আমার কষ্ট লেগেছে তাই করেছি। এখন সুখ লাগছে। তাই গান গাইব।

অনেক খুঁজে খুঁজে তারপর আমার শাড়ির আঁচলটা খুঁজে পেলাম। তারপর আঁচল কোমরে গুজে নিয়ে দু হাত নাড়িয়ে সারা ঘরময় নাচতে শুরু করলাম। গান ধরলাম-
“কাঁটা লাগা…..”

সে আবার আমার মুখ চেপে ধরলো। এই গুন্ডা তো দেখছি আমাকে গান গাইতেই দেবে না।
আমি আমার মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে বললাম-
__এই গুন্ডা তুমি আমাকে গান গাইতে দিচ্ছো না কেন? তুমি আসলেই একটা গুন্ডা। তুমি মোটেও ডাক্তার নও। আমি গান গাইবো ব্যাস।

সে নম্রভাবে বলল-
__কোনো গান নয়, এখন ঘুমাবে।

আমি আবার তার গলা জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে ফিসফিস করে বললাম-
__আমি তোমাকে ভালোবাসি গুন্ডা ছেলে।

সে আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। সে এমন করে তাকিয়ে আছে কেন? আমার অবস্থা দেখে কী তার কাঁন্না পাচ্ছে?
আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম-
__ কিন্তু তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না ডাকাত ছেলে। আমার মন ডাকাতি করে এখন তুমি ভালোবাসতেই ভুলে গেছো। এখন আমি কাঁদবো। কিন্তু কাঁন্নাই তো আসছে না।

সে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বলল-
__একটু শান্ত হও। এখন লেবুজল কোথায় পাই আল্লাহ্!

সে আমাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমি উঠে বসে গান ধরলাম-
“টিকাতলীর মোড়ে একটা হল রয়েছে….”

সে আবার আমার মুখ চেপে ধরে বলল-
__কী সব গান গাইছো হু। এসব কোথায় শুনেছো? ভদ্রঘরের বউরা এসব গান গায় কখনও? এতরাতে বাড়ির সবাই শুনলে কী ভাববে?

আমি মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে দিয়ে গাইলাম-
“সেই হলে নাকি এয়ারকন্ডিশন রয়েছে…”

সে আবার আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে শুইয়ে দিলো। সে শোয়াচ্ছে আর আমি বসছি। সে দিলো একটা বিকট ধমক। আমি চমকে উঠে ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম। চোখ মেলে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, আমি সোফার পাশে মেঝেতে পড়ে আছি। আমি এখানে কেন? আমি তো মাতাল ছিলাম। মাতাল হয়ে টলতে টলতে পড়ে গেছি নাকি? কিন্তু সে তো আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ছিল, এখানে এলাম কী করে? বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি সে শুয়ে আছে। আমার হুশ ফিরলো। ওরে আল্লাহ এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম? কী সুন্দর স্বপ্নের মধ্যে মাতাল ছিলাম। ভালোই তো লাগছিল। এত সুন্দর স্বপ্নটা ধমকে ভেঙে দিলো? ডাকাতটা স্বপ্নেও ধমক দেয়। কিন্তু ঐ গানগুলো আমি শিখলাম কোথায় থেকে?

__একি ফ্লোরে শুয়ে আছো কেন? ঠান্ডা লাগবে, সোফায় উঠো।
তার কথায় চেতনায় ফিরলাম। সে বিছানায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। মনে মনে বললাম, ঢঙের দরদ দেখাচ্ছে। চাই না দরদ। আমি মুখ ভেংচি কেটে বললাম-
__লাগুক ঠান্ডা, আমি ফ্লোরেই শুয়ে থাকবো। যে মেয়ের বিছায় ঠাই হয় না তার তো ফ্লোরেই শোয়া উচিত।

সে বসা থেকে শুতে শুতে বলল-
__বাংলা সিনেমার ডায়ালগ বাদ দাও। এসব বলে আমাকে পটিয়ে বিছানায় আসতে পারবা না। সুতরাং সোফাতে উঠে যাও।

আমি রাগ করে চেঁচিয়ে বললাম-
__চাই না তোমার বিছানায় শুতে। থাকো তুমি একাই তোমার ময়ূরপঙ্খী খাটে। আমি ফ্লোরেই ঘুমাবো। আর একদম আমার সাথে কথা বলবে না।

সে বিকট ধমক দিয়ে বলল-
__উঠো বলছি!

আমি এক লাফে সোফায় উঠলাম। পৃথিবীর কোনো মেয়ের বর এত নিষ্ঠুর নয়। আমার ভেউ ভেউ করে কাঁন্না পাচ্ছে। সে আর আমাকে ভালোবাসে না আল্লাহ গো!


পরের দিন রাতে সে হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন আগের সেই মানুষটা। আমি ডিনার করে রুমে ঢুকতেই সে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। আমি হতভম্ব হয়ে চুপ করে রইলাম। বুঝলাম ঘাপলা আছে। সে রাগ করলে এমনি এমনি তার রাগ পড়ে যায় না। আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় তার রাগ ভাঙানোর জন্য। আর সেই মানুষ হঠাৎই রাগ ভেঙে জড়িয়ে ধরে আছে। আমার ভয় ভয় লাগছে। এবার কী তবে বুকে চেপে ধরে রেখে জোর করে ট্যাবলেট খাওয়াবে নাকি? শালার ৭২ ঘন্টা শেষ হবে কখন?
সে মিষ্টি করে বলল-
__অনেক আদর করবো তোমায়। আর কখনও বকবো না আমার পাগলিটাকে। আমার অনেক ভুল হয়ে গিয়েছে সোনা। এই দেখো আমি কান ধরছি।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে চুপ করে আছি। তার বুক থেকে মাথা সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। হুট করেই তার মুখে এমন কথা আমি হজম করতে পারছি না। আমার যেন কেমন কেমন লাগছে। ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__দুই হাত দিয়ে তো আমাকে চেপে ধরে আছো তাহলে কান ধরেছো কী দিয়ে?

সে একহাত ছেড়ে দিয়ে তার কান ধরলো। তারপর বলল-
__এই তো কান ধরেছি। কী হলো? আদর চাও না?

আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নড়ালাম। সে আমাকে হতবাক করে দিয়ে বলল-
__৭২ ঘন্টা হতে আর মাত্র আধা ঘন্টা বাকী আছে। প্লিজ ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও সোনা!

যা ভেবেছিলাম তাই হলো। ডাকাত ছেলে এসব বলে আমাকে পটানোর চেষ্টা করছে। আমিও পটবো না কিছুতেই। আমি তার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে বললাম-
__আমি মা হতে চাই এটা কেন বুঝো না তুমি?

সে এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলল-
__আমি বাচ্চা চাই না এটা তুমি কেন বুঝো না?

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁজালো স্বরে বললাম-
__বুঝতেও চাই না। চুলোয় যাক তোমার ট্যাবলেট।

সে চরম রেগে গেল। পারলে এখনই আমাকে গুলি করবে। ধমকের স্বরে বলল-
__এর পরিণাম কিন্তু খুব ভয়ানক হবে বলে দিলাম।

আমি দৃঢ় স্বরে বললাম-
__হোক ভয়ানক। আমি ভয় পাই না। কাকে ভয় দেখাচ্ছো তুমি? আমি যে বরাবরই একটু বেশি সাহসী সেটা তোমার অজানা নয়।

রাগ করে গ্লাস ভেঙে সে নিজের হাত কেটে ফেলল কিন্তু আমাকে ছুঁতেও দিলো না। আমি অঝরে কাঁদছি তার হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়া দেখে। সে ওষুধ লাগাবে না আর ব্যান্ডেজও করবে না। বাধ্য হয়েই দৌড়ে গিয়ে মামনিকে ডেকে আনলাম। মামনি ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর বললেন-
__আমি জানি না তোদের মধ্যে কী চলছে। কেন এমন পাগলামি করছিস তোরা? আমাকে কী একটু শান্তিতে থাকতে দিবি না?

আমরা দুজন কেউ কোনো কথা বললাম না। মামনি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি সারারাত সোফায় বসে কেঁদে কাটালাম। আর সে বিছানায় বসে কাটালো।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here