ভালোবাসার প্রান্ত,৬,৭
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-৬)
সন্ধ্যায় নাস্তা রেডি করছি তখন নানান আমার কাছে দাঁড়িয়ে সীমান্তকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুচকি হেসে বললেন-
__শুনলাম তোমার রাজাসাহেব নাকি গতরাতে গ্লাস ভেঙে হাত কেটে “আই লাভ ইউ সোনাবউ” লিখেছে?
মনে মনে বললাম, সেই কপাল নিয়ে কী দুনিয়াতে এসেছি? রাগী টাইগারের বউ আমি, কেন হাত কেটেছে তা তো আর বলতে পারছি না। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
__তাকেই জিজ্ঞেস করুন কী লিখেছে। আই লাভ ইউ সোনাবউ লিখেছে নাকি আই কিল ইউ সোনাবউ লিখেছে!
সীমান্ত বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো। মনে মনে বললাম, এই কাজটা ছাড়া তো আর কিছু পারো না তুমি হুহ। বাঘ একটা!
নানান সীমান্তর দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন-
__বুঝলে ছোট রাণী, ভাবছি তোমায় নিয়ে লং ড্রাইভে যাব। তুমি তো লেখালেখি করো, গান গাইতে পারো তো?
__হ্যাঁ পারি তবে শুনতে কা কা মনে হয়।
নানান রোমান্টিক সুরে বললেন-
__কা কা হলেও চলবে। আমি সাগর তীরে তোমার নাম লিখবো।
আমি সীমান্তর দিকে তাকালাম। তার দৃষ্টি দেখে মনে হলো, “যেখানে ইচ্ছে যাও, তাতে আমার বয়েই গেছে।”পাষাণ স্বামী!
এমন রোমান্টিক মানুষের নাতি কাঠ হয় কী করে মাবুদ!
নানা বললেন-
__পাগল টাগল বিয়ে না করে সুস্থ কাউকে বিয়ে করতে পারতে ছোট রাণী। জীবনে মস্ত ভুল করেছো।
সীমান্ত নানানের দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন এখনি বোমা মেরে তাকে উড়িয়ে দেবে। নানানের কথায় আমি হেসে ফেললাম। সীমান্ত এবার আমার দিকে তাকালো। তার চোখ বলছে, এক বোমাতেই দু’জনকে উড়িয়ে দেবো। মরজ্বালা! হাসি পেয়েছে তাই হেসেছি, ইচ্ছে করে হেসেছি নাকি? এমন করে তাকানোর কী আছে হু?
⭐
এক সপ্তাহ সোফায় ঘুমানোর পরে সে আমাকে বিছানায় ঘুমানোর পারমিশন দিলো। কিন্তু মাঝখানে দুইটা কোলবালিশ দিয়ে চীনের প্রাচীর দিয়ে রাখল। এমন স্বামী আমার ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও নেই তা আমি শিওর। সোনায় বাঁধানো স্বামী আমার। রাগে দুঃখে মনে হলো কোলবালিশ দুটো ছিড়ে ফেলি। কোনো মতে নিজেকে কন্ট্রোল করলাম।
সে একটু ঘুমের মতো হলেই আমি কোলবালিশ সরিয়ে দিলাম। সে টের পেয়ে হংকার ছাড়লো। বাঘ একটা! শেষমেশ আমি একটা বাঘের বউ হলাম মাবুদ? এজীবনের কোনো মানেই নেই!
করুণ সুরে বললাম-
__বালিশ একটু সরালে কী হয়?
সে চোখ না খুলেই বলল-
__তোমায় করে কোনো বিশ্বাস নেই। একদম আমাকে টাচ করবে না।
আমি অভিমানের সুরে বললাম-
__একশ বার করবো।
__হাত ভেঙে দেবো।
__তাই দাও।
__তর্ক না করে ঘুমাও।
আমাদের বালিশময় জীবন চলছে। পারলে সে তার চারপাশ বালিশ কুশন দিয়ে ঘিরে রাখতে পারলে বাঁচে। রাগে আমি সোফায় গিয়ে শুলাম। সে হুংকার ছেড়ে বলল-
__সোফায় শোয়া যাবে না। যেখানে শুতে বলেছি সেখানেই শোবে।
আমি রাগ করে বললাম-
__দয়াকরে আমাকে ওয়াশরুমে শুতে বলুন জাহাপনা। এতে আমার অনেক উপকার হবে। আপনার রাজ্যও শষ্য শ্যামলে ভরে উঠবে।
আমার কথা শুনে মহারাজ এবার চোখ মেললেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
__তুমি ওয়াশরুমে শুলে রাজ্য শষ্য শ্যামলে ভরে উঠবে কেন? এই তুমি ওয়াশরুমে ধান গমের চাষ করবে নাকি?
মরজ্বালা! চাষাবাদ করবো এসব তো কখনও মনেও আনিনি। বললাম রাগ করে আর সে আমাকে কৃষক ভেবে বসলো? কৃষকের ফিমেল ভার্সন যেন কী? কৃষকী? ধুর ভুলে গেছি। বললাম-
__আমি সরিষার চাষ করবো। হলুদ ফুলে ভরে যাবে ওয়াশরুম। আমি সেখানে মনের সুখে শুয়ে থাকবো।
__তাহলে গোসলসহ অন্যান্য কাজ কোথায় হবে?
তার দুশ্চিন্তায় ভরপুর চোখমুখ দেখে অমার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসা যাবে না। আমি তো সিরিয়াস মুডে আছি। সত্যিই তো! গোসলসহ অন্যান্য কাজ কোথায় হবে? বললাম-
__সরিষার ক্ষেতে হবে।
সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল-
__কিহ?
আমি আর কিছু বললাম না। সে বলল-
__অনেক চাষাবাদ করা হয়েছে এখন ফাজলামি বাদ দিয়ে ঘুমাও।
আমি রাগ করে বললাম-
__ আমি সোফাতেই ঘুমাবো।
__একদম বেশি কথা নয়। এখনি বেডে এসে ঘুমাবে।
মনে মনে বললাম, কাঠ একটা! পাথর একটা! নিষ্ঠুর একটা! পাষাণ একটা! হৃদয়হীন একটা!
⭐
আব্বুর খবর নেবার জন্য সে নাটোরের বাড়িতে রোজ কল করে। তার বউ পর হলেও বউয়ের বাপ মা ভাই তার খুব আপন। আব্বু বলেছেন তার প্রেসার একটু বেড়েছে। এটা শুনেই সে রেডি হয়েছে নাটোর যাবে বলে। আমিও খুশি মনে কাপড় চোপড় গোছগাছ করে নিলাম। বাপের বাড়ি যাওয়া বলে কথা! আমি সেজেগুজে রুম থেকে বেরিয়ে শুনি সে চলে গিয়েছে। কেমন লাগে? দেখেছি মেয়েরা রাগ করে বাপের বাড়ি যায় কিন্তু কোনো ছেলে রাগ করে শ্বশুরবাড়ি যায় তা এই প্রথম দেখলাম। আমি শুধু অবাক নয় হতবাক হলাম। মামনি আমাকে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হা করে তাকিয়ে থেকে বললেন-
__তুইও ওর সাথে যেতে চেয়েছিলি নাকি?
আমি মন খারাপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বর আমাকে ফেলে একাই শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে, এই শরমের কথা বলি কী করে?
মামনি হয়তো বুঝেই ফেলেছেন। বললেন-
__আচ্ছা আমি কল করে তাকে বাড়ি আসতে বলছি। এখনো বেশি দূর যায়নি।
__লাগবে না মামনি। আসলে আমি তার সাথে যাবার জন্য রেডি হইনি। আমি একটু শপিং এ যাব।
__কার সাথে?
__তানির সাথে। হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে নিয়ে শপিংএ যাব।
মামনি হয়তো সত্যিটা বুঝে ফেলেছেন তাই বললেন-
__আচ্ছা ঘুরে আয় ভালোলাগবে।
আমার মন এতটাই খারাপ যে, আমার বের হতে ইচ্ছে করছে না। আর এমনিতেও শপিং করতে আমার ভালোলাগে না। কিন্তু মামনিকে এখন কী বলবো? বললাম-
__কিন্তু আমার এখন খুব মাথাব্যাথা করছে।বরং কাল যাব।
মামনি হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
__এমন করে তুই মন খারাপ করে থাকলে আমার যেন সব কিছু খালি খালি লাগে। এই বাড়িতে তুই ছাড়া সারাদিন আর কে থাকে বলতো? তুই হাসি আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে রাখিস বলেই তো আমরা ভালো আছি। আর সেই তুই যদি এমন করে মনমরা হয়ে থাকিস তবে আমরা কী করে ভালো থাকবো বলতো?
মামনির বুকে মাথা রেখে আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে খুব করে কেঁদে নিজেকে হালকা করি কিন্তু পারলাম না। আমাকে কাঁদতে দেখলে মামনিও কেঁদে ফেলবেন, এটা আমার জন্য আরও কষ্টের।
⭐
সন্ধ্যায় নানান এলেন। কার থেকে কী খবর পেয়েছেন জানি না। তিনি আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন-
__ছোট রাণী শুনলাম তোমার বর নাকি তোমাকে ফেলেই শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে?
কী লজ্জার কথা আল্লাহ! সব ঐ লাট সাহেবের জন্য। তার উপরে রাগে আমার শরীর খিটমিট করছে। আমাকে ফেলে গিয়ে সে নিশ্চয়ই আনন্দেই আছে। শ্বশুরবাড়ির আদর খাচ্ছে। আর আমি বিরহীনি হয়ে বসে আছি। থাকবো না আমি বিরহীনি হয়ে। বললাম-
__হ্যাঁ সে একাই গেছে।
__সে তো দেখছি ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছে। আমার এত বয়সে এমন ঘটনা আমি কখনও শুনিনি। কিন্তু তোমাকে ফেলে গেল কেন?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন-
__কতবার বলেছি, ও বান্দর শালাকে ছেড়ে দিয়ে আমার বাড়িতে চলো। তুমি হবে পাটরাণী আর বড়জন হবে সাধারণ রাণী। তুমি তো শুনলে না। এখন দেখছো তো বর কেমন ফেলে রেখে চলে যায়?
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__হু দেখছি।
__বিয়ে করার জন্য কোনো সুস্থ ছেলে পেয়েছিলে না? এমন আধা পাগলকে বিয়ে করলে, বিয়ের পরে সে হয়ে গেল ফুলপাগল। আমার মতো ফুলসুস্থদের তো কারও চোখেই পড়ে না।
এবার তার কথায় খুব হাসি পেলো। নানান এই বয়সেও কতটা হাসিখুশি থাকেন। সবাইকে আনন্দে মতিয়ে রাখেন। তার সাথে কথা বললে যেকারোর মন ভালো হয়ে যাবে। আমি নানানের দিকে মুচকি হেসে বললাম-
__আপনাকেও চোখে পড়ে তো। ঐ দেখেন আপনার রাণী ড্যাব ড্যাব করে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।
নানান নানুনের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন-
__এসব তাকানোকে আমি পাত্তা দিই না। শোনো কাল আমরা ঘুরতে যাব। ঐ শালা এসে যখন এসব শুনবে তখন সে জ্বলবে। ফারুককেও সাথে নেবো আমাদের ছবি উঠানোর জন্য। কিছু প্রমান তো রাখা উচিত, কী বলো ছোট রাণী?
আমি কিছু বললাম না। তিনি নানুনের দিকে তাকিয়ে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন-
__কোনো বয়স্ক মহিলাকে সাথে নেয়া যাবে না। এই ট্যুর শুধুই আমার ছোট রাণীর জন্য।
নানুন নানানকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন-
__কোনো বুড়োর সাথে ট্যুরে যাবার সাধ নেই আমার।
নানান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__ঐ ভদ্রমহিলা কী আমাকে বুড়ো বলল ছোট রাণী?
আমি পড়লাম মহাবিপদে। আমি আছি আমার স্বামীর দুঃখে আর ইনারা স্বামী স্ত্রী কথার যুদ্ধ শুরু করেছেন। যুদ্ধ অবশ্য ভালোই লাগছে। তাহলে আরেকটু বাঁধিয়ে দেয়াই যায়। নিষ্ঠুরটা যখন আমাকে ছেড়ে আনন্দেই আছে তখন আমিই বা বিরস থাকবো কেন?
নানানকে বললাম-
__আপনাকে বলেছে বলেই তো মনে হচ্ছে।
নানান ন্যাকা রাগ দেখিয়ে বললেন-
__কিহ তার এতবড় সাহস আমাকে বুড়ো বলে? আজ আমি গুলি করে সব উড়িয়ে দেবো। আমার বন্দুকটা কোথায়?
নানুন নানানের দিকে এগিয়ে এলেন তারপর তার সামনে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললেন-
__বুড়োকে বুড়ো বলবো না তো কী কিশোর বলবো?
নানান নানুরর দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন-
__ছোট রাণী তুমি এই ভদ্রমহিলাকে বলো তার সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তিনি যেন আমার সামনে থেকে সরে যান।
নানুন মুখ ভেংচি কেটে বললেন-
__আমি তোমার সামনে বসে থাকার জন্য সকাল থেকে কাঁন্নাকাটি করছি তো, হুহ।
নানুন দ্রুত সরে গেলেন। নানান বললেন-
__আজ আমি সব গুলি করে তছনছ করে দিয়ে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব ছোট রাণী। তাকে সাথে নেব না বলেই তো সে এমন জ্বলছে।
কথাটা বলেই তিনি হাহা করে হাসলেন এরমধ্যে তানি এসে বলল-
__কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমিও যাব তোমাদের সাথে।
নানান তানির দিকে তাকিয়ে বললেন-
__তোমার না বর আছে? বর ছেড়ে অন্যদের সাথে ঘুরবা কেন? ছোট রাণীর বর আপাতত নেই তাই তাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। তুমি বাদ ছোট গীন্নি।
__বাদ টাদ মানি না। আমি যাব ব্যাস। সাথে শপিং করাতেও হবে।
__তাহলে তো তুমি আরও আগে বাদ। আমি কোনো শপিংমল চিনি না।
__কিপ্টামি করবেন না নানান। তাহলে কিন্তু আপনার বন্দুক দিয়ে আপনাকেই গুলি করবো।
নানান ভয় পাবার ভান করে বললেন-
__কী সব অলক্ষুণে কথা বলছো ছোট গীন্নি?
ওদের এসব কোনো কথাই আমার ভালোলাগছে না। আর কোনো কথাও যেন আমার কানে ঢুকছে না। আমার সব হাসি আনন্দ উল্লাস সে সাথে নিয়ে নাটোরে চলে গিয়েছে। এতগুলো মানুষের ভীড়েও বড্ড নিঃসঙ্গ আর নিঃস্ব আমি।
সারাটা দিন কেটে গিয়ে রাত এলো। সে ঠিকঠাক পৌঁছেছে কি না সেটাও কল করে বলেনি লাট সাহেব। আমিও নিজে থেকে কল করবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। অমন হৃদয়হীন কাঠ তক্তাকে কল করে খবর নিতে আমার বয়েই গিয়েছে। কিন্তু ভেতরে একটা চাপা টেনশন কাজ করছে। এত দূরের পথ ঠিকঠাক পৌঁছেছে তো? ধুর একটু কল করে বললে কী হয়? আমাকে কল করলে কী তার জাত যাবে? গন্ডার একটা!
অস্থিরতার চরম পর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে আব্বুকে কল করে শুনলাম সে ঠিকঠাক পৌঁছেছে। স্বস্তির শ্বাস নিলাম। কিন্তু তার শূন্যতার তোলপাড়ে আমি যেন মরে যাচ্ছি। কী এক অবাধ্য হৃদয় দিয়েছো আমাকে মাবুদ! এত বয়স হলো তবু হৃদয় শক্ত পুক্ত হলো না। কেমন ল্যাকল্যাকেই রয়ে গেল।
পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna
“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-৭)
বেলকোণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভয়ানক একটা রাত দেখছি আমি। একলা এই রাতটা আমার কাটবে কী করে? তার কী একটিবারও মনে হয়নি যে, একা একা আমি কেমন করে থাকবো? আকাশ পাতাল ভেঙে আমার কাঁন্না আসছে। মুখে কোনো শব্দ করতে না পারলেও চোখ বাঁধ মানছে না কিছুতেই। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব কাঁন্না এসে আজ আমার চোখে বসেছে। আমার রুমে তানির গলার আওয়াজ পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর বারান্দা থেকে রুমে গেলাম। সে বিছানায় বসে আছে। আমি তার পাশে বসতেই সে বলল-
__বান্দর এটা কী করলো? তোমায় রেখে চলে যেতে পারলো?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। এমন ভান করলাম যেন কিছুই হয়নি। মুচকি হেসে বললাম-
__ফেলে যাবে কেন? আমাকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য কত অনুরোধ করলো জানো? আমার এখন নাটোরে যাবার মুড নেই তাই রাজী হইনি। সেই রাগেই তো সে একাই গেল।
তানি চোখ কপালে তুলে বলল-
__এই প্রথম শুনলাম বাপের বাড়িতে যেতে নাকি মেয়েদের মুড থাকে না। দেখো তো আমি কেমন রোজ আসি। নইলে তো ভালোই লাগে না।
আমি যে কী বলে সব ঢাকবো তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। সব কষ্ট কী ঢেকে রাখা যায়? তবুও চেষ্টা তো করাই যায়। বললাম-
__আমার বাপের বাড়ি ২২৭ কিলোমিটার দূরে। জার্নি করে গিয়ে দু’দিন লাগে শরীর ঠিক হতে। শরীর ঠিকমতো ঠিক না হতেই আবার ফিরে আসতে হয়। এদিকে আমার শরীরটাও তো ঠিক নেই।
__শরীরে কী হয়েছে? নতুন খবর টবর আছে নাকি?
আমি লাজুক মুখ করে বললাম-
__কী যে বলো না!
__অনেক রাত হয়েছে, আর কত বরের বিরহে বসে জেগে থাকবে? এসো ঘুমাবো। আজ তোমার জন্য বাড়ি ফিরে না গিয়ে থেকে গেলাম।
আমি বিষণ্ন মন নিয়ে বললাম-
__আমার ঘুম আসছে না, তুমি ঘুমাও।
কেউ না জানলেও আমি তো জানি যে আমার রাগী ডাকাত বরটা জেগে আছে। আর জেগে থেকে আমার ছবি দেখছে। তার এই গোপন ব্যাপারটা আমি ছাড়া তো আর কেউ জানে না।
তানি আমার গায়ে ঠ্যালা দিয়ে বলল-
__কী ব্যাপার সোনাভাবী, বর ছাড়া ঘুম আসছে না? নাকি বরের আদর ছাড়া ঘুম আসছে না?
আমি হুট করেই না বুঝে বলে ফেললাম-
__দুটোই।
তানি হতবাক হয়ে বলল-
__হাবলুটা জাদু টাদু করেছে নাকি তোমায়? সে এসব কবে শিখলো?
__বিয়ের আগে থেকেই জাদু করে রেখেছিল আমাকে। নইলে এমন পাষাণকে আমি বিয়ে করি?
__পাষাণ?
__হু
তানি দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বলল-
__ওহ মাই গড! এতো গভীর অভিমান দেখছি!
আমার খুব রাগ হচ্ছে সীমান্তর উপর। রাগ করেই বললাম-
__আই হেট হিম!
সে আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল-
__হয়েছে আর বলতে হবে না। এখন বলতো কী নিয়ে এই অভিমান চলছে?
আমি যেন আর লুকিয়ে রাখতেই পারছি না। শেষমেশ বলেই ফেললাম-
__সে নাটোরে যাবে শুনে আমিও যাব ভেবে কাপড় গুছিয়ে নিলাম। তারপর সাজতে বসেছি। সে এসব সব দেখেছে। অথচ সে আমাকে রেখেই চলে গিয়েছে। কেমন পাজি তোমার ভাই দেখো।
কথাগুলো বলে আমি আর কাঁন্না আটকে রাখতে পারলাম না।
তানি চোখ কপালে তুলে বলল-
__তুমি তো একটু আগে বললে সে তোমাকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল। তোমার মুড ছিল না তাই যাওনি। তাই সে রাগ করে একাই চলে গেছে।
আমি মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম-
__ওসব তো বানিয়ে বলেছি।
তানি হাহা করে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ রুমে নানুন ঢুকে বললেন-
__আমার ঘুম পেয়েছে আমাকে জায়গা দে তোরা।
তানি নানুনকে বলল-
__বড় রাণীসাহেবা আপনি কী এখানে ঘুমাবেন?
__হ্যাঁ। দুটো কম বয়সী মেয়েকে একা একটা রুমে রাখা যায় নাকি? আমি তোদের পাহারা দেবো।
__আপনি এই রুমে ঘুমালে তো কিছুক্ষণ পর আপনার বরও এখানেই ঘুমাতে চলে আসবেন।
__এই বুড়ো বয়সে সে বউয়ের পিছু নেবে না।
__প্রেম করার জন্য পিছু না নিলেও ঝগড়া করার জন্য ঠিকই পিছু নেবে।
তানির কথা শেষ হবার আগেই মামনি তূর্য্যকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে বললেন-
__সবাই সর তূর্য্যকে শোয়াবো।
আমি আর তানি হা করে তাকিয়ে রইলাম।
মামনি তূর্য্যকে কোলে ঢুকিয়ে নিয়ে শুলেন। তার পাশে নানুন শুয়ে পড়লেন। বিছানাতে যেটুকু যায়গা আছে তাতে আমি আর তানি বসে আছি।
তানি বলল-
__আমরা দুজন তাহলে কোথায় ঘুমাবো?
নানুন বললেন-
__ফ্লোরে ফোম পেতে ঘুমা।
আমি আর তানি একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ফ্লোরে ফোম পেতে সুন্দর বিছানা করলাম। হঠাৎ আমান ভাই এসে ফ্লোরের বিছানায় শুয়ে বললেন-
__বাহ দারুণ আরাম। ঘুম চলে আসছে।
তানি চোখ পাঁকিয়ে বলল-
__তুমি এই রুমে কেন? যাও আমাদের রুমে গিয়ে ঘুমাও।
__আমি একা ঘুমাবো নাকি? আমি এখানেই ঘুমাবো।
আমি ফিসফিস করে তানিকে বললাম-
__তানি তুমি বললে নানুনের পিছু নিয়ে নানান আসবেন। এখন দেখি তোমার বর তোমার পিছু নিয়ে চলে এসেছে।
আমান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
__একটা কোলবালিশ দিও তো নানানের ছোট রাণী।
আমি অন্যরুম থেকে কোলবালিশ আনতে গেলাম। এসে দেখি আমান ভাইয়ের পাশে বাবা শুয়ে আছেন। কিছু বলার আগেই নানান রুমে ঢুকে আমার হাত থেকে কোলবালিশ নিয়ে আমান ভাইকে বললেন-
__নাতনি জামাই সরে শোও। আমি মাঝখানে শোবো।
আমান ভাই সরে শুয়ে বললেন-
__কোলবালিশটা আমাকে দেন নানান!
__উহু, এটা আমার।
আমান ভাই আর নানান কোলবালিশ ধরে টানাটানি করছেন। বাবা উঠে বসে বললেন-
__এটা বালিশ খেলা নাকি?
আমান ভাই আর নানান বাবার দিকে হতবাক হয়ে তাকালেন। তানি আর আমি তো সেই কখন থেকেই হতবাক হয়ে আছি। আমি আর তানি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের শোবার জায়গা নেই। এতবড় বাড়িতে এতগুলো রুম থাকতে সবাই এসে আমার রুমে শুয়েছে। এটা কোনো কথা হলো? আনন্দে আমার চোখে জল এলো। এটাকেই বোধহয় চাঁদের হাট বলে। অথচ আমার জীবন আকাশের চাঁদটাই এখানে নেই। বুকের ভেতরে হুহু করে উঠলো।
আমি আর তানি সোফায় বসে আছি। বসে থেকেই আজ আমাদের ঘুমাতে হবে। অবশ্য আমার আজ ঘুম কিছুতেই আসবে না। কিছুক্ষণ পর মামনি উঠে বসে আমাকে আর তানিকে বললেন-
__কী রে তোরা বসে আছিস কেন?
তানি বলল-
__আমাদের শোবার জায়গা নেই, আমরা এখন রহিঙ্গা।
নানান শোয়া থেকে উঠে বসে বললেন-
__সবাই উঠে বসো। আজ ঘুমানো হবে না। আমরা গল্প করে রাত শেষ করবো।
তিনি বাবাকেও টেনে বসালেন। সবাই বসে আছে শুধু নানুন শুয়ে। নানান বললেন-
__বুড়ি ভদ্রমহিলা কাকে বলে তা নিজের চোখে দেখো। একটা রাত জেগে থাকার শক্তি নেই এই ভদ্রবুড়ির।
নানুন লাফ দিয়ে বসে বললেন-
__আমার তো ভিমরতিতে ধরেনি। তোমার ধরেছে তুমি বসে থাকো।
নানান মুচকি হেসে বললেন-
__বললাম কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। এই তোমাকে কখন কী বললাম আমি? আমি তো একটা ভদ্রবুড়িকে বলেছি।
নানুন বললেন-
__সবাই জানে কাকে বলছো।
নানান আদেশের ভঙ্গিতে বললেন-
__এখন তোমার কাজ হলো মুড়ি মেখে আনবে। যাও উঠো!
__পারবো না এই রাত একটায় মুড়ি মাখতে।
নানান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__দেখেছো ছোট রাণী কেমন অবাধ্য বউ উনি।
বললাম-
__আমি মুড়ি মেখে আনছি।
নানান রোমান্টিক চোখে তাকিয়ে বললেন-
__এজন্যই তো তোমাকে পাট রাণী করতে চাই। বান্দরটা শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরুক। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি তার বউকে তুলে নিয়ে যাব।
মনে মনে বললাম, সেই যুগে আমি জন্ম নিলে ঐ ডাকাতকে নয় আপনাকেই বিয়ে করতাম। আর ডাকাতটা সম্পর্কে আমার নাতি হতো, ভাবা যায়! যায় যায়। সে আমাকে নানুন বলে ডাকতো? ওহ নো!
⭐
মুড়ি মেখে আনলাম। নানান বললেন-
__ছোট রাণী এবার তোমাদের প্রেম কাহিনীটা সবাইকে বলো শুনি।
আমি উদাসীন সুরে বললাম-
__গত এক বছরে অনেকবার বলা হয়ে গিয়েছে তো নানান। আর বলতে ইচ্ছে করে না।
নানান ভুলে যাবার ভান করে বললেন-
__আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না, কী কী যেন বলেছিলে?
আমি নির্লিপ্ত ভাবে বললাম-
__আপনার বান্দর নাতি পাঠক ছিল আর আমি লেখিকা ছিলাম। বাকী আর কিছু আমারও মনে নেই।
নানান ভাষণের মতো করে বললেন-
__এখানে উপস্থিত আমি ব্যতিত সবারই বিয়ে প্রেম করে হয়েছে। আমার একমাত্র মেয়ে রুবা তো কঠিন অন্বেষণ করেছিল। পাভেলকে ছাড়া সে অন্যকাউকে বিয়েই করবে না। আমিও কঠোর, আমার মেয়েও কঠোর। কী মজবুত ভালোবাসা!
নানানের কথা শুনে মামনি ব্যস্ততার ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরালেন। বাবা কী যেন খোঁজার জন্য বালিশ আর বিছানা উল্টিয়ে তোলপাড় শুরু করলেন। নানান কী যেন ভেবে কথা আর এগুলেন না। তিনি তানির দিকে তাকিয়ে বললেন-
__তুমিও তো কম যাও না প্রেয়সী! প্রেমে তো ডুবে গিয়েছিলে। তোমার প্রেমের ইতিহাসটা বলো সবাইকে।
তানি অবাক হবার ভান করে বলল-
__আমি আবার কবে প্রেম করলাম? আমান একাই আমাকে ভালোবেসে মরে যাচ্ছিল তাই মায়া হলো আর বিয়ে করলাম।
তানির কথা শুনে আমান ভাই নড়েচড়ে বসে হা করে তানির দিকে তাকিয়ে রইল। তানি এমন ভাব করলো যেন সে সব সত্যি বলছে।
নানান বললেন-
__তুমি তো কিছুই করো নাই, নাতনি জামাইয়ের সাথে তাহলে প্রেমটা বোধহয় আমিই করেছি। কী বলো নাতনি জামাই?
কথাটা বলেই নানান আমান ভাইয়ের দিকে তাকালেন। সবাই হাসতে শুরু করলো। আমিও হাসলাম কিন্তু আমার পাগলটা কী করছে এখন?
তানি ফিক করে হেসে বলল-
__আমি কিন্তু একটা সিক্রেট জানি।
সবাই উৎসুক চোখে তানির দিকে তাকালো। নানান বললেন-
__কী সিক্রেট?
__জনৈক এক লেখিকার প্রেমে জনৈক এক ডাক্তার কেমন হুড়মুড় করে পড়েছিল তার শুরুটা একমাত্র আমিই জানি। যেটা সয়ং লেখিকাও জানে না।
নানান উৎসাহ নিয়ে বললেন-
__তাড়াতাড়ি বলো।
তানি বেশ ভাব নিয়ে বলল-
__শপিং করে দিলে বলবো।
__ঠিক আছে করে দেবো। এখন তো বলো প্রেয়সী।
তানি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমি হতভম্ব হয়ে তানির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna