ভালোবাসার রংধনু,পর্ব-১০,১১
sinin tasnim sara
১০
(১৭)
সেদিনের ঐ ঘটনার পর সব অকস্মাৎ সব চুপচাপ হয়ে যায়। সেই বিকেলের পর ইনতিসারকে আর একবারের জন্যেও বাড়িতে দেখিনা আমি। হয়তোবা নিজের ঘরে থাকতো কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছিলো। সে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি আর। আপার ওপর চাপ সৃষ্টি করে হোস্টেলে উঠতে চেয়েছি কিন্তু আপা কোনোভাবেই আমার জিদ আমলে নেয়নি । দাঁত কামড়ে পড়ে থেকেছি ওখানেই। তারপর এলো পরীক্ষার সময়। জোর করে সব দূর্ঘটনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো। আপাও আর টু শব্দ করলো না এ ব্যাপারে। চারদেয়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা চারদেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে আমরা স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। একে একে আমার পরীক্ষা শেষ হলো, ইনতিসারের ওপর রাগটাও অল্প অল্প করে কমতে শুরু করলো। সময় বাড়ার সাথেসাথে উপলব্ধি করলাম এ ঘটনার পেছনে সম্পূর্ণ দোষ তো ওকেও দেয়া যায়না। কোন পারপাসেই বা দোষারোপ করবো আমি? ও তো মানুষটা আগাগোড়াই এরকম। ভেবেচিন্তে কোনোকিছু করেনা। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়ে এসেছে। কখনো কোনো জিনিসের জন্য স্ট্রাগল করতে হয়নি। আমার কাছে যা দুঃসাধ্য তা ওর কাছে কখনোই দুঃসাধ্য হবার কথা নয়। কেনই বা দুঃসাধ্য হবে! ওর জীবনে দুঃসাধ্য বলে কখনো কিছু ছিলো কি! ছিলো না। তাহলে ও আমার মতো জটিল চিন্তা করবে কেন?
এরকম নানা প্রশ্ন তৈরি হতে থাকলো আমার মনে। ঐ ঘটনাটা নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিলাম বারবার। তখন হঠাৎ ইনতিসারের খোঁজ করতে ইচ্ছে হলো। একদিন সাহস করে আপাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর ব্যাপারে। প্রথমে আপা থম মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে তারপর ধীর গলায় বলল,
— এতকিছুর পরেও মাথা থেকে বের করতে পারিসনি ওকে?
— সেদিন হয়তোবা একটু বেশিই বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলাম আপা। ব্যাপারটা ভাবলে কেমন যেন লাগে।
— ভাবতে হবেই বা কেন! যা হবার হয়ে গেছে। ওসব মাথায় এনে আবারও ঝামেলায় জড়াতে চাস?
— কোনো ঝামেলাতেই জড়াতে চাইনা আপা। শুধু খোঁজ নিতে চাচ্ছিলাম এই আরকি!
— খোঁজ নেয়াটাও স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয় নীরদ৷ সত্যি করে বল তো ইনতিসারের প্রতি তোর কোনো অনুভূতি আছে?
— ছিঃ আপা কিসব বলছো! এসব নিয়ে কখনোই চিন্তা করিনা আমি।
— চিন্তা না করাই উচিৎ। তোর জীবনটা আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নয়। জীবন সম্পর্কে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে এই বিষয়টা মাথায় রাখবি।
— থাকে আপা সবসময় মাথায় থাকে। আমার জীবনের অমোঘ সত্যি চাইলেই কি ভুলতে পারবো অথবা অস্বীকার করতে পারবো আমি? পারবো না৷
মৃদু হেসে বলি। আপা বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখে আমাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
— সেদিন একটু বাড়াবাড়ি করেছিলি বটে তবে সেটা হয়তোবা তোদের দুজনার জন্য ভালোই হয়েছে। খুব আত্মাভিমানী ছেলে ইনতিসার। অতগুলো কথা শোনবার পর কি আগের মতো সহজ স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারতো এখানে? চলে গেছে ও বাড়ি ছেড়ে।
অস্বাভাবিক কথাটা কত স্বাভাবিকভাবে বলে দিয়েছিল আপা। চমকে উঠেছিলাম আমি।
— বাড়ি ছেড়েছে? কথাটা এত স্বাভাবিকভাবে বলছো তুমি? ও আমার জন্য নিজের বাড়ি ছাড়লো?
— স্বাভাবিকভাবে বলছি কারণ ব্যাপারটা আমাদের কাছে আসলেই স্বাভাবিক। ইনতিসারের অভ্যেসই এরকম। যখন যেটা মন চায় তখন সেটাই করে ও। এর পূর্বে অনেক বারই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থেকেছে।
— কিন্তু আপা…
— চিন্তার কিছু নেই। খোঁজ নেয়া হয়েছে৷ বড় ভাইজানের কাছে গেছে ও।
— বড় ভাইজান মানে তোমার ভাসুর? উনি তো দেশের বাইরে থাকেন আপা।
— হু।
— আমার ওপর রাগ করে দেশের বাইরে চলে গেল ইনতিসার?
— হু। গেল। যেতে দে। বিষয়টা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করিস না। এটাই ঠিক তোদের জন্য। দূরে থাকলে সেদিনের বাজে ঘটনাটা ভুলতে পারবে ও৷
এরকম নানা কথাবার্তা বলে আপা বোঝালো আমাকে, ওর দূরে যাওয়াটাই আমাদের দুজনার জন্য মঙ্গলকর। আপার বোঝানোয় আমিও হয়তোবা বুঝলাম। কিন্তু কোথাও একটা অপেক্ষা ছিলো ইনতিসারের ফেরার । আমার জন্য ও নিজের বাড়ি-ঘর, দেশ সব ছাড়লো ব্যাপারটা যন্ত্রণা দিতো আমাকে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের উপায় খুঁজছিলাম হন্যে হয়ে। ওকে স্যরি বললে কি সব সমাধান হয়ে যাবে? নাকি কোনো একদিন সামনাসামনি বসে শান্তভাবে কথা বলে ওর পাগলামোর সমাধান বের করবো? এসব ভাবতাম সবসময়। কিন্তু ভাবনার অন্ত কখনোই খুঁজে পাইনি। বেশ কিছু সময় ভুগেছি এসব নিয়ে৷ আপা হয়তোবা লক্ষ্য করেছিল আমার অস্বাভাবিকতা৷ তাই আবারও একদিন সময় নিয়ে বোঝালো আমায়৷ ইনতিসার ওখানে গিয়ে থেমে নেই । জীবনের গতিটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে৷ লেখাপড়া শুরু করেছে ওখানে। তার এখন নিজের জীবন নিয়ে আলাদা একটা ভাবনা আছে। যে ভাবনার মধ্যে আমার স্মৃতি আর কোথাও নেই। দেশ ত্যাগের সাথে সাথে আমার জন্য গড়ে তোলা পাগলাটে অনুভূতিরও ত্যাগ করেছে ও।
ও যদি সব ভুলে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে আমি কেন থেমে থাকবো?
আপার কথা ছিল এটা। পরবর্তীতে আমিও চিন্তা করি, কম বয়সের এক পাগলামিকে ধরে বসে থেকে নিজের ক্ষতি করার তো কোনো মানে হয়না। এরপর আর আমিও মনে রাখতে চাইনা ওকে, ওর ভালোবাসাকে। সেদিনই মন, মস্তিষ্ক সব জায়গা থেকে মুছে যায় ও। ওর কোনোপ্রকার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে হয়না আর। আপা তবুও সময়ে-অসময়ে ওর ছবি দেখাতো, ও কতখানি ভালো আছে তার গল্প করতো। চুপচাপ দেখে একটুখানি মৃদু হাসি দিয়ে চলে আসতাম আমি।
তখন থেকেই জেনে এসেছি ও আর আমাকে নিয়ে ভাবেনা৷ হয়তোবা ঘৃণাও করে। কিন্তু না আমি যে আবারও ভুল প্রমাণিত হলাম। হিসেবে গড়বড় হয়ে গেছে অনেকবড় । সম্পূর্ণ আনপ্রেডিক্টেবল একটা মানুষ ইনতিসার । ঘৃণা তো দূর আমাকে ভালোবাসাই ছাড়তে পারেনি ছেলেটা । মনের রাগটাকে অভিমানে পরিণত করেছে। এটা কি হওয়ার কথা ছিলো? কেন ও আমার সাথে জড়িয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে চাইছে বুঝতে পারছি না। ও কি এতবছরেও বুঝে উঠতে পারেনি এ সম্পর্ক কারোর কাছেই স্বীকৃতি পাওয়ার নয়৷ দুলাভাই জানতে পারলে আপার ওপর ভয়ানক বিপদ নেমে আসবে । আমি কখনোই চাইনি আমার জন্য আমার বোনের কোনোপ্রকার ক্ষতি হোক ।
বয়সটা আমার আবেগে ভেসে যাওয়ার ছিলো, ওপাশের একটু কাতর চাহনি আর গলে যাওয়ার ছিলো, কই যাইনি তো। খুব করে সামলেছি নিজেকে। ওকে প্রত্যাখ্যান করবার সময় কষ্ট তো অনুভূত হয়নি, স্রেফ ভয় পেয়েছিলাম। মাথার ওপরের ছাদটা হারানোর ভয়, এছাড়া কোনো অনুভূতি জাগেনি। তখন থেকেই ভাবনাটা আত্মকেন্দ্রিক ছিলো। যার কষ্টেও এক মুহুর্তের জন্য প্রভাবিত হয়নি, যার জন্য আমার মনে একটুখানিও জায়গা নেই তার সমস্ত মন জুড়ে কেবল আমারই বসবাস কেন?
লোকে বলে, প্রেমে পড়লে মানুষ চিন্তাশক্তি হারায়। সেও নিশ্চয়ই সমস্ত চিন্তাশক্তি হারিয়ে বসে আছে। নইলে এই ক’বছরে আমাদের সম্পর্ক গড়ে না ওঠবার পেছনের কারণ ঠিকই উপলব্ধি করতে পারতো এবং আমাদের দু’জনার মঙ্গলের জন্যই ভুলে যেত আমাকে।
এতটা সময়ের অপরিবর্তনীয় অনুভূতি তাহলে কি আমাকেই মুছে দিতে হবে ওর মন থেকে? মুছে দেয়ার উপায় তো ঐ একটাই, আবারও আঘাত করতে হবে শক্ত প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে । করবো, তাই করবো। এ-ই ঠিক, এ-ই উচিৎ।
— ভালোবাসা কি এভাবে জোর করে পাওয়া যায় ইনতিসার?
হাল ছেড়ে দিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধলাম আমি।
— এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয় নীরদ।
— আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।
— বাধ্য তুমি বাধ্য। হয় আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে নয়তো আজই এই মুহুর্তে আমায় বিয়ে করবে তুমি ।
অস্থিরভাবে বলল ও। খুব বিরক্ত লাগলো আমার৷
— আবারও ঐ এক কথা!
— হ্যাঁ এক কথা। জোর জবরদস্তি না করলে তোমার সাথে পেরে ওঠা সম্ভব?
— আপনি যতই জোর করার চেষ্টা করুন না কেন আপনাকে কখনোই অ্যাকসেপ্ট করবো না আমি।
— করবে। বিয়েটা হয়ে গেলেই করবে।
— বিয়ে কি ছেলেখেলা?
রেগে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম ইনতিসারকে। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না। বজ্র আলিঙ্গনে যেন বন্দী করে নিয়েছে আমায়৷ বৃথা চেষ্টা কিছুক্ষণ দেখলো চুপচাপ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব নরম সুরে বলল,
— আমি এই বাড়ির ছেলে, তোমার বোনের দেবর এটাই তোমার সমস্যা তাইনা নীরদ? তুমি ভাবো আমাকে অ্যাকসেপ্ট করলে তোমার বোনের সংসার ভাঙবে, লোকে তোমাদের পরিবারকে লোভী বলবে। এজন্যই আমাকে ইগনোর করো তাইনা?
সত্যিটা তাহলে ও আবিষ্কার করে ফেলেছে! এভাবে ওর মুখে নিজের ভাবনা শোনামাত্র ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম আমি। পুনরায় মুখ ফিরিয়ে প্রশ্নটাকে এড়ানোর চেষ্টা করলাম পুরোদমে।
আমায় মুখ ফেরাতে দেখে ইনতিসারের ভীষণ রাগ হলো। কড়া স্বরে বলল,
— মুখ ফেরাবে না নীরদ। সত্যের মুখোমুখি হলে এভাবে মুখ ফেরাবে না। সত্যকে সাহসের সাথে মাথা উঁচু করে স্বীকার করতে শেখো।
— কিসের সত্য? মনগড়া দু’টো কথা বললেই তা সত্য হয়ে গেল নাকি!
— তাহলে সত্য কোনটা? তুমিই বলে দাও।
— সত্য, সত্য শুনতে চাইছেন তো? তাহলে শুনুন, আমি আপনাদের মতো লোক দেখানো উঁচু বংশীয় লোকদের ঘৃণা করি। বাইরে আপনাদের চাকচিক্য আর আভিজাত্যের ছড়াছড়ি অথচ ভেতরটা ভীষণ নোংরা আর কলুষিত। বোনের সংসারের কথা বলছেন তাইনা? আরেহ্ ঐ সংসার ভাঙার ভয় কি করবো! সংসার তো আগে থেকেই ভেঙে বসে আছে।
আমার কথায় ইনতিসারের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
— আপনার মেজো ভাই ফেরেশতা না আপনাদের চোখে? ওর আসল সত্যি আমার বোনকে জিজ্ঞেস করুন। ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকা নোংরা কিট একটা। সুন্দরী বউ, ফুটফুটে ছেলে ঘরে থাকতেও বাইরে অন্য মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়ায়। আমার বোনের সব স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে দিয়ে দু টাকার ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে বউ করে এনেছে এবাড়িতে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে অত্যাচার। কে জানে কতবছর থেকে ওই অমানুষের অত্যাচার সহ্য করে আসছে আমার বোনটা। এক মুহুর্তের জন্যেও বুঝতে দেয়নি আমাকে।
— এসব কি উল্টোপাল্টা কথা বলছো নীরদ? কার সম্পর্কে কথা বলছো আইডিয়া আছে?
— একটা নোংরা কিটের সম্পর্কে কথা বলছি যে দূর্ভাগ্যবশত আমার বোনের হাজবেন্ড হয়। হাজবেন্ড, ভালোবাসার মানুষ! যার হাতে প্রতিনিয়ত মার খায় আমার বোন।
— মেজো ভাই ভাবিকে মারে?
অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল ইনতিসার।
— মারেনা তো আমার বোনের গায়ে একহাত লম্বা বেল্টের আঘাতের চিহ্নগুলো এলো কীভাবে? চৌদ্দ হাত শাড়ির আস্তরণে ঢেকে রাখলেই সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারবে ওর মনে হয়? যার চোখে পড়বার দরকার ছিলো পড়ে গেছে। আমার বোন তো এটাও জানেনা ওর ফেরেশতা সাজিয়ে রাখা হাজবেন্ডকে তার বাজারু গার্লফ্রেন্ডের সাথে কয়েকদিন আগেই রাস্তায় ঢলাঢলি করতে দেখেছি আমি।
এই যে এতকিছুর পরেও ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস রাখব আমি? যার ভাই পশুর চাইতেও অধম সে নিজে কেমন হবে এবং তার ভালোবাসা কেমন হতে পারে জানা আছে আমার।
তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম আমি। এবারে যেন ধীরে ধীরে শক্ত আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে থাকলো আমায় ইনতিসার। দু কদম পেছনে সরে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল,
— তুমি সত্যি বলছো তো নীরদ? আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কিছু বলছো না তো?
— আপনাদের মতো নোংরা লোকদের নিয়ে বানিয়ে বলতেও আমার বাঁধবে।
মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভেতর দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম আমি। অল্প কিছুদূর গিয়ে আবারও দাঁড়িয়ে বললাম,
— বেশিদিন আমার বোনকে এই জাহান্নামে রাখবো না আমি। খুব শীঘ্রই ওকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। মাফিনকে যদি একমুহুর্তের জন্যেও ভালোবেসে থাকেন তাহলে দেখে রাখবেন আমার বোন আর ভাগ্নেকে।
— নীরদ দাঁড়াও।
পেছন থেকে ডেকে উঠলো ইনতিসার। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আমার হাত টেনে ধরে নিয়ে গেল পূর্বের স্থানে।
— তোমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে নীরদ তাহলে মেজো ভাইকে আমরা অবশ্যই শাস্তি দেব। ভাবিকে মুখ বুঁজে অন্যায় সহ্য করতে দেব না৷ তোমার সহযোগিতা চাই আমার।
— আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে রাজি নই। ওর যা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হয় তা আমি নিজেই করতে পারবো। কোনো মিষ্টি কথায় আমাকে বশ করে রাখতে পারবেন না আপনারা। একবার শুধু এই বাড়ি থেকে বের হই । তারপর দেখুন কি অবস্থা হয় আপনার ভাইয়ের।
— তুমি সবসময় আমাকে ভুল বুঝেই গেলে নীরদ। মেজো ভাই যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে ওর অন্যায়ের ওপর পর্দা দেওয়ার চেষ্টা করবো কেন আমরা? ওকে যেমন ভালোবাসি, ভাবিকেও ঠিক তেমনই ভালোবেসেছি সবসময়।
— আপনাদের ভালোবাসা! সব লৌকিকতা। চোখের পলকে পাল্টে যায়।
— তুমি সবাইকে এক দাঁড়ি পাল্লায় মাপতে পারোনা। মেজো ভাই কেবল আমার ভাই বলে তার আর আমার চরিত্র এক হবে এমন কোনো কথা নেই।
— আপনাদের মতো থার্ডক্লাস বড়লোকদের সবারই চরিত্র এক। আপনাদের ভালোবাসা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এবং আমি আপনাদের ভীষণ ঘৃণা করি। ভীষণ।
— তোমার সব ঘৃণা তো শুধু আমার বেলাতেই নীরদ৷ তোমার চোখে কেবল আমিই চরিত্রহীন৷ আর ঐ প্রীতম ওর চরিত্র ঠিকঠাক তাইনা?
— মানে! প্রিতম এখানে কোথা থেকে আসছে?
— প্রিতম আসবে অবশ্যই আসবে। ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলে না তুমি? ডেইটে গিয়েছিলে আজ। ওর ক্লাস আর চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে তো?
— সেটা আমার পারসোনাল ব্যাপার। আপনাকে এটা নিয়ে ভাবতে হবেনা।
— তুমিও আমার পারসোনাল ব্যাপার নীরদ। কেবল আমার মানুষ তুমি। তোমার লাইফের ভালোমন্দ সব সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে।
— সে অধিকার আমি আপনাকে দিইনি।
— তুমি না দিলেও এই ইনতিসারের মন যেদিন তোমার ওপর এসে গিয়েছিল সেদিনই তার অধিকার প্রাপ্তিও হয়ে গেছে। আমার সম্পর্কে তোমার সব ভুল ধারণা একদিন ভাঙিয়েই ছাড়বো আমি নীরদ। সেদিন তুমি বাধ্য হবে আমায় ভালোবাসতে। জেনে রেখো ইনতিসার তার ভালোবাসা আদায় করতে ঠিক জানে।
চলবে,
sinin tasnim sara
ভালোবাসার রংধনু
১১
________________
(১৮)
এই বাড়িতে এসেছি থেকে আপা আর দুলাভাইয়ের সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি। আপাও সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কয়েকমাস যাবৎ ওর আচার-আচরণে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করছিলাম। ওর অনেক কথাই বুঝিয়ে দিতো
সংসার জীবনে ও সুখী নয় । শুরু শুরুতে বিশ্বাস হতো না নিজেরই। যে আপা ভালোবাসার খাতিরে নিজের সমস্ত স্বপ্ন, শখ- আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দুলাভাইয়ের হাত ধরেছিল তার সংসারে অশান্তি হবে! বিষয়টা অদ্ভুত, মানতে চাইতাম না। তাছাড়াও দুলাভাই আমাদের সকলের সামনে আপার এত কেয়ার করতো, মাফিনের যেন আদর্শ বাবা। অমন মানুষের সাথে অশান্তি হওয়ার কথা নয়। ছোটখাটো ঝগড়া ভেবে বিষয়টা প্রথমে আমলে নিইনি। কিন্তু দিন গড়ানোর সাথে যখন আপার বিতৃষ্ণা বেড়ে যাচ্ছে উপলব্ধি করলাম তখনই খটকা লাগলো আমার। চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের দু’জনকে। ওদের ওপর সূক্ষভাবে নজর রাখতে গিয়ে মনে হলো দুলাভাইয়ের দিকটা যেমন দেখা যায় বাস্তবিকপক্ষে সে ঠিক তেমন নয়৷ তার আচরণে ততটা আন্তরিকতা থাকেনা যতটা সে দেখানোর চেষ্টা করে অথবা আমি মনে করতাম। আপার খোঁজ খবর তেমন নেয়না বললেই চলে। কেয়ার বলতে সকালে খাওয়ার টেবিলে কিংবা রাতে ডিনারের সময়, বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসলে। এই তো! এর চাইতে বেশি কিছু নয়। মাফিনও সারাদিন আমার কাছে নইলে ওর দাদু-দাদীর কাছে থাকে। বাবার সাথে সখ্যতা ওর তেমন নেই। ওর সাথেও দুলাভাইয়ের সম্পর্ক চিপস, চকলেট কিনে দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বিষয়গুলো নজরে আসার পর আমি অবাক হয়ে যাই। তাহলে এতদিন যে দুলাভাইয়ের আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবা’র একটা অবয়ব মনে অংকিত হয়েছিল সেটা ভুয়া। দুলাভাই আসলে আমার বোন-ভাগ্নের সাথে কেমন সেটা কখনো যাচাইয়ের চেষ্টাই করিনি! মিডেলক্লাস ফ্যামিলি থেকে বিলং করা আপাকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছে সে, এটাই মুগ্ধ হবার বিষয় ছিল আমার কাছে। সে মানুষটা কেমন এটা কখনো খেয়াল না করে অযথাই তাকে মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছি!
এসব অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করবার পর বিষয়টা নিয়ে আপার সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু একবারও সফল হতে পারিনি। বারংবার আপাই থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে,
— বয়সের চাইতে বেশি বুঝতে যাসনা নীরদ। আমার সংসারে কোনো অশান্তিই নেই। টুকটাক ঝগড়াবিবাদ সবার সংসারেই হয়। বাইরে থেকে দেখে তো আর একটা ধারণা করে নিতে পারিস না তাইনা? মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল এসব।
তোর একটা ভুল স্টেপ সব এলোমেলো করে দিতে পারে। মনে রাখিস এটা তোর বোনের সংসার। তোর বোনের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য স্থান। তোর কিছু ভুলভাল ধারণার কারণে শেষে এ স্থানটাও হারাতে না হয়! তাছাড়া তুইও তে ঋণী এই পরিবারের কাছে। তোর অসহায় সময়টাতে উচ্চবাচ্য না করে এরা খোলা হাতে সাহায্য করেছে। অন্য কারোর পরিবার হলে করতো? কখনোই করতো না।
আপার এত যুক্তির পর আমিও আর কিছু বলবার সাহস পাইনি। ভেবেছি নাহ্ ঠিকই, এই মুহুর্তে আমি হলাম পরজীবি। আপার শ্বশুরবাড়ি আমার আশ্রয়দাতা। আসলেই তো আমার একটা ভুল স্টেপ আর শেষ আশ্রয়টাও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আপার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে। শিওর না হয়ে কিছু করে বসাটা বোকামিই হবে আমার জন্য। তারচাইতে কিছুদিন সময় নিয়ে বিষয়টার গভীর পর্যন্ত যাই।
তখনকার মতো থেমে যাই আমি। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। ঘটনার গভীরে যাওয়ার পর দেখা যায় আমার ধারণাই ঠিক। দুলাভাই সকলের সামনে নিজের যে চরিত্র তৈরি করে রেখেছে বাস্তবে সে ওরকম নয়৷ তার আসল চেহারা কেবল আমার বোনের সামনেই উন্মুক্ত। এটা বুঝে যাওয়ার পর এসব সিলি যুক্তি মনটাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি আমার। বয়স বাড়ার সাথেসাথে সবকিছু যখন বুঝতে শিখছি, একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খায়, অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করে এবাড়িতে পড়ে থাকবে কেন আমার বোন? ও কি আসলেই এতখানি অসহায়! কোন ভয়ে ও নিজের ওপর এত অন্যায় সহ্য করছে? যাওয়ার কোনো জায়গা নেই এই ভয়! ঠিকাছে এবার তাহলে ওর এই ভয়টাই দূর করবো আমি। ওর জন্য একটা নির্ভরযোগ্য ছাদের ব্যবস্থা করবো। এই যে আমার এত পড়াশোনা, সামনে এগোনোর অদম্য ইচ্ছা! সব আপার জন্য। আপাকে একটা স্বাধীন জীবন দেয়ার জন্য। কোনো স্টেপ নিতে পারবো না তো! তাহলে এতটাদিন যেমন কষ্ট করেছে আর ক’টাদিন কষ্ট করুক মানুষটা। কষ্টের সময় দীর্ঘ হয় ঠিক কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। একদিন সব কষ্ট থেকে ওকে মুক্ত করেই ছাড়বো। আপার সাথে সাথে আমিও ধৈর্য ধরে ছিলাম এতদিন, কিন্তু ইদানিং ধৈর্যটা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
ইশি আপুর প্রি ওয়েডিং ফটোশ্যুটের রাতে আপা যখন প্রীতম সাহেবের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে আসলো তখনই ওর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলাম আমি। চিহ্নটা এমন জায়গায় ছিল, কোনো বাহানা দিয়ে ও ওর ওপর হওয়া অত্যাচারকে লুকোতে পারতো না। মারের দাগ সবাই চেনে। কিছু জিজ্ঞেস করিনি। জানতাম ও সব লুকিয়ে যাবে, মিথ্যে কথা বলবে। মিথ্যেটা হজম করতে পারবো না আমি। হয়তোবা দুলাভাইয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলবো। আমরা দুই বোন সবসময় ঝামেলা এড়ানোর চেষ্টা করেছি। সময় তো আমাদেরও আসবে। এখন না-হয় একটু কষ্ট হলো!
ইনতিসারকে আপা আর দুলাভাইয়ের ব্যাপারটা বলতে চাইনি। আসলে বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঐমুহুর্তে ওকে কোনো সিনক্রিয়েট করার থেকে আটকাবো কীভাবে! আজই ও আমাদের সম্পর্কটাকে কোনো না কোনো এক পরিণতির দিকে নিয়ে যেত। সে পরিণতি ভালো হোক বা খারাপ সেটা ওর ভাবনার বিষয় নয়। এটাই তো হতে দিতে চাইনা আমি। আর মাত্র ক’টা দিন, তারপর ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবো। ততদিন আটকাতে হবেই ওকে।
এটা ছাড়াও অন্য এক বিষয় নিয়ে মাথা ঠিক ছিল না। আজ সকালে প্রীতম সাহেবের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় যে জ্যামে আটকেছিলাম তখন দুলাভাইকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখেছি রাস্তায় । দৃশ্যটা গেঁথে আছে মাথায়।
তার এই তৃতীয় নম্বর অপরাধটাও হয়তোবা চুপচাপ মেনে নিতাম কিন্তু সময় দরকার ছিল। সময়টা তো পাইনি তাই রাগের বশবর্তী হয়ে ইনতিসারের সামনে বলে ফেলেছি। এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে ও বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলবে কি না! এক ঝামেলা থেকে উঠে আরেক ঝামেলায় পড়ে গেলাম দেখছি। আমি ঘটিত সিনক্রিয়েটের চাইতে এটা বেশি ভয়াবহ।
ভেন্যিউতে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা ওকে। থেকে থেকে কোথায় হারিয়ে যায় বুঝতে পারছি না। ওর সাথে কথা বলা দরকার। এবার নিজ প্রয়োজনে দরকার। সবকিছুর তো একটা নিয়ম আছে!
ওর হঠকারী সিদ্ধান্ত সব আমার ক্ষেত্রে হোক কিন্তু আপার ক্ষেত্রে নয়।
স্টেজে ইশি আপুর হলুদ জমজমাট। আমি একা দূরে বসে ইতিউতি ইনতিসারকে খুঁজে ফিরছি। শুধু যে ওকে খোঁজার বাহানায় এদিকটায় বসেছি তা নয়। সামনের সারিতে মাউইমাদের সাথে আমার না হওয়া শ্বাশুড়িও বসে আছেন একটা হ্যান্ডসাম মতো ছেলেকে বগলদাবা করে। ছেলেটা নিশ্চয়ই প্রিতম সাহেব। বেচারাকে তো আমার সাথে দেখা করানোর জন্যই ওভাবে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। এ মুহুর্তে সে তার মায়ের হাতের পুতুল। নড়াচড়া করবারও উপায় নেই। এত বিপদের মধ্যেও লোকটার অসহায় চেহারা কল্পনা করে আমার হাসি পাচ্ছে।
— কি, একা একা হাসছিস কেন?
পাশে থেকে আপার গলা শোনা গেল। চট করে হাসি থামিয়ে ফিরে তাকালাম আমি। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।
— এমনিই একটা ব্যাপার নিয়ে হাসছিলাম। তুমি খাবার নিয়ে ঘুরছো কার জন্য?
— কার জন্য আবার! জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয় কাকে? তোকেই তো।
— মোটেও আমাকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়না আপা। স্বাভাবিক নিয়মে যখন ক্ষুধা লাগে তখন খেয়ে নেই আমি।
— কিন্তু আজ তো স্বাভাবিক নিয়মে খাচ্ছিস না। তাই শ্বাশুড়ি মা খাবারের ট্রে হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাঠালেন তোকে খাওয়াতে। সব প্লেট খালি চাই ওনার, বলে দিয়েছেন।
— মাউইমার এদিকেও নজর আছে!
বেশ অবাকই হলাম আমি।
— হু। তার সবদিকে নজর। তোরদিকে একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে ইদানিং। ব্যাপারটা ভাববার মতো।
— আমিও ভাবছি আপা।
— মাফিনকে ছাড়া একা বসে আছিস কেন?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করলো আপা।
— ও তো সামনে সবার সাথে মজা করছে। আমাকে দেখলে টেনে নিয়ে যাবে ওখানে। এ মুহুর্তে যেতে চাইছি না আমি।
— কেন? ইশিকে হলুদ মাখাবি না?
— তুমি জানো উনি আমাকে পছন্দ করেন না। আমার হাতের হলুদ মাখবে নাকি!
— সেটাও কথা। কিন্তু তুই তো অন্য কারণে সামনে যাচ্ছিস না।
— কি কারণ শুনি!
— সামনে তোর হবু শ্বাশুড়ি বসে আছেন তোর হবু বরকে নিয়ে।
— আপা!
কপট রাগের সাথে বললাম আমি। আপা হাসতে হাসতে আমার হাতে মৃদু চাপড় মেরে বলল,
— প্রিতমকে দেখার পর আমি আমার মত পাল্টে ফেলেছি নীরদ। ভাবছি তোর ওখানে বিয়ে করিয়ে দেবো।
— অদ্ভুত কথা বলবে না আপা।
— অদ্ভুত নয় সত্যি। এই একটা উপায়ই খোলা আছে তোকে ইনতিসারের থেকে দূরে সরানোর।
হাসতে হাসতে বলল আপা।
— মানে!
শুকনো বিষম খেলাম আমি। কিসব বলছে আপা! এবারে আপার হাসিটাও বন্ধ হয়ে গেল। খনিক পূর্বের হাস্যোজ্জ্বল মুখটায় একরাশ গাম্ভীর্য্য ফুটিয়ে চাপা গলায় শুধলো,
— একটু আগে বাড়ির পেছন দিকে ইনতিসারের সাথে তুই কি করছিলি নীরদ?
আপার প্রশ্নে সচকিত হলাম আমি। চট করে কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। আপা জানলো কীভাবে? প্রীতম সাহেবের মা তাহলে সব বলে দিয়েছে আপাকে? আপা বোধহয় আমার মনে উত্থিত প্রশ্ন আঁচ করতে পারলো। ঠান্ডা গলায় বলল,
— বাড়ি ভর্তি লোকজন। এখানে আড়াল বলতে আসলেই কিছু আছে? অনেকের কাছে তুই পরিচিত মুখ নোস বলে বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়নি। কিন্তু আমারও চোখ এড়ায়নি। তখন কিন্তু আমিও এখানে আশেপাশেই ছিলাম।
— আপা এই ঘটনায় আমার কোনোই দোষ নেই।
— তুই আমাকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছিস নীরদ।
— না আপা। বিশ্বাস করো, কিছুই নেই আমার ইনতিসারের সাথে।
অশ্রুসজল হয়ে উঠলাম আমি। আপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
— বিশ্বাসটাই করতে পারছি না নীরদ।
— আপা..
দুচোখ ঠেলে কান্না আসতে লাগল আমার।
কান্নার ফলে আর কথা বলা সম্ভব হলো না। আশেপাশে কেউ যেন আমার কান্না দেখতে না পারে সেজন্য তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে নিলাম। শেষ পর্যন্ত আপাও ভুল বুঝলো আমাকে?
আপা কিছুক্ষণ চুপচাপ কান্না দেখলো আমার। তারপর গাঢ় স্বরে বলল,
— আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি নীরদ। প্রিতমের সাথেই তোর বিয়ে হবে। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা শুনতে রাজি নই আমি। আজই একটু পর দেখা করবি ওর সাথে। আমি ব্যবস্থা করে রাখবো। যত জলদি তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি ততই আমাদের সকলের জন্য মঙ্গল।
— এতবড় অন্যায় কোরো না আপা।
খুব ক্ষীণ স্বরে বললাম আমি।
— অন্যায় তো আমি আগেই করে ফেলেছি নীরদ৷ তোকে এ বাড়িতে এনে তার বোঝা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। অজ্ঞাতেই যখন আমার অপরাধের সাথে জড়িয়ে গেলি তাহলে এখন মাশুলটাও তো গুনতে হবে বোন । আমার হাতে এখন আর কিছু নেই। মাফ করিস আমাকে।
খাবারের প্লেট হাতে ধরিয়ে উঠে চলে গেল আপা। প্লেট হাতে আমি বসে রইলাম একা চুপচাপ৷ আমার জীবনে তাহলে আরেকটা দূর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসছে। আচ্ছা এর নাম তাহলে কি হবে? বিয়ে নাকি প্রিতম!
_____________
(১৯)
মাউইমার জোর জবরদস্তিতে ইশি আপুকে হলুদ মাখাতে গিয়েছিলাম একবার। প্রিতম সাহেবের সাথে চোখাচোখি হলো তখন। তার মা সহ দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই। আমি সামনে যাওয়ার পর আন্টিও কি সুন্দর ইশারা করে দিলেন লোকটাকে। এক পলকে ওনার চোখের ভাষা বুঝতে পারিনি আমি, বোঝার কথাও নয়। তবে ঐ চোখাচোখির পর থেকে ভেতরের যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। আপা বারবার নানা ছুতোয় এসে বলে যাচ্ছে কখন, কোথায় দেখা করতে হবে। খুব হেল্পলেস ফীল করছি আমি। বারবার চোখ ভিজে আসছে। আপা পাশে ছিল এতদিন। এখন সেও নেই। এত ছোট ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি করে সরে গেল। একবার আমার কথাটা শোনার চেষ্টা করতো! আমি হলাম অভাগী। যেদিকেই যাই সাগর শুকায়।
— তাম্মি বারবার হারিয়ে যাও কেন বলো তো? দাদুমনি ডাকছে সেই কখন থেকে।
শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো মাফিন। ওকে দেখে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম।
— হারাচ্ছি না। শরীর খারাপ লাগছে বুঝলে! বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলাম।
— তোমার শুধু শরীরই খারাপ হয়। আমার সাথে পিক তোলার কথা বললেই খারাপ হয়। আমাকে একটুও ভালোবাসোনা তুমি।
মন খারাপ করে বলল মাফিন। আমি হাঁটু গেঁড়ে বসলাম ওর সামনে। ওর গালে হাত রেখে নরম সুরে বললাম,
— কে বলেছে ভালোবাসিনা। আমার মাফিনকে আমি সবচাইতে বেশি ভালোবাসি।
— উহ্ মিথ্যে।
— না বাবা সত্যিই। খালামণি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
— তাহলে চলো পিক তুলতে?
— আচ্ছা চলো।
অগত্যা ওর কথা রাখতে যেতে হলো আমায়।
ফটোশ্যুটের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে গিয়ে দেখি বাড়ির সবাই উপস্থিত, ইনতিসারও। আমায় দেখে একটুখানি হাসলো ইনতিসার। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম ওর থেকে। ঠিক করলাম এখানটায় ভীড় কমলেই এক ফাঁকে ওকে ডেকে নেবো কথা বলার জন্য।
মাউইমা চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে ইশি আপুর ফটোশ্যুট দেখছিলেন। মাফিন স্ব-উদ্যোগে আমায় ওনার কাছে টেনে নিয়ে গেল। উনি বোধহয় এক্সপেক্টই করেননি আমাকে। প্রথমে বিস্মিত হলেন তারপর ওনার খুশি দেখে কে! হাত চেপে ধরে বললেন,
— এবার আর পালাই পালাই করতে দেব না। এই যে হাতটা ধরলাম তোমার। প্রোগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথেই থাকবে।
মাউইমার কথায় অন্যরকম একটা জোর ছিল, ভালোবাসার জোর। আমি না করতেই পারলাম না৷ পরে মাউইমার সাথে গল্প করে বাকি সময়টা কাটলো। ফ্যামিলি ফটো যখন নেয়া হবে তখন এলো আপা। মাউইমার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। কখন যে ইনতিসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। আপা দেখে একটা অদ্ভুত শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে। আমি কাতর চাহনিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম ওকে দেখিনি আমি, কিন্তু এবারেও আমায় বিশ্বাস করলো না আপা। দৃষ্টির অস্বাভাবিকতা বজায় রেখে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ছবি টবি তোলা হলে গেস্টদের সাথে কথাবার্তা বলায় যখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মাউইমা তখন এক ফাঁকে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম আমি। আর প্রোগ্রামে থাকা সম্ভব নয়৷ যত দ্রুত সম্ভব এই সাজসজ্জা ছাড়তে হবে। আপাকে তো থামানো সম্ভব নয়, বিয়ের কথাটা যেন আর এগোতে না পারে তাই আমাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনদিকে চোখ রাখবো আমি? উফফ। ভেবে ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
বাড়ির ভেতর দিকটায় কেউ নেই বলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি ড্রইংরুমে আপা প্রীতম সাহেবের মাকে নিয়ে গল্পে মশগুল। আমার উপস্থিতি ওদের কথা থামিয়ে দিলো। আন্টি হাসিমুখে উঠে এলেন আমার কাছে। কাঁধে হাত রেখে উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন,
— এসেছ তুমি? তোমারই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ। ছাদে প্রিতম দাঁড়িয়ে আছে তোমার অপেক্ষায়, যাও ওর সাথে দেখা করে এসো।
আন্টির কথায় খানিক অবাকই হলাম। ইনতিসারের সাথে একটা বাজে সিচুয়েশনে দেখার পর ওনার এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই? সোজা ছেলের সাথে দেখা করতে পাঠাচ্ছেন!
চোখ ঘুরিয়ে আপার দিকে তাকালাম। আপার মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো সে হয়তোবা সামলেছে ব্যাপারটা। তাহলে শেষ রক্ষা হলো না আমার?
দীর্ঘশ্বাস চেপে চোখমুখে অসহায়ত্ব ফোটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু মায়া হলোনা আপার৷ এগিয়ে এসে আন্টির কথায় তাল মিলিয়ে বলল,
— হ্যাঁ যা৷ জলদি যা৷ অনেকক্ষণ থেকেই অপেক্ষা করছে ছেলেটা।
আপার মুখের কৃত্রিম হাসির দিকে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। অযথা ভুল বুঝে আমার সাথে এতবড় অন্যায় তুমি করতে পারলে আপা?
উচ্চবাচ্য করলাম না আর। কোনোরকমে মাথা নেড়ে হাঁটা ধরলাম ছাদের দিকে৷ জিদ চেপে গেল মাথায়। বিয়ে করাবে না আমায়? ঠিকাছে আমিও দেখি কীভাবে ঐ লোকটা আমায় পছন্দ করে। সরল সোজা নীরদকে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত না! এবার তাহলে নিজের চরিত্রের বিপরীতে যাবো আমি। মুগ্ধতা তিক্ততায় পরিণত করবো।
ছাদে এসে দেখলাম কেউ নেই এখানে। পুরো ছাদ ফাঁকা। জিদের বশে প্রত্যেকটা কোণ ভালো করে পরীক্ষা করলাম । নাহ্ আমি ছাড়া আর কোনো মানুষের অস্তিত্বই নেই। নেই কেন লোকটা? সকালে অপেক্ষা করিয়েছিলাম বলে কি এখন আমাকে অপেক্ষা করাবে? তাহলে ওরা যে বলল লোকটা ছাদে আছে? মিথ্যে বলেছে? উফফ
বিরক্তিকর। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পায়চারী করতে শুরু করলাম ছাদময়। বিয়ে ভাঙার জন্য কি বাহানা দিতে হবে? শুরুতেই দেরি করলো জন্য দূর্ব্যবহার করবো নাকি অন্য কোনো উপায়ে..
কিন্তু অন্য উপায়টা কি?
— অসময়ে ছাদে একা একা কি করছো নীরদ?
পরিচিত কন্ঠস্বরে চিন্তাভঙ্গ হলো আমার। ইনতিসার! এই মুসিবত আবার এই সময়ে এখানে কেন? এখন তো প্রীতম সাহেবের আসার কথা। সে যদি এর সাথে আমায় দেখে নেয়…
একমিনিট,সে যদি এর সাথে আমায় দেখে নেয় তাহলে ব্যাপারটা কি বিয়ে ভাঙায় হেল্প করতে পারে। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলাম আমি। জানিনা কি উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এলো কিন্তু মনে হলো এই মুহুর্তে কেবল ইনতিসারের মাধ্যমেই আমি বেঁচে যেতে পারি।
ঠোঁটে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললাম,
— আপনার সাথে আমার কথা আছে।
— আমার সাথে?
ভ্রু কোঁচকালো ও তারপর সাথেসাথেই স্বাভাবিক হয়ে বলল,
— ভাইয়া ভাবির ব্যাপারটায়?
— হু।
বেখেয়ালে বললাম আমি।
— ডোন্ট ওয়ারি নীরদ ভাবির চিন্তা আমারও আছে। এমন কোনো কাজই আমি করবো না যাতে তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে। ভরসা করতে পারো আমায়৷
— হু।
ওর কথায় বিশেষ কান দিলাম না আমি। এগোতে এগোতে বেখেয়ালে নজর চলে গেছে ছাদের দরজার দিকে। প্রিতম সাহেব আসছেন। তাকে দেখে মাথায় অদ্ভুত কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। ভয়ানক কিছু । মনে হচ্ছে এরকম কিছু করলেই বিয়ের কথা না এগিয়ে এক লহমায় থেমে যাবে।
আমি জানিনা যা চিন্তা করছি তা ঠিক কি না তবে যেকোনো উপায়ে বিয়ে ভাঙা এখন মূল উদ্দেশ্য৷ চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে নিলাম। যা করতে যাচ্ছি এর ফলাফল খারাপ হতে পারে কিন্তু এটা এখন আমাকে করতেই হবে।
— কথা বলছো না কেন নীরদ? এখনো ভাবছো আমায় ভরসা করা যায় কি না?
নরম গলায় শুধল ইনতিসার। এবারে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম ওর দিকে। ওর চাহনি কেমন জানিনা তবে ও আইডিয়াও করতে পারবে না এই মুহুর্তে কত দুঃসাহসিকতার কাজ করতে যাচ্ছি আমি! দু’হাত মুঠ পাকিয়ে নিজেকে শেষ বারের মতো সাহস যুগিয়ে নিলাম। এরপর আর সময় ব্যয় না করে খুব দ্রুততার সাথে ইনতিসারের খুব কাছে চলে গেলাম। যতটা কাছে গেলে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। অকস্মাৎ আমায় এত কাছে দেখে ভড়কে গেল ও। চোখজোড়া স্বাভাবিকের চাইতে দ্বিগুণ বড় হয়ে গেল। কিছু বলবার জন্য যখনই ও দু ঠোঁট আলতো ফাঁক করেছে ঠিক সেই মুহুর্তে আমি পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দু’হাতে ওর পাঞ্জাবির কলারটা খামচে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। সাথেসাথেই চমকে উঠলো ও। কয়েকসেকেন্ড হতভম্ব থাকবার পর দু’হাতে আমার গাল চেপে ধরে নিজের থেকে আলাদা করে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলো। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,
— প্রিতমকে বিয়ে করতে চাইনা আমি, প্লিজ। প্রীতমকে বিয়ে করতে চাইনা।
কিছুটা সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো হয়তো আমার কথাটা তারপর গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। আমি বোধশক্তি ফিরে পেয়ে সরে যেতাম ওর কাছে থেকে কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে ওর হাতজোড়া এবার নেমে এলো আমার কোমরে। ছাদের দরজায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে তারপর আমার চোখে চোখ রাখলো।সন্ধ্যেবেলার চাইতেও শক্ত করে চেপে ধরে একটুখানি টেনে তুললো আমায় ওপর দিকে। ওর বরাবর দাঁড় করিয়ে গাঢ়ভাবেই স্পর্শ করে ফেললো আমার ঠোঁটজোড়া। আমিও তখন মাটির পুতুল। ঠিক-ভুল জ্ঞানটা ভুলতে চাইলাম খনিকের জন্য। আপনা থেকেই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো আমার। সাথে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কি? জানা নেই, তবে ওর ডাকে সাঁড়া দিলাম পাগলপারা হয়ে। আমরা দুজনেই জানি এই চুম্বন দুই প্রেমিক-প্রেমিকার তুমুল ভালোবাসা কিংবা আবেগের প্রকাশ নয়। এর আসলে কোনো নাম নেই। হয়তোবা এটা একটা ভুল অথবা অন্যায়, তবে ভালোবাসা নয়।
চলবে,
sinin tasnim sara