ভালোবাসার রংধনু,০৩,০৪

0
1275

ভালোবাসার রংধনু,০৩,০৪

________
(৫)
কোচিং-এ নতুন ভর্তি হবার পর প্রথমবারের মত কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে আমার। অবশ্য ওরা সব আমার টাইপেরই, ইন্ট্রোভার্ট। এজন্যই জমেছে।
বন্ধুত্বের শুরুটা এক ক্লাস টেস্টের মাধ্যমে। জিনিয়া, যার সাথে একটু বেশি ক্লোজ! ও কনফিউশান ক্লিয়ার করার জন্য একটা কোয়েষ্চেন জিজ্ঞেস করেছিল আমাকে। আন্সার বলে দেয়ার মাধ্যমে প্রথম কথা! তারপর নিজে থেকেই এগিয়েছিলাম। আসলে ভাবছিলাম এখন থেকে একা চলতে হবে আমাকে, কয়টা মাসই বা আছি আপার বাসায়! দু একজন বন্ধু না থাকলে একা সার্ভাইব করবো কীভাবে? প্রথমে জিনিয়াই হলো আমার বান্ধবী। এরপর আমাদের ইংলিশ যিনি পড়ান ঐ ভাইয়া গ্রুপ স্টাডির জন্য কয়েকজনকে চ্যুজ করে দিলেন। পড়তে পড়তে তাদের সাথেও জমে গেল। একটা সার্কেল যে পেলাম হুট করে! তারপর থেকেই পাল্টাতে লাগল আমার জীবন। ওদের সাথে মিশতে গিয়ে বুঝলাম ইন্ট্রোভার্ট হলেও প্রোগ্রেসিভ সমাজের সাথে টক্কর দেয়ার অ্যাবিলিটি ওদের সবার আছে। সেটা লেখাপড়ার দিক দিয়ে হোক কিংবা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস! কেউ ভীষণ ভালো গান জানে, কেউ গ্রাফিক্স ডিজাইন, কেউবা বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াডগুলোর চ্যাম্পিয়ন, আর কেউ ভালো আঁকিয়ে। অনলাইনেও ওরা অ্যাক্টিভ। ওদের সবার মধ্যে আমি একা অ্যাভারেজ। পড়া মুখস্থ করার ক্ষমতা ছাড়া আর কোনো দিকে পারদর্শী নই । না অনলাইনে আর না অফলাইনে।
অবশ্য জিনিয়া বলে আমার গানের গলা সুন্দর। চেষ্টা করলে আরও ভালো হবে। ও চায় আমি গান শিখি। কিন্তু এটা কি গান শেখবার কোনো বয়স? প্রতিদিন জোরজবরদস্তি করে, গানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবার জন্য নিয়ে যাবে। আমি ওর কথায় পাত্তা দেইনা। ও ভাবে আপার টাকাপয়সা খরচ করতে চাইনা বলে হয়তোবা যাইনা। কিন্তু এ কথা সত্যি নয়। আমার কোনো আগ্রহ নেই গানের প্রতি। গান শেখা নিয়েও একটা খারাপ স্মৃতি আছে। সেটা মনে করতে চাইনা বলেই শিখতে আগ্রহ দেখাইনা। তবে জিনিয়া নাছোড়বান্দা। আমার আগ্রহ না থাকলেও ওর আগ্রহ ষোলোআনা। মাঝেমধ্যে ওকে বলতে ইচ্ছে হয় আমার গান শেখা নিয়ে খারাপ ঘটনাটা। তারপর ভাবি ও আমার ততটাও ক্লোজ নয় যে জীবনের সব অন্ধকার দিকের গল্পগুলো ওর সাথে শেয়ার করবো।
আমার মত ইন্ট্রোভার্টদের সমস্যা এই, দীর্ঘসময় নিজের জীবনের ভালো-খারাপ দিকটা একান্ত নিজের ভেতর চাপিয়ে রাখতে রাখতে তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, কাউকে বললে যে হালকা লাগতে পারে এ ব্যাপারটা মাথাতেই থাকেনা। তাছাড়াও দীর্ঘসময়ের বান্ধবহীনতার ফলে মানুষ চেনার ক্ষমতাটা আমার নেই বললেই চলে। ঝামেলা বাড়ানোর দরকার আছে? এসব ভেবে বলা হয়না।
আজ কোচিং-এ জিনিয়া আসেনি। ওর নাকি জ্বর, মেসেজ পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। কোচিং-এ আসার পর মেসেজটা চেইক করেছি। বাড়িতে থাকা অবস্থায় দেখলে আমিও আজ আসতাম না। বন্ধুবান্ধব হওয়ার পর হঠাৎ করেই ওদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। ওরা ছাড়া ভাল্লাগেনা।
জিনিয়া বাদে বাকি যে’কজন তাদের সাথে কেবল ইংলিশ ক্লাসটা হয় । ওদের ব্যাচ আলাদা। আজ ইংলিশ ক্লাস ছিল না। পুরো ক্লাস পানসে লেগেছে আমার। মনে হচ্ছিল কখন যে বাড়ি ফিরবো! অবশ্য বাড়িতেও এত লোকসমাগম! সেখানেও শান্তি লাগেনা আমার। সবকিছু থেকে শুধু পালাতে ইচ্ছে করে। অবস্থা আমার আসলেই শোচনীয়।
_____________
কোচিং থেকে ফেরার পর দেখি বাড়ির সব ছেলেরা বাড়ির সামনে গলিতে ক্রিকেট খেলছে। অনিক সাহেব ব্যাট করছেন আর ইনতিসার বোলিংয়ে। গলির মাথা থেকে দশ কদমের মত হাঁটলে একটু ভেতর দিকে বাড়িটা। বাড়ির গেইটে দাঁড়ালে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কিংবা মানুষ স্পষ্ট দেখা যায়। আমি যখন রিকশা থেকে নামছি তখনই অনিক সাহেব দেখেছিলেন আমাকে। খেলার মাঝেই উনি হাত নেড়ে হাই দিলেন । জবাবে আমি মৃদু হেসে ভাড়া মিটিয়ে গলিতে ঢুকলাম। ওনাকে এদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইনতিসারও ফিরে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে বক্র হাসির আভাস দেখা দিল। বুঝতে পারলাম না এর সঠিক কারণ। তবে বুঝতে বেশি একটা সময়ও লাগল না। আমার ওপর ওর যে রাগ সেই রাগটা ও দেখাবে অনিক সাহেবের ওপর। এজন্য ওপাশ ফিরে কিছু না বলেই দ্রুত বেগে বল ছুঁড়ে দিল। অনিক সাহেবের নজর আমার দিকে থাকলেও বল ছোঁড়ার পর অটোম্যাটিক্যালি তার নজর বলের দিকে চলে গেল। নিজেকে বাঁচাতে উনি তড়িঘড়ি করে বলটা ব্যাট টাচ করালেন। ওনার বেখেয়ালি শট ওনাকে বাঁচিয়ে দিলেও আমায় রক্তাক্ত করে ছাড়ল। দ্রুতবেগে ছুটে আসা বলটা ঠাস করে আমার নাকে এসে লাগল। সাথেসাথেই নাকের হাড় ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করল। আমি মৃদু একটা চিৎকার দিয়ে নাক চেপে বসে পড়লাম মাটিতে। চোখ থেকে চশমাটাও খুলে পড়ে গেল ঐ দরুন।
অনিক সাহেব একরাশ ভয় নিয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। এসেই নাক থেকে হাত সরিয়ে দেখলেন কি অবস্থা। রক্ত দেখে তো তার ভয়ের শেষ নেই। মুহুর্তে আমায় টেনে তুলে দুলাভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— ভাইয়া এক্ষুনি গাড়ি বের করো ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
মানুষের শরীরে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলোতে বেকায়দায় লেগে গেলে ব্যথাটা সোজা মস্তিস্কে আঘাত করে। তেমনই নাক একটা। নাকে শক্ত রাবারের বল যে আঘাত করেছে, নাকের হাড়ও ফেটেছে এই যন্ত্রণাটা আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। বরং যন্ত্রণা শুরু হলো আমার মাথায়। চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরতে শুরু করল। হাজার চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারছিলাম না।কান্নার দমকে গা কেঁপে উঠছিল বারবার।
আমায় এভাবে কাঁদতে দেখে অনিক সাহেবও যেন কেঁদে ফেলবেন। আমার রক্তাক্ত নাকে রুমাল চেপে ধরে কেমন অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলেন বারবার।
আমি ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তারউপর চশমাটা খুলে পড়ে গেছে। কি যে এক বাজে অবস্থা! চোখ বন্ধ করে অনিক সাহেবের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি বারবার বলতে লাগলেন, কোনো চিন্তা করোনা নীর, আমরা এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যাব।
আমি কোনোরকমে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।

পূর্বেই বলেছি ও বাড়িতে কেউ তেমন একটা পছন্দ করেনা আমায়, তাই হসপিটালে যাওয়ার সময় কারো কোনোপ্রকার আগ্রহ কিংবা কনসার্ন দেখা গেল না। অবশ্য আমি এক্সপেক্টও করিনা।
তবে আমার যতদূর মনে হয়েছে আমার এই দূর্ঘটনায় খেলা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল তাই সবাই ভীষণ বিরক্ত হয়েছে। সবচাইতে বেশি বিরক্ত হয়েছে ইনতিসার। গাড়িতে ওঠার মুহুর্তে দেখেছি ও বিরক্তির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হাতের বলটা ভীষণ রেগে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ কালো করে ধপাধপ্ পা ফেলে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।
সবার বিরক্তির কারণ হয়ে আমারও খুব খারাপ লাগল। কিন্তু করারও তো কিছু নেই, দূর্ঘটনা কি বলে কয়ে আসে? তবুও আমাকে সাবধান হতে হবে। বেশিদিন তো নেই এ বাড়িতে। যতদিন আছি আর কারো সমস্যার কারণ হওয়া যাবে না।

ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে অনিক সাহেব মনে করে একটা চশমা কিনে দিলেন আমাকে। পুরাতনটা পড়ে ভেঙে গেছে বিষয়টা খেয়াল করেছেন উনি।
ওনার এমন দায়িত্বশীলতায় খুশিই হলাম। কিন্তু বুঝতে দিলাম না।
উনি নানা ছুঁতোয় কথা বলার চেষ্টা করছেন আমার সাথে। ওদিকে মাথা ব্যথার কারণে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ইগনোরও করতে পারছি না। শেষে গাড়ির জানালায় হেলান দিয়ে ওনার কথার পৃষ্ঠে হু হাঁ বলে রেসপন্স করতে থাকলাম। উনি হয়তোবা বুঝতে পারলেন আমার ভালো লাগছে না। তাই আষাঢ়ে গল্প বাদ দিয়ে প্রেসক্রিপশন বের করে ঔষধ বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন। মনোযোগ দিয়ে আমি দেখে নিলাম সব। ওই ফাঁকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে হঠাৎ উনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
— নীরদ নাকটা ফাটার পর কিন্তু তোমার সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে। নাকের ওপর সার্জিক্যাল টেপটা সুন্দর লাগছে খুব।
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি হাসিটা আরও বাড়িয়ে বললেন,
— আমি কিন্তু সত্যি বলছি। তুমি নিজে না-হয় দেখো।
ফোন বের করে দেখাতে চাইলেন। আমি বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে বললাম,
— লাগবে না।
আমার এত অনাগ্রহ দেখে বেচারা এবার দমে গেলেন। আর কথা হলোনা পথে।
_______________
(৬)
বাড়ি ফেরার পর আমায় নিয়ে মাউইমার কি অস্থিরতা! কি করবেন, কি না করবেন ঠিক নেই।
বললাম,
— এত অস্থির হবেন না, ঠিক আছি তো আমি।
উনি আমার কথা শুনলেন না। ড্রয়িংয়ে বসাতে বসাতে বললেন,
— কি ঠিক আছো তুমি মেয়ে? আমাদের বাড়ির ছেলের জন্যই আজ এতবড় বিপদ ঘটে গেল। খারাপ কিছুও হতে পারতো। তোমাকে এমন অবস্থায় দেখে কি যে খারাপ লাগছে আমার!
— ডাক্তার তো ঔষধ দিয়েছেন। চিন্তা করবেন না আপনি।
— চিন্তা করবেন না বললেই হয়? এ বাড়িতে এসেছ থেকে তোমাকে কখনও অন্য চোখে দেখেছি? তুমি তো আমার মেয়ের মতই। ইশি আমার কাছে যেমন , তোমাকেও ঐ নজরে দেখি । শুধু অনুভূতিগুলো কখনও কাউকে বোঝাতে পারিনা বলে তোমার সাথে এত দূরত্ব।
আমি প্রতুত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। অশ্রুসজল হয়ে তাকালাম ওনার দিকে।
আমাদের কথোপকথনের মাঝে আপার ননদ ইশি আপু ওপর থেকে নেমে এলো। আমায় দেখেই সে চোখ সরু করে বলল,
— এই মেয়ের নাকে ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে?
— ও’মা তুই জানিস না? দুপুরে বল লেগে যে ওর নাকটা ফেটে গেল!
— দুপুরে তো ভাইয়ারা খেলছিল। ও ওখানে কি করতে গিয়েছিল?
— যায়নি। আসছিল কোচিং থেকে। গলির মাথায়ও দাঁড়িয়েছে, তোর বেকুব ভাইটাও কোনোদিকে না তাকিয়ে বল ছুঁড়েছে। ওর জন্যই তো মেয়েটার এতবড় বিপদ হলো।
মাউইমা ইনতিসারকে দোষী ভাবছেন বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে ওনাকে থামিয়ে দিলাম।
— এটা কেবলমাত্র একটা দূর্ঘটনা ছিল মাউইমা। কারোরই দোষ নেই এখানে।
ইশি আপু আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
— তুমি অযথাই ইনতিসারকে দোষ দিচ্ছ মা। ও কি জানতো নাকি এই মেয়ে হুট করে ওদের খেলার মাঝে প্রকট হয়ে যাবে! তাছাড়াও ও বোলার ছিল, এ ছিলো ওর পেছন দিকে। দেখবে কীভাবে? দেখার কথা তো ছিলো অনিকের। ও কিছু বলতে পারলো না? দোষারোপ যদি করতেই হয় যারা অ্যাকচুয়াল দোষী তাদের কথা বলো।
আমার দিকে তাকিয়ে বেশ ঝাঁঝালো স্বরে বলল ইশি আপু। মাউইমা এবার তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন,
— খেলাধুলা করবে সেটাও অন্ধের মতো? গলির মধ্যে খেলছে ওর সেন্স থাকবে না পথচারী আসতেই পারে! তাদের অসুবিধা করতে হবে কেন? তোমাকে আর তোমার ভাইয়ের হয়ে সাফাই গাইতে হবেনা। তাকে বলা হয়েছিল খেললে যেন মাঠে গিয়ে খেলে। কথা শুনলো না কেন সে? নাটের গুরু যে তাকেই তো দোষারোপ করতে হবে।
— হয়েছে তুমিই ঠিক আমিই ভুল। আর তর্ক করতে চাচ্ছিনা। তোমার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। তোমার এই নিরীহ গেস্ট এর খোঁজ খবর নেয়া হলে ঘরে চলো এখন।
— কথাবার্তা মেপে বলো ইশি। কার সামনে কি কথা বলছো সেটা খেয়াল করো । নিরীহ গেস্ট আবার কেমন শব্দ? ইম্পর্ট্যান্ট কথা পরে হবে। দেখছো না মেয়েটা মাত্র হসপিটাল থেকে ফিরলো। ওকে রুমে শুইয়ে,কিছু খাইয়ে তবেই আমি ফ্রি হবো। তুমি এখন যেতে পারো।
মাউইমার কথা শুনে ইশি আপু ভীষণ রেগে গেল। তার মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারলাম। কিন্তু রেগেছে সেটা প্রকাশ করলো না। কেবল আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মাউইমাকে বলল,
— জলদি এসো।
তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে যেতে আমার উদ্দেশ্যে খোঁচা মেরে বলল, “ট্রাবলমেকার একটা”
কথাটা বেশ জোরেই বলল সে, আমি এবং মাউইমা দু’জনারই কানে এলো কথাটা। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম আমি।
আসলে একদিন বাদে তার প্রি ওয়েডিং ফটোশ্যুট। এ নিয়েই হয়তোবা কথা বলতে চায় মাউইমার সাথে । আহারে তার মাঝেই আমার এই অসুস্থতা। কত-শত কাজের চাপ মাউইমার ওপর। সব ফেলে তিনি কি না আমায় নিয়ে পড়লেন! আমার জন্য বেচারির আনন্দ মাটি না হয়ে যায়।
বিষণ্ন চোখে ইশি আপুর প্রস্থান দেখলাম।

ইশি আপু চলে যাওয়ার পর মাউইমা আমায় নিয়ে ঘরে চলে এলেন। ফ্রেশ করিয়ে আপাকে আদেশ করলেন খাবার আর ঔষধ নিয়ে আসতে।
আমি বারবার করে বললাম উনি যেন ইশি আপুর কাছে যায় আমি এখন ঠিক আছি, আপাই বাকিটা দেখে নিতে পারবে। কিন্তু উনি শুনলেন না। খাবার খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে তবেই বেরুলেন।
তারপর সারা বিকেল কাটলো আমার ঘুমিয়ে। উঠলাম সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় একবার দুলাভাই আর অনিক সাহেব এসে খোঁজ নিয়ে গেলেন। তারপর এলেন মাউইমা। আবারও নাশতা খাইয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেলেন।
রাতে একটু পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু শরীর খারাপ লাগায় আর পড়া হলো না। বিছানায় শুয়ে-বসে, ফোন চেপে সময় কাটল। আপা একবার মাফিনকে দিয়ে গেছিল আমার কাছে। সে তার চকলেট বক্স থেকে ডজনখানেক চকলেট বসে থেকে খাইয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, গুটুরগুটুর গল্প শুনিয়ে আমার বুকে ঘুমিয়ে পড়ল।
ও ঘুমোলে আপা এসে নিয়ে গেল ওকে। বলেছিলাম আজ রাতটা আমার কাছেই থাক! শুনলো না। আমি অসুস্থ, ও ডিস্টার্ব করতে পারে এজন্য থাকা যাবে না। মন খারাপ লাগল খুব, কিন্তু কিছু বললাম না।
আপা যাওয়ার সময় বলে গেল শরীর বেশি খারাপ লাগলে যেন ওকে ডাকি। মনে মনে ঠিক করলাম কিছু হলে মোটেই ডাকবো না তাকে।

ডাক্তার বলেছিল ব্যথায় জ্বর-টর আসতে পারে।
ডাক্তারের কথাকে সত্যি করে মাঝরাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। কাউকে ডাকবার মত খুঁজে পেলাম না। আপাকে ডাকবো! মাফিনকে নিয়ে গেছে সে অভিমানে ডাকলাম না। ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম শুধু। গলা শুকিয়ে আসছিল বারবার।
কেমন একটা ঘোরের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। রাজ্যের একাকিত্ব ভর করছিল আমাকে। গোঙাতে গোঙাতে বাবাকে ডাকছিলাম বারবার। কিন্তু কোথায় আমার বাবা? কেউ নেই পাশে, কেউ নেই।

কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম মনে নেই তারপর হঠাৎ ঘোরের মাঝে মনে হলো ঘরের দরজা খুলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো। ধীরপায়ে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। আমার মাথার কাছে বসে মুখের ওপর ঝুঁকে কয়েক মিনিট কি যেন দেখলো তারপর ছুটে গেল কোথাও একটা। খানিক বাদে গায়ে ভারী কিছু আবিষ্কার করলাম। সাথে ঠান্ডা কিছুটা কমে গেল।
কাঁথা! কেউ কাঁথা চাপিয়ে দিয়েছে আমার ওপর। কাঁথাটা আঁকড়ে ধরলাম শক্ত করে। তীব্র মাথা ব্যথায় গোঙানি বেড়ে গেল। আমাকে গোঙাতে দেখে সে পরম যত্নে গালে হাত রাখলো। তার স্নেহের স্পর্শ ছুঁয়ে গেল আমার কপাল, চিবুক, শুষ্ক ঠোঁট এমনকি গলাও।
মনে হলো আমার জ্বর পরীক্ষা করল। তারপর আবার হারিয়ে গেল স্পর্শ। স্পর্শটাকে কল্পনা মনে হলো আমার কাছে। ওভাবেই পড়ে রইলাম কাঁথা আঁকড়ে। খানিক বাদে ফিরলো সে। তার সাথে পানির শব্দ কানে এসে লাগল। চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে! কিন্তু চোখদুটো খোলা সম্ভব হলো না, এত ভারী হয়ে আছে চোখের পাতা!
আবার স্নেহের স্পর্শটা। গা পুড়িয়ে দেয়া জ্বরের তাপকে স্তিমিত করতে এক টুকরো নরম ভেজা কাপড় আমার কপালে চেপে ধরল সে। জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে কেউ?
আমি জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, কে? পারলাম না। কথা বলতে ইচ্ছে করলে না।
বেশকিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে দিল সে আমাকে। এর মাঝে বারবার মুখের ওপর ঝুঁকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিল, জিজ্ঞেস করছিল। বুঝতে পারিনি। একটানা জলপট্টি দেয়ার কারণে জ্বরটা যখন কমে আসছিল আমার, মাথা ব্যথা কমে তন্দ্রাভাব আসছিল ঠিক ঐ মুহুর্তে উপলব্ধি করলাম কারো তপ্ত শ্বাস আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার চিবুক, ঠোঁট । এরপর কয়েক মুহুর্তের উন্মত্ত চুম্বন, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ঠান্ডা।
প্রস্থানের পূর্বে কানের কাছে একটা ফিসফিসানো আওয়াজ এলো,
“হেইট ইউ গ্লুমি ওয়েদার”
আর বাঁ গালে টুপ করে পড়লো দু ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুজল ।
আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেল সাথেসাথেই। ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলাম, “ইনতিসার তুমি?”
জবাব এলো না। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষার পর চোখ খুলে উঠে বসলাম। ইতি-উতি তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম আসলেই সে কি না! কিন্তু কিছুই নজরে এলো না, এত অন্ধকার চারিপাশে! ইলেক্ট্রিসিটি নেই নাকি? ডিমলাইট জ্বালিয়েই তো শুয়েছিলাম। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। কাঁথা গায়ে আছে আমার। অজান্তে হাতটা ঠোঁটের ওপর চলে গেল। চুমু খেয়েছিল না ও আমাকে?
কিন্তু দরজা তো ভেতর থেকে লক করা থাকে, ও ঢুকবে কীভাবে?
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে অন্ধকারের মাঝেই বসে রইলাম। ইনতিসার, ইনতিসার,ইনতিসার।
তুমি আসলে কি? বাস্তব নাকি কল্পনা?

চলবে,
sinin tasnim sara

ভালোবাসার রংধনু

________
(৭)

অতীত_
প্রথমদিন ইনতিসারের নামঘটিত অপমানের পর ওকে ভীষণভাবে এভয়েড করতে চাইলাম। কিন্তু আমি চাইলে কি হবে? মানুষরূপী সেই ভূতটা কি চাইতো! কোনো না কোনো ছুতোয় প্রতিদিন প্রকট হয়ে যেত আমার সামনে । মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো ও ইচ্ছে করে আমাকে খোঁচানোর জন্য এভাবে ভূতের মত প্রকট হয়। আমার সবকিছুতেই ওর সমস্যা। আমার গায়ের রঙ ওর কাছে কুষ্ঠ রোগীর মত মনে হয়, উচ্চতায় আমি নাকি বাংলাদেশের সবচাইতে খাটো মেয়ে। অথচ ক্লাসে সবার চাইতে লম্বা মেয়েটা ছিলাম আমি। পাঁচ ফিট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির মতো আমার উচ্চতা। চোখের পাওয়ার কম চশমা পরি, এতেও ওর সমস্যা। চারচোখের মানুষ দেখলে নাকি ওর দিন খারাপ যায়। এসব শুনলে কারোর মাথা ঠান্ডা থাকার কথা? এগুলো কেমন অদ্ভুত সমস্যা আমি একদম বুঝে উঠতে পারতাম না৷
ও আমাকে দেখলেই হেঁড়ে গলায় ডেকে উঠতো,
— এই গ্লুমি ওয়েদার আজ আষাঢ়ের প্লাবন ঝরাবা কীভাবে? নাক দিয়ে নাকি চোখ দিয়ে? দেখি আসো তো তোমার নাক-চোখ সিল করে দেই।
বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমি চোখ পাকিয়ে তাকাতাম ওর দিকে। মনে মনে শক্ত একটা গালি দিলেও গায়ের ঝাঁঝ কমতো না।
শরীর সুস্থ হলে ও কোচিংএ ভর্তি হলো। ভাবলাম এখন এর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু নাহ্ আমার কপালে তো শনির প্রভাব। দেখা গেল ওর আর আমার কোচিং প্রায় এক জায়গাতেই, পাঁচ মিনিটের পথ। তবে ক্লাস টাইম আলাদা। ওর ক্লাস মর্নিং শিফটে আমার ছিল ইভিনিং শিফটে। দু শিফটে হলে কি হবে! আমার সব খোঁজখবর নিচ্ছে, আলাভোলা চেহারার আড়ালে আমি মিচকে শয়তান। কি কি বদমায়েশি করে বেড়ায় সব খবর ও নেবে। এই বলে বলে শাঁসাতো।
আমি তো তখন নিউ টেন। পড়ার বেশি চাপ নিতে হতো না। কখনও কোচিংয়ে যেতাম কখনও যেতাম না। আপা এ নিয়ে কখনও কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু ইনতিসার খোঁজ নেয়ার বাহানায় যখন এ কথা শুনলো তখন তার নতুন সমস্যা শুরু হলো৷ আমি কোচিংএ কেন যাইনা এ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই । সবার সামনে তো কথাই বলতো না আমার সাথে কিন্তু একা পেলে হয়েছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এক কথা বলবে,
“অপচয়কারী মেয়ে একটা। কোচিং-এ ভর্তি হয়ে আবার ক্লাস করেনা। আমার ভাইয়ের টাকা বেশি হয়েছে না? বাড়ি বসে থাকবা তুমি আর মাসে মাসে কোচিং-এ টাকা ঢালবে আমার ভাই”
টাকার খোঁটা খুব গায়ে লাগতো আমার। বিরাট একটা ধমক দিয়ে বলতে ইচ্ছে করতো,
“এই বেয়াদব ছেলে যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস কোন সাহসে? তোর ভাইয়ের টাকা নষ্ট করতে আমার বয়েই গেছে। লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ আমার বাবা’র টাকায় চলে। বাবার সম্পত্তি যা চলে গেছিল সব পুনরুদ্ধার করেছে আপা। সেই সম্পত্তি বিক্রি করে আমার নামে সঞ্চয় করেছে, ওখানে এত বেশি টাকা আছে যে চার পুরুষ বসে খেতে পারবে সেই টাকা। তোদের বাসায় থাকি আর খাই বলে সব তোদের টাকায়ই করি তা মনে করবি তুই?”
কিন্তু বলতে পারতাম না। কত আদরের ছেলে সে। তার হাতেও তো কিছুমিছু ক্ষমতা আছে। ভুলভাল কিছু করলে নালিশ করে যদি আমায় বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন কি করবো? অসহায় আমি’র আপা ছাড়া আর কে আছে?
এই চিন্তা করে চুপচাপ হজম করতাম ইনতিসারের কথা।
আমাকে চুপচাপ দেখে ওর বাড়াবাড়ি ভীষণ রকমভাবে বেড়ে গেল । ও করল কি একদিন দুপুরের খাওয়ার সময় বাড়িভর্তি লোকের সামনে আমার কোচিংয়ে না যাওয়ার কথাটা তুলল, যেটা ওর ভাষায় কোচিং ফাঁকি। খুব কনসার্ন দেখিয়ে বলল,
— মেজো ভাবি তোমার বোন দেখি ঠিকঠাক কোচিং করেনা, স্কুলেও তো শুধু পরীক্ষা দিয়ে আসে। তার সামনে পেছনে তুমি ছাড়া তো কোনো গার্ডিয়ান নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ওকে। এভাবে লেখাপড়া ফাঁকি দিলে কি তা সম্ভব?
মাউইমা অবশ্য ওর কথা ধরেছিলেন। কথার পৃষ্ঠে বলেছিলেন,
— তুই নিজে ঠিকঠাকমতো পড়াশোনা করিস তো বাবা? মানুষের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকটা আগে দেখ।
— আমি রেগুলার স্টুডেন্ট না হলেও উত্তরোত্তর ভালো রেজাল্টই দিয়ে গেছি মা। কখনো রেজাল্ট খারাপ হয়নি আমার।
— তুই যেমন নিজ উদ্যোগে পড়েছিস নীরদও পড়ে। সারাদিন ঘরে দরজা আটকে পড়ে। সে ওসব কোচিং ফোচিং না করলেও ভালো রেজাল্ট করবে।
— শোনো মা আমি কখনোই নিজ উদ্যোগে পড়িনি। যা পড়েছি তা ঐ পরীক্ষা আগের রাতেই। সে তো ব্রেইন ভালো ছিলো বলে কখনো আটকাইনি। সবার কি এমন জিনিয়াস ব্রেইন থাকে?
সাইন্সে অনেক পড়া। কোনো প্রকার ক্লাস ছাড়া, টিউশন ছাড়া, কোচিং ছাড়া একা একা সব কভার করা পসিবল? সারাদিন ঘরে দরজা আটকে পড়ার ভান ধরলেই তো হবেনা। ঠিকঠাক পড়ছে কি না এটা জানা প্রয়োজন।
— ইনতিসার তো ঠিকই বলেছে। নীরদ এত অলসতা শুরু করেছে কেন তাই তো বুঝতে পারছি না। প্রতিমাসে কোচিংয়ের পেছনে কত টাকা খরচ হচ্ছে! ক্লাস না করলে এত টাকা খরচ করে লাভ কি?
দুলাভাইও সম্মতি দেন ইনতিসারের কথায়। এবার আর আপাকে পায় কে? ওদের দু ভাইয়ের যুক্তি শুনে আপার আমাকেই দোষী মনে হলো। একদফা বকাঝকা করে সে আল্টিমেটাম দিয়ে দিল একদিন ক্লাস কামাই করলে খবর আছে আমার। তবুও তার মন শান্তি পেলো না। পরদিন নিজে কোচিং নিয়ে গিয়ে স্যারদের বলে এলো কোচিং কামাই করলে সাথেসাথেই যেন আপাকে ইনফর্ম করা হয়।
পড়ালেখার চাপ কখনোই আমার কাছে বিরক্তিকর ছিল না। কিন্তু ইনতিসারের কারণে এতগুলো বকা খেলাম, নিজ পরিকল্পনা সব মাটি হয়ে গেল। এ নিয়ে ওর ওপর রাগ বেড়ে গেল। মনে মনে ওকে হাজারখানেক পঁচা গালি আর অভিশাপ দিতে শুরু করলাম। এডমিশানে কোনো পছন্দের ইউনিভার্সিটি পাবে না ও। এটাই আমার অভিশাপ।

কোচিং যেহেতু ইভিনিং শিফটে ছিল তাই ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা-ন’টা বেজে যেত। মাউইমা গাড়ি দিতে চাইলেও আমি না করেছিলাম। পরে আপা একটা রিকশা রিজার্ভ করে দিল। সেটা শুধু আমাকেই নিয়ে যাওয়া-আসা করবে। মোটামুটি একসপ্তাহ সেই নিয়ম মেনে চললাম। এক সপ্তাহ পর থেকে হঠাৎ কোচিং ছুটির সময় করে ইনতিসারের আগমন । প্রথমদিন এসেই সে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করলো। শুনে সেদিন আর রাগ সামলাতে পারিনি। একটা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— রিকশাওয়ালাকে বিদায় করলেন কেন? পারমিশন কে দিয়েছে আপনাকে?
— ইনতিসারের কখনো পারমিশন লাগেনা। আমার ইচ্ছে হয়েছে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করেছি।
পকেটে দু-হাত ভরে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল ও। আমি পারছিলাম না শুধু চেঁচাতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— সব আপনার ইচ্ছেমত হবে? রিকশাওয়ালাকে বিদায় করেছেন এখন আমি যাওয়া-আসা করবো কীভাবে?
সে চোখ সরু করে বলল,
— কেন অন্য গাড়ি-ঘোড়া নেই? আমার সাথে একটা বাইক আছে এটা চোখে পড়েনা? আমাকে চোখে পড়েনা? আমি নিতে এসেছি তোমাকে। তুমি আমার সাথে যাবা।
— আমি কখনোই যাব না আপনার সাথে।
এবারে পাল্টা ধমকে উঠলো ও,
— এ্যাই মেয়ে। গলা নামিয়ে কথা বলো। খবরদার জোর গলায় কথা বলবা না আমার সাথে। আর যাবেনা মানে কি? আমি বলেছি যেহেতু অবশ্যই যাবা। অবাধ্যতা একদম পছন্দ না আমার। চলো?
ব্যাগ টেনে ধরলো আমার। আমিও ত্যাড়ামি করলাম বেশি করে। ব্যাগ টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে হনহন করে হাঁটা ধরলাম। ও পিছু আসার আগেই একটা সিএনজি করে বসে পড়লাম ওতে। তারপর সোজা বাড়ি। বাড়িতে সচরাচর আমাকে ধমক দেয়ার সুযোগ পেত না শুধু খোঁচা মেরে কথা বলতো। কিন্তু বাইরে গেলে বাঘ।
আমিও থোড়াই পরোয়া করি ঐ বাঘকে!
একদিন অপমানিত হয়ে ওর শিক্ষা হলোনা। পরদিন আবার এলো। আমি চোখ সরু করে তাকাতেই বলল,
— গতদিন ওরকম বেয়াদবি করলা আমি মাইন্ড করিনি। উঠতি বয়স ছেলেমেয়েদের রক্ত গরম থাকবেই। আমারও ছিলো।
ওর কথা শুনে কেবল বিরক্তি প্রকাশ করে পুনরায় ওকে ইগনোর করে একা একাই বাড়ি ফিরে এলাম। ভাবলাম নাহ্ এরপর আর আসবে না।
কিন্তু এই বান্দার ভেতর যে অপমানবোধ জিনিসটা একদম কম কম সে কি আমি জানতাম! পরদিন, তারপর দিন,তারপর দিন;প্রতিদিন ইগনোরেন্স সহ্য করেও ও আসতে লাগল। প্রথম দেখায় ওকে যে দাম্ভিক মনে হয়েছিল, এসব কাজকারবার দেখে সেই দাম্ভিকতার চিত্র সরে গিয়ে তার জায়গায় ছ্যাঁচড়া ভেবে নিলাম ওকে। এবং এই ছ্যাঁচড়া ছেলেটার ছায়াও অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল আমার কাছে।
আমি ভাবছিলাম ও চুপচাপ হজম করবে এসব। কিন্তু না ভেতরে ভেতরে ওর ধৈর্যের বাঁধনও যে টান টান হয়ে ছিঁড়ে যাবার দশা হচ্ছিল এ খবর তো আর আমি পাইনি।

ফজরের আজান পড়তেই ঘরের লাইট জ্বলে উঠল। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল তাহলে? দেয়াল ঘড়িতে দেখলাম ভোর চারটা বেজে পনেরো।
উফফ্ মাথার যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছে আর কিছু ভাবতে পারছি না। চুলগুলো কোনোরকমে বেঁধে শুয়ে পড়লাম কাঁথা আঁকড়ে। ইনতিসারের বদলে যাওয়ার পেছনে আমি কোনোভাবে দায়ী নই, কোনোভাবেই না। তাই এসব অতীতের চিন্তা কিংবা অপরাধবোধের কোনো মানে হয়না৷
________
(৮)
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি শিয়রের কাছে আপা বসে। আমায় জাগ্রত দেখে শুধলো,
— কাল জ্বর এসেছিল। ডাকলিনা কেন?
আমি উঠে বসতে বসতে বললাম,
— ভেবেছিলাম ঔষধ তো খেয়েছি,ঘুমলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সারাদিন ব্যস্ত ছিলে। অত রাতে আর ডিস্টার্ব করতে চাইনি।
— ভোরবেলা এসে দেখি জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছিস।
— জলপট্টি দিয়ে দিয়েছিলে তুমি?
— হু।
— কিন্তু আপা দরজা তো ভেতর থেকে লক ছিল। ঢুকলে কীভাবে?
— কই? লক ছিলো না তো।
— কিন্তু আমি যে লক করে শুয়েছিলাম।
— অসুস্থতার কারণে হয়তোবা লক করতে ভুলে গিয়েছিলি, অভ্যাসবশত মনে হয়েছে লক করেছিস।
— আসলেই কি!
— তাছাড়া কীভাবে খোলা থাকবে?
আপার কথায় এবার দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। ঠিক ঠিক দরজা লক করিনি কাল? তাহলে ইনতিসার এলো, সেবাযত্ন করলো আমার, আবার চুমুও খেলো। এসবই কি ভুল ধারণা? স্বপ্নের মত অলিক কল্পনা? হবে হয়তো। তবে কাঁথা তো আর এমনি এমনি আসেনি। নাকি শীত করছিল বলে আমিই নিয়েছি? বুঝতে পারছি না কিছু।
আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে আপা জিজ্ঞেস করলো,
— কি ভাবছিস?
— হু? না কিছুনা। তুমি এখানে কাজ ফেলে বসে আছো কেন? মানুষ কি বলবে!
— মানুষের কথা গায়ে মেখে লাভ আছে রে মা? মানুষ কি তিনবেলা খাবার দেয়? নাকি খারাপ সময়ে দু কথার সহানুভূতি দেখায়? নিজের প্রয়োজনের সামনে ওসব কিছুই না।
মাউইমার গলা শুনে দরজার দিকে তাকালাম। খাবারের প্লেট হাতে হাসিমুখে ভেতরে প্রবেশ করলেন উনি। ওনার কাজই কি আমাকে প্রত্যেকবেলা এমন যত্ন করে খাওয়ানো?
মুচকি হেসে বললাম,
— আরেহ্ মাউইমা আসুন।
— ঘুম থেকে উঠলে কখন?
— মাত্রই।
— দেখি জ্বরটা আর আছে কি না?
প্লেট রেখে আমার দিকে এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে নিলেন। তারপর আপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— বউমা ওর ঔষধগুলো বের করে দিয়ে তুমি যাও। ইশি খুঁজছে তোমাকে। নীরকে খাবারদাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেবো আমি।
আপা মাউইমার কথায় সম্মতি দিয়ে ঔষধগুলো বের করে দিয়ে চলে গেল। আপার চোখমুখে এক অদ্ভুত শীতলতা। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ওর। সেটা কি আমি ঘটিত?
বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম । সময়টাও কাটছে না দ্রুত। কেন যে আপার কথা শুনে এই বাসায় থেকে গেলাম! ভুলই হয়েছে ।
,
আপার প্রস্থানের পর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাবারটা খেয়ে নিলাম। এই ফাঁকে মাউইমার তার ছেলেবেলাকার গল্প শোনালেন। তিনিও আমার মতো চুপচাপ ধরনের ছিলেন। এ বাড়িতে বিয়ে করে আসেন অনেক কম বয়সে। স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি তখন। আসলে ওনার আব্বা পছন্দ করতেন না মেয়েদের পড়াশোনা। ওনার মতে মেয়ে মানুষের জন্মই সংসারধর্ম পালনের জন্য। মাউইমারা তিনবোন। তিনবোনেরই বিয়ে হয় পনেরো-ষোলো বছর বয়সে। বিয়ের পরপর বাকি লেখাপড়াটা ওনার পক্ষে সম্ভব হলেও বাকি দুবোনের ক্ষেত্রে হয়নি । মাউইমার ক্ষেত্রে ক্রেডিট অবশ্যই আঙ্কেলের।
মাউইমার সাথে তার মতের অনেক পার্থক্য থাকলেও লেখাপড়া কিংবা চাকরি-বাকরি এসবে কখনোই বাঁধা প্রদান করেননি তিনি। স্ত্রী’র ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ পছন্দ নয় ওনার । এদিক দিয়ে মাউইমা নিজেকে খুব লাকি মনে করেন।
আজকের সফলতা অর্জনের পথে এমন অনেক সিচুয়েশন এসেছিল শুধুমাত্র লোকের কথায় কান দিতে গিয়ে মাউইমার মনে হয়েছে তার দ্বারা কিছু সম্ভব না। সেই সময়গুলোতে আঙ্কেল তাকে সামলেছেন, বুঝিয়েছেন মানুষ তো কত কথাই বলবে। সব কথায় কান দিয়ে জীবন থামিয়ে রাখা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমার খনিক পূর্বের কথাকে ভিত্তি করেই যে মাউইমা গল্পটা শোনালেন তা বুঝতে সমস্যা হলোনা। উনিও হয়তোবা বুঝতে পেরেছেন আমি ওনার গল্পের উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছি। মুচকি হেসে বললেন,
— একটা কথা মাথায় রাখবে নীরদ কে কি ভাববে, কে কি বলবে এসব চিন্তা করে কখনো কোনো কাজে নিজেকে বাঁধা দেবেনা। তোমার নিজের মন যেখানে সায় দেয় সেটাই করবে। মনের কথা শুনলে জীবনে কখনো ঠকবে না। বুঝতে পেরেছ?
— বুঝেছি মাউইমা। কিন্তু আমি অনেক ভীতু একটা মেয়ে। কোনো কাজ করবার আগে আশেপাশের মানুষের থেকে ফিডব্যাক কেমন আসতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করি। সেই চিন্তার বেশিরভাগটা জুড়ে থাকে নেগেটিভিটি।
— এই চিন্তাটাই তো তোমায় সবক্ষেত্রে দমিয়ে রাখে। যদি ভালো থাকতে চাও তাহলে চিন্তা করাটা বাদ দিতে হবে। মন বলছে এটা করা উচিৎ, করে ফেলবে। চিন্তায় যাবেনা। অতিরিক্ত চিন্তা মানুষের কনফিডেন্স কমিয়ে দেয়।
আর অতিরিক্ত চিন্তা করবে না মনে থাকবে?
— থাকবে।
— ভেরি গুড। এখন কাপড় পাল্টে বাইরে এসো তো।সবাই কত মজা করছে,তুমি এমন ঘরে বন্দী থাকবে? এখন তো একটু সুস্থ হয়েছ। বাইরে আসলে সবার মাঝে ভালো লাগবে ।
— কিন্তু আমার এই ব্যান্ডেজ।
নাকের দিকে ইশারা করলাম।
— এটাতে কি সমস্যা? কেউ কিচ্ছু বলবে না। ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ একদম তোমার সৌন্দর্যকে ফিঁকে করতে পারেনি। আর মাফিনটাও একা একা ঘুরছে ওখানে। ওর বয়েসি কেউ নেই আজ। ওকে কোলে নিয়েই না-হয় বসে থাকবে। আবার তোমার ইনতিসার ভাইয়া ফটোশুট করছে বোনের। খুব ভালো ফটোগ্রাফার আমার ছেলে। ওর থেকে কিছু ছবি তুলে নেবে চলো।

যা একটু উঠতাম মাউইমার মুখে ইনতিসারের নাম শুনে আমার পা দুটো অটোম্যাটিক্যালি বরফে পরিণত হয়ে গেল।
— কি ওঠো? গতবার ইদে মেজো বউমা যে ওশন কালারের থ্রিপিসটা কিনে দিল? ওইটা পরো। তোমাকে দারুণ মানায় রঙটা।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম,
— হ্যাঁ উঠছি।
— জলদি এসো কিন্তু।
তাড়া দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মাউইমা। আমি থমথমে মুখে বসে ভাবতে লাগলাম,
গতকাল আমার নাক ফাটিয়েছে, আজ সামনে গেলে কি রাগের চোটে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে?

চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here